গরীবের বৌ-ছেলেমেয়ে ও কাল্লে গাগ

গরীবের বৌ-ছেলেমেয়ে ও কাল্লে গাগ

এক লোক ছিল বেশ গরিব। সে অনেক অনেক দিন আগের কথা। তার ছিল তিন সন্তান আর বৌ নিয়ে সুন্দর সংসার। সহায় সম্বল বলতে ছিল কেবল একটি গরু। একদিন লোকটি তার গরুটাকে জবাই করলো এবং নাড়িভুঁড়ি বের করে আনলো। যখন নাড়িভুঁড়ি পরিষ্কার করছিল ভয় পেয়ে গেল লোকটি। আতঙ্কে ভুঁড়িটাকে ছিদ্র ছিদ্র করে ফেললো। যখন দেখলো ভুঁড়িটা আর ব্যবহার উপযোগী নেই, তার মাথায় একটা চিন্তা এলো। ভুঁড়ি তার স্ত্রীর হাতে দিয়ে বললো: পানির নালায় গিয়ে এটা ভর্তি করে পানি নিয়ে আসো। পানি ভর্তি করতে না পারলে আর ফিরে এসো না।

তার নিরীহ স্ত্রী তো কিছুই জানতো না। সে স্বামীর কথামতো চলে গেল ভুঁড়ি ভরে পানি আনতে। কিন্তু ভুঁড়ি যতোই পানিতে ডুবিয়ে ভর্তি করতে চাইলো, হলো না। পানি থাকেই না, পড়ে যায় সব। বেচারি ক্লান্ত হয়ে গেল। খালি ভুঁড়ি নিয়েই অবশেষে বাসায় ফিরে গেল সে। গিয়ে দেখে ঘরের দরোজা বন্ধ। দরোজায় ঠক ঠক করে আঘাত করে বললো: দরোজা বন্ধ করেছো কেন? তার স্বামী বললো: পানি এনেছো নাকি আনো নি? স্ত্রী বললো: তুমি ভুঁড়িটাকে শতছিদ্র করে রেখেছো, ওর ভেতর পানি থাকে নাকি! স্বামীও দরোজা আর খুললো না, বললো: যাও নিজের কাজে যাও। বলেছি না! ভুঁড়ি ভর্তি করে পানি আনতে না পারলে বাসায় এসো না!

মহিলা তার স্বামীকে ভালো করেই জানতো যে এই লোক কখনো তার কথার অন্যথা করবে না। তাই সে ফিরে গেল। কিন্তু দেখলো বরফ পড়ছে। ভীষণ ঠাণ্ডা বাইরে। এই আবহাওয়ায় সামনে এগুলো নির্ঘাত বরফ হয়ে যাবে নিজেই। তাড়াতাড়ি করে ভুঁড়িটাকে মাঝখান থেকে দুই টুকরা করলো। সেগুলো দুই পায়ের নীচে বেঁধে হাঁটতে লাগলো। যেতে যেতে পৌঁছলো এক পাহাড়ের কাছে। সেখানে দেখলো ধোঁয়ার চিকন একটা কুণ্ডলী থেকে থেকে বের হচ্ছে এবং বাতাসে মিলিয়ে যাচ্ছে। মহিলা ওই ধোঁয়ার উৎসের খোঁজে হাঁটতে শুরু করলো। যেতে যেতে চমৎকার একটা গুহায় গিয়ে পৌঁছলো। কিন্তু এতো সুন্দর এবং পরিপাটি যে একেবারেই গুহা বলে মনে হচ্ছে না। বাসা বাড়ির মতো মনে হচ্ছিলো তার।

মহিলা ভেতরে গেল। চারপাশে ভালো করে দেখে নিলো কোথায় কী আছে বা কে আছে। কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলো না অথচ পাতিলভর্তি মাংস দেখতে পেল চুলার ওপর পাকানো হচ্ছে। ঠাণ্ডায় জমে যাচ্ছিলো সে, তাই চুলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। কিছুক্ষণ পরই তার ক্লান্তি এবং ঠাণ্ডা ভাব চলে গেল। চুলার ওপর থেকে চামুচে করে একটু পানি মুখে দিলো সে। মনে মনে ভাবছিল এই গুহার মালিক কে? যতোই এদিকে সেদিক তাকালো কাউকেই দেখতে পেলো না। তবে গুহার শেষ প্রান্তে একটা হ্রদ তার নজরে এলো। নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা করলো মহিলা।

দিন গড়িয়ে সন্ধ্যার দিকে যাচ্ছিলো। মহিলা ভাবলো রাতের বেলা নিশ্চয়ই গুহার মালিকের দেখা পাওয়া যাবে, দিনের বেলা হয়তো কাজে কর্মে গেছে কোথাও। সে নিজেকে ভালো করে লুকানোর চেষ্টা করলো। এমন এক জায়গা বেছে নিলো যেখানে লুকালে একদম দেখা যাবে না। মহিলা দেখতে চাচ্ছিলো কে বা কারা এই গুহায় বাস করে। হঠাৎ কানে ভেসে আসতে লাগলো: ‘উটেরা হায় হায়…. ঘোড়ার পাল হায় হায়…… মেষের দল হায় হায়….. গরুর পাল হায় হায়….’ শব্দ যেদিক থেকে আসছিল সেদিকে তাকিয়ে দেখলো এক পাল পশু এগিয়ে আসছে গুহার দিকে।

একটা সময় গুহায় ফিরে এলো এবং যে যার জায়গায় চলে গেল। কিন্তু পশুগুলোর সাথে কাউকেই দেখা গেল না। অবাক হয়ে গেল মহিলা। একটু পরে দেখা গেল ছোট্ট একটি মানুষ চিরুনির সমান হবে, বসে আছে একটি ছাগলের শিঙে। ওই ছাগল ধীরে ধীরে আসছে গুহার দিকে। গুহামুখে আসার পর ছোট্ট মানুষটি ছাগলের শিঙ থেকে নীচে নেমে এলো। চামড়ার একটা বিছানা বিছিয়ে বসলো এবং দেয়ালে হেলান দিলো। হঠাৎ আশপাশে দেখে বললো: কেমন যেন মানব গন্ধ পাচ্ছি, মানবগন্ধ…। এই বলে নাক দিয়ে গন্ধ শুঁকলো। কাউকে খুঁজে না পেলেও সে নিশ্চিত যে গুহায় কোনো মানুষ আছে। চীৎকার করে বললো: ‘যে-ই আছো গুহার ভেতরে, মানুষ হও, জিন হও, দৈত্য হও কিংবা পরী বেরিয়ে আসো লুকিয়ে থেকো না। সোলায়মান নবীর কসম, তোমাকে কিছু করবো না। বেরিয়ে আসো’!

মহিলা এবার অন্ধকার স্থান থেকে বেরিয়ে এসে বললো: আমি মানুষ। তোমার ঘরে আমার কোনো কাজও নেই। এই পাহাড়ের ভেতর আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। তাই ঠাণ্ডা থেকে মুক্তি পাবার জন্য একটু আশ্রয় নিয়েছি এখানে। ছোট্ট মানুষটির নাম হলো কাল্লে গাগ। তার মাথা মুণ্ডানো ছিল ডিমের মতো। সে মহিলাকে বললো: তুমি আমার মায়ের মতো। আমিও তোমার সন্তানের মতো। আমার কেউ নেই। তাই তুমি এখানেই থাকো। আমি দিনের বেলা চলে যাই রাখালবৃত্তিতে। ঘর খালিই থাকে। তুমি ঘরটা একটু পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করে রাখবে আর খাবার দাবারের ব্যবস্থা করবে। সব মিলিয়ে বাসা দেখভাল করবে।

কাল্লে গাগের প্রস্তাবে মহিলা বেশ খুশি হয়ে গেল। সে মেনে নিল। তারপর থেকে কাল্লে গাগ দিনের বেলা চলে যায় মেষ চরাতে। পাতিলে মাংস দিয়ে চুলা জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যায় সে। দায়িত্ব দিয়ে যায় মহিলার ওপর। সন্ধ্যায় যখন ফিরতো বাসায়, ততক্ষণে মাংস বেশ সুন্দর সিদ্ধ হয়ে যেত। সেগুলো রান্না করে দু’জনেই খেত। এভাবেই কেটে যাচ্ছিলো দিনরাত।

একদিন হঠাৎ মহিলার মনে পড়ে গেল তার নিজের সংসারের কথা, ছেলেপুলের কথা। বাচ্চাদের জন্য তার মন পুড়ছিল। কাল্লে গাগকে সে বললো: আমার ঘর আছে। ছেলেপুলে আছে। তাদেরকে দেখতে যেতে ইচ্ছে করছে। কাল্লে গাগ বললো: ঠিক আছে। দেখে আসো! মহিলা কিছু মাংস ও অন্যান্য খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়লো নিজের বাসার উদ্দেশ্যে।#

গরীবের বৌ-ছেলেমেয়ে ও কাল্লে গাগ(২)

(২য় পর্ব) মহিলা বাসায় ফিরে দেখলো ঘরের দরোজা বন্ধ। বাড়ির ছাদে উঠে দেখলো তার স্বামী আর ছেলেরা খাবারের অভাবে এতোই কাহিল বা জবুথবু হয়ে পড়েছে যে নড়াচড়া করার শক্তিও তারা হারিয়ে ফেলেছে। যে গরুটা জবাই করেছিল তার গোশত শেষ হয়ে গেছে। এখন ঘরে খাদ্যবস্তু বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। না খেতে পেয়ে পেটের প্রচণ্ড জ্বালায় দুর্বল হয়ে পড়া তার সন্তানেরা এখন মৃত্যুর মুখে। মহিলা তার সন্তানদের দিকে তাকিয়ে দেখছিল। এমন সময় ছোট্ট ছেলে বলে উঠলো: হে খোদা! আমাকে খাবার দাও…! মহিলা সামান্য গোশত তার জন্য ফেললো। দ্বিতীয় ছেলে ওই গোশত দেখে মাথা উঠিয়ে বললো: হে খোদা! আমাকেও খাবার দাও…! মহিলা সামান্য গোশত তার জন্যও ফেললো। তৃতীয় সন্তান যখন দেখলো দু’ ভাইয়ের দোয়াই কবুল হয়েছে, সেও বললো: হে খোদা! আমাকেও খাবার দাও…! মহিলা সামান্য গোশত তার তৃতীয় সন্তানের জন্যও ফেললো।

এ অবস্থা দেখে মহিলার স্বামীও আল্লাহর কাছে খাবার চাইলো। মহিলা তখন ছাদের ওপর থেকে একটা ভারি ইট ছুঁড়ে মারলো। স্বামী বললো: এরকম রুযি চাচ্ছি না। অন্যদের মতো খাবার আমাকেও দাও। মহিলা এবার তার সন্তানদের বললো: দরোজা খোলো! বাচ্চারা তাদের মায়ের কণ্ঠ শুনে ভীষণ খুশি হয়ে গেল এবং তাড়াতাড়ি করে দরোজা খুলে দিলো। মহিলা ঘরে ঢুকলো। তার স্বামীর দিকে তাকিয়ে সে বললো: আমাকে বাসা থেকে বের করে দিয়ে আস্ত একটা গরুর সমস্ত গোশত একা একাই তো খেলে, তাই না? পুরোটা শীতকাল পেরিয়ে গেছে। গরুর মাংসও শেষ হয়ে গেছে। কিন্তু আমি মরে যাই নি।

স্বামী জিজ্ঞেস করলো: তোমার দিনকাল কেমন কাটছে? মহিলা বললো: বাসাবাড়ি ভালোই পেয়েছি, ভালোভাবেই জীবন কাটছে। তোমার জিনিসপত্র গুটিয়ে নাও, চলো সবাই একসাথে সেখানে যাবো।

মহিলা সমস্ত জিনিসপত্র তার স্বামীর ঘাড়ে চাপালো আর বাচ্চাদের হাত ধরে তাদের নিয়ে চললো গুহার দিকে। যেতে যেতে এক সময় গিয়ে পৌঁছলো গুহায়। গুহা দেখে সবাই অবাক। যা যা দরকার সবই আছে ওই গুহায়। চুলার ওপরেও বিশাল একটা পাতিল বসানো। মাংস পাক হচ্ছে ওই পাতিলে। সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। ছোট্ট রাখাল তার মেষ পাল নিয়ে ফিরে এলো গুহায়। সবাই দেখলো মেষ, দুম্বা, উট, ছাগল, গরু যে যার মতো যার যার খোঁয়াড় বা গোয়ালে চলে গেল। আর রাখাল ছাগলের শিঙে চড়েই গুহার ভেতরে ঢুকলো। গুহায় মহিলার স্বামী ছেলে সন্তানদের দেখে ছাগলের শিঙ থেকে দ্রুত নেমে এলো নীচে। সবাইকে স্বাগত জানালো।

রাখাল লোকটি ছিল বেশ মহানুভব। সে মহিলার স্বামীকে নিজের পিতার মতো সম্মান দিলো আর তাদের সন্তানদের নিজের ভাইয়ের মতো আপন করে নিলো। ছেলেদেরকে প্রতিদিন সে তার সঙ্গে নিয়ে যেত চারণভূমিতে। স্বামী স্ত্রী গুহাতেই থাকতো। তারা দু’জন মিলে গুহাকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করতো। এভাবেই কাটছিল তাদের দিনকাল। মোটামুটি সবাই মিলে সুন্দরভাবেই বসবাস করছিল। একদিন রাখাল চারণভূমি থেকে ফিরে এসে বাবাকে বললো: তুমি বাদশার দরবারে যাও! বাদশার কন্যার সাথে আমার বিয়ের প্রস্তাব দাও! বাবা কিছুই বললো না। মনে মনে ভাবলো এই ময়লা পোশাক-আশাক নিয়ে কী করে বাদশার দরবারে যাবে। আর এক বিঘৎ সমান একটা ছেলের জন্য কী করে বাদশার মেয়ের মতো সুন্দরী শাহজাদির বিয়ের প্রস্তাব দেবে।

কিন্তু কিচ্ছু করার নেই। ছেলের দাবি, যেতেই হবে এবং কোমরে একটা শাল বেঁধে মাথায় রুমাল পরে রওনা হলো। শহরে পৌঁছে বাদশার প্রাসাদের ঠিকানাটা যার কাছেই জানতে চাইলো সে-ই হেসে উঠলো। কিন্তু সে কিছুতেই পিছ পা হলো না। প্রাসাদে গেলই সে। প্রাসাদের প্রহরীরা জিজ্ঞেস করলো: কী কাজ তোমার।

সে বললো: এসেছি বাদশার মেয়ের বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। প্রহরী হাসি-ঠাট্টা করলো এবং পরে ঢুকতে দিলো ঠিকই। কিন্তু তাকে পদে পদে বাধা দিতে লাগলো। বাদশা এ অবস্থা দেখে প্রহরীদের বললো: ওকে বাধা দিও না, আসতে দাও! বেচারা হয়তো ভিক্ষা চাইতে এসেছে। দরবারে তাকে কেউই তেমন একটা পাত্তা দিলো না। কিন্তু বাদশা তাকে তার পাশে বসার জন্য ইশারা করলো। সে বসলো বাদশার পাশে। সবাই এখন হিংসায় জ্বলে যেতে লাগলো।

বাদশার আগন্তুকের সাথে আলাপ করে যখন বুঝলো সে এসেছে তার ছেলের সাথে শাহজাদির বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে, প্রথমে ভাবলো এমন আচরণ করতে যাতে সবাই হাসে। কিন্তু তা না করে বাদশা বললো: এক শর্তে হতে পারে। শর্তটা হলো: ছেলের ঘর থেকে এই প্রাসাদ পর্যন্ত কালো হাঁটু বিশিষ্ট উটের লাইন থাকবে এবং প্রত্যেকটি উটের পিঠে থাকতে হবে স্বর্ণ রূপাভর্তি ভাণ্ডার। কাল্লেগাগের বাবা শর্ত মেনে নিলো এবং প্রাসাদ থেকে ফিরে গেল গুহায়। ছেলেকে বাদশার শর্তের কথা জানালো। ছেলে তা শুনে খুশি হয়ে বললো: এটা কোনো ব্যাপারই না। সে কালো জানুর উটের সারি জমা করলো। বস্তার ভেতর স্বর্ণ-রূপা ভরলো। সেগুলোকে উটের পিঠে রেখে প্রথম উটের লাগাম দিলো বাবার হাতে। নিজে ছাগলের শিঙে উঠে বসলো। উটের পিছে পিছে রওনা হলো প্রাসাদের দিকে।

উটের সারি পৌঁছে গেল প্রাসাদে, তখনো গুহার মুখ পর্যন্ত কালো জানুর উট শেষ হয় নি । এ অবস্থা দেখে বাদশার সেনারা বাদশাকে খবর দিলো। বাদশা তো শুনে অবাক হয়ে গেল। নিরুপায় হয়ে আদেশ দিলো ময়লা জামা পরা লোককে যেন প্রাসাদে ঢুকতে দেয়। কিন্তু লোকজন এতো এতো উট আর স্বর্ণ গয়না দেখে বিস্মিত হয়ে গেল। তারা নিজেদের আঙুল কামড়াতে শুরু করলো। গুনগুন করে বলতে লাগলো: ছেঁড়া আর ময়লা জামা পরা একটা লোকের পক্ষে এতো মালামাল এনে হাজির করা কী করে সম্ভব।#

গরীবের বৌ-ছেলেমেয়ে ও কাল্লে গাগ (৩)

(৩য় পর্ব) মহিলাকে তার স্বামী ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলো সে একটা গুহায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছিলো। ওই গুহায় বাস করতো ছোট্ট একজন মানুষ।বিশাল মেষের পাল চরাতো সে। প্রতিদিন একটি করে মেষ জবাই করে চুলায় চড়িয়ে দিয়ে চলে যেতো চারণভূমিতে। মহিলাকে সে মায়ের মতো গ্রহণ করলো। কিছুদিন পর ওই মহিলা তার স্বামী এবং ছেলেদেরও নিয়ে এলো গুহায়। ছোট্ট মানুষটি তাদেরকে ভালোভাবেই গ্রহণ করলো।

একদিন ছোট্ট মানুষটি তার বাবাকে বললো বাদশার মেয়ের সাথে তার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে। বাবা প্রস্তাব নেয়ার পর বাদশা ঠাট্টা করে বলেছিল: এক শর্তে বিয়ে দিতে পারি। শর্তটা হলো: ছেলের ঘর থেকে এই প্রাসাদ পর্যন্ত কালো হাঁটু বিশিষ্ট উটের লাইন থাকবে এবং প্রত্যেকটি উটের পিঠে থাকতে হবে স্বর্ণ রূপাভর্তি ভাণ্ডার’। মজার ব্যাপার হলো এসবের আয়োজন করে বিয়ের জন্য বাবা তার ছেলেকে নিয়ে এলো প্রাসাদে। সবাই তো অবাক।

বাদশা আদেশ দিলো উটগুলোকে একত্রিত করার জন্য। একের পর এক উটগুলোকে টেনে নেয়ার পর দেখা গেল একটি ছাগলের শিঙে বসে আছে ছোট্ট একজন মানুষ। বাদশা তাকে ভালোভাবে দেখলো। কারণটা হলো এর আগে রাজা আর কখনো এতো ছোটো মানুষ দেখে নি। ওই ছোট্ট মানুষ মানে কাল্লেগাগ প্রাসাদে ঢুকে সালাম করলো। বাদশাও তাকে স্বাগত জানালো। কাল্লেগাগ চামড়ার তৈরি তার বিশেষ আসনটি বিছিয়ে তার ওপর বসলো। গরিব লোকটি অর্থাৎ কাল্লেগাগের বাবা বললো: এই ছেলের সাথেই শাহজাদির বিয়ের প্রস্তাব দিয়েছিলাম। বাদশা তো এ কথা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেল। কেননা সে তো এখন তার কথা ফেরাতে পারবে না। বাধ্য হয়ে কাল্লেগাগের সাথেই তার মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দিলো।

ঘটা করে বিয়ে হলো। পুরো শহরকে আলোকসজ্জায় সাজানো হলো। সাত দিন সাত রাত উৎসব করা হলো। উৎসব শেষে বাদশার মেয়েকে নিয়ে কাল্লেগাগ ছাগলের শিঙে চড়েই গুহায় ফিরে গেল। বাদশা যদিও কথায় আটকে গিয়ে মেয়েকে এভাবে বিয়ে দিলো কিন্তু মানসিক পেরেশানি গেল না। সেজন্য কনের পেছনে পেছনে লোক পাঠালো অবস্থাটা কী বা কোথায় যাচ্ছে তারা জেনে আসার জন্য। রাজার পেয়াদারা গুহায় ঢুকে দেখলো এতো গুহা নয়, বিরাট এক বাড়ি। সবকিছুই আছে ওই বাড়িতে। কোনো কিছুর অভাব নেই। যতো মানুষই এলো সবারই জায়গা হয়েছে ওই বাড়িতে। সকল অতিথিকেই আপ্যায়ন করা হয়েছে ঠিকঠাকমতো। কিন্তু কে তৈরি করলো এই খাবার বোঝা গেল না। বাদশার লোকেরা বহু তদন্ত করেও কাউকে দেখলো না। অবশেষে তারা ফিরে গেল বাদশার দরবারে।

বাদশা তো অপেক্ষা করছিল কখোন তার পেয়াদারা ফিরে আসে। কী খবর জানার কৌতূহল নিয়ে বাদশা ছটফট করছিল। পেয়াদারা ফিরে এসেই বাদশার কাছে গেল এবং যা যা হয়েছে আর যা কিছু তারা দেখেছে সব হুবহু বর্ণনা করলো। কথাবার্তা শেষে তারা বললো: জানি না কাল্লেগাগ মানুষ নাকি জিন। বাদশা দেখলো যা হবার তো হয়েই গেছে এখন তো কিছু করার নেই। এদিকে কাল্লেগাগ আর তার স্ত্রী ভালোভাবেই তাদের জীবন কাটাচ্ছে। কাল্লেগাগ প্রতিদিন তার পশুপাল নিয়ে চলে যায় চারণভূমিতে। শাহজাদি ঘর সামলায়। একদিন কাল্লেগাগ তার স্ত্রী বললো চারণভূমিতে যাবার পর সে যেন তার বিশেষ আসনের ব্যাপারে একটু সতর্ক থাকে। কোনোভাবেই যেন তাতে আগুন না লাগে। এই চামড়ার টুকরাটিতেই তার প্রাণবায়ু রয়েছে। এটা যদি পুড়ে যায় তাহলে তাকে আর দেখবে না কোনোদিন।

এ অবস্থায় তাকে লোহার জুতা পরতে হবে, লোহার লাঠি হাতে নিয়ে তাকে খুঁজতে বেরুতে হবে। জুতা যখন ক্ষয়ে ক্ষয়ে পাতলা সালুনির মতো হয়ে যাবে আর হাতের লাঠি হবে সুঁইয়ের সমান তখন তাকে খুঁজে পাবে। বাদশার মেয়ের হাতে একটা আংটি দিয়ে কাল্লেগাগ বললো যে এই আংটিটার বিশেষ গুণ রয়েছে। একদিন এই আংটি তার কাজে আসবে বলে জানালো। এক দুই বছর পেরিয়ে যাবার পর একদিন বাদশার মেয়ে নিজে নিজেই বললো: এই চামড়ার আসনটা আসলে কী! প্রতিদিন কাল্লেগাগ কেন এরকম গুরুত্বের সাথে দেখাশোনা করতে বলে যায়-যাতে না পোড়ে! সে মনে ভাবলো একদিন পরীক্ষা করে দেখবে।

শাহজাদি ওই চামড়ার আসনটি ছুঁড়ে মারলো চুল্লির আগুনের ভেতর। আসনে আগুন লাগতেই কাল্লেগাগ ছবির মতো হাজির হলো সামনে। চীৎকার করতে লাগলো সে: পুড়ে গেলাম! পুড়ে গেলাম বলে চীৎকার করতে লাগলো। এরপর শাহজাদির দিকে তাকিয়ে কাল্লেগাগ বললো: কেন করতে গেলে এ কাজ? আমি তো এখন অদৃশ্য হয়ে যাবো। এখন তোমাকে যেমনটি বলেছিলাম: লোহার জুতা পরতে আর লোহার লাঠি হাতে নিতে, তা-ই করতে হবে। আমাকে পাওয়া পর্যন্ত এ কাজ চালিয়ে যেতে হবে। শাহজাদি তার এ কাজের জন্য ভীষণ অনুতপ্ত হলো। নিজের প্রতি নিজের এতো রাগ হলো যে কী করবে বুঝে উঠতে পারছিল না। কামারের কাছে গেল এবং তার জন্য লোহার জুতা বানানোর আদেশ দিলো। একটি লোহার লাঠিও তৈরি করতে বললো।

লাঠি জুতা তৈরি হবার পর শাহজাদি সেগুলো ব্যবহার করে শুরু করলো কাল্লেগাগের সন্ধান। পাহাড় পর্বত, নদী, সমুদ্র আর মরুপ্রান্তর হেঁটে হেঁটে খুঁজতে লাগলো তার স্বামী কাল্লেগাগকে। এভাবে হাঁটতে হাঁটতে লোহার জুতা ক্ষয়ে যখন সালুনির মতো শতছিদ্র হয়ে গেল আর লাঠিটা হয়ে গেল সুঁইয়ের মতো, তখন সে পৌঁছলো এক শহরে। ওই শহরে সে কোনো মানুষকে দেখতে পেল না। পুরো শহরে ঘুরে বেড়ালো। দেখলো একটা কুপের পাশে কিছু লোক সমবেত হয়ে এক জনের গায়ে পানি ঢালছে। নে কেবলি বলছে ‘পুড়ে গেলাম পুড়ে গেলাম’। শাহজাদি মনে মনে বললো: এ-ই সেই কাল্লেগাগ নয় তো! তার মনে পড়ে গেল আংটিটার কথা যেটা দিয়ে কাল্লেগাগ বলেছিল এই আংটি একদিন তোমার কাজে আসবে। সে আংটিটা একটা গামলাভর্তি পানিতে ছুঁড়ে মারলো। তারপর ওই গামলার পানি নিয়ে পুড়ে যাওয়া লোকটার গায়ে ঢাললো।

লোকটা নীরব হয়ে গেল এবং একপাশে গিয়ে বসে পড়লো। শাহজাদি তার দিকে তাকাতেই চিনতে পারলো: এ-ই তার স্বামী কাল্লেগাগ। স্বামী তাকে বললো: দেখো কী করেছো। তোমাকে বলেছিলাম যে এই চামড়ার আসন আমার প্রাণ। কেন এটা পুড়তে গেলে? শাহজাদি ক্ষমা চাইলো। দুজনেই আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করে ফিরে গেল তাদের গুহায়। গিয়ে দেখলো বাবা-মা আর সন্তানেরা মিলে উট গরু ছাগল আর মেষগুলো চরাচ্ছে। কাল্লেগাগ আর তার স্ত্রীকে দেখে খুশি হয়ে তাদেরকে বরণ করে নিলো। কাল্লেগাগ তখন বললো: আমি এক পরীর সন্তান। রাগ করে আমি এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছি এবং ধীরে ধীরে এসব পশুর মালিক হয়েছি। সবাই আবারও আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলো এবং তারপর থেকে তারা সুখে শান্তিতে বসবাস করতে লাগলো।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত