মাহির ও পানির দৈত্য

মাহির ও পানির দৈত্য

অনেক অনেকদিন আগে, সেই প্রাচীনকালের এক দম্পতির ঘটনা। তারা স্বামী স্ত্রী ভালোভাবেই দিন কাটাচ্ছিল। কিন্তু তাদের দুটো জিনিসের অভাব ছিল। একটা হলো ধন-সম্পদ অপরটি হলো সন্তান। বিয়ের বহু বছর পরও তাদের সন্তান হচ্ছিল না। অনেক ডাক্তার কবিরাজ, অনেক ওষুধ পথ্য খাবার পর আল্লাহ শেষ পর্যন্ত তাদেরকে একটি পুত্র সন্তান দিলেন। তারা সন্তানের নাম রাখলো ‘মাহির’। মাহির ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে লাগলো।

একদিন মাহিরের পিতা, মা’কে বললো: মাহির তো বড়ো হচ্ছে। কাজকর্ম কিছু একটা তো শেখানো দরকার। নৈলে তো মানুষের কাছে হাত পাততে হবে। ভিক্ষার হাত বাড়ানোর মতো নিকৃষ্ট আর কী হতে পারে! স্ত্রী তার স্বামীর কথায় সায় দিলো। পরের দিন সকালেই মাহির ও তার বাবার জামা কাপড় গুছিয়ে পোটলা বাঁধা হলো। রওনা দিলো তারা। পাহাড় পর্বত মরুভূমি পেরিয়ে ছোট্ট একটা হ্রদের পাশে গাছের নিচে বিশ্রাম নিতে বসলো তারা। ক্ষিধেও লেগেছে। দুপুরের খাবার দাবারও সেরে নিতে হবে। বাবা ছেলে খাবার খেতে শুরু করলো।

খাবার খেতে খেতে মাহিরের নজরে পড়লো আজগুবি এক ঘটনা। হ্রদের পানি ভেদ করে একটা লোক বেরিয়ে এলো। লোকটা মাহির এবং তার বাবার পাশে এসে বসলো। আস্তে আস্তে মাহিরের বাবাকে সে বললোঃ মাহিরকে আমার কাছে দাও। আমি তাকে বিভিন্ন রকমের শিল্প ও কাজে দক্ষ করে তুলবো। তিন বছর পর ঠিক এই দিনে এই জায়গায় এসে মাহিরকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যেও। মাহিরের বাবা রাজি হলো এবং লোকটার সাথে ছেলেকে দিয়ে ফিরে গেল বাসায়। পানি থেকে আসা লোকটা মাহিরকে নিয়ে আবার পানিতে ডুবে গেল।

ওস্তাদের বাসায় তার একটা মেয়ে ছাড়া আর কেউ ছিল না। তিন বছর ধরে মাহির জ্ঞান বুদ্ধি ও শিক্ষা অর্জন করার সময় ঐ মেয়েটাই ছিল তার একমাত্র সঙ্গী। যাই হোক, মাহির অনেক কিছু শিখলো। এতোটাই শিখলো যে স্বয়ং ওস্তাদই তাকে হিংসা করতে শুরু করে দিলো। যাই হোক, মাহিরের বাবা তিন বছর পর সঠিক দিনে সঠিক জায়গায় যেতেই মাহিরকে নিয়ে অদ্ভুত লোকটা পানি ভেদ করে বেরিয়ে এলো। মাহিরকে তার বাবার কাছে বুঝিয়ে দিয়ে লোকটা চলে গেল আর মাহির বাসায় ফিরে গেল তার বাবার সাথে। মাহিরের বাবার আর্থিক অবস্থা তো খুব খারাপ ছিল অনেকটা দিন এনে দিন খাওয়ার মতো। সেজন্যে মাহির সিদ্ধান্ত নিলো তার যোগ্যতাকে কাজে লাগিয়ে বাবার অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে।

সে বাবাকে বললো: ‘বাবা! আমি একটা সাদা সুদর্শন তাগড়া ঘোড়ায় পরিনত হবো। তুমি আমাকে প্রতিদিন বাজারে নিয়ে বিক্রি করতে পারবে। তবে মনে রাখতে হবে লাগামটা অবশ্যই আমার ঘাড় থেকে খুলে নিয়ে আসবে,নৈলে কিন্তু আমাকে হারাবে। আর প্রতিদিন যদি তুমি লাগাম খুলে নিয়ে আসো তাহলে প্রতিদিনই আমাকে ঘোড়া বানিয়ে বিক্রি করতে পারবে। আর ঘোড়া বিক্রি করে করে তুমি ধনী হয়ে যাবে।

বাবা বললো ঠিকাছে। এর পর থেকে প্রতিদিনই ঘোড়া বিক্রি করে করে বাবা বড়লোক হয়ে গেল। যতোই ধনী হতে লাগলো ততোই আরো বেশি সম্পদের লোভ তাকে পেয়ে বসলো। একদিন সে ঘোড়া নিয়ে বাজারে গেলে ঘটে গেলো এক অদ্ভুত ঘটনা। এক ক্রেতা এসে বললো তোমার ঘোড়াটা আমি দ্বিগুণ দামে কিনবো। তবে শর্ত হলো লাগামসহ বিক্রি করতে হবে। মাহিরের বাবা লোভে পড়ে রাজি হয়ে গেল। ঐ ক্রেতা ছিল মাহিরের সেই ওস্তাদ, যে কিনা পানির ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ওস্তাদ যখন দেখলো মাহির তাকেও ছেড়ে গেছে, সেজন্যে মাহিরকে মেরে ফেলার জন্যে তাকে কিনে নিয়ে গিয়ে নিজের কব্জায় রেখে দিল।

যে ছাত্র দক্ষতায় ওস্তাদকেও ছেড়ে যায় সেই ছাত্র যে-কোনো মুহূর্তে ওস্তাদের জন্যে প্রতিদ্বন্দ্বী এবং বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে- এ চিন্তা করেই ওস্তাদ লাগামসহ ঘোড়া কিনেছিল। ওস্তাদ এখন লাগামটাকে বড়ো বড়ো পেরেক দিয়ে ভালো করে মাটিতে পুঁতে রাখলো। তারপর দৌড়ে গেল ঘোড়াটাকে জবাই করার জন্যে ধারালো ছুরি আনতে। ওস্তাদের মেয়েটা সবকিছু দেখতে পেয়ে রহস্যটা বুঝতে পেরেছিল। সে এগিয়ে এসে মাটিতে পুঁতে রাখা মাহিরের লাগামটাকে মুক্ত করে প্রান্তরে নিয়ে রেখে আসলো। মাহির পুনরায় সাদা ঘোড়া বনে গেল। ঘোড়া এখন দৌড়তে শুরু করলো।

ওস্তাদ সেই মুহূর্তেই সেখানে এসে যখন দেখলো মাহির চলে যাচ্ছে নিজে একটা সাদা কবুতর বনে গেল। উড়তে উড়তে ঘোড়ার পিছু নিলো কবুতররূপী ওস্তাদ। কবুতর উড়তে উড়তে উপরে উঠে ঘোড়ার পিছু নিলো। মাহির এবার বুদ্ধি করে ঘোড়া থেকে বাজপাখিতে পরিনত হলো। বাজপাখি এবার কবুতরের পিছু নিলো। আকাশে উড়তে উড়তে মাহির এক জায়গায় দেখতে পেল ধুমধাম করে বিয়ের উৎসব অনুষ্ঠান হচ্ছে। সাথেসাথে খুব সুগন্ধি ফুলের তোড়া হয়ে দফ করে গিয়ে পড়লো কনের আঁচলের ওপর। ওস্তাদও গায়ক সেজে গিয়ে হাজির হলো সেই অনুষ্ঠানে। অনুষ্ঠানে আগত লোকেরা একের পর এক সুগন্ধি ফুলের তোড়া শুঁকে শুকে এক হাত থেকে আরেক হাতে দিয়ে যাচ্ছিলো। এক পর্যায়ে ফুলের তোড়া এসে পড়লো গায়ক ওস্তাদের হাতে।

আর যায় কোথায়। ওস্তাদ ফুলগুলোকে টুকরো টুকরো করে ফেললো। তবে ফুলের একটি শাখা ওস্তাদের হাত থেকে মাটিতে পড়ে গেল। ঐ শাখাটি সাথে সাথে গমের দানায় পরিনত হয়ে গেল। ওস্তাদও সাথে সাথে মোরগে পরিনত হয়ে গমের দানাগুলো খেয়ে ফেলতে শুরু করলো। গমের একটি দানা হঠাৎ করেই গড়াতে গড়াতে গিয়ে পড়লো একটি গর্তে। এই দানাটিই আসলে মাহির। মাহির দ্রুত শৃগালে পরিনত হয়ে গেল। ওস্তাদ তো এবার ধরা খেয়ে গেল। শেয়ালের সামনে তো মুরগি টিকে থাকতে পারে না, আর মুরগিটাকেও অন্য কোনো রূপ ধারন করার সুযোগ দেওয়া হলো না। মুরগি মুরগিই থেকে গেল আর শেয়াল মজা করে মুরগিটাকে খেয়ে ফেললো।

গল্পের বিষয়:
ছোট গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত