ম্যানহাটানে মুনস্টোন

ম্যানহাটানে মুনস্টোন

নিউ ইয়র্কে থাকার একটা মস্ত অসুবিধা হল চেনা-অচেনা অনেককেই এয়ারপোর্টে গিয়ে রাইড দিতে হয়। আর শুধু রিসিভ করা নয়, মাঝে মধ্যে এইসব ভিসিটারদের দু-দশ দিনের জন্যে নিজেদের অ্যাপার্টমেণ্টে থাকতে দিতে হয়। আমি প্রায় ছ’বছর ম্যানহ্যাটানে আছি। এরমধ্যে এমন একট মাসও যায় নি, যে-মাসে আমাকে এয়ারপোর্টে ছুটতে হয় নি। সত্যিকথা বলতে কি, না চাইলেও এসব ঝুটঝামেলা এড়ানো খুব মুশকিল। তবে ছ’বছর এই আনপেড পাবলিক সার্ভিস দিয়ে একটা জিনিস কিন্তু হয়েছে। আমি এখন চোখ বুজে ইউ এন বিল্ডিং-এর গাইডেড ট্যুরটা দিতে পারি। এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিং-এর কত নম্বর এলিভেটর ক’তলা অবধি যায়, সার্কেল লাইন ট্যুর ঠিক কটার সময় শুরু হয়, গুগেনহাইম মিউজিয়ামে ঢুকতে কত ডলার লাগে – সব আমার ঠোঁটস্থ।

“বিগ ডিল,” প্রমথ আমাকে প্রায়ই খোঁচা দেয় এই নিয়ে। “তোর এই বিদ্যেগুলো হচ্ছে ইউজলেস। ফালতু পাবলিক সার্ভিস না দিয়ে যদি পিৎসা ডেলিভারির কাজও নিতিস, তাহলে মাসান্তে অন্তত একস্ট্রা টু-পাইস ব্যাঙ্কে জমা পড়ত।”
প্রমথ সমাদ্দার আমার বহুদিনের বন্ধু, বালিগঞ্জে এক পাড়ায় দুজনে বড় হয়েছি। কেমিস্ট্রিতে এন ওয়াউ ইউ-তে পিএইচ ডি করছে। থাকে দোতলায়, আমার নীচের অ্যাপার্টমেন্টে। প্রমথ হল আমার ফ্রেন্ড ফিলসফার এন্ড গাইড। তবে গাইড না বলে গার্জেন বলাই ভালো। সেটা হবার নাকি ওর হক আছে। লতায় পাতায় আমাদের মধ্যে একটা সম্পর্ক ও আবিষ্কার করেছে। আসলে ও নাকি আমার মামা।

অনাহূত অতিথি নিয়ে আমি কমপ্লেন করছি বলে এই নয় যে ইন্টারেস্টিং লোক কখনো আসেন নি। বছর দেড়েক আগে শৈলেন সাঁপুই বলে এক ভদ্রলোক কিছুদিনের জন্যে আমার কাছে এসে ছিলেন। রাইস রিসার্চ ইনস্টিট্যুট-এ কি জানি কি করতেন। ওঁর একটা অদ্ভুত ক্ষমতা ছিল কপাল দেখে পাস্ট ফিউচার সবকিছু বলে দেওয়া। আমার দিকে তাকিয়ে ধাঁ করে বলে দিলেন যে, সাত বছর বয়েসে আমার জলে ডুবে মরার কথা, নেহাৎ বৃহস্পতির জোরে বেঁচে গেছি। সাত কিনা মনে নেই, কিন্তু ছেলেবেলায় চৌবাচ্চায় পড়ে গিয়ে সত্যিই প্রায় মরমর হয়েছিলাম। প্রমথও সাঁপুইয়ের ভবিষ্যৎবাণীতে খুব ইমপ্রেসড হয়েছিল। ওর বাবার মৃত্যুর খবর উনি এক্কেবারে ঠিকঠাক বলে দিয়েছিলেন।

তবে শৈলেন সাঁপুইয়ের মত ইন্টারেস্টিং লোক কদাচিৎ আসেন। ভদ্রলোক দিন পনেরো ছিলেন আমার কাছে। তার মধ্যেই ওঁর এত চেলা-চামুন্ডা জুটে গেল যে, রাইস ইনস্টিট্যুটের কাজ ছেড়ে উনি একেবারে ফুল-টাইম অ্যাস্ট্রলজার হয়ে বসলেন। শুনেছি এখন কুইন্সে একটা বাড়ি ভাড়া করে আছেন। ভাগ্য গণনা করেন আর গ্রহদশা ঘোচাবার জন্যে তাবিজ, গ্রহরত্ন, ইত্যাদি নানান জিনিস বিক্রি করেন।

আর একবার বম্বে থেকে এক পেশাদার ন্যাজিশিয়ান এসেছিলেন ‘ওয়ার্ল্ড ম্যাজিক কনফারেন্স’-এ যোগ দিতে। আমার ছোটমামার পরিচিত। প্রমথ তাঁকে আড়ালে ‘মিস্টার ইন্দ্রজাল’ ডাকতো। মিস্টার ইন্দ্রজাল দুর্দান্ত ম্যাজিক দেখাতেন, কিন্তু ফাঁকে ফাঁকে নানান রকমের ডেঞ্জারাস কমেন্ট করতেন। একদিন আমার অ্যাপার্টমেন্টে ম্যাজিকের আসর বসেছিল। আকাশে হাত বাড়িয়ে মিস্টার ইন্দ্রজাল নিজের নাম সই করা পাসপোর্ট সাইজের ছবি কোত্থেকে যে বের করছিলেন – ভগবান জানেন! আর সেগুলো এক-একটা করে দর্শকের হাতে ধরিয়ে দিচ্ছিলেন। হঠাৎ বললেন, “জানেন, হোলিম্যান আর ম্যাজিশিয়ানের তফাৎ কি?”
সবাই চুপ।

মিস্টার ইন্দ্রজাল তখন নিজেই উত্তরটা দিলন। “একজন হল অনেস্ট, আর একজন ঠকবাজ। আমি যেটা দেখাচ্ছি – সেটা হল পিওর ম্যাজিক, শ্রেফ হাত সাফাইয়ের খেলা। আর আমি সেটা স্বীকার করি। কিন্তু আমাদের গুরু-অবতাররা এটাকে বলেন বিভূতি। তাহলে অনেস্ট কে?”

প্রফেসর আনন্দ প্রভাকর সেখানে ছিলেন – এক বিভূতি-দেখানো সাধুভাবার অন্ধ-ভক্ত। তিনি মিস্টার ইন্দ্রজালকে এই মারেন কি সেই মারেন! যাচ্ছেতাই কাণ্ড! অনেক কষ্টে সবাইকে শেষে ঠাণ্ডা করা গিয়েছিল।
প্রমথ সেবার আমায় ধরে প্রচণ্ড জ্ঞান দিয়েছিল। “এরপর তুই পার্সোনালি কাউকে না চিনলে বাড়িতে থাকতে দিবি না। তোর গেস্টদের বিহেভিয়ারের জন্যে পাবলিক তোর ওপর কি রকম ক্ষেপেছে – সেটা জানিস!”

আমিও নাকে খত দিয়েছিলাম। আর না, অচেনা আর কাউকে বাড়িতে রাখব না। কিন্তু ম্যান প্রোপোজেস এন্ড গড ডিসপোজেস। দেশ থেকে পাড়ার বন্ধু রনুর চিঠি যে, ওর এক বিশেষ পরিচিত মিস্টার সেন আমেরিকাতে এক মাসের জন্যে আসছেন, আমি যেন তাঁকে আমার কাছে রাখি। তারপর ছেলেবেলায় আমরা কত বন্ধু ছিলাম, আশাকরি আমেরিকাতে গিয়ে পুরনো বন্ধুকে ভুলে যাই নি – সেন্টিমেন্টে সুড়সুড়ি দিয়ে নানান কথা। কতবড় বদমাশ!

দুই

সাধারণত লোক দেখলে আমার বিতৃষ্ণা হয় না। কিন্তু মিস্টার সেনকে দেখে হল। উস্কোখুস্কো চুল ভর্তি বিশাল মাথা একটা ক্যাংলা শরীরের ওপর বসানো। গায়ে নোংরা সাদা সার্ট। ঘিয়ে রঙের কোটটা এমন কোঁচকানো যে মনে হয় দলামোচা করে কিছুক্ষণ আগে কেউ সেটার ওপর বসেছিল। প্যান্টের অবস্থাও তথৈবচ। আমেরিকায় আসছে লোকটা, কিন্তু জামাকাপড়ের ব্যাপারে এতটুকু হুঁশ নেই! গলার স্বরটাও অত্যন্ত ঘ্যানঘ্যানে, বিরক্তিকর। তারওপর কথার পিঠে ‘স্যার’ জোড়া। এয়ারপোর্ট থেকে পেরিয়ে সবে ভ্যানউইক এক্সপ্রেস ওয়েতে পড়েছি, মিস্টার সেন নিরবতা ভাঙলেন। মার্লবারোর প্যাকেট খুলে একটা সিগারেট আমার নাকের সামনে নাচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

“চলবে স্যার?”
“আমি খাই না।” সংক্ষিপ্ত জবাব দিলাম।

“ভালোই করেন স্যার, ভেরি ব্যাড হ্যাবিট। আমিও এবার ছাড়ব।” বলে সিগারেটটা ঠোঁটে লাগাতে যাচ্ছিলেন। কি ভেবে জানি নামিয়ে নিলেন। “স্যার, আপনাকে একটা প্রশ্ন করি?”

“করুন।”
“সিগারেটের ধোঁয়া কি আপনাকে বদার করে?”
“ওয়েল, তা অবশ্য একটু করে।”
“তারমানে স্যার, আমি এখানে সিগারেট খেলে আপনি বদারড হবেন।”
“না, না, একটু আধটুতে কি আর আসুবিধা, আপনি খান।”
“নো স্যার, আই ক্যান নট বদার ইউ। আচ্ছা, গাড়িটা কোথাও থামানো যায় না। আমি তাহলে টুক করে দুটো টান দিয়ে নিতে পারতুম।”
“না, এটা হাই ওয়ে। এমার্জেন্সি স্টপিং-এর জন্যে কোনও লেন না পাওয়া পর্যন্ত থামার উপায় নেই।”
“আই সি।”
আমার খারাপ লাগল। বললাম, “আপনি খান, এক-আধটা সিগারেটে কিছু এসে যায় না।”
“থ্যাঙ্ক ইউ স্যার, থ্যাঙ্ক ইউ ভেরি মাচ। এটা আবার সময় মত না খেলে সাইনাসটা ট্রাব্‌ল দেয়।”
লোকটা উন্মাদ নাকি! সাইনাসের সঙ্গে ধূমপানের সম্পর্ক কি? মরুক গে যাক!

হঠাৎ খেয়াল করলাম, ভদ্রলোকের কোলের ওপর রাখা ব্যাগে লেখা মিস্টার ই.সেন। ই.সেন দেখে আমি খুব অবাক হলাম। এরমধ্যে রনু একদিন ফোনও করেছিল ওর বন্ধু এন.সেনের আমেরিকা আসার খবরটা আমি চিঠিতে ঠিকঠাক পেয়েছি কিনা জানতে। কি সর্বনাশ, আমি কি তাহলে ভুল লোককে গাড়ীতে তুললাম!

“আচ্ছা আপনার ফার্স্ট নেমটা কি বলুন ত?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“একেন।”
“একেন! খুব আনইউস্যুয়াল নামটা তো!”
“একেন্দ্র থেকে একেন। বাবা-মা একেবারে মার্ডার করে গেছেন স্যার। এই নিয়ে সবার গোল লাগে।”

হঠাৎ ব্যাপারটা জলের মত পরিস্কার হয়ে গেল। রনুর আদি বাড়ি ঢাকায়। তাই একেন সেন না বলে বলেছিলো অ্যাকেন সেন। আর আমি ভেবেছিলাম এক এন.সেন আসছেন! হো হো করে হেসে উঠলাম আমি। একেন সেন অবাক হয়ে আমার দিকে তাকালেন। কনফিউসানটা ওঁকে বলতেই মাথা দুলিয়ে বললেন, “ভেরি ফানি স্যার।“ সঙ্গে সঙ্গে সিগারেট থেকে বড় এক টুকরো ছাই গাড়ীর হলুদ কার্পেটের ওপর পড়ল। আমি সাবধান করার আগেই জুতো দিয়ে কালো ছাইটা কার্পেটে ঘষে ঘষে মিশিয়ে দিলেন। অর্থাৎ এখন একশো বার ভ্যাকুয়াম করলেও ওই দাগ তোলা যাবে না!

তিন

সাতদিনও হয় নি একেনবাবু এসেছেন, কিন্তু এর মধ্যেই ওঁর অনর্গল বাক্যবাণে আমার প্রাণ ওষ্ঠাগত। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে সবে রান্না চাপিয়েছি, একেনবাবু কিউ-টিপ দিয়ে কান খোঁচাতে খোঁচাতে এসে বললেন, “আপনাদের ‘ইন্ডিয়া অ্যাব্রড’ পেপারটা ওল্টাচ্ছিলাম স্যার। আপনি দেখেছেন, একজম ইন্ডিয়ান বিজনেসম্যান দিনে দুপুরে মার্ডারড?”
খবরটা চোখে পড়েছে। এক ভারতীয় অ্যান্টিক ডিলার খুন হয়েছেন হিট এন্ড রান অ্যাকসিডেন্টে, অর্থাৎ মোটর গাড়ী এসে চাপা দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু সে নিয়ে আলোচনার এতটুকু ইচ্ছে বা উৎসাহ আমার ছিল না।
“কি মনে হয় স্যার, রেশিয়াল অ্যাটাক?”
আমি হ্যাঁ হুঁ কিছুই করলাম না। একেনবাবুর বকবকানি অবশ্য তাতে থামল না।

“লোকাটার ব্যাগে নাকি হাজার ডলার ক্যাশ পাওয়া গেছে। সেইজন্যেই পুলিশ সন্দেহ করছে রবারি নয়। তবে একটা জিনিস একেবারে অ্যাবসার্ড স্যার।”

“কি অ্যাবসার্ড?” কথা বাড়ানোর ইচ্ছে ছিল না, তাও মুখ দিয়ে বেরিয়ে গেল।
“এই এত ক্যাশ নিয়ে ঘোরা। নিউ ইয়র্কে যখন এত মাগিং হয়, তখন এসব নিয়ে ঘুরে বেড়ানো কেন?”
আমার বিরক্তি লাগল। বললাম, “কেন, কলকাতা কিংবা মুম্বাইয়ে ছিনতাই হয় না?”
“না স্যার নিউ ইয়র্কের মত হয় না।”

“কে বলেছে আপনাকে? এখান থেকে কত লোক দেশে গিয়ে টাকা খুইয়েছে জানেন? আমাদের অবিনশই তো গতবার দেশে এয়ারপোর্ট থেকে বেরোতে পর্যন্ত পারল না‌, ড্রাইভার্স লাইসেন্স, ক্রেডিট কার্ড সব কিছু গন! কি প্রচণ্ড ঝামেলা! যার জন্যে এবার ও সব কিছু এখানে রেখে গেছে।“

অবিনাশ প্রমথর রুমমেট। এই কিছুদিন হল দেশে বেড়াতে গেছে।

একেনবাবু দমলেন না। “গ্র্যান্ট ইউ স্যার, পিক পকেটে আমরা টপে আছি। কিন্তু মার্ডার ছিনতাইয়ের ব্যাপারে নিউ

ইয়র্কের কাছে স্যার আমরা শিশু। এই দেখুন না, কলকাতায় বছরে খুন হয় একশো জনের মত, আর নিউ ইয়র্কে আড়াই হাজার! অথচ প্রায় সমান সমান পপুলেশন।”

“কোথায় শুনলেন কথাটা?”
“কাল টিভিতে বলছিল স্যার,” উজ্জ্বল মুখে খবরের অথেন্টিসিটি প্রমাণ করলেন একেনবাবু।
কি শুনতে কি শুনেছেন কে জানে! কিন্তু আমি আর কথা বাড়ালাম না।
“আচ্ছা স্যার, প্রমথবাবু বলছিলেন, এখানে ভারতীয় অ্যান্টিক ডিলার নাকি গোনাগুনতি?”
এই ধরণের প্রশ্নের উত্তর দেওয়া অর্থ হয় না। চুপ করে রইলাম।

“ইট মেকস সেন্স স্যার। ইন্ডিয়া গভর্নমেন্ট যা কড়াকড়ি করে! ভালো অ্যান্টিক দেশ থেকে আনতে হলে চুরি করে পাচার করা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেই।”

“আপনি কি মিন করছেন,” আমি বিরক্ত হয়ে বললাম। “অ্যান্টিক বিজনেসে যারা আছে, তারা সব চুরি করছে?”
“না, না, তা নয় স্যর। অ্যান্টিক ডিলার মাত্রই চোর নয়। আমি বলছি চোর হলে সে ভালো অ্যান্টিক ডিলার হতে পারে।“ চোখ বুজে সিগারেটে শেষ টানটা দিলেন একেনবাবু।

“দিস ইস মাই লাস্ট ওয়ান স্যার।“ ফাঁকা প্যাকেটটা আমাকে দেখিয়ে বাইরের ঘরের সোফায় গিয়ে বসলেন। “আই কুইট সিগারেট। আর জ্বালাব না আপনাকে।”

আমার অ্যাপার্টমেন্টে একটা বড় ঘরের একদিকে কিচেন-কাম-ডাইনিং এরিয়া, অন্যদিকে বসার ঘর। সুতরাং কিচেন থেকেও গলাটা একটু তুলে বসার ঘরের লোকদের সঙ্গে কথা বলা চলে।

আমি বললাম, “গুড ডিসিশন। তবে আমাকে জ্বালানোর প্রশ্ন নয়, ইট ইজ গুড ফর ইয়োর হেলথ।”
“আচ্ছা এই ক্রেডিট কার্ড জিনিসটা ফ্যান্টাস্টিক, তাই না স্যার?” প্লাস্টিকের একটা পাৎলা কার্ড, তার ওপর আপনার নাম আর নম্বর এম্বস করা। অথচ তাই দিয়ে আপনি হাজার হাজার ডলারের জিনিস কিনে ফেলছেন!”
“তা ফেলছি, তবে সে টাকা পরে দিতেও হচ্ছে। সময় মত না দিলে উইথ হেভি ইন্টারেস্ট।”
“তা বটে। তবে কি ওয়ার্ল্ড স্যার, আর আমরা কোথায় পড়ে আছি! পকেটে ক্যাশ না নিয়ে বাজারে যাওয়ার জো নেই।”
“কেন, আমাদের দেশেও তো ক্রেডিট কার্ড চলছে।”

“কি যে বলেন স্যার, কিসের সঙ্গে কিসের তুলনা! কজনের আছে কার্ড? আমাদের দেশে এসব সত্যি করে চালু হতে বহুদিন লাগবে। ব্লিক ফিউচার স্যার, ব্লিক ফিউচার।” বলে ঘন ঘন কয়েকবার পা নাচালেন একেনবাবু। “আচ্ছা স্যার, ফিউচারের কথায় মনে পড়ে গেল। আপনার এক বন্ধু ফরচুন টেলার না?”
“বন্ধু নয়, এককালে আমার এখানে কিছুদিন ছিলেন। আপনাকে তাঁর কথা কে বলল?”
“প্রমথবাবু। বলছিলেন ওঁর কথা নাকি খুব ফলে। তাছাড়া গ্রহ দশা কাটানোর জন্যে উনি নাকি রত্ন-ফত্ন প্রেসক্রাইব করেন – খুব এফেক্টিভ জুয়েল।”

“এফেক্টিভ কিনা জানি না, গ্রহ-রত্ন দেন বলে শুনেছি।“
“আপনি মনে হচ্ছে এসবে খুব একটা বিশ্বাস করেন না, ঠিক কিনা স্যার?”
“”না,” সত্যি কথাই একেনবাবুকে বললাম।
“যাঃ, তাহলে তো ওঁর কাছে যাওয়ার কোনো অর্থ হয় না।”
“কি মুশকিল, আপনার ইচ্ছে হলে আপনি নিশ্চয় যাবেন। আমার বিশ্বাস-অবিশ্বাসে আপনার কি এসে যায়!”
“তা না স্যার, আসল কথা – না থাক গে। প্রমথবাবুর বোধহয় একটু উইকনেস আছে – তাই না স্যার?”
“হ্যাঁ, প্রমথ কিছুটা বিশ্বাস করে।”

“তবে যাই বলুন স্যার, নীলা হ্যাস পাওয়ার। সকলকে স্যুট করে না অবশ্যি। যাদের করে – তাদের একেবারে ফরচুন এনে দেবে।“

কি অসম্ভব বক বক করতে পারে লোকটা, তাই ভাবছিলাম।

আমার মনের কথাটা একেনবাবু শুনতে পেলেন কিনা জানি না, কিছুক্ষণের মধ্যেই বকবকানি থামিয়ে দেখলাম ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’ নিয়ে চুপ করে বসলেন। বাঁচা গেছে!

আমি রান্নায় মন দিলাম। কিন্তু কতক্ষণ? এবার একেনবাবুর প্রশ্ন, “আচ্ছা স্যার, কেউ যদি কার্ড চুরি করে বহু টাকার জিনিস কিনে ফেলে?”
আমি অবাক হয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে ওঁর দিকে তাকালাম।

“মানে আমি ক্রেডিট কার্ডের কথা বলছি,” একেনবাবু চিন্তার সূত্র ধরিয়ে দেবার চেষ্টা করলেন।
“আপনি এখনো ঐ নিয়ে চিন্তা করছেন! আমি তো ভাবছিলাম আপনি নিউ ইয়র্ক টাইমস পড়ছেন!”
“পড়ছিলাম। কিন্তু নিউজ কিস্যু নেই, যতসব বস্তা পচা খবর! দেখুন না, এখনও সেই স্মিথসোনিয়ানের স্পেস মিউজয়াম থেকে চুরি নিয়ে পাতা ভর্তি! স্যার, দুটো স্পেস-স্যুট চুরি গেল কি গেল কিনা, হু কেয়ারস? কিন্তু একটা জলজ্যান্ত ইন্ডিয়ান রাস্তার ওপরে মার্ডারড হল, তার কোনও উল্লেখ নেই! টোটালি বায়াসড স্যার, টোটালি বায়াসড।”
কথাগুলো বলে একেনবাবু নিজের ঘরে চলে গেলেন। একটু বাদেই দেখি ছোট ছোট পাথর ভর্তি একটা জুতোর বাক্স হাতে নিয়ে ফিরে এসেছেন।

“আচ্ছা, এই পাথরগুলো কেমন লাগছে স্যার? কাল বেয়ার মাউন্টেন থেকে নিয়ে এসেছি।”
“ সুন্দর,” প্রায় না দেখেই বললাম আমি।
“প্রমথবাবুকে সারপ্রাইজ দেব বলে নিয়ে এলাম।”
“প্রমথ পাথর নিয়ে কি করবে?”
“কেন স্যার, ওঁর ক্যাকটাস গাছগুলোর নীচে ছড়িয়ে রাখবেন।”
এবার ভালো করে তাকালাম। না, পাথরগুলো সত্যিই সুন্দর। প্রমথ নিঃসন্দেহে খুব খুশি হবে।

চার

খাওয়া দাওয়ার পর আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করুলাম, “কি একটু হাঁটবেন? আমাকে কয়েক মিনিটের জন্যে স্কুলে যেতে হবে, কালকে পড়ানোর নোটটা ফেলে এসেছি।”

একেনবাবু টেবিলের ওপর পা তুলে বসেছিলেন। সেই অবস্থাতেই ঠ্যাঙ নাচাতে নাচাতে বললেন, “আপনি স্কুল বললেন কে স্যার, ইউনিভার্সিটিতে যাবেন বলুন!”
“এখানে ইউনিভার্সিটিকে লোকে স্কুল বলে।”

“ভেরি কনফিউসিং। স্কুল হচ্ছে স্কুল। মানে ক্লাস ওয়ান থেকে টেন বা টুয়েলভ অবধি। তারপর কলেজ, তারপর ইউনিভার্সিটি। এখানে কি তার উলটো নাকি?”
“উলটো নয়, এখানে সব কিছুই স্কুল।“

একেনবাবু একটু মাথা চুলকোলেন। তারপর উঠে ক্লজেট থেকে ওঁর মান্ধাতা আমলের ওভারকোটটা বার করে বললেন, “চলুন স্যার, ডিনারের পর হাঁটাটা স্বাস্থ্যকর।”

আমি ওঁকে ইনভাইট করেই কিন্তু মনে মনে আফশোস করতে শুরু করেছি। সারাটা পথ বকিয়ে মারবেন। মারছিলেনও , শুধু বাঁচোয়া প্রমথর সঙ্গে রাস্তায় দেখা হয়ে গেল। প্রমথ স্কুল থেকে ফিরছিল। বলল সুপারমার্কেটে

যাচ্ছে, বাজার করে বাড়ি ফিরবে।
আমি জিজ্ঞেস করলাম, “এত রাত্রে?”
“আর বলিস না, অবিনাশের আঙ্কল ডি.এম কাল রাত্রে হঠাৎ এসে হাজির।”
আঙ্কল ডি.এম হলেন অবিনাশের মামা কিরিট প্যাটেল। ভদ্রলোক ডায়মন্ড মার্চেন্ট বলে প্রমথ ওঁকে আড়ালে ওই

নামে ডাকে।
“তোর কাছে বেড়াতে এসেছেন!” আমি আমি আশ্চর্য হলাম।
“বেড়াতে নয়, নিরুপায় হয়ে। ওঁর বাড়ির হিটিং হঠাৎ খারাপ হয়ে গেছে। এদিকে আজকেই আমার আবার হেক্টিক স্কেজুল।”

“আমাকে একটা ফোন করে দিলেই পারতিস। আমাদের সঙ্গেই না হয়ে খেয়ে নিতেন।”
“আরে না, সেকি আমার মাথায় আসে নি নাকি! ঝামেলা হল, ভদ্রলোক হচ্ছেম স্ট্রিক্ট ভেজিটেরিয়ান – এমন কি পেঁয়াজ পর্যন্ত খান না। বাড়িতে এদিকে কোনো তরিতরকারি নেই। যাইহোক, গুড নিউজ হল ভদ্রলোক কালই ইন্ডিয়া কাটছেন।”

নিউ ইয়র্কে ফেব্রুয়ারি মাসে বাড়িতে হিট না থাকা যে কি সমস্যা, সেটা ভুক্তভোগীরাই বুঝতে পারবে। জমে কুলপি না হলেও নির্ঘাৎ নিমোনিয়া! তবে অবিনাশের আত্মীয়্র জন্যে প্রমথর মাথাব্যথা দেখে আমি বেশ অবাক হলাম। অবিনাশ প্রমথর সঙ্গে প্রায় এক বছর হল অ্যাপার্টমেন্ট শেয়ার করছে ঠিকই, কিন্তু দুজনের মধ্যে সম্পর্কটা আপাতত মোটেই মধুর নয়।

আমার বুঝতে দেরি হল না একেনবাবু কোনদিকে যেতে চান। বাজার করতে যাওয়ায় একেনবাবুর প্রচণ্ড আগ্রহ। প্রত্যেকটা জিনিসের দরদাম পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে পড়েন, আর দেশের সঙ্গে তার অনবরত তুলনা করেন!
আমি একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি, আপনি প্রমথর সঙ্গে যাবেন নাকি?”
একেনবাবু বোধহয় লজ্জা পেলেন। “না, না স্যার, আপনার সঙ্গে বেরিয়েছি, আপনার সঙ্গেই ফিরব।“
“তাতে কি হয়েছে, আমার সঙ্গে বেরিয়েছেন বলেই আমার সঙ্গে ফিরতে হবে?”
প্রমথও হৈ হৈ করে উঠল। “আরে চলুন, চলুন। আমার আবার একা একা বাজার করতে বোর লাগে।”

আমি ভেবেছিলাম চট করে ফিরব,কিন্তু সেটা হল না। কলেজ থেকে বেরনোর মুখেই প্রায় এক ঘন্টা ধরে প্রচণ্ড বৃষ্টি, আর তার সঙ্গে পিলে চমকানো বাজ। ফিরতে ফিরতে প্রায় দশটা বেজে গেল। বাড়ির সামনে পৌঁছে দেখি রাস্তার ওপর দুটো পুলিশের গাড়ি, একটা অ্যাম্বুলেন্স আর কিছু লোকের জটলা। পুলিশের গাড়ির ওপরে লাগানো লাল-নীল লাইটগুলো ঘুরপাক খেয়ে চারিদিকে আলোর ঘুর্ণী তুলেছে। নিউ ইয়র্কে এটা অবশ্য খুব একটা অস্বাভাবিক দৃশ্য নয়। আমাদের বিল্ডিং-এ বেশ কিছু বৃদ্ধ-বৃদ্ধা থাকেন। তাঁদেরই কেউ হয়ত অসুস্থ বা কারো হার্ট অ্যাটাক।
গেটের মুখে দাঁড়ানো এক পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি হয়েছে?”

অফিসারটি কাঁধ ঝাঁকিয়ে হাত ওল্টালো। বুঝলাম জবাব দিতে চায় না। কিন্তু আমি দরজার দিকে এগোতেই আমাকে থামিয়ে প্রশ্ন করল, “ড্যু ইউ লিভ হিয়ার?”
“ইয়েস, আই ডু।”
উত্তরটা শুনে আর আটকাল না।

আমি লিফটে চেপে তেতালায় উঠতেই শুনলাম নীচের তলায় একটা গোলমাল হচ্ছে। এই প্রথম আমার বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। সিঁড়ি ধরে নামতেই দেখি প্রমথর অ্যাপার্টমেন্টের দরজাটা হাট করে খোলা ! দরজায় দুজন পুলিশ, আর তার একটু দূরে ল্যাণ্ডিং-এর ঠিক মাঝখানে প্রমথ আর একেনবাবু দাঁড়িয়ে। প্রমথর মুখ দেখে বুঝলাম খুব বিচলিত।
“কি হয়েছে?” আমি উদ্বিগ্ন হয়ে একটু চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
ও ধরা গলায় উত্তর দিল, “মিস্টার প্যাটেল ডেড।”
“ডেড! কি বলছিস যা-তা!

আমি ছুটে কাছে যেতেই প্রমথ আমার হাতটা চেপে ধরে বলল, “ওদিকে চল, বলছি।”
ল্যান্ডিং-এর অন্য পাশে জানলার ধারে আমরা তিনজন দাঁড়ালাম। তারপর প্রমথর কাছে সব শুনে আমার রক্তও হিম হয়ে গেল। ঘটনাটা হচ্ছে, প্রমথরা বাড়ি ফিরেছে আধ ঘণ্টাটাক হল। সঙ্গে অনেক জিনিসপত্র থাকায় একেনবাবু সোজা তিনি তলায় না উঠে প্রমথর সঙ্গে দোতলায় থেমেছিলেন। প্রমথ ডোর বেল বাজিয়ে কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে চাবি দিয়ে দরজা খোলে। ঘরে ঢোকা মাত্র চোখে পড়ে মিস্টার প্যাটেল চেয়ারে বসে, মাথাটা ডাইনিং টেবিলের ওপর। পেছনটা খালি দেখা যাচ্ছিল, কারণ মুখটা জানলার দিকে। কয়েক মুহূর্তের জন্যে প্রমথ বুঝতে পারে নি ব্যাপারটা

কি। তারপরেই দেখে সারা টেবিল রক্তে ভেসে যাচ্ছে। মেঝেতেও রক্ত – টেবিলের পায়া বেয়ে বেয়ে নেমেছে। মিস্টার প্যাটেলের বাঁ হাতটা সোজা অবস্থায় টেবিলের ওপর ছড়ানো, আর তার কয়েক ইঞ্চি দূরে একটা রিভলবার পড়ে আছে। গুলিটা ঢুকেছে মাথার বাঁ দিক, ঠিক রগের ওপর। প্রমথ এমনিতে খুব শক্ত। কিন্তু এরকম ভয়াবহ রক্তাক্ত দৃশ্য দেখে প্রায় কোলাপস করছিল। ভাগ্যিস একেনবাবু সঙ্গে ছিলেন! শেষমেষ দু’জনে শক্তি সংগ্রহ করে পুলিশকে করে।
প্রমথর কথা শেষ হয় নি, সিঁড়িতে জুতোর আওয়াজ। তাকিয়ে দেখি দুজন লোক তাড়াহুড়ো করে উঠছে। একজন স্পোর্টস জ্যাকেট পরা প্রায় সাড়ে ছফুট লম্বা সাদা আমেরিকান। দ্বিতীয় লোকটা কালো, লম্বায় প্রায় আমাদেরই মত – পাঁচ ছয় কি পাঁচ আট হবে। গলা পর্যন্ত জিপার লাগানো উইন্টার জ্যাকেট, কাঁধে ঝুলছে পেল্লাই সাইজের ফ্ল্যাশ

লাগানো ক্যামেরা। লম্বা লোকটা আমাদের দিকে একবার আড়চোখে তাকিয়ে অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে গেল। প্রথমে মনে হয়েছিল প্রেসের লোক। কিন্তু ভেতরে ‘ক্যপ্টেন’ সম্বোধন শুনে অনুমান করলাম হোমিসাইড স্কোয়াডের ডিটেক্টিভ।
আমরা যেখানে দাঁড়িয়ে, সেখান থেকে প্রমথর অ্যাপার্টমেন্টের শুধু একফালি দেখা যায়। কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর দরজার ফাঁক দিয়ে ক্যামেরার ফ্ল্যাশের ঝলকানি চোখে পড়ছে। আমি দেয়ালে ঠেস দিয়ে প্রায় স্ট্যাচু হয়ে আছি। প্রমথটা ছোট্ট ল্যান্ডিং-এর ভেতরেই নার্ভাসনেসটা কাটানোর জন্যে অস্থির ভাবে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। বক্কেশ্বর দি গ্রেট একেনবাবুও চুপচাপ। মধ্যে শুধু একবার দরজার সামনে উঁকুঝুঁকি মারার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু পুলিশের তাড়া খেয়ে ফিরে এসেছেন। সময়ের দিক থেকে হয়তো আধ ঘন্টার বেশী হবে না, কিন্তু আমার মনে হল বোধহয় প্রায় এক যুগ ধরে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় লম্বা ভদ্রলোকটি বেরিয়ে এসে আমাদের ভেতরে ডাকলেন। ঠিকই ধরেছিলাম হোমিসাইডের লোক। নিজের পরিচয় দিলেন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট বলে।

ডেডবডিটা ইতিমধ্যে কালো প্ল্যাস্টিক দিয়ে ঢেকে ফেলা হয়েছে। ওয়াল টেলিফোনের নীচে বাজারের ব্যাগগুলো ইতস্তত ছড়িয়ে আছে। কিচেনের ডাইনিং টেবিলে আর তার ঠিক নীচে মেঝের দিকে না তাকালে ঘরের আর সব কিছুই স্বাভাবিক। এখানে যে একটু আগে এত বড় একটা কান্ড ঘটে গেছে, সেটা বোঝার জো নেই।

একজন পুলিশ অফিসার দেখলাম ফিঙ্গার প্রিন্ট কিট নিয়ে সাইড টেবিলে রাখা টাইপ রাইটারের চাবিতে ফিঙ্গার প্রিন্ট খুঁজছে। কেন, প্রথমে সেটা বুঝি নি। কিন্তু কাছে গিয়ে দাঁড়াতে কারণটা স্পষ্ট হল। টাইপ রাইটার রোলারে যে কাগজটা আটকানো – সেখানে লেখা ‘আই ডোণ্ট ওয়ান্ট টু লিভ এনি মোর।’ ব্যস ঐটুকুই! কেন বাঁচতে চান না – কি কারণ, কি বৃত্তান্ত – কোথাও কোনো উল্লেখ নেই। কাগজ লাগানো অবস্থায় টাইপরাইটারটা ওখানে অনেক দিন ধরে পড়ে আছে, ওটা প্রমথ আজকাল ব্যবহার করে না। ফিতের কালিগুলো প্রায় শুকিয়ে গেছে। লেখাগুলো তাই আবছা, তবে পড়া যাচ্ছে। মিস্টার প্যাটেলকে আমি এক-আধবারই দেখাছি। কিন্তু সব সময়েই মনে হয়েছে ব্রেভিটি ইজ নট হিস স্ট্রং পয়েন্ট। তাই এই সংক্ষিপ্ত সুইসাইড নোটটা একটু যেন অস্বাভাবিক।

ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট ইতিমধ্যে আমাদের সামনেই প্রমথর জবানবন্দি নিতে শুরু করলেন। আমি ভেবেছিলাম প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে স্টেটমেন্ট নেবেন। কিন্তু ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট মনে হল এ ব্যাপারে একটু ক্যাসুয়াল। ওঁর হাতে একটা ছোট্ট নোটবই। প্রশ্ন করছেন, আর মাঝেমাঝে সেখানে দুয়েকটা পয়েন্ট লিখছেন। মিস্টার প্যাটেল যে এখানে থাকতেন না – হঠাৎ এসেছিলেন, সেটা শুনে উনি প্রমথকে জিজ্ঞেস করলেন, “ওঁর এখানে আসার কথা

আর কি কেঊ জানতো?”
প্রমথ উত্তর দিল, “আর কারোর কথা বলতে পারব না, তবে মিস্টার ব্রিজ শাহ জানতেন।”
“ব্রিজ শাহ কে?”
“ব্রিজ শাহ ওঁর অ্যাটর্নি।”

“আই সি। কিন্তু আপনি জানলেন কি করে যে, মিস্টার শাহ জানতেন?”
“আজ দুপুরে আমার সামনেই উনি মিস্টার শাহকে ফোন করে বলেছিলেন উনি আমার এখানে আছেন।”
“এ ছাড়া আর কি কথাবার্তা হয়েছিল মনে আছে?”
“তা বলতে পারব না, কারণ ঠিক ওই সময়ে আমি আমার ঘরে কিছুক্ষণের জন্যে যাই। তবে যখন বেরিয়ে আসি তখন শুনি মিস্টার শাহকে উনি বলছেন কাল সকালে ন’টার আগে অবশ্য করে একটা ফোন করতে।”
“আই সি। কেন ফোন করতে বলেছিলেন আপনি জানেন?”
“না, আমার কোনও ধারণাই নেই।”
“আর কারোর সঙ্গে ওঁর কথা হয়েছিল?”
“আমি যতক্ষণ বাড়িতে ছিলাম – হয় নি।”
“আপনি কতক্ষণ পর্যন্ত বাড়িতে ছিলেন?”
“একটা নাগাদ আমি স্কুলে যাই।”
“ওঁর আচার ব্যবহারে কোনও অস্বাভাবিকতা লক্ষ করেছিলেন নি?”
“হি অয়াজ নট ইন দ্য বেস্ট অফ স্পিরিট।” প্রমথ এক মুহূর্ত চিন্তা করে উত্তর দিল।
“হোয়াই ডু ইউ সে দ্যাট?”

“আমার মনে হয়েছিল উনি একটূ ডিপ্রেসড ছিলেন। আসার পর থেকে বাড়ির বাইরে কোথাও বেরোন নি। শুধু তাই নয়, কারো সঙ্গে দেখা হোক – সেটাও উনি চান নি। আমাকে বলেছিলেন ওঁর এখানে আসার কথাটা কাউকে না জানাতে।”
“আপনি কাউকে জানিয়েছিলেন?”
“না।”

এক্সেপ্ট আস, আমি মনে মনে বললাম।
এর পর ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট জানতে চাইলেন মিস্টার স্টুয়ার্ট লেফট হ্যান্ডেড ছিলেন কিনা। প্রমথ বলল, ও আগে জানত না। তবে সকাল বেলায় মিস্টার প্যাটেল যখন কয়েকটা জিনিস আনার জন্যে লিস্ট লিখছিলেন, তখনই প্রথম খেয়াল করে।
“লিস্টটা কোথায়?” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট জিজ্ঞেস করলেন।

“শেষ পর্যন্ত লিস্টটা উনি শেষ করেন নি,” প্রমথ উত্তর দিল। “একটা মাত্র জিনিস হলেই চলবে বলেছিলেন।”
“কি জিনিস?”
“নাইলনের একটা শক্ত দড়ি।”
“নাইলনের দড়ি! এনি আইডিয়া, হোয়াই?”
“না,” কথাটা প্রমথ বলল বটে, কিন্তু আমার চোখ এড়ালো না যে, প্রসঙ্গটাতে ও অসোয়াস্তি বোধ করছে।
“সামথিং রঙ?” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট প্রশ্ন করলেন।
“একটা কথা উনি বলেছিলেন, তখন সেটাকে আমি গুরুত্ব দিই নি। কিন্তু …” এটুকু বলে প্রমথ হঠাৎ চুপ করে গেল।
“কি বলেছিলেন?”

“আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, কি-রকম সাইজের দড়ি উনি চাইছেন। উনি … উনি অদ্ভুত উত্তর দিয়েছিলেন।” প্রমথ আবার একটু থামল। “…আই থট ইট ওয়াজ এ জোক… আই স্টিল থিঙ্ক…।”
“হোয়াট দ্য হেল ডিড হি সে?” ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের স্বরে অসহিষ্ণু ভাবটা স্পষ্ট।
“ফাঁস লাগানো যায় এমন দড়ি।” কোনো মতে কথাগুলো বলল প্রমথ।

আমি নিজের অজান্তেই কড়িকাঠের দিকে তাকালাম। শুধু আমি নই। ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টও পলকের জন্যে একবার উপরে তাকালেন।
“দড়িটা কোথায়?”

“আমি একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম ওটার কথা, কেনা হয় নি।”
“আই সি।“ কয়েক সেকেন্ড চুপ করে কি জানি ভাবলেন ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট। তারপর প্রমথ কি করে, কি না করে, একটার সময়ে বেরিয়ে এর মধ্যে বাড়িতে এসেছিল কিনা, টেবিলের রিভলবারটা আগে দেখেছে কিনা, ওর নিজের কোনও বন্দুক বা রিভলবার আছে কিনা – ইত্যাদি, ইত্যাদি হাজার গন্ডা প্রশ্ন করলেন। আমি ও একেনবাবুও রেহাই পেলাম না। তবে একেনবাবুর ক্ষেত্রে ভোগান্তিটা একটু বেশীই হল। উনি এদেশে ভিসিটার শুনে ওঁর পাসপোর্ট দেখতে চাইলেন। তারপর কেমন জানি সন্দিগ্ধ ভাবে ওঁর দিকে তাকালেন। আমার কেমন সন্দেহ হচ্ছিল এবার কিছু একটা ঘটবে! ঠিক তাই। জেরা করার জন্যে ওঁকে সোজা অন্য একটা ঘরে নিয়ে গেলেন। আমি আর প্রমথ দুজনেই বেশ নার্ভাস হয়ে বসে রইলাম। নিউ ইয়র্ক পুলিশ কোন কারণে কিছু সন্দেহ করে বসলে সর্বনাশ! আর বাক্যবাগিস কি বলতে কি বলে বসবেন – কে জানে! তবে যাঁর ভয় পাওয়ার কথা, তাঁরই কোনও বৈকল্য নেই! একটা কথা আছে না, ‘হোয়্যার এঞ্জেলস ফিয়ার টু ট্রেড, দ্য ফুল রাশেস ইন’!
কিছুক্ষণ বাদে দিব্বি কান চুলকোতে চুলকোতে ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের পেছন পেছন বেরিয়ে এলেন। শুধু তাই নয়, ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট যখন চলে যাচ্ছেন, তখন দুম করে একটা প্রশ্ন করে বসলেন, “আপনার কি মনে হয় স্যার, এটা মার্ডার?”

এভাবে যে কেউ ওঁকে প্রশ্ন করতে পারে, সেটা বোধহয় ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট কল্পনা করেন নি। একটু থমকে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, “ওয়েল, নাথিং ইজ ইম্পসিবল।”
“কিন্তু দরজা তো ভেতর থেকে বন্ধ ছিল!” প্রমথ বলল।
ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্ট প্রমথর দিকে বেশ একটু অবজ্ঞাভরে তাকালেন। দরজার নবটা ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, “এই দরজা একটা ক্রেডিট কার্ড ঢুকিয়েও খোলা যায়। একটা ডেড বোল্ট লাগিয়ে নেবেন। নিউ ইয়র্ক ইজ নট এ সেফ প্লেস।”

পাঁচ

আমি ভেবেছিলাম পুলিশ প্রমথর অ্যাপার্টমেন্ট লক করে দিয়ে চলে যাবে ‘সিন অফ ক্রাইম’ বলে। এ রকম সিল করে যাওয়াটাই এখানকার দস্তুর – দরকার হলে যাতে পরে চেক করা যায় নতুন কোনও ক্লুর জন্য। তাই বেশ আশ্চর্য হলাম যখন ডেডবডিটা স্টেচারে তুলে “দ্য প্লেস ইজ অল ইয়োরস,” বলে পুলিশরা বিদায় নিল।
পুলিশ চলে যেতেই আমি আর প্রমথ সাবানজল আর স্পঞ্জ এনে বাইরের ঘর নিয়ে পড়লাম। মিস্টার প্যাটেলের দুটো স্যুটকেস পুলিশ ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেছে। একেনবাবু সেগুলো গুছোতে ভেতরে গেলেন। আমাদের ধোয়া পোঁছার কাজ যখন প্রায় শেষ, তখন একেনবাবু বেডরুম থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, “স্যার, আমাকে একটা ক্রেডিট কার্ড

দেবেন?”
“ক্রেডিট কার্ড দিয়ে কি করবেন?”
“দেখব সত্যিই কার্ড দিয়ে দরজাটা খোলা যায় কিনা।”

আমি উচ্চবাচ্য না করে আমার ‘আমেরিকান এক্সপ্রেস’-এর কার্ডটা ওঁর হাতে ধরিয়ে দিলাম। একটু পরেই একেনবাবু বাইরে গিয়ে দরজাটা টেনে লক করে দিলেন।

একেনবাবু বাইরে খুটখাট করছেন, প্রমথ আচমকা প্রশ্ন করল,”আচ্ছা বাপি, ওঁর যদি সুইসাইড করারই প্ল্যান ছিল, তাহ্লে নিজের বাড়িতে না করে এখানে এলেন কেন? সুইসাইড নোটে সইটাই বা করলেন না কেন?”
প্রমথ কি ভাবছে আমি পরিষ্কার বুঝতে পারছিলাম। না, চিঠিটা মিস্টার প্যাটেল নন, ওঁর হত্যাকারীই টাইপ করেছে। এটা আত্মহত্যা হতে পারে না, ইট গট টু বি এ মার্ডার। কিন্তু প্রমথ সেটা শুনে সন্তুষ্ট হল না।
“সামহাউ ইট লুকস টু অবভিয়াস,” এইটুকুই শুধু বলল।
“হোয়াট এলস কুড ইট বি, এনি আদার এক্সপ্লানেশন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“আই ক্যান থিঙ্ক অফ ওয়ান। ধর, এমন একজন লোক, যিনি নিজে বাঁচতে চান না, অথচ যারা ওঁর রোজগারের ওপর নির্ভর করে আছে, তাদেরও জলে ফেলতে চান না। এই অবস্থায় তিনি কি করতে পারেন?”
“আই ডোণ্ট আন্ডারস্ট্যান্ড।” আমি বললাম।

“বুঝতে পারছিস না! আমি বলতে চাচ্ছি যে, উনি সত্যিই সুইসাইড করতে চেয়েছেন, কিন্তু সেটা কেঊ ধরতে পারুক, সেটা উনি চান না। হি রিয়েলি ওয়ান্টেড ইট টু লুক লাইক এ মার্ডার। সেই কারণেই উনি এখানে এসে আত্মহত্যা করেছেন, আর সেই কারণেই উনি সুইসাইড নোট-এ সই করেন নি।”
“তাতে লাভ?”

“লাভ হচ্ছে যে সেক্ষেত্রে ইন্সিওরেন্সের টাকাগুলো যাদের জন্যে রেখে গিয়েছেন তারাই পাবে। সুইসাইড করলে ইন্সিওরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে কানাকড়িও জুটতো না। সেটাই হচ্ছে আইন। এবার বুঝতে পারছিস?” (পরে অবশ্য জেনেছি – প্রমথর এই ধারণা সম্পূর্ণ ঠিক নয়, সে কথা থাক।)
“তা পারছি। তবে অবাক লাগছে, ওঁর কথাবার্তা থেকে তুই কোনও ক্লু পাস নি যে উইনি সুইসাইড করার কথা ভাবছেন!”

প্রমথ একটু চুপ করে থেকে বলল, “এখন মনে হচ্ছে হয়তো পেয়েছিলাম। একটা কথা কাল রাত্রে উনি বলেছিলেন, যেটা খুবই খাপছাড়া। উনি হঠাৎ জিজ্ঞেস করেছিলেন, আমার কোনও উইল আছে কিনা। নেই শুনে বলেছিলেন, প্রত্যেকের উইল থাকা উচিত। ওয়ান মাস্ট বি প্রিপেয়ার্ড ফর ডেথ, দড়ির ব্যাপারটা তো ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকেই বলেছি। কিন্তু বলার সময় যেটা মনে পড়ে নি, সেটা হল বেরনোর আগে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, আর কিছু লাগবে কিনা। তখন উনি বলেছিলেন, “রাইট নাঊ, দ্যাটস অল আই নিড।” ‘রাইট নাউ’ কথাটাতে বেশ খানিকটা জোর দিয়েছিলেন। বুঝলি, এখন নিজেকে ভীষণ বোকা মনে হচ্ছে।” বিমর্ষ ভাবে প্রমথ বলল।

আমি প্রমথকে আশ্বস্ত করে বললাম, “দ্যাখ, আজ মিস্টার প্যাটেল মারা না গেলে, ওঁর এই কথাবার্তাগুলোতে আমরা কিছুই আবিষ্কার করতাম না। তুই দড়িও কিনিস নি আর সেই দড়িতে ফাঁস লাগিয়ে উনি আত্মহত্যাও করেন নি। উনি ব্যবহার করেছেন রিভলবার। ইন ফ্যাক্ট, উনি দড়ির খোঁজ কেন করছিলেন কে জানে!”
“আমার ধারণা স্যার, উনি দড়ি আনতে বলেছিলেন ওঁর স্যুটকেস দুটো বাঁধার জন্যে।”

আমি আর প্রমথ দুজনেই চমকে উঠলাম একেনবাবুর গলায়। কখন নিঃশব্দে উনি ঘরে ঢুকে পড়েছেন!
“সে কি, আপনি ঢুকতে পারলেন?” আমি বেশ আশ্চর্য হয়েই প্রশ্ন করলাম।

“নট টু ডিফিকাল্ট স্যার। ক্রেডিট কার্ডটা দরজা আর ফ্রেমের মাঝখানে ঢুকিয়ে যেখানে লকের মেটাল রডটা আছে – সেখানে চাপ দিলেই রডটা সরে যায়। আমি নিজেই সারপ্রাইজড স্যার!”

“মাই গুডনেস! দেখি কি করে ঢুকলেন?” প্রমথ উঠে দরজার দিকে গেল। আমি ওদের পেছন পেছন গেলাম। একেনবাবু গর্ব গর্ব মুখে একটা ডেমনস্ট্রেশন সিলেন। সত্যিই ব্যাপারটা খুব একটা শক্ত নয়।
“কি আশ্চর্য! এটা তো যে কেউ খুলতে পারে!” প্রমথ উদবিগ্ন হয়ে বলল।

“ তাই তো বলছিলাম স্যার, আমি নিজেই সারপ্রাইজড। কিন্তু যে-কথাটা বলছিলান স্যার, আমার ধারণা নাইলনের দড়িটা মিস্টার প্যাটেল স্যুটকেসের জন্যেই চেয়েছিলেন।”
“আপনি কি করে সেটা বুঝলেন?”
“আসুন স্যার, স্যুটকেস দুটো আপনাকে দেখাই।”

অবিনাশের বেডরুমে বিছানার ঠিক পাশে মেঝের ওপর পর পর দুটো স্যামসনাইট স্যুটকেস। কোনোটাই পুরোপুরি বন্ধ নয়। একেনবাবু বললেন, “আমি স্যার, অনেক সময় নিয়ে ভেতরে জিনিসগুলো গুছিয়েছি, এভরিথিং ইস জ্যাম প্যাকড। কিন্তু বন্ধ করার চেষ্টা করুন স্যার।”

আমি একটার ডালা ধরে চাপ দিলাম, প্রমথ অন্যটার। বন্ধ হল ঠিকই, কিন্তু তার জন্যে এতো জোরে চাপ দিতে হল যে আমার ভয় হচ্ছিল লকটা ভেঙ্গে খুলে আসবে। প্রমথকেও বার কয়েক চেষ্টা করতে হল ডালাটা বন্ধ করতে।
“আরেকটা জিনিস দেখাই স্যার। এই লেবেলটা দেখুন,” একেনবাবু স্যুটলেসে সাঁটা একটা লেবেল দেখালেন।
লেবেল-এ মিস্টার প্যাটেলের নাম ঠিকানা ইত্যাদি লেখা।
“কি আছে দেখার এর মধ্যে?” প্রমথ বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করল।

“এখানে একটা কালির পোঁচ পড়েছে খেয়াল করেছেন? কিন্তু দেখুন স্যার, মাঝখানে খানিকটা অংশ পরিষ্কার। দেখে মনে হয় না স্যার যে, ওই জায়গাটা দড়ি জাতিয় কিছু দিয়ে ঢাকা ছিল?”

“তারমনে আপনি বলতে চাচ্ছেন, মিস্টার প্যাটেল তাঁর সুইটকেস দড়ি দিয়ে বাঁধতেন এবং সেই জন্যেই দড়ির খোঁজ করছিলেন?”

“আমার তো সেরকমই সন্দেহ হচ্ছে স্যার। এত জিনিস ঢোকাতে হলে, আমি কোনও লককেই ট্রাস্ট করব না – সে যে কোম্পানিরই হোক না কেন স্যার।”

“হোল্ড অন!” প্রমথ বলল, “তাই যদি হবে, তাহলে তো মিস্টার প্যাটেলের মরার কোনও ইচ্ছেই ছিল না। দেশে যাবার জন্যে সত্যিই উনি প্রস্তুত হচ্ছিলেন!”

“আই উইল নট বি সারপ্রাইজিড স্যার।” একেনবাবু ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বললেন।
আমি আর প্রমথ চোখ চাওয়া চায়ি করলাম। কথার কোনও প্রয়োজন নেই। সুইসাইড নয়, ইট ইজ এ কেস অফ পিওর এন্ড সিম্পল মার্ডার!”

ছয়

সেই রাতে একেনবাবু প্রমথকে প্রায় জোর করে আমার অ্যাপার্টমেন্টে পাঠিয়ে দিয়ে নিজে নীচে প্রমথর ঘরে শুলেন। আমি অবশ্য সবাইকে ওপরে এসে শুতে বলেছিলাম। প্রমথ সোফায় শুতে পারত। কিন্তু একেনবাবুর মনে হল নীচে শুতে কোনও অসুবধাই নেই। ইন ফ্যাক্ট একবার মনে হল উনি যেন সেটাই চাইছেন। স্ট্রেঞ্জ!
শুতে পেলাম ঠিকই, কিন্তু ঘুমটা মোটেও ভালো মত এল না। জেগে-জেগে নানা রকমের শব্দ শুনলাম। আমি ভূতফুতে বিশ্বাস করি না। তবু মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, যে-লোকটা সকালেও জলজ্যান্ত ছিল, তার কি কোনও অস্তিত্বই আর নেই? প্রেতাত্মার এত গল্প যে শুনেছি – সবই কি ভুয়ো?

আসলে কাঠের বাড়িতে টেম্পারেচার চেঞ্জের জন্যে সবসময়ে এ ধরণের আওয়াজ হয়। আগে খেয়াল করলেও পাত্তা দিই নি। কিন্তু কিরিট প্যাটেলের মৃত্যু আর একেনবাবুর দরজা খোলার ডেমনস্ট্রেশনের ফলে প্রত্যেকটা আওয়াজেই জেগে জেগে উঠছিলাম। প্রত্যকটা শব্দেই মনে হচ্ছিল, হয় কোনও খুনী বাড়িতে ঢুকছে কিংবা কিরিট প্যাটেলের অতৃপ্ত আত্মা হেঁটে বেড়াচ্ছে! তারওপর পাশের বাড়ির কুকুরটা রাত্রে বেশ কয়েকবার সুর করে কেঁউ কেঁউ করেছে। কুকুররা শুনেছি অনেক কিছু দেখতে পায় ও শুনতে পায়, যেগুলো মানুষ পায় না। মানছি, এর আগেও ব্যাটা এরকম চেঁচিয়েছে। কিন্তু তখন তো … যাক সে কথা।

ভোর রাত্রে ঝিমুনি এসেছিল, অ্যালার্মে ঘুম ভাঙলো। প্রমথ দরজা বন্ধ করে তখনো ঘুমোচ্ছে। হাতমুখ ধুয়ে বাইরের ঘরে এসে দেখি একেনবাবু ডাইনিং টেবিলে একটা বিশাল বোলে পাহাড় করে সিরিয়াল ঢেলে দুধ-চিনি মিশিয়ে খাচ্ছেন। আমাকে দেখে বললেন, আপনারা ঘুমোচ্ছেন দেখে, ডিস্টার্ব না করেই ঢুকে পড়লাম। এই নিন স্যার, আপনার ক্রেডিট কার্ডটা। আপনি তো কাল ভুলে মেরে দিয়েছিলেন ফেরৎ নিতে।

আমি ক্রেডিট কার্ডটা ওয়ালেটে ঢুকোলাম, একেনবাবু মুড় মুড় করে সিরিয়াল খেতে খেতে বললেন, “ঘুম থেকে উঠলেই বড্ড খিদে পেয়ে যায় স্যার।”

আমি বিরক্ত হয়ে বললাম, “কি করে ঘুমোতে পারলেন আপনি? মিস্টার প্যাটেল মিস্টিরিয়াসলি ডেড, পসিবলি মার্ডারড। অ্যাপার্টমেন্ট ডোর ইজ ভার্চুয়ালি ওপন!”

“দ্যাটস ট্রু,” একেনবাবু চিবনোটা একটু থামালেন। “এনি ওয়ে স্যার, দ্য নাইট ইজ ওভার। আপনাকে একটা মামলেট করে দেব?”
“না, আমার খিদে নেই।“
“তাহলে স্যার আপনাকে একটা কফি বানিয়ে দিই। খুব বিধ্বস্ত লাগছে আপনাকে।”
আমি আপত্তি করতে যাচ্ছিলাম। একেনবাবু শুনলেন না।
“আপনি রিল্যাক্স করুন স্যার। আমি কফিটা বেশ বানাতে পারি।”

“তারজন্যে নয়, কিছুই ভালো লাগছে না আজ। রাত্রেও একদম ঘুমই নি। খালি ভাবছিলাম, কে মিস্টার প্যাটেলকে খুন করতে পারে? এভাবে খুন করে তার লাভটা কি?”

কফির জল চাপাতে চাপাতে একেনবাবু বললেন, “আপনি ধরে নিচ্ছেন কেন স্যার, কেঊ ওঁকে খুন করেছে। আমার তো মনে হয় আত্মহত্যাও একটা স্ট্রং পসিবিলিটি।”

“মোর স্ট্রং দ্যান মার্ডার? এর মধ্যে আবার আর কি ইন্ডিকেশন পেলেন যাতে মনে হয় উনি মরতে চেয়েছিলেন?”
একেনবাবু চেয়ারে এসে বসে সিরিয়ালের বোলটা সামনে টেনে নিলেন। মুড়মুড়ানির ফাঁকে ফাঁকে বললেন, “কাল বোধহয় স্যার, আমরা একটু বায়াসড হয়ে গিয়েছিলাম।”
“তার মানে?”

“লোকে যখন সুইসাইড করে – তখন কি অত র‌্যাশেনাল হয় স্যার?” আমি যখন কলেজে পড়তাম, আমার হস্টেলেরই এক ছেলে আমার ক্লাসনোট কপি করবে বলে নিয়ে গেল। কয়েক ঘন্টা বাদে শুনি, সে নাকি আত্মহত্যা করবে বলে অ্যাসিড খেয়েছে! মরতেই যদি চেয়েছিলি, তাহলে আমার ক্লাসনোট নিলি কেন? সে এক যাচ্ছেতাই ব্যাপার স্যার। সেই ক্লাসনোট আমি ফেরৎ পাই নি। ফলে পরীক্ষাটা…।”
“আপনার পয়েন্টটা কি?” আমি অসহিষ্ণু হয়ে বললাম।

“ও হ্যাঁ স্যার, যেটা বলতে চাচ্ছিলাম – অন্য পসিবিলিটিগুলোও ভাবুন। ফোনেও তো উনি কোনও দুঃসংবাদ পেতে পারেন? ধরুন, উনি জানতে পেরেছেন ওঁর ক্যান্সার হয়েছে – একেবারে ফাইন্যাল স্টেজ, বা জুয়ো খেলায় উনি সর্বস্বান্ত হয়েছেন, আরও কত কি? এইসব জেনে উনি আর বাঁচতে চান নি। এভরিথিং ইজ পসিবল স্যার, ঠিক কিনা?”
“তা বটে,” আমি স্বীকার করলাম। বলতে কি, একেনবাবুর ব্যাপার স্যাপার থেকে আমি বাস্তবিকই আশ্চর্য হয়ে যাচ্ছি! ক্রাইসিস অনেক সময় লোকের মধ্যে প্রচন্ড পরিবর্তন আনে। ওঁর বাজে বকা যে একদম কমেছে, তা বলতে পারব না, কিন্তু দুয়েকটা ইনসাইটফুল কথা বলে বেশ তাজ্জব করে দিচ্ছেন!

সকালে আমাকে একটু স্কুলে যেতে হল। দুপুরে যখন বাড়ি ফিরলাম প্রমথ তখন লাঞ্চ বানাচ্ছে। আমাকে দেখে হড়বড় করে খবর দিল, একেনবাবু নাকি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টকে ফোন করে জেনেছেন নিজের ছোঁড়া গুলিতেই মিস্টার প্যাটেলের মৃত্যু হয়েছে।। রিভলবারের ট্রিগারে যে ছাপ পাওয়া গেছে, সেটা ওঁর বাঁ হাতের ইনডেক্স ফিঙ্গারের সঙ্গে একদম মিলে গেছে। তার চেয়েও বড় কথা বাঁ হাতে বারুদের গঁড়ো পাওয়া গেছে, যেটা নাকি একমাত্র সম্ভব কেউ যদি নিজের হাতে গুলি ছোঁড়ে। সুতরাং কনক্লুশন হচ্ছে আমরা প্রথমে যেটা ভেবেছি তাই, সুইসাইড।
এরকম ভাবে পুলিশকে ফোন করা একমাত্র একেনবাবুর পক্ষেই সম্ভব! অবভিয়াসলি ওপন এন্ড শাট কেস। তদন্তের কাজ শেষ। তাই উত্তরটা একেনবাবু পেয়েছেন, নইলে কপালে ধমক জুটতো।
একেনবাবু প্রমথর পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। উনি যোগ করলেন, “লাকিলি স্যার, বিশেষ কষ্ট পান নি।”
প্রমথ সায় দিল। গুলিটা নাকি আড়াআড়ি ভাবে ঢুকে এদিক থেকে ওদিক চলে গেছে। ম্যাসিভ ব্রেন ড্যামেজ এন্ড অলমোস্ট ইনস্ট্যান্ট ডেথ।

লাঞ্চ খেতে খেতে মিস্টার প্যাটেলের কথাই বারবার আলোচনার মধ্যে এসে পড়ল। সবাই খুব ডিপ্রেসড বোধ করছিলাম। প্রমথ তো খাবার পর শুতেই চলে গেল, রাত্রে নাক ওর একদম ঘুম হয় নি! আমি সোফায় বসে ঝিমচ্ছি, একেনবাবু বললেন, “চলুন স্যার, কোথাও ঘুরে আসি। বাড়ি থেকে বেরোলে আপনার মনটা অন্তত একটু চাঙ্গা হবে।”
বেরোতে যে খুব ইচ্ছে করছিল তা নয়, আবার বাড়িতে থাকতেও ভালো লাগছিল না। জিজ্ঞেস করলাম, “কোথায় যাবেন?”

“চলুন না স্যার, আপনার সেই অ্যাস্ট্রলজার বন্ধুর কাছে।’
আমি একটু আসোয়াস্তি বোধ করলাম। প্রায় এক বছর কোনও যোগাযোগ নেই। কিন্তু একেনবাবুর ভীষণ ইচ্ছে ওঁকে একবার দেখেন। ওর এত উৎসাহ দেখে শেষ পর্যন্ত শৈলেন সাঁপুওকে ফোন করলাম। শৈলেন সাঁপুই আমার ফোন পেয়ে খুব খুশি। বললেন, “আরে সে কি কথা, আপনার পরিচিত – নিশ্চয় তাঁর গণনা করে দেব।”
একেনবাবু দেখি ভীষণ হাত পা নেড়ে ফিস ফিস করছেন, “চার্জ, চার্জটা জিজ্ঞেস করুন সয়ার।”
“ও হ্যাঁ, আপনার ফী-টা কি রকম?”
“দু-শো ডলার। কিন্তু আপনার বন্ধুর জন্যে কিচ্ছু লাগবে না। দরকারের সময় আপনি আমার জন্যে অনেক করেছেন। আই মাস্ট পে ব্যাক।”
“ওসব কেন বলছেন। সে যাই হোক, আপনার কখন সুবিধা?”
“আজই আসুন না সাতটা নাগাদ আমার অফিসে। প্রমথবাবুকেও নিয়ে আসবেন।”
আমি ডিরেকশনটা নিয়ে নিলাম। প্রমথ ঘুম থেকে উঠলে ওকে প্ল্যানটা বললাম। ও শুনে মন খারাপ করল। ওর আবার রাত্রে কি একটা সেমিনার।

সাত

শৈলেন সাঁপুই অবশ্য ম্যানহাটানে থাকেন না, থাকেন কুইন্সে। সময় হাতে নিয়েই বেরিয়েছিলাম। কিন্তু পথে একেনবাবুর কফি তেষ্টা পাওয়ায় পৌঁছতে পৌঁছতে সেই সাতটাই বাজল!
গ্লোব স্ট্রীটে ওপরে দোতলা একটা মাত্র। সদর দরজাটা খোলাই ছিল। ঢুকতেই একটা ছোট্ট ওয়েটিং রুম। ঘরটা ফাঁকা, রিসেপশানিস্ট ছাড়া আর একজনই শুধু বসে আছে। সেই লোকটির কাজ মিনিট দশেকের মধ্যে হয়ে যেতেই আমাদের ডাক পড়ল।

অফিসটা সত্যিই দেখার মত। মেহগনি কাঠের বিশাল একটা টেবিল, আর তার পাশে সাজানো মখমলের কুশন দেওয়া অ্যান্টিক চেয়ার, হার্ড উডের মেঝের ওপর একটা ইন্ডিয়ান কার্পেট পাতা। টেবিলের পেছনে কয়েকটা কাচের আলমারিতে নানান ধরণের কিউরিও সাজানো। ঘরের দুই কোণে কর্নার টেবিলে দুটো টিফানি শেড-এর ল্যাম্প। কিন্তু প্যানলের গাঢ় রং-এর জন্যে ঘরটা তাতে খুব একটা আলোকিত হয় নি। শৈলেন সাঁপুই দেখলাম একটু মোটা হয়েছেন। মুখ চোখেও বেশ একটা উজ্জ্বলতা। আবছা আলোয় গেরুয়া রঙের সিল্কের আলখাল্লা আর বিবেকানন্দ স্টাইলের পাগড়িতে ভদ্রলোককে বেশ অলৌকিক-অলৌকিক লাগছে। আমরা বসতেই শৈলেন সাঁপুই জিজ্ঞেস করলেম, “কফি চলবে তো?”

“আজ না, এক্ষুণি খেয়ে এলাম।” কথাটা বলে আমি একেনবাবুর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলাম। “এঁর কথাই ফোনে আমি বলছিলাম। আপনার কাছে ভাগ্য জানতে চান।”
শৈলেন সাঁপুই মাথাটা দোলাতে দোলাতে বললেন, “বেশ, বেশ গণনা নিশ্চয় হবে। চলুন, পেছনে আমার একটা প্রাইভেট অফিস আছে, সেখানে যাব। ব্যক্তিগত প্রশ্ন টশ্ন যদি থাকে…”
আমি বললাম, “তার কি দরকার, আমিই না হয় বাইরে যাচ্ছি।”

আমি উঠতে যাচ্ছিলাম, একেনবাবু বাধা দিলেন। “না স্যার না।“ তারপর শৈলেন সাঁপুইকে বললেন, “আসলে আপনার কথা প্রমথবাবু খুব বলছিলেন। আমি একটু পাজলড হয়ে গেলাম স্যার। দেশে অবশ্য ফরচুন নিয়ে অনেকেই…, কিন্তু তা বলে আমেরিকাতে, মানে আমি বলতে চাচ্ছি অ্যাস্ট্রলজি ব্যাপারটাকে আমি খুব সায়েন্টিফিক ভাবতাম না। কিন্তু এখানেও যখন এত ইন্টারেস্ট…সেই জন্যেই বাপিবাবুকে…।”
“টাইম আনলকড লাইফের কথা শুনেছেন?” শৈলেন সাঁপুই বক্কেশ্বরকে থামিয়ে বললেন।
“না স্যার।”

“সাধারণ মানুষরা টাইম-লকড জীবন যাপন করে। অর্থাৎ তারা সময়ের সঙ্গে বাঁধা। এই বন্ধন থেকে যদি মুক্তি পাওয়া যায়, তাহলে পাস্ট, প্রেসেন্ট, ফিউচার – যখন যেখানে খুশি চলে যাওয়া সম্ভব। তার জন্যে দরকার ব্রেন ওয়েভকে সুপার লাইট স্পিডে মুভ করানো। সে-যুগে আমাদের যোগীরা সেটা পারতেন। এ যুগে আর সে সাধনা কজন করেছে?”

একেনবাবুর মুখ দেখে মনে হল উনি সাক্ষাৎ ভগবান দর্শন করছেন। “দাঁড়ান স্যার, আপনি কি … মাই গড!”
“প্রমাণ চান?” শৈলেন সাঁপুই স্মিত মুখে জানতে চাইলেন।
“না, না স্যার, কি যে বলেন!” একেনবাবু লজ্জা পেলেন।

“না, প্রমাণ ছাড়া কিচ্ছু অ্যাকসেপ্ট করবেন না,” শৈলেন সাঁপুই মাথা নাড়লেন। “আমি তো একটা ফোর-টোয়েন্টিও হতে পারি, পারি না?”
“ছি ছি স্যার লজ্জা দেবেন না।”
“এক থেকে দশের মধ্যে একটা সংখ্যা ভাবুন।” শৈলেন সাঁপুই প্রায় আদেশের সুরেই বললেন।
“কেন স্যার?”
“আঃ, ভাবুন না!”
“ভেবেছি স্যার।”
“কি সেটা?”
“চার।”
“আচ্ছা, এবার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়ান, আর বসার কুশনটা তুলে ফেলুন।”
একেনবাবু দেখলাম ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে হুকুম মত কুশনটা উঠিয়ে ফেললেন।
“একটা কাগজ রয়েছে দেখেছেন?”
“হ্যাঁ স্যার।”
“ওটা তুলুন আর পড়ে দেখুন তো কি লেখা আছে?”
“আনবিলিভেবল, ট্রুলি ট্রুলি অ্যামেজিং স্যার।” মাথা চুলকোতে চুলকোতে একেনবাবু আমার দিকে কাগজটা এগিয়ে দিলেন।

দেখলাম পরিষ্কার লেখা ‘চার’। সঙ্গে সঙ্গে আমার মিস্টার ইন্দ্রজালের কথা মনে পড়ল।
“এটা কিন্তু ম্যাজিক নয়। এখানে বসে নম্বরটা লিখে এক মুহূর্তে অতদূরে কাগজ পাচার করা কোনও ম্যাজিশিয়ানের কম্ম নয়।” শৈলেন সাঁপুই যেন আমাকে উদ্দেশ্য করেই কথাটা বললেন।
মাই গড, উনি কি সত্যিই অন্তর্যামী! একেনবাবু দেখি তখনও মাথা চুলকে চলেছেন।
শৈলেন সাঁপুই একেনবাবুর দিকে তাকিয়ে ক্ষমাসুন্দর হাসি হেসে বললেন, “এ সিম্পল প্রসেস অফ ক্রসিং দ্য স্পিড অফ লাইট। আপনার কাছে যা ফিউচার, আমার কাছে তা পাস্ট।”
“তার মানে আপনি আগে থেকেই জানতেন, আমি কি ভাবব, কোথায় বসব…।”
শৈলেন সাঁপুই কথাটার কোনও উত্তর দিলেন না। ঘড়ির দিকে চট করে একবার তাকালেন। তারপর জিজ্ঞেস করলেন, “এবার বলুন, ঠিক কি জানতে আপনি এসেছেন?”
“যা কিছু দুয়েকটা ফিউচার বলে দিন স্যার। বিশেষ করে যে-কাজের জন্যে এসেছি, সেটা হবে কিনা।”
“শৈলেন সাঁপুই কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চোখ বুজলেন।

“হ্যাঁ, হবে। তবে বাধা আসবে প্রচুর। এ-বছরটা আপনার একটু অশান্তিতে কাটবে, তারপর বছর পনেরো অতি শুভ সময়। পনেরোর মাথায় একটা ফাঁড়া আছে, কিন্তু সেটা কাটিয়ে উঠবেন। আয়ু বিরাশি বছর। আমৃত্যু স্বাস্থ্য ভালো থাকবে – ওই ফাঁড়ার সময়টুকু ছাড়া। টাকা পয়সা প্রচুর রোজগার করবেন, তবে ধরে রাখতে পারবেন না। একটা পলা আপনাকে আমি ধারণ করতে বলব। ওটা আপনাকে অনেক সাহায্য করবে। যত তাড়াতাড়ি পারেন ততোই ভালো, বিশেষ করে এই সময়টাতে।”
“পলা! পলা কোথায় পাব স্যার?”

“যাওয়ার পথে রিসেপশানিস্টকে বলে যাবেন। ও আনিয়ে রেখে দেবে।”
“জ্যাকসন হাইটসের ইন্ডিয়ান জুয়েলারির দোকানগুলোতে পাওয়া যাবে কি?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
পাবেন, তবে সব জায়গায় খাঁটি জিনিস পাবেন না। একটা দোকান অবশ্য সাজেস্ট করতে পারি।”
“বলুন স্যার,” একেনবাবু পকেট থেকে তড়িঘড়ি একটা ডায়রি বের করে বললেন, “একটা পেন…।”
শৈলেন সাঁপুই নিজের পেনটা দিয়ে বললেন, “চন্দন জুয়েলার্স, জ্যাকসন হাইটসেই সেভেন্টিয়েথ স্ট্রীটের ওপর।”
“ঠিকানা?”

আমি বললাম, “ওটুকু জানলেই হবে। ইন্ডিয়ান দোকানগুলো সব পাশাপাশি।”
“এক্স্যাক্টলি, তাড়াতাড়ি যান। দোকান হয়তো এখনও খোলা পেয়ে যবেন। আমার নাম বলবেন, তাহলে সুপার কোয়ালিটির ভালো জিনিস দেবে।“ বলে শৈলেন সাঁপুই উঠে দাঁড়ালেন।
আমি বুঝতে পারলাম শৈলেন সাঁপুই আমাদের আর সময় দিতে চান না। আফটার আল আনপেড কাস্টমার।
চেয়ার থেকে উঠতে উঠতে বললাম, “অবিনাশকে মনে আছে আপনার?”
“বাঃ, মনে থাকবে না! কেমন আছেন উনি?”

“ও ইন্ডিয়াতে বেড়াতে গেছে। কিন্তু ওঁর মামা হঠাৎ সুইসাইড করেছেন। আর করেছেন আবার প্রমথর অ্যাপার্টমেন্টে বেড়াতে এসে।”
“সে কি!” শৈলেন সাঁপুই খুব অবাক হলেন।
“খুব আননার্ভিং এক্সপিরিয়েন্স। প্রমথ তো ভীষণ আপসেট।”
“সে তো বুঝতেই পারছি, কবে ঘটল ব্যাপারটা?”
“এই তো গতকাল।”
শৈলেন সাঁপুই দুঃখিত হয়ে মাথা নাড়লেন। “অবিনাশকে আমার কন্ডোলেন্স জানাবেন।”
“ফিরে এলে জানাব।”
বেরোবার পথে একেনবাবু রিসেপশানিস্টকে জিজ্ঞেস করলেন, একটা পলা অর্ডার করলে কালকে সেটা আনিয়ে দিতে পারে কিনা।
“কাল হবে না, শুক্রবার আমাদের অফিস বন্ধ থাকে। হাউ অ্যাবাউট স্যাটারডে?”
“না, থাক।”

গাড়িতে উঠে একেনবাবুকে বললাম, “জ্যাকসন হাইটস এখান থেকে খুব একটা দূরে নয়। কিন্তু দোকান এখনও খোলা থাকবে কিনা জানি না। চেষ্টা করে দেখব নাকি?”
“আপ টু ইউ স্যার? আপনার অসুবিধা না হলেই হল।”
“নো প্রব্লেম,” বলে আমি কুইন্স বুলেভার্ডে টার্ন নিলাম।
কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর একেনবাবু বললেন, “মিস্টার সাঁপুইয়ের অফিসটা খুব ইম্প্রেসিভ।”
প্রশ্ন নয় স্টেটমেন্ট। তাই জবাব দিলাম না।”

“ওঁর ঘরের কার্পেটটা খেয়াল করেছিলেন স্যার। কাশ্মীরের তৈরি, দারুন ইনট্রিকেট ডিসাইন। আমাদের দেশেই ওর দাম কম-সে-কম এক লাখ টাকা। এখানকার হিসেব অবশ্য জানি না।”
কার্পেটের দাম সম্পর্কে আমার কোনও ধারণাই নেই, তাই চুপ করে রইলাম।
“পিতলের বুদ্ধমূর্তি হয় টিবেট অথবা নেপাল থেকে আনা। ওর দামও ধরুন হাজার দশেক হবে।”
“আপনি বসে বসে এত সব লক্ষ করেছেন!”
“কি করব স্যার, আমার চোখ চলে যায়।”

“আচ্ছা বলুন তো ওঁর হাতঘড়িটা কি ছিল?” ওই একটা জিনিসই আমি লক্ষ করেছিলাম হাত বাড়িয়ে যখন একেনবাবুকে পেন দিচ্ছিলেন। নিতান্ত কদিন আগে মেসিজ-এ দামি ঘড়ির মধ্যে রোলেক্স-এর ওই ব্র্যান্ডটা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলাম বলেই মনে ছিল।
“আপনি এবার আমার পরীক্ষা নিচ্ছেন স্যার।” একেনবাবু লজ্জা পেয়ে বললেন।
“আহা, বলুনই না।”

“মনে হল স্যার রোলেক্স। সেদিনই তো ওই ব্র্যান্ডটা দেখলাম স্যার মেসিজ-এ।”
“মাই গুডনেস, আপনি তো পেনটা নিতেই ব্যস্ত ছিলেন, তাও চোখে পড়েছে! আমি সত্যিই অবাক হলাম। “আর কি দেখলেন, বলুন।”
“এবার আপনি স্যার ঠাট্টা করছেন।”

জ্যাকসন হাইটসে পৌঁছে দেখি জুয়েলারি স্টরগুলো সব বন্ধ হয়ে গেছে। সন্ধ্যায় জায়গাটা খুব নিরাপদ নয়, তাই বোধহয় খোলা রাখে না। ফিরব বলে গাড়ি ঘোরাচ্ছি, একেনবাবু বললেন, “আচ্ছা স্যার, মিস্টার প্যাটেল তো এদিকেই

কোথাও থাকতেন, তাই না?”
“আপনি কি করে জানলেন?”
“প্রমথবাবু কাল বলছিলেন সেভেটিফিফথ স্ট্রীটে ওঁর অ্যাপার্টমেন্ট, তাই মনে হল।”
“ইউ আর রাইট। আর তিনটে স্ট্রীট পরেই একটা অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্স আছে, সেখানে থাকতেন।”
“একবার ওখানে থামবেন?”
আমি আশ্চর্য হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কেন বলুন তো?”
“আমার মাথায় একটা খটকা লেগেছে – সেটা ক্লিয়ার করে নিতাম।”
“কি খটকা?”
“চলুন না স্যার?”

আরও নিশ্চয় একেনবাবুকে খোঁচাতে পারতাম, কিন্তু খোঁচালাম না। মিস্টার প্যাটলের বাড়িতে আমি আগে দুয়েকবার গেছি। দূরে নয়, কয়েক মিনিটের পথ। আমার অবশ্য জনতে ইচ্ছে করছিল একেনবাবুর খটকাটা ঠিক কি, আর কেনই বা একেনবাবু সেটা সাসপেন্সে রাখতে চান! তবে জিনিসটা এতোই মামুলি হবার সম্ভাবনা, খুব উৎকণ্ঠিত বোধ করলাম না।

আট

মিস্টার প্যাটেলের অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটা বিশাল। সামনের পার্কিং লট-এ গাড় পার্ক করতে করতে বললাম, “এবার বলুন তো আপনার খটকাটা কি?”

একেনবাবু আমার প্রশ্ন শুনলেন কিনা কে জানে ! দেখলাম মাথা ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিকে তাকাচ্ছেন। হঠাৎ আমার হাতে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে বললেন, “স্যার, তাড়াতাড়ি নামুন, নইলে চান্স মিস করব।”
আমি আচমকা টান খেয়ে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “কি চান্স?”

একেনবাবু গলা নামিয়ে, “দেখছেন না স্যার, লোকটা এগোচ্ছে! আর দেরি নয়, চট করে নেমে পড়ুন, প্লিজ।”
কার কথা বলছেন উনি! আমি তো কোথাও কোনও সন্দেহজনক ক্যারেক্টার খুঁজে পেলাম না। থাকার মধ্যে শুধু একটা বেঁটে-খাটো আমেরিকান সাহেব বাজারের ব্যাগ হাতে অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিং-এর দিকে যাচ্ছে। এই ঠাণ্ডায় আমার একদম নামতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু একেনবাবু এতো ছটফট করতে লাগলেন যে শেষে খানিকটা উত্ত্যক্ত হয়ে নেমে পড়লাম। একেনবাবু আমার হাত ধরে প্রায় টানতে টানতে সাহেবের পিছু নিলেন।

সাহেব চাবি দিয়ে বিল্ডিং-এর দরজাটা খুলতেই একেনবাবু টুক করে ঢুকে পড়লেন। তারপর এলিভেটর ধরে সোজা তিনি তলা। আমি যে কেন ওঁর পেছন পেছন গেলাম নিজেই জানি না। এতক্ষণ সাহেব সামনে ছিল বলে একটা কথাও বলি নি। এলিভেটর থেকে বেরিয়েই আমি বললাম, “আচ্ছা, আপনার মাথায় কি ঘুরছে বলুন তো?”

“এক্ষুণি ক্লিয়ার হয়ে যাবে স্যার।” উনি হাঁটতে হাঁটতে বললেন, “আমাদের যেতে হবে তিনশো চার নম্বরে। তিনশো …তিনশো দুই…এই তো তিনশো চার। দেখুন স্যার মিস্টার প্যাটেলের নামও লেখা আছে।”

আমি কেমন একটু কনফিউসড হয়ে গেলাম। জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি কি করে জানলেন মিস্টার প্যাটেল কোনা অ্যাপার্টমেন্টে থাকতেন?”

“বাঃ স্যার, আপনার মনে নেই – ওঁর ঠিকানা তো স্যুটকেস দুটোর ওপরেই লেখা ছিল!”
“তা না হয় ছিল, কিন্তু কি করতে চান আপনি?”
“আমি একটূ ঢুকবো স্যার।”

“ঢুকবেন মানে!” আমি ভীষণ ভয় পেয়ে বললাম, “সেটা তো ব্রেকিং এন্ড এন্টারিং, ধরা পড়লে কত বছরের জেল হবে এদেশে জানেন?”

“স্যার, আমি যাব আর আসব। একদম ঘাবড়াবেন না। ভয় করলে আপনি বরং দাঁড়িয়ে থাকুন, নয় গাড়িতে গিয়ে বসুন।”

ভয় আমি পাচ্ছিলাম ঠিকই। কিন্তু একা হলওয়েতে দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকা, বা নীচে গাড়িতে আধা-অন্ধকারে বসে থাকা – কোনওটাই খুব প্রীতিপ্রদ মনে হল না। একেনবাবু ইতিমধ্যে পকেট থেকে একটা স্ক্রু ড্রাইভার মত জিনিস বার করে চাবির মত সেটা দরকার লকে ঢুকিয়েছেন! কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে খুট করে দরজাটা খুলে গেল। আমি দ্রুত গতিতে মনে মনে হিসেব করলাম – এ ধরণের বিল্ডিং-এ পেছনের জানলায় সব সময়ে একটা ফায়ার এসকেপ থালে। কেউ হঠাৎ এসে পড়লে সেখান দিয়ে পালানো যেতে পারে। আমি শুধু চাপা গলায় বললাম, “হয় আপনি জানেন কি করছেন, নয় পুরোপুরি বেপরোয়া ক্রেজি! ধরা পড়লে দশ বছরের জেল – খেয়াল আছে? এখনও সময় আছে, চলুন, কেটে পড়া যাক।”

একেনবাবু আমার হাতে একটা চাপ দিয়ে বললেন প্রায় ফিসফিসিয়ে বললেন, “চুপ স্যার, আর কথা নয়। জাস্ট মিনিট কয়েক, তার বেশী লাগবে না। আর সাবধান, কোনও কিছু টাচ করবেন না।” বলতে বলতেই পকেট থেকে দুটো প্লাস্টিকের গ্লাভস পরে নিয়েছেন।

অ্যাপার্টমেন্টটা খুবই ইমপ্রেসিভ। কারিস্তান কার্পেট, মার্বেল ফ্লোরের কিচেন, দামি কাউন্টার টপ, দরজা জানলাগুলোর ফিনিশ তাকিয়ে দেখার মত! ঘরের আসবাবপত্রগু্লো কিন্তু তার সঙ্গে খাপ খায় না। বাইরের ঘরে পুরনো সস্তা একটা সোফাসেট আর ভাঙ্গা কফি টেবিল – ব্যস!

ভিসিটার্স ক্লজেটে কয়েকটা কোট আর ওভারকোট ঝোলানো । একেনবাবু সেগুলোর পকেট একটু হাতড়ে বাথরুমে ঢুকলেন। বাথরুমে সিঙ্কের ওপর হাতল ভাঙা একটা পুরনো কাপের ওপর রাখা একটা টুথব্রাশ, সঙ্গে যে টুথপেস্টের টিউব, তাতে প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই। মেডসিন ক্যাবিনেটে অ্যাসপিরিন, টাইলানল আর ওই জাতীয় কয়েকটি ওষুধের বোতল।

বাথরুমের পাশেই কিচেন। সেখানে ঢুকে একেনবাবু রেফ্রিজারেটর খুললেন। দুধ, মাখন, অরেঞ্জ জুস, চীজ – সব কিছুই চোখে পড়ল। এ ছাড়া কয়েকটা প্লাস্টিকের কৌটোয় খাবার তৈরি করে রাখা। ভেজটেবল ট্রেটাও ফাঁকা নয়, কিছু তরকারি পড়ে আছে।

মিস্টার প্যাটেলের বেডরুমটা আমার বেডরুমের প্রায় দ্বিগুণ। বেডরুমের ফার্নিচার বলতে একটা ডাবল বেড, চেস্ট অফ ড্রয়ার্স আর নাইট টেবিল। একটা বড় আয়না দেওয়ালে আটকানো। নাইট টেবিলে একটা ছবি – এক বৃদ্ধ মহিলার সাথে মিস্টার প্যাটেল। মুখের আদল দেখে মনে হয় মা। মাস্টার বেডরুমের সঙ্গে লাগোয়া বাথরুমটা মনে হল ব্যবহার করা হয় না।

দ্বিতীয় বেডরুমটা মনে হল অফিস গিসেবে ব্যবহার করা হত। কাঠের ছোট টেবিল, তার ওপর কয়েকটা থ্রি-রিং বাইন্ডার সাজানো। একটা ট্রে-তে ‘জেমস ইন্ডিয়া’ ছাপা চিঠির কাগজ। ডেস্ক ড্রয়ারে শ্রী মদ্ভাগবত গীতার ইংরেজি ট্র্যান্সলেশন আর কিছু অফিস স্টেশনারি।

আমি অধৈর্য হয়ে একেনবাবুর হাত ধরে টান দিয়ে চাপা স্বরে বললাম, “এবার চলুন।”

একেনবাবু কৌতুহল বোধহয় ফুরিয়েছে। আমার সঙ্গে দরজার দিকে এগোলেন। হঠাৎ কি খেয়াল হল, দাঁড়িয়ে থেমে ক্লজেটের দরজাটা খুললেন। ক্লজেটটা ফাঁকা, শুধু নীচে একটা লম্বা কার্ডবোর্ডের বাক্স খবরের কাগজে ভর্তি। কয়েকটা খবরের কাগজ সরাতেই বেরিয়ে পড়ল অনেকগুলো বাঁধানো খাতা। প্রত্যেকটা ওপর তারিখ লেখা। সবচেয়ে পুরানোটা হল ১৯৮১ সালের। খাতাগুলো ডায়রি, অ্যাড্রেসবুক, আপয়েন্টমেন্ট ক্যালেন্ডার – সবকিছু। একেনবাবু ১৮৮৯-৯০ লেখা খাতাটা তুলে নিয়ে বললেন, “চলুন স্যার, যাওয়া যাক।”

নীচে নেমে একেনবাবু মিস্টার প্যাটেলের মেলবক্সের ফুটো দিয়ে ভেতরে তাকালেন। তারপর আবার সেই স্ক্রু ড্রাইভার টাইপের জিনিসটা বার করছেন দেখে, আমি একেনবাবুকে সাবধান করলাম, “মশাই, অন্যের মেলবক্সে হাত দেওয়া কিন্তু এদেশে ফেডারেল অফেন্স – অনেক বছরের জেল।”

একেনবাবু এদিক ওদিক তাকিয়ে টুক করে বাক্সটা খুলে ফেললেন। উনি যখন চিঠিগুলোতে চোখ বুলোচ্ছেন, আমি দেখলাম একজন পার্কিং লট থেকে বিল্ডিং-এর দিকে আসছে।

“হারি-আপ। কেউ আসছে,” বলেই আমি কোনও দিকে না তাকিয়ে বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে। এই প্রথম খেয়াল করলাম বুকটা কি ভীষণ ধুকপুক করছে।

একেনবাবু এলেন একটু পরে। দ্রুত গতিতে লট থেকে বেরিয়ে বড় রাস্তায় গাড়িটা নামিয়ে এনে আমি একেনবাবুকে এক চোট ঝাড়লাম। “আপনি কি সুরু করেছেন বলুন তো! শখের গোয়েন্দাগিরি করে কি জেলে যেতে চান?”
“ধরা তো পড়ি নি স্যার,” একেনবাবু একটা মোক্ষম আর্গুমেন্ট দেওয়ার চেষ্টা করলেন।
“এটা কোনও যুক্তি হল! আপনার জন্যে আজ আমরা ফেডারেল, স্টেট, কাউন্টি, সিটি – সব কটা পেনাল কোডই বোধহয় ভায়লেট করেছি। হোয়াট আই স্টিল ডোন্ট আন্ডারস্ট্যান্ড – ইজ ফর হোয়াট?”
“আপনি রেগেছেন স্যার।”
“আলবাত রেগেছি। ইন্ডিয়াতে যে সব চলে, এখানে সেগুলো চলে না। পুলিশ একবার ধরলে, ইনফ্লুয়েন্স দিয়ে কোনও কাজ হয় না। ইউ শুড আন্ডারস্ট্যান্ড দ্যাট।”
একেনবাবু বকুনি খেয়ে কাঁচুমাচু হয়ে চুপ করে রইলেন।
এরকম ভাবে সাধারণত আমি কথা বলি নয়া। নিজেরই খারাপ লাগল। বললাম, “আমার বিরক্তি লাগছে লাগছে কেন জানেন – এই যে অনর্থক রিস্কটা নিলেন, কি হাতিঘোড়া দেখলেন ওখানে?”
“খুব কনফিউসিং স্যার।”
“কনফিউসিং!”
“হ্যাঁ স্যার। মিস্টার প্যাটেল প্রমথবাবুর কাছে আসার অন্তত তিন চারেক আগে বাড়ি ছেড়েছেন; সেটাই খুব কনফিউইসিং।”
“আপনি সেটা বুঝলেন কি করে!”

“ফার্স্ট ক্লু স্যার, রেফ্রিজারেটার থেকে। ভেবে দেখুন রেফ্রিজারেটরে যে পরিমাণ দুধ, কাঁচা সবজি আর খাবার দেখলাম, তা কখনোই দিন দুয়ের মধ্যে শেষ করা সম্ভব নয়। অথচ মিস্টার প্যাটেলের আজকেই ইন্ডিয়া রওনা দেবার কথা ছিল। যিনি এত কৃপণ, মানে বাড়ির জিনিসপত্রগুলো দেখে বলছি, তিনি হঠাৎ এত খাবার নষ্ট করে চলে যাবেন।

চরিত্রের সঙ্গে ঠিক খাপ খায় না – তাই না স্যার?”
দ্যাটস ট্রু, কিন্তু উনি হয়ত খাবারগুলো কাউকে দিয়ে যাবার প্ল্যান করেছিলেন।”
“আমারও সেটা একবার মনে হয়েছিল স্যার, সেইজন্যেই মেলবক্সটা খুললাম। বাক্সে নিউ ইয়র্ক থেকে পোস্ট করা দুটো চিঠি ছিল, দুটোতেই ডেট স্ট্যাম্প ছিল ১২ ফেব্রুয়ারির। আজ স্যার ২০ তারিখ, তাই না?”
নাঃ। একেনবাবুর এলেম আছে মানতে হবে। তবু বললাম, “হয়তো আর কাউকে বলে গিয়েছিলেন, খাবারগুলো নিয়ে যেতে। চিঠিও হয়তো সেই নিয়ে যেত।”

“হতে সব কিছুই পারে। তবে খটাকা লাগছে এইজন্যে স্যার, উনি প্রমথবাবুকে বলেছিলেন, হিটিং কাজ করছিল না বলে উনি প্রমথবাবুর কাছে চলে এসেছেন। কিন্তু উনি বাড়ি ছেড়েছিলেন বেশ কয়েকদিন আগে। মিথ্যে বললেন কেন

স্যার?”
এর উত্তর আমার জানা নেই।
“আরও একটা ব্যাপার কনফিউসিং স্যার।”
“কি বলুন তো?”

“এরকম একজন কঞ্জুস লোক, এত দামি অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলেন কেন?”
এর উত্তরটা আমার জানা ছিল। বললাম, “এটা ভাড়া বাড়ি নয়, এগুলো সব কন্ডোমোনিয়াম, অর্থাৎ কেনা অ্যাপার্টমেন্ট। নিউ ইয়র্কে বাড়ির দাম যে রেট-এ বাড়ছে, বাড়ি কেনা একটা চমৎকার ইনভেস্টমেন্ট।”
“তাই বলুন স্যার। ভারি খটকা লাগছিল।

নয়

আমরা বাড়ি পৌঁছিলাম প্রায় ন’টা নাগাদ। অ্যাপার্টমেন্টে ঢুকে দেখি টেলিফোন অ্যানসারিং মেশিনের মেসেজ লাইটটা জ্বলছে আর নিবছে, অর্থাৎ কেউ ফোন করে মেসেজ রেখেছে। মেসেজ-এর বোতামটা টিপতেই প্রমথর গলা রেকর্ডিং-এ শুনলাম – ‘সোয়া ন’টায় ফিরব। রান্না করিস না, একসঙ্গে পিৎসা খেতে যাব।’
একেনবাবুকে মেসেজটা দিয়ে আমি নোংরা জামাকাপড়গুলো ওয়াশিং মেশিনে চাপাতে নীচে বেসমেন্টে গেলাম। ফিরে এসে দেখি একেনবাবু নিবিষ্ট মনে একটা চিঠি পড়িছেন। আমাকে দেখে চিঠিটা এগিয়ে দিয়ে বললেন, “ভেরি ইন্টারেস্টিং স্যার।”

সংক্ষিপ্ত চিঠি। নামধাম সম্বোধন কিছুরই বালাই নেই। টাইপ রাইটারে ছাপা :
Mary owns one nice stone
Sounds music to my ear!
I must have it, else Mary dies.
এ আবার কি ধরণের হেঁয়ালি?
“কোথায় পেলেন এটা?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“মিস্টার প্যাটেলের মেলবক্সে ছিল। খামটার ওপর শুধু অ্যাপার্টমেন্ট নম্বরটা দেখে কৌতুহল জেগেছিল স্যার, তাই নিয়ে এসেছিলাম।”
“আমি তো এর মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। হু ইজ মেরি?”

“আমিও প্রথমে সেটাই চিন্তা করছিলাম স্যার। এখন মনে হচ্ছে মেরির কোনও অস্তিত্বই নেই। মেরি সম্ভবত মিস্টার প্যাটেল।”
“সেটা কি করে বুঝলেন?”

“মেরির কাছে একটা পাথর আছে, চিঠিটা যে লিখেছে তাকে ওই পাথরটা পেতেই হবে। যদি না পায়, তাহলে মেরির মৃত্যু হবে। আর চিঠিটা ছিল মিস্টার প্যাটেলের মেলবক্সে। সুতরাং …”

“ও মাই গড! মিস্টার প্যাটেল যখন ডায়মন্ড মার্চেন্ট ছিলেন, স্টোন মানে নিশ্চয় একটা হিরে।”
“তাই তো মনে হয় স্যার। প্রশ্ন হচ্ছে, কোন হিরের কথা চিঠিতে বলা হচ্ছে। আরও একটা ক্লু মনে হয় এখানে আছে?”
“কি সেটা?”
“প্রথম লাইনের প্রত্যেকটা ওয়ার্ডের প্রথম লেটারগুলো পড়ুন স্যার।”
“এম ও ও এন… মুন। তারমানে মুনস্টোন?”

“এক্স্যাক্টলি স্যার। মিস্টার প্যাটেলের কাছে নিশ্চয় একটা দামি মুনস্টোন ছিল, আর সেটারই কারোর খুব দরকার হয়ে পড়েছিল।”

চিঠিটার আসল মানে যাই হোক না কেন, মানতে হবে একেনবাবুর কল্পনা করার ক্ষমতা আছে। কিন্তু একেনবাবুর অ্যানালিসিস যদি ঠিক হয়, তাহলে আই মাস্ট হ্যাভ ইট…এলস মেরি ডাইজ, সর্বনাশ! তার মানে তো মিস্টার প্যাটেলের মৃত্যুর সঙ্গে এই চিঠির একটা যোগও থাকতে পারে! কিন্তু তা কি কিরে হয়? না, সেটা অসম্ভব – মিস্টার প্যাটেল তো করেছেন আত্মহত্যা! তবু কেন জানি আমার বুকটা ছ্যাৎ করে উঠল।
“আপনার কি মনে হচ্ছে, মিস্টার প্যাটেলের মৃত্যুর সঙ্গে এই চিঠির কি কোনও যোগ আছে?” একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করলাম।

একেনবাবু আমার প্রশ্নের উত্তর করলেন না। “আচ্ছে স্যার, আপনার কাছে বাইনোকুলার আছে কি?”
একেনবাবুর কথার পারম্পর্য নিয়ে আগে কখনও মাথা ঘামাই নি। পাগলে কিনা বলে ছাগলে কিনা খায়! কিন্তু আজ সন্ধ্যা থেকে একেনবাবুর গোয়েন্দাগিরির বহর দেখে হঠাৎ একটা শ্রদ্ধাভাব এসে গিয়েছিল। এই প্রশ্নে সেটা একটু চিড় খেল।

“আছে, কেন বলুন তো?”

এমন সময় বাইরের দরজায় বেল বাজল। একেনবাবু হঠাৎ আমাকে অবাক করে বললেন, “স্যার, আজকে মিস্টার প্যটেলের বাড়ি যাওয়ার ব্যাপারে কারোর সঙ্গে আলোচনা করবেন না। এমন কি প্রমথবাবুর সঙ্গেও নয়, প্লিজ।”
একেনবাবুর এই সতর্কবাণীর কোনও অর্থ আমি পেলাম না। কিন্তু এখন প্রশ্ন তোলার সময় নেই। বললাম, “ঠিক আছে।”

বেল বাজাচ্ছিল প্রমথ। ঢুকেই তাড়া লাগাল,”চল, চল, খিদেতে পেট জ্বলছে। খেতে খেতে তোদের একটা ইন্টারেস্টিং ব্যাপার বলব।”

আমাদের রাস্তার মোড়ে টমির পিৎসা পার্লার। সেখানে একটা কর্নার টেবিল ম্যানেজ করে দুটো বড় পিৎসার অর্ডার দিলাম।

প্রমথ বলল, সন্ধ্যার সময় মিস্টার প্যাটেলের একটা ফোন এসেছিল।”
“কার কাছ থেকে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“নাম বলল, স্যাম ফ্রম লং আইল্যান্ড।”
“তারপর?”

“মিস্টার প্যাটেল মারা গেছেন শুনেও ব্যাটা মানতে চায় না। বলল, ‘আমি কিরিট প্যাটেলের কথা বলছি, তাঁকে ফোনটা দিন। ‘ আমি বললাম, ‘আমিও তাঁর কথা বলছি।’ এই শুনে একটা কথা না বলে লাইন ছেড়ে দিল।”
“ইন্টারেস্টিং। মিস্টার প্যাটেল তোকে বলেছিলেন খবরটা কাউকে না জানাতে, কিন্তু লোকটা অবভিয়াসলি জানত, মিস্টার প্যাটেলকে তোর নম্বরে পাওয়া যাবে।”

“মিস্টার প্যাটেলই নিশ্চয় নম্বরটা দিয়েছিলেন, কিংবা ব্রিজ শাহ-র কাছ থেকে পেয়েছে – কে জানে!” প্রমথ বলল।
“আচ্ছা স্যার, শৈলেন সাঁপুই যদি আগে থেকেই জানতেন, আমি কি ভাবব বা বলব, তাহলে আপনি যখন মিস্টার প্যাটেলের মৃত্যুর খবর দিলেন, তখন উনি আশ্চর্য হলেন কেন? সেটাও তো ওঁর জানা উচিত ছিল।”
প্রমথ ব্যাপারটা জানত না বলে অবাক হয়ে আমার দিকে তাকাল।

আমি একেনবাবুকে বললাম, “আপনার ভক্তিতে একটু চোট লেগেছে মনে হচ্ছে। প্রশ্নটা এখন আমাকে না করে ওঁকে করলেই পারতেন।”

“তখন খেয়াল হয় নি স্যার।”
প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “কেসটা কি ?”
তখন শৈলেন সাঁপুইয়ের গল্পটা করলাম।
“তোরা বুঝি ওখানেই কাটালি সন্ধ্যেটা?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।

বলা উচিত ছিল, ‘না’। কিন্তু একেনবাবুর অনুরোধ রাখতে কিরিট প্যাটেলের অ্যাপার্টমেন্টে-অভিযানটা চেপে গেলাম – যদিও ‘হ্যাঁ’ বলতে নিজেকে খুব অপরাধী লাগল।

খাওয়াদাওয়ার পর বাড়ি ফিরে সোফায় বসতেই বুঝলাম, কি ভীষণ টায়ার্ড হয়ে আছি! প্রমথ আজকেও উপরে শোবে বলে চলে এল। সোফায় শোবার প্ল্যান করছিল, কিন্তু একেনবাবু শুনলেন না। জোর করে নিজের ঘরে প্রমথকে পাঠিয়ে আমার কাছ থেকে বাইনোকুলারটা নিয়ে নীচে প্রমথর অ্যাপার্টমেন্টে শুতে গেলেন। আমি কিছুক্ষণ বই পড়ার ব্যর্থ চেষ্টা করে বিছানায় চিৎপাত হলাম।

পরদিন ঘুম থেকে উঠে দেখি প্রমথ নেই। নিশ্চয় সাত-সকালে এক্সপেরিমেন্ট ছিল, স্কুলে গেছে। হাতমুখ ধুয়ে একেনবাবুকে ফোন করতে যাচ্ছি, এরমধ্যেই একেনবাবু সশরীরে উপস্থিত।
“আপনি নিশ্চয় টেলিপ্যাথি জানেন, এক্ষুণি আপনাকে ফোন করতে যাচ্ছিলাম।”

একেনবাবু হাসি হাসি মুখে বললেন, কাঠের বাড়িতে এটাই স্যার সুবিধা, ওপরের তলায় কি হচ্ছে না হচ্ছে নীচের তলা থেকে দিব্বি বোঝা যায়। আপনি ঘুম থেক উঠে মুখ ধুয়ে বাইরের ঘরে এলেন, আর আমিও চলে এলাম।”
“ভালো করেছেন। কিন্তু আজলে আপনাকে একটু উৎফুল্ল মনে হচ্ছে।”

“মর্নিং-এ আমি সব সময়েই ফ্রেশ থাকি স্যার, তবে আজকে একটা বিশেষ কারণও আছে।” একেনবাবু ঘাড় চুলকোতে চুলকোতে বললেন।
“কারণটা কি জানতে পারি, না সেটা গোপনীয়?”
“কি যে বলেন স্যার, নিশ্চয় পারেন। নীচে চলুন, দেখাচ্ছি।”
“এই সক্কাল বেলা কি আবিষ্কার করলেন?”
“আসুন না স্যার।”

নীচে যেতেই একেনবাবু আমার হাতে বাইনোকুলারটা ধরিয়ে দিয়ে কিচেনের জানলার সামনে নিয়ে গেলেন।
“সামনের বাড়ির জানলার একটু নীচে বাঁ দিকে তাকিয়ে দেখুন তো স্যার, কিছু দেখতে পাচ্ছেন কিনা।”
আমি বাইনোকুলারে চোখ রাখলাম। দূরের জানলাটা খুব কাছে এসে গেল। দেওয়ালের রঙটা হালকা খয়েরি। জানলার ঠিক নীচে সম্ভবত বৃষ্টির জলের জন্যে কিছুটা অংশ কালচে হয়ে গেছে। সেই কালচে অংশের এক পাশে মনে হল একটা ফুটোর মত কিছু। তাছাড়া আর কিছু চোখে পড়ল না।

“কিছুই তো দেখলাম না, কি দেখব?” আমি বুঝতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম।
একেনবাবু আমার পর্যবেক্ষণের ক্ষমতা দেখে বোধহয় হতাশ হলেন।
“নাঃ, আপনি একদম খেয়াল করছেন না! যাইহোক একটা মই জোগাড় করতে পারেন স্যার?”
“মই! মই দিয়ে কি করবেন?”
“কাছে গিয়ে একটু পরীক্ষা করতাম স্যার।”
“আপনি কি মশাই ক্ষেপে গেকেন! এই শীতে মই বেয়ে উঠতে গিয়ে কি হাত-পা ভাঙতে চান?”
“স্যার, আপনি ঠিক বুঝছেন নয়া, ইট ইজ ভেরি ইমপর্টেন্ট।”
“কি এতো ইমপর্টেন্ট?” আমি বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“আগে মইটা জোগাড় করুন স্যার, প্লিজ ‘না’ করবেন না।”
“আপনি তো মহা ঝামেলা পাকালেন, কোথায় পাব এখন মই!”

গজগজ করলাম বটে, কিন্তু লোকটা যে পুরোপুরি ক্ষ্যাপা নয়, সেটা এতদিনে বুঝে গেছি। একতলায় অ্যাপার্টমেন্ট ম্যানেজারের কাছে একটা মই ছিল। সে সবে ঘুম থেকে উঠে কফি খাচ্ছিল। প্রথমে দিতে চাচ্ছিল না। ওর ভয় পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙলে ওর বিরুদ্ধে মামলা ঠুকবো। অনেক তুইয়ে বুইয়ে শেষ পর্যন্ত ম্যানেজ করা গেল। অ্যালুমিনিয়ামের হালকা মই। একেনবাবু নিজেই কাঁধে করে নিয়ে পাশের বাড়ির জানলার ধারে লাগালেন। ভাগ্যিস ঐ বাড়িতে কোনও ভাড়াটে নেই, নইলে মই লাগিয়ে জানলার দিকে কেউ উঠে আসছে দেখলে থানা-পুলিশ হত। আমি নীচ থেকে পরিষ্কার সবকিছু দেখতে পাচ্ছিলাম না, তবে মনে হল একেনবাবু পকেট থেকে কিছু একটা বার করে দেয়ালে খোঁচাখুঁচি করছেন।

এদিকে আমার ধৈর্যচ্যুতি হচ্ছে। বললাম, “কি, আপনার গবেষণা শেষ হল?”
“কাজ খতম স্যার,” যেটা দিয়ে খোঁচাচ্ছিলেন, সেটা পকেটে ঢুকিয়ে হাসিহাসি মুখে উনি নেমে এলেন।
“কি আবিষ্কার করলেন ওখানে?”
“মইটা ফেরৎ দিয়ে আসুন স্যার, বলছি।”
আর যে কোথাও ওঠার প্ল্যান করছেন না, তাতেই আমি খুশি। দ্বিরুক্তি না করে আমি অদৃশ্য হলাম।
মই জমা দিয়ে যখন ঘরে এলাম তখন দেখি একেনবাবু খাবার টেবিলে রাখা একটা রুমালের দিকে নিবিষ্ট মনে তাকিয়ে আছেন। দূর থেকে বুঝি নি, সামনে এসে দেখি রুমালের ওপর একটা বুলেট।
“এটা কোত্থেকে এল?” আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।
“ও-বাড়ির দেওয়াল থেকে।”
“ও-বাড়ি মানে যেখানে মই দিয়ে উঠলেন?”
“হ্যাঁ স্যার। আর আমি প্রায় ডেফিনিট এই গুলিটা মিস্টার প্যাটেলের রিভলবার থেকেই বেরিয়েছিল।”
“সেটা কি করে বুঝলেন?”

“আপাতত বলব স্যার, সেটাই লজিক্যাল পসিবিলিটি। শিওর হতে গেলে ব্যালিস্টিক টেস্ট করতে হবে।”
আমি গুলিটাকে আরেকবার ভালো করে দেখলাম। তারপর বললাম, “লজিকটা ভালো করে বোঝাবেন কি?”
একেনবাবু মাথাটা একটু চুলকে বললেন, “তিনটে পয়েন্ট স্যার। এক নম্বর, এটা টয়েন্টিটু ক্যালিবারের বুলেট। মিস্টার প্যাটেলের হাতে যে রিভলবারটা ছিল, সেটাও টোয়েণ্টিটু ক্যালিবারের। দু’ নম্বর হল, গুলিটা বার করতে গিয়ে দেখলাম ওটা একেবারে হরাইজেন্টালি দেওয়ালে ঢুকেছে। সেটা একমাত্র সম্ভব, কেউ যদি প্রমথবাবুর অ্যাপার্টমেন্ট থেকে গুলিটা ছোঁড়ে। ফাইন্যালি স্যার, গর্তের মুখটা একেবারে পরিষ্কার। অর্থাৎ গর্তটা অনেকদিনের নয়, নইলে এতদিনে সেখানে ধুলোবালি জমে যেত। এখন আমরা জানি, প্রমথবাবুর রিভলবার নেই, সুতরাং ওঁর পক্ষে …।”
একেনবাবু বক্তৃতা থামিয়ে আমি বললাম, “বুঝলাম, গুলিটা মিস্টার প্যাটেলই ছুঁড়েছিলেন। একটা নয়, দুটো গুলিই তিনি ছুঁড়েছিলেন। কিন্তু তাতে হাতিঘোড়া হলটা কি?”
“বিগ ডিফারেন্স স্যার, ভের বিগ ডিফারেন্স! চিন্তা করুন মিস্টার প্যাটেল কি ভাবে নিজেকে মারার চেষ্টা

করেছিলেন?”
“অফ কোর্স রিভলবার চালিয়ে, উই অল নো দ্যাট।”
“রাইট স্যার। রিভলবারটা কি ধরণের মনে আছে আপনার, মানে ব্যারেলের সাইজটা?”
“থাকবে না কেন, অর্ডিনারি ব্যারেল – ইঞ্চি চারেক লম্বা।”
“রাইট এগেইন স্যার। এবার বলুন, গুলিটা কোথায় লেগেছিল?”
“রগের পাশে।”

“ঠিকই মনে আছে আপনার। লাস্ট কোয়েশ্চেন স্যার, রিভলবারের ট্রিগারে কোন আঙ্গুলের প্রিন্ট পাওয়া গেছে?”
“সে তো আপনাদের কাছেই শুনলাম, ইনডেক্স ফিঙ্গারের।”
“তথ্যে কোনও ভুল নেই স্যার, আমি নিজের কানে শুনেছি ক্যাপ্টেন স্টুয়ার্টের কাছ থেকে, আর সেখানেই হচ্ছে পাজল।”
“পাজল!”
“হ্যাঁ স্যার।“
“আমি কিছুই বুঝতে পারছি না। এতে পাজলের কি আছে?”

“বলছি স্যার। নর্মালি আমরা ইনডেক্স ফিঙ্গারটাই ট্রিগারের ওপর রাখি। কিন্তু এই সিচুয়েশনটা ডিফারেন্ট। মনে করুন রিভলবারের নলটা খাড়া ভাবে রগের ওপর বসিয়ে আঙুল দিয়ে ট্রিগার টিপছেন।”
ডেমনেস্ট্রেট করার জন্যে একেনবাবু আমার কোনুইটা তুলে কব্জিটা একটু বেঁকিয়ে ধরলেন।
“মনে রাখবেন স্যার, ব্যারেলটা চার ইঞ্চি লম্বা, ফায়ার করতে গেলে ট্রিগারে যথেষ্ট চাপ দেওয়া দরকার। কোনুইটা আরেকটু উপরে তুলুন, আর একটুখানি – ব্যস। এবার কব্জিটা আর একটু বেঁকান, জাস্ট রাইট, একদম কারেক্ট পজিশন। এবার বলুন স্যার, কি মনে হচ্ছে?”
“ঊঃ,” আমি স্বীকার করলাম। “মাসলে ভীষণ টান পড়ছে!”

“রাইট স্যার। আর আপনি তো নর্ম্যাল হেলদি ইন্ডিভিজুয়াল। আপনারই যদি এই অবস্থা হয় , তাহলে ভেবে দেখুন আর্থ্রাইটিসের রোগী মিস্টার প্যাটেলের কি অবস্থা হবে!”
“ওঁর আর্থ্রাইটিস ছিল, সেটা আবার কে বলল?”

“পিওর স্পেকুলেশন স্যার। দেখলেন না ওঁর বাড়িতে অ্যাসপিরিন, টাইলানল – ব্যথা কমানোর ওষুধের কি ছড়াছড়ি!”
“ওয়েট এ মিনিট, আপনি কি বলতে চান এভাবে নিজের রগে গুলি চালিয়ে কেউ আত্মহত্যা করতে পারে না?”
“তা তো বলিনি স্যার। স্বচ্ছন্দেই সেটা পারা যায়; কিন্তু সেক্ষেত্রে একটা নয়, দুটো হাত লাগে। ফর এ রাইট হ্যান্ডেড পার্সন, বাঁ হাতে রিভলবারের ব্যারেলটা ধরে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে ট্রিগারে চাপ দিলে সেটা পারা যায়।”
আমি একেনবাবুর কথা মত দুটো হাত ওপরে তুলে বুঝতে পারলাম নিঃসন্দেহে সেটাই সবচেয়ে স্বাভাবিক পজিশন।
“যে কথা বলছিলাম স্যার। আমরা জানি, যে ফিঙ্গার-প্রিন্ট পাওয়া গেছে, সেটা বুড়ো আঙ্গুলের নয়। কিন্তু মোস্ট ইম্পরটেন্ট ঘটনা হল, ওঁর হাতে গান পাঊয়ার পাওয়া গেছে। এটা একমাত্র সম্ভব কেউ যদি নিজের হাতে গুলি ছোঁড়ে।”

এবার আমি বুঝতে পারলাম একেনবাবু কোনদিকে এগোচ্ছেন। বললাম, “বুঝতে পেরেছি। অর্থাৎ, মিস্টার প্যাটেলকে খুন করার পরে, আততায়ী ওঁর হাতে রিভলবারটা ধরিয়ে ইনডেক্স ফিঙ্গারটা ট্রিগারের ওপর রেখে তাতে চাপ দিয়ে আরেকটা গুলি চালিয়েছে, যাতে গান পাউডার হাতে লেগে থাকে এবং ট্রিগারেও ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া যায়।”

“কারেক্ট স্যার। কিন্তু শুধু তাই নয়’ গুলিটা যাতে কারোর চোখে না পড়ে, সে-ব্যবস্থাটা করা দরকার। সবচেয়ে সহজ উপায় হল জানলাটা খুলে তার ফাঁক দিয়ে গুলি চালানো। তাহলে গুলিটা বাইরে চলে যাবে। অন্য কোনও দেয়ালে লাগলেও সেটা লাগবে বাইরে। সেদিনের ঝড় বৃষ্টি বজ্র বিদ্যুতের মাঝে কারও কিছু খেয়াল হবে না।”
একেনবাবুর কথাগুলো মোটেই উপেক্ষা করার মত নয়। পুরো ব্যাপারটা হৃদয়ঙ্গম করার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, “বাট হু কুড হ্যাভ মার্ডারড হিম?”

প্রশ্নটা করার সময় আমার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল একেনবাবু দু-একজন সাসপেক্টকে এরমধ্যেই আইডেন্টিফাই করে ফেলেছেন।
একেনবাবু মাথা নাড়লেন, “সেটাই স্যার সমস্যা। আই হ্যাভ নো ক্লু।”

দশ

সকালে ব্যোমশেলটি ফাটিয়ে একেনবাবু কেটেছেন, ফিরতে ওঁর নাকি আজ সন্ধে হবে। আমার মাত্র আজ একটা ক্লাস। সেটা সেরে অফিসে এসে কাগজপত্রগুলো ব্রিফ কেসে ঢোকাতে গিয়ে দেখি মিস্টার প্যাটেলের খাতাটা! নিশ্চয় তাড়াহুড়ো করে বেরোবার সময় অন্যান্য কাগজপত্রের সঙ্গে ওটাকে ঢুকিয়ে ফেলেছিলাম! খাতাটা বের করে একটু পাতা ওলটালাম। প্রতি পাতার ওপরে হাতে লেখা একটা তারিখ। প্রথম তারিখ দেখলাম ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৮৯। শেষ লেখা মাত্র কয়েকদিন আগের, ১০ ফেব্রুয়ারির। খুবই নিরস দিনপুঞ্জী। ১ সেপ্টেম্বরের পাতায় লেখা:
কাল সিডের বাড়িতে ব্রিজ খেলতে গিয়েছিলাম। আমি-সিড ভার্সাস সিদ্দিকি-কে.জি.। আমরা দুটো রাবার জিতেছি। বাজি ধরে খেলা উচিত ছিল! সিড একটা বড়সর কিছুর প্ল্যান করছে। ঠিক কি বলল না। তবে ইট ইজ ভেরি ভেরি বিগ

– ও নিজে সামলাতে পারবে না। হি নিডস হেল্প – আমায় দলে নিতে চায়। সিড-এর বাড়িতে এই শেষ ব্রিজ খেলা। এর পর অন্য কোথাও।
গোপালরাজ বলেছে আমার চিঠি পায় নি। হি ইস লাইং।

আজ ৯টায় কে.জি.-র বাড়ি যাচ্ছি। একটা ভালো অপরচুনিটি আছে। মার্জিন নিয়ে সমস্যা হবে, কারণ কে.জি. পনেরো পার্সেন্ট চাচ্ছে!

অন্যান্য তারিখেও এরকমই এনট্রি। শেষ লেখাটা মাত্র এক লাইনের – বিশ্বাস করতে পারছি না সিড এভাবে চলে গেল! কোথায় গেল, কেন গেল – তার কোনও উল্লেখ নেই। সত্যি কথা বলতে কি, চাঞ্চল্যকর কিছুই চোখে পড়ল না, যা নিয়ে পরে অনুসন্ধান চালান যায়। হঠাৎ খেয়াল করলাম ৮ সেপ্টেম্বর মিস্টার প্যাটেল কিছু লেখেন নি। কিন্তু অবাক লাগল যখন দেখলাম যে, ১৫ সেপ্টেম্বরেও কোনও কিছু লেখা নেই। ইণ্টারেস্টিং, পনেরো হচ্ছে আটের সাত দিন পরে। পনেরোর সঙ্গে সাত যোগ করলে দাঁড়ায় বাইশ। আমি ২২ তারিখে কি লিখেছেন দেখতে গিয়ে দেখলাম যে, ওই তারিখেও কোনও এনট্রি নেই! ২৯ তারিখও শূন্য। ক্যালেণ্ডারে দেখলাম, ৮ সেপ্টেম্বর হচ্ছে শুক্রবার। অর্থাৎ

কোনও শুক্রবারই ডায়রিতে কিছু লেখা হয় নি! এবার খাতাটাকে একটু ভালো করে পরীক্ষা করলাম। আমেরিকাতে এধরণের খাতার খুব চল – রিং বাইণ্ডার দেওয়া খাতা। রিং-এর ভেতরে দেখলাম কাগজের কিছু-কিছু আঁশ তখনও লেগে! তার মানে কেউ খাতা থেকে কিছু কাগজ ছিঁড়েছে! কিন্তু কে এবং কেন? এক হতে পারে যে, ওই বিশেষ দিনগুলোতে এমন কিছু ঘটেছিলো – যেটা কিরিট প্যাটেল আর কাউকে জানতে দিতে চান নি! কিন্তু তাই যদি হবে, তাহলে উনি সেগুলো লিখেছিলেন কেন? তবে কি আর কেউ কাগজগুলো ছিঁড়েছে? কিরিট প্যাটেলকে ব্ল্যাকমেল করার জন্য, বা কোনও রকমের এভিডেন্স লুকোনোর জন্য? কিন্তু সেক্ষেত্রে কাগজগুলো না ছিঁড়ে পুরো খাতাটা চুরি করাই তো বুদ্ধিমানের কাজ হত! তখনই আমার মনে সন্দেহটা এল। একজনই এগুলো ছিঁড়তে পারেন, এবং সম্ভবত সেই জন্যেই উনি মিস্টার প্যাটেলের বাড়িতে গিয়েছিলেন। তাহলে কি একেনবাবু….!

আমি জানি যে-ভাবে চিন্তা করছি, একমাত্র সন্দেহ-বাতিকগ্রস্থ লোকরাই সে-ভাবে চিন্তা করবে। কিন্তু কিছুতেই আমি নিজেকে বোঝাতে পারলাম না যে, হ্যাঁ, একেনবাবু যদি পাতাগুলো ছিঁড়ে থাকেন, তাহলে ইণ্টারেস্টিং কিছু আবিষ্কার করেছেন বলেই ছিঁড়েছেন। এর মধ্যে গুপ্ত কোনও ব্যাপার জড়িত নেই। তবু কেন জানি আমার মনে হল কোথাও কোনও কনস্পিরেসি আছে! আর আমি যত ভাবলাম, ততই ব্যাপারটা আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল। মিস্টার প্যাটেলের বাড়ি গিয়ে একেনবাবু ভীষণভাবে কিছু একটা জিনিস খুঁজছিলেন। ডায়রিটা পাওয়ার পরই মনে হল, যেন ওঁর কাজ শেষ হয়েছে। ওঁর পক্ষে খাতাটা গায়েব করা অসম্ভব, যেহেতু আমি সেটা দেখেছি। কিন্তু পাতাগুলো ছেঁড়া কিছুই কঠিন নয়। আমি যখন স্নান করছিলাম, তখনই হয়ত ছিঁড়েছেন! কিন্তু কেন? তার উত্তর অবশ্যই আমার জানা নেই। তবে এই প্রথম আমি উপলব্ধি করলাম যে, একেনবাবু লোকটি কে, কী করেন, কেন এদেশে এসেছেন – সে সম্পর্কে আমি প্রায় কিছুই জানি না। উনি আমার ছেলেবেলার বন্ধু রনুর পরিচিত, গভর্ণমেণ্টে কিছু একটা করেন, এবং এদেশে কোনও কাজের সূত্রেই এসেছেন। অথচ খতিয়ে দেখতে গেলে এই জানাটা এত সুপারফিশিয়াল যে, প্রায়

কিছুই জানি না বলাটা অত্যুক্তি নয়। নিজের সম্পর্কে যে-কোনও কথাই উনি অদ্ভুতভাবে এড়িয়ে যান! এতদিন পর্যন্ত ওঁকে দেখে আমার মনে হত যে, উনি হলেন র্যা ন্ডাম কৌতুহল, আর অফুরন্ত অসংলগ্ন প্রশ্নের ঝুরি! ভদ্রলোকের মননশক্তি বা বুদ্ধি সম্পর্কে উচ্চ ধারণা দূরে থাক, প্রায়েই মনে হয়েছে এরকম একটা গবেট লোক এতকাল করে খাচ্ছে কী করে! কিন্তু এই মুহুর্তে আমার যে চিন্তা, সেটা একেনবাবুর বুদ্ধি নিয়ে নয়। উনি যে অত্যন্ত বুদ্ধিমান লোক, সে সম্পর্কে এখন আর আমার এতটুকু সন্দেহ নেই। আমার চিন্তা হচ্ছে – কেন সেই বুদ্ধিটাকে উনি কাউকে জানতে দিতে চান না? এটা মোটেই বিনয় নয়, এটা হল চতুরতা। এই ভাবে বোকা সাজার পেছনে আসল মতলবটা কি? মিস্টার প্যাটেলের হত্যাকারীর সঙ্গে ওঁর কি কোনও কানেকশন আছে? পুলিশের কাছ থেকে এভিডেন্স লুকোবার জন্য কি উনি পাতাগুলো ছিঁড়েছেন? কেন উনি মিস্টার প্যাটেলের বাড়িতে আমাদের ওই অভিযানটা প্রমথকে জানাতে দিতে চান নি? উনি তদন্ত চালাবার ভান করে আমাকে নানান তথ্য দিচ্ছেন, কিন্তু পুলিশকে কোনও কথা জানাচ্ছেন না – কেন?

আমি ঠিক করলাম প্রমথকে সমস্ত ঘটনা খুলে বলব। এ-ব্যাপারে আমাদের একটা জয়েণ্ট স্ট্র্যাটেজি দরকার। প্রমথর ল্যাব আমার অফিসের খুব কাছেই, দুটো বিল্ডিং পরে। কয়েক মিনিট মাত্র লাগে যেতে। প্রমথ ল্যাবেই ছিল। আমি প্রথমেই মিস্টার প্যাটেলের বাড়িতে আমাদের অভিযানের কথাটা বললাম। তারপর একেনবাবুর রহস্যজনক আচরণ, প্লাস, প্রমথকে যে এগুলো উনি জানতে দিতে চান না, সেটা বললাম। প্রমথ প্রথমে হাঁ করে শুনছিল। তারপর হঠাৎ হাসতে শুরু করল।

“হাসছিস কেন ওরকম,” আমি কিছু বুঝতে না পেরে ওকে ধমক লাগালাম।
“হাসছি একেনবাবুর খ্যাপামি, আর তোর বুদ্ধুমি দেখে!”
“তার মানে?”

“ক’দিন আগে একেনবাবু আমাকে বলছিলেন, ‘সার, একটা কথা খুব প্রাইভেটলি বলছি।’ আমি ওঁকে থামিয়ে বলেছিলাম, ‘একদম না। আমার পেট ভীষণ পাত্লা। দেখতে-না-দেখতে হাজার লোককে বলে ফেলব।’ আমার মনে হয় সেই শুনেই ভদ্রলোক একটু সতর্কতা নিয়েছেন। কিন্তু তোদের বলিহারি, এরকম ভাবে কারোর বাড়িতে বেআইনী প্রবেশের শাস্তি কী জানিস?”

তা আর জানি না! কিন্তু আমার আসল চিন্তার এখনও সুরাহা হচ্ছে না। প্রমথকে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা, একেনবাবু ঠিক কী করেন বলে তোর ধারণা?”

“ইণ্ডিয়া গভর্ণমেণ্টের লোক, সেটা আমি শিওর। ইনফ্যাক্ট গতকাল ইণ্ডিয়া কনসুলেটের দিলীপ দোশি বলে একজনের সঙ্গে আলাপ হল। সে একেনবাবুকে বেশ ভালভাবে চেনে। ওর কথা শুনে মনে হল যে, উনি বেশ উঁচু পদেই কাজ করেন।”
“আর একটু ভাল করে খোঁজ নিতে পারিস?”
“তা পারি, কিন্তু তোর ওকে এত সন্দেহ হচ্ছে কেন?”

আমি ডায়রির ছেঁড়া পাতার কথাটা তখনও প্রমথকে বলি নি। সেটা বলতেই প্রমথ বলল, “তোর মুণ্ডু! হোয়াই উইল হি ডু দ্যাট?”

“আই অ্যাম নট সিওর। মে বি কোনও এভিডেন্স লুকোতে!”
“ওয়েল আই অ্যাম সিওর অফ ওয়ান থিং, দ্যাট ইউ অ্যান ইডিয়াট! পুলিশ কেস ক্লোজ করে দিয়েছে। উনি যদি সত্যিই দোষী হন, তাহলে তো ওঁর চুপচাপ থাকার কথা। ডায়রি চুরি করে, তার পাতা ছিঁড়ে – সেটা তো খেঁচো খুঁড়তে গিয়ে সাপ বার করার মত ব্যাপার হবে! তোর মাথায় আছে কী – অ্যাঁ? যাক সে কথা, এদিককার খবর শুনেছিস! অবিনাশ ইজ নাউ এ ভেরি রিচ ম্যান!”
“তার মানে?”

“ব্রিজ শাহ অবিনাশের অ্যাড্রেসটা ভেরিফাই করতে ফোন করেছিলেন, তখন জানলাম। মিস্টার প্যাটেলের সমস্ত সম্পত্তির মালিক হচ্ছে অবিনাশ। আর গেস ওঁর এস্টেটের ভ্যালুয়েশনটা কত?”
“আই ডোণ্ট নো! কত, চারশো…পাঁচশো…?”
“কুল থ্রি মিলিয়ন ডলার্স!”
“থ্রি মিলিয়ন!” আমি প্রচণ্ড অবাক হলাম। “লোকটার এত টাকা ছিল?”
“তুই তো একেবারে ভিরমি খাচ্ছিস! আরে বাপু, বিজনেস মানেই মানি।”
“অবিনাশ খবরটা জানে?”

“ঠিক বুঝলাম না। আরেকটা কনফিউশন। অবিনাশের এক মামা আজ সকালে দেশ থেকে ফোন করেছিলেন অবিনাশের সঙ্গে কথা বলতে।। এখনো এখানে আসে নি শুনে অবাক হলেন। কারণ অবিনাশ নাকি গত শনিবারে আমেরিকা রওনা দিয়েছে।”

“তা কী করে হয়! সেক্ষেত্রে তো ওর এখানে পৌঁছে যাবার কথা! অবশ্য ইউরোপে যদি স্টপ ওভার নেয়, তাহলে অন্য কথা।”

“স্ট্রেঞ্জ ব্যাপার হল যে, ও আমেরিকার ডিরেক্ট ফ্লাইটই ধরেছিল। সেক্ষেত্রে রবিবার দুপুরে, অর্থাৎ চার দিন আগেই ওর এখানে পৌঁছনোর কথা!”

আমি তখন প্রমথকে বললাম সকালবেলায় একেনবাবুর গুলি আবিষ্কারের ঘটনাটা, আর সেই সঙ্গে ওঁর মার্ডার থিওরিটা।

প্রমথ থ হয়ে শুনল! তারপর বলল, “গড! এতো গভীর গাড্ডা রে! তারমানে একজন সাসপেক্ট অন্তত আছে যার মিস্টার প্যাটেলকে মারার মোটিভ ছিল। আর সত্যই যদি চার দিন আগে এখানে ও এসে থাকে, তাহলে ওর অপরচুনিটিও ছিল।

“আমাদের অবিনাশ মার্ডারার! দ্যাটস ননসেন্স!” আমি বললাম।
প্রমথর এক্সপেরিমেণ্ট প্রায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। আমরা দু’জনে একসঙ্গেই বাড়ি ফিরলাম। এলিভেটরের জন্য অপেক্ষা না করে আমরা সিঁড়ি বেয়ে উঠছিলাম। হঠাৎ প্রমথর অ্যাপার্টমেণ্ট থেকে কারও গলা ভেসে এল। প্রথমে ভেবেছিলাম একেনবাবুর। কিন্তু তারপর খেয়াল হল, ওঁর তো দেরি করে ফেরার কথা! আমাদের উচিত ছিল ওপরে গিয়ে পুলিশকে ফোন করা। কারণ ভেতরে কে আছে, লোকটা সশস্ত্র কিনা, কিছুই জানি না। কিন্তু প্রমথ গোঁয়ারের মত চাবি ঢুকিয়ে দ্যুম করে দরজাটা খুলে ফেলল। দু’জনেই সবিস্ময়ে যাকে দেখলাম, সে হল অবিনাশ!

এগারো

অবিনাশ ফোনে কারও সঙ্গে কথা বলছিল। আর সোফায় বসে একটা অচেনা লোক চিমনির মত ধোঁয়া বের করে সিগারেট ফুঁকে যাচ্ছিল। অবিনাশ আমাদের দেখে হাত নাড়ল। তারপর “ও.কে., আজ রাতে তা হলে দেখা হবে, বাই,” বলে ফোনটা ছেড়ে দিল।

ফোন নামাতেই প্রমথ চেঁচিয়ে উঠল, “হোয়াট দ্য হেল, কোথায় ছিলে তুমি এতদিন?”
উত্তরে অবিনাশ যেটা বলল, সেটা বিশ্বাস করা কঠিন। ও নাকি পাঁচ দিন আগে ওর আঙ্কল, কিরিট প্যাটেলের কাছ থেকে খুব জরুরি ফোন কল পায়, নেক্সট ফ্লাইটেই আমেরিকাতে চলে আসার জন্য। কেন, কিরিট প্যাটেল জানাতে চান নি। তবে গলার স্বর শুনে অবিনাশ অনুমান করেছিল যে, ব্যাপারটা বেশ গুরুতর। নিউ ইয়র্কের কেনেডি এয়ারপোর্টে নামতেই কিরিট প্যাটেল ওকে হল্যাণ্ড টানেলের পাশে যে ‘হলিডে ইন’ হোটেলটা আছে, সেখানে নিয়ে যান। কিরিট প্যাটেল ওকে বলেন যে, কয়েকজন বিজনেস অ্যাসোসিয়েটের সঙ্গে ওঁর বেশ রকমের একটা ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। ভুল বোঝাবুঝির মাত্রাটা এত চরমে পৌঁছেছে যে, উনি নিজের বাড়িতে থাকতে খুব নিরাপদ বোধ করেন নি। কাউকে না জানিয়ে ‘হলিডে ইন’-এ এসে আছেন। কিন্তু এ-ভাবে লুকিয়ে থাকায় ওঁর বিজনেসের খুব ক্ষতি হচ্ছে। পরের ক’দিন কানেকটিকাট, নিউ জার্সি, আর পেনসিলভ্যানিয়ার বেশ কয়েকটা দোকানে ওঁর মাল ডেলিভারির ডেট। উনি সেটা মিস করতে চান না। এই ব্যবসায় একবার সুনাম নষ্ট হলে সেটা ফিরে পাওয়া কঠিন। আবার নিজেও মালগুলো নিয়ে যেতে ভয় পাচ্ছেন, নিরাপত্তার কথা ভেবে। অচেনা অজানা কাউকে ভারটা দেওয়া যায় না, লাখ-লাখ টাকার টাকার জিনিস! তাই ওঁর অবিনাশের সাহায্য দরকার।

“কার সঙ্গে গণ্ডগোলটা হয়েছিল সেটা বলেছিলেন?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“না।”
“তুমি জানতে চাইলে না?”
“কি হবে জেনে!”

“হোয়াট ড্যু ইউ মিন – কি হবে জেনে! এরকম একটা লাইফ থ্রেটেনিং সিচুয়েশন দেখেও তুমি কিছু বললে না?”
“ওয়েল আই টোল্ড হিম, ইফ দেয়ার ইজ এ ফিয়ার ফর লাইফ, তাহলে ইমিডিয়েটলি পুলিশে খবর দেওয়া উচিত।”
“উনি কী বললেন?”
“হি ওয়াজ ভেগ।এটুকু বুঝেছিলাম যে, ব্যাপারটা একটু গোলমেলে। পুলিশে খবর দিলে সবাই ঝামেলায় পড়বে, আঙ্কলও বাদ যাবেন না!”
“উনি কি বলেছিলেন যে, প্রাণহানির কোনও আশঙ্কা আছে?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“নট রিয়েলি।”

“ওয়েট এ মিনিট,” প্রমথ বলল, “তাই যদি হয়, তাহলে তুমি ওঁকে বললে কেন, ইফ দেয়ার ইজ এ ফিয়ার ফর লাইফ!”
“আই ডোণ্ট নো। আই মে জাস্ট হ্যাভ গেসড!”
“ইউ আর জাস্ট অ্যাজ ভেগ অ্যাজ ইওর আঙ্কল,” প্রমথ মন্তব্য করল।
অবিনাশ ঘাড় ঝাঁকাল, “কাণ্ট হেল্প ইট।”

প্রমথ আর অবিনাশের মধ্যে কম্যুনিকেশনটা বরাবরই অত্যন্ত বাজে। তাই আমি একটু চেষ্টা করলাম, যদি আর দু’ একটা পয়েণ্ট উদ্ধার করা যায়। জিজ্ঞেস করলাম, “কি ধরনের ঝামেলা, সে-সম্পর্কে কোনও হিণ্ট পাও নি মিস্টার প্যাটেলের কাছ থেকে ?”

“অল আই নো যে, একটা লোক ঝামেলাটা পাকিয়ে উধাও হওয়ায় আঙ্কলের ঘাড়ে দোষটা এসে পড়েছিল। আঙ্কল জাস্ট নিডেড সাম টাইম টু গেট হিমসেলফ ক্লিয়ারড।”

“উনি এখানে এলেন কেন?” প্রমথ আবার প্রশ্ন শুরু করল। প্রমথর প্রশ্ন করার ভঙ্গিটা বেশ অ্যাটাকিং। একবার মনে হল অবিনাশ চটে গিয়ে আর উত্তর দেবে না। কিন্তু ও মাথা ঠাণ্ডা রেখেই উত্তর দিল।

“হোটেল লবিতে হঠাত্ একজন পরিচিত লোকের সঙ্গে আঙ্কলের দেখা হয়ে যায়। উনি ভয় পান যে, খবরটা ছড়িয়ে যাবে। তখন আমিই ওঁকে সাজেস্ট করি, অন্য কোন হোটেলে না গিয়ে তোমাকে ফোন করতে।”

“ওঁকে ফাঁসিয়ে যে উধাও হয়েছিল, তার নামটা উনি বলেছিলেন?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।
“না।”
“তুমি কখন জানলে যে, তোমার আঙ্কল মারা গেছেন?” প্রমথর প্রশ্ন।

“আজ সকালে, ‘ইণ্ডিয়া অ্যাব্রড’ পড়ে। সঙ্গে-সঙ্গে আমি ব্রিজ আঙ্কেলকে ফোন করি। ব্রিজ আঙ্কেলও আমার খোঁজ করছিলেন। উনি বললেন…।

“ব্রিজ শাহর কথা বাদ দাও,” প্রমথ অবিনাশকে থামিয়ে দিল, “তুমি পুলিশকে এ বিষয়ে কিছু জানিয়েছো?”
“কোন বিষয়?”
“তুমি যা এতক্ষণ আমাদের বললে!”
“না”
“কেন?”

অবিনাশ একটু থতমত খেল। আমতা-আমতা করে বলল, “আমি ব্রিজ আঙ্কলকে এ-নিয়ে জিজ্ঞেস করেছিলাম। উনি বললেন, ‘সেটা তোমার ডিসিশন। তবে আনঅফিশিয়ালি তোমাকে বলি, যে চলে গেছে তাকে তো তুমি আর ফিরিয়ে আনতে পারবে না। সুতরাং এটা নিয়ে আর ঘাঁটিও না’।”

“আর তুমিও সেটা দিব্বি মেনে নিলে!” বেশ ব্যঙ্গ করেই কথাটা বলল প্রমথ।

প্রমথর সঙ্গে অবিনাশে প্রায়ই খটাখটি লাগে, আর আমি সাধারণত তাতে মাথা ঘামাই না। কিন্তু আজ মনে হল, মিস্টার প্যাটেলের হত্যার সঙ্গে অবিনাশ যদি জড়িত থাকে, তাহলে প্রমথর একটু সতর্ক হওয়া উচিত। ওয়ানস এ মার্ডারার ইজ অলওয়েস এ মার্ডারার! আমি প্রমথকে বললাম, “যাঃ, তার নিশ্চয় কোনও একটা রিজন আছে।”
“সমাদ্দারকে সেটা কে বোঝাবে!” অবিনাশ আমার সমর্থন পেয়ে প্রমথকে ঠুকল। তারপর একটু চুপ করে থেকে কিছুটা কৈফিয়তের সুরে বলল, “আমি ব্রিজ আঙ্কেলকে বলেওছিলাম যে, আমি পুলিশকে জানাতে চাই। তখন উনি বললেন কেন উনি আমার খোঁজ করছিলেন। আমার আঙ্কলের উইল অনুসারে তাঁর সমস্ত সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী হচ্ছি আমি। ‘এবারে ভেবে দ্যাখো,’ উনি বললেন, ‘তুমি এদেশে হঠাৎ চলে এসে কাউকে না জানিয়ে একটা হোটেলে লুকিয়ে রইলে। আর তোমার আঙ্কল তোমার অ্যাপার্টমেণ্টে গিয়ে মিস্টিরিয়াসলি মারা যাওয়ার পর-পরই তুমি উদয় হলে। আমার তো মনে হয়, তুমিই হবে পুলিশের প্রাইম সাসপেক্ট।’ ব্যাপারটার গুরুত্ব তখনই আমি প্রথম রিয়্যালাইজ করলাম।

প্রমথর মুখ দেখে বুঝলাম, এই কথটা আদায় করার জন্যই ও অবিনাশকে খোঁচাচ্ছিল। বলল, “এখন বুঝেছি, চাচা আপন বাঁচা! ভালকথা, তুমি কী করছিলে পরশু সন্ধ্যার সময়?”

“পরশু!”
“হ্যাঁ, বুধবার সন্ধ্যায়, যখন তোমার আঙ্কল মার যান!”
“হোটেলে বসে টিভি দেখছিলাম।”
“একা?”
“হ্যাঁ, কিন্তু এরকম প্রশ্ন করার অর্থ?”
“সিম্পল, শুধু দেখছিলাম তোমার কোনও অ্যালিবাই ছিল কিনা!”

প্রমথটা মাঝে-মাঝে ভব্যতার সীমা ছাড়িয়ে যায়! কিন্তু অবিনাশকেও বলিহারি! মামার মৃত্যুর খবরে এতটুকু বৈকল্য নেই! প্রমথর কথার পিঠে বলল, “কিন্তু এটা তো আত্মহত্যা!”

“ওয়ান কুড নেভার বি সিওর,” আমি বললাম। “সাপোজ ইট ইজ এ মার্ডার। সেক্ষেত্রে যারা ওঁকে মার্ডার করেছে, তুমিও তো তাদের টার্গেট হতে পারো। তারা ভাবতে পারে যে, যেটা তারা খুঁজছে, সেটা এখন তোমার কাছে আছে!”
“আই ডোণ্ট আণ্ডারস্ট্যাণ্ড, কে কি খুঁজছে?” অবিনাশ একটু যেন সন্দেহ নিয়ে আমার দিকে তাকাল।
আমি সঙ্গে-সঙ্গে চেপে গেলাম। শুধু বললাম, “তাও আমার মনে হয়, তোমার পুলিশকে সব কিছু জানানো উচিত।”
অবিনাশ কোনও জবাব দিল না।

প্রমথ দুম জিজ্ঞেস করে বসল, “আচ্ছা, তোমার আঙ্কল কি শুক্রবার-শুক্রবার কোথাও যেতেন?”
“আই ডোণ্ট নো। হঠাৎ এ প্রশ্ন কেন?” এখন আর সন্দেহ নেই, অবিনাশ বেশ একটু সাসপিশাস।
আমি চট করে আর-একটা প্রশ্ন করে আবহাওয়াটা ক্লিয়ার করার চেষ্টা করলাম, “তোমার আঙ্কলকে স্যাম বলে একজন ফোন করেছিল। বিশেষ দরকারে মনে হল। তুমি তাঁকে চেন?”

উত্তরে ‘না’ বা ওই জাতীয় কিছু শুনব ভেবেছিলাম। কিন্তু অবিনাশ সোফায়-বসা লোকটাকে দেখিয়ে বলল, “ইনিই হচ্ছেন স্যাম ওয়াকার।”

বারো

স্যাম ওয়াকার ভারতীয় ক্রিশ্চান, জাম্বিয়াতে মানুষ। শুধু নামে নয়, চেহারা দেখলেও পরিষ্কার বোঝা যাবে না যে, স্যাম ভারতীয়। চুলগুলো কোঁকড়া-কোঁকড়া, ঠোঁটটা পুরু – মোটেও টিপিক্যাল ভারতীয় চেহারা নয়। বয়সে আমাদের থেকে বেশ কয়েক বছরের ছোটই হবে মনে হল।
আমি স্যাম ওয়াকারকে প্রশ্ন করলাম, “মিস্টার প্যাটেলকে ধরার চেষ্টা করছিলেন কেন?”
স্যাম যে উত্তরটা দিলেন, সেটা একদমই আশা করি নি। বললেন, “একটা মুনস্টোনের খোঁজে।”
কথাটা শুনে আমি আর প্রমথ মুখ চাওয়াচাওয়ি করলাম।

আমি শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললাম, “দেখুন, শুধু আপনি নন, একাধিক লোক এই মুনস্টোনটার ব্যাপারে গত কয়েকদিন ওঁর সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন। এটা এত কী মহামূল্য জিনিস আমাকে বলবেন?”

আরও অনেকে মুনস্টোনটার খোঁজ করছে জেনে স্যাম ভীষণ আশ্চর্য হল। তবে আমি আমার প্রশ্নের উত্তর পেলাম। যে মুনস্টোন নিয়ে এত গণ্ডগোল, সেটা বহুদিন আগে এক জুলু প্রিন্সের কাছ থেকে স্যামের বাবা পান। মাস কয়েক আগে কিছু টাকার প্রয়োজন হওয়ায় স্যাম ওটা পাঁচ হাজার ডলারে কিরিট প্যাটেলকে বিক্রি করে দেয়। ক’দিন আগে নাটালের এক জেমস ডিলার হঠাৎ স্যামকে ফোন করে জানতে চায় ওই মুনস্টোনটা স্যামের কাছে আছে কি না! তার জন্য ১৫ হাজার পর্যন্ত সে দিতে রাজি! ফোনটা পেয়েই স্যাম কিরিট প্যাটেলকে ফোন করে। কিন্তু কিরিট প্যাটেল এর মধ্যেই ওটা আর কাউকে বেচে দেয়েছেন! স্যাম তখন ওঁকে নাটালের ডিলারের টাকার অঙ্কটা বলে। কিরিট প্যাটেল বলেন যে, টাকার অ্যামাউণ্টটা আর কাউকে না জানাতে। উনি দু-চার পয়সা বেশি দিয়ে আবার ওটা কেনার চেষ্টা করবেন। তারপর বিক্রি করে যে লাভটা হবে, ওঁরা দু’জন সেটা ভাগ করে নেবেন। এই হল ঘটনা।

আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনাকে কি মিস্টার প্যাটেল বলেছিলেন যে, কাকে ওটা বিক্রি করেছিলেন?”
স্যাম উত্তর দিলেন, “না”।
“এখানকার এই ফোন নম্বরটা আপনাকে কে দিল?”

“মিস্টার প্যাটেল। আমাকে বুধবার ফোন করে বলেছিলেন, বৃহস্পতিবার বিকেলে এই নম্বরে ফোন করতে। তার মধ্যেই উনি খবরটা পেয়ে যাবেন।”
ইট ইজ এ বিলিভেবল স্টোরি।

প্রমথ বলল, “সবই বুঝলাম। কিন্তু যেটা বুঝলাম না, সেটা হল, আপনি সেদিন আচমকা ফোনটা ছেড়ে দিলেন কেন?”
স্যাম ওয়াকার লজ্জা পেলেন। বললেন, “আপনি ফোন ধরেছিলেন বুঝি! আই অ্যাম সরি। মিস্টার প্যাটেল ডেড শুনে ভেবেছিলাম, কেউ নিশ্চয় প্র্যাক্টিক্যাল জোক করছে!”

অবিনাশ এই ফাঁকে নিজের ঘরে গিয়ে কয়েকটা সোয়েটার আর কোট নিয়ে এসেছে দেখলাম। প্রমথ জিজ্ঞেস করল, “কী ব্যাপার, তুমি ওগুলো নিয়ে কোথায় চললে?”
“ভাবছি কয়েকদিন হোটেলেই থাকব।”
“নিজের অ্যাপার্টমেণ্টে ছেড়ে হোটেলে থাকবে?” আমি অবাক হয়ে বললাম।

অবিনাশ সোজাসুজি জবাব দিল না। তবে অনুমান করলাম যে, প্রমথ যে-কারণে নিজের ঘরে থাকছে না, ওরও বোধ হয় সেই একই কারণ। ভূতের ভয়েই সবাই গেল!

আমি ভদ্রতা করে জিজ্ঞেস করলাম যে, গাড়ি করে ওকে পৌঁছে দেব কিনা। ও বলল যে, মালপত্র ডেলিভারি করার জন্য ও এক সপ্তাহের জন্য একটা গাড়ি ভাড়া করেছে। সুতরাং যানবাহনের কোনও অসুবিধা নেই। বাঁচিয়েছে! এই শীতে আমার এতটুকু বেরোতে ইচ্ছে করছিল না।

একেনবাবু এলেন সেই সন্ধ্যায়। প্রমথটার কাণ্ড, একেনবাবু বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই বলল, “কি মশাই, আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে আপনারা দু’জন যে বেশ গোয়েন্দাগিরি করে বেড়াচ্ছেন!”
আমি আর একেনবাবু দু’জনেই অপ্রস্তুত!

“ছি ছি, কি যে বলেন স্যার! হঠাৎ মাথায় খেয়াল চেপেছিল, আপনি হাসাহাসি করবেন বলে আর জানাই নি!” বলে আমার দিকে একটা অনুযোগপূর্ণ দৃষ্টি দিলেন।

“না জানিয়ে ভুল করেছেন,” প্রমথ কপট গাম্ভীর্য দেখিয়ে বলল। “জানালে অনেকগুলো দরকারি তথ্য দিতে পারতাম। যেমন, …” এই বলে প্রমথ গড়গড় করে ব্রিজ শাহর ফোন থেকে শুরু করে অবিনাশের সঙ্গে আমাদের দেখা হওয়া পর্যন্ত প্রচণ্ড ডিটেলে আওড়ে গেল। তারপর একেনবাবুকে একটু খোঁচাল, “এবার বলুন পার্টনার বাছতে ভুল করেছেন কিনা?”

একেনবাবু দমবার পাত্র নন। বললেন, “আপনি আপনার এক্সপেরিমেণ্ট নিয়ে এত ব্যস্ত থাকলে আমি কী করতে পারি স্যার?”

এরকম হাসি ঠাট্টার মধ্যে দিয়েই এ ক’দিনের লুকোচুরির ব্যাপারটা চলে গেল। ভাগগিস প্রমথটা হড়বড় করে বলে ফ্যালে নি যে, আমি একেনবাবুকে সন্দেহ করছিলাম! তা হলে সত্যই ভারি লজ্জায় পড়তে হত!
প্রমথ একেনবাবুকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা, আপনি যখন সিওর এটা মার্ডার, তাহলে পুলিশকে সেটা জানালে হয় না?”

একেনবাবু বললেন, সেটা হবে স্যার খোদার ওপরে খোদকারি। তার আগে আর-একটু আঁটঘাট বাঁধা দরকার। মানে একজন সাসপেক্ট, কিছু এভিডেন্স।”
“অবিনাশ নিশ্চয় একটা সাসপেক্ট।” প্রমথ বলল।
“শিওর স্যার। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে, হি লুকস টু মাচ লাইক এ সাসপেক্ট।”
“তার মানে?”

“ভেবে দেখুন স্যার, অবিনাশবাবু যদি সত্যই খুন করতে চাইতেন, তা হলে এইভাবে লুকিয়ে এসে, কোনও রকম অ্যালিবাই ছাড়া খুন করে, তারপর হঠাৎ উদয় হওয়াটা মোটেই স্মার্ট মুভ নয়।”
“তা ঠিক, কিন্তু এও তো হতে পারে যে, ডিটেকটিভরা ঠিক আপনার মতই ভাববে বলে অবিনাশ প্ল্যান করে এটা করেছিল?”

“আপনার সঙ্গে স্যার কথায় পারা মুশকিল। না, মেনে নিচ্ছি যে, অবিনাশবাবুকে আমরা বাদ দিতে পারি না।”
“হাউ অ্যাবাউট স্যাম ওয়াকার?” আমি প্রশ্ন তুললাম, যদিও আমার মন বলছিল যে, লোকটা মোটেও ক্রিমিন্যাল টাইপের নয়।

“পসিবল,” প্রমথ বলল, “ও হয়ত অবিনাশের পার্টনার ইন দ্য ক্রাইম।”
“ভাল কথা,” আমি একেনবাবুকে বললাম, “আপনি মিস্টার প্যাটেলের ডায়রিটা পড়েছেন?”
“ভালো করে নয় স্যার, তবে পাতা উলটেছি।”
“একটা ইণ্টারেস্টিং জিনিস দেখলাম, শুক্রবারের সমস্ত এনট্রি ডায়রি থেকে ছেঁড়া।”
“এক্সেলেণ্ট অবজারভেশন স্যার। সেটা একটু অনুসন্ধান করার জন্য একবার কুইন্সে যাওয়া দরকার।”
“কুইন্সে?” আমি খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম।

“জাস্ট এ হাঞ্চ স্যার। ডায়রির মধ্যে একটা পার্কিং-এর টিকিট পেয়েছিলাম। সেটার ওপরে পিঙ্ক এলিফ্যাণ্ট রেস্টুরেণ্টের ছাপ, আর যে ডেটটা স্ট্যাম্প করা – সেটা হল ফেব্রুয়ারি ৯, ১৯৯০, অর্থাৎ শুক্রবার। আমি আজ নিউ ইয়র্ক সিটির টেলিফোন গাইড থেকে দেখলাম, রেষ্টুরেণ্টটা হচ্ছে কুইন্সে-এ।”
“ওয়েট এ মিনিট, টিকিটতো পার্কিং লট থেকে গাড়ি বের করার সময় জমা দিতে হয়, সেটা ডায়রির মধ্যে এলো কি করে?”

একেনবাবুকে একটু হতভম্ব দেখে আমি পার্কিং ডিসকাউন্টের ব্যাপারটা এক্সপ্লেইন করলাম। প্রাইভেট পার্কিং কোম্পানির সঙ্গে রেস্টুরেন্টের অনেক সময় ডিল থাকে খরিদ্দারদের কাছ থেকে কম পার্কিং ফি নেবার জন্যে। সেইজন্যেই বিল পে করার সময় ক্যাশিয়ারকে পার্কিং টিকিটটা দিলে সে তার ওপর রেস্টুরেন্টের ছাপ মেরে দেয়। পার্কিং অ্যাটেন্ডেন্ট সেই ছাপ দেখলে ডিসকাউণ্ট দেয়। কিন্তু টিকিটটা পার্কিং অ্যাটেন্ডকেই জমা দিতে হয় – ওদের হিসেব রাখার জন্যে।

“তাই নাকি স্যার! তাহলে তো আরও ওখানে যাওয়া দরকার।”
“কখন যেতে চান?” প্রমথ জিজ্ঞেস করল।
“শুভস্য শীঘ্রম স্যার। এখন যাওয়া যায় না?”

“অন্ধকার হয়ে আসছে, এখন যাবেন? কুইন্স এমনিতে খুব আনসেফ নয়, কিন্তু কিছু কিছু জায়গায় সমস্যা আছে,” আমি সতর্ক করলাম।

“আজ যাওয়াটাই ভাল স্যার। কারণ আজও শুক্রবার। উই মে গেট সাম ক্লু কেন ডায়রির পাতাগুলো ছেঁড়া হয়েছিল।”

প্রমথ বলল, “ইশশ্, আমার এত যেতে ইচ্ছে করছে! কিন্তু একবার ল্যাবে না গেলেই নয়। আর ফিরতে ফিরতে দেরি হয়ে যেতে পারে।”
“তাহলে তো মুশকিল স্যার।”
“আমি যেতে পারি,” আমি বললাম।

গল্পের বিষয়:
সাইন্স-ফিকশন
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত