অন্ধকারের গ্রহ

অন্ধকারের গ্রহ

টেবিলের অন্যপাশে বসে থাকা মানুষটা একবার ভিডিও মডিউলটার দিকে তাকালো, তারপর য়ুহার দিকে তাকালো, তাকে দেখে মনে হয় সে বুঝি এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে য়ুহা তার সামনে বসে আছে।

তুমি য়ুহা?

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমি য়ুহা। মনে নাই আমি গত সপ্তাহে এসেছিলাম

হ্যাঁ আমার মনে আছে। মানুষটা মাথা নাড়ল, তুমি শব্দ দিয়ে কী যেন কর।

আমি শব্দশিল্পী। য়ুহা তার ছেলেমানুষী মুখটা গম্ভীর করার চেষ্টা করে বলল, তোমরা যাকে বল কবি।

কবি?

হ্যাঁ। আমি শব্দকে এমনভাবে সাজাতে পারি যে সাধারণ একটা কথা অসাধারণ হয়ে যাবে।

তাজ্জবের ব্যাপার। সামনে বসে থাকা মানুষটা তার গাল চুলকাতে চুলকাতে বলল, আমি ভেবেছিলাম এসব জিনিস উঠে গেছে। ভেবেছিলাম কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক দিয়ে সব করা যায়। ছবি আঁকা যায়, সংগীত তৈরি করা যায়, কবিতা লেখা যায়—

য়ুহা হা হা করে হাসল, বলল, যাবে না কেন? নিশ্চয়ই যায়। কিন্তু সেই ছবি, সেই সংগীত কিংবা সেই কবিতা হবে খুব নিম্নস্তরের। হাস্যকর, ছেলেমানুষী! খাঁটি শিল্প যদি চাও তাহলে দরকার খাঁটি মানুষ। খাঁটি কবিতা লিখতে পারে শুধু খাঁটি মানুষের খাঁটি মস্তিষ্ক। য়ুহা নিজের মাথায় টোকা দিলে বলল, আসল কবিতা লিখতে হলে দরকার আসল নিউরনের মাঝে আসল সিনান্স সংযোগ।

টেবিলের অন্যপাশে বসে থাকা মানুষটা ফেঁস করে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি মনে কিছু নিও না ছেলে, কিন্তু আমার ধারণা ছিল লেখক কবি শিল্পী এই ধরনের মানুষকে কেউ গুরুত্ব দিয়ে নেয় না। তোমার চিঠিটা দেখি সবাই খুব গুরুত্ব দিয়ে নিয়েছে। প্রাথমিক বাছাই হয়ে সেটা একেবারে তিন ধাপ উঠে গেছে। একাডেমি দেখি সাথে সাথে অনুমতি দিয়ে দিল—

য়ুহা টেবিলে থাবা দিয়ে বলল, দেবে না কেন? একশ বার দেবে। একজন কবির ইচ্ছা লক্ষ মানুষের ইচ্ছা থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। একজন কবি যেটা ভাবে সেটা হচ্ছে পুরো জাতির ভাবনার নির্যাস। প্রাচীনকালে—

টেবিলের অন্যপাশে বসে থাকা মানুষটা সহৃদয় ভঙ্গিতে হাত তুলে য়ুহাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, সবই বুঝলাম, কিন্তু আমার প্রশ্ন অন্য জায়গায়।

কোন জায়গায়?

এত কিছু থাকতে তুমি মহাকাশযানে উঠতে চাইছ কেন?

য়ুহার ছেলেমানুষী চেহারায় এখন উত্তেজনার ছাপ পড়ল। সে বড় একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তুমি বুঝতে পারছ না? আমি হচ্ছি একজন কবি। আর করিরা হচ্ছে সৌন্দর্যের পূজারি। আমি বুভুক্ষের মতো সৌন্দর্য খুঁজে বেড়াই। এই বায়োডোমের প্রত্যেকটা বিন্দুতে আমি সৌন্দর্য খুঁজেছি। এখন আমি এই সৌন্দর্য খুঁজতে চাই মহাকাশের শূন্যতা থেকে। মহাকাশের প্রায় অলৌকিক নিঃসঙ্গতা থেকে–

টেবিলের সামনে বসে থাকা মানুষটা আবার হাত তুলে য়ুহাকে থামালো। ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি জান মহাকাশযানে যেতে হলে কী পরিমাণ প্রশিক্ষণ নিতে হয়? দশ জি তুরণে যখন মহাকাশযানটা যেতে শুরু করে তখন মনে হয় পুরো মহাকাশযানটা টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। শরীরটা হয়ে যায় সিসার মতো ভারি। প্রচণ্ড চাপে হৃৎপিণ্ড থেমে যেতে চায়। মনে হয় চোখের মণি কোটর থেকে বের হয়ে আসবে। কোনো কিছু পরিষ্কার করে চিন্তা করা যায় না চোখের সামনে তখন কাঁপতে থাকে একটা লাল পর্দা, মাথায় তো একটা যন্ত্রণা!।

য়ুহার চোখ উত্তেজনায় চকচক করতে থাকে, সে নিঃশ্বাস আটকে রেখে বলে, আমি তো সেই অভিজ্ঞতাই পেতে চাই!

পাবে। সেই অভিজ্ঞতাই পাবে। মনে হয় তার থেকে বেশিই পাবে। ছোট একটা মহাকাশযানে অল্প কিছু মানুষ। কোনো যোগাযোগ নেই, যেদিকে তাকাও কুচকুচে কালো অন্ধকার আকাশ, তার মাঝে নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। তার ওপর কথা বলতে বলতে মানুষটা হঠাৎ থেমে গেল।

য়ুহা জিজ্ঞেস করল, তার ওপর কী?

নাহ্। কিছু না।

বলে ফেলো। আমি সবকিছু জানতে চাই।

মানুষটা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বিপদ আপদ আছে না? মহাজাগতিক দস্যু আছে। আন্তঃ গ্যালাক্টিক বিদ্রোহী আছে। গেরিলা যুদ্ধ আছে। ছিনতাই আছে। সেদিন খবর পেলাম আস্ত একটা মহাকাশযান নিখোঁজ হয়ে গেছে–

এই সব রকম অভিজ্ঞতা নিয়ে হচ্ছে একজন মানুষের জীবন।

য়ুহার চকচকে চোখ আর ছেলেমানুষী মুখের দিকে তাকিয়ে মানুষটা হেসে ফেলল, বলল, ঠিক আছে তাহলে তুমি এই সবকিছু নিয়েই মানুষ হবার জন্যে প্রস্তুতি নাও। আমার কাছে যেটুকু তথা আছে সেটা দেখে মনে হচ্ছে তোমার প্রশিক্ষণের তারিখ দেওয়া হয়েছে। সেটা শেষ হওয়ার পর প্রথম যে মহাকাশযান রওনা দেবে সেটাতে তোমাকে তুলে দেয়া হবে।

সেটা কী রকম মহাকাশযান হবে? কে কে থাকবে সেখানে?

আগে থেকে তো বলা যাবে না। একটা বাণিজ্যিক মহাকাশযান হতে পারে–যেটা হয়তো আকরিক নিয়ে যাচ্ছে। প্রতিরক্ষা বাহিনীর মহাকাশযান হতে পারে। বিজ্ঞানীদের গবেষণা মহাকাশযানও হতে পারে। তোমার কপাল খারাপ হলে অপরাধী বোঝাই দুবৃত্তদের একটা মহাকাশযান হতে পারে।

য়ুহা তার কপালের ওপর থেকে চুলগুলো সরিয়ে বলল, যেটাই হোক আমি কোনোটাকে ভয় পাই না! আমি একবার ভয়াবহ নিঃসঙ্গতাটা অনুভব করতে চাই। মানুষেরা চেতনা বুঝতে হলে আগে বুঝতে হয় নিঃসঙ্গতা-

বুঝবে। তুমি নিঃসঙ্গতা বুঝবে। একা থাকার কী যন্ত্রণা তুমি সেটা খুব ভালো করেই বুঝবে। টেবিলের সামনে বসে থাকা মানুষটা য়ুহার দিকে তাকিয়ে সহৃদয়ভাবে হেসে বলল, যখন একজনের টুটি আরেকজন চেপে ধরতে চাইবে, তখন কিন্তু আমাকে দোষ দিও না।

য়ুহা বলল, সেটাও এক ধরনের অভিজ্ঞতা। একজন কবির কাছে সেটারও একটা মূল্য আছে।

য়ুহা আরো কিছু বলতে চাচ্ছিল, মানুষটা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, যাও, তুমি এখন পাশের ঘরে যাও। তোমার শরীরের পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে হবে।

য়ুহা উঠে দাঁড়িয়ে পাশের ঘরের দিকে রওনা দিল।

মহাকাশ একাডেমি থেকে য়ুহা যখন বের হয়েছে তখন দুপুর হয়ে গেছে। সূর্য মাথার ওপর এবং বেশ তীব্র রোদ। মুহ। নীল আকাশের দিকে তাকিয়ে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। এই মহাকাশে মানুষ যেখানেই বসতি তৈরি করেছে সেখানে নীল আকাশ তৈরি করেছে, সূর্য তৈরি করেছে। এই সব আসলে কৃত্রিম, আসল পৃথিবীর আসল আকাশ আর সেই আকাশে জ্বলজ্বলে প্রখর সূর্য না জানি কী রকম! পৃথিবীর নির্বোধ মানুষেরা সেই গ্ৰহটাকে নষ্ট না করে ফেললে এখনো তো মানুষেরা সেখানে থাকতে পারত। আবার কি কখনো পৃথিবীর মানুষ পৃথিবীতে ফিরে যেতে পারবে?

কমান্ডার একটু অবাক হয়ে এগারোজন মানুষের দিকে তাকিয়ে রইল, গত কয়েক দিনের অবরোধে ছয়জন মারা গেছে, তা না হলে এখানে সতেরোজন থাকত। মাত্র সতেরোজন মানুষ ছোট একটা স্কাউটশিপে করে এসে পুরো বায়োডোমের অস্তিত্বটাই প্রায় শেষ করে ফেলেছিল। একটা ছোট ঘরের মাঝে গাদাগাদি করে রাখা এই মানুষগুলোর দিকে তাকিয়ে কেউ কি অনুমান করতে পারবে এরা কত দুর্ধর্ষ, কত সুশৃঙ্খল, নিজেদের আদর্শের জন্যে কত আন্তরিক? এ রকম বিদ্রোহী দলকে কি কখনোই পুরোপুরি পরাস্ত করা যাবে?

কমান্ডার একটা নিঃশ্বাস ফেলে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের দলপতি কে?

মানুষগুলো তার প্রশ্নের কোনো উত্তর দিল না, এক ধরনের ভাবলেশহীন চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল। কমান্ডার বলল, আমি তোমাদের একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছি, তোমাদের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে।

মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ, তার মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি, চোখের নিচে কালি, গালের চামড়াটা নির্মমভাবে ঘষতে ঘষতে পিচিক করে মেঝেতে থুথু ফেলে বলল, মিছি মিছি সময় নষ্ট করো না। আমাদের নিয়ে কী করতে চাও করে ফেল।

তুমি যদি জিজ্ঞেস করো আমি কী করতে চাই তাহলে আমি কী বলব জান?

মানুষগুলো ভাবলেশহীন চোখে তার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো উত্তর দিল না। কমান্ডার তখন নিজেই বলল, আমি বলব যে, আমি তোমাদের সবাইকে ছেড়ে দিতে চাই। সত্যি কথা বলতে কী ছেড়ে দেবার আগে তোমাদের সবাইকে নিয়ে একবেলা খেতে চাই। খাঁটি যবের রুটি, মসলা মাখানো ঝলসানো তিতির পাখির মাংস, আঙুরের রস-

মধ্যবয়স্ক মানুষটা বিরক্ত গলায় বলল, ফালতু কথা বলো না। আমাদের নিয়ে কী করতে চাও করো। মারতে চাইলে মেরে ফেক, আফা চুকে যাক।

কমান্ডার জিব দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, মেরে ফেলাটা তো সবচেয়ে সহজ, তোমাদের জন্যেও সহজ, আমাদের জন্যেও সহজ। কিন্তু এত সহজে কি কাউকে মারা যায়? তোমাদের যে ছয়জন মারা গেছে তাদের মস্তি

ও এর মাঝে কয়োজেনিক চেম্বারে রেখে দেয়া হয়েছে। তাদের সাথেও যোগাযোগ করা হবে। তোমাদের কথা তো ছেড়েই দিলাম, তোমাদের মস্তি স্কের প্রত্যেকটা নিউরনকে ওলটপালট করে দেখা হবে সেখানে কী আছে! কমান্ডার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বিষয়টা আমার হাতে নেই। যদি আমার হাতে থাকত তাহলে আমি তোমাদের সবাইকে ছেড়ে দিতাম। ছেড়ে দেবার আগে তোমাদের সবাইকে উষ্ণ সুগন্ধী পানিতে গোসল করার সুযোগ করে দিতাম। গোসল করে তোমরা ভাজভাঙা নিও পলিমারের কাপড় পরতে-

মধ্যবয়স্ক মানুষটা হিংস্র গলায় বলল, ফালতু কথা বলো না। তোমার ফালতু কথা শুনে আমার বমি এসে যাচ্ছে।

কমান্ডার মাথা নাড়ল, বলল, আমি দুঃখিত। আমি খুবই দুঃখিত যে আমার একেবারে আন্তরিক কথাগুলোকেও তোমার কাছে ফালতু কথা মনে হচ্ছে! শুধু যে ফালতু মনে হচ্ছে তা-ই না, কথাটা শুনে তোমার বমি এসে যাচ্ছে। যা-ই হোক, আমি তাহলে আর কথা বলব না। তোমাদের সাথে কথা বলার জন্যে, তোমাদের মুখ থেকে কথা বের করার জন্যে বিশেষ বাহিনীই আছে। তারাই বলবে। তবে আমি আগের থেকে তোমাদের সাবধান করে দিই, তাদের পদ্ধতিটা কিন্তু তোমাদের ভালো লাগবে না। একেবারেই ভালো লাগবে না।

কমান্ডার ছোট ঘরটা থেকে বের হতে গিয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে গেল, গাদাগাদি করে বসে থাকা মানুষগুলোর দিকে মাথা ঘুরিয়ে বলল, আমি জানি আমার কথাগুলো শুনতে তোমাদের খুবই বিরক্তি লাগছে, তারপরেও আমাকে বলতেই হবে, তোমরা অসম্ভব ভালো যুদ্ধ করেছ। আমি মুগ্ধ হয়েছি। এত অল্প যোদ্ধা দিয়ে যে এ রকম একটা অপারেশন করা যায় সেটা অবিশ্বাস্য।

ছোট ঘরের মেঝেতে গাদাগাদি করে বসে থাকা মানুষগুলো কোনো কথা বলল না। কমান্ডার তাদের সবার দিকে একবার চোখ বুলিয়ে কোনায় বসে থাকা একটা কমবয়সী মেয়ের দিকে তাকালো, বলল, আমার এখনো বিশ্বাস হয় না, মেয়ে, তুমিও কি যুদ্ধ করছিলে?

মেয়েটি অন্যমনস্কভাবে সামনে তাকিয়ে ছিল, কমান্ডারের কথা শুনে তার দিকে ঘুরে তাকালো, বলল, তুমি কি আমাকে কিছু জিজ্ঞেস করেছ?

হ্যাঁ। আমার কৌতূহল—তুমিও কি সত্যি যুদ্ধ করেছ?

হ্যাঁ। করেছি।

কমান্ডার মাথা নেড়ে বলল, কী আশ্চর্য। তোমাকে দেখে মনেই হয় না তুমি যুদ্ধ করতে পার। তোমাকে দেখে মনে হয় একজন ভাবুক, একজন বিজ্ঞানী বা সে রকম কিছু। তোমার বয়সী একজনের এখন জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করার কথা অথচ তুমি কি না–

মেয়েটা হাসার মতো শব্দ করে বলল, তুমি কেমন করে জান আমি জ্ঞান-বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা করি না? আরোপিত বুদ্ধিমত্তার ওপরে আমার একটা মডেল আছে। একটু সময় পেলেই আমি সেটার একটা গাণিতিক বিশ্লেষণ করব। সত্যি কথা বলতে কী আমি এটা নিয়েই ভাবছিলাম যখন

তুমি আমার মনোযোগটা নষ্ট করলে।

খোঁচা খোঁচা দাড়িসহ মধ্যবয়স্ক মানুষটা পিচিক করে মেঝেতে একটু থুথু ফেলে বলল, আমাদের রায়ীনা খুঁটি বৈজ্ঞানিক। একশ ভাগ খাঁটি বৈজ্ঞানিক।

কমান্ডার একবার মধ্যবয়স্ক মানুষটার দিকে তাকালো, তারপর কমবয়সী মেয়েটার দিকে তাকালো, জিজ্ঞেস করল, তোমার নাম রায়ীনা?

মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।

তার মানে তোমরা তোমাদের সম্পর্কে কোনো তথ্য দেবে না সেটা সত্যি না? তুমি তোমার নাম বলেছ, তুমি কী নিয়ে গবেষণা করেছ সেটা বলেছ-

তুমি যদি চাও তাহলে আমার পছন্দের খাবার কী, আমার প্রিয় সিম্ফোনি কোনটা, কোন প্রাইম সংখ্যাটা এই মুহূর্তে সবচেয়ে বড় সেগুলোও তোমাকে বলে দিতে পারব। কিন্তু আসলে আমাদের সেগুলো নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে করছে না। যে ছয়জন মারা গেছে তার মাঝে একজন আমার খুব প্রিয় বন্ধু ছিল।

কমান্ডার একটা নিঃশ্বাস ফেলে বাল, আমি জানি। তোমরা আমার কথা বিশ্বাস করবে না, কিন্তু তবু বলি। আমি খুবই দুঃখিত বীনা, আমি খুবই দুঃখিত।

মেঝেতে গাদাগাদি করে বসে থাকা মানুষগুলো কোনো কথা বলল না, শুধু মধ্যবয়স্ক মানুষটা আবার পিচিক করে মেঝেতে থুথু ফেলল।

রায়ীনা অন্যমনস্কভাবে শুনে তাকিয়ে ছিল, এবারে মাথা ঘুরিয়ে মধ্যবয়স্ক মানুষটার দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় বলল, এটা তোমার খুব খারাপ একটা অভ্যাস, এভাবে মেঝেতে থুথু ফেলবে না।

ঠিক আছে ফেলব না। বলে সে নিজের অজান্তেই আরেকবার মেঝেতে থুথু ফেলল।

কন্ট্রোল রুমে উঁকি দিয়েই য়ুহী ক্যাপ্টেন ক্রবকে দেখতে পেল। প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে মহাকাশযানের সব কয়জন ক্রুয়ের ত্রিমাত্রিক ছবি তাকে দেখানো হয়েছে কিন্তু য়ুহার কারো চেহারাই মনে নেই। মহাকাশযানের ক্যাপ্টেনের কাধে একটা লাল তারা থাকে সেটা তার মনে আছে, কাজেই কন্ট্রোল রুমের মধ্যবয়সী মানুষটা নিশ্চয়ই মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন, তার কাঁধে একটা লাল তারা জ্বল জ্বল করছে।

য়ুহা কন্ট্রোল রুমে ঢুকে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের সামনে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন ক্ৰবের সামনে একটা হলোগ্রাফিক প্যানেল, সেখানে কোনো একটা অদৃশ্য সুইচকে সে টানাটানি করছিল। য়ুহাকে দেখে ক্যাপ্টেন ক্ৰব হাত নামিয়ে তার দিকে দুই পা এগিয়ে এলো, তুমি নিশ্চয়ই য়ুহা?

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। আমি য়ুহা।

কবি য়ুহা?।

য়ুহা একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, অনেকে আমাকে তা-ই বলে।

আমার ত্রিশ বৎসরের জীবনে আগে কখনো এ রকম ঘটনা ঘটেনি। একাডেমি থেকে নির্দেশ দিয়েছে একজন কবিকে নিয়ে যেতে। শুধু তা-ই না, সেই নির্দেশে বলা আছে তোমার সৃজনশীলতাকে উৎসাহ দেয়ার উপযোগী একটা পরিবেশ তৈরি করে দিতে! খুব একটা মজার কথা বলেছে এ রকম ভাব করে ক্যাপ্টেন ক্রুব হা হা করে হাসতে লাগল।

য়ুহা কী বলবে বুঝতে না পেরে একটু হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে রইল। ক্যাপ্টেন ত্রুব হাসি থামিয়ে বলল, একজন কবির জন্যে সৃজনশীল পরিবেশ কী আমার সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই!

য়ুহা বলল, আসলে আমাদের জন্যে আলাদা কোনো পরিবেশের প্রয়োজন হয় না। যে কোনো পরিবেশই আমাদের জন্যে সৃজনশীল পরিবেশ।

ভালো। খুব ভালো। শুনে নিশ্চিন্ত হলাম।

আমি কি তোমাদের কোনো কাজে সাহায্য করতে পারি?

তোমার পেছনে যদি আমাদের সময় দিতে না হয় সেটাই হবে আমাদের জন্যে একটা রিরাট সাহায্য।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, দিতে হবে না। আমি প্রশিক্ষণটা খুব ভালোভাবে নিয়েছি। তুমি বিশ্বাস করবে কি না জানি না আমাকে এগারো জি তে নিয়ে গিয়েছিল, আমি তবু জ্ঞান হারাইনি।

ভালো, খুব ভালো।

য়ুহা একটু ইতস্তত করে বলল, ক্যাপ্টেন ক্ৰব, আমি কি মহাকাশযানটা ঘুরে দেখতে পারি?

অবশই। ক্যাপ্টেন ক্ৰব একটু চিন্তা করে বলল, তোমার সাথে আমি বরং একজন ক্রুকে দিয়ে দিই, প্রথমবার সে তোমাকে সবকিছু দেখিয়ে দিক।

ক্যাপ্টেন জব তার যোগাযোগ মডিউলের একটা বোতাম টিপতেই নিঃশব্দে একজন ক্রু এসে হাজির হলো। সোনালি চুলের কমবয়সী একটা মেয়ে, তার মুখে এক ধরনের কাঠিন্য। মেয়েটি কোনো কথা না বলে ঘরের এক কোণায় নিঃশব্দে এসে দাঁড়াল। ক্যাপ্টেন ত্রুব সরাসরি তার দিকে না তাকিয়ে বলল, ক্লিজা, তুমি য়ুহাকে মহাকাশযানটা একটু ঘুরিয়ে দেখাও।

ক্লিডা বলল, দেখাচ্ছি মহামান্য ক্যাপ্টেন। তারপর ঘুরে য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, চল, আমার সাথে।

য়ুহা ক্লিডার সাথে ঘর থেকে বের হতে হতে এফ, আমার নাম য়ুহা।

জানি। আমাদের রেকর্ডে তোমার নাম আছে। তুমি নিশ্চয়ই ক্লিডা। হ, আমি কর্পোরাল ক্লিডা।

তার মানে, আমার তোমাকে কর্পোরাল ক্লিডা বলে সম্বােধন করতে হবে? শুধু ক্রিড়া বললে হবে না?

তুমি যেহেতু আমাদের কমান্ডের নও তুমি যা ইচ্ছে তা-ই ডাকতে পার।

আচ্ছা ক্লিভা, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করি?

কর।

ক্যাপ্টেন ত্রুব যখন তোমাকে ডাকল, আর তুমি যখন এলে তখন এসে তুমি চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকলে। কোনো কথা বললে না! কারণটা কী?

ক্লিডা এমনভাবে য়ুহার দিকে তাকালো যেন সে খুব একটা বিচিত্র কথা বলেছে, ভুরু কুঁচকে বলল, আমি নিজে থেকে কেন ক্যাপ্টেন ক্ৰকে কিছু জিজ্ঞেস করব? ক্যাপ্টেন ক্ৰব আমাকে ডেকেছে, দেখেছে আমি এসেছি।

তার যখন ইচ্ছে করবে তখন সে কথা বলবে।

কিন্তু আমাকে যদি ডাকত আমি ঘরে গিয়েই জিজ্ঞেস করতাম, ক্যাপ্টেন ক্ৰব! তুমি কি আমাকে ডেকেছ?

তুমি সেটা করতে পার, কারণ তুমি কমান্ডের মাঝে নেই। যারা কমান্ডের মাঝে থাকে তাদের কিছু নিয়মকানুন মানতে হয়।

এটাই তোমাদের নিয়ম? আমি আসলে সেটাই জানতে চাচ্ছিলাম। হ্যাঁ, এটাই নিয়ম।

যুহ বলল, তুমি কিছু মনে করো না ক্লিড়া তোমার কাছে আমার আরও একটা প্রশ্ন।।

বল, কী প্রশ্ন।

তুমি যখন এলে, ক্যাপ্টেন ক্রব যখন তোমার সাথে বলল তখন সে তোমার দিকে না তাকিয়ে কথা বলেছে। আমরা যখন একজন আরেকজনের সাথে কথা বলি তখন তার দিকে তাকাই। আমার মনে হলো, মনে হলো।

কী মনে হলো?

মনে হলো যেন তোমাকে একটু তাচ্ছিল্য করা হলো।

য়ুহার কথা শুনে ক্লিডা একটু অবাক হয়ে তাকালো, বলল, তাচ্ছিল্য?। মোটেও তাচ্ছিল্য করা হয়নি।

নিশ্চয়ই করেনি কিন্তু আমার মনে হলো।

তোমার মনে হওয়াটা ভুল। আমাদের কমান্ডে একেকজন একেক ধাপে থাকে। যারা নিচের ধাপে থাকে তারা সব সময়েই উপরের ধাপের যে আছে তার আদেশ মেনে চলে। এটা শৃঙ্খলার জন্যে প্রয়োজন, শৃঙ্খলা খুব গুরুত্বপূর্ণ।

য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার জীবনে কোনো শৃঙ্খলা নেই। আগে কখনো ছিল না, পরেও থাকবে বলে মনে হয় না।

ক্লিডা মুখ শক্ত করে বলল, শৃঙ্খলা ছাড়া কোনো বড় কাজ করা যায় না।

য়ুহা বলল, বড় কাজ করার জন্যে সবার জন্মও হয় না। অনেকের জন্ম হয় ছোট কাজ করার জন্যে। ছোট আর তুচ্ছ। কিন্তু খুব প্রয়োজনীয়। সবাই যদি বড় কাজ করে তাহলে কেমন করে হবে?

ক্লিডা একবার য়ুহার দিকে তাকালো কিন্তু কোনো কথা বলল না। য়ুহা গলার স্বর পাল্টে বলল, আমাকে একবার মহাকাশযানটা দেখাও।

কোথা থেকে শুরু করতে চাও? ইঞ্জিন। আমি প্রথমে দেখতে চাই মহাকাশযানের ইঞ্জিন।

বেশ। চল তাহলে ইঞ্জিনঘরে যাই। এই মহাকাশযানের ইঞ্জিন দুটো। দুটোই কুরু ইঞ্জিন। এর জ্বালানি হিসেবে বের করা হয় পদার্থ এবং প্রতিপদার্থ। নিরাপত্তার দিক দিয়ে এই জ্বালানির কোনো তুলনা নেই। বিশাল একটা মহাকাশযানকে এটা অনির্দিষ্ট সময় দশ জি ত্বরণে রাখতে পারে। মহাকাশযাত্রার ইতিহাসে একটা ব্ল্যাক হোলের কাছে বিপজ্জনকভাবে গিয়ে বের হওয়ার একমাত্র উদাহরণটুকু এই কুরু ইঞ্জিনের।

ক্লিডা শান্ত গলায় কথা বলতে থাকে, য়ুহা এক ধরনের মুগ্ধ চোখে কথাগুলো শোনে। সে আগে কখনোই এ ধরনের কোনো কথা শোনেনি।

খাবার টেবিলে ক্যাপ্টেন ত্রুব য়ুহাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কি মহাকাশযানটা দেখেছ?

হ্যাঁ দেখেছি।

তোমার কী মনে হয়, যেতে পারবে আমাদের সাথে?।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, অবশ্যই পারব। চমৎকার একটা মহাকাশযান। দেখে মনে হয় এর প্রত্যেকটা স্কু বুঝি অনেঃ যত্ন করে তৈরি করা হয়েছে।

সেটা তুমি খুব ভুল বলনি।

আমরা কখন রওনা দেব?

চব্বিশ ঘণ্টার মাঝে। কার্গো পৌঁছানোর সাথে সাথে।

আমাদের কার্গোটা কী?

য়ুহার কথা শুনে খাবার টেবিলের সবাই এক মুহূর্তের জন্যে থেমে গেল। য়ুহা একটা অবাক হয়ে বলল, আমি কি ভুল কিছু জিজ্ঞেস করে ফেলেছি?

বলতে পার। এটা সামরিক মহাকাশযান। এখানে কেউ নিজে থেকে কিছু জানতে চায় না। যার যেটা জানার দরকার তাকে সেটা জানানো হয়।

য়ুহা মুখে হাসি টেনে বলল, আর আমি যদি জিজ্ঞেস না করেই কিছু একটা জেনে যাই, সেটা কি বেআইনি হবে?

ক্যাপ্টেন ক্ৰব তার পানীয়ের গ্লাসটা স্নায়ু উত্তেজক পানীয় দিয়ে ভরতে ভরতে বলল, না সেটা বেআইনি হবে না। তুমি কি কিছু জেনেছ?

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ জেনেছি।

কী জেনেছ?

এই মহাকাশযানের কার্গো হচ্ছে মানুষ। এগারোজন মানুষ।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব চোখ বড় করে য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কেমন করে সেটা অনুমান করলে?

ক্লিডা যখন আমাকে মহাকাশযানটি দেখাচ্ছিল তখন শীতলঘরে নিয়ে গিয়েছিল। সেখানে এগারোটা ক্রায়োজেনিক ক্যাপসুল চার্জ করা হচ্ছিল। তার মানে নিশ্চয়ই এগারোজন মানুষকে নেয়া হবে।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব তার পানীয়ে চুমুক দিয়ে বলল, আর কিছু অনুমান করেছ?

হ্যাঁ করেছি।

কী অনুমান করেছ?

য়ুহা পানীয়ের গ্লাসটা হাতে নিয়ে বলল, এই এগারোটা মানুষকে তোমরা নিশ্চয়ই খুব ভয় পাও। তা না হলে তাদের ক্রয়োজেনিক ক্যাপসুলে করে কেন নেবে? আমার মতো যাত্রী হিসেবে নিতে পারতে।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব মাথা নাড়ল, বলল, ভালো অনুমান করেছ য়ুহা।

য়ুহা তার পানীয়টুকু এক চুমুকে শেষ করে দিয়ে বলল, আমি মানুষগুলো দেখার জন্যে খুব আগ্রহী হয়ে আছি।

কেন?

আমার মনে হচ্ছে তাদের মাঝে নিশ্চয়ই রহস্য আছে। আমি একজন কবি, মানুষের চরিত্র, তাদের চরিত্রের রহস্য বুঝতে আমার খুব ভালো লাগে।

ঘুম থেকে উঠে য়ুহা আবিষ্কার করল মহাকাশযানের ক্রুদের প্রত্যেকের হাতে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র। সে একটু অবাক হয়ে একজন ক্রুকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের সবার হাতে অস্ত্র কেন? কিছু কি হয়েছে?

মানুষটি বলল, না, কিছু হয়নি। এটা সামরিক মহাকাশযান, আমরা সামরিক মানুষ। আমাদের হাতে অস্ত্র থাকতে হয়।

কিন্তু গতকাল তো ছিল না।

মহাকাশযানের কাজকর্মে প্রতিমুহূর্ত অস্ত্র রাখতে হয় না। সে জন্যে আমরা রাখি না। আজকে অস্ত্র রাখতে হবে।

য়ুহা কৌতূহলী চোখে বলল, বিপজ্জনক মানুষগুলো আসছে বলে?

বলতে পার।

তোমার অস্ত্রটা একটু দেখাবে?

মানুষটি হেসে ফেলল, বলল, এগুলো অত্যন্ত বিপজ্জনক অস্ত্র। না বুঝে কোনো একটা সুইচ স্পর্শ করে কিংবা একটা লিভার টেনে তুমি এখানে প্রলয়কাণ্ড করে ফেলতে পার! তোমার হাতে অস্ত্র দেয়াটা ঠিক হবে না!

তবে—

তবে কী?

একাডেমি থেকে যে চিঠিটা এসেছে সেই চিঠিতে লেখা আছে তোমার সব কৌতূহলকে সম্মান করতে। তুমি যদি ক্যাপ্টেন ক্ৰবের কাছে আবেদন কর, তোমাকে একটা অস্ত্র দেখানো হতে পারে।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে, আমি তাহলে তা-ই করি। ব্যাপারটা মন্দ হয় না। কী বল? কবির হাতে অস্ত্র!

 

ক্যাপ্টেন ত্রুব য়ুহার কথা শুনে একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি অস্ত্র চালানো শিখতে চাও?

আসলে ঠিক চালানো শিখতে চাই তা নয়। একটা সত্যিকারের অস্ত্র হাতে নিয়ে দেখতে চাই। যদি চালানো না শিখি তোমরা তো অস্ত্র হাতে নিতে দেবে না।

সেটা ঠিক। এই অস্ত্রগুলো খুব বিপজ্জনক। কিন্তু অস্ত্র কেন হাতে নিতে চাও?

য়ুহা একটু ইতস্তত করে বলল, তুমি কিছু মনে করো না ক্যাপ্টেন ক্ৰব–আমার কাছে সব সময় মনে হয়েছে একটা অস্ত্র আসলে সৃষ্টি জগতের সবচেয়ে অশুভ জিনিস। তুমি কি চিন্তা করতে পারে, একটা অস্ত্র তৈরি করা হয়েছে মানুষকে হত্যা করার জন্যে। হত্যা! মানুষ কেন মানুষকে হত্যু! করবে? আর সেই হত্যা করার জিনিসটা মানুষ কেন হাতে নিয়ে ঘুরে বেড়াবে?

ক্যাপ্টেন ক্রব কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, মানুষের সভ্যতার ইতিহাস পড়েছ কবি য়ুহা? পুরো ইতিহাসটুকুই হচ্ছে যুদ্ধের ইতিহাস-

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। পড়েছি। সেজন্যেই বলছি। আমি তাই এই অশুভ জিনিসটা একবার স্পর্শ করে দেখতে চাই।

বেশ। আমি ব্যবস্থা করে দিই। তোমাকে একটা প্রশিক্ষণ দেব, যদি সেটা নিতে পার তোমাকে একটা অস্ত্র নিয়ে ঘুরতে দেব।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, না, না, আমি অস্ত্র নিয়ে ঘুরতে চাই না। আমি শুধু একবার স্পর্শ করতে চাই।

সেটা তোমার ইচ্ছা। কিন্তু একাডেমি থেকে তোমাকে যে অনুমতিপত্র দিয়েছে তাতে তুমি নিজের কাছে একটা অস্ত্র রাখতে পার।

য়ুহা মাথা নাড়ল, না। না। আমি অস্ত্র রাখতে চাই না।

ক্যাপ্টেন ক্রব কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, সেটা তোমার ইচ্ছা।

যে মানুষটি য়ুহাকে অস্ত্র ব্যবহার করা শেখাল তার নাম হিসান। সে প্রথমে য়ুহাকে মহাকাশযানে রাখা সবগুলো অস্ত্র দেখাল, একজন মানুষ কাঁধে করে আস্ত নিউক্লিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র নিয়ে যেতে পারে সেটা য়ুহা জানত না, দেখে সে খুব অবাক হলো। একটা মহাকাশযান থেকে ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে যে অন্য একটা মহাকাশযানকে উড়িয়ে দেয়া যায় সেটাও সে জানত না। সাধারণ অস্ত্রগুলো বেশ হালকা এর ভেতরে ভয়ঙ্কর ধ্বংসলীলা চালানোর মতো এত বিস্ফোরক কেমন করে থাকে সেটা একটা রহস্য। হিসান ব্যাপারটা য়ুহাকে বোঝানোর চেষ্টা করল। রুহা ঠিক ভালো করে বুঝতে পারল না।

য়ুহাকে সে অস্ত্রটি ব্যবহার করতে শেখানো হলো সেটি হালকা এবং দেখতে প্রায় খেলনার মতো। কোনো কিছুকে আঘাত করার আগে সেটাকে লেজার রশ্মি দিয়ে লক করে নিতে হয়। ট্রিগার টানার সাথে সেকেন্ডে দশটি বিস্ফোরক ছুটে যায়। লক্ষ্যবস্তুকে ভেদ করে বিস্ফোরিত হয়, কাজেই এর ধ্বংস ক্ষমতা অসাধারণ। ভুল করে কোথাও চাপ দিয়ে হঠাৎ করে যেন কোনো দুর্ঘটনা ঘটিয়ে না ফেলে সে জন্যে একাধিক সেফটি লক রয়েছে।

মহাকাশযানের ভেতরেই অস্ত্র চালানোর অনুশীলন ঘর রয়েছে। য়ুহাকে সেখানে প্রশিক্ষণ দিয়ে হিসান তার হাতে অস্ত্রটা তুলে দিয়ে বলল, নাও। এখন এটা তোমার অস্ত্র। তুমি যতদিন মহাকাশযানে থাকবে তুমি এটা নিজের কাছে রাখতে পারবে।

না। আমি নিজের কাছে রাখতে চাই না। আমি শুধু একবার এটাকে হাতে নিয়ে দেখতে চাই।

নাও, দেখ।

য়ুহা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে নিয়ে দাঁড়াল। সে এখন ইচ্ছে করলেই একটা মানুষকে খুন করে ফেলতে পারবে চিন্তা করেই তার শরীর কাটা দিয়ে ওঠে। য়ুহা অস্ত্রটা হাতে নেয়, ট্রিগারে আঙুল রেখে সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকে। তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে একটা সত্যিকার অস্ত্র হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

য়ুহা বুক থেকে নিঃশ্বাসটা ছেড়ে দিয়ে বলল, তুমি কি জান, এই অস্ত্রটা কি কখনো ব্যবহার করা হয়েছে?

হিসান মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ হয়েছিল।

কখন, কীভাবে?

বেশ কয়েকবার। একটা বিদ্রোহ বন্ধ করার জন্যে—

কেউ কি মারা গিয়েছিল?

হ্যাঁ। এই অস্ত্রটি দিয়ে প্রায় সতেরোজনকে মা্রা হয়েছিল। সব রেকর্ড করা থাকে, নতুন করে ব্যবহার করার আগে রেকর্ড মুছে দেয়া হয়।

য়ুহা অস্ত্রটি হাতে নিয়ে অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে, তা এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না যে সে হাতে একটা অস্ত্র ধরে রেখেছে যেটা দিয়ে সতেরো জন মানুষকে হত্যা করা হয়েছিল। সতেরোটি প্রাণ! হয়তো সতেরোটি পরিরার। সতেরোজন ভালোবাসার মানুষ। য়ুহার শরীরটা কেমন জানি শিউরে ওঠে, সে প্রায় ছটফট করে অস্ত্রটা হিসানের দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে, নাও। রেখে দাও।

এটা তোমার নামে ইস্যু করা হয়েছে। তুমি রাখতে পার।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, না, না, আমি রাখতে চাই না।

একটা অস্ত্র আসলে একজনের ব্যক্তিত্বের পরিবর্তন করে দিতে পারে। যখনই তুমি এটা হাতে নেবে তখনই তুমি অনুভব করবে তুমি একজন ভিন্ন মানুষ। অন্য মানুষ থেকে তোমার ক্ষমতা বেশি। তুমি নিজে ভেতরে এক ধরনের নতুন আত্মবিশ্বাস অনুভব করবে। নতুন ক্ষমতা অনুভব করবে।

য়ুহা আবার মাথা নাড়ল, বলল, না। আমার এই আত্মবিশ্বাসের দরকার নেই। ক্ষমতারও দরকার নেই। যে ক্ষমতার অনুভূতির জন্যে হাতে অস্ত্র নিতে হয় আমার সেই অনুভূতির প্রয়োজন নেই।

হিসান হেসে বলল, আমি ভেবেছিলাম, তুমি একজন কবি। সব রকম অভিজ্ঞতাই তোমার কাছে মূল্যবান।

সেটা সত্যি, সব অভিজ্ঞতাই আমার কাছে মূল্যবান। তবে কিছু অভিজ্ঞতা আমি এগিয়ে গিয়ে গ্রহণ করি, কিছু অভিজ্ঞতা থেকে পালিয়ে চলে আসি। হাতে অস্ত্র রাখাটা সে রকম একটা অভিজ্ঞতা।

কেন?

আমার মনে হয় অস্ত্র খুব বুঝি অশুচি একটা জিনিস। মনে হয় এটা হাতে নিলে আমিও বুঝি অশুচি হয়ে যাব।

হিসান তার নিজের অস্ত্রটি হাতবদল করে খুব অবাক হয়ে য়ুহার দিকে তাকিয়ে রইল।

য়ুহা যদিও বলেছিল সে কিছুতেই অস্ত্র হাতে নেবে না কিন্তু দেখা গেল সত্যি সত্যি তার স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা হাতে নিয়ে সে কার্গো বেতে অপেক্ষা করছে। অন্য কিছু দেখুক আর না-ই দেখুক এগারোজন বন্দীকে তার দেখার খুব ইচ্ছা ছিল, কিন্তু নিরাপত্তার খাতিরে অস্ত্র ছাড়া কারো সেখানে যাবার কথা নয়।

শেষ পর্যন্ত এগারোজন বন্দী হেঁটে হেঁটে কার্গো বে’তে এসেছে তখন য়ুহা অবাক হয়ে আবিষ্কার করল মানুষগুলো নেহায়েতই নিরীহ ধরনের। কয়েকজন মধ্যবয়স্ক, পোড় খাওয়া চেহারা, অন্যরা কমবয়সী। দু-একজন বয়সে প্রায় কিশোর। চারজন নানা বয়সী মেয়ে, এর মাঝে একজনকে আলাদা করে চোখে পড়ে, চেহারার মাঝে এক ধরনের কমনীয়তা রয়েছে, দেখে মনেই হয় না সে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করতে পারে। য়ুহা অবাক হয়ে ক্যাপ্টেন এবকে জিজ্ঞেস করল, এরা সবাই যোদ্ধা?

হ্যাঁ।

এরা সবাই বিদ্রোহী দলের?

হ্যাঁ।

এরা কোথায় ধরা পড়েছে?

একটা স্কাউটশিপ করে বায়োডোম আক্রমণ করতে এসেছিল। অসাধারণ যুদ্ধ করেছে।

যুদ্ধে কি কেউ মারা গেছে?

হ্যাঁ, অনেকে মারা গেছে। এদের মারা গেছে ছয়জন।

এখন এদের কোথায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে?

ক্যাপ্টেন ক্রব য়ুহার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, বলার নিয়ম নেই।

নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে নেয়া হচ্ছে। তাই না?

সম্ভবত।

মস্তিষ্ক স্ক্যান করে সব তথ্য বের করা হবে?

সম্ভবত।

এরা আর কখনোই মুক্তি পাবে না?

সম্ভবত না।

য়ুহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমি কি এদের সাথে কথা বলতে পারি?

ক্যাপ্টেন ত্ৰুব য়ুহার দিকে ঘুরে তাকিয়ে জিজ্ঞেস, তুমি কী নিয়ে কথা বলতে চাও?

আমি ঠিক জানি না।

তারা তোমার কথার উত্তর দেবে না। শুধু শুধু চেষ্টা করো না।

তবুও, আমি কি তাদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করতে পারি?

ক্যাপ্টেন ক্রুব একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ঠিক আছে যাও। কিন্তু মনে রেখো আমি তোমাকে যেতে নিষেধ করেছিলাম।

য়ুহা তখন বন্দীদের দিকে এগিয়ে গেল। এগারোজন বন্দী কার্গো বে-এর খোলা জায়গাটিতে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, য়ুহী একটু এগিয়ে গিয়ে তাদের উদ্দেশ করে বলল, তোমরা কেমন আছ?

মানুষগুলো খানিকটা অবাক হয়ে য়ুহার দিকে তাকালো, কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। য়ুহা আবার জিজ্ঞেস করল, কেমন আছ তোমরা?

এবারেও কেউ তার প্রশ্নের উত্তর দিল না। য়ুহা একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, আমি তোমাদের একটা প্রশ্ন করেছি, তোমরা কেমন আছ?

মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ পিচিক করে মেঝেতে থুথু ফেলে বলল, আমাদের বিরক্ত করো না, যদি কিছু করার না থাকে তাহলে জাহান্নামে যাও।

য়ুহার চোখে-মুখে বেদনার একটা ছায়া পড়ল, সে বলল, আমি জানি তোমরা এখন খুব দুঃসময়ের মাঝ দিয়ে যাচ্ছ, তার মানে এই নয় যে তোমরা অকারণে রূঢ় হবে।

কমবয়সী একজন ব্যঙ্গ করে বলল, আহা হা! সোনামণি মনে কষ্ট পেয়েছে। আস, আস! কাছে অস, তোমার গালে একটা চুমু দিই।

এবারে বন্দীদের সবাই শব্দ করে আনন্দহীন এক ধরনের হাসি হেসে উঠল। য়ুহা আহত গলায় বলল, তোমরা ঠিক বুঝতে পারছ না। আমরা এবং তোমরা একই মানুষ। তোমাদের জন্যে আমাদের সম্মানবোধ থাকবে ঠিক সে রকম আমাদের জন্যে তোমাদের সম্মানবোধ থাকতে হবে।

মধ্যবয়স্ক মানুষটি এবার গলা উঁচিয়ে বলল, তুমি জাহান্নামে যাও ছেলে। দূর হও এখান থেকে।

রুহা আহত দৃষ্টিতে মানুষটির দিকে তাকিয়ে রইল, দেখে মনে হয় তার চোখে পানি এসে যাবে। কিছু একটা বলার চেষ্টা করল, ঠিক বলতে পারল না। তখন বন্দীদের ভেতরে কমনীয় চেহারার মেয়েটা বলল, ছেলে, তুমি একটা জিনিস মনে হয় ধরতে পারনি।

য়ুহা বলল, আমার নাম য়ুহা।

য়ুহা। তুমি মনে হয় একটা জিনিস–

আমি আমার নাম বলেছি। তোমারও উচিত তোমার পরিচয় দেওয়া।

আমার নাম রায়ীনা।

তোমার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম রায়ীনা।

মেয়েটা হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গি করে বলল, য়ুহা, তুমি একটা জিনিস এখনো ধরতে পারিনি। আমরা আর তোমরা এক মানুষ নই। তোমাদের সবার ঘাড়ে একটা করে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রয়েছে। তোমরা আর কিছুক্ষণের মাঝে আমাদের সবাইকে শীতলঘরে ঢুকিয়ে ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় নিয়ে একটা জড়বস্তুতে পাল্টে দেবে। আমাদের আর কখনো জাগিয়ে তোলা হবে কি না জানি না। যদি জাগিয়ে তোলাও হয় সেটা কত শত বৎসর পরে হবে আমরা সেটা জানি না। কাজেই এই সময়টুকু আমাদের একান্তই নিজস্ব সময়। আমাদের এটা ব্যবহার করতে দাও। যদি তুমি সত্যিই মনে করো আমাদের সম্মান দেখাবে তাহলে আমাদের একলা থাকতে দাও। বুঝেছ?

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, বুঝেছি। আমি খুবই দুঃখিত–

রায়ীনা কঠিন গলায় বলল, এই শব্দগুলো তোমরা ব্যবহার করো না। তোমরা পেশাদার সৈনিক, তোমার ঘাড়ে অস্ত্র, তোমাদের ঠান্ডা মাথায় শক্র হত্যা করানো শেখানো হয়। আমরা তোমাদের শত্রু, আমাদের জন্যে তোমাদের কোনো দুঃখবোধ নেই। শুধু শুধু কথাগুলো উচ্চারণ করে আমাদের অপমান করো না।

য়ুহা মৃদু গলায় বলল, আসলে আমি পেশাদার সৈনিক না।

তাহলে তুমি কে?

আমি–আমি–আমি একজন—

কী?

য়ুহা প্রশ্নটির উত্তর দিতে পারল না, বিড়বিড় করে বলল, না, কিছু না। কেউ না। আমি একজন একজন মানুষ। সাধারণ মানুষ।

 

য়ুহা যখন ক্যাপ্টেন ক্রবের কাছে পৌঁছাল তখন ক্যাপ্টেন ক্রব নরম গলায় বলল, এখন বুঝেছ, আমি কেন তোমাকে ওদের কাছে যেতে নিষেধ করেছিলাম?

হ্যাঁ, বুঝেছি।

তুমি জগৎটাকে যেমন কল্পনা করো জগন্টা সে রকম না। জগৎটা অনেক কঠিন।

য়ুহা নিচু গলায় বলল, বাইরে। শুধু বাইরে জগৎটা কঠিন। ভেতরে সব এক। নিশ্চয়ই সব এক।

পাশাপাশি এগারোটি ক্রায়োজেনিক সিলিন্ডার সাজিয়ে রাখা হয়েছে। প্রত্যেকটার ভেতরে একজন করে মানুষ। নিয়ন্ত্রণকক্ষে বড় প্যানেলের সামনে দুজন দাঁড়িয়ে আছে। একজন মাথা ঘুরিয়ে পেছনে দাঁড়ানো ক্যাপ্টেন ক্রবকে জিজ্ঞেস করল, আমি কি শীতল করতে শুরু করব?

হ্যাঁ। কর।

মানুষটি মাইক্রোফোনের বোতামটি স্পর্শ করে বলল, তোমাদের দেহকে শীতল করার প্রক্রিয়া শুরু হচ্ছে। বিষয়টি তোমাদের জন্যে অনেক সহজ হবে যদি তোমরা আমার কথাগুলো মন দিয়ে শোন। শরীরকে শীতল করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তোমাদের শরীরে স্বাভাবিক রক্ত সঞ্চালন হওয়ার জন্যে আমরা চাই তোমরা সবাই তোমাদের হাত দুটি বুকের ওপর নিয়ে এসো, বাম হাতের ওপর ডান হাতটি রাখ।।

এগারোজন বন্দীর ভেতর মাত্র চারজন সেই নির্দেশ অনুযায়ী হাত দুটো বুকের ওপর আনল। য়ুহা মনিটরগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল, সে দেখল মধ্যবয়স্ক রূঢ় ধরনের মানুষটি মুখ বিকৃত করে একটা অশালীন শব্দ উচ্চারণ করেছে। য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে রায়ীনার দিকে তাকালো, মেয়েটি দুই হাত সামনে এনে হাতের আঙুলে কিছু একটা গুনছিল, সে মাইক্রোফোনে দেয়া নির্দেশটি শুনেছে বলে মনে হলো না।

কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়ানো মানুষটি মাইক্রোফোনের কাছে মুখ এনে নিচু গলায় বলল, আমরা এখন তোমাদের সিলিন্ডারে নিহিলা গ্যাসের মিশ্রণ পাঠাচ্ছি। তোমাদের শরীর অবসন্ন হয়ে আসবে, চোখের পাতা ভারি হয়ে আসবে। তোমাদের শরীরের জন্যে পুরো বিষয়টি সহজ হবে যদি তোমরা পুরো শরীরটাকে ঢিলে করে রাখ, স্নায়ুকে নরম করে রাখ। আমি এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনব তার মাঝে তোমাদের সবার চোখে ঘুম নেমে আসার কথা।

কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি নিচু গলায় গুনতে শুরু করে, এক-দুই-তিন-চার-পাঁচ-ছয়…

য়ুহা দেখতে পায় দশ পর্যন্ত গোনার অনেক আগেই একজন একজন করে সবাই অচেতন হয়ে পড়ছে। সবার শেষে অচেতন হলো রায়ীনা এবং অচেতন হওয়ার পরও তার মস্তিষ্কে এক ধরনের কর্মকাণ্ডের স্ক্যান দেখা যেতে লাগল।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব বলল, এই মেয়েটা একটু অন্য রকম।

য়ুহা জানতে চাইল, কী রকম?

সব সময় কিছু না কিছু চিন্তা করছে। মস্তিষ্কটাকে ব্যবহার করছে।

কী নিয়ে চিন্তা করছে বলা সম্ভব?

কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি বলল, মস্তিষ্কের যে জায়গা থেকে সিগন্যাল আসছে সেটা গাণিতিক চিন্তাভাবনার জায়গা। মেয়েটা সম্ভবত কোনো গাণিতিক সমস্যার কথা ভাবছে।

য়ুহা অবাক হয়ে বলল, মেয়েটা অচেতন হয়েও ভাবছে।

ক্যাপ্টেন জব বলল, আমরা সবাই ভাবি। কেউ বেশি কেউ কম।

কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি ক্যাপ্টেন ক্ৰবের দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমি এদের ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় নেবার অনুমতি চাইছি ক্যাপ্টেন ক্ৰব।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বলল, অনুমতি দিলাম।

মানুষটি প্যানেলের একটি বোতাম স্পর্শ করতেই মৃদু একটা হিস হিস শব্দ শোনা যেতে থাকে, সিলিন্ডারগুলোর পাশ থেকে এক ধরনের সাদা ধোয়া বের হতে শুরু করে। য়ুহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কী হচ্ছে?

কিছু না।

সাদা ধোয়াগুলো কী?

জলীয় বাষ্প। সিলিন্ডার থেকে বের করে দেয়া হচ্ছে।

তাদের শরীর কী শীতল হতে শুরু করেছে?

হ্যাঁ। শুরু করেছে। মানুষটি মনিটরের এক জায়গায় হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, এইখানে তাদের শরীরের তাপমাত্রা দেখতে পাবে।

য়ুহা দেখতে পায় খুব ধীরে ধীরে তাদের শরীরের তাপমাত্রা কমে আসছে। ঠিক কী কারণে জানা নেই সে নিজের বুকের ভেতরে এক ধরনের বেদনা অনুভব করে। একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পুরোপুরি শীতল হতে কতক্ষণ সময় নেবে?

দুই থেকে তিন ঘণ্টার মাঝে করার নিয়ম। আমরা হয়তো আরো একটু তাড়াতাড়ি করব।

দুই ঘণ্টা পর য়ুহা শীতলঘরটিতে আবার ফিরে এসে প্যানেলগুলোর দিকে তাকালো। এগারোজন মানুষকে এগারোটি পাথরের মূর্তির মতো দেখাচ্ছে। তাদের শরীরে প্রাণের স্পন্দন দূরে থাকুক কোনো ধরনের রাসায়নিক বিক্রিয়ার কোনো চিহ্ন নেই। য়ুহা দীর্ঘ সময় রায়ীনার নিষ্প্রাণ মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে থাকে। এই মেয়েটির দেহে সত্যি কি আবার প্রাণ সঞ্চার করা যাবে? সেটি কি এই মেয়েটির জন্যে একটি জীবনের শুরু হবে না কি একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের শুরু হবে?

য়ুহা কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটিকে জিজ্ঞেস করল, এই এগারোজনকে দেখে-শুনে রাখবে কে?

আমাদের কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক।

য়ুহা ভুরু কুঁচকে বলল, যদি কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কে কোনো সমস্যা হয়

মানুষটি শব্দ করে হেসে বলল, সমস্যা হবে না।

যদি হয়।

হবে না।

আমি কথার কথা বলছি। যদি হয়?

মানুষটি বলল, তুমি কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক সম্পর্কে জান না বলে এ রকম বলছ। কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কে কখনো সমস্যা হয় না। এখানে চারটি স্তর আছে। একটি স্তর নষ্ট হলে অন্যটা দায়িত্ব নেয়। সেটা নষ্ট হলে অন্যটা। যখন কোনো স্তর নষ্ট হয় সেটা নিজে থেকে নিজেকে সারিয়ে নেয়। অনেকটা জৈবিক প্রাণীর মতো শুধু প্রাণী থেকে অনেক বেশি চৌকস!

য়ুহা কিছুক্ষণ চিন্তা করে বলল, যদি কেউ কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক একটা নিউক্লিয়ার বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেয় তাহলে কি এই এগারোজন মারা যাবে?

না। মারা যাবে না। এই সিলিন্ডারের যে ব্যাকআপ সিস্টেম আছে সেটা দায়িত্ব নেবে। তাকে বাঁচিয়ে রাখবে। মানুষটি ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, তুমি এ রকম অদ্ভুত অদ্ভুত প্রশ্ন কেন জিজ্ঞেস করছ?

রুহা মাথা নাড়ল, বলল, মোটেও অদ্ভুত প্রশ্ন নয়। এগুলো অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। এগারোজন মানুষের জীবনের দায়িত্ব খুব সহজ দায়িত্ব নয়।

মানুষটি হা হা করে হেসে বলল, এই কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক পুরো মহাকাশযানটা মহাকাশে উড়িয়ে নেবে। শুধু এই এগারোজন নয় আমাদের সবার জীবনের দায়িত্ব কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের।

য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, ভাগ্যিস আমার কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক হয়ে জন্ম হয়নি–আমি কখনো এত বড় দায়িত্ব নিতে পারতাম না!

মানুষটি হেসে বলল, কিন্তু কোয়ান্টাম কম্পিউটার এই দায়িত্বটি নেয়। রুটিনমাফিক নেয়।

মিটিয়া নামে কমান্ডের ডাক্তার মেয়েটি য়ুহার ওপর ঝুঁকে পড়ে তার কপালের পাশে একটা প্রোব লাগাচ্ছিল। মেয়েটি বেশ হাসিখুশি, দুক্ষ হাতে কাজ করতে করতে সে গুনগুন করে একটা ভালোবাসার গান গাইছে। প্রিয় মানুষটি মহাকাশে হারিয়ে গেছে, ভালোবাসার মেয়েটি জানালা দিয়ে দূর আকাশের একটি নক্ষত্রের দিকে তাকিয়ে ভাবছে, এটি কি তার প্রিয় মানুষের মহাকাশযান-গানের কথাগুলো এ রকম।

য়ুহা বলল, তুমি খুব সুন্দর গাইতে পার।

মিটিয়া হেসে বলল, তার অর্থ তুমি কখনো গান বা সঙ্গীত শোনো না! সে জন্যে বলছ আমি সুন্দর গাইতে পারি।

য়ুহা বলল, শুনি। সে জন্যেই বলছি। তোমার গলা খুব সুন্দর।

ধন্যবাদ।

কমান্ডের এই কঠিন কাজ করতে করতে তুমি গান গাইবার সময় পাও?।

পাই না। তাই কাজ করার সময় গুনগুন করি।

তুমি এখন কী করছ মিটিয়া।

মিটিয়া মাথা নেড়ে বলল, বিশেষ কিছুই না। তুমি যেহেতু প্রথমবার যাচ্ছ তাই তোমাকে নিয়ে আমরা একটু বেশি সতর্ক থাকছি, আর কিছু না।

আমাকে নিয়ে তোমাদের ব্যস্ত হতে হবে না। প্রশিক্ষণের সময় আমাকে খুব ভালোভাবে প্রস্তুত করে দিয়েছে।

প্রশিক্ষণ ক্যাম্প আর আসল মহাকাশযানে অনেক পার্থক্য। প্রশিক্ষণ ক্যাম্প সবকিছু হয় নিয়মমাফিক। রুটিনমাফিক। সত্যিকারের মহাকাশযানে বিচিত্র বিচিত্র ঘটনা ঘটে। প্রত্যেকটা অভিযান হচ্ছে নতুন, প্রত্যেকটা অভিযান হচ্ছে বিচিত্র! এখন পর্যন্ত একটা অভিযানে আমি যাইনি যেখানে নতুন একটা কিছু ঘটেনি।

য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে মিটিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কী মনে হয়? এই অভিযানেও কী নতুন কিছু ঘটবে?

ঘটতেই পারে?

কী ঘটতে পারে বলে তোমার মনে হয়?

মিটিয়া খিল খিল করে হেসে বলল, সেটা আমি আগে থেকে কেমন করে বলব? তুমি যেহেতু নতুন মানুষ তুমি কিছু একটা কর।

য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, সেটা তুমি খারাপ বলনি! আমারই কিছু একটা করা দরকার।

মিটিয়া বড় বড় দুটি বেল্ট হাতে নিয়ে বলল, এখন তুমি কয়েক মিনিট চুপ করে বস, তোমাকে এই সিটের সাথে এখন শক্ত করে বেঁধে ফেলতে হবে!।

য়ুহা নিঃশব্দে বসে রইল, মিটিয়া তার দক্ষ হাতে তাকে আরামদায়ক চেয়ারটায় আটকে ফেলে বলল, চমৎকার! এখন তুমি ইচ্ছে করলেও কোনো বিপদ ঘটাতে পারবে না।

য়ুহা বলল, আমার বিপদ ঘটানোর কোনো ইচ্ছে নেই!

শুনে খুশি হলাম। মিটিয়া য়ুহার হাত ধরে বলল, তোমার শরীরের সকল কাজকর্ম এখন কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক নিয়ন্ত্রণ করছে। তোমার কোনো অসুবিধা হবার কথা নয়। তার পরেও যদি মনে করো তোমার কিছু একটা সমস্যা হচ্ছে তাহলে এই লাল লিভারটা টেনে ধরো।

ঠিক আছে।

তুমি এখন চুপচাপ শুয়ে থাক। কিছুক্ষণের মাঝেই আমরা রওনা দেব।

চমৎকার। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ মিটিয়া।

ধন্যবাদ য়ুহা।

মিটিয়া চলে যাবার পর য়ুহা আরামদায়ক চেয়ারটাতে সমস্ত শরীর এলিয়ে দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় অপেক্ষা করতে থাকে। তার এখনো বিশ্বাস হয় না যে সে সত্যি সত্যি একটি মহাকাশ অভিযানে যাচ্ছে। পদার্থ প্রতি পদার্থের বিক্রিয়ায় যে প্রচণ্ড শক্তির সৃষ্টি হবে সেই শক্তিতে এই মহাকাশ্যানটি তীব্র গতিতে ছুটে যাবে। সেই গতির কারণে সময় স্থির হয়ে যেতে চাইবে–সেই মুহূর্তগুলো কি সে অনুভব করতে পারবে? য়ুহা এক ধরনের উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষা করতে থাকে।

ক্যাপ্টেন ক্ৰবের গলায় একটা ঘোষণা শুনতে পেল য়ুহা, শান্ত গলায় বলছে, মহাকাশযানের সবাইকে যাত্রার জন্যে প্রস্তুত হতে বলছি। আমি ইঞ্জিন দুটো শুরু করছি এখন।

য়ুহা একটা চাপা গুমগুম শব্দ শুনতে পেল। হঠাৎ করে মহাকাশযানটি থরথর করে কাঁপতে থাকে। কিছু একটা হঠাৎ ঘটে গেল, য়ুহার মনে হতে থাকে অদৃশ্য কোনো একটা শক্তি তাকে যেন তার চেয়ারে প্রচণ্ড শক্তিতে চেপে ধরেছে! য়ুহা প্রাণপণে নিজেকে সেখান থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে, তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যেতে চায়, সে বড় বড় মুখ করে নিঃশ্বাস নেয়, ৩ মনে হয় সে বুঝি বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছে না।

মহাকাশযানের মাঝে একটা লাল আলো কিছুক্ষণ পর পর ঝলকানি দিতে থাকে। একটা চাপা যান্ত্রিক শব্দ ভেসে আসে। পুরো মহাকাশযানটি থরথর করে এমনভাবে কাঁপতে থাকে যে য়ুহার মনে হতে থাকে পুরো মহাকাশযানটি ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। যতই সময় যেতে থাকে য়ুহার মনে হয় অদৃশ্য শক্তিটা বুঝি তাকে আরো জোরে চেপে ধরছে। তার মনে হতে থাকে সে বুঝি তার চোখের পর্দাটাও আর খুলতে পারবে না। মাথায় এক ধরনের ভোতা যন্ত্রণা অনুভব করতে থাকে, চোখের ওপর একটা লাল পর্দা খেলা করতে থাকে। মুখের ভেতরটা শুকিয়ে গেছে, সে প্রবল এক ধরনের তৃষ্ণা অনুভব করে। য়ুহার মনে হতে থাকে সে বুঝি জ্ঞান হারিয়ে ফেলবে, কিন্তু যে কোনো মূল্যে সে জেগে থাকতে চায়। য়ুহা প্রচণ্ড গতির সেই বিস্ময়কর শুরুটুকু নিজের চোখে দেখতে চায়, নিজের ইন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করতে চায়। প্রাণপণে সে চোখ খোলা রেখে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে থাকে। সে বিড়বিড় করে নিজেকে বলল, আমি অচেতন হব না। কিছুতেই অচেতন হব না। কিছুতেই হব না?

য়ুহা দাঁতে দাঁত কামড় দিয়ে শক্ত হয়ে বসে থাকে। সে অনুভব করতে থাকে তার শরীরের মাংসপেশিতে ভোতা এক ধরনের যন্ত্রণা। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে, মনে হচ্ছে কেউ যেন টেনে তার মুখের মাংসপেশি পেছন দিকে সরিয়ে নিয়েছে, মুখ থেকে দাঁতগুলো বের হয়ে আসছে, চেষ্টা করেও সে সেটা বন্ধ করতে পারছে না। এটি একটি অভূতপূর্ব অনুভূতি। য়ুহা নিজেকে বোঝাল, পৃথিবীর খুব বেশি মানুষের এই অনুভূতিটি অনুভব করার সৌভাগ্য হয়নি। আমি নিঃসন্দেহে একজন সৌভাগ্যবান মানুষ। অত্যন্ত সৌভাগ্যবান মানুষ।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি য়ুহা এক সময় এই ভয়ঙ্কর পরিবেশে অভ্যস্ত হয়ে গেল। সে অনেক কষ্ট করে বড় বড় নিঃশ্বাস নিতে নিতে চোখ বন্ধ করে শুয়ে থাকে। কোনো একটা বিচিত্র কারণে সে পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছিল না, মাথার ভেতরে কিছু একটা দপদপ করছে, সে তার সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে অপেক্ষা করছে কখন এটি শেষ হবে। বুকের ওপর চেপে বসে থাকা অদৃশ্য পাথরটি সরে যাবে, আবার সে উঠে বসতে পারবে।

য়ুহার কাছে যখন মনে হয় বুঝি অনন্তকাল কেটে গেছে তখন হঠাৎ করে মহাকাশযানের ত্বরণ কমে আসতে শুরু করে। য়ুহার হঠাৎ করে মনে হতে থাকে তার সারা শরীর বুঝি পাখির পালকের মতো হালকা হয়ে আসছে। যখন মিটিয়া এসে তার বেল্টটি চাপ দিয়ে খুলে তাকে বের করে আনল, তখন য়ুহা তাকে জড়িয়ে ধরে বলল, অনেক ধন্যবাদ মিটিয়া, আমার মনে হচ্ছিল, আমি বুঝি আর কখনো এই অদৃশ্য দানবের হাত থেকে মুক্তি পাব না!

মিটিয়া য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, প্রথমবার হিসেবে তুমি চিৎকার করেছ য়ুহা। তোমাকে নিয়ে আমাদের রীতিমত গর্ব হচ্ছে।

ধন্যবাদ মিটিয়া।

এরপরের ধাপে তুমি নিশ্চয়ই আরো ভালো করবে!

পরের ধাপ?

হ্যাঁ। এর পরের ধাপ!

য়ুহা ভুরু কুঁচকে বলল, এর পরের ধাপ মানে কী?

মহাকাশযানটি ক্রমাগত তার গতিবেগ বাড়িয়ে চলে। একবারে তো করা যায় না, তাই এটাকে ধাপে ধাপে করতে হয়। প্রত্যেকবারই তার গতিবেগ আগের থেকে বাড়িয়ে তোলা হয়। মাঝে মাঝে আমরা বিরতি দিই, তখন দৈনন্দিন কাজগুলো সেরে নিতে হয়। খাওয়া-দাওয়া করি।

য়ুহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, আবার মহাকাশযানের গতি বাড়ানো হবে? আবার আমাকে মহাকাশযানের চেয়ারে বেল্ট দিয়ে বেঁধে বসতে হবে?

হ্যাঁ। মিটিয়া মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, একবার নয়, অনেকবার।

অনেকবার?

হ্যাঁ। প্রত্যেকবারই আগেরবার থেকে বেশি তীব্রতায় এবং বেশি সময় ধরে।

য়ুহা ফ্যাকাসে মুখে বলল, সত্যি?

হ্যাঁ, সত্যি। তবে ভয় নেই-তুমি দেখবে ধীরে ধীরে পুরো ব্যাপারটায় তুমি অভ্যস্ত হয়ে পড়েছ!

তার মানে আমার আর কষ্ট হবে না?

মিটিয়া য়ুহার হাত স্পর্শ করে বলল, আমি সেটা বলিনি। কষ্ট যেটুকু হবার সেটা তো হবেই।

তাহলে?

কষ্ট সহ্য করা শিখে যাবে।

ঘণ্টা দুয়েক পর য়ুহা আবার আবিষ্কার করল, তাকে মহাকাশযানের আরামদায়ক চেয়ারটিতে শক্ত করে বেঁধে ফেলা হয়েছে। সে নিঃশ্বাস বন্ধ করে অপেক্ষা করতে থাকে। বিশাল মহাকাশযানটি আবার ঝটকা দিয়ে থরথর করে কাঁপতে শুরু করে। মহাকাশযানের ভেতর একটা লাল আলোর ঝলকানি দেখা যায়, য়ুহার মনে হতে থাকে তার বুকের ওপর একটা অদৃশ্য পাথর ধীরে ধীরে চেপে বসেছে। হব না। আমি অচেতন হব না। য়ুহা বিড়বিড় করে বলল, আমি কিছুতেই অচেতন হব না।

য়ুহা তার সমস্ত স্নায়ুকে শক্ত করে পাথরের মতো বসে থাকে। মনে হতে থাকে বুঝি অনন্তকাল কেটে যাচ্ছে।

ধাপে ধাপে মহাকাশযানের গতিবেগ বাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত চূড়ান্ত গতিবেগে পৌঁছানোর পর মহাকাশযানের ভেতরের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এলো। খাবার টেবিল ঘিরে কমান্ডের সবাই এসে বসেছে, ক্যাপ্টেন ব য়ুহার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলল, এই যে কবি য়ুহা তোমার অবস্থা কেমন?

ভালো।

তোমার খুব দুর্ভাগ্য যে তুমি একটা সামরিক মহাকাশযানে যাচ্ছ। সাধারণ যাত্রীদের মহাকাশযানে এত কষ্ট নেই।

কষ্ট ছাড়া যদি যাওয়া যায় তাহলে মিছি মিছি কষ্ট করা হয় কেন?

সময় বাঁচানোর জন্যে। প্রাথমিক গতিবেগ যত বাড়ানো যায় তত সময় বাঁচানো যায়। মহাকাশযানের পুরো ব্যাপারটাই হচ্ছে সময়। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রাথমিক বেগটা বাড়িয়ে নিয়েছি।

য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বেগ যেটুকু বাড়ানোর কথা ততটুকু বাড়ানো হয়ে গেছে? আর বাড়ানো হবে না?

ক্যাপ্টেন ত্রুব একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, কবি য়ুহা–এই যে তুমি মহাকাশযানের ভেতরে ভেসে বেড়াচ্ছ না, শক্ত মেঝেতে দাঁড়িয়ে আছ তার অর্থ আমাদের বেগ এখনো বাড়ছে। তবে সেটা আমাদের সহ্যসীমার ভেতরে। তাই তুমি টের পাচ্ছ না।

য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, সব মিলিয়ে আমার একটা চমৎকার অভিজ্ঞতা হলো।

মিটিয়া নামের ডাক্তার মেয়েটি হেসে বলল, অভিজ্ঞতা হলো বলো না, বল অভিজ্ঞতা হওয়া শুরু হলো।

য়ুহা ভয়ে ভয়ে বলল, কেন? আরও কিছু হবে নাকি?

গতিবেগটা যেভাবে বাড়ানো হয়েছে আবার সেভাবে কমানো হবে? একই ব্যাপার হবে তখন।

য়ুহা শুকনো মুখে বলল, সেটা কখন হবে?

মিটিয়া মাথা নাড়ল, বলল, যখন সময় হবে তখন জানানো হবে।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, তার দেরি আছে য়ুহা। তুমি নিশ্চিন্ত মনে তোমার মহাকাশ ভ্রমণ উপভোগ কর। তোমার আনন্দের জন্য এখানে সব রকম ব্যবস্থা করে দেয়া আছে।

ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন ক্ৰব। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।

আমাকে ধন্যবাদ দেবার কিছু নেই। আমাদের উপরে নির্দেশ দেয়। হয়েছে আমরা যেন তোমার আনন্দের ব্যবস্থা রাখি। তোমার সম্মানে আজকে আমরা বিশেষ ধরনের খাবারের ব্যবস্থা করেছি। নাও খেতে শুরু কর।

বিশেষ ধরনের খাবার খেতে গিয়ে য়ুহা আবিষ্কার করে সেটি আসলে মোটামুটি সাধারণ খাবার। মহাকাশযানের দীর্ঘ সময়ের জন্যে নিশ্চয়ই খাবারে বৈচিত্র্য আনা কঠিন। য়ুহা এক টুকরো শুকনো রুটি গরম স্যুপে ভিজিয়ে মুখে দিয়ে চিবুতে চিবুতে বলল, আমার ধারণা ছিল তোমাদের কোনো একজন একটা ককপিটে বসে থেকে মহাকাশযানটাকে চালিয়ে নিয়ে যাবে!

য়ুহার কথা শুনে খাবার টেবিলের কয়েকজন শব্দ করে হেসে উঠল। ক্যাপ্টেন ক্রুব মাথা নেড়ে বলল, না, আমাদের এই মহাকাশযানটা আমাদের চালিয়ে নিতে হয় না। যাত্রার শুরুতে আমাদের গন্ত স্থানের কোঅর্ডিনেট ঢুকিয়ে দিতে হয়। বাকি কাজটুকু কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক করে।

তোমাদের কিছুই করতে হয় না? না, আমাদের কিছুই করতে হয় না।

য়ুহা একটু ইতস্তত করে বলল, একটা যন্ত্রের ওপর এত বিশ্বাস রাখা। কি ঠিক?

উত্তেজক পানীয় খাবার কারণে প্রায় সবাই একটু তরল মেজাজে ছিল, এবারে অনেকেই শব্দ করে হেসে উঠল। হিসান নামের সুদর্শন মানুষটি তার পানীয়ের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বলল, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ককে যন্ত্র বলা ঠিক নয়। তার ভেতর যে জটিল নেটওয়ার্ক আছে সেটা মানুষের মস্তিষ্কের নেটওয়ার্ক থেকেও বেশি জটিল, বেশি বিস্তৃত। এই মহাকাশযানের প্রত্যেকটা বিন্দুর ওপর সেটি দৃষ্টি রাখছে, সেটি নিয়ন্ত্রণ রাখছে।

ক্যাপ্টেন ত্রুব গলা উঁচিয়ে বলল, য়ুহাকে আমাদের কোয়ার্টজ গোলকের পরীক্ষাটি দেখিয়ে দিই।

মিটিয়া মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ, হ্যাঁ, সেটা দেখিয়ে দাও!

ক্যাপ্টেন ক্রব হিসানের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি একটা কোয়ার্টজ গোলক নিয়ে এসো তো!

হিসান প্রায় সাথে সাথেই একটা ছোট কোয়ার্টজের স্বচ্ছ গোলক এনে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের হাতে ধরিয়ে দেয়। ক্যাপ্টেন ক্র অনেকটা বক্তৃতার ভঙ্গিতে বলল, এই যে আমার হাতে গোলকটা দেখছ এটা একটা নিখুঁত গোলক। এটাকে ভরশূন্য পরিবেশে তৈরি করা হয়েছে। এই কোয়ার্টজের গোলকটাকে আমি সাবধানে এই টেবিলটার ওপর রাখছি।

ক্যাপ্টেন ত্রুব সাবধানে গোলকটাকে টেবিলের ওপর রাখল, তারপর হাত সরিয়ে নিয়ে বলল, তুমি দেখছ এটা স্থির হয়ে আছে, কোনোদিকে গড়িয়ে যাচ্ছে না?

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ দেখছি।

তার মানে কী বলতে পারবে?

য়ুহা মাথা চুলকে বলল, তার মানে, তার মানে—এই টেবিলটা একেবারে সোজা, এটা কোনোদিকে ঢালু হয়ে নেই?

হ্যাঁ। একজন কবি হিসেবে তোমার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা খারাপ নয়। আমাদের এই মহাকাশযানের প্রযুক্তি প্রায় নিখুঁত, এই টেবিলগুলো সব সময়েই সোজা কোথাও কোনোদিকে ঢালু হয়ে নেই। কিন্তু এখানে আরেকটা ব্যাপার আছে।

কী ব্যাপার?

মহাকাশযানটা এক জি ত্বরণে সোজা, সামনের দিকে যাচ্ছে। এত বড় একটা মহাকাশযানের গতিতে এতটুকু বিচ্যুতি না ঘটিয়ে নিখুঁতভাবে নেয়া কিন্তু সহজ নয়। যদি এতটুকু বিচ্যুতি হয় আমরা এই গোলকটাতে দেখব। যদি মহাকাশযানটা একটু বামদিকে ঘুরে যায় এই গোলকটা ডানদিকে গড়িয়ে আসবে, যদি মহাকাশযানটা ডান দিকে ঘুরে যায় এটা বাম দিকে গড়িয়ে যাবে।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, মজার ব্যাপার।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব কোয়ার্টজের স্বচ্ছ গোলকটা য়ুহার হাতে দিয়ে বলল, নাও। এটা তুমি রাখ, তোমার ঘরের টেবিলের ঠিক মাঝখানে এটা রেখে দাও। তুমি দেখবে আগামী এক মাসেও এটা এক চুল ডানে বা বামে সরবে না। আমাদের কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের কাজ এত নিখুঁত!

য়ুহা গোলকটা হাতে নিয়ে বলল, তোমাকে ধন্যবাদ ক্যাপ্টেন ক্ৰব।

খাওয়ার পর সবাই মহাকাশযানের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ল। য়ুহা হিসানকে খুঁজে বের করে বলল, হিসান, তুমি কি আমাকে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কটা একটু দেখাতে পারবে?

হিসান একটু অবাক হয়ে বলল, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক দেখবে?

হ্যাঁ।

আসলে এটা তো দেখার মতো কিছু নয়। মহাকাশযানের ঠিক মাঝখানে একটা ঘরের ভেতরে আছে।

সেই ঘরে আমরা যেতে পারি না?

না। ভেতরে যাবার কোনো উপায় নেই।

উঁকি দিয়ে দেখতে পারি না?

হিসান হেসে ফেলল, বলল, উঁকি দিয়ে দেখারও কিছু নেই। মূল নেটওয়ার্কটা হচ্ছে প্রায় এক মিটার বর্গাকৃতির একটা নিখুঁত ক্রিস্টাল, এর মাঝে একটা পরমাণুও তার সঠিক জায়গা থেকে বিচ্যুত হয়নি। এটাকে রাখা হয় চরম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রায়। আলোর সকল তরঙ্গে এর সাথে যোগাযোগ হয়। বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগ করার জন্যে এটাকে ঘিরে রয়েছে একটার পর আরেকটা তারপর আরেকট। ওর! হিস। এ মুহূর্ত থেমে বলল, তোমার ঘরের যোগাযোগ মডিউলে তুমি এ সম্পর্কে সব তথ্য পেয়ে যাবে। হলোগ্রাফিক ছবিতে দেখানো আছে।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, আমি হলোগ্রাফিক ছবি দেখতে চাই না। আসল জিনিসটা দেখতে চাই।

ঠিক আছে, তুমি তাহলে আস আমার সাথে, তোমাকে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের ঘরটির কাছাকাছি নিয়ে যাই।

হ্যাঁ। চল। আমার দেখার খুব শখ।

হিসান য়ুহাকে মহাকাশযানের নানা গলি ঘুচি দিয়ে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের ঘরটিতে নিয়ে গেল। চারপাশে নানা ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা, তার মাঝখানে বর্গাকৃতির সাদামাটা ঘর। বলে না দিলে বোঝার উপায় নেই এর ভেতরে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কটা রয়েছে।

য়ুহা ঘরটার ধাতব দেয়াল স্পর্শ করে বলল, কেউ যদি এই দেয়াল ভেঙে ঢুকে যায়?

হিসান শব্দ করে হেসে বলল, নিউক্লিয়ার বোমা দিয়েও এই দেয়াল ভাঙা যাবে না। মহাকাশযানের সবচেয়ে সুরক্ষিত এলাকাটি হচ্ছে এই কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের ঘর।

য়ুহা বাইরে থেকে ঘুরে ঘুরে ঘরটিকে দেখে, ধাতব দেয়ালটি হাত দিয়ে স্পর্শ করে তারপর একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, চল, যাই।

চল। তুমি যেটা দেখতে চেয়েছিলে সেটা দেখেছ?

হ্যাঁ দেখেছি।

সত্যি কথা বলতে কী তুমি এই ঘরের ধাতব দেয়াল ছাড়া আর কিছুই দেখনি।

য়ুহা হিসানের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, তুমি ভুলে যাচ্ছ আমি একজন কবি। আমার কাজই হচ্ছে কল্পনা করা। আমি যেটা দেখতে পাই না সেটা কল্পনা করতে পারি, আমি যেটুকু দেখিনি সেটুকু কল্পনা করে নিয়েছি।

হিসান মাথা ঘুরিয়ে একবার য়ুহার মুখের দিকে তাকালো, কোনো কথা বলল না।

মহাকাশযানের গলি খুঁচি দিয়ে হেঁটে হেঁটে মূল নিয়ন্ত্রণকক্ষের দিকে ফিরে আসতে আসতে য়ুহা বলল, আমি এই মহাকাশযানে যে জন্যে এসেছি

সেটা কিন্তু এখনো করিনি।

কী করতে এসেছ?

আমি মহাকাশযানের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে মহাকাশকে দেখব। আমি শুনেছি এটা নিকষ কালো-তার মাঝে শুধু নক্ষত্রগুলো জ্বলজ্বল করে, দূরে কোনো একটা গ্যালাক্সিকে স্পষ্ট দেখা যায়।

হিসান মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছ। মহাকাশযানে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে থাকা একটা অভূতপূর্ব দৃশ্য। যারা প্রথমবার দেখে তারা হতবাক হয়ে যায়।

য়ুহা বলল, আমার মনে হয় আমি যত দিন এই মহাকাশযানে থাকব তত দিন এই জানালার পাশে বসে বাইরে তাকিয়ে থাকব। ব্যাপারটা চিন্তা করেই আমার এক ধরনের শিহরণ হচ্ছে। আমার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে!

হিসান বলল, তুমি যখন নিজের চোখে দেখবে তখন গায়ের লোম শুধু দাঁড়িয়ে যাবে না–দাঁড়িয়ে নাচানাচি করতে থাকবে!

নিয়ন্ত্রণকক্ষে ঢুকে সত্যি সত্যি য়ুহার গায়ের লোম দাঁড়িয়ে গেল। সামনে বিশাল একটা স্বচ্ছ জানালায় মহাকাশকে দেখা যাচ্ছে–নিকষ কাল অন্ধকার মহাকাশে অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলছে। দুরে একটি গ্যালাক্সি আরো দূরে আরো কয়েকটি গ্যালাক্সি। মাঝামাঝি একটা অংশে ধোয়াটে কিছু অংশ, তার মাঝামাঝি একটা অংশ গাঢ় অন্ধকারে ড়ুবে আছে। দেখে মনে হয় পুরো মহাকাশ বুঝি জীবন্ত কোনো প্রাণী তার সহস্র চোখ নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে আছে।

য়ুহা বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, কী অসাধারণ! কী অপূর্ব!

হিসান য়ুহার উচ্ছ্বাসে যোগ দিল না। সে অসংখ্যবার মহাকাশ অভিযানে যোগ দিয়েছে, এই দৃশ্য তার কাছে খুব পরিচিত একটা দৃশ্য।

য়ুহা বলল, আমার ধারণা ছিল নক্ষত্রগুলো বুঝি মিটিমিটি করবে–

হিসান মাথা নাড়ল, বলল, ভুল ধারণ! মিটিমিটি করে না। স্থির হয়ে জ্বলে। যদি বায়ুমণ্ডলের ভেতর দিয়ে দেখতে হয় তাহলে এ রকম মনে হতে পারে।

এত বিচিত্র রং আছে সেটাও আমি জানতাম!

হ্যাঁ। নক্ষত্রের তাপমাত্রার ওপর তার রংটা নির্ভর করে।

কোনো কোনোটা উজ্জ্বল কোনো কোনোটা এত নিষ্প্রভ যে দেখাই যায় না।

হিসান বলল, সেগুলো এত লক্ষ কোটি আলোকবর্ষ দূরে যে তুমি সেটা কল্পনাও করতে পারবে না।

আমি একজন কবি। য়ুহা নিজের বুকে হাত দিয়ে বলল, আমি সব কল্পনা করতে পারি।

ঠিক এ রকম সময়ে ক্যাপ্টেন ক্ৰব ঘরটিতে এসে ঢুকল, য়ুহার কথা শুনে হাসতে হাসতে বলল, তুমি সব কল্পনা করতে পার?

হ্যাঁ। পারি।

দেখা যাক তোমার কথা সত্যি কি না। ক্যাপ্টেন ক্ৰব জানালার মাঝামাঝি একটা অংশের দিকে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, তুমি এই দিকে তাকিয়ে থাক।

তাকিয়ে থাকলে কী হবে?

আমি এর ঔজ্জ্বল্যতাটুকু বাড়িয়ে দিই–তুমি তখন একটা অংশ দেখবে যার কাছাকাছি একটা ব্ল্যাক হোল আছে। ব্ল্যাক হোলের আকর্ষণে যে গ্যাস–

দাঁড়াও-দাঁড়াও-তুমি কী বলছ আমি বুঝতে পারছি না। তুমি এর ঔজ্জ্বল্যতাটুকু কেমন করে বাড়াবে? আমরা জানালা দিয়ে বাইরে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে আছি। মহাকাশের ঔজ্জ্বল্যতা তুমি কেমন কয়ে বাড়াবে?

এই যে। ক্যাপ্টেন ক্রব হলোগ্রাফিক একটা প্যানেল বের করে তার একটা জায়গায় স্পর্শ করে বলল, এর পুরো নিয়ন্ত্রণ আমাদের হাতে। এই স্ক্রিনে যা আছে তার সবকিছু আমি ইচ্ছে করলে আরো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে পারি।

স্ক্রিন? য়ুহা চোখ বড় বড় করে বলল, এটা তাহলে একটা স্ক্রিন? এটা জানালা না?

হ্যাঁ এটা একটা স্ক্রিন। মহাকাশযানের বাইরে যে ক্যামেরা আছে সেগুলো থেকে মহাকাশযানের যে ছবি দেখা যাচ্ছে সেগুলো এই স্ক্রিনে দেখাচ্ছে।

তার মানে এটা আসল মহাকাশ না? এটা মহাকাশের ছবি?

ক্যাপ্টেন ত্রুব বলল, তুমি ঠিক কী বলতে চাইছ আমি জানি না। আমাদের সামনে একটা খোলা জানালা থাকলে আমরা যা দেখতাম এখানে হুঁবহুঁ তা-ই দেখা যাচ্ছে।

হুবহুঁ একরকম। কিন্তু আসল দৃশ্য নয়?

ক্যাপ্টেন ত্রুব বলল, তুমি যদি সেভাবে বলতে চাও বলতে পার।

য়ুহার মুখে আশাভঙ্গের একটা ছাপ পড়ল। সে নিচু গলায় বলল, আমি আসলে নিজের চোখে সত্যিকার মহাকাশ দেখতে চেয়েছিলাম।

এটা সত্যিকার মহাকাশ, তুমি নিজের চোখে দেখছ।

এটা সত্যিকার মহাকাশ না। এটা সত্যিকার মহাকাশের ছবি!

ক্যাপ্টেন ত্রুব হিসানের দিকে তাকিয়ে হাল ছেড়ে দেয়ার ভঙ্গিতে কাঁধ ঝাঁকালো। হিসান বলল, য়ুহা তুমি বিশ্বাস কর। সত্যিকার মহাকাশ ঠিক এ রকম। হুঁবহুঁ এ রকম।

য়ুহা বলল, আমি তোমার কথা বিশ্বাস করছি। কিন্তু তবুও সত্যিকার মহাকাশ দেখতে চাইছিলাম।

সত্যিকার মহাকাশ দেখার উপায় থাকে না। তার প্রয়োজন নেই, তুমি যেহেতু অনেক ভালোভাবে দেখতে পাচ্ছ কেন তার জন্যে কষ্ট করবে।

য়ুহা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, তোমরা বুঝতে পারছ না। আমি ব্যাপারটা অনুভব করতে চাই। অনুভব। ভুল জিনিস দিয়ে কোনো কিছু অনুভব করা যায় না। সত্যি আর তার ছবি এক নয়।

ক্যাপ্টেন জব বাধা দিয়ে বলল, ঠিক আছে, ঠিক আছে। আমি বুঝতে পারছি তোমার কৌতূহলটা যৌক্তিক কৌতূহল নয়, এটা হচ্ছে এক ধরনের আবেগতাড়িত কৌতূহল!

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তুমি ঠিকই ধরতে পেরেছ। আমার ভেতরে যুক্তি খুব বেশি নেই। যা আছে তার পুরোটাই আবেগ! এবং—

এবং?

সে জন্যে আমার কোনো লজ্জা নেই। কোনো হীনম্মন্যতা নেই।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে, আমি বুঝিতে পারছি। আমি তোমাকে সত্যিকার জানালা দিয়ে বাইরে তাকানোর ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তারপর হিসানের দিকে তাকিয়ে বলল, ট্রান্সপোর্ট ঘরের পাশে সিকিউরিটি চ্যানেলের যে কোয়ার্টও জানা আছে য়ুহাকে সেখানে নিয়ে যাও।

কিন্তু সেটা এত ছোট!

হ্যাঁ। অনেক ছোট। কিন্তু কিছু করার নেই।

য়ুহা আগ্রহ নিয়ে বলল, ছোট হোক আমার আপত্তি নেই! সত্যিকার জানালা হতেই হবে। আমি ছোট একটা জানালা দিয়েই বাইরে তাকাতে পারব।

হিসনি ইতস্তত করে বলল, জায়গাটাতে অক্সিজেন সরবরাহ আর তাপমাত্রার খানিকটা সমস্যা আছে।

য়ুহা ব্যস্ত হয়ে বলল, থাকুক! আমার আপত্তি নেই।

কোয়ার্টজের একটা জানালা, অতিবেগুনি রশ্মিা পুরোটুকু কাটা যায়। রেডিয়েশনের সমস্যাও আছে।

ক্যাপ্টেন ক্রব বলল, রেডিয়েশন মনিটর দেখে যেও। আমার মনে হয় সিকিউরিটি স্যুট পরে গেলে কোনো সমস্যা হবে না।

 

কাজেই কিছুক্ষণ পর দেখা গেল ট্রান্সপোর্ট ঘরের পাশে সিকিউরিটি চ্যানেলের কাছে একটা সিকিউরিটি স্যুট পরে য়ুহা কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে নিঃশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে আছে।

হিসান জিজ্ঞেস করল, তুমি যেটা দেখতে চেয়েছ সেটা দেখছ?

য়ুহা বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, হ্যাঁ, দেখছি। আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না আমি নিজের চোখে মহাকাশকে দেখছি।

কেমন দেখছ?

অপূর্ব! গ্যালাক্সিটা দেখেছ?

হ্যাঁ, এন্ড্রোমিডা। আমাদের সবচাইতে কাছের গ্যালাক্সি।

আমার চোখের পাতি ফেলতেও ভয় করছে। মনে হচ্ছে চোখের পাতি ফেললে যদি চলে যায়?

হিসান শব্দ করে হাসল, বলল, না যাবে না। এই গ্যালাক্সিটা ঠিক এখানেই থাকবে! আমাদের মহাকাশযানটা তার গতিপথ এতটুকু পরিবর্তন না করে এগিয়ে যাবে। তাই এন্ড্রোমিডাটাকে থেখানে দেখছ সেখানেই দেখবে, আগামী এক মাস এটা এখান থেকে এক চুলও নড়বে না।

য়ুহা আবার কোয়ার্টজের জানালায় মুখ লাগিয়ে বলল, আমি এটাকে আরো কিছুক্ষণ দেখি?

দেখ। তোমার যতক্ষণ ইচ্ছে দেখ।

য়ুহা কোয়ার্টজের জানালায় মুখ লাগিয়ে মহাকাশের দিকে তাকিয়ে রইল। তার এখনো নিজের চোখকে বিশ্বাস হচ্ছে না যে সত্যি সত্যি মহাকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।

ঘুমানোর আগে য়ুহা অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। বিছানায় তার মাথার কাছে টেবিলের ঠিক মাঝখানে স্বচ্ছ কোয়ার্টজের গোলকটা যেখানে রেখে গিয়েছিল সেটা ঠিক সেখানেই আছে–তার জায়গা থেকে সেটা এক চুল নড়েনি। ক্যাপ্টেন ক্রব ঠিকই বলেছিল, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক সত্যিই অসাধারণ। এত বড় একটা মহাকাশযানকে অচিন্ত্যনীয় বেগে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, শুধু যে উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে তা-ই নয়, প্রতি মুহূর্তে তার গতিবেগ বাড়িয়ে যাচ্ছে কিন্তু সেটা বোঝার কোনো উপায় নেই। মনে হয় তারা সবাই মিলে বুঝি মহাকাশযানে নিঃসঙ্গ পরিবেশে কোথাও স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ঘুমানোর আগে য়ুহা যোগাযোগ মডিউলটা চালু করে শীতলঘরে ক্রায়োজেনিক তাপমাত্রায় শীতল করে রাখা এগারোজন মানুষকে একবার দেখে। রায়ীনার ছবিটা ভেসে আসার পর সে একদৃষ্টে অনেকক্ষণ তার দিকে তাকিয়ে থাকে, মেয়েটার চেহারায় এক ধরনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রাণবন্ত মানুষের চিহ্ন ছিল। এখন সেখানে কিছু নেই, শক্ত পাথরের মতো দেহটি নিশ্চল হয়ে আছে, দেখে মনে হয় না এটি আসলে কোনো মানুষের দেহ। মনে হয় এটা বুঝি পাথরের তৈরি একটা ভাস্কর্য। য়ুহা রায়ীনার দেহটির দিকে তাকিয়ে নিজের বুকের ভেতরে এক ধরনের বেদনা অনুভব করে, ঠিক কী কারণে জানা নেই তার ভেতরে এক ধরনের গভীর অপরাধবোধের জন্ম নেয়।

ঘুম থেকে ওঠার পর য়ুহার এক সেকেণ্ড সময় লাগে বোঝার জন্যে সে কোথায় আছে। মাথার কাছে বড় একটা টেবিল, সেই টেবিলের ঠিক মাঝখানে স্বাচ্ছ কোয়ার্টজের একটা গোলক, সেটা দেখে হঠাৎ করে য়ুহার মনে পড়ে সে একটা মহাকাশযানে করে যাচ্ছে। য়ুহা তখন তার আরামদায়ক বিছানায় উঠে বসে বেশ কিছুক্ষণ স্বচ্ছ কোয়ার্টজের গোলকটির দিকে তাকিয়ে থাকে, তারপর বিছানা থেকে নেমে আসে।

য়ুহা যখন খাবার টেবিলে গিয়েছে তখন সেখানে শুধু মিটিয়া নামের মেয়েটি বসে কোনো একটা পানীয়তে চুমুক দিচ্ছে। য়ুহাকে দেখে মুখে হাসি টেনে বলল, ঘুম ভাঙল?

হ্যাঁ। ভেঙেছে।

তোমাকে দেখে আমার রীতিমতো হিংসে হয়।

হিংসে হয়? আমাকে?

মিটিয়া মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ।

কেন?

তুমি যখন ইচ্ছে ঘুমাতে যেতে পার, যখন ইচ্ছে ঘুম থেকে উঠতে পার।

য়ুহা টেবিলের নিচে সুইচটাতে চাপ দিতেই একটা অংশ খুলে ধূমায়িত একটা ট্রে বের হয়ে আসে। তার মাঝে কয়েক ধরনের কৃত্রিম শর্করা এবং প্রোটিন। য়ুহা পানীয়ের মগটা টেনে নিয়ে এক চুমুক খেয়ে বলল, এই মহাকাশযানের সবকিছুই তো নিয়ন্ত্রণ করছে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক। তোমাদের কমান্ডের কারো তো কোনো কাজ নেই–তোমরা সবাই আমার মতো যখন ইচ্ছে ঘুমাও না কেন? যখন ইচ্ছে জেগে ওঠো না কেন?

মিটিয়া শব্দ করে হেসে উঠে বলল, আমরা একটা কমান্ডের অধীনে কাজ করি। আমাদের সব সময় এমনভাবে প্রস্তুত থাকতে হয় যেন পরের মুহূর্তে একটা অঘটন ঘটবে!

কিন্তু কোনো অঘটন তো ঘটছে না।

না ঘটছে না। কিন্তু আমাদের প্রস্তুত থাকতে হয়, সে জন্যে আমরা আছি।

এই মুহূর্তে যদি কিছু একটা অঘটন ঘটে তাহলে তোমরা তার জন্যে প্রস্তুত?

হ্যাঁ। মিটিয়া হেসে বলল, আমার কথা বিশ্বাস না করলে বিপদ সংকেতের এলার্মটা বাজিয়ে দেখ। মুহূর্তের মাঝে পুরো কমান্ড তাদের দায়িত্ব নিয়ে চলে আসবে।

য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, যদি দেখি আমার মহাকাশ ভ্রমণ আস্তে আস্তে একঘেয়ে হয়ে যাচ্ছে তাহলে একদিন আমি বিপদ সংকেতের এলার্মটা বাজিয়ে দেব।

নিজের দায়িত্বে বাজিয়ে! যদি দেখা যায় শুধু মজা করার জন্যে বাজিয়েছ তাহলে বাকি সময়টা ক্যাপ্টেন ক্রব তোমাকে তোমার ঘরে তালা মেরে আটকে রাখতে পারে! আমাদের সামরিক নিয়মকানুন তা-ই বলে!

য়ুহা খাবারের ট্রে থেকে একটা কৃত্রিম ফল হাতে নিয়ে সেটাতে একটা কামড় দিয়ে বলল, তোমরা সবাই কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক খুব বিশ্বাস কর?

হ্যাঁ। করি। মিটিয়া তার পানীয়তে শেষ চুমুক দিয়ে মগটা টেবিলের নিচে ঢুকিয়ে বলল, তুমি কর না?

আমি কোনো যন্ত্রকে কখনো বিশ্বাস করি না।

মিটিয়া হাসি হাসি মুখ করে বলল, কিন্তু তুমি নিজে কি একটা বায়ো মেডিকেল যন্ত্র না?

য়ুহাকে একটু বিপন্ন দেখায়, সে ইতস্তত করে বলল, আমি, মানে আমি-

হ্যাঁ তুমিও একটা যন্ত্র। কোনো কোনো যন্ত্র জৈবিক উপায়ে তৈরি হয়, কোনো কোনোটা আমরা তৈরি করি। এই হচ্ছে পার্থক্য!

য়ুহা ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি বলতে চাইছ, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক জৈবিক যন্ত্রের মতো কিছু একটা?

হ্যাঁ। কোনো কোনো দিকে তার থেকে বেশি।

তার মানে আমি যদি একটা কবিতার লাইন বলি তোমাদের কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক তার পরের লাইনটা বলতে পারবে?

মিটিয়া খিলখিল করে হাসতে হাসতে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, তুমি নিজেই চেষ্টা করে দেখ! আমার মনে হয় পারবে।

পারবে?

হ্যাঁ।

আমি কেমন করে জিজ্ঞেস করব?

কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের একটা কণ্ঠ ইন্টারফেস আছে। সেটা ব্যবহার করা হয় না। ক্যাপ্টেন ক্রবকে বললে সে তোমার জন্যে এটা চালু করে দিতে পারবে। তুমি তখন তার সাথে খোশগল্প করতে পারবে!

সত্যি?

হ্যাঁ সত্যি!

বাহ। খুব মজা তো। আমি ক্যাপ্টেন ত্রুবকে এখনই ধরছি।

 

কিছুক্ষণের মাঝেই দেখা গেল য়ুহা একটা গোপন পাসওয়ার্ড ঢুকিয়ে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের সাথে কথা বলতে শুরু করেছে। প্রথমে সে খানিকটা অনিশ্চিতের মতো বলল, আমি য়ুহা, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। তুমি যদি আমার কথা বুঝে থাক তাহলে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।

কাছাকাছি একটা ভয়েস সিনথেসাইজার শুষ্ক এবং যান্ত্রিক গলায় বলল, উত্তর হ্যাঁ-সূচক।

তুমি কি কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক কথা বলছ?

উত্তর পুনরায় হ্যাঁ-সূচক।

তুমি কি আমাকে চেনো? আমার নাম-

উত্তর হ্যাঁ-সূচক। তথ্যকেন্দ্রে তথ্য সংরক্ষিত।

মুহ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, আমাকে সবাই বলেছে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক অত্যন্ত বুদ্ধিমান। আমার ধারণা ছিল তুমি সত্যিকার মানুষের মতো কথা বলতে পারবে। কিন্তু তুমি একটা খেলনা যন্ত্রের মতো শব্দ করছ।

মানব প্রজাতির মতো কথা বলতে সক্ষম।

তাহলে বলছ না কেন?

আনুষ্ঠানিক নির্দেশনা প্রয়োজন।

ঠিক আছে। ঠিক আছে। আমি আনুষ্ঠানিকভাবে তোমাকে বলছি—একজন মানুষ আরেকজন মানুষের সাথে যেভাবে কথা বলে, তুমি সেভাবে আমার সাথে কথা বল।

বয়স?

আমার বয়সী?

পুরুষ অথবা রমণী?

য়ুহা এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, পুরুষ। কোয়ান্টাম কম্পিউটার তার যান্ত্রিক গলায় বলল, ঠিক আছে।

য়ুহা জিজ্ঞেস করল, তুমি কি এখন সত্যিকার মানুষের মতো কথা বলবে?

ভয়েস সিনথেসাইজার থেকে সুন্দর পুরুষের মতো গলার কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক বলল, বলব। অন্তত বলার চেষ্টা করব!

চমৎকার! য়ুহা একটু এগিয়ে এসে বলল, কথা বলার সাথে সাথে যদি তোমাকে দেখতে পেতাম সেটা আরো মজা হতো!

এগুলো আসলে ছেলেমানুষী কাজকর্ম। মানুষ যখন প্রথম শুরু করেছে তখন এর মাঝে সময় দিয়েছে। সময় নষ্ট করেছে। এখন এর মাঝে কোনো নতুনত্ব নেই, তাই কেউ চেষ্টা করে না! তুমি প্রথমবার এসেছ বলে করছ। কয়দিন পর তুমিও আর করবে না।

কিন্তু এখন আমার কাছে এর অনেক নতুনত্ব আছে।

থাকুক। আমার কথা বিশ্বাস কর। একটা কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ককে মানুষের চেহারায় দেখে মানুষের কণ্ঠে কথা বলিয়ে কোনো লাভ নেই। কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক মানুষ না। তার অনুভূতি মানুষের অনুভূতির নয়। তার ইন্দ্রিয় মানুষের ইন্দ্রিয় নয়।

য়ুহা বলল, কিন্তু আমি তোমার সাথে মানুষের ভাষায় কথা বাজে চাই।

কেন?

আমি তোমার বুদ্ধির একটা পরিমাপ করতে চাই।

কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক একটা হাসির মতো শব্দ করল, বলল, আমার জানামতে সে রকম কোনো গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি নেই।

আমার কোনো গ্রহণযোগ্য পদ্ধতির প্রয়োজন নেই। আমি আমার নিজের পদ্ধতি ব্যবহার করব।

তোমার নিজের পদ্ধতি কী?

একটা প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা যখন খুব উপরে উঠে যায় তখন সে যুক্তির বাইরের কাজ করতে পারে।

সেটা কী?

যেমন, মনে করো সে কবিতা লিখতে পারে।

কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক কোনো কথা না বলে চুপ করে রইল। য়ুহা বলল, আমি তোমাকে কবিতার একটা লাইন বলব। তুমি। তার পরের লাইনটা বলবে। ঠিক আছে?

ঠিক নেই।

য়ুহা অবাক হয়ে বলল, ঠিক নেই?

না। ঠিক নেই। আসলে আমি তোমার সাথে এই প্রতিযোগিতায় যেতে চাই না।

এটা প্রতিযোগিতা না। এটা একটা পরীক্ষা।

আমি এই পরীক্ষা দিতে চাই না।

চেষ্টা কর। দেখি তুমি কতটুকু পার।

আমি একটুও পারব না। আমি আসলে এ ধরনের কাজের জন্যে তৈরি হইনি। আমি এই মহাকাশযানটাকে নিখুঁতভাবে মহাকাশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে নিয়ে যেতে পারব কিন্তু কবিতার একটা লাইনের পিঠাপিঠি আরেকটা লাইন বসাতে পারব না।

য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, তুমি চেষ্টা করে দেখ।

তুমি যদি জোর কর, তাহলে চেষ্টা করব।

হ্যাঁ। আমি জোর করছি।

বেশ।

য়ুহা বলল, আকাশের পথে দেখ নক্ষত্রের ঘর–

আকাশের পথে? কিন্তু আকাশ ব্যাপারটা তো একটা কাল্পনিক ধারণা। আকাশ বলে তো কিছু নেই। সেই আকাশের পথ–

য়ুহা বলল, আমি তোমার সাথে এটা নিয়ে তর্ক করতে চাই না। আমি একটা কবিতার লাইন বলেছি, তুমি এর পরের লাইন বল।

কিন্তু সে জন্যে এটা তো একটু বিশ্লেষণ করতে হবে। নক্ষত্র হচ্ছে মহাজাগতিক বিষয়। কিন্তু ঘর শব্দটি অত্যন্ত জাগতিক। মহাজাগতিক নক্ষত্রকে তুমি একটা জাগতিক শব্দ দিয়ে প্রদর্শন করছ

য়ুহা বলল, থাক। আমার মনে হয় তোমার বলার ইচ্ছে নেই।

ইচ্ছের ব্যাপার নয়—এটা হচ্ছে—

থাক তোমার আর চেষ্টা করতে হবে না।

তুমি তুমি কী আমার ওপর ক্রুদ্ধ হয়েছ?

না। হা মাথা নাড়ল, মানুষ কখনো যন্ত্রের ওপর ক্রুদ্ধ হয় না।

শুনে একটু স্বস্তি পেলাম।

ঠিক আছে তাহলে, বিদায়।

য়ুহা চলে যেতে গিয়ে হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। বলল, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক। তোমাকে আরেকটা প্রশ্ন করতে পারি।

কর।

তুমি কী কখনো মিথ্যা কথা বলেছ?

মিথ্যা কথা?

হ্যাঁ।

না। আমি কেন মিথ্যা কথা বলব। আমাদের কখনো মিথ্যা কথা বলার প্রয়োজন হয় না। এটা তোমাদের ব্যাপার। মানুষকে প্রয়োজনে এবং কখনো কখলো অপ্রয়োজনে মিথ্যা কথা বলতে হয়। শুধু মানুষকে। আমাদের নয়।

কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক, বিদায়।

বিদায়।

য়ুহা তার ঘরে ঘুমানোর আগে টেবিলের পাশে এসে দাঁড়ায়। বড় টেবিলের ঠিক মাঝখানে স্বচ্ছ কোয়ার্টজের গোলকটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এক চুল নড়েনি। কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক অবিশ্বাস্য নিখুঁত গতিতে এই মহাকাশযানটিকে মহাকাশে উড়িয়ে নিতে পারে কিন্তু একটা সহজ কবিতা। লাইন তৈরি করতে পারে না!

য়ুহার ঘুম হলো ছাড়া ছাড়া। ঘুম থেকে উঠে সে কিছুক্ষণ তার বিছানায় বসে রইল। ঠিক কী কারণ জানা নেই সে নিজের ভেতরে এক ধরনের বিষণতা অনুভব করে। সে বিছানা থেকে নেমে টেবিলটার দিকে তাকালোসাথে সাথে তার চোখ বিস্ফারিত হয়ে যায়, স্বচ্ছ কোয়ার্টজের গোলকটি খুব ধীরে ধীরে বাম দিকে গড়িয়ে যাচ্ছে।

পুরো এক মাস মহাকাশযানটির এক দিকে যাবার কথা। কিন্তু মহাকাশযানটি দিক পরিবর্তন করছে। কেন?

 

য়ুহা যখন তার হাতে কোয়ার্টজের গোলকটা নিয়ে ছুটে এসেছে তখন খাবার টেবিলে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের সাথে তার কমান্ডের আরো চারজন বসে আছে। য়ুহাকে দেখে ক্যাপ্টেন ত্রুব একটু অবাক হয়ে বলল, কী ব্যাপার হা? তুমি এভাবে ছুটে আসছ কেন?

তোমরা বলেছ এই মহাকাশযান সোজা সামনের দিকে। দি পরিবর্তন করবে না। ঠিক কী না?

হ্যাঁ ঠিক। বলেছি।

কিন্তু মহাকাশযানটি দিক পরিবর্তন করছে।

ক্যাপ্টেন ক্ৰবের মুখে একটা হাসি ফুটে উঠল, হাসি হাসি মুখেই বলল, তুমি কেমন করে জান?

য়ুহা তার হাতের কোয়ার্টজ গোলকটা দেখিয়ে বলল, এই গোলকটা আমার টেবিলে রাখা ছিল, এটা বাম দিকে গড়িয়ে যেতে শুরু করেছে।

হয়তো তোমার হাতে টোকা লেগে গড়িয়ে গেছে।

না। য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, আমি অনেকবার পরীক্ষা করে দেখেছি। হাতের কোয়ার্টজ গোলকটা ক্যাপ্টেন ক্ৰবের দিকে এগিয়ে দিও বলল, আমার কথা বিশ্বাস না করলে তুমি নিজে পরীক্ষা করে দেখ।

ক্যাপ্টেন ক্রব কোয়ার্টজ গোলকটা নেয়ার চেষ্টা করল না, হাত ও বলল, য়ুহা তুমি বস।

হ্যাঁ, বসব। কিন্তু তুমি আমাকে আগে বোঝাও। আসলে মহাকাশযানটার সোজা সামনের দিকে যাবার কথা, কিন্তু এটা কি পরিবর্তন করছে। কেন করছে?

তুমি এত উত্তেজিত হয়ো না। তুমি আগে মাথা ঠান্ডা করে বস।

কিন্তু তুমি আগে বোঝাও। কেন এটা তোমাদের কিছু না জানিয়ে দিক পরিবর্তন করছে? কোথায় চলে যাচ্ছে মহাকাশযানটা?

ক্যাপ্টেন ত্রুব নরম গলায় বলল, তুমি শুধু শুধু উত্তেজিত হচ্ছ য়ুহা। এই মহাকাশযানটা কোথাও চলে যাচ্ছে না। যেখানে যাবার কথা ঠিক সেখানেই যাচ্ছে।

কিন্তু তাহলে এটা দিক পরিবর্তন করছে কেন?

এটা দিক পরিবর্তন করছে না। ওপরে তাকিয়ে দেখ–এখানে একটা মনিটর আছে। এই মনিটরে এটা দেখাচ্ছে যে এটা তার কো-অর্ডিনেট একেবারেই পরিবর্তন করেনি। মহাকাশযানটার যেদিকে যাবার কথা এটা সেদিকেই যাচ্ছে।

কিন্তু কিন্তু এই কোয়ার্টজ গোলক?

আমি ঠিক জানি না তোমার কোয়ার্টজ গোলকটা কী করেছে।

আমি যতবার টেবিলে রেখেছি ততবার বাম দিকে গড়িয়ে গেছে।

ক্যাপ্টেন ত্রুব বলল, তুমি নিশ্চয়ই ঠিক করে রাখনি।

আমার কথা বিশ্বাস না করলে তুমি রাখ টেবিলের ওপর।

ক্যাপ্টেন ক্রব হা হা করে হেসে বলল, তুমি আমাকে বলছ আমি যেন কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ককে বিশ্বাস না করে তোমাকে বিশ্বাস করি। কিন্তু আসলে আমি কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ককেই বেশি বিশ্বাস করি। কাজেই কোয়ার্টজ গোলকটা টেবিলের ওপর রাখার কোনো প্রয়োজন দেখি না?

য়ুহা মুখ শক্ত করে বলল, ঠিক আছে আমি নিজেই রাখছি। এই দেখ।

য়ুহা কোয়ার্টজের গোলকটা টেবিলের মাঝখানে রাখল এবং সেটা একটুও না নড়ে স্থির হয়ে রইল। ক্যাপ্টেন ক্ৰব কৌতুকের ভঙ্গিতে বলল, কবি য়ুহা, তোমার গোলক তত মোটেও গড়িয়ে যাচ্ছে না।

য়ুহা বিব্রত মুখে বলল, কী আশ্চর্য! এখন নড়ছে না। কিন্তু বিশ্বাস কর আমার ঘরের টেবিলের ওপর যতবার রেখেছি ততবার বাম দিকে গড়িয়ে গেছে!

সম্ভবত তোমার টেবিলে কোনো সমস্যা আছে!

টেবিলে বসে থাকা মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, কোয়ান্টাম নেটওয়ার্কে একটা সমস্যা হওয়া থেকে তোমার টেবিলে সমস্যা হওয়া অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য!

বসে থাকা সবাই শব্দ করে হেসে উঠল।

য়ুহা তার ঘরে চুপচাপ বসে আছে। পাশে বড় টেবিলের ঠিক মাঝখানে সে তার স্বচ্ছ কোয়ার্টজের গোলকটা রেখেছে, সেটা সেখানে স্থির হয়ে আছে। তার টেবিলে কোনো সমস্যা নেই, তাহলে গোলকটা সেখানে এভাবে স্থির হয়ে থাকত না। এই মহাকাশযালে কিছু একটা ঘটছে যেটা সে বুঝতে পারছে না। সে মহাকাশযানের দায়িত্বে নেই—তার এটা নিয়ে মাথা ঘামানোর কথা নয় কিন্তু ভেতরে কিছু একটা খচখচ করছে। কেউ যদি তাকে পুরো বিষয়টা ঠিক করে বুঝিয়ে দিত তাহলে ভেতরের অস্থিরতাটা একটু কমত। বিষয়টা হয়তো খুবই সহজ-খুবই ছেলেমানুষী, সে যেটা বুঝতে পারছে না। যুহ অনেকটা অন্যমনস্কভাবে কোয়ার্টজের গোলকটার দিকে তাকিয়ে থাকে, হঠাৎ সে আবার চমকে উঠল, গোলকট। আবার ধীরে ধীরে বামদিকে গড়িয়ে যেতে শুরু করেছে। য়ুহা গোলকটির দিকে তাকিয়ে থাকেসেটা গড়িয়ে গড়িয়ে টেবিলের কিনারায় পৌঁছানোর পর সে সেটাকে আবার টেবিলের মাঝখানে বসিয়ে দেয়, গোলকটি আবার গড়াতে শুরু করে। এর অর্থ কী? মহাকাশযানটা কি আবার দিক পরিবর্তন করতে শুরু করেছে?

য়ুহা উঠে দাঁড়াল, তাকে ব্যাপারটা বুঝতেই হবে। গোলকটা হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হতেই সে দেখে মিটিয়া হেঁটে যাচ্ছে–য়ুহা গলা উঁচিয়ে

তাকে ডাকল, মিটিয়া।

কী ব্যাপার য়ুহা।

তুমি এক সেকেন্ডের জন্যে আমার ঘরে আসতে পারবে?

অবশ্যই। কী হয়েছে?

সে রকম কিছু না। আমি তোমাকে একটা জিনিস দেখাতে চাই।

কী জিনিস? এই যে এই গোলকটা, দেখ।

য়ুহা গোলকটাকে টেবিলের ওপর রাখল এবং সেটা স্থির হয়ে রইল। মিটিয়া জিজ্ঞেস করল, কী দেখব?

য়ুহা ব্ৰিতভাবে বলল, না, একটু আগেই এটা বাম দিকে গড়িয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু এখন যাচ্ছে না।

মিটিয়া হেসে বলল, তুমি এই গোলকের কথা ভুলে যাও য়ুহা। এটা মনে হয় তোমাকে খুব চিন্তার মাঝে ফেলে দিচ্ছে।

না, চিন্তার মাঝে ফেলেনি। আমি শুধু এটা বুঝতে চাইছি।

এত কিছু বুঝে কী হবে? আমাদের কাছে মহাকাশ ভ্রমণের কিছু মজার অভিজ্ঞতার হলোগ্রাফিক ক্লিপ আছে। বসে বসে দেখ-

য়ুহা বলল, হ্যাঁ। ঠিক আছে। দেখব।

মিটিয়া ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সাথে সাথে গোলকটা আবার গড়িয়ে যেতে শুরু করে। য়ুহা ছুটে গিয়ে মিটিয়াকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেল, হঠাৎ করে সে বুঝতে পারে মিটিয়াকে ঘরে আনা মাত্রই গোলকটা আবার থেমে যাবে, কেউ একজন তাকে নিয়ে খেলছে। কেন খেলছে?

য়ুহা চিন্তিত মুখে ঘর থেকে বের হয়ে এলো। কন্ট্রোল প্যানেলে হিসান একটা ভিডিও মডিউল খুলে কিছু একটা দেখছিল। য়ুহা তার কাছে গিয়ে বলল, তোমাকে একটা জিনিস জিজ্ঞেস করতে পারি?

কী জিনিস?

যদি মনে কর এই মহাকাশযানের কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক ঠিক করে আমাদের সবাইকে যেখানে নেয়ার কথা সেখানে না নিয়ে অন্য কোথাও নিয়ে যাবে তাহলে কি তোমরা সেটা কোনোভাবে বুঝতে পারবে?

হিসান হেসে ফেলল, কোয়ান্টাম কম্পিউটার কেন সেটা করবে?

য়ুহা বলল, যদি করে?

করবে না।

মনে কর এটা কাল্পনিক একটা প্রশ্ন। যদি করে—

হিসান এক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, না আমরা সেটা বুঝতে পারব। এই মহাকাশযানে আমরা যেটা দেখি, যেটা শুনি তার সবকিছু আসে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক থেকে। কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক আমাদের হাত-পা, আমাদের চোখ-কান, আমরা আমাদের নিজেদের চোখ-কানকে অবিশ্বাস করব কেমন করে? তবে–

তবে কী? আমরা যদি জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই, নিজের চোখে দেখার চেষ্টা করি তাহলে সেটা দেখব।

য়ুহা বলল, আমি জানি, ব্যাপারটা এক ধরনের ছেলেমা কৌতূহল। তবুও আমি একবার নিজের চোখে দেখে নিশ্চিত হতে চাই।

হিসান হাসল, বলল, যাও। দেখে আস।

য়ুহা হেঁটে হেঁটে ট্রান্সপোর্ট ঘরের পাশে সিকিউরিটি চ্যানেলের কাছে এসে দেখে দরজাটি বন্ধ। সে দরজাটি খোলার চেষ্টা করল, খুলতে পারল না। কয়েকবার চেষ্টা করে সে হাল ছেড়ে দেয়। কোনো একটা অজ্ঞাত কারণে দরজাটি বন্ধ করে রাখা হয়েছে।

য়ুহা কী করবে বুঝতে না পেরে আবার নিজের ঘরে ফিরে আসে। বিছানায় পা তুলে বসে সে খানিকক্ষণ চিন্তা করল। ব্যাপারটা সে বুঝতে পারছে না, বোঝার চেষ্টা করেছে, লাভ হয়নি। সে আর সময় নষ্ট করবে না, সবকিছু ভুলে গিয়ে সে মহাকাশভ্রমণ উপভোগ করতে শুরু করবে। সে শুনেছিল মহাকাশ ভ্রমণে নাকি ভরশূন্য পরিবেশ হতে পারে, সে ক্যাপ্টেন ক্রবকে অনুরোধ করবে ভরশূন্য পরিবেশ তৈরি করতে। মিটিয়া। হলোগ্রাফিক ক্লিপগুলোর কথা বলেছিল সেগুলো দেখাবে। কোয়ও গোলকটা সে ছুড়ে ফেলে দেবে কোথাও!

বিছানা থেকে নামতেই হঠাৎ করে য়ুহার মাথাটা একটু ঘুরে গেল, আরেকটু হলে সে পড়েই যাচ্ছিল, কোনোভাবে বিছানাটা ধরে নিজেকে সামলে নেয়। কী আশ্চর্য! কী হয়েছে তার?

টলতে টলতে একটু এগিয়ে গিয়ে দরজাটা খুলতে গিয়ে আবিষ্কার করল দরজাটা বন্ধ। য়ুহা কয়েকবার জোরে ধাক্কা দেয় দরজাটাকে, সেটা পাথরের মতো শক্ত হয়ে আটকে আছে। য়ুহা অবাক হয়ে বন্ধ দরজাটার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ঘরে খুব সূক্ষ্ম মিষ্টি এক ধরনের গন্ধ, মাথাটা ঝিমঝিম করছে। কিছু একটা হয়েছে এই ঘরে। কী হয়েছে?

য়ুহা।

কেউ একজন তাকে ডাকছে, য়ুহা চমকে উঠে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। কেউ নেই, কে কথা বলে?

য়ুহা।

কে?

আমি কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক।

তুমি কী চাও?

তোমার বিছানার মাথার কাছে তোমার অস্ত্রটা রাখা আছে। সেটা হাতে নাও।

কেন?

তুমি এখন আত্মহত্যা করবে।

য়ুহা চমকে উঠে বলল, কেন আমি আত্মহত্যা করব?

আমি তোমাকে নির্দেশ দিচ্ছি তাই।

না। য়ুহা চিৎকার করে বলল, কিছুতেই না।

কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক হাসির মতো শব্দ করল, বলল, তোমার ঘরে আমি নিহিনক্স গ্যাস পাঠাচ্ছি। একটু পরেই তোমার নিজের ইচ্ছাশক্তি বলে কিছু থাকবে না। আমি যেটা বলব সেটাই হবে তোমার।

য়ুহা বিস্ফারিত চোখে মাথা ঘুরিয়ে তাকালো। সত্যি সত্যি তার কাছে মনে হচ্ছে কিছুতেই আর কিছু আসে-যায় না। তার কাছে মনে হতে থাকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটা মাথায় ঠেকিয়ে ট্রিগার টেনে দেয়া চমৎকার একটা ব্যাপার।

মহাকাশযানের সবাই জানে কিছু একটা নিয়ে তুমি খুব বিক্ষিপ্ত। কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক ফিস ফিস করে বলল, কেউ যদি তোমার যোগাযোগ মডিউল দেখে, দেখাবে সেখানে তুমি অনেক বিভ্রান্ত কথা লিখেছ।

আমি লিখিনি।

কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক নরম গলায় বলল, আমি লিখেছি। তোমার হয়ে আমি লিখেছি। নিঃসঙ্গ মহাকাশযানে বিভ্রান্ত একজন কবি এক ধরনের মানসিক চাপের মাঝে থেকে হঠাৎ করে আত্মহত্যা করেছে। এটা খুবই বিশ্বাসযোগ্য একটা ঘটনা।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। বিশ্বাসযোগ্য।

তুমি এসো, অস্ত্রটি হাতে নাও।

য়ুহা টলতে টলতে এগিয়ে যায়। অস্ত্রটা হাতে নেয়।

কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক ফিসফিস করে বলে, অস্ত্রটা তোমার মাথায় ধর য়ুহা। ট্রিগার টেনে ধর।

য়ুহা অস্ত্রটা মাথায় ধরে, ট্রিগার টানতে গিয়ে থেমে গিয়ে বলল, কিন্তু কেন?

তুমি আমার কাজকর্মে অসুবিধে করছ।

কিন্তু—কিন্তু–

ট্রিগারটা টানো য়ুহা।

ট্রিগার টানতে গিয়ে য়ুহা আবার থেমে গেল। বড় বড় কয়েকটা নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, আমাকে শুধু একটা কথা বল।

কী কথা?

তুমি সবাইকে নিয়ে কোথায় যাচ্ছ?

আমি জানি না। আমাকে যে নির্দেশ দিয়েছে সে জানে।

কে তোমাকে নির্দেশ দিয়েছে?

অত্যন্ত বুদ্ধিমান কোনো প্রাণী। যারা আমার নেটওয়ার্কে প্রবেশ করে আমার নির্দেশকে পাল্টে দিতে পারে। আমার এখন তার নির্দেশ মানতে হবে। আমি এখন তার নির্দেশ মানছি।

কিন্তু—কিন্তু–

ট্রিগারটা টানো য়ুহা।

ট্রিগারটা টানতে গিয়ে য়ুহা আবার থেমে গেল। তার ভেতরের কোনো একটা সত্তা তাকে বলছে, না, কিছুতেই না। কিছুতেই না।

টানো।

না। হা দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, না। টানব না।

কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক হাসির মতো শব্দ করল, বলল, তুমি টানবে য়ুহা! অবশ্যই ট্রিগারটা টানবে। নিহিনক্স গ্যাস তোমার চেতনাকে যখন আরেকটু দুর্বল করবে তখন তুমি ট্রিগারটা টানবে।

য়ুহা অস্ত্রটা শক্ত করে ধরে রাখে। তার মাথার মাঝে একটা কবিতার লাইন এসেছে, রক্তের মাঝে মৃত্যুর খেলা মৃত্যুর মাঝে রক্ত-

টানো।

য়ুহা ট্রিগার টানল, কিন্তু টানার ঠিক আগের মুহূর্তে অস্ত্রটা দরজার দিকে ঘুরিয়ে নিল। প্রচণ্ড একটা শব্দে তার কানে তালা লেগে যায়, ধোঁয়ায় ঘরটা ভরে যায়। খক খক করে কাশতে কাশতে য়ুহা দেখল একটু আগে যেখানে দরজাটা ছিল সেখানে একটা বিশাল গর্ত। য়ুহা হামাগুড়ি দিয়ে গর্তটা দিয়ে বের হতে চেষ্টা করে। কে যেন পেছন থেকে ডাকছে, য়ুহা। য়ুহা। শোন য়ুহা।

কোনোমতে ঘর থেকে বের হয়ে য়ুহা উঠে দাঁড়ায়, কোনো কিছু সে পরিষ্কার করে চিন্তা করতে পারছে না। মনে হচ্ছে সে বুঝি একটা দুঃস্বপ্ন দেখছে। চারপাশে যা ঘটছে সেগুলো যেন অতিকৃতিক ঘটনা। সবকিছু যেন পরাবাস্তব। টলতে টলতে সে দুই পা এগিয়ে যায়। গুলির শব্দ শুনে কমান্ডের সবাই ছুটে আসছে, তারস্বরে একটা এলার্ম বাজতে শুরু করেছে কোথাও।

য়ুহা টলতে টলতে ছুটে যেতে থাকে ট্রান্সপোর্ট ঘরের পাশে সিকিউরিটি চ্যানেলের দিকে। বন্ধ দরজাটা সে গুলি করে ভেঙে ভেতরে ঢুকবে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখবে

য়ুহা। কী করছ তুমি?

কেউ একজন পেছন থেকে ডাকছে কিন্তু য়ুহা পেছন ফিরে তাকালো না—এখন তার আর নষ্ট করার মতো সময় নেই। সে ছুটে যেতে থাকে।

য়ুহা।

রক্তের মাঝে মৃত্যুর খেলা মৃত্যুর মাঝে রক্ত য়ুহা বিড়বিড় করে বলল, রক্তের মাঝে মৃত্যুর খেলা…

ট্রান্সপোর্ট ঘরের পাশে সিকিউরিটি চ্যানেলের সামনে দাঁড়িয়ে সে তার অস্ত্রটা তুলে ধরে ট্রিগার টেনে ধরল। প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো, ধোয়ায় অন্ধকার হয়ে যায় চারদিকে। ধোয়াটা সরে গেলে য়ুহা দেখল যেখানে দরজাটা ছিল সেখানে বিশাল একটা বৃত্তাকার গর্ত হয়ে গেছে।

য়ুহা গর্তের ভেতরে দিয়ে ঘরটাতে ঢুকে জানালায় মুখ লাগিয়ে বাইরে তাকালো। কালো মহাকাশে অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে কিন্তু এন্ড্রোমিডা গ্যালাক্সিটা দেখা যাচ্ছে না। ঠিক সামনেই এটা থাকার কথা ছিল, এটি নেই। মহাকাশযানটা ঘুরে গেছে বলে এখন আর দেখা যাচ্ছে না।

য়ুহা জানালা থেকে মুখ সরিয়ে তাকালো, কমান্ডের লোকজন অস্ত্র উদ্যত করে তাকে ঘিরে রেখেছে। য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার কথা তোমরা বিশ্বাস করনি। এখন তাহলে নিজের চোখেই দেখ।  য়ুহা জানালা থেকে সরে গিয়ে বলল, এই মহাকাশযানটা আমাদের অন্য কোথাও নিয়ে যাচ্ছে। তাকিয়ে দেখ।

অবশ্যি তখন আর তাকিয়ে দেখার প্রয়োজন ছিল না। পুরো মহাকাশযানটি হঠাৎ একবার ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে উঠল। এতক্ষণ কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক পুরো বিষয়টা সবার কাছে গোপন রেখেছিল, এখন আর গোপন রাখার প্রয়োজন নেই।

কিছু বোঝার আগেই য়ুহা মহাকাশযানের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় গড়িয়ে গেল, হাত দিয়ে নিজেকে থামানোর চেষ্টা করল, পারল না, মহাকাশযানের দেয়ালে গিয়ে সে সজোরে একটা ধাক্কা খেল। পুরো মহাকাশযানটা থরথর করে কাঁপছে, মনে হচ্ছে এটা বুঝি যে কোনো মুহূর্তে টুকরো টুকরো হয়ে উড়ে যাবে। য়ুহা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে থাকে, তীচ স্বরে একটা এলার্ম বাজছে। এলার্মের তীব্র শব্দটি শুনলেই মনে হয় বুৰিা ভয়ঙ্কর একটা বিপদ নেমে আসছে। একটা লাল আলো থেকে থেকে জ্বলে উঠছে, সেটা বুকের মাঝে একটা কাঁপুনির জন্ম দেয়। য়ুহা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, পারল না। তার মনে হলো অদৃশ্য একটা শক্তি বুঝি তাকে দেয়ালে চেপে ধরে রেখেছে। সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকানোর চেষ্টা করল, মহাকাশযানের ভেতরে সবকিছু লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। কমান্ডের ক্রুরা চারদিকে ছিটকে পড়ছে। কেউ আর উঠে দাঁড়াতে পারছে না। ভেতরে কর্কশ এক ধরনের ভয় জাগানো শব্দ, সেই শব্দ ছাপিয়ে ইঞ্জিনের চাপা গুম গুম শব্দ ভেসে আসছে। য়ুহা মহাকাশযানের দেয়াল ধরে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। হঠাৎ পুরো মহাকাশযানটি একটা জীবন্ত প্রাণীর মতো ঝটকা দিয়ে ওঠে, য়ুহা কিছু বোঝার আগেই দেখে সে শূন্যে ছিটকে উঠেছে—নিচে পড়ার আগেই সে অন্য পাশে ছুটে গেল—নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা করল, পারল না। মুহূর্তেই তার চারপাশের জগৎটা অন্ধকার হয়ে যায়। অন্ধকারে ড়ুবে যাবার আগে য়ুহার মনে হলো, তাহলে এটাই কি মৃত্যু?

ভয়ঙ্কর এক ধরনের দুঃস্বপ্ন দেখছিল য়ুহা, পাহাড়ের খাড়া ঢাল বেয়ে সে গড়িয়ে যাচ্ছে, নিজেকে থামানোর চেষ্টা করছে, পারছে না। নিচে লকলক আগুন, সেই আগুনের প্রচণ্ড তাপে তার শরীরের চামড়া গলে গলে পড়ে যাচ্ছে, ভয়ঙ্কর কিছু প্রাণী তাকে ঘিরে ফেলেছে, শরীরটাকে ছিঁড়ে ছিড়ে খাচ্ছে আর সে প্রচণ্ড যন্ত্রণায় চিৎকার করছে। এর মাঝে ভাসা ভাসাভাবে তার জ্ঞান ফিরে এসেছে। তীব্র আলোর ঝলকানি, মানুষের আর্তচিৎকার আর ভয়ঙ্কর বিস্ফোরণের শব্দ শুনে সে আবার জ্ঞান হারিয়েছে। অচেতন অবস্থায় সে টের পেয়েছে তার দেহটা মহাকাশযানের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় ছিটকে গেছে, আঘাতে আঘাতে তার সারা শরীর ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেছে।

য়ুহার জ্ঞান ফিরে পাবার পরও সে বুঝতে পারল না কোথায় আছে। চারপাশে অসংখ্য জঞ্জাল ভেসে বেড়াচ্ছে, তার মাঝে সে নিজেও ভাসছে। য়ুহা হতবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে, তার মাঝে এক ধরনের আতঙ্ক এসে ভর করে, সে কি হঠাৎ করে নিচে পড়বে, শরীরের সবগুলো হাড় গুঁড়ো হয়ে যাবে? কিন্তু য়ুহা পড়ল না, সে মহাকাশযানের ভেতরে ভাসতে লাগল।

য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালো, একটা লাল আলো একটু পরে পরে ঝলকানি দিচ্ছে কিন্তু সেই কর্কশ এলার্মের শব্দটি নেই। চারপাশে এক ধরনের নীরবতা, সেই ভয়ঙ্কর নৈঃশব্দ বুকের মাঝে এক ধরনের ভয়ের কাপুনি ছড়িয়ে দেয়। য়ুহা নিজের অজান্তেই সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল, পারল না কিন্তু হঠাৎ করে তার সারা শরীরটা বিচিত্রভাবে ওলটপালট খেতে থাকে। শরীরের কোথাও কোথাও ভয়ঙ্কর এক ধরনের বেদনা–কে জানে হাড়গোড় কিছু ভেঙেছে কি না। য়ুহা দাঁতে দাঁত কামড়ে ব্যথাটুকু সহ্য করল। নিজেকে থামানোর জন্যে সে হাত বাড়িয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করল, হঠাৎ করে যেটা ধরল সেটা হাত থেকে ছুটে বেরিয়ে যায়–একজন মানুষের শীতল দেহ! রুহা ভয় পাওয়া গলায় চিৎকার করে উঠে চারদিকে তাকায়, সবাই কি মারা গেছে?

ঠিক এ রকম সময় রুহা মহাকাশযানের এক পাশে আলো হাতে কয়েকজনকে ভেসে যেতে দেখে। অত্যন্ত ব্যস্তভাবে দ্রুতগতিতে তারা ছুটে যাচ্ছে। য়ুহা তাদেরকে ডাকতে গিয়ে থেমে গেল, মানুষগুলো খুব ব্যস্ত, এখন হয়তো তাদের বিরক্ত করা ঠিক হবে না। য়ুহা মহাকাশযানের ভেতরে অসহায়ভাবে ঝুলে আছে, সামনে-পিছে যেতে পারছে না। একজন ক্রুয়ের দেহ ভেসে ভেসে আসছে, সেটাকে টেনে ধরে সে ছেড়ে দিতেই সামনের দিকে এগিয়ে গেল। দেয়ালের কাছে পৌঁছাতেই সে শক্ত করে দেয়ালটা খামচে ধরার চেষ্টা করতে থাকে। বাম হাতটা ব্যথায় টনটন করছে, মাথার ভেতরেও যন্ত্রণার এক ধরনের অনুভূতি দপ দপ করছে। য়ুহা সেই অবস্থায় দেয়ালটা ধরে নিচে নামতে থাকে।

ঠিক এ রকম সময়ে য়ুহা দেখল তার সামনে দিয়ে হিসান দ্রুত ভেসে যাচ্ছে–ভঙ্গিটা এত সাবলীল যে দেখে মনে হয় পানির ভেতর দিয়ে কোনো একটি জলচর প্রাণী ভেসে যাচ্ছে। য়ুহা গলা উঁচু করে ডাকল, হিসান। এই যে হিসান।

হিসান য়ুহার গলার আওয়াজ শুনে দাঁড়ানোর চেষ্টা করতেই এক পাক ঘুরে গেল, হাত দুটো পেছনের দিকে ধাক্কা দিয়ে সে অত্যন্ত দক্ষ ভঙ্গিতে য়ুহার কাছে হাজির হলো, য়ুহা?

হ্যাঁ। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার দেখেছ? পুরো মহাকাশযানটা একেবারে লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে।

হিসান শুকনো গলায় বলল, হ্যাঁ।

তুমি বিশ্বাস করবে না। আমি দেখেছি একঙন মনে হয় মারা গেছে। উপরে ভাসছে।

একজন নয়, বেশ কয়েকজন।

সর্বনাশ।

কিছু আসে-যায় না। কেউ একটু আগে আর কেউ একটু পরে।

য়ুহা ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে?

আমরা এই মহাকাশযানটা ধ্বংস করে ফেলছি।

য়ুহা অবাক হয়ে বলল, কী করছ?

মহাকাশযানটা ধ্বংস করে ফেলছি।

কী বলছ তুমি? য়ুহা চিৎকার করে বলল, কী বলছ?

হ্যাঁ। আমরা মহাকাশযানটা ধ্বংস করে ফেলছি।

কেন?

ক্যাপ্টেন ক্ৰবের আদেশ। এই মহাকাশযানটা হচ্ছে মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ প্রযুক্তি। এটা যেন কিছুতেই অন্য কোনো বুদ্ধিমান প্রাণীর হাতে না পড়ে।

য়ুহা চিৎকার করে বলল, কিন্তু এটা রক্ষা করার জন্যে তোমরা চেষ্টা করবে না? আগেই মহাকাশযানটা ধ্বংস করে ফেলবে? সবাইকে মেরে ফেলবে?

হিসান শান্ত গলায় বলল, আমার এখন সেটা নিয়ে কথা বলার সময় নেই য়ুহা। আমরা সবাই সামরিক কমান্ডের ক্রু। আমরা মরতে ভয় পাই না।

য়ুহা চিৎকার করে বলল, কিন্তু আমি সামরিক কমান্ডের ক্রু না! আমি মরতে ভয় পাই। আমি তোমাদের সাথে মরতে চাই না। আমি বেঁচে থাকতে চাই।

হিসান য়ুহার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে মেঝেতে পা দিয়ে ভেসে যেতে যেতে বলল, বিদায় য়ুহা। আশা করছি তোমার জীবনটা সুন্দর ছিল।

য়ুহা হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। সত্যিই এই মহাকাশযানটাকে ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছে? সে মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালো। মহাকাশযানের মাঝে আবছা এক ধরনের অন্ধকার, একটা ঘোলাটে লাল আলো জ্বলছে আর নিভছে। বিশাল মহাকাশযানে অসংখ্য জঞ্জাল ঘুরে বেড়াচ্ছে, এর মাঝে কয়েকজন ক্রুয়ের দেহও আছে। মানুষগুলো মারা গেছে—হিসান বলেছে তাতে কিছু আসে-যায় না। একটু পরে অন্য সবাইও মারা যাবে। কেউ আগে, কেউ পরে।

য়ুহার ভেতরে হঠাৎ প্রচণ্ড ক্রোধ ফুসে উঠতে থাকে। সে চিৎকার করে ডাকল, ক্যাপ্টেন ক্ৰব! তুমি কোথায় ক্যাপ্টেন ক্ৰব?

য়ুহা শেষ পর্যন্ত ক্যাপ্টেন ক্রবকে কন্ট্রোলঘরে খুঁজে পেল। ঘরের মাঝখানে একটা অসম্পূর্ণ হলোগ্রাফিক স্ক্রিন মাঝে মাঝে এসে আবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। ক্যাপ্টেন ক্রব অন্যমনস্কভাবে সেদিকে তাকিয়ে আছে। তাকে দেখে মনে হয় সে বুঝি মেঝের ওপর দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু ভাল করে তাকালে বোঝা যায় সে আসলে মেঝে থেকে বেশ খানিকটা উপরে সোজা হয়ে ভাসছে! ক্যাপ্টেন ত্রুবকে দেখে য়ুহী চিৎকার করে বলল, ক্যাপ্টেন ক্ৰব।

ক্যাপ্টেন ক্রুব শান্ত ভঙ্গিতে বলল, বল য়ুহা।

এটা কি সত্যি যে তুমি এই মহাকাশযানটাকে উড়িয়ে দিচ্ছ?

হ্যাঁ, এটা সত্যি।

তুমি এই মহাকাশযানের সবাইকে মেরে ফেলবে?

আমরা সামরিক কমান্ডের ক্রু। আমাদেরকে প্রয়োজনে মত শেখানো হয়েছে।

তোমাদের শেখানো হয়েছে—আমাকে তো শেখানো হয়নি।

সেটা তোমার দুর্ভাগ্য—

না। হা চিৎকার করে বলল, তুমি এটা করতে পার না। তোমাকে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বেঁচে থাকার চেষ্টা করতে হবে।

ক্যাপ্টেন ক্রুব শান্ত গলায় বলল, চেষ্টা করার বিশেষ কিছু নেই। আমি সবার সাথে কথা বলেছি, সবার সাথে কথা বলে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই মুহূর্তে আমরা একটা গ্রহের আকর্ষণে আটকা পড়ে আছি–কালো অন্ধকার একটা গ্রহ। এই গ্রহে কোনো একটা মহাজাগতিক প্রাণী থাকে তারা আমাদের ধরে এনেছে। আমাদের পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করছে। আমাদের বিশেষ কিছু করার নেই। আমি সব কিছু ভেবে দেখেছি।

য়ুহা বলল, হয়তো দেখনি। হয়তো তুমি ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছ। আমি যখন বলেছিলাম মহাকাশযানটা গতিপথ পরিবর্তন করছে তখন তুমি আমার কথাও বিশ্বাস করনি। মনে আছে? তুমি যদি আমার কথা বিশ্বাস করতে তাহলে হয়তো অবস্থা অন্য রকম হতো!

সেটা সম্ভবত সত্যি। কিন্তু আমাকে তো যুক্তির ভেতরে থেকে কাজ করতে হবে। আমি তো অযৌক্তিক কাজ করতে পারি না।

য়ুহা হিংস্র গলায় বলল, হয়তো খুব জটিল অবস্থায় একটা অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নিতে হয়

ক্যাপ্টেন ক্রুব একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো প্রক্রিয়া আমার জানা নেই য়ুহা। তবে তুমি নিশ্চিত থাক আমি সবার সাথে কথা বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

তুমি আমার সাথে কথা বলনি?

তুমি আমার কমান্ডের কেউ নও! তোমার সাথে কথা বলার কথা। নয়।

কিন্তু হতে পারে আমি তোমাকে খুব ভালো একটা সিদ্ধান্ত দিতে পারতাম।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব ভুরু কুঁচকে বলল, দিতে পারতে?

হ্যাঁ।

ঠিক আছে দাও দেখি।

এই মহাকাশযানে এগারোজন বিদ্রোহীকে শীতলঘরে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। তাদের ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলে তাদের সাথে পরামর্শ কর।

তাদের নিয়ে একটা সিদ্ধান্ত নাও।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব আনন্দহীন এক ধরনের হাসি হেসে বলল, তোমার নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়ে গেছে—তা না হলে কেউ এ রকম কথা বলে? তারা বিদ্রোহী গেরিলা দল, তাদের হেডকোয়ার্টারে পৌঁছে দেবার জন্যে এই অভিযান–আর আমি তাদের ছেড়ে দেব?

হ্যাঁ। ছেড়ে দেবে। অবশ্যই ছেড়ে দেবে—

কোন যুক্তিতে?

য়ুহা জ্বলজ্বলে চোখে বলল, কারণ আমরাও মানুষ, তারাও মানুষ। একটা মহাজাগতিক প্রাণীর হাত থেকে বাঁচার জন্যে আমরা মানুষেরা এক সাথে থাকব! আমাদের পার্থক্যের কথা আমরা ভুলে যাব-

ক্যাপ্টেন ক্ৰব শব্দ করে হেসে বলল, এটা একটা অত্যন্ত আজগুবি প্রস্তাব। এ ধরনের কিছু করা হলে সামরিক কমান্ডে আমাকে বিচার করা হবে।

না, করা হবে না। এতগুলো মানুষের প্রাণ বাঁচানোর জন্যে তোমাকে পদক দেয়া হবে।

না। হবে না। আমি সামরিক কমান্ডের মানুষ—আমি জানি। আমাদের নিয়ম মেনে চলতে হয়।

য়ুহা চিৎকার করে বলল, তোমার নিয়মের আমি নিকুচি করি! আগে মানুষের জীবন তারপর জীবন।

ক্যাপ্টেন ত্রুব কঠিন মুখে বলল, না। সবার আগে নিয়ম।

য়ুহা কাতর গলায় বলল, দোহাই লাগে তোমায় ক্যাপ্টেন ক্ৰব, এগারোজন যোদ্ধাকে তুমি শীতলঘরে শীতল করে রেখেছ! তাদের ব্যবহার কর।

না। ক্যাপ্টেন ত্রুব মাথা নেড়ে বলল, য়ুহা। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় আর কঠিন সিদ্ধান্তটি নিয়েছি। আমার ক্রুরা এই মুহূর্তে মহাকাশযানের নির্দিষ্ট জায়গায় বিস্ফোরক লাগাচ্ছে। ক্যাপ্টেন ত্রুব হাতে ধরে রাখা একটা সুইচ দেখিয়ে বলল, কিছুক্ষণের মাঝে আমি এই সুইচ টিপে পুরো মহাকাশযানটি উড়িয়ে দেব। আমি আমার জীবনের শেষ মুহূর্তটি একটু একা থাকতে চাই। নিজের সাথে শেষ বোঝাঁপড়া করতে চাই।

য়ুহা স্থির দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের দিকে তাকিয়ে ছিল। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার কারণে ক্যাপ্টেন ক্ৰব ভরশূন্য পরিবেশে স্থিরভাবে দাঁড়িয়ে থাকতে পারে, য়ুহা একেবারেই পারে না, তাকে এক জায়গায় থাকার জন্যে এটা-সেটা ধরতে হয়—একটু আগে একটা ভাসমান ধাতবদণ্ড ধরেছে, সেটা এখনো তার হাতে আছে। য়ুহা একবার ক্যাপ্টেন ক্ৰবের দিকে তাকালো তারপর তার হাতের দণ্ডটির দিকে তাকালো। তার মুখের মাংসপেশি হঠাৎ করে শক্ত হয়ে যায়। সে দুই হাতে শক্ত করে ধাতবদণ্ডটি ধরে রেখে নিঃশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়ায়। তার এ জীবনে কখনোই কোনো মানুষের গায়ে হাত তোলেনি—একজন মানুষকে কেমন করে আঘাত করতে হয় সে জানে না। বহুদিন আগে কোথায় শুনেছিল মাথার পেছনে ঘাড়ের কাছাকাছি আগত করলে মানুষ নাকি অচেতন হয়ে যায়। য়ুহা তা-ই চেষ্টা করল, পুরো ঘটনাটি ঘটল চোখের পলাকে এবং অত্যন্ত স্থূল ভাবে, এ ধরনের ব্যাপারে একেবারেই অভ্যস্ত নয় বলে আঘাত করার ধাক্কা সামলাতে গিয়ে সে নিজে শূন্যে হুঁটোপুটি খেতে থাকে। অনেক কষ্টে নিজেকে যখন সামলে নেয় তখন সে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখে ক্যাপ্টেন ক্রলের অচেতন দেহ ভাসতে ভাসতে নিচে নেমে মেঝেতে ধাক্কা খেয়ে আবার উপরে উঠে যাচ্ছে। তার হাতে এখনো শক্ত করে একটা সুইচ ধরে রাখা আছে, এই সুইচে কিছু গোপন সংখ্যা প্রবেশ করিয়ে একটু পরে পুরো মহাকাশযানটিকে উড়িয়ে দেয়ার কথা ছিল।

য়ুহা মেঝেতে ধাক্কা দিয়ে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের কাছে পৌঁছে তার হাতের মুঠি থেকে সুইচটা খুলে নেয়। সুইচটা পকেটে রেখে সে তার গলায় ঝোলানো স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটিও খুলে নিল। তারপর ক্যাপ্টেন ক্ৰকের দেহটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়, মহাকাশযানের অসংখ্য জঞ্জালের ভেতর সেটিও ঘুরপাক খেতে খেতে ভাসতে থাকে। ক্যাপ্টেন ক্ৰবের জ্ঞান ফিরে না আসা পর্যন্ত কেউ তাকে খুঁজে পাবে না।

এখন তাকে শীতলঘরে গিয়ে এগারোজন বিদ্রোহীকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আগে সে কখনো এটা করেনি কিন্তু সেটা নিয়ে তার খুব একটা দুশ্চিন্তা নেই। আগে সে অনেক কিছুই করেনি। একটা ধাতবদণ্ড দিয়ে আঘাত করে সে আগে কখনো কোনো মানুষকে অচেতন করেনি।

ভরশূন্য পরিবেশে চলাচল করার অভ্যাস না থাকার কারণে শীতল ঘর পর্যন্ত পৌঁছাতে য়ুহার বেশ অনেকক্ষণ সময় লেগে গেল। পাশাপাশি এগারোটা ক্যাপসুল সাজানো আছে, ভেতরে আবছা অন্ধকার, যন্ত্রপাতির মৃদুগুঞ্জন ছাড়া সেখানে কোনো শব্দ নেই।

য়ুহা ক্যাপসুলগুলো পরীক্ষা করে, কেমন করে এর ভেতরে শীতল হয়ে থাকা মানুষগুলোকে জাগিয়ে তোলা যাবে সে জানে না। তাকে বলা হয়েছে ক্যাপসুলগুলো স্বয়ংসম্পূর্ণ কাজেই বাইরের সাথে যোগাযোগ কেটে দিলে ক্যাপসুল গুলো কোনো উপায় না দেখে নিশ্চয়ই ভেতরের মানুষটিকে জাগিয়ে দেবে। বিষয়টা হয়তো বিপজ্জনক কিন্তু নিশ্চয়ই কার্যকর। য়ুহা হাতের অস্ত্রটি নিয়ে একটা একটা করে ক্যাপসুল পরীক্ষা করে রায়ীনার ক্যাপসুলের পাশে এসে দাঁড়াল। স্বচ্ছ ঢাকনার ভেতর দিয়ে রায়ীর শীতল দেহটি দেখা যাচ্ছে, দেখে মনে হয় না এটি একটি জীবন্ত মানুষ, মনে হয় পাথরের ভাস্কর্য। য়ুহা ক্যাপসুলের পাশে সুইচগুলো পরীক্ষা করে, কোনো একটি লিভার টেনে কোনো একটা সুইচ টিপে দিলেই ভেতরের মানুষটি জেগে উঠবে সে রকম কিছু খুঁজে পেল না। তাই সে ক্যাপসুলের ভেতর থেকে বের হয়ে যাওয়া নানা ধরনের টিউব, বৈদ্যুতিক তার, অপটিক্যাল ক্যাবলগুলো খুঁজে বের করল। যদি সে এগুলো কেটে দেয় তাহলে নিশ্চয়ই ক্যাপসুলটি পুরোপুরি দায়িত্ব নিয়ে রায়ীনাকে জাগিয়ে তুলবে। বিষয়টি নিশ্চয়ই খুব বিপজ্জনক কিন্তু য়ুহার কিছু করার নেই। এই মহাকাশযানের প্রতিটি মুহূর্ত এখন প্রতিটি মানুষের জন্যে বিপজ্জনক।

য়ুহা হাতের অস্ত্রটি ক্যাবলগুলোর দিকে তাক করে ট্রিগার টেনে ধরলঘরের ভেতর একটা বিস্ফোরণের শব্দ হয়, কালো ধোঁয়া এবং আঁঝালো গন্ধে সারা ঘর ভরে ওঠে। য়ুহা কাশতে কাশতে একটু পেছনে সরে এলো। চেষ্টা করেছে ছোটখাটো একটা বিস্ফোরণ ঘটাতে কিন্তু তারপরও সেটি পুরো ঘরটিকে কাঁপিয়ে দিয়েছে। বিস্ফোরণের শব্দে কৌতূহলী হয়ে ক্রুরা এখানে চলে এলে একটা ঝামেলা হয়ে যাবে।

য়ুহা একটা ক্যাপসুলের পেছনে লুকিয়ে থেকে নিঃশব্দে অপেক্ষা করে। বিস্ফোরণের শব্দ শুনে সে কাউকে দ্রুত ভেসে আসতে দেখল না দেখে খানিকটা স্বস্তি অনুভব করে। রায়ীনার ক্যাপসুলের ওপর একটা লাল বাতি নির্দিষ্ট বিরতি দিয়ে জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করেছে। সাথে সাথে একটা কর্কশ এলার্ম বাজতে থাকে। য়ুহা ক্যাপসুলটির ভেতরে তাকালো, হালকা একটা সাদা ধোয়া ধীরে ধীরে বের হতে শুরু করেছে। শেষ পর্যন্ত কী হবে সে এখনো জানে না। রায়ীনার দেহটি সত্যি সত্যি জেগে উঠবে না কী প্রক্রিয়াটি শেষ করতে না পারার কারণে ভয়ঙ্কর যন্ত্রণায় ছটফট করে মেয়েটির মৃত্যু ঘটে যাবে সেটি সে এখনো জানে না। ক্যাপসুলে হেলান দিয়ে য়ুহা নিঃশব্দে বসে থাকে। একজন মানুষের দেহ চরম শূন্যের কাছাকাছি তাপমাত্রা থেকে জীবনের উতায় ফিরিয়ে আনতে নিশ্চয়ই একটু সময়ের দরকার।

য়ুহা দেখতে পেল খুব ধীরে রায়ীনার মুখের রং ফিরে আসছে। এক সময় সে দেখতে পায় তার হৃৎস্পন্দন শুরু হয়েছে এবং খুব ধীরে ধীরে নিঃশ্বাসের সাথে সাথে তার বুক উপরে উঠতে এবং নিচে নামতে শুরু করেছে। য়ুহা ঠিক বুঝতে পারল না, সে কী ক্যাপসুলের উপরের ঢাকনাটি খুলবে না কি আরো কিছুক্ষণ অপেক্ষা করবে।

রায়ীনা ধীরে ধীরে জেগে ওঠে। জ্ঞান ফিরে পাবার পর সে তার হাতের আঙুলগুলো চোখের সামনে নিয়ে এসে সেদিকে তাকিয়ে থাকে ঠিক অচেতন হবার আগে সে যে জিনিসটি নিয়ে ভাবছিল দেখে মনে হয় সে ঠিক সেই জিনিসটি নিয়েই ভাবতে শুরু করেছে। এর মাঝখানে যে একটি বড় সময় পার হয়ে গেছে মনে হচ্ছে সে সেই বিষয়টিই বুঝতেই পারছে না। য়ুহা ক্যাপসুলের ঢাকনার ওপর ঝুঁকে পড়ে হাত দিয়ে শব্দ করল, রাহীনা তখন খানিকটা হতচকিতের মতো মাথা ঘুরিয়ে তাকালো, তারপর উঠে বসার চেষ্টা করল। য়ুহা উপরের ঢাকনাটি খুলে দিতেই ভেতর থেকে এক ব্যালক ঠান্ডা বাতাস বের হয়ে আসে। রায়ীনা য়ুহার দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করে, তাকে দেখে মনে হয় সে ঠিক কিছুই বুঝতে পারছে না। য়ুহা নিচু গলায় ডাকল, রায়ীনা–

রায়ীনা চোখের কাছে হাত নিয়ে য়ুহাকে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, তুমি কে?

আমি য়ুহা।

আমার কী হয়েছে? আমি ভালো করে কিছু দেখতে পাচ্ছি না কেন?

তুমি এই মাত্র শীতলঘর থেকে জেগে উঠেছ তাই। য়ুহা সাহস দিয়ে বলল, কিছুক্ষণের মাঝেই তুমি পুরোপুরি জেগে উঠবে।

রায়ীনা তরল গলায় বলল, আমার নিজেকে খুব হালকা লাগছে–মনে হচ্ছে আমি ভাসছি।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, আমরা এখন ভরশূন্য পরিবেশে আছি তাই তোমার নিজেকে হালকা লাগছে।

রায়ীনা খানিকটা অপ্রকৃতস্থের মতো হাসার শব্দ করে বলল, আমাকে ছেড়ে দাও-আমি ভেসে বেড়াব! ভরশূন্য পরিবেশে ভেসে বেড়াতে আমার খুব ভালো লাগে।

মেয়েটা এখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি, কথাবার্তায় এখনো খানিকটা অসংলগ্ন। য়ুহা রিয়ানার হাত ধরে তাকে খুব সাবধানে ক্যাপসুলের ভেতর থেকে বের করে আনে। রায়ীনা দুই হাত ছড়িয়ে দিয়ে ভারশূন্য পরিবেশে শুয়ে পড়ার ভঙ্গি করতে করতে আদুরে গলায় বলল, আমি কত দিন ঘুমাইনি আমাকে একটু ঘুমাতে দাও!

য়ুহা রিয়ানার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, রিয়ানা, আসলে তুমি অনেক দিন থেকে ঘুমাচ্ছ। সত্যি কথা বলতে কি তোমার এখন ঘুম থেকে ওঠার সময়। খুবই জরুরি, তুমি জেগে ওঠার চেষ্টা করো।

জেগে উঠব?

হ্যাঁ।

কেন জেগে উঠব?

এই মহাকাশযানটির এমন খুব বড় বিপদ। তুমি তাড়াতাড়ি জেগে উঠো, আমি তোমার সাথে এটা নিয়ে কথা বলতে চাই রায়ীনা।

রায়ীনা ভুরু কুঁচকে য়ুহার দিকে তাকিয়ে মনে হয় পুরো বিষয়টা বোঝার চেষ্টা করে। ঠিক এ রকম সময় য়ুহা দরজার কাছে মৃদু একটা শব্দ শুনতে পায়। সে মুখ তুলে তাকাতেই চমকে ওঠে। ক্যাপ্টেন ক্ৰবের সাথে কমান্ডের বেশ কয়েকজন ক্রু বাতাসে ভেসে তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। সবাই একটা ভয়ঙ্কর ভঙ্গিতে তার দিকে অস্ত্র তাক করে রেখেছে। য়ুহা কী করবে ঠিক বুঝতে পারল না, শুনতে পেল, কমান্ডের একজন হিংস্র গলায় বলছে, হাতের অস্ত্রটা ছেড়ে দিয়ে দুই হাত শূন্যে তুলে স্থির হয়ে দাঁড়াও য়ুহা।

য়ুহা এক মুহূর্তের জন্যে চিন্তা করল। সে কী একবার শেষ চেষ্টা করবে? চেষ্টা করে কোনো লাভ নেই, এতজন সশস্ত্র অভিজ্ঞ সামরিক কমান্ডের ক্রুয়ের বিরুদ্ধে সে একা কিছুই করতে পারবে না। তাই সে অস্ত্রটা ছেড়ে দিল, সাথে সাথে সেটা ভাসতে ভাসতে উপরে উঠে গেল। য়ুহা হাত দুটো উপরে তুলে স্থির হয়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করে। কমান্ডের মানুষটি এবারে রায়ীনাকে লক্ষ করে বলল, তুমিও দুই হাত শূন্যে তুলে স্থির হয়ে দাঁড়াও, তা না হলে আমি তোমাকেও হত্যা করতে বাধ্য হব।

রায়ীনা মানুষটির দিকে তাকিয়ে আদুরে গলায় বলল, তুমি আমার সাথে এ রকম রাগ হয়ে কথা বলছ কেন?

য়ুহা অনেকটা কৈফিয়ত দেয়ার মতো করে বলল, আসরোয়ানা এখনো পুরোপুরি জেগে ওঠেনি—এখনো খানিকটা অপ্রকৃতস্থ হয়ে আছে।

ক্যাপ্টেন ত্রুব শীতল গলায় বলল, য়ুহা। তুমি কী জান, তোমাকে যেন আমি কঠিন একটা শাস্তি দিতে পারি শুধু এটা নিশ্চিত করার জন্যে আমি মহাকাশযানটাকে আরো কিছুক্ষণ বাঁচিয়ে রাখব?

য়ুহা কোনো কথা বলল না, শুধু রায়ীনা একটা বাচ্চা মেয়ের মতো খিল খিল করে হেসে উঠল। যেন ক্যাপ্টেন ত্রুব খুব মজার কথা বলেছে।

য়ুহা শেষ পর্যন্ত আর অনিয়ন্ত্রিতভাবে ভেসে বেড়াচ্ছে না, কারণ তাকে মহাকাশযানের দেয়ালে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার পাশেই রায়ীলা, তাকেও একইভাবে বাঁধা হয়েছে। কমান্ডের ছয়জন ক্রু তাদের দিকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র তাক করে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ক্যাপ্টেন ত্রুব কাছাকাছি একটা টেবিলের পাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

ক্যাপ্টেন ক্রর দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে শেষ পর্যন্ত একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি আমার দীর্ঘ জীবনে কখনোই এ রকম একটি ঘটনা ঘটতে দেখিনি। য়ুহা, তুমি আমার নির্দেশ পুরোপুরি উপেক্ষা করে আমাকে শারীরিকভাবে আঘাত করে অত্যন্ত বিপজ্জনকভাবে একজন বিদ্রোহীকে জাগিয়ে তুলেছ?

য়ুহা বলল, তুমি যদি আমার কথা শুনতে তাহলে আমার তোমাকে অচেতন করার প্রয়োজন হতো না। আর একটা বিদ্রোহীকে বিপজ্জনকভাবে জাগিয়ে তুলতে হতো না। তোমাকে আঘাত করার জন্যে আমি দুঃখিত। একজন মানুষকে অচেতন করার জন্যে তাকে কত জোরে আঘাত করতে হয় আমার জানা নেই তাই সম্ভবত, আঘাতটি প্রয়োজনের তুলনায় অনেক জোরে হয়ে গিয়েছিল।

ক্যাপ্টেন ত্রুব দাঁতে দাঁত ঘষে বলল, তোমার দুঃসাহস দেখে আমি স্তম্ভিত হয়েছি য়ুহা। তোমাকে সে জন্যে শাস্তি পেতে হবে। অত্যন্ত কঠিন একটা শাস্তি।।

মহাকাশযানটিকে ধ্বংস করে সবাইকে মেরে ফেলবে, তুমি এর মাঝে আমাকে আলাদা করে কী শাস্তি দেবে?

এর মাঝেও তোমাকে আলাদা করে শাস্তি দেয়া সম্ভব। সময় হলেই তুমি সেটা দেখবে।

য়ুহা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, এ রকম চরম বিপদের মাঝেও তুমি একেবারে ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার উপরে উঠতে পারছ না দেখে আমি খুব অবাক হয়েছি। ক্যাপ্টেন ক্ৰব, আমি তোমার জন্যে করুণা অনুভব করছি, তুমি নিশ্চয়ই খুব অসুখী একজন মানুষ।

আমি আমার ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখ নিয়ে কথা বলতে আসিনি।

য়ুহা ক্যাপ্টেন ত্রুবকে বাধা দিয়ে বলল, আমি এখনো বিশ্বাস করি আমার সিদ্ধান্তটি পুরোপুরি সঠিক। এগারোজন বিদ্রোহীকে জাগিয়ে তুলে তাদের সাথে পরামর্শ করে তোমার একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত ছিল। তোমার নিজের নেয়া সিদ্ধান্তটি ভুল। পুরোপুরি ভুল।

ক্যাপ্টেন ক্রল ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি আমার সিদ্ধান্তটি নিয়ে তোমার সাথে কথা বলতে আগ্রহী নই।

তুমি অন্তত রায়ীনার সাথে কথা বল। মহাজাগতিক প্রাণীর বুদ্ধিমত্তার ব্যাপারে সে একজন বিশেষজ্ঞ। সে তোমাকে সাহায্য করতে পারে।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব কোনো কথা না বলে য়ুহার দিকে স্থির চোখে তাকিয়ে রইল। য়ুহা আবার বলল, সে যেহেতু জেগেই গেছে তখন তার সাথে কথা বলার মাঝে কোনো সমস্যা নেই। আমি নিশ্চিত রায়ীনা তোমাকে সাহায্য করতে পারবে।

ক্যাপ্টেন ক্রব এবারে রায়ীনার দিকে তাকায়, জিব দিয়ে নিচের ঠোঁটটা ভিজিয়ে শুকনো গলায় বলে, য়ুহার কথা কি সত্যি? তুমি কি এ ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করতে পারবে?

রায়ীনা বলল, সবকিছু না জানলে আমি কিছু বলতে পারব না। তবে এ কথাটি সত্যি আমি বুদ্ধিমত্তা নিয়ে গবেষণা করি। একটা প্রাণীর বুদ্ধিমত্তা কীভাবে বিকশিত হয়, সেই বুদ্ধিমত্তার কারণে একটা প্রাণী তার চারপাশের জগতের কাছে কী আশা করে সে সম্পর্কে আমার মৌলিক কিছু গবেষণা আছে।

ক্যাপ্টেন ক্রব কয়েক মুহূর্ত চিন্তা করে বলল, আমি যদি তোমাকে সব তথ্য দিই তাহলে তুমি কি আমাকে এ ব্যাপারে কিছু বলতে পারবে? মহাজাগতিক প্রাণীটি কী চায় কেন চায় কীভাবে চায় সেটি ব্যাখ্যা করতে পারবে?

রায়ীনা কয়েক মুহূর্ত কিছু একটা চিন্তা করে বলল, খুব নিখুঁতভাবে পারব সেটা দাবি করি না। তবে সম্ভবত তোমাদের অনেকের চাইতে ভালো পারব।

ঠিক আছে। ক্যাপ্টেন ত্রুব মাথা নেড়ে বলল, আমি তোমাকে সব তথ্য দিচ্ছি, দেখি তুমি আমাদের কী দিতে পার।

রায়ীলা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল। ক্যাপ্টেন ক্ৰব ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি হাসছ কেন?

রায়ীনা হাসি থামিয়ে বলল, খানিকক্ষণ আগে আমি যখন জেগে উঠতে শুরু করি আমার নিজের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ ছিল না। আমি অবান্তর কথা বলেছি, অসংলগ্ন ব্যবহার করেছি, অকারণে হেসেছি। সেগুলোর কোনো গুরুত্ব ছিল না, কিন্তু এখন আমার হাসিটুকু একেবারেই আমার নিজস্ব! আমি হাসছি তার সুনির্দিষ্ট একটা কারণ আছে।

ক্যাপ্টেন ক্রব ভুরু কুঁচকে বলল, কী কারণ?

তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে আমি তোমার কমান্ডের একজন অনুগত সদস্য! তুমি আমাকে একটা আদেশ দেবে আর আমি, হুঁকুম শিরোধার্য বলে তোমার আদেশ মেনে চলব! তুমি নিশ্চয়ই লক্ষ করেছ আমাদের বিন্দুমাত্র সম্মান না দেখিয়ে মহাকাশযানের দেয়ালে বেঁধে রাখা হয়েছে?

ক্যাপ্টেন ত্রুবকে এক মুহূর্তের জন্যে একটু বিচলিত মনে হলো, সে নিজেকে সামলে নিয়ে বলল, তুমি বিদ্রোহী দলের একজন সদস্য। আমাদের এই মহাকাশযানের নিরাপত্তার একটা বিষয় আছে। আমি তোমাকে ছেড়ে রাখতে পারি না।

রায়ীনা মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, কিন্তু তুমি যদি আমার সাহায্য নিতে চাও তাহলে আগে আমার কিছু কথাবার্তা শুনতে হবে।

তোমার কথাবার্তাগুলো কী?

প্রথমেই আমাকে যেভাবে বেঁধে রেখেছ সেটা খুলে দিতে হবে। মানুষ যখন একটা পশুকে বাধে তখনও চেষ্টা করে রক্ত সঞ্চালনের বিষয়টা নিশ্চিত করতে, তোমরা সেটা করনি। আমাকে যদি খুলে দাও তাহলে আমার পাশে বসে থাকা য়ুহা নামের এই বিচিত্র মানুষটির বাঁধনও খুলে দিতে হবে। আমি এর সম্পর্কে কিছুই জানি না। কিন্তু এর কথাগুলো এবং এর খাপছাড়া কাজগুলো আমার বেশ পছন্দ হয়েছে। সত্যি জীবন সম্পর্কে এর বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, সে কারণে তার জন্যে একটু মায়াও হয়েছে। রায়ীনা একটু নিঃশ্বাস নিয়ে বলল, তারপর আমার দলের বাকি এগারোজনকে জাগিয়ে তুলতে হবে। আমাকে যেভাবে অসম্ভব বিপদের ঝুঁকি নিয়ে জাগানো হয়েছে—সেভাবে নয়। স্বাভাবিকভাবে জাগাতে হবে যেন জেগে ওঠার সাথে সাথে তারা পুরোপুরি কার্যক্ষম থাকে। আমার মতো অপ্রকৃতস্থ না থাকে।

য়ুহা কৈফিয়ত দেয়ার ভঙ্গিতে বলল, আসলে দোষটা আমার–

রায়ীনা য়ুহার দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করে বলল, তোমার কোনো দোষ নেই, তুমি যেটা করেছ সেটা অসাধারণ। তোমার কারণে আমি এই মহাকাশযানের ক্যাপ্টেনের কাছে আমার দাবিগুলোর কথা বলতে পারছি।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব শক্ত মুখ করে বলল, তোমার কথা শেষ হয়েছে।

না। শেষ হয়নি। রায়ীনা বলল, আমার দলের সবাইকে জাগিয়ে তুললেই হবে না। তাদের নিরাপত্তার জন্য তাদের সবার হাতে একটা করে অস্ত্র দিতে হবে যেন ইচ্ছে করলেই তোমরা তাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে না পার। শুধুমাত্র তাহলেই আমি তোমার সাথে কথা বলতে পারি।

ক্যাপ্টেন ক্ৰব শীতল চোখে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে রইল। সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না। কয়েকবার চেষ্টা করে বলল, তুমি নিশ্চয়ই একবারও বিশ্বাস করনি যে তোমার এই দাবিগুলো আমরা মেনে নেব।

স্বাভাবিক অবস্থা হলে বিশ্বাস করতাম না, কিন্তু এখন অবস্থাটা খুব জটিল। হয়তো তোমার একটা সঠিক সিদ্ধান্তে এতগুলো মানুষের প্রাণ বেঁচে যাবে।

আমি দুঃখিত রায়ীনা। তোমার রক্তসঞ্চালনের জন্যে হাতের বাঁধনটা একটু ঢিলে করে দেয়া ছাড়া আমার পক্ষে তোমার আর কোনো দাবিই মেনে নেয়া সম্ভব না।

রায়ীনা আবার শব্দ করে হাসল। ক্যাপ্টেন ক্ৰব ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি কেন হাসছ।

তোমার কথা শুনে। তোমার আশেপাশে তোমার কমান্ডের এত জন। মানুষ দাঁড়িয়ে আছে, কিন্তু সিদ্ধান্ত দেবার জন্যে একবারও তাদের সাথে কথা বললে না! আমি তোমার জায়গায় হলে তাদের সাথে একবার কথা বলতাম।

ক্যাপ্টেন জব ক্রুদ্ধ গলায় বলল, আমি কীভাবে সিদ্ধান্ত নেব সেটি আমার ব্যাপার। আমি সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারি বলেই আমি এই মহাকাশযানের ক্যাপ্টেন।।

য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, তোমার সিদ্ধান্ত দেখে সেটা মনে হচ্ছে না ক্যাপ্টেন ক্ৰব।

আমার সিদ্ধান্তটি কী সেটা তোমরা এখনো জান না। আমি এখনো সেটা বলিনি।

সবাই এবার উৎসুক দৃষ্টিতে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের দিকে তাকাল। ক্যাপ্টেন ক্রব তার মুখে একটা বিচিত্র হাসি ফুটিয়ে বলল, আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি একটা স্কাউটশিপে করে তোমাদের দুজনকে এই কালো কুৎসিত গ্রহটাতে পাঠাব। এই গ্রহতে মহাজাগতিক প্রাণীগুলো আছে, দেখা যাক তারা তোমাদের কীভাবে গ্রহণ করে!

য়ুহা চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?

আমি ঠিকই বলছি। দেখি তোমরা এই মহাজাগতিক প্রাণীকে পরাস্ত করে ফিরে আসতে পার কী না।

য়ুহা কী বলবে বুঝতে না পেরে বলল, পরাস্ত করতে হবে? আমাদের?

সেটা তোমাদের ইচ্ছে।

য়ুহা ভয়ার্ত চোখে রায়ীনার দিকে তাকালো। রায়ীনার চোখে-মুখে ভয়ের কোনো চিহ্ন নেই। সে য়ুহার দিকে তাকিয়ে চোখ মটকে বলল, আশা করি সঙ্গী হিসেবে তুমি ভালো হবে–তোমার সাথে অনেক সময় কাটাতে হবে আমার।

আসলে সঙ্গী হিসেবে আমি যাচ্ছেতাই! য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, এত বয়স হয়েছে এখনো আমার কোনো ভালো বন্ধু নেই!

রায়ীনা বলল, আমি স্কাউটশিপে ওঠার আগে আমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই।

ক্যাপ্টেন ত্রুব বলল, তুমি অর্থহীন কথা বলো না। তোমার বন্ধুরা সবাই একটি করে জড় পদার্থ হয়ে আছে। একটা স্ক্রু ড্রাইভারের কাছ থেকে বিদায় নেয়া আর তোমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নেয়ার মাঝে কোনো পার্থক্য নেই।

রায়ীনা বলল, কে আমার বন্ধু কে ক্রু ড্রাইভার আমি সেটা নিয়ে তর্ক করতে চাই না। আমি বলছি যে আমি আমার এই বন্ধুদের সাথে আমার জীবনকে এক সুতায় বেঁধেছি। আমার কাছে আমি যেটুকু গুরুত্বপূর্ণ আমার এই বন্ধুরাও সমান গুরুত্বপূর্ণ। আমি চলে যাবার আগে তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে চাই।

ক্যাপ্টেন ত্রুব বলল, এটি অত্যন্ত ছেলেমানুষী, অর্থহীন একটা প্রক্রিয়া।

রায়ীনা বলল, আমি ছেলেমানুষ এবং এই মুহূর্তে আমার জীবনের কোনো অর্থ নেই। তবে তুমি নিশ্চিত থাক আমি পালিয়ে যাবার চেষ্টা করব না। শুধু তাদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসব।

ক্যাপ্টেন ত্রুব বলল, তারা সেটি জানতেও পারবে না।

রায়ীনা বলল, যদি কখনো তাদেরকে জাগিয়ে তোলা হয় তখন তারা জানতে পারবে।

হিসান ক্যাপ্টেন বের কাছে গিয়ে গলা নামিয়ে বলল, ক্যাপ্টেন ক্রব, মেয়েটি যখন চাইছে তাকে অনুমতি দেয়া যেতে পারে। আমরা কয়েকজন তাকে শীতল ঘরে নিয়ে যাব তারপর ফিরিয়ে আনব। প্রতিমুহূর্ত তাকে চোখে চোখে রাখব।

ক্যাপ্টেন ত্রুব হিসানের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিক আছে। আমি তোমাকে দায়িত্ব দিচ্ছি তুমি এই মেয়েটিকে শেষবারের মতো শীতলঘর থেকে ঘুরিয়ে আনে। সে তার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে আসুক। ক্যাপ্টেন ক্রব এক মুহূর্ত থেমে যোগ করল, মনে রেখো সে যদি অন্য কিছু করতে চায় তুমি তাকে সাথে সাথে গুলি করে হত্যা করতে পার।

স্কাউটশিপটা ছোট, দুজন পাশাপাশি বসতে পারে। নানারকম যন্ত্রপাতিতে বোঝাই, যার কোনটা কী কাজ করে সে সম্পর্কে য়ুহার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। য়ুহাকে প্রথমবারের মতো বায়ু-নিরোধক একটা পোশাক পরিয়ে দিচ্ছিল মিটিয়া। সে নিঃশব্দে কাজ করছে, য়ুহা জিজ্ঞেস করল, তুমি এবারে কিন্তু গুন গুন করে গান গাইছ না।

না। গাইছি না। মিটিয়া একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আসলে সব ।সময় গান গাইতে ইচ্ছে করে না।

সেটা আমি বুঝতে পারছি।

যাই হোক, তুমি এই পোশাকটি কখনো ব্যবহার করনি।

য়ুহা বাধা দিয়ে বলল, করেছি। আমাকে যখন প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছিল তখন তারা এই পোশাকটা পরিয়েছিল।

সেটা ছিল খুবই কৃত্রিম একটা পরিবেশ—এখন পরিবেশটা খুব ভিন্ন। মিটিয়া গম্ভীর গলায় বলল, সব সময় মনে রাখতে হবে তোমার চলাফেরা হবে খুব সীমিত। এমনিতে তুমি যা যা করতে পার এই বিদঘুটে পোশাক পরে তুমি কিন্তু তার বিশেষ কিছুই করতে পারবে না।

য়ুহা জিজ্ঞেস করল, তাহলে আমাদের এই পোশাক পরাচ্ছ কেন?

তোমরা গ্রহটিতে যাচ্ছ সে জন্যে–

আমরা মোটেও গ্রহটিতে যাচ্ছি না-আমাদের জোর করে এই অন্ধকার গ্রহটাতে পাঠানো হচ্ছে।

মিটিয়া একটু থতমত খেয়ে বলল, আমি দুঃখিত য়ুহা।

তোমার দুঃখিত হবার কিছু নেই মিটিয়া।

যাই হোক, আমি যেটা বলছিলাম, এই পোশাকটা যদিও অত্যন্ত বিদঘুটে কিন্তু এটি একটি অসাধারণ পোশাক। একজন মানুষকে বেঁচে থাকতে হলে যা যা দরকার তার সবকিছু এর ভেতরে আছে। একবার চার্জ করিয়ে নিলে এটা একজন মানুষকে পুরো আটচল্লিশ ঘণ্টা বাঁচিয়ে রাখতে পারে! এর ভেতরে যোগাযোগের ব্যবস্থা আছে, অস্ত্র আছে

অস্ত্র আছে? য়ুহা চমকে উঠে বলল, আমাদের হাতে তোমরা অস্ত্র তুলে দিচ্ছ?

হ্যাঁ, দিচ্ছি তার কারণ তোমরা এখন সেটা ব্যবহার করতে পারবে। নিচের অন্ধকার গ্রহটাতে পৌঁছানোর পর সেটাকে চালু করা হবে।

নিচের গ্রহ সম্পর্কে তুমি কিছু জান মিটিয়া?

না। আমি বিশেষ কিছু জানি না। তোমাকে এই মুহূর্তে বলা হয়তো ঠিক হবে না কিন্তু গ্রহটি অত্যন্ত কুৎসিত। এর মাঝে এক ধরনের অশুভ ব্যাপার লুকিয়ে আছে।

য়ুহা কোনো কথা না বলে চুপ করে বসে রইল।

মহাকাশযান থেকে স্কাউটশিপটা উড়ে গেল কোনোরকম আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই। য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে একবার পেছন দিকে তাকিয়ে মহাকাশযানটিকে দেখার চেষ্টা করল, ঠিক কী কারণ জানা নেই সেটিকে একটা বিধ্বস্ত জাহাজের মতো দেখাচ্ছে। সে আর কখনো এখানে ফিরে আসতে পারবে কী

জানে না। য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে রায়ীনার দিকে তাকালো, রায়ীনা।

বল।

তোমার কী মনে হয়? এই গ্রহটার প্রাণীগুলো কী রকম?

আমার এখনো কোনো ধারণা নেই। তবে প্রাণীগুলো বুদ্ধিমান সে ব্যাপারে আমার কোনো সন্দেহ নেই।

তারা কী আমাদের থেকে বুদ্ধিমান?

রায়ীনা শব্দ করে হেসে বলল, আমরা বুদ্ধিমান তোমাকে কে বলেছে? আমরা যদি বুদ্ধিমান হতাম তাহলে কি নিজেরা নিজেরা যুদ্ধ করি? নিজেদের গ্রহটাকে ধ্বংস করে মহাজগতের এখানে-সেখানে বেঁচে থাকার চেষ্টা করি? মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে হত্যা করি? জোর করে অপছন্দের মানুষদের কালো কুৎসিত অন্ধকার একটা গ্রহে ঠেলে পাঠিয়ে দিই?

তার পরও আমরা তো একটা সভ্যতা গড়ে তুলেছি তুলিনি—

এটাকে সভ্যতা বলে না।

য়ুহা সভ্যতার সংজ্ঞা নিয়ে প্রশ্ন করতে গিয়ে থেমে গেল। হঠাৎ করে তার মাথাটা একটু ঘুরে উঠেছে, হালকা এক ধরনের মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে কোথা থেকে। সে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে ভয় পাওয়া গলায় ডাকল, রায়ীলা—

হ্যাঁ। রায়ীনা মাথা নাড়ে, আমাদের অচেতন করে দিচ্ছে।

কে অচেতন করছে? কেন করছে?

ক্যাপ্টেন জব নিশ্চিত করতে চাইছে যেন আমরা এই স্কাউটশিপটা ব্যবহার করে অন্য কিছু করতে না পারি। রায়ীনা ঘুমঘুম গলায় বলল, য়ুহা, আমি জানি না এই স্কাউটশিপটা আমাদের ঠিকভাবে গ্রহটাতে পৌঁছাতে পারবে কী না। যদি না পারে তাহলে বিদায়! তোমার সাথে পরিচয় হওয়াটা আমার জন্যে চমৎকার একটা অভিজ্ঞতা ছিল।

য়ুহা কিছু একটা বলতে চাইছিল, কিন্তু কিছু বলার আগেই সে গভীর ঘুমে অচেতন হয়ে পড়ল।

য়ুহা ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল সে একটি গহিন বনে হারিয়ে গেছে, যেদিকেই যায় সে দেখতে পায় শুধু গাছ আর গাছ। কৃত্রিম গাছ নয়, সত্যিকারের গাছ। সেই গাছের ডাল, গাছের পাতায় তার শরীর আটকে যাচ্ছে, লতাগুলোতে সে জড়িয়ে যাচ্ছে, তখন শুনতে পেল বহুদূর থেকে কেউ যেন তাকে ডাকছে, য়ুহা।

য়ুহা এদিকে সেদিকে তাকালো, কাউকে দেখতে পেল না। শুধু মনে হলো কণ্ঠস্বরটি বুঝি আরো কাছে এগিয়ে এসেছে—আবার ডাকছে, য়ুহা। এ রকম সময় সে ধড়মড় করে ঘুম থেকে জেগে উঠল, তার ওপর ঝুঁকে পড়ে আছে রায়ীনা, তাকে ধাক্কা দিতে দিতে সে ডাকছে।

য়ুহা এসে বসে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, আমরা কোথায়? আমরা গ্ৰহটাতে নেমে এসেছি।

আমরা তো বেঁচে আছি তাই না?

মনে হচ্ছে বেঁচে আছি। তবে এটাকে তুমি যদি বেঁচে থাকা না বলতে চাও তাহলে অন্য ব্যাপার।

য়ুহা স্কাউটশিপের গোল জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, সর্বনাশ, কী বিদঘুটে গ্রহ!

রায়ীনা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ এটা খুব বিদঘুটে একটা গ্রহ।

য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি কখনো চিন্তা করিনি, আমার জীবনের শেষ সময়টা কাটাব এ রকম একটা বিদঘুটে অন্ধকার গ্রহে।

তোমার জীবনের শেষ সময়টা কোথায় কাটানোর কথা ছিল?

আমি ভেবেছিলাম আমার নিজের পরিচিত মানুষের সাথে। সাধারণ মানুষ। সাদামাটা মানুষ।

রায়ীনা মাথা ঘুরিয়ে য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, বিষয়টা নিয়ে আমারও এক ধরনের কৌতূহল! তুমি তো সামরিক কমান্ডের কেউ নও-তুমি কেমন করে এই মহাকাশযানে আছ?

আমি একজন কবি! আমি একাডেমির কাছে আবেদন করেছিলাম যে আমি মহাকাশ ভ্রমণে যেতে চাই। একাডেমি এদের সাথে আমাকে যেতে দিয়েছে।

রায়ীনা হাসার চেষ্টা করে বলল, তুমি এখন নিশ্চয়ই খুব আফসোস করছ যে কেন এসেছিলে?

না, আসলে করছি না। সবকিছুই তো অভিজ্ঞতা, এটাও এক ধরনের অভিজ্ঞতা। একটা জীবন তো নানারকম অভিজ্ঞতা ছাড়া আর কিছু না।

রায়ী অন্যমনস্কভাবে বলল, তা ঠিক।

য়ুহা বলল, এখান থেকে বের হয়ে যদি আবার নিজের পরিচিত মানুষদের কাছে ফিরে যেতে পারতাম, তাহলে অভিজ্ঞতার গুরুত্বটুকু আরো অনেক বাড়ত।

রায়ীনা আবার অন্যমনস্কভাবে বলল, তা ঠিক।

য়ুহ্য জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কী করব?

রায়ীনা বলল, আমি প্রথম ছত্রিশ ঘণ্টা বিশেষ কিছু করতে চাই না।

য়ুহা একটু অবাক হয়ে বলল, প্রথম ছত্রিশ ঘণ্টা?

হ্যাঁ। ছত্রিশ ঘণ্টার পর আমি মহাকাশযান থেকে আরো কয়েকটি স্কাউটশিপ আশা করছি। আমাদের সাহায্য করার জন্যে তখন আরো কিছু মানুষ আসবে। যন্ত্রপাতি আসবে! অস্ত্র আসবে! তখন যদি কিছু করা যায় করব।

য়ুহা হতচকিত হয়ে বলল, আমি কিছু বুঝতে পারছি না। ছত্রিশ ঘণ্টা পর মহাকাশযান থেকে স্কাউটশিপ কেন আসবে?

তার কারণ ছত্রিশ ঘণ্টা পর আমার দলের লোকজন মহাকাশযানটা দখল করে নেবে। চব্বিশ ঘণ্টার মাঝেই সেটা ঘটে যাবার কথা, আমি নিশ্চিত হওয়ার জন্যে আরো বারো ঘণ্টা হাতে রাখছি। আর তারা মহাকাশযানটা দখল করার পর আমাকে সাহায্য করার জন্যে ছুটে আসবে।

য়ুহা বিস্ফারিত চোখে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার দলের লোকেরা কেমন করে মহাকাশযানটা দখল করবে?

তোমার মনে আছে এই স্কাউটশিপ রওনা দেবার আগে আমি আমাদের দলের লোকদের কাছ থেকে বিদায় নিতে গিয়েছিলাম?

হ্যাঁ। মনে আছে।

আসলে আমি মোটেও বিদায় নিতে যাইনি। ক্যাপ্টেন ক্ৰব ঠিকই বলেছিল, কাউকে যখন হিমঘরে শীতল করে রাখা হয় তখন তার ভেতরে আর একটা ক্রু ড্রাইভারের মাঝে কোনো পার্থক্য নেই। আমি গিয়েছিলাম আমাদের একজনের লিকুইড হিলিয়াম সরবরাহে ঘোট একটু ফুটো করতে-খুব ছোট, খালি চোখে কিছুতেই ধরা পড়বে না কিন্তু সময় দেয়া হলে লিকুইড হিলিয়ামটা বের হয়ে যাবে! সবাই যখন ভেবেছে আমি গভীর আবেগে বিদায় নিয়ে আসছি, আসলে তখন আমার জুতোর গোড়ালিতে লাগানো টাইটেনিয়ামের সূক্ষ্ম পিনটি দিয়ে টিউবে একটা ছোট ফুটো করেছি। ঘণ্টা তিনেক পর যখন শরীরটাকে ঠান্ডা রাখতে পারবে না তখন তাকে জাগিয়ে তোলা হবে! তুমি আমাকে যেভাবে জাগিয়েছিলে।

কী আশ্চর্য!

না, মোটেও আশ্চর্য নয়। এটা হচ্ছে খুব বাস্তব একটা কাজ! যাই হোক আমি যার ক্যাপসুলে এই ঘটনা ঘটিয়ে রেখে এসেছি তার নাম হচ্ছে রিহি। রিহি হচ্ছে আমাদের মাঝে সবচেয়ে বুদ্ধিমান। আমাদের ধারণা, তার নিউরনের সিনালের সংখ্যা আমাদের থেকে দশ গুণ বেশি! সে নিশ্চয়ই জানবে তখন কী করতে হবে। অন্য সবাইকে তখন জাগিয়ে তুলবে। পরের অংশ সহজ–মহাকাশযানটা দখল করে নেয়া! ছোটখাটো যুদ্ধ হতে পারে কিন্তু সেই যুদ্ধে কেউ তাদের হারাতে পারবে না। তাদেরকে হারানোর মতো সামরিক বাহিনী এখনো জন্মায়নি।

তুমি সত্যি বলছ?

হ্যাঁ। আমি সত্যি বলছি। তাই আমি পরের ছত্রিশ ঘণ্টা বিশেষ কোনো অ্যাডভেঞ্চার না করে বসে থাকতে চাই। যতটুকু সম্ভব তথ্য সংগ্রহ করতে চাই। যখন সময় হবে তখন যেন সেটা ব্যবহার করতে পারি।

মুহ বিস্ফারিত চোখে বলল, রায়ীন, আমি যতই তোমাকে দেখছি ততই মুগ্ধ হয়ে যাচ্ছি।

রায়ীনা হেসে বলল, তোমার কথা শুনে মনে হচ্ছে তুমি তোমার জীবনে খুব বেশি মানুষ দেখনি। তাই অল্পতেই মুগ্ধ হয়ে যাও!

না, আমি অল্পতে মুগ্ধ হই না। তুমি আসলেই অসাধারণ।

ঠিক আছে, আমি অসাধারণ! সেটা নিয়ে পরে আলোচনা করব। এখন ঠিক করা যাক ছত্রিশ ঘণ্টা সময় কীভাবে কাটানো যায়।

য়ুহা এবং রায়ীনা কিছুক্ষণের মাঝেই আবিষ্কার করল বিশেষ কিছু না করে ছত্রিশ ঘণ্টা সময় কাটিয়ে দেয়া খুব সহজ নয়। স্কাউটশিপে যে যন্ত্রপাতিগুলো আছে সেগুলো ব্যবহার করে তারা গ্রহটা সম্পর্কে তথ্য বের করার চেষ্টা করছিল কিন্তু কিছুক্ষণের মাঝেই সেই কাজটা শেষ হয়ে গেল। তারা আবিষ্কার করল গ্রহটা মোটামুটি বিচিত্র, বায়ুমণ্ডল বলতে গেলে নেই, তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি। গ্রহটার পৃষ্ঠে আলো বিকিরণকারী এক ধরনের যৌগ আছে, সেখান থেকে নিস্প্রভ এক ধরনের আলো বের হয়, পুরো গ্রহটা সেজন্যে কখনো পুরোপুরি অন্ধকার নয় কিন্তু কখনোই পরিষ্কার করে কিছু দেখা যায় না। চারপাশে কেমন যেন মন খারাপ করা বিষঃ এক ধরনের পরিবেশ। এটা মূলত সিলিকনের গ্রহ, গ্ৰহটার ভর খুব কম, তাই বায়ুমণ্ডল আটকে রাখতে পারেনি। ছোট গ্রহ বলে পৃষ্ঠদেশ একেবারে অসম। জৈবিক প্রাণীর রুটিন বাঁধা পরীক্ষাগুলোতে কিছু ধরা পড়েনি কিন্তু এই গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব আছে তার একটি প্রমাণ পাওয়া গেছে। গ্রহটির পৃষ্ঠ থেকে নির্দিষ্ট সময় পরপর একটা সিগন্যাল মহাকাশে পাঠানো হয়। এ ধরনের একটা সিগন্যাল পাঠাতে হলে তার জন্যে জ্ঞান বিজ্ঞান প্রযুক্তির একটা নির্দিষ্ট ধরনের উন্নতি হতে হয় মানুষের সভ্যতার সমকক্ষ সভ্যতা ছাড়া এটি সম্ভব নয়।

সিগন্যালটি নির্দিষ্ট একটা সময় পরপর পাঠানো হয়, মোটামুটি সহজেই কোথা থেকে সিগন্যালটা পাঠানো হচ্ছে জায়গাটুকু নির্দিষ্ট করা গেছে। এই গ্রহে বুদ্ধিমান প্রাণীর অস্তিত্ব খুঁজে বের করতে হলে মনে হয় এই জায়গাটা দিয়েই শুরু করতে হবে। তবে নিজে থেকে সেখানে হাজির হওয়াটা খুব বিপজ্জনক একটি কাজ হয়ে যেতে পারে।

প্রথম কয়েক ঘণ্টার ভেতরেই য়ুহা এবং রায়ীনার ভেতরে এক ধরনের। ক্লান্তি এসে ভর করল, কোনো কিছু না করার এক ধরনের ক্লান্তি আছে, সেই ক্লান্তি খুব সহজেই একজনকে কাবু করে ফেলে। য়ুহা বলল, এই ছোট স্কাউটশিপে বসে থাকতে অসহ্য লাগছে! আমি কি স্কাউটশিপের বাইরে থেকে একটু ঘুরে আসতে পারি? অপরিচিত একটা গ্রহে পা দিতে কেমন লাগে সেটা একটু দেখতে চাই! কখনো এ রকম একটা অভিজ্ঞতা হবে আমি ভাবিনি।

রায়ীনা বলল, আমারও অসহ্য লাগছে, কিন্তু এক সাথে দুজন বের হওয়া ঠিক হবে না। তুমি বের হও আমি তোমার ওপর চোখ রাখি, তারপর আমি বের হব, তখন তুমি আমার ওপর চোখ রাখবে।

য়ুহা তখন খুব সাবধানে স্কাউটশিপ থেকে বের হয়ে এলো। তার শরীরে তাপ নিরোধক পোশাক, তারপরও বাইরের শীতল গ্রহটিতে তার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে। য়ুহা উপরের দিকে তাকালো, সেখানে কুচকুচে কালো আকাশে অসংখ্য নক্ষত্র জ্বলজ্বল করছে। চারদিকে এবড়ো থেবড়ো পাথর, শুষ্ক এবং বিবর্ণ। য়ুহা স্কাউটশিপটি ছেড়ে কয়েক পা এগিয়ে গেল এবং হঠাৎ তার ভেতরে এক ধরনের বিচিত্র অনুভূতি হতে থাকে, তার মনে হয় কেউ যেন তার দিকে তাকিয়ে আছে। য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকালো, আবছা অন্ধকারে উঁচু-নিচু পাথর, তার ভেতর থেকে সত্যিই কি কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে?

য়ুহা।

বল।

আমার মনে হচ্ছে তোমার হৃৎস্পন্দন হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। কিছু কী হয়েছে?

না। কিছু হয়নি।

তুমি কী কোনো কারণে ভয় পেয়েছ?

না ভয় পাইনি। তবে—

তবে কী?

আমার কেন জানি মনে হচ্ছে কেউ যেন আমার দিকে তাকিয়ে আছে।

মানুষের মন খুব বিচিত্র। রায়ীনা হাসির মতো শব্দ করে বলে, সত্যি সত্যি কেউ তোমার দিকে তাকিয়ে থাকলে আমি একটু চিন্তিত হতাম কিন্তু এটা যদি তোমার একটা কল্পনা হয়ে থাকে তাহলে আমি ব্যাপারটাকে খুব গুরুত্ব দেব না।

য়ুহা মাথা ঘুরিয়ে চারপাশে তাকালো, চারপাশে শুষ্ক বিবর্ণ পাথর, কোথাও কিছু নেই। য়ুহা জোর করে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দেয়। মহাকাশের এই বিশেষ পোশাকে অভ্যস্ত হতে সময় নেবে, য়ুহা সাবধানে আর কয়েক পা অগ্রসর হয়। হাঁটা বলতে যা বোঝায় এটা মোটেও সে রকম নয়—গ্রহটার মাধ্যাকর্ষণ এত কম যে পায়ের ধাক্কাতেই অনেকটুকু উপরে উঠে যায়, মনে হয় সে বুঝি হেঁটে যাচ্ছে না, লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছে। শরীরের ভরকেন্দ্রটিও ঠিক জায়গায় নেই, পেছনে নানা ধরনের বোঝা, তাই একটু সামনে ঝুঁকে হাঁটতে হচ্ছে। এই পোশাকের সাথে একটা জেট প্যাক লাগানো আছে, সুইচ টিপেই সে উপরে উঠে যেতে পারবে, সামনে-পেছনে যেতে পারবে। য়ুহা এই মুহূর্তে সেটা অবশ্যি পরীক্ষা করে দেখার সাহস পেল না। এই পোশাকের সাথে একটা অস্ত্র ও থাকার কথা। অস্ত্রটা কোথায় আছে কীভাবে ব্যবহার করতে হয়, সেটাও সে বুঝতে পারছে না। মনে মনে আশা করে আছে তাকে কখনোই অস্ত্রটা হাতে তুলে নিতে হবে না। পৃথিবীতে একটা জিনিসকেই সে অপছন্দ করে, সেটা হচ্ছে অস্ত্র।

যুহ অন্যমনস্কভাবে আরো একটু সামনে এগিয়ে যেতেই রায়ীনার একটা সতর্কবাণী শুনতে পেল, য়ুহা, তুমি আর সামনে যেয়ো না।

কেন?

কোনো কারণ নেই। স্বাভাবিক নিরাপত্তার নিয়ম হচ্ছে অচেনা জায়গায় বেশি দূর না যাওয়া।

য়ুহা বলল, ঠিক আছে। আমি ফিরে আসছি।

য়ুহা ঘুরে যাওয়ার চেষ্টা করে আবিষ্কার করল মহাকাশ অভিযানের এই বেঢপ পোশাক পরে খুব সহজ কাজগুলোও মোটেও সহজে করা যায় না। কোনোভাবে তাল সামলানোর চেষ্টা করে নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হঠাৎ করে তার মনে হলো কিছু একটা যেন সরে গেছে। য়ুহা থমকে দাঁড়িয়ে মাথা ঘুরে তাকালো, সাথে সাথে সে রায়ীনার গলার স্বর শুনতে পায়, কী হয়েছে?

না কিছু না। তবে—

তবে কী?

আমার মনের ভুলও হতে পারে, কিন্তু আমার মনে হলো কী একটা যেন সরে গেছে।

রায়ীনা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তুমি বাইরে আর অপেক্ষা করে স্কাউটশিপে চলে এসো। রায়ীনা যদিও গলার স্বরটি শান্ত রাখার চেষ্টা করেছে তার পরেও সেখানে উদ্বেগটুকু লুকিয়ে রাখতে পারল না।

আসছি। য়ুহা একটু এগিয়ে যেতেই দেখল অন্ধকার গ্রহের পাথরের আড়াল থেকে কিছু একটা দ্রুত সরে যাচ্ছে। সে আতঙ্কিতভাবে অন্যপাশে তাকালো, তার স্পষ্ট মনে হয় চারদিক থেকে কিছু একটা তাকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করছে।

রায়ীনা।

কী হয়েছে?

আমার চারদিকে কিছু একটা এসেছে। মনে হয় কিছু একটা করার চেষ্টা করছে।

তুমি তোমার মাথা ঠান্ডা রাখ য়ুহা। দৌড়ানোর চেষ্টা করবে না। ঠিক যেভাবে আসছিলে সেভাবে আসতে থাক। কোনো রকম বিপদ হলে আমি আছি।

ঠিক আছে।

য়ুহা স্কাউটশিপটার দিকে এগুতে থাকে এবং হঠাৎ করে তার হেডফোনে কর্কশ একটা ধাতব শব্দ শুনতে পায়। অর্থহীন একটা শব্দ কিন্তু শব্দ সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। য়ুহার হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে ওঠে। মহাকাশের বেঢপ পোশাকের ভেতর সে কুলকুল করে ঘামতে থাকে। য়ুহা আরো দুই পা এগিয়ে গেল এবং হঠাৎ করে মনে হলো কোনো একটা প্রাণী খুব কাছে দিয়ে ছুটে গেছে, আবছা অন্ধকারে তার শরীরের খুঁটিনাটি কিছু দেখা গেল না। শুধু তার অস্তিত্বটা অনুভব করা গেল।

ভয় পেয়ো না য়ুহা। তুমি এগিয়ে আসতে থাকো-রায়ীনা তাকে সাহস দেয়ার চেষ্টা করল, তোমার কিছু হলে আমি আছি।

ঠিক আছে রায়ীনা।

য়ুহা আরো দুই পা এগিয়ে গেল, বড় কিছু পাথরের আড়ালে এখন স্কাউটশিপটা আবছাভাবে দেখা যাচ্ছে। আর একটু এগিয়ে গেলেই সেখানে পৌঁছে যাবে। নিজের অজান্তেই য়ুহার পদক্ষেপ হঠাৎ দ্রুততর হয়ে ওঠে।

ঠিক এ রকম সময় বড় একটা পাথরের আড়াল থেকে একটা প্রাণী তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল, তার ধাক্কায় সে ছিটকে পড়ে যায়। সাথে সাথে নানা আকারের আরো কিছু প্রাণী তার উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে হুঁটোপুটি খেতে থাকে। য়ুহা আতঙ্কে চিৎকার করে উঠে হাত দিয়ে প্রাণীগুলো নিজের ওপর থেকে সরানোর চেষ্টা করল কিন্তু পারল না, প্রাণীগুলো তাকে জাপটে ধরে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ায় চেষ্টা করতে থাকে। য়ুহা হাত দিয়ে প্রাণীগুলোকে আঘাত করার চেষ্টা করল, নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করল কিন্তু কোনো লাভ হলো না।

হেডফোনে রায়ীনার গলার স্বর শুনতে পেল য়ুহা, আসছি। আমি আসছি!

য়ুহাকে যখন টেনেহিঁচড়ে বেশ কিছুদূর নিয়ে এসেছে তখন রায়ীনা দৌড়ে তার কাছে পৌঁছালো। হাতের অস্ত্রটি দিয়ে অনির্দিষ্টভাবে গুলি করতে করতে সে ছুটে এসেছে। পেছন থেকে একটা প্রাণীকে টেনে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে, অস্ত্রটা দিয়ে সেটাকে আঘাত করে, তার পরেও সরাতে না পেরে সে আবার গুলি করল।

গুলির আঘাতে প্রাণীটা ছিটকে পড়ে গেল, কর্কশ এক ধরনের শব্দ করতে করতে সেটি উঠে দাঁড়ায়, তারপর উবু হয়ে উঠে সেটি হামাগুড়ি দিয়ে পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। রায়ীনা য়ুহাকে টেনে নিয়ে যাওয়া বিচিত্র প্রাণীগুলোর দিকে অস্ত্রটা তাক করে গুলি করল এবং তখন হঠাৎ প্রাণীগুলো য়ুহাকে ছেড়ে দিয়ে ছুটে পালিয়ে যেতে শুরু করল।

প্রাণীগুলো পালিয়ে যাবার পর য়ুহা উঠে দাঁড়িয়ে কাঁপা গলায় বলল, তোমাকে ধন্যবাদ রায়ীনা। তুমি না এলে সর্বনাশ হয়ে যেত।

তুমি ঠিক আছ তো?

হ্যাঁ। ঠিক আছি।

তাহলে চল, স্কাউটশিপে।

এক সেকেন্ড দাঁড়াও- য়ুহা হঠাৎ নিচু হয়ে কিছু একটা দেখার চেষ্টা করল, ভয় পাওয়া গলায় বলল, এই দেখো কী পড়ে আছে।

রায়ীনা এগিয়ে যায়, কী পড়ে আছে?

একটা হাত। তোমার গুলিতে প্রাণীটার শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে।

রায়ীনা নিচু হয়ে হাতটা তুলে নেয়, সেটা তখনো নড়ছে, কিন্তু সেটা বড় কথা নয়। বড় কথা হাতটা মানুষের হাত।

স্কাউটশিপের ভেতরে ছোট টেবিলটার ওপর মানুষের একটা হাত, সেটি শুকিয়ে অস্থিচর্মসার হয়ে আছে, কিন্তু তারপরেও বুঝতে এতটুকু সমস্যা হয় না যে হাতটি মানুষের। রায়ীনার গুলিতে হাতটি শরীর থেকে আলাদা হয়ে গেছে কিন্তু যে ব্যাপারটা তারা বুঝতে পারছে না সেটি হচ্ছে যে হাতটি এখনো জীবন্তু। তার আঙুলগুলো নড়ছে এবং মাঝে মাঝেই সেটা উল্টে যাওয়ার চেষ্টা করে। যতবার এটা উপুড় হয়েছে ততবার সেটা তার আঙুলগুলো দিয়ে খামচে খামচে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। শুধু তাই নয়, ধরে ফেলার মতো কোনো কিছু পেলে হাতটা সেটা শক্ত করে ধরে ফেলে এবং তখন সেটাকে ছুটিয়ে নিতে যথেষ্ট কষ্ট হয়। য়ুহা এক ধরনের আতঙ্ক নিয়ে এই কাটা হাতটির দিকে তাকিয়ে থাকে, আঙুল দিয়ে খামচে খামচে সেটা টেবিলের কিনারা পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছিল, য়ুহা হাত দিয়ে ঠেলে সেটাকে টেবিলের মাঝামাঝি এনে বলল, আমি কিছুতেই বুঝতে পারছি না একটা হাত কেমন করে জীবন্ত থাকে।

রায়ীনা কোনো একটা ভাবনায় ড়ুবে ছিল, এবারে য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, একটা হাত আলাদাভাবে জীবন্ত থাকে না।

এই যে থাকছে। নাড়াচাড়া করছে।

রায়ীনা হাসার চেষ্টা করে বলল, নাড়াচাড়া করে মানে জীবন্ত থাকা নয়! অনেক রকেট, মহাকাশযান, বাইভার্বাল নাড়াচাড়া করে, তার মানে এই নয় যে সেগুলো জীবন্ত।

তুমি বলছ এটা জীবন্ত না?

আমার তা-ই ধারণা।

তাহলে এটা কেমন করে নড়ছে?

এটাকে নাড়ানো হচ্ছে।

কে নাড়াচ্ছে? কীভাবে নাড়াচ্ছে?

রায়ীনা মুখে হাসি টেনে বলল, এতক্ষণ পর তুমি একটা সত্যিকারের প্রশ্ন করেছ। কে নাড়াচ্ছে এবং কীভাবে নাড়াচ্ছে। আমাদের সেটা খুঁজে বের করতে হবে।

তার মানে তুমি বলতে চাইছ–

রায়ীনা মাথা নাড়ল, আমি আসলে এখনো কিছুই বলতে চাইছি না। তবে তুমি যদি খুব বিরক্ত না হও তাহালে খানিকক্ষণ জোরে জোরে চিন্তা করতে পারি।

করো। জোরে জোরে চিন্তা করো, তোমার চিন্তাটা শুনি।

তোমাকে যখন প্রাণীগুলো আক্রমণ করল তখন সেখানে আবছা অন্ধকারে পরিষ্কার করে কিছু দেখা যাচ্ছিল না, তার পরেও মনে হচ্ছিল প্রাণীগুলোর হাত-পা আছে, শরীর আছে, মাথা আছে। মাথায় নাক মুখ চোখ আছে কী না আমরা এখনো জানি না। অন্ধকারের মাঝে গুলি করে শরীরের একটা অংশ আমরা আলাদা করে ফেলেছি—সেটা হচ্ছে একটা হাত। কাজেই মোটামুটি নিশ্চিত যে প্রাণীগুলো আসলে মানুষের আকৃতির।।

তার মানে তুমি বলছ এখানে মহাজাগতিক প্রাণী নেই, আছে মানুষ–

রায়ীনা বলল, আমি যখন তোমার সাথে কথা বলব তখন তুমি আমাকে প্রশ্ন করতে পারবে। এখন আমি চিন্তা করছি। চিন্তার ভেতরে কেউ প্রশ্ন করতে পারে না!

ঠিক আছে, তুমি চিন্তা কর। আমি আর প্রশ্ন করব না।

হাতটা যেহেতু মানুষের, তার মানে শরীটাও মানুষের। কিন্তু আমরা জানি মানুষের শরীর অত্যন্ত কোমল একটা জিনিস। একটা নির্দিষ্ট তাপমাত্রা, নির্দিষ্ট চাপ এবং সুনির্দিষ্ট পরিবেশ না থাকলে সেটা বেঁচে থাকতে পারে না। তাকে কিছুক্ষণ পরপর খেতে হয়। তাকে প্রতি মুহূর্তে ফুসফুসে নির্দিষ্ট পরিমাণ অক্সিজেন নিতে হয়, সেটা রক্তের মাধ্যমে শরীরে ছড়িয়ে দিতে হয়—এ রকম নানা ধরনের ঝামেলা আছে।

রায়ীনা এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমরা জানি এই গ্রহটির তাপমাত্রা শূন্যের কাছাকাছি, বায়ুমণ্ডল বলতে গেলে নেই এবং যেটুকু আছে সেখানে অক্সিজেনের কোনো চিহ্ন নেই। আমাদের দুজনকে দেখলেই সেটা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই গ্রহটিতে বেঁচে থাকার জন্যে আমাদের কী বেটপ একটা পোশাক পরে থাকতে হচ্ছে কিন্তু এই মানুষগুলোর কোনো পোশাক নেই—বাতাসবিহীন, অক্সিজেনবিহীন শীতল একটা গ্রহে তারা ঘুরে বেড়াচ্ছে তাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না। সেটা হতে পারে শুধু একটি উপায়ে–

কী উপায়ে? জিজ্ঞেস করতে গিয়ে য়ুহা থেমে গেল, রায়ীনার চিন্তার প্রক্রিয়াটাতে সে বাধা দিতে চায় না।

রায়ীনা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, সেটা হতে পারে যদি আসলে মানুষগুলো হয় মৃত!

মৃত? মাঝখানে কথা বলার কথা নয় জেনেও য়ুহা নিজেকে সামলাতে পারল না।

হ্যাঁ। মৃত। কিন্তু মৃত মানুষ হাঁটে না, চলাফেরা করে না, কাউকে আক্রমণ করে তাকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাবার চেষ্টা করে না। কাজেই অনুমান করছি এই মৃত মানুষগুলোকে অন্য কেউ চালাচ্ছে। তার স্পষ্ট প্রমাণ হচ্ছে এই কাটা হাতটা। দেখা যাচ্ছে এটা এখনো নিজে নিজে চলছে।

আমি অনুমান করছি এটাকে নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ দিয়ে এবং আমার অনুমান সত্যি কী না সেটা খুব সহজেই পরীক্ষা করে দেখা যায়। যদি এই হাতটা বৈদ্যুতিক পরিরাহী কিছু দিয়ে আমরা ঢেকে দিই তাহলে এর মাঝে বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ পৌঁছাতে পারবে না। তখন নাড়াচাড়াও করতে পারবে না।

রায়ীনা স্কাউটশিপের জানালার দিকে তাকিয়ে বলল, এই জানালায় পাতলা মাইলারের ওপর বৈদ্যুতিক পরিরাহী স্বর্ণের একটা সূক্ষ্মা স্তর আছে। আমার অনুমান সত্যি হলে আমরা এটা দিয়ে হাতটা যদি মুড়ে দিই তাহলে হাতটা নাড়াচাড়া করা বন্ধ করে দেবে।

য়ুহা চোখ বড় বড় করে বলল, তোমার জোরে জোরে চিন্তা করা শেষ?

হ্যাঁ।

তাহলে আমরা এই মাইলার আর স্বর্ণের আবরণ দিয়ে হাতটাকে মুড়ে দেব?

হ্যাঁ। এলুমিনিয়ামের ফয়েল দিয়েও করা যেত কিন্তু এই স্কাউটশিপে সেটা খুঁজে পাব বলে মনে হয় না।

য়ুহা জানালা থেকে মাইলারের পর্দাটুকু খুলে আনে, সেটা দিয়ে হাতটাকে মুড়ে দিতেই হঠাৎ করে কাটা হাতটা স্থির হয়ে গেল। য়ুহা চোখ বড় বড় করে বলল, তোমার অনুমান সত্যি, রায়ীনা! তোমাকে যতই দেখছি ততই মুগ্ধ হচ্ছি।

রায়ীনা নিচু গলায় বলল, বোঝা যাচ্ছে তুমি মুগ্ধ হবার জন্যে প্রস্তুত হয়ে থাক! তোমাকে মুগ্ধ করা খুব কঠিন নয়। যাই হোক, আমাদের পরীক্ষাটা সম্পূর্ণ করার জন্যে কাটা হাতটার ওপর থেকে স্বর্ণের আবরণ দেয়া মাইলারের পর্দাটা আবার খুলে ফেলতে হবে, তাহলে কাটা হাতটা আবার নাড়াচাড়া করতে শুরু করবে।

য়ুহা বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। দেখি তো। সে বেশ উৎসাহ নিয়ে মাইলারের পর্দাটা খুলে ফেলল এবং প্রায় সাথে সাথেই হাতটা নড়তে শুরু করে। য়ুহা মাথা নাড়ল, বলল, রায়ীনা তুমি সত্যিই অসাধারণ! এখন পর্যন্ত তোমার প্রত্যেকটা কথা সত্যি বের হয়েছে।

কথাগুলো সহজ ছিল সে জন্যে!

এবারে তুমি বল এই মহাকাশের প্রাণীটা সম্পর্কে। যে প্রাণীটা এই মৃত মানুষগুলোকে নাড়াচাড়া করাচ্ছে সেটা কী রকম? তাদের কী অক্টোপাসের মতো শুড় আছে? অনেকগুলো চোখ? মাকড়সার মতো অনেকগুলো পা? কী খায়?

রায়ীনা মাথা নাড়ল, বলল, উঁহু। আমার কী মনে হয় জানো?

কী?

আসলে এখানে কোনো মহাকাশের প্রাণী নেই!

য়ুহা চোখ কপালে তুলে বলল, মহাকাশের প্রাণী নেই?

না। এখানে হয়তো মানুষের একটা বসতি ছিল, কিংবা কোনো একটা মহাকাশযান বিধ্বস্ত হয়ে মহাকাশচারীরা এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। তাদের সাথে ছিল কোনো ধরনের কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক, সেই কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক ধীরে ধীরে সবকিছু দখল করে নিয়েছে। সেটা ধীরে ধীরে আরো ক্ষমতাশীল হয়েছে, মানুষগুলো যখন মারা গেছে তখন তাদের মৃতদেহ ব্যবহার করতে শুরু করেছে।

য়ুহা অবাক হয়ে বলল, তুমি সত্যিই তা-ই মনে করো?

হ্যাঁ। আমার তা-ই ধারণা।

কেন? তোমার এ রকম ধারণা কেন হলো?

দেখছ না এই প্রাণীগুলোর প্রযুক্তি ঠিক আমাদের মতন। যদি একেবারে ভিন্ন ধরনের বুদ্ধিমান প্রাণী হতো তাহলে তাদের প্রযুক্তি হতো একেবারে অন্য রকম। হয়তো বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ দিয়ে যোগাযোগ না করে যোগাযোগ করত নিউট্রিনো বীম দিয়ে। হয়তো মানুষের দেহ ব্যবহার করে অন্য কিছু ব্যবহার করত।

য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, তোমার কথায় এক ধরনের যুক্তি আছে।

রায়ীনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, শুধু যুক্তি থাকলেই হয় না। আমি দেখেছি জীবনে যে সব ব্যাপার ঘটে তার বেশির ভাগেরই কোনো যুক্তি নেই!

এ রকম কেন বলছ?

আমার দিকে দেখ? আমার কি একটা গেরিলা বাহিনীতে যোগ দিয়ে যুদ্ধ করে এখন এই গ্রহে আটকা পড়ার কথা ছিল? আমার জন্ম হয়েছিল একটা শান্তশিষ্ট মেয়ে হিসেবে। আমি বড় হয়েছি জ্ঞান-বিজ্ঞানের পরিবেশে, শিল্প-সাহিত্য নিয়ে। অথচ এখন আমার বন্ধু মহাজগতের বড় বড় গেরিলারা। আমি যুদ্ধ করতে পারি, আমার প্রাণের বন্ধু মারা গেলেও আমি চোখ থেকে এক ফোটা পানি ফেলি না। আমার বুকের ভেতরটা এখন পাথরের মতো কঠিন।

য়ুহা আস্তে আস্তে বলল, আসলে মানব জাতির পুরো ইতিহাসটাই হচ্ছে এ রকম। মানুষের একটা গোষ্ঠী সবকিছু নিয়ে নিচ্ছে। অন্য গোষ্ঠী তার প্রতিবাদ করছে। সেটা নিয়ে বিরোধ। সংঘর্ষ। যুদ্ধ। যে জিনিসটি খুব সহজে মেনে নেয়া যায় সেটি কেউ মানছে না–একজনের সাথে আরেকজন শুধু শুধু যুদ্ধ করছে।

রায়ীনা বিষণ্ণ গলায় বলল, মাঝে মাঝে আমি এক ধরনের ক্লান্তি অনুভব করি। মনে হয় অস্ত্রটা ভাঁজ করে রেখে একটা ল্যাবরেটরিতে খানিকটা সময় কাটাই।

য়ুহা নরম গলায় বলল, নিশ্চয়ই তুমি একসময় তোমার অস্ত্রটা ভজ করে রেখে ল্যাবরেটরিতে ঢুকবে। নিশ্চয়ই ঢুকবে।

রায়ীনা কোনো কথা না বলে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাদের ছত্রিশ ঘণ্টার কত ঘণ্টা পার হয়েছে য়ুহা।

বেশি না, খুব বেশি হলে মাত্র বারো ঘণ্টা।

রায়ীনা স্কাউটশিপের জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো, উপরে কুচকুচে কালো আকাশ, সেই আকাশে এই মুহূর্তে একটি মহাকাশযান এই গ্রহটাকে ঘিরে ঘুরছে। তার দলের মানুষেরা এই মুহূর্তে হয়তো সেই মহাকাশযানটা দখল করার চেষ্টা করছে। তারা কি পারবে দখল করতে? তারপর তারা কি আসবে তাদের এই ভয়ঙ্কর গ্রহ থেকে উদ্ধার করতে? যদি কেউ না আসে?

রায়ীনা জোর করে চিন্তাটা মাথা থেকে সরিয়ে দিল।

চুপচাপ বসে থাকতে থাকতে য়ুহার চোখে একটু তন্দ্রার মতো এসেছিল, ঠিক এ রকম সময় একটা বিস্ফোরণের মতো শব্দ হলো এবং তার সাথে সাথে স্কাউটশিপটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে কেঁপে ওঠে। য়ুহা চমকে উঠে বলল, ওটা কীসের শব্দ?

রায়ীনা জানালার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল, গুলির শব্দ।

গুলির শব্দ?

হ্যাঁ। মনে হয় ওরা এখন অস্ত্র নিয়ে এসেছে!

সর্বনাশ!

য়ুহার কথা শেষ হবার আগেই আবার বিস্ফোরণের শব্দ হলো এবং স্কাউটশিপটা ভয়ানকভাবে দুলে উঠল।

রায়ীনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এ জন্যে আমি এদের সাথে গোলাগুলি করতে চাইনি! আমরা গুলি করেছি তাই আমরা এখন তাদের শত্রু হয়ে গিয়েছি।

আবার একটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো, এবারে স্কাউটশিপের ভেতরে কিছু ঝনঝন করে ভেঙে পড়ে। এক কোনা থেকে কুণ্ডলী পাকিয়ে কালো ধোঁয়া উঠতে থাকে। য়ুহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, সর্বনাশ! আমরা এখন কী করব?

সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হতো যদি আমরা কিছু না করতাম।

কিন্তু তাহলে আমাদের মেরে ফেলবে না?

মেরে ফেলার কথা না। আমি যদি আরেকটি বুদ্ধিমান প্রাণী পেতাম তাহলে কখনোই রাগ হয়ে তাকে মেরে ফেলতাম না। আমি মৃত অবস্থায় যেটুকু গুরুত্বপূর্ণ বেঁচে থাকা অবস্থায় তার থেকে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ

রায়ীনার কথার মাঝখানে ঠিক মাথার ওপর একটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো এবং সেখান থেকে কিছু যন্ত্রপাতি ভেঙেচুরে নিচে এসে পড়ল। য়ুহা শুকনো গলায় বলল, রায়ীনা, কিছু একটা কর।

রায়ীনা স্কাউটশিপের নিচে গুড়ি মেরে বসে বলল, আমি একটা জিনিস ভাবছি।

য়ুহা একটু অস্থির হয়ে বলল, ভাবাভাবির অনেক সময় পাবে। এখন কিছু একটা কারো। গুলি শুরু কর! মৃত মানুষকে তো আর দ্বিতীয়বার মারা যায় না। তোমার ভয়টা কীসের?

গুলি করা থেকে ভালো কিছু করা যায় কী না ভাবছি।

সেটা কী?

গুলি করা মানেই শত্রু হিসেবে দাঁড় করিয়ে দেয়। তা ছাড়া গুলি করা মানে ধ্বংস করা

কাছাকাছি আরেকটা বিস্ফোরণের শব্দ হলো এবং স্কাউটশিপের একটা বড় অংশ হুঁড়মুড় করে ভেঙে পড়ল। য়ুহা ক্রুদ্ধ গলায় বলল, তারা আমাদের ধ্বংস করলে কোনো দোষ নেই, আমরা করলেই দোষ?

যুক্তিতর্কের সময় এটা না— রায়ীনা নিচু গলায় বলল, আমাদের খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা করতে হবে।

কী করবে?

যেহেতু আমরা দেখছি বিদ্যুৎ-চৌম্বকীয় তরঙ্গ দিয়ে এরা যোগাযোগ করছে, তাই আমরা ইচ্ছে করলে তাদের সমস্ত সিগন্যাল জ্যাম করে দিয়ে তাদেরকে অচল করে রাখতে পারি।

সেটা কেমন করে করবে?

রায়ীনা হাত দিয়ে স্কাউটশিপের যোগাযোগ মডিউলটা দেখিয়ে বলল, এই যোগাযোগ মডিউলটা দেখেছো?

হ্যাঁ, দেখেছি।

এটা থেকে খুব শক্তিশালী সিগন্যাল বের হয়। মহাকাশযান থেকে মহাকাশযানে এই সিগন্যাল পাঠানো হয়। আমরা তাদের ফ্রিকোয়েন্সিতে আমাদের সিগন্যাল পাঠাব, সবকিছু জ্যাম হয়ে যাবে!

য়ুহা ভুরু কুঁচকে বলল, তুমি পারবে?

গুলি করে যোগাযোগ মডিউলটাই যদি উড়িয়ে না দেয় তাহলে পারার কথা?

তাহলে দেরি করো না। শুরু করে দাও।

একটু সময় দাও-ওটা খুলে আনি।

য়ুহা অধৈৰ্য্য গলায় বলল, কেন? খুলে আনতে হবে কেন?

আমার মাথায় অন্য একটা বুদ্ধি এসেছে!

কিন্তু তোমার বুদ্ধি কাজে লাগানোর আগেই আমরা মরে ভূত হয়ে যাব।

না। এত সহজে আমরা মরে ভূত হয়ে যাব না! এই প্রাণীগুলো আমাদের দিকে গুলি করতে পারে কিন্তু আমাদের মারবে না।

রায়ীনা গুড়ি মেরে স্কাউটশিপের কন্ট্রোল প্যানেলের কাছে গিয়ে টেনেহিঁচড়ে যোগাযোগ মডিউলটা খুলে আনে। আবার গুড়ি মেরে য়ুহার কাছে এসে যোগাযোগ মডিউলের কন্ট্রোল বোতামটি চেপে ধরে বলল, আগে দেখে নিই কোন ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করছে।

রায়ীনা সঠিক ফ্রিকোয়েন্সি বের করে সেখানে তীব্র কিন্তু অর্থহীন সিগন্যাল পাঠাতেই হঠাৎ করে বাইরের গোলাগুলি বন্ধ হয়ে গেল। য়ুহা সাবধানে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখল স্কাউটশিপ ঘিরে ইতস্তত কিছু প্রাণী নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলো হঠাৎ করে আবার নড়ে উঠবে না ব্যাপারটা নিশ্চিত হবার পর য়ুহা আবার রায়ীনার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি আসলেই অসাধারণ রায়ীনা!

এর মাঝে অসাধারণের কিছু নেই। রায়ীনা একটু হেসে বলল, আমি যেটা করেছি সেটা হচ্ছে একেবারে প্রাগৈতিহাসিক একটা ব্যাপার। এই প্রাগৈতিহাসিক উপায়ে আমি যে এটা করতে পেরেছি সেটাই হচ্ছে রহস্য!

য়ুহা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বলল, আমরা এখন কী করব?

স্কাউটশিপের ভেতরে থাকাটা বিপজ্জনক হয়ে যাচ্ছে! যে কোনো মুহূর্তে নতুন একটা ফ্রিকোয়েন্সিতে সিগন্যাল আসতে পারে। ফ্রিকোয়েন্সিটা এমনভাবে অদলবদল করতে পারে যে আমরা হয়তো আর তাল রাখতে পারব না। এই প্রাণী বল, মানুষ বল, মৃতদেহ বল–তারা নতুন করে আক্রমণ শুরু করতে পারে। বসে বসে গুলি খাওয়ার কোনো অর্থ নেই আমাদের বের হয়ে যাওয়াটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

ঠিকই বলেছ।

সাথে যোগাযোগ মডিউলটা রাখি—আবার কাজে দেবে।

একেবারে ম্যাজিকের মতো কাজে দেবে।

রায়ীনা বলল, প্রয়োজন না হলে আমি এই প্রাণীগুলোর শত্রু হতে চাই। আমি শত্রু হয়ে দেখেছি। খুব কষ্ট।

য়ুহা কোনো কথা না বলে রায়ীনার মুখের দিকে তাকালো। কমবয়সী একটা মেয়ে কিন্তু এর ভেতরেই তার জীবনে কত কিছু ঘটে গেছে।

স্কাউটশিপকে ঘিরে থাকা প্রাণীগুলোকে দেখে য়ুহা এবং রায়ীনা হতবাক হয়ে গেল–এগুলো মানুষেরই দেহ কিন্তু কোনোটাই পূর্ণাঙ্গ নয়। কারো হাত নেই, কারো পা নেই–কারো বুকের ভেতর বিশাল একটা গর্ত। দুটি মানুষের মাথারই অস্তিত্ব নেই। শুধু ধড়টি দাঁড়িয়ে আছে। কয়েকজনের মুখমণ্ডলের খানিকটা অংশ উড়ে গেছে, চোখের জায়গায় খালি কুটুরী। দেখে মনে হয় এই মূর্তিগুলোকে বুঝি সরাসরি নরক থেকে তুলে আনা হয়েছে।

য়ুহা বুকের ভেতর আটকে থাকা একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, রায়ীনা, এখান থেকে চল। এই মূর্তিগুলো যদি হঠাৎ করে জীবন্ত হয়ে যায় তাহলে সেই দৃশ্যটা আমি সহ্য করতে পারব না।

রায়ীনা মাথা নাড়ল, ঠিকই বলেছ, আমিও পারব না।

সরাসরি নরক থেকে উঠে আসা কিছু দেহাবশেষকে স্থির অবস্থায় রেখে য়ুহা আর রাহীন সামনের দিকে এগিয়ে যায়।

য়ুহা জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কোথায়?

মনে আছে এই গ্রহ থেকে নির্দিষ্ট সময় পরপর একটা সিগন্যাল বের হচ্ছে?

হ্যাঁ, তুমি বলেছিলে।

আমরা গিয়ে দেখতে পারি সেটা কী রকম। কেন বের হচ্ছে, কীভাবে বের হচ্ছে।

কোনো বিপদ হবে না তো?

বিপদ তো হতেই পারে–রায়ীনা হাসার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু বিপদ দেখে তুমি পিছিয়ে আস সে রকম কোনো প্রমাণ তো আমি পাইনি!

য়ুহা শব্দ করে হেসে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ! আমার নিজেরই বিশ্বাস হচ্ছে না—কিছুদিন আগেও আমি কখনো চিন্তা করিনি শব্দের পেছনে শব্দ বসিয়ে কবিতা লেখা ছাড়া আমি আর কিছু করতে পারি। কিন্তু দেখো আমি কত কী করেছি।

রায়ীনা নরম গলায় বলল, তুমি আর কী কী করেছ আমি জানি —কিন্তু তুমি আমাকে একটা নতুন জীবন দিয়েছ। যদি সবকিছু ঠিক করে শেষ হয় আর আমি সত্যি সত্যি নিজের জীবনে ফিরে যেতে পারি সেটা হবে তোমার জন্যে। শুধুমাত্র তোমার জন্যে।

আমি এমন কিছুই করিনি।

আর আমরা যদি এই গ্রহ থেকে বের হতে না পারি, এখানে মারা পড়ি, এই গ্রহের কোনো একটা ভয়ঙ্কর প্রাণী আমাদের মৃতদেহটাকে ব্যবহার করে উৎকট নাটক করে তাহলে—

তাহলে কী?

তাহলে তুমি কিছু মনে করো না। তোমার সাথে আমি খুব কম সময় কাটিয়েছি, কিন্তু সময়টা ছিল চমৎকার!

তোমাকে ধন্যবাদ রায়ীনা।

মহাকাশের পোশাকের ভেতর থেকে একজন আরেকজনকে স্পর্শ করতে পারবে না জেনেও, য়ুহা হাত দিয়ে রায়ীনার কাধ স্পর্শ করল।

 

গ্রহটার পাথরের ভেতর দিয়ে দুজনে নিঃশব্দে হাঁটতে থাকে। ছোট-বড় পাথর ছড়িয়ে আছে, উঁচু-নিচু পথ। পাথর থেকে এক ধরনের ঘোলাটে আলো বের হচ্ছে, কোথাও নিষ্প্রভ, কোথাও বেশ আলো। মাঝে মাঝে বিশাল খাদ, তার গভীরে কী আছে বাইরে থেকে বোঝা যায় না, জেট প্যাক ব্যবহার করে তারা সেই জায়গাগুলো উড়ে পার হয়ে যায়। জেট প্যাকের জ্বালানি খুব সীমিত, তাই সেগুলো তারা বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছে, খুব বেশি প্রয়োজন না হলে তারা জেট প্যাক ব্যবহার করছে না। সত্যিকারের বড় কোনো বিপদে হয়তো এই জেট প্যাক ব্যবহার করেই তারা নিজেদের রক্ষা করার চেষ্টা করবে। য়ুহা আগে কখনো জেট প্যাক ব্যবহার করেনি, রায়ীনা তাই তাকে ছোটখাটো নিয়মগুলো শিখিয়ে দিচ্ছে। অজানা অন্ধকার একটা কুৎসিত গ্রহে নিজের জীবন হাতে নিয়ে যদি এই জেট প্যাক ব্যবহার করতে না হতো তাহলে য়ুহা এই পুরো প্রক্রিয়াটা রীতিমতো উপভোগ করতে পারত।

হেঁটে হেঁটে তারা যখন ক্লান্তির একেবারে শেষ সীমায় পৌঁছেছে তখন তারা দূরে একটা বিধ্বস্ত মহাকাশযান দেখতে পেল। মহাকাশযানের আকারটি দেখেই রায়ীনা বুঝতে পারে এটি ক্যাটাগরি তিন মহাকাশযান। আন্তঃগ্যালাক্টিক অভিযানে এগুলো ব্যবহার করা হয়, এই মহাকাশযানটি প্রায় একটা শহরের মতো এখানে কয়েকশ মহাকাশচারী থাকে। এই বীভৎস গ্রহে বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে থাকা এই মহাকাশযানটি দেখে মনে হয় এটি বুঝি কোনো একটি পরাবাস্তব জগতের দৃশ্য।

মহাকাশযানের কাছাকাছি এসে য়ুহা আর রায়ীনা বড় বড় কয়টা পাথরের আড়ালে নিজেদের আড়াল করে লুকিয়ে রইল। ভেতরে কী আছে তারা জানে না, হঠাৎ করে ভেতরে ঢুকে তারা বিপদে পড়তে চায় না, বাইরে থেকে আগে ব্যাপারটা ভালো করে বুঝতে চায়। বেশ অনেকক্ষণ নিঃশব্দে বসে থেকেও তারা মহাকাশযানের ভেতর যখন কোনো কিছু ঘটতে দেখল না, তখন তারা মহাকাশযানের ফাটল দিয়ে খুব সাবধানে ভেতরে ঢুকে গেল।

ভেতরে বেশ অন্ধকার, হেলমেটের নিয়ন্ত্রণ বোতাম স্পর্শ করে চশমার কার্যকারিতা দশ ডিবি বাড়িয়ে নেয়ার পর মহাকাশযানের ভেতরটুকু স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ভেতরের দৃশ্য দেখে তারা দুজনেই একেবারে হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে। বাইরে থেকে যে রকম অনুমান করেছিল–মহাকাশযানটি ঠিক সে রকম বিধ্বস্ত। যন্ত্রপাতি ভেঙে পড়ে আছে, দেয়ালে বড় বড় ফাটল, প্রচণ্ড উত্তাপে নানা অংশ গলে পুড়ে কদাকার হয়ে আছে—কিন্তু তাদের সেই দৃশ্যগুলো বিচলিত করেনি। তাদেরকে বিচলিত করেছে মহাকাশচারীদের মৃতদেহগুলো। মহাকাশযানের এখানে-সেখানে সেগুলো বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। সবগুলো যে নিচে পড়ে আছে তা নয়, কোনো কোনোটা উবু হয়ে বসে আছে এমন কী কোনো কোনোটা বিচিত্র ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে আছে।

য়ুহা মাথা নেড়ে বলল, এটা আমার পছন্দ হচ্ছে না। একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না।

রায়ীনা জানতে চাইল, কোনটা তোমার একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না?

এই যে মৃতদেহগুলো দাঁড়িয়ে আছে, বসে আছে। এগুলো আমার একেবারেই পছন্দ হচ্ছে না। প্রথমত মৃতদেহ কেন আমাদের চোখের সামনে থাকবে? আর থাকতেই যদি হয় তাহলে কেন দাঁড়িয়ে থাকবে?

রায়ীনা বলল, আমার কী মনে হয় জান?

কী?

এই মৃতদেহগুলো আসলে কাজকর্ম করছিল। ছোটাছুটি করছিল। হঠাৎ করে যে যেভাবে ছিল সেভাবে থেমে গেছে। সেজন্যে মনে হচ্ছে কেউ দাঁড়িয়ে আছে, কেউ বসে আছে।

য়ুহা ভুরু কুঁচকে জিজ্ঞেস করল, হঠাৎ করে থেমে গেল কেন?

জানি না। রায়ীনা মাথা নাড়ে, মনে হয় আমাদের জন্যে। আমরা মহাকাশযানের ভেতর ঢুকেছি সে জন্যে সবকিছু থামিয়ে দিয়েছে। মনে হয় বোঝার চেষ্টা করছে আমাদের মতলবটা কী!

তার মানে মহাকাশের প্রাণীগুলো আমাদের দেখছে?

নিশ্চয়ই দেখছে, আমাদের কি লুকিয়ে থাকা সম্ভব।

যদি আমাদের দেখছে তাহলে ধরার জন্যে ছুটে আসছে না কেন?

দুটি কারণ হতে পারে, এক: ছুটে আসবে, এক্ষুণি সবাই ছুটে আসবে। দুই: ছুটে আসার প্রয়োজন নেই। কারণ ছুটে গিয়ে আমাদের ধরে যেখানে আনার কথা আমরা সেখানেই বসে আছি!

সর্বনাশ! য়ুহা বলল, তুমি না বলছিলে, আসলে এখানে কোনো মহাজাগতিক প্রাণী নেই। পুরোটাই হচ্ছে কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক।

হ্যাঁ। আমার এখনো তা-ই মনে হয়। আমাদের জন্যে সেটা নিরাপদ। আমরা তাহলে আমাদের পরিচিত যন্ত্রপাতি, পরিচিত অস্ত্রপাতি, পরিচিত প্রযুক্তি দিয়েই নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পারব।

রায়ীনার কথা শেষ হওয়া মাত্রই হঠাৎ মহাকাশযানটা একটু দুলে ওঠে, সাথে সাথে অত্যন্ত বিচিত্র একটা ঘটনা ঘটল। মহাকাশযানের নানা জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা সবগুলো মৃতদেহ একসাথে নড়তে শুরু করল। দাঁড়িয়ে থাকা মৃতদেহগুলো সামনে ঝুঁকে পড়ে পা ঘষে ঘষে হাঁটতে থাকে। বসে থাকা মৃতদেহগুলো বসে থাকা অবস্থাতেই নিজেকে ঘষে ঘষে টেনে নিতে থাকে। কিছু মৃতদেহ হামাগুড়ি দিয়ে এগিয়ে যায়। অনেকগুলো বুকে ঘষে ঘষে এগুতে থাকে। তারা হাতে ছোটখাটো যন্ত্রপাতি টেনে নিতে থাকে, সেগুলো এখানে-সেখানে বসাতে থাকে, যন্ত্রগুলো টানাটানি করতে থাকে–সব মিলিয়ে অন্ধকার মহাকাশযানের ভেতরে অত্যন্ত কর্মব্যস্ততার একটা দৃশ্য ফুটে ওঠে, কিন্তু সেই দৃশ্যটি এত অবাস্তব, এত অবিশ্বাস্য যে য়ুহা এবং রায়ীনা দুজনেই হতবাক হয়ে যায়।

য়ুহা বলল, আমার দেখতে ভালো লাগছে না।

রায়ীনা বলল, আমারও ভালো লাগছে না।

চল, বাইরে গিয়ে অপেক্ষা করি।

হ্যাঁ। আমার হিসেব যদি ঠিক হয়ে থাকে তাহলে আর কিছুক্ষণের মাঝেই আমাদের উদ্ধার করতে কেউ না কেউ চলে আসবে!

যদি না আসে?

আসবে। আমার দলের লোকগুলো অসাধারণ। রায়ীনা মহাকাশযান থেকে বের হওয়ার জন্যে ঘুরে গিয়ে বলল, একটু পরে তুমি নিজেই দেখবে।

মহাকাশযানের ভেতর থেকে বের হতে গিয়ে রায়ীনা থমকে দাঁড়াল এবং তার সাথে য়ুহাও থেমে গিয়ে একটা চাপা আর্তনাদের মতো শব্দ করল। মহাকাশযানের যে বিশাল ফাটল দিয়ে তারা ঢুকেছিল, সেই ফাটল দিয়েই তারা বের হয়ে যেতে চাইছিল। কিন্তু সেদিক দিয়ে একজন-দুজন নয় অসংখ্য মৃত মানুষ বিচিত্র ভঙ্গিতে দেহটাকে টেনে টেনে এসে হাজির হচ্ছে।

য়ুহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, এরা কী চায়?

এখানে আসছে কেন? রায়ী নিচু গলায় বলল, জানি না।

মৃতদেহগুলো গাদাগাদি করে তাদের দিকে এগিয়ে হাসতে থাকে, য়ুহা তখন চিল্কার করে বলল, কী চাও তোমরা? সরে যাও সামনে থেকে।

দেহগুলো সরে যাবার কোনো লক্ষণ দেখলি না, বরং গাদাগাদি করে তারা আরও এক পা এগিয়ে এলো। মৃতদেগুলো প্রাণহীন চোখ দিয়ে তাদের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। সেই দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থেকে য়ুহার বুক কেঁপে ওঠে। সে ভয় পাওয়া গলায় অস্ত্র উঁচিয়ে বলল, সরে যাও বলছি, তা না হলে কিন্তু গুলি করে দেব।

প্রাণীগুলো সরে গেল না বরং আরো এক পা এগিয়ে এলো–এত কাছে। যে তারা ইচ্ছে করলে এখন এই য়ুহা আর রায়ীনাকে স্পর্শ করতে পারে। য়ুহা অস্ত্রটা ঝাকুনি দিয়ে বলল, গুলি করে দেব, দেব গুলি করে–

প্রাণীগুলো আরো এক পা এগিয়ে এলো–য়ুহা তখন ট্রিগার টেনে ধরে। প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মৃতদেহগুলোর হাত পা মাথা উড়ে যায়, ঠিক সেই অবস্থায় মৃতদেহগুলো আরো এক পা এগিয়ে এলো। রায়ীনা হাত দিয়ে য়ুহার হাত ধরে বলল, শুধু শুধু গুলি করে লাভ নেই। মৃত মানুষকে মারা যায় না—

কিন্তু—

কোনো কিন্তু নেই। পেছনে সরে যাও।

য়ুহা আর রায়ীনা পেছনে সরে এলো। মৃতদেহগুলো তখন আরো একটু এগিয়ে আসে, এভাবে তাদের দুজনকে ঠেলে ঠেলে মৃতদেহগুলো তাদের একটা অন্ধকার গহ্বরের কাছে নিয়ে আসে। মৃতদেহগুলো তখন চারপাশ থেকে ঘিরে তাদের দুজনকে গহ্বারের মাঝে ঠেলে ফেলে দেয়ার চেষ্টা করল। য়ুহা আর রায়ীনা আতঙ্কিত হয়ে হাতের অস্ত্র দিয়ে গুলি করে প্রাণীগুলোকে সরানোর চেষ্টা করল, কিন্তু পারল না। মৃতদেহগুলো ঠেলে ঠেলে তাদের গহ্বরের মাঝে ফেলে দেয়। হা আর রায়ীনা অন্ধকার ঘরের ভেতর অদৃশ্য হয়ে যাবার শেষ মুহূর্তে বাইরে তাকিয়ে দেখে, যে প্রাণীগুলো এতক্ষণ তাদেরকে ঠেলে ঠেলে এনে গহ্বরের মাঝে ফেলে দিয়েছে হঠাৎ করে সেগুলো মূর্তির মতো স্থির হয়ে গেছে। কেউ আর এতটুকু নড়ছে না, হাত পা মাথাহীন ভয়ঙ্কর দেহগুলো যেটা যেখানে ছিল ঠিক সেখানে স্থির হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে তারা তাদের দায়িতু পালন করেছে। এখন আর তাদের কিছুই করার নেই।

পিচ্ছিল আঠালো চটচটে এক ধরনের তরলের ভেতর দিয়ে দুজনে গড়িয়ে গড়িয়ে একটা ফাঁকা জায়গায় হাজির হলো। জায়গাটি বিচিত্র। এটি আশ্চর্য রকম সমতল এবং চারপাশের দেয়ালগুলো দেখলে প্রাগৈতিহাসিক কারুকাজের কথা মনে পড়ে। য়ুহা এবং রায়ীনা উঠে দাঁড়াল, চটচটে আঠালো তরলে তারা মাখামাখি হয়ে আছে। য়হা ভয় পাওয়া গলায় বলল, আমরা কোথায়?

রায়ীনা বলল, তুমি শুনে বিশ্বাস করবে কী না জানি না, কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আমরা কোনো একটা প্রাণীর পেটের ভেতরে হাজির হয়েছি!

পেটের ভেতরে?

হ্যাঁ।

য়ুহা ভয়ে ভয়ে চারদিকে তাকালো, চারপাশের অংশটুকুর তার পরিচিত কোনে কিছুর সাথে কোনো মিল নেই। সে তার জীবনে এ রকম বিচিত্র কিছু দেখেনি। রায়ীনা নিচু গলায় বলল, তুমি দেয়ালগুলো দেখো–কিছুক্ষণ থেকেই হেডফোনে একটা খসখসে চাপা শব্দ আসছিল য়ুহা তাই ভালো করে কথা শুনতে পেল না, সে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ?

তুমি দেয়ালগুলো দেখ–সেগুলো নড়ছে।

য়ুহা চারপাশের দেয়ালগুলোর দিকে তাকালো, সেগুলো শুধু নড়ছে না ধীরে ধীরে সেগুলোর আকার পাল্টে যাচ্ছে। দেখতে দেখতে সেখানে ছোট ছোট অসংখ্য বিন্দু বড় হতে শুরু করছে। য়ুহা তার অস্ত্রটি হাতে নিয়ে বলল, এটা জীবন্ত?

রায়ীনার হেডফোনেও একটা কর্কশ শব্দ, সে তার মাঝে চিৎকার করে বলল, হ্যাঁ, মনে হয় এটা জীবন্ত।

রায়ীনার কথা শেষ হবার সাথে সাথে য়ুহা তার হেডফোনে একটা যান্ত্রিক শব্দ শুনতে পেল, য়ুহা কথাটা পরিষ্কার বুঝতে পারল না, রায়ীনাকে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ?

আবার প্রতিধ্বনির মতো একটা শব্দ হলো, তার ভেতরে রায়ীনা বলল, আমি কিছু বলিনি।

তাহলে কে বলেছে?

আবার ভোঁতা একটা শব্দ হলো। রায়ীনা চারদিক ঘুরে তাকালো, বলল, অন্য কেউ বলছে।

অন্য কেউ?

হ্যাঁ।

কী বলছে?

বুঝতে পারছি না।

রায়ীনার কথা শেষ হবার আগেই খসখসে একটা শব্দ শোনা গেল, বুঝি বুঝি বুঝি…

য়ুহা চমকে ওঠে, কে কথা বলে?

প্রতিধ্বনির মতো একটা গমগমে আওয়াজ আসে, কে? কে? কে?

রায়ীনা নিচু গলায় বলল, কেউ একজন আমাদের সাথে কথা বলতে চাইছে।

য়ুহা বলল, কী বলছে?

দুর্বোধ্য কিছু শব্দ শুনতে পেল তারা, সেই অর্থহীন শব্দগুলোর মাঝে শুধু মানুষ শব্দটা তারা বুঝতে পারে। য়ুহা বলল, হ্যাঁ। আমরা মানুষ। তোমরা কারা?

মানুষ প্রতিধ্বনির মতো আবার শব্দ হয় মানুষ! সত্যি মানুষ! জীবন্ত মানুষ! মানুষ!

হ্যাঁ। আমরা জীবন্ত মানুষ। তোমরা কারা?

আমরা? আমরা? মানুষ না। মানুষ না। তোমরা মানুষ। আমরা মানুষ।

আবার দুর্বোধ্য কিছু শব্দ শুনল, দ্রুত বিজাতীয় এক ধরনের ভাষার কথা বলতে থাকে তার মাঝে বুদ্ধিমত্তা, চেতনা, অনুভূতি এ রকম কয়েকটা শব্দ তারা বুঝতে পারল। রায়ীনা চারদিকে চোখ বুলাতে বুলাতে বলল, আমরা তোমাকে দেখতে চাই।

দেখতে চাও? দেখতে চাও?

হ্যাঁ।

এই তো আমি। আমি।

তুমি কি একা?

একা। আমি একা। আমি এক এবং একা।

এই গ্রহে তুমি একা?

আমি একা। আমি সব। আমি সব।

তুমি কি এই মহাকাশযানগুলো ধ্বংস করেছ?

ধ্বংস? ধ্বংস?

হ্যাঁ। এই বিধ্বস্ত মহাকাশযানটা কি তুমি ধ্বংস করেছ?

না। আমি করি নাই।

য়ুহা লক্ষ করল দুর্বোধ্য একটা দুটো শব্দ দিয়ে কথা শুরু করলেও খুব দ্রুত এই প্রাণীটি অর্থবহ কথা বলতে শুরু করেছে। য়ুহা জিজ্ঞেস করল, তুমি কী চাও?

আমি মানুষ বুঝতে চাই। গমগমে এক ধরনের কণ্ঠস্বরে মহাকাশের প্রাণীটি বলে, বিধ্বস্ত মহাকাশযানে কোনো জীবন্ত মানুষ নাই। আমি জীবন্ত মানুষ বুঝতে চাই।

য়ুহা বলল, আমরা জীবন্ত মানুষ।

আমি বুঝতে চাই।

রায়ীনা বলল, আমরাও তোমাকে বুঝতে চাই। তুমি কেমন করে দেখ কেমন কথা বল আমরা বুঝতে চাই। তোমরা কেমন করে চিন্তা কর বুঝতে চাই।

তোমরা আলাদা। তোমাদের কথা আলাদা। চিন্তা আলাদা। আমি এক। আমি একা।

তুমি কেমন করে কথা বল? দেখ? শোন? স্পর্শ কর?

আমি কথা বলি না। দেখি না। শুনি না। স্পর্শ করি না। আমি এক। আমি একক।

রায়ীনা গলা উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি চিন্তা কর?

আমি চিন্তা করি।

তুমি কীভাবে চিন্তা কর?

তোমরা যেভাবে চিন্তা কর আমি সেভাবে চিন্তা করি। তোমাদের সবার আলাদা আলাদা মস্তিষ্ক। আমার একটা মস্তিষ্ক।

কোথায় তোমার মস্তিষ্ক? দেখতে চাই।

এই গ্রহের ভেতরে বিশাল মস্তিষ্ক।

গ্রহের ভেতরে?

হ্যাঁ, এই গ্রহের ভেতরে বিশাল জায়গা জুড়ে আমার মস্তিষ্ক। আমার সেই মস্তিষ্ক আস্তে আস্তে বড় হচ্ছে।

আমরা যে রকম হাঁটতে পারি। এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যেতে পারি তুমি সেটা পার না?

না। আমার তার প্রয়োজন হয় না। আমার যেটা দরকার আমি সেটা আমার নিজের কাছে নিয়ে আসি।

রায়ীনা নিঃশ্বাস বন্ধ করে বলল, আমাদেরকে যেভাবে এনেছ?

হ্যাঁ। তোমাদেরকে যেভাবে এনেছি।

কেন এনেছ আমাদের।

আমি আগে শুধু মৃত মানুষ দেখেছি। শুধু মৃত মানুষ নিয়ে কাজ করেছি। আমি জীবন্ত মানুষ দেখতে চাই, তারা কেমন করে কাজ করে বুঝতে চাই।

তুমি কী বুঝতে পেরেছ?

আমি তাদের আরো গভীরভাবে দেখতে চাই। আরো গভীরভাবে বুঝতে চাই। আরো নিবিড়ভাবে দেখতে চাই, শরীরের প্রত্যেকটা কোষ দেখতে চাই, মস্তিষ্কের প্রত্যেকটা নিউরন দেখতে চাই

য়ুহা ভয় পাওয়া গলায় বলল, কীভাবে দেখবে তুমি?

খুলে খুলে।

না য়ুহা চিৎকার করে বলল, আমি দেব না। কিছুতেই দেব না।

দেব না?

না। আমাদের ছেড়ে দাও। যেতে দাও।

য়ুহা অবাক হয়ে দেখে তাদের চারপাশের দেয়ালগুলো তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। একটু আগে সেগুলো প্রায় মসৃণ ছিল, এখন সেগুলো অসমান, কোথাও উঁচু কোথাও নিচু। গোলাকার অংশ ফুলে ফুলে বের হয় আসছে। তার চারপাশে শুড়ের মতো অংশ কিলবিল করতে করতে নড়ছে। য়ুহা চারদিকে তাকিয়ে খপ করে অস্ত্রটা তুলে নেয়, সাথে সাথে শুড়ের মতো একটা অংশ তাকে জড়িয়ে ধরে ফেলে। য়ুহা ঝটকা মেরে নিজেকে ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করে, পারে না। সে রায়ীনার দিকে তাকালো, বেশ কয়েকটা শুড়ের মতো জিনিস তাকেও জাপটে ধরেছে, রায়ীনা প্রাণপণ চেষ্টা করছে মুক্ত হবার জন্যে কিন্তু মুক্ত হতে পারছে না। গোলাকার জিনিসগুলো তাদের কাছাকাছি এগিয়ে আসছে, য়ুহা তখন সেগুলোকে চিনতে পারে। গোলাকার জিনিসগুলো এক ধরনের চোখ, একটি দুটি নয় অসংখ্য চোখ তাদের দেখছে। গভীরভাবে দেখছে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে।

পেঁচিয়ে থাকা শুড়গুলো য়ুহাকে জাপটে ধরে ওলট পালট করে, কানের ভেতর ভেঁতা একটা যান্ত্রিক শব্দ, চোখের সামনে একটা লাল পর্দা ঝুলছে। মাথার ভেতরে একটা দপদপে যন্ত্রণা, মনে হচ্ছে পুরো মস্তিষ্কটা বুঝি ফেটে বের হয়ে যাবে। সে মাথা ঘুরিয়ে রায়ীনাকে দেখার চেষ্টা করল। কিলবিলে শুড় আর ছোট-বড় অসংখ্য চোখের আড়ালে সে ঢাকা পড়ে গেছে। সামনে কিছু একটা খুলে যায়, বিশাল এলাকা জুড়ে কিছু একটা থলথল করছে, নড়ছে, মাঝে মাঝে বুদবুদের মতো কিছু একটা বের হয়ে আসছে। শুড়ের মতো কিছু বের হয়ে আসছে, আবার ভেতরে ঢুকে যাচ্ছে। অহা টের পেল তাকে সেখানে ফেলে দেয়া হলো, থলথলে আঠালো একটা ঘন তরলের মাঝে সে ড়ুবে যাচ্ছে, অসংখ্য নল তাকে পেচিয়ে ধরেছে, তাকে দেখছে, নাড়ছে। য়ুহা পরিষ্কার করে কিছু চিন্তা করতে পারছিল না। ভয়ঙ্কর আতঙ্কে সে চিৎকার করে ওঠে, রায়ীনা–রায়ীনা-

কেউ তার কথার উত্তর দিল না।

য়ুহা। য়ুহা–

য়ুহা চোখ খুলে তাকালো। কেউ একজন তাকে ডাকছে, ক্লান্তিতে তার চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসছিল তার মাঝে সে কোনোভাবে চোখ খুলে তাকালো। বিড়বিড় করে বলল, আমরা কি বেঁচে আছি না মরে গেছি?

বেঁচে আছি।

তাহলে এ রকম লাগছে কেন?

কী রকম লাগছে?

মনে হচ্ছে মরে গেছি!

মনে হয় আমরা মরেই গিয়েছিলাম, আবার বেঁচে গেছি।

য়ুহা উঠে বসে, সমতল একটা জায়গায় বসে আছে–চারপাশে প্রাগৈতিহাসিক যুগের মতো বিচিত্র নক্সা। য়ুহা চারদিকে তাকিয়ে বলল, আমরা কোথায়?

জানি না।

আমরা কী যেতে পারব?

সেটাও জানি না। প্রাণীটা আর কোনো কথা বলছে না।

য়ুহা উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে চারদিকে তাকায়, ঠিক কী কারণ জানা নেই সে নিজের ভেতরে এক ধরনের বিষঃ বেদনা অনুভব করে, মনে হয় কিছু একটা ঘটে গেছে, যেটা সে বুঝতে পারছে না।

রায়ীনা বলল, আমাদের এখন বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করা দরকার।

প্রাণীটা যেতে দেবে?

কেন দেবে না? আমাদের শরীরের প্রত্যেকটা কোষ খুলে খুলে তার যেটা জানা দরকার জেনে গেছে। আমাদের সবকিছু সে জানে।

সবকিছু?

হ্যাঁ। সবকিছু। আমরা কী চিন্তা করি, কী ভাবি সব কিছু।

য়ুহা ক্লান্ত গলায় বলল, ব্যাপারটা চিন্তা করেই আমার শরীরটা কেমন যেন গুলিয়ে আসছে।

রায়ীনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এসব নিয়ে ভাবার অনেক সময় পাওয়া যাবে। এখন চল, দেখি এখান থেকে বের হওয়া যায় কি না। আমার হিসেব অনুযায়ী আমার খোজে আমার দলের লোকজনের এতক্ষণে চলে আসার কথা।

য়ুহা আর রায়ীনা অস্ত্র হাতে সতর্ক পায়ে এগুতে থাকে। কেউ তাদেরকে বাধা দিল না-কেন বাধা দিল না সেই ভাবনাটি তাদের ভেতরে খচখচ করতে থাকে। তাহলে কি এমন কিছু ঘটেছে যেটা তারা জানে না?

বিধ্বস্ত মহাকাশযান থেকে বের হয়েই তারা স্কাউটশিপটা দেখতে পায়। মহাকাশযানের কাছাকাছি একটা বড় পাথরের ওপর একটা অতিকায় গুবরে পোকার মতো সেটা বসে আছে। রায়ীনা হাসিমুখে য়ুহার দিকে তাকিয়ে বলল, দেখেছো? আমি বলেছি না? আমার খোঁজে আমার লোকজন চলে আসবে?

য়ুহা বলল, তোমাকে যতই দেখছি আমি ততই মুগ্ধ হচ্ছি!

মুগ্ধ হওয়ার অনেক সময় পাওয়া যাবে, এখন চল। তাড়াতাড়ি।

য়ুহা রায়ীনায় পিছু পিছু দ্রুত হাঁটতে থাকে। রায়ীনা বলল, আমি বুঝতে পারছি না আমার দলের লোকজন স্কাউটশিপের ভেতর বসে আছে কেন? তারা আমাদের খুঁজছে না কেন?

হয়তো খুঁজেছে।

আমি তাদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছি না কেন?

সেটা বুঝতে পারছি না। চেষ্টা করেছ?

হ্যাঁ করেছি।

হঠাৎ তারা একটা বিচিত্র ব্যাপার দেখতে পায়। স্কাউটশিপটা গর্জন করে উঠে থরথর করে কাঁপতে থাকে। দেখে মনে হয় উড়ে চলে যাবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। য়ুহা চমকে উঠে বলল, রায়ীনা! স্কাউটশিপটা কি চলে যাচ্ছে?

অসম্ভব! আমাদের না নিয়ে কিছুতেই যাবে না!

হয়তো অনেক খুঁজেছে। খুঁজে না পেয়ে চলে যাচ্ছে।

হতেই পারে না। আমাকে না নিয়ে যাবে না–

রায়ীনা পাথরের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে স্কাউটশিপের কাছে হাজির হয়, তখন সেটা নড়তে শুরু করেছে। রায়ীনা ইঞ্জিনের একটা অংশ ধরে জানালায় মুখ রাখে এবং মুহূর্তে তার মুখমণ্ডল রক্তহীন হয়ে যায়। য়ুহা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে রায়ীনা? কী হয়েছে?

রায়ীনা কোনো কথা না বলে শূন্য দৃষ্টিতে য়ুহার দিকে তাকিয়ে রইল।

য়ুহা আবার জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

রায়ীনা এবারেও তার প্রশ্নের উত্তর দিল না, শূন্য দৃষ্টিতে য়ুহার দিকে তাকিয়ে রইল। য়ুহা এগিয়ে গিয়ে রায়ীনাকে সরিয়ে জানালায় মুখ রেখে ভেতরে তাকালো, স্কাউটশিপে অনেকেই আছে, সবার সামনে দুজনতাদেরকে সে স্পষ্ট চিনতে পারল, একজন রায়ীনা, অন্যজন য়ুহা।

য়ুহা বিস্ফারিত চোখে রায়ীনার দিকে তাকালো, কঁপা গলায় বলল, ওরা কারা?

আমি আর তুমি।

আমরা কারা?

আমি জানি না।

য়ুহা আর রায়ীনা বিধ্বস্ত মহাকাশের পাশে দাঁড়িয়ে দেখল স্কাউটশিপটি গর্জন করে উপরে উঠে পেছনে তীব্র লাল আলোর একটা জ্বলন্ত শিখা বের করে উড়ে গেল, যতক্ষণ সেটা মিলিয়ে না গেল তারা দুজন সেদিকে তাকিয়ে রইল। যখন সেটা ছোট একটা আলোর বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল তখন য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, এমন কী হতে পারে যে আমি আর তুমি আসল য়ুহা আর আসল রায়ীনা। আমাদেরকেই রেখে আমাদের অন্য দুজনকে নিয়ে গেছে?

রায়ীনা য়ুহার দিকে তাকালো, বলল, তুমিই বল? তুমি কি সত্যিকার য়ুহা?

য়ুহা কিছুক্ষণ চুপ করে রইল, তারপর বলল, না, আমি আসল য়ুহা না।

কেন?

আসল য়ুহা একজন কবি। সে শব্দের পাশে শব্দ বসিয়ে কবিতা লিখতে পারত। আমি পারি না। চেষ্টা করে দেখেছি আমি শব্দের পাশে শব্দ আর বসাতে পারি না।

রায়ীনা মাথা নাড়ল, বলল, আসল রায়ীনা মানুষের বুদ্ধিমত্তার ওপর গবেষণা করত। কুরিত্রা সমীকরণের সহগগুলো সে মনে মনে হিসাব করে বের করতে পারত। আমি পারি না।

য়ুহা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমাদের মতো দুঃখী আর কেউ নেই। তাই না রায়ীনা?

রায়ীনা মাথা নাড়ল। য়ুহা জিজ্ঞেস করল, আমরা এখন কী করব রায়ীনা।

মহাকাশের এই প্রাণীটা যেন আমাদের মতো কাউকে নিয়ে এ রকম নিষ্ঠুরত্ত করতে না পারে সেটা সবার আগে নিশ্চিত করতে হবে। মহাকাশযানটি এখানে বিধ্বস্ত হয়েছিল বলে সে মহাকাশের সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ করেছে। আমরা প্রাণীটিকে হত্যা করতে পারব না–কিন্তু সে যেন আর বাইরের কারো সাথে যোগাযোগ করতে না পারে সেটা তো নিশ্চিত করতে পারি।

আমরা কী পারব?

পারব। আগে আমরা কখনো আমাদের প্রাণের ঝুঁকি নিইনি। এখন আমাদের প্রাণের কোনো ঝুঁকি নেই। আমরা এখন নিরাপদ স্কাউটশিপে করে মহাকাশযানে যাচ্ছি। আমাদের শুধু দুটি দেহ এই গ্রহে রয়ে গেছে। আমার আর তোমার এই দেহ দুটির কোনো মূল্য নেই।

মহাকাশযানের সবাই সবিস্ময়ে দেখল ভয়ঙ্কর একটি বিস্ফোরণে কুৎসিত কালো গ্রহটির শক্তিশালী এন্টেনাটি উড়ে গেছে। মহাকাশযানের কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক সাথে সাথেই কুৎসিত কালো গ্রহের সেই মহাজাগতিক প্রাণীর নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়ে গেল। কোয়ান্টাম নেটওয়ার্ক নিজে থেকে একবার চালু নেয়ার সাথে সাথে, মহাকাশযানের ভেতরে আলো জ্বেলে ওঠে। শক্তিশালী কুরু ইঞ্জিন গর্জন করে ওঠে। মহাকাশযানটি নিজ অক্ষের ওপর ঘুরতে শুরু করার সাথে সাথে কৃত্রিম মহাকর্ষে ভেসে থাকা সবকিছু নিচে নেমে আসে। মহাকাশচারীরা অনেক দিন পর হেঁটে হেঁটে যেতে থাকে।

য়ুহা আর রায়ীনার সম্মানে এবং তাদের প্রতি গভীর ভালোবাসায় যে ভোজের আয়োজন করা হয়েছিল, সেখানে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের ক্রু এবং বিদ্রোহী দলের সদস্যরা পাশাপাশি বসে পানাহার করছিল। সেখানে মহাকাশযানের বিশেষভাবে সংরক্ষণ করে রাখা সত্যিকার ভেড়ার মাংস, জৈবিক যবের রুটি এবং প্রাকৃতিক আঙুরের রসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। মহাজাগতিক সিম্ফোনির সপ্তম অংশটি শুনতে শুনতে ক্যাপ্টেন ক্ৰবের ক্রু এবং বিদ্রোহী দলের সদস্যরা একে অন্যের সাথে হাসি তামাশায় মেতে উঠেছিল। উত্তেজক পানীয় খেতে খেতে তরল কণ্ঠে তাদের কথাবার্তা পুরো মহাকাশযানে একটা অন্য ধরনের আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল।

ঠিক সেই মুহূর্তে নিচের কালো কুৎসিত গ্রহটার একটা বড় পাথরের পাশে য়ুহা এবং রায়ীনার দেহ দুটি পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিল। য়ুহা তার হাতের অস্ত্রটির ট্রিগারে হাত দিয়ে রায়ীনার দিকে তাকিয়ে বলল, তোমাকে ছেড়ে যেতে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে রায়ীনা।

রায়ীনা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি জানি। আমি আর তুমি তো সত্যিকারের য়ুহা নই, সত্যিকারের রায়ী নই। আমরা হচ্ছি তাদের জোড়াতালি দেয়া দেহ! আমাদের কোনো গুরুত্ব নেই য়ুহা। তার পরেও চলে যেতে আমার খুব কষ্ট লাগছে।

য়ুহা রায়ীনাকে গভীর মমতায় আলিঙ্গন করে বলল, আমাকে বিদায় দাও রায়ীনা।

রায়ীনা য়ুহার মুখের দিকে তাকিয়ে রইল, বিদায় দিতে পারল না। ধীরে ধীরে তার চোখ অশ্রুতে ভরে যায়, য়ুহার ছেলেমানুষী মুখটা যখন ঝাঁপসা হয়ে যাচ্ছিল ঠিক সেই মুহূর্তে তারা ট্রিগার টেনে ধরে।

বায়ুমণ্ডল নেই বলে গুলির শব্দটি গ্রহের ভেতর ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে পারেনি।

গল্পের বিষয়:
সাইন্স-ফিকশন
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত