হাসি

হাসি

মেয়েটা হাসতো, খুব সুন্দর করে হাসতো।প্রাণ খুলে হাসতো। তার হাসির মুগ্ধতা চারদিকে ছড়িয়ে পড়তো। হাসতে হাসতে তার পেটে ব্যথা পেতো, চোখে মুখে পানি চলে আসতো, তারপরেও হাসতো।বাবা-মা গালি দেওয়ার পরেও হাসতো।মুখ টিপে হাসতো।গালি শেষে তার বাবা মাও হাসতো। কেউ কখনও তার মুখ মলিন হতে দেখেনি।তার মুখে কেউ কখনও কান্না দেখেনি। সব কিছুতেই শুধু হাসতো। তার এই হাসি যেন কখনও ফুরাবার নয়।
.
কিন্তু আজ মেয়েটা নিশ্চুপ নিস্তব্ধ।আজ একটা প্রাণহীন পাথরে পরিণত হয়েছে। হাসিটাও তার কাছ থেকে চিরতরে হারিয়ে গেছে। হাসতে অনেক চেষ্টা করে কিন্তু পারে না।আবার কাঁদতেও চেষ্টা করে, সেটাও পারে না। আজ তার অন্ধকার নিত্যসঙ্গী, আজ তার ঘরেই এক টুকরো পৃথিবী।রুম থেকে বের হয় না। কারো সাথে কথা বলে না। একা একা থাকে একা একা বাঁচে।প্রতিদিন মৃত্যুর প্রহর গুণে।

– ‘এই মুখপুড়ি আবার কি শুরু করলি হাসিটা বন্ধ করবি?’
– হি হি হি (মুখ টিপে হাসে)
– ‘আবার! আচ্ছা তোর কি লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই?
– ‘আমার নামেই তো হাসি। আমার কাজেই তো হাসা। তাহলে লজ্জা করবে কেন?’
.
হাসির মা ভালো বা মন্দ আর কিছু বলেননি। কারণ তিনি কখনও মেয়ের সাথে কথা বলে পারেন না। তাই আবার রান্নার কাজে মন দেন। আর হাসি! হাসতে হাসতে নিজের রুমে চলে আসে। হাসি নিজেকে আয়নায় দেখছে আর হাসছে।হঠাৎ হাসি বন্ধ করে এক দৃষ্টিতে আয়নার দিকে তাকিয়ে থাকে।

হাসি বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে। তার আগে ও পরে ভাই বোন ছিল। কিন্তু তার মায়ের পেটেয় তাদের মৃত্যু হয়। হাসির মা নিজের প্রথম সন্তান হারিয়ে কেমন যেন হয়ে গিয়েছিল।হাসির জন্মের পর ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়। হাসির মুখে হাসি দেখেই তার নাম রাখা হয় হাসি। হাসিকে ঘিরে শুরু হয় তাদের নতুন পথ চলা।
.
– ‘হাসি রান্না হয়েছে খেতে আই মা’ (রান্নাঘর থেকে তার আম্মা বলে)
– ‘আসছি মা’
হাসি গুণ গুণ করে আসতে থাকে।
– ‘আম্মা আব্বা কই? আব্বাকে দেখছি না যে!
– ‘দোকালে কি যেন প্রয়োজন ছিল। তাই সকাল সকাল বের হয়েছে।’
সে আর কথা বাড়ায়নি চুপচাপ খেতে থাকে।
.
হাসি বান্ধুবীদের নিয়ে কলেজে যাচ্ছে। কিন্তু সে জানে না কলেজ থেকে ফিরার সময় তার জীবনে কি ঘটছে! কলেজে আসার পর ক্লাস করে হাসি আনন্দে মেতে থেকে কলেজ টাইম শেষ করে।তারপর বান্ধুবীদের নিয়ে বাড়ির পথ ধরে।
.
– ‘টাটা কাল দেখা হবে আজ বিদায়’ (হাসি)
– ‘টাটা সাবধানে বাড়ি যাবি দেশের পরিস্থিতি ভালো না। (তার বান্ধবীরা)
তারপর প্রত্যেকে প্রত্যেকের বাড়ির রাস্তা ধরে হাটতে থাকে।

হাসি গুণ গুণ করে বাড়ির পথে ফিরছে। হঠাত একটা মাইক্রোবাস তার সামনে এসে থামে। কোন কিছু বুঝার আগে তাকে মাইক্রোর ভিতর ভরে ফেলে।মাইক্রোবাস চলছে, হাসি আত্মচিৎকার করছে। কিন্তু তার এই চিৎকার কারো কানে পৌছাচ্ছে না।এই বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ গুলোর মনে একটু দয়া মায়া জন্মাচ্ছে না।
.
হাসির মা মেয়ের জন্য অপেক্ষা করছেন। কিন্তু মেয়ের বাড়ি ফেরার কোন নাম নেই। মনের ভিতর অজানা একটা ভয় ঘিরে ধরছে। কারণ হাসি কখনও যে এতো দেরি করে বাড়ি ফিরেনি।মেয়ের পথ চেয়ে বসে আছেন।অনেক্ষণ পর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাসির বাবাকে ফোন করেন।
.
– ‘হ্যা, হাসির মা বলো।’
– ‘হাসি এখনও বাড়ি ফিরেনি; আপনি কলেজে খবর নিয়ে দেখেন তো ঐ খানে আছে কিনা।’
– ‘কি বলো! এতোটা সময় পাড় হয়ে গেছে এখনও বাড়ি ফিরেনি? আমি এখনেই দেখছি।’

আর কাকে ফোন দিবে? কাকে ফোন দিলে হাসির খবর পাওয়া যাবে চিন্তা করছেন। উনার মাথায় যেন কিছুই আসছে না।হঠাৎ হাসির বান্ধুবীদের কথা মনে পড়ে। তাড়াতাড়ি হাসির এক বান্ধবীকে ফোন দেয়।
– ‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি’
– ‘ওলাইকুম আসসালাম, হাসি কি তোমাদের এখানে?’
– ‘না, আন্টি সে কি এখনও বাসায় পৌছায়নি? আমরা তো এক সাথেই কলেজ থেকে বের হয়েছি।’
– ‘কিহ!’
– ‘হ্যা আন্টি’
হাসির মা ভালো মন্দ আর কিছু বলতে পারেননি। উনার মনে হচ্ছে কে যেন উনার সারা শরীরের শক্তি চুষে নিয়ে গেছে।হাসি কোথায় আছে? কেমন আছে? কি করছে? কেন এখনও বাড়ি ফিরছে না? সে কি কোনো বিপদে পড়েছে? সে ভালো আছে তো? উনি আর কিছু চিন্তা করতে পারছেন না। পাথরের মতন দাঁড়িয়ে আছেন। উনার সব কিছু কেমন যেন অন্ধকার মনে হচ্ছে।
.
বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ গুলো হাসিকে নিয়ে একটা পুরনো বাড়িতে আসে। হাসি কাঁদছে, কতো করে কতো ভাবে তাকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য তাদেকে বলেছে। কিন্তু তাদের মন একটুও গলেনি।তাদের চোখে মুখে লেগে আছে রক্ত নেশা।
.
– ‘ভাইয়া, এই ভাইয়া, ভাইয়ারে আমাকে ছেড়ে দাও আমাকে আমার বাবা মায়ের কাছে যেতে দাও।’
হা হা হা হা, প্রত্যেকে এক সাথে হেসে ওঠে।
– ‘ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ, এসব কি বল? এসব বলতে নেই।আমরা তোমার ভাইয়া হতে যাব কেন আমরা তোমার স্বামী (ব্যঙ্গ করে বলে) স্বামীকে কেউ ভাইয়া বলে?’
– হাসি কেঁদেয় যাচ্ছে। কিন্তু তার চোখের পানির কেউ দিচ্ছে না।
– ‘এতো সুন্দর ফুল আগে কখনও হাতে আসেনি। আজ খুব মজা হবে তাইনা?’
– ‘হ্যা, ঠিক বলেছিস। আমার তো আর সইছে না।’
– হাসি দু-হাতে কান দুটি বন্ধ করে কেঁদেয় যাচ্ছে।এক এক ওরা সবাই হাসির দিকে এগিয়ে আসতে থাকে।
– না, না, আমার কাছে আসবে না।(আত্মচিৎকার দিচ্ছে আর বলছে)
কিন্তু কেউ কথা শুনেনি।ক্ষুদার্ত বাঘের মতো হাসির উপর ঝাপিয়ে পড়ে।

হাসির বাবা কলেজে গিয়ে মেয়েকে পাননি।সারা দুপুর বেলা অনেক জায়গায় খুঁজেছে। কিন্তু কোথাও মেয়ের খোঁজ পাননি।মলিন মুখে বাড়ি ফিরে। বউ এর কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে পারেননি। শুধু তাকিয়ে থেকেছেন।বাবা মা দুইজন মেয়ের পথ চেয়ে বসে আছেন।কিন্তু মেয়ের দেখা নেই। হাসির মা হাসি বলে ডাকছেন আর কাঁদছেন।আর বাবা নিস্পলক দৃষ্টিতে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছেন। ধীরে ধীরে সময় বয়ে যেতে থাকে।
.
পড়ন্ত বিকাল। সূর্য পশ্চিম আকাশে হেলে পড়েছে। হাসি অর্ধ নগ্ন অবস্থায় একটা রুমে পড়ে আছে। তার হাত দু’টো বাঁধা। তার মুখে আর হাসি নেই। তার চোখে আর পানি নেই। হাসি নীরব নিস্তব্ধ ভাবে বসে আছে। কত স্বপ্ন ছিল, কত ইচ্ছা ছিল, কত আশা ছিল। কিন্তু তার সব শেষ হয়ে গেল।সে আর এই পৃথিবীকে মুখ দেখাতে চায় না। এখন সে মরতে পারলেই বাঁচে।বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ গুলো এসে বলে।
– ‘এই ওঠ তোকে তোর বাড়ি পৌছে দিয়ে আসি। আর একটা কথা শুনে রাখ তোকে যখনেই ডাকব তখনেই আসবি না হলে আজকের এই ভিডিও টা সারা দেশের মানুষের কাছে পৌছাবে।’
হাসি শুধু একবার তাদের দিকে তাকিয়ে ছিল। আবার মাইক্রোবাস চলছে। কিন্তু হাসি আর চিৎকার করছে না। এখন সে একদম নিস্তব্ধ।
.
অন্ধকার হয়ে আসছে। কিন্তু এখনও মেয়ের কোনো খোঁজ নেই। কোথায় যাবে? কোথায় খোঁজবে? কাকে কি বলবে? মেয়ে যে, মানুষে শুনলে মেয়ে ও তারা সমাজে আর মুখ দেখাতে পারবে না। এই নিষ্ঠুর সমাজ তাদেরকে বাঁচতে দিবে না। হঠাৎ একটা মাইক্রোবাস তাদের গেইটের সামনে থামে। কিছু বুঝার আগেই হাসিকে ফেলে দিয়ে চলে যায়। হাসিকে এই অবস্থায় দেখে তাদের চোখে অন্ধকার নেমে আসে। মেয়ের কাছে এসে কিছু বলতে পারছে না। শুধু চোখের অশ্রু ঝরছে।আর হাসি চুপ করে বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে আছে।মেয়ে তাকানো দেখে তাদের বুকটা যেন ফেটে যাচ্ছে।কি বলে শান্তনা দিবে? কি বলে বুঝাবে? কোনো উত্তর কি আছে?

এই বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ গুলো এই সমাজের ক্ষমতাশালী লোক। তারা যখনেই অপরাধ করে তখনেই আইনের ফাঁক দিয়ে বেড়িয়ে আসতে পারে। কিন্তু উপর ওয়ালার শাস্তি থেকে কি করে বাঁচবে? এরাও বাঁচতে পারেনি।হাসির বাবা তাদের নামে মামলা করে। কিন্তু তারা আইনের ফাঁক দিয়ে বের হয়ে আসে।
.
আজ কতগুলো দিন পাড় হয়ে গেল। হাসি রুম থেকে বের হয় না। কারো সাথে কথা বলে না। বান্ধবীরা প্রতিদিন আসে দেখা করে কিন্তু তার সাথে কথা বলতে পারে না। তারা এক এক জন এক এক ভাবে বলে, ‘হাসি, এই হাসি, একটু হাস না।আমাদেরকে একটু হাসা না! আমরা কতদিন ধরে হাসি না। তোর হাসি দেখতে পারি না। এই হাসি, একটু হাস না!’ হাসি একবার তাদের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের মতো করে থাকে। তারা একজন আর একজনকে ধরে কাঁদতে শুরু করে।আড়াল থেকে তাদের বাবা মা এই দৃশ্য দেখে আর সহ্য করতে পারে না। কাছে এসে প্রত্যেক বার বলে, ‘মা হাসি, একবার তোর বান্ধুবীদের কথা রাখ না।একবার কথা বল না! কেন এমন করে থাকিস?’ হাসি কিছু বলে না মায়ের দিকে একবার ফিরে তাকায়। তার তাকানো দেখে তারা সবাই আবার কাঁদতে শুরু করে। কেউ জানে না এর শেষ কোথায়।
.
ঐদিন রাতে হাসি আত্মহত্যা করতে চেয়েছিল। কিন্তু বাবা মায়ের জন্য আর পারেনি।তারপর হাসির হাত তার মায়ের মাথায় রেখে কসম খাওয়ায় যেন কখনও নিজেকে শেষ না করে। হাসি “আম্মা” বলে একটা চিৎকার দেয়। ঐদিন সে অনেক কেঁদেছিল। তারপর থেকে হাসির মুখে হাসি দেখেনি তার চোখে পানিও দেখেনি।

আজ অনেকদিন পর বিকৃত মস্তিষ্কের মানুষ গুলো আবার আর এক হাসিকে ধরে নিয়ে যেতে থাকে। আগের সেই পুরনো বাড়িতে নিয়ে যায়। কিন্তু ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! ঐ মেয়েটা নিজেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়। আর ওরা ঐ বাড়িটাতে পুড়ে মরে। এবং তাদের দেহগুলো পুড়ে ছাই হয়ে যায়।তাদেরকে কেউ শনাক্ত করতে পারেনি। কিন্তু এই বাড়িতে কিভাবে আগুন লাগল কেউ বুঝতে পারেনি এবং এর সমাধানও আর হয়নি।এটা রহস্যই থেকে গেল।
.
হাসি খবরটা শুনে একবার হেসেছিল।ঐদিন সবাই তার হাসি দেখতে পেয়েছিল। কি মন মুগ্ধকর হাসি। যে হাসি দেখলে প্রত্যেকের মন এমনতেই ভালো হয়ে যেতো, এই সেই হাসি।
.
রাত্রি আকাশ, অন্ধকার রুম। হাসি মোমবাতি জ্বালায়। রুমটা মৃদু আলোতে পরিপূর্ণ হয়। হাসি এক দৃষ্টিতে নিজেকে আয়নায় দেখছে।একটা মুচকি হাসি দেয়। হাসি দেখছে আর ভাবছে কবে তার মৃত্যু হবে? তার এই দুনিয়ার জীবন কোনদিন শেষ হবে? শেষ বারের মতো নিজেকে আয়নায় দেখে ভুবন ভুলানো হাসি হাসে।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত