অসমতল

অসমতল

মজিদ মাস্টার গম্ভীর সবজান্তার ভঙ্গিতে বলল, ইরাকের পর সিরিয়া যে হইব এইটা আমি আগেই জানতাম!
মজিদ মাস্টার ডেইলি দুই-চারটা পেপার পড়ে। সে তো আগে থিকা সব জানবেই। এই রাতেরবেলাও তার বগলে একটা পেপার। সে জিভের ডগায় চুন মাখাচ্ছে।

আমরা মুসলমানরাই বড় খারাপ বুঝলা রতন! মজিদ মাস্টার বলে চলে। তার মুখ ভর্তি পানের রস।
রতন উচ্চমার্গের কথা শোনার ভঙ্গিতে মাথা নাড়ে। জ্ঞান গম্ভীর একটা আলোচনা শোনার জন্য তৈরি হয়।
এই যে সিরিয়ায় আক্রমন হইবো, মুসলমানরা সবাই এক হইয়া ক্যান এর প্রতিবাদ করতাছে না?

মসজিদের ইমাম সাব চা খেতে আসছিলেন। তিনি বললেন, এই জন্যই সারা দুনিয়ায় মুসলমানরা মার খাইতাছে। মুসলমানদের মধ্যে কোন ঐক্য নাই। স্বার্থ আর লোভে মুসলমানরা আজ ডুইবা আছে। আল্লাপাকের ইচ্ছায় কাল বাদ জোহর মিছিল আছে। ইনশাল্লাহ শরিক হইবেন সবাই।

সবাই জানতে চায় কিসের মিছিল। ইমামসাব বললেন, মুসলমানদের বিরুদ্ধে খ্রিস্টান দুনিয়ার যে অন্যায্য যুদ্ধ তার প্রতিবাদে গণমিছিল হবে।মাদ্রাসাগুলা থিকা মিছিল বাইর হইব, আমরা মিছিল নিয়া তাদের সঙ্গে যোগ দিবো।
মজিদ মাস্টার বললেন, ইনশাল্লাহ!

রতনও মিছিলে যোগ দিবে ঠিক করলো। মিছিলে সে নতুন যায় না। একবেলা দোকান বন্ধ রাখতে হবে। তা হোক। রিজিকের মালিক আল্লা। আগুনে পুড়ে তার দোকান ছাই হয়ে গিয়েছিল। আল্লাপাক ফের ঘুরে দাঁড়াবার তৌফিক দিয়েছেন। আল্লার পথে যে নামে তার চিন্তা আল্লার। বান্দা চলবে নির্ভয়ে।

রতনের বাইতুল মোকারমের সামনের রাস্তায় চৌকির উপর ইসলামী বই, আতর, তসবী, জয়তুনের ডাল, তাবিজ-কবজের দোকান। পাঞ্জেগানা নামাযী লোক সে। বাইতুল মোকারমের ফুটপাথে মুন্সীর দোকান বললেই এক নামে চিনে সবাই। সেই গন্ডগোলের সময় রতনের চৌকিতেও আগুন লেগেছিল। রতন নিজেও মনে করে এসব ঐ নাস্তিকগো কাজ। তার চৌকির কোরআন শরীফ, বুখারী শরীফ পুড়ে ছাই হয়ে গিয়েছিল। সেই ব্যথা এখনো তার দিলে বাজে। ব্যবসায়িক ক্ষতির চাইতোও এটা তাকে অনেক বেশি দুঃখ দেয়।

রতন কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত নয়। তবে সে ইসলামী শাসন চায়। এই ইসলামী শাসন যে কি সে নিজেও ভালো জানে না। এটুকু সে শুনেছে আল্লার নবী ও তার সাহাবীরা যেভাবে দেশ চালাইছেন সেভাবে দেশ চালাতে হবে। কাজেই রতনের অত বুঝারও দরকার নেই। আল্লার নবী আর সাহাবীদের চেয়ে কে আর ভাল বুঝেন? খেলাফতই শান্তি। খেলাফত না আসলে কিছুতে শান্তি আসবে না। রতন তাই যে কোন ইসলামী মিটিং-মিছিলে শরিক হওয়ার চেষ্টা করে। শুধু ঘর সংসার করলে তো হবে না, দ্বিনের কাজ না করলে পরকালে কি জবাব দিবে? রতনের কাছে এই জীবনের কোন মূল্য নেই। এটা তো ক্ষণস্থায়ী। পরকালের যে জীবন সে জীবন অনন্তকালের। সে জীবনের টিকিট কাটতে হবে এই জীবনেই।

ইমামসাব উঠলেন। মজিদ মাস্টারও তার সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলেন। রতনও উঠে পরল। গলিতে দেখা হলো কমিউনিস্ট পার্টির মোফাজ্জলের সঙ্গে। মহল্লার ছোট ভাই। কাঁধে হাত দিয়ে মোফাজ্জল বলল, রতন ভাই, কাল দুপুরে থাইকেন, মিটিং আছে। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মিছিল হবে। আমেরিকার সিরিয়া আক্রমনের প্রতিবাদে গণমিছিলে বস্তির সবাই থাকবো। কাল সকালে আমি আসমু, রেডি থাইকেন।

রতন জানে তাদের বস্তির অনেকেই কমিউনিস্ট পার্টির মিটিং মিছিলে যায়। মোফাজ্জলই নিয়ে যায়। রতন হাসে। ভোট তো দেয় সব শালা আমলীগ আর বিনপিরে। সে নিজে অবশ্য ইসলামী দলকেই তার ভোটটা দেয়। মোফাজ্জল এলাকার স্থানীয় পোলা, মুখের উপর কিছু বলা যায় না। ইমামসাব কন, নাস্তিকগো লগে উঠবস করবা না রতন। এতে ঈমানে চোট লাগতে পারে। মুসলমানের ঈমান ছাড়া দ্বিতীয় কিছু নাই। এই মোফাজ্জল হইল শাহাবাগী। আমলীগের টাকা খাইয়া কমিউনিস্ট নাস্তিকগুলি শাহবাগে নাচানাচি করছিল। এরা হইল ইসলামের দুশমন! রতনের মনে আছে মজিদ মাস্টার তখন পেপার পড়ে শোনাত, ইন্ডিয়ার থন বস্তায় বস্তায় ট্যাকা আইছে বুঝলানি, সেই ট্যাকায় নাস্তিকরা শাহবাগে রাইত দিন গানবাজনা, নাচানাচি করতাছে। এই দেহো মিয়া কাগজে কয়টা নাস্তিকের ছবি ছাপছে! এরা খোদা মানে না!…

রতন বলে, ইমামসাবরে কথা দিছি, বাদ জোহর মসজিদ থন মিছিল বাইর হইবো। যদি আগে কইতা…

মোফাজ্জল জানে রতন যাবে না। মোফাজ্জল মনে মনে হাসে। তবু কাঁধে হাত রেখে আন্তরিকভাবে বলে, আচ্ছা ঠিক আছে অসুবিধা নাই। তয়, বস্তিবাসীরে নিয়ে যে মিটিংটা আছে সেখানে কিন্তু থাইকেন। মনে আছে তো?

রতনের মনে আছে। সরকার বস্তি উচ্ছেদ করবে শুনেছে। অবৈধ বস্তি উচ্ছেদ করে এখানে প্রশস্ত রাস্তা হবে, সুন্দর সুন্দর দালান-কোঠা হবে। আজ বিশ বছর ধরে এই বস্তিতে আছে সে। বস্তি বলতেই ঝুপরি ঘর তা না, পাকা মেঝে টিনসেডের ঘর। তার বাড়িঅলার ঘরের মেঝেতে টাইলস লাগানো। সেই বস্তি নাকি উচ্ছেদ হবে। প্রয়োজনে তারা সবাই হাইকোর্টে যাবে। ‘আমরা বস্তিবাসী’ ব্যানারে একটা আন্দোলন শুরু করবে। মোফাজ্জলের পার্টি সেখানে মূল ভূমিকা রাখছে। সেই মিটিংয়ে রতন যাবে। সামনের সাপ্তাহে শুক্রবার মিটিং। মোফাজ্জল চলে যায় কথাটা মনে করিয়ে দিয়ে। রতন মোফাজ্জলের চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে থাকে। তার মনে পড়ে যায় কয়েক মাস আগের সময়কার কথা। নাস্তিকদের বিরুদ্ধে যখন আন্দোলন চলছিল তখন একদিন তর্ক বাধে মোফাজ্জলের সঙ্গে। মোফাজ্জল শুকনো হেসে বলেছিল, রতন ভাই, তুমি আজ নাস্তিক কইয়া যাগো লগে নিজেরে এক ভাবতাছো, এই মজিদ মাস্টার আর ইমামসাব, তুমি যে তাদের মত কেউ না এইটা পরে বুঝবা…।

ঘরে এসে খেতে বসে রতন চেয়ে দেখে তার পাতে আজ দুই পদের মাছ, মাংস। সে চোখ বড় বড় করে চেয়ে থাকে। সপ্রশ্ন স্ত্রীর দিকে তাকায়। মর্জিনার গালে বড় একটা ভাতের ডেলা, সে ভাত ভর্তি মুখে উত্তর দেয়, মুখলেছের মাদ্রাসায় অনুষ্ঠান গেছে, সেইখান থিকা মুখলেছ পাঠাইছে। খাও, ঠান্ডা হইয়া যাইবো।

রতন ছেলেকে মাদ্রাসায় দিয়েছে। পাঁচ বছর পর ছেলে হাফেজ হয়ে বের হবে ইনশাল্লাহ। এই ছেলে পরকালে বাপ-মার হয়ে সুপারিশ করবে। রতনের এখন একমাত্র চিন্তা মেয়ের বিয়ে। আল্লার মর্জি সেটাও দ্রুত শেষ করে সে নিশ্চিন্ত হতে চায়। মুখলেছের বড় হুজুরকে রতন অনুরোধ করেছে একজন পরেজগার ছেলের খোঁজ দিতে। হুজুর কথা দিয়েছেন তিনি দেখবেন। মেয়ে অবশ্য এ কথা শুনেই বাপ-মার সামনে পা নাচানাচি করেছে। হুজুর বিয়া করবে না! কত বড় আস্পর্দা দেখো, হুজুর খারাপটা কি? সব যুগের দোষ! বস্তিতে ঘরে ঘরে টেলিভিশন। রতন নিজের ঘরে এই শয়তানের বাক্সকে ঢুকতে দেয়নি। কিন্তু মা-মেয়ে যে ঠিকই লুকিয়ে লুকিয়ে মানুষের ঘরে গিয়ে টিভি দেখে রতন সেটা বুঝে। এই ইন্ডিয়ান চ্যানেলগুলি দেইখা সব বেয়াদপ হইয়া যাইতাছে। বলে হুজুর বিয়া করবে না! আরে মাইয়া বাপ-মায় হুজুরের লগে বিয়া দিবে না ডাকাতের লগে বিয়া দিবে সেটা তাদের ব্যাপার। মেয়ের মাকে তাই রতন শেষ কথা বলে দিয়েছে, মাইয়া সামলা, নাইলে তরে …।

রতন ভাত মাখতে থাকে। জব্বর স্বাদ হইছে রান্না। রতন খেতে খেতে ভাবে, বস্তি সত্যি সত্যি উঠে গেলে যাবে কোথায়? নদীভাঙ্গা মানুষ সে। শূন্য হাতে একদিন এই শহরে আসছিল। এখানেই জীবন নতুন করে তার শুরু। হঠাৎ নিজেকে শিকড়হীন মনে হলো রতনের। এই শেকড়হীনতা এক মুহূর্ত সব কিছু তাকে ভুলিয়ে দিল। নিজেকে শুধু অস্তিত্ব রক্ষার অবিরাম এক সংগ্রামী ছাড়া আর কিছুই মনে হলো না…।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রতন স্বপ্নে সিরিয়ায় আমেরিকার আক্রমন দেখতে পেলো। বাড়ি-ঘর সব কেঁপে উঠছে। লোকজনের চিৎকার-চেঁচামেচিতে এক দানবীয় অবস্থা। সে চোখ মেলে চেয়ে দেখে সকাল হয়ে গেছে।

ঝড়ের মত লোকমান এসে ঘরে ঢুকলো। রতনকে হাত ধরে টেনে বাইরে নিতে নিতে উত্তেজিতভাবে সে বলছিল, রতন লাডিলুডি যা আছে ল! হালারপুতেগো আইজ গোয়া দিয়া বাঁশ ফান্দাইয়া দিমু…বস্তি ভাঙ্গতে আইতাছে কুত্তার বাচ্চারা…

মোফাজ্জল এসে তাৎক্ষণিক একটা মানববন্ধনের আয়োজন করে ফেলল। পুরোনো একটা ব্যানার ছিল, “পুনর্বাসন ছাড়া বস্তি উচ্ছেদ মানি না! মানবো না!” সেটাই কাজে লাগানো হলো। বস্তির লোকজনকে গরু ছাগল তাড়ানোর মত করে মোফাজ্জলের ছেলেরা দাঁড় করানোর চেষ্টা করতে লাগলো। সবাই যার যার মালসামান সামলাতে ব্যস্ত। বুলড্রোজার সব তছনছ করে দিছে চোখের নিমিষে।

রতনের ঘর ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে। খোলা আকাশে মালসামান নিয়ে সে দাঁড়িয়ে আছে। গোটা পরিবারই যেন বোবা হয়ে গেছে। কারুর মুখ ফুটেই কোন কথা বেরুচ্ছে না। কার কাছে নালিশ করবে? কার কাছে যাবে?

মোফাজ্জল এসে বলল, রতন ভাই, প্রতিবাদ করতে হইব। দরকার পড়লে রক্ত দিয়া এই উচ্ছেদ বন্ধ করতে হইব। রতন ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে থাকে। মোফাজ্জল একটা উল্কার মত ছুটে চলেছে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকতে পারছে না। সে বস্তিবাসীকে সংগঠিত করতে চেষ্টা করছে। মানববন্ধনের ছবি তোলার জন্য এক সাংবাদিক এসে মোফাজ্জলকে বলল, মফু ভাই, ছবি লমু আহেন…।

মোফাজ্জল চলে গেলে। এলো এখলাছউদ্দিন। তার পার্টি এখন বিরোধী দলে। সে তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়লো। সরকারকে পরলে সে কাঁচা খেয়ে ফেলে। তারও অন্যান্য কর্মসূচী আছে। তার পক্ষেও বেশিক্ষণ থাকা সম্ভব হলো না।

সিরিয়া আক্রমণ বিরোধী দুটো মিছিলই যথা সময়ে শুরু হলো। রতনের খুব ইচ্ছা ছিল যোগ দেয়ার। সবই আল্লাপাকে ইচ্ছা। কাল রাতেরবেলা ঘুমাতে যাবার সময়ও একবারের জন্য মনে হয়নি সকালবেলা মাথার উপর ছাদ থাকবে না! ছেলেমেয়ে দুুটোর অবস্থাই হয়েছে সবচেয়ে খারাপ। এদের জন্মই হয়েছে এখানে। ছেলেটা কিছুক্ষণ লাফঝাপ করেছে মোফাজ্জলের দলের সঙ্গে। ‘মানি না মানমু না’ করে এখন সেও বাপ-মার সঙ্গে খাট-তোশক, হাড়ি-পাতিল বেঁধেছেঁদে ভ্যানে তুলছে। রতনের মেয়ে খালি উদভ্রান্ত্রের মত জিজ্ঞেস করতে লাগলো, আমরা অহন কই যামু মা? মর্জিনার এসব শোনার হুঁশ নাই। সে খুঁজে খুঁজে দেখছে কি কি লোকশান গেছে। হারামজাদারা একটুও সময় দেয় নাই। আল্লার গজব পড়–ক হারামীর বাচ্চাগুলার উপর!…

ইমামসাব খুব দুঃখ করলেন। মসজিদের পাকা বারান্দায় বসে বললেন, তোমার লগে দেহা করুম নে গুলিস্তান গেলে…।

মজিদ মাস্টার ছাত্র পড়াচ্ছিল তার ঘরের বৈঠকখানায়। আফসোস করে রতনকে বললেন, তোমাগো আগেই কোর্টে যাওয়া উচিত ছিল!

ভ্যানের পেছনে পা ঝুলিয়ে বসেছে রতন। সামনের ভ্যানে বউ ছেলেমেয়ে। পেছনেরটায় মালসামান সহ সে। রেল লাইন পার হয়ে তাদের ভ্যান ছোট রাস্তাটা ধরলো। রতন উদাস নয়নে আকাশের দিকে তাকালো। টিপ টিপ করে বৃষ্টি হচ্ছে। মালসামানগুলো সব ভিজছে। আজকের দিনেও আল্লাপাকের বৃষ্টি দিতে ইচ্ছা হইছে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে রতন।
বড় রাস্তা থেকে মাইকের শব্দ আসছে। রতন কান খাড়া করে। মিছিলের শ্লোগান শুনে রতন, সিরিয়ায় আক্রমন মানি না, মানবো না!… সাম্রাজ্যবাদীদের কালো হাত ভেঙ্গে দাও গুড়িয়ে দাও… নারায়ে তাকবির…আল্লাহো আকবর…

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত