একজন অতি সাধারণ আমি…

একজন অতি সাধারণ আমি…

১.

ওভারব্রীজের উপর দাঁড়িয়ে আছি আমি। সন্ধার সূর্যটা বহু আগেই বাড়ি ফিরে গেছে,রাস্তার সোডিয়াম হলুদ বাতিগুলোও জ্বলে উঠেছে আলোকময় নগরীকে আরেকটু আলোকিত করে দিতে। এই সময় বাড়ি ফেরার তাড়া থাকে মানুষের,ফিরে যাওয়ার নিরব প্রতিযোগীতা যেন শুরু হয়ে যায়। ভীড় বাড়ে বাসে, এই যাত্রাবাড়ি,গুলিস্তান,মিরপুর,শ্যামলী,ডাক হাঁকায় কন্ট্রাক্টাররা। আর যাত্রিদের ফিরে যাবার আকুলতা দেখতে থাকি আমি। মানুষের জীবনটা বড় বিচিত্র। দিন শেষে রাতে পরিবারের পিছুটান এড়াতে পারেনা মানুষ। অবাক লাগে মাঝে মাঝে এরকম পিছুটান। আমার পাশেও ভীড় বাড়ে,অস্থায়ী বাসিন্দারা ফিরতে শুরু করেছে আপন নীরে। শুধু আমিই ব্যস্ততার পাশ কাটিয়ে দাঁড়িয়ে আছি। হাতের জ্বলন্ত বেনসন এন্ড হেজেসটাও আপন মহিমায় উজ্বল হয়ে উঠছে। আমাদের পৃথিবীটাও হয়ত কোন জ্বলন্ত সিগারেট,প্রতি মুহুর্তেই ছোট হয়ে আসছে। আমার মত মধ্যবিত্ত বেকারের হাতে এজিনিস বেমানান। তবুও আজকের দিনে একটু বিলাসিতা হতেই পারে। টিউশনির বেতনটা এ মাসে দুদিন আগেই পেলাম। ছাত্রের বাসা পরিবর্তন হচ্ছে,সেই সাথে শিক্ষকও। দিনটা যে সত্যিকার অর্থে আমার জন্যেই। কাল হয়ত আবার এক গাদা চাকুরির আবেদনপত্র,নয়ত টিউশনি খোঁজার মত জরুরী কাজ পরবে। তাই আজকে একটু অবসর কাটানই যায়। পকেটে অনেকগুলো টাকাও আছে। পৃথিবিতে হয়ত টাকার সুখটাই বড় সুখ। প্রাচ্যের অক্সফোর্ড থেকে দুবছর হল বের হয়ে এখনও বেকার ই আছি।হয়ত আরো থাকব। থাকিনা আজকে কিছুটা চিন্তামুক্ত। তন্ময় হয়ে চেয়ে থাকি আমি রাস্তার ব্যস্ততার দিকে। ফুটপাতের দোকান গুলোতেও ভীড় বাড়ে। লাল নীল চুড়ি,ফিতা,শখের আংটি। কত কিছুতে ছেয়ে আছে দোকান । আপনমনেই হেসে উঠি আমি। সুখ বুঝি খুব একটা দামী না। কত কম দামেই না সুখ পাওয়া যায় দোকানগুলোতে। চুড়ির সাথে মেশানো দুফোঁটা ভালবাসার সামনে জগতের অপ্রাপ্তি বড় মেকী লাগে। ভাবছি মায়ার জন্যে কিনে নেব নাকি এক ডজন।মায়া আমার একমাত্র ছোট বোন। কাচের চুড়ি খুব পছন্দ মেয়েটার্। কিন্তু রাখতে পারেনা ভেঙ্গে ফেলে। দূর থেকেই একজোড়া কানের দুল চোখে লাগছে,প্রিয়তার জন্যে নেয়া যেতে পারে। এই পাঁচ বছরেও মেয়েটার জন্যে কিছু করতে পারিনি আমি। আসলে পকেটে টাকা থাকলে সব সুখ কিনে নিত ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করাটা কি খুব বেশি বেমানান? আলোগুলোর প্রাবল্য কমতে থাকে,কমে মানুষের ভীড়। আমার পাশেও নিদ্রার প্রস্তুতি চলছে পুরোদমে,ওভারব্রীজের বাসিন্দাদের নিম্নবিত্তের সংসারে ঘুম নামের অন্ধকার নেমে পড়তে শুরু করেছে। ওরা কি স্বপ্ন দেখে? আসলে জীবনটা আপেক্ষিক,ওদের স্বপ্ন গুলো বড় সরল। আইনস্টাইন সাহেব কাছে থাকলে জীবনের আপেক্ষিকতার জটিল সুত্রটা শিখে নিতাম। আমিও বেশিক্ষন পিছুটান থেকে বেরুতে পারিনা,হয়ত অবসাদ,হয়ত ভালবাসা,অথবা অসহায়ত্ব। পা বারাতেই হয় আপন গৃহের দিকে। ফিরে হয়ত দেখব মায়ের আমাকে নিয়ে চিন্তা,মায়ার একগাদা প্রশ্ন,অথবা কাঠিন্যের মোড়কে থাকা বাবার মমত্ব নিয়ে অপেক্ষা। এরকম ভালবাসাকে উপেক্ষা করার সাহস হয়না আমার,ঠোটের কোণে এক চিলতে সুখ হাসি নিয়ে এগিয়ে যাই। হারিয়ে যাই সেই ব্যস্ত মানুষদের সাথে নিরব প্রতিযোগিতায়। এভাবেই হয়ত অজানা এক মোহে আটকে পড়ি আমরা,চাইলেও বেরুতে পারিনা।হয়ত বেরুতে চাইই না।

২.

আমি বসে আছি প্রিয়তার সামনে। আমারসামনে বিরক্তি নিয়ে বসে আছে প্রিয়তা।মাঝে মাঝেই পার্কের মামার দোকানটায় আসা হয় আমাদের্। এই মুহুর্তে প্রিয়তার চোখ টলমল করছে। কাঁদতে গিয়েও কাঁদতে পারছেনা মেয়েটা। আমার লোভ হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্যটা দেখার,কিন্ত আমি তাকাচ্ছিনা। আমি জানি তাকালেই কেঁদে দিবে প্রিয়তা। মাঝে মাঝে জীবনের বাস্তবতা এড়িয়ে যেতে হয়। তখন মানুষকে স্বার্থপর হতে হয়। আমিও স্বার্থপর হয়ে যাই,প্রিয়তাকে কিছু বলার সাহস হয়না আমার্। আমি জানি আজও মেয়েটা গোমরা মুখেই বাড়ি ফিরে যাবে। মধ্যবিত্ত অবসরপ্রাপ্ত বাবার তিন কন্যার বড় মেয়ে প্রিয়তা। বহু কষ্টে নিজের বিয়েটা আটকে রেখেছে প্রিয়তা। বৃদ্ধ বাবাও চান মেয়েকে পাত্রস্থ করে সংসারের ব্যায় সংক্ষিপ্ত করতে। চাওয়াটাও অমূলক নয়। আমি জানি আমি প্রিয়তার যোগ্য নই,তবুও কেন যেন মেয়েটা পাগলের মত ভালবাসে আমাকে।আগের ছাত্রটা প্রিয়তাই যোগার করেছিল। আমার কত নিস্ফল আবেদন পত্র যে ও কুরিয়ার করেছে। পরম যত্নে মেয়টা আগেল রােখ আমােক। আমার মত বেকার মানুষেক সহানুভূিত দেখানো যায়,ভালবাসাটা িনতান্তই বোকামী। তবুও প্রিয়তা আমােক ভালবােস,আমায় িঘের এক ছোট্ট সংসােরর স্বপ্ন দেখে । প্রিয়তার ছলছল চাখ দুেটা সবসময় আমার অসহায়ত্ব মেন কিরেয় দেয়। আিম প্রিয়তােক আগেল রাখেত পািরনা,কখনও দামী শািড় িদেয় বিলনা তোমােক ভালবািস,কখন কাব্যের ছেন্দেও প্রিয়তা আমার নািয়কা হয়না । বড় বেরিসক আিম। কখনও কখেনা যখন বড় একা লােগ,হতশা আঁকেড় ধের,িকভােব যেন বুঝেত পের যায় প্রিয়তা। দুহােত আমার হাত রেখে আলত কের চাপ দেয়। সে সময় কাউেক বেল িদেত হয়না কতটা িনর্ভরতায়,কতটা বিশ্বাসে এভােব আঁকেড় ধরা যায়। প্রিয়তা আমােক বিশ্বাস কের,এক ভালবাসার বুনেন বঁেধে িনেয়েছ ও আমােক। এ ভালবাসা অগ্রাহ্য করা সম্ভব হয়না কোন পুরুষের পক্ষে। আিমও পািরনা। আমারও ইচ্ছে হয় প্রিয়তার খোলক চুেল হািরেয় যেতে,চােখর মায়াকাজেলর নকশা লেপ্টে িদেত,প্রগাড়তম কোন ভালবাসায় ছোট্ট দুপােয়র নুপুের পরশ িনেয় আমােদর দুরুমের সুখ স্বপ্ন দেখতে । িকন্তু কেন যেন মিলনই থেকে যায় ইচ্ছেরা । মেয়টা মাথা িনচু কেরচেল যাচ্ছে। িপছেন একবােরা তাকায়িন,হয়ত ওর কান্না দেখেত পাব বেল। আমার িচতকার কের বলেত ইচ্ছে হয়,প্রিয়তা,আমি তোমার কান্না দেখেত চাই,রমনীর অশ্রুতে িনেজেক অনুভব করেত চাই,িকন্তু কোন িদনই িকছু করা হয়না। আজও একদল সভ্য দর্শক আসেব,নেড়েচেড়ে দেখে যােব আমার প্রিয়তােক। আিম জািন আজও আেগর মত সামেল নেবে প্রিয়তা,আমার প্রিয়তা। তেব সামেল না নেয়াটাই বাধহয় ভাল। বারবার প্রিয়তার সামেন কাপুরুষ হেত হয় আমােক,হয়ত প্রিয়তােক ভালবািস বেলই। আমার মত চাল চুেলাহীন মানুেষর হােত হাত রেখে পথ চলতে চাওয়া অলীক প্রার্থনা। হয়ত প্রিয়তাও একিদন স্বপ্নিল না হেয় বাস্তিবক হেয় উঠেব,না চাইেলও হেত হেব। প্রিয়তােক িবিলেয় িদেত খুব কষ্ট হয় আমার । মেন হয় এই মেয়ে ছাড়া অপুর্ন আিম। আসেল বড় সংকীর্ণমনা আমরা। জিবনটাকে বড় সংকির্ণ করে ফেলি। ছক বাঁধা এক বৃত্তের ভেতরেই আমাদের জগত। কেন্দ্র,ব্যাস আর পরিধি নিয়েই মেতে আছি। আমাদের ভালবাসার সাম্রাজ্যটাও তাই বৃত্তের পরিধিতেই আবদ্ধ থাকে। প্রিয়তার সুখটাও এভাবে হয়ত হারিয়ে গেছে বৃত্তের কোন ক্ষুদ্র রেডিয়ানে অথবা পাই এর কোন অনুপাতে। জিবনটাকে গণিতের ছকে ফেলা বোকামি,তবুও আমরা হিসেব কষে যাই,চাওয়া পাওয়ার হিসেব,পুর্ণতার হিসেব। হয়ত এইসব হিসেবের ফাঁকে আমার প্রিয়তার ভালবাসার দশমিক অংশ হিসেবের উর্ধ্বেই থেকে যায়।

৩.

বাসায় ঢুকতেই দেখি মায়া বিষন্ন মনে বারান্দার এক চিলতে সূর্যের আলোর সাথে চড়ুইভাতি করছে। হয়ত আজো মায়ের সাথে কোন অপার্থিব বিষয়ে পার্থিব বিবাদ হয়েছে। আমার এই বোনটা পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম বোন। ভাগ্য বলে কিছু থাকলে আমি ভাগ্য বান মায়ার মত বোন পেয়ে। মেয়ে হিসেবে মায়ার আবদার খুব কম,চাওয়া নিয়ে ওর অনুভূতি নিস্পৃহ। আমি ওকে কোনদিন সাজতে দেখিনি। অন্য মেয়েরা যখন শখের প্রলেপে আবৃত হয়,তখন আমার বোনটা ওর ফুলের বাগানে ফুলগুলোর সাথে নির্লিপ্ততার গল্প জুড়ে দেয়। খুব ছোট থাকতেই ও কিরকম একাকী করে রেখেছে নিজেকে। ছোটবেলায় একবার ফেরিওয়ালার চুড়ি দেখে কিনতে চেয়েছিল মায়া,আমি বাবার পকেট থেকে টাকা চুরি করে কিনে দিয়েছিলাম। সেদিন বাবা প্রচন্ড মেরেছিল আমাকে,চুড়ির জন্যে নয়,বরং চুরির জন্যেই মেরে ছিল বাবা। মায়া সেদিন মায়ের পিছনে নিরবে সব দেখেছিল,তারপর থেকে মায়া কোনদিন আমার কাছে চায়নি। হয়ত সেই ছোটবেলাতেই চাহিদা,শখ,আহ্লাদের স্থানে বড় একটা দেয়াল তুলে দিয়েছিল ও। আমার খুব ইচ্ছে করছে মায়ার সাথে সূর্যাস্ত দেখতে,তবু আমি দাঁড়িয়ে থাকি দরজার আড়ালে। সব ভালবাসা প্রকাশ করতে হয়না,হয়তবা করার দরকার ও হয়না। ভালবাসা আমাদের প্রতি প্রত্যাশা বাড়িয়ে দেয়। আমি প্রত্যাশা চাইনা,অনুভূতিহীন হয়ে থাকতে চাই। কিন্ত আমাদের এরকম ভালবাসার মাঝেই থাকতে হয়,এক সময় প্রত্যাশা অপ্রাপ্তির সাথে মানিয়ে নেই। বাস্তবতার সাথে মানিয়ে নিতে কোথায় যেন শখ,স্বপ্ন,আবেগের সুতোগুলো ছিড়ে হারিয়ে যায়। আমরা বড় যান্ত্রিক হয়ে যাই এই নাগরিকতায়। বন্দ্বী লাগে নিজেদের,দায়িত্ব,কর্তব্য না পালন করার কষ্টটা খুব তীব্র। ভালবাসা পাওয়ার চেয়ে ভালবাসতে না পারার জ্বালা বেশি। হয়ত প্রকৃতিও আমাদের ভাই বোনের দূরত্ব পছন্দ করে। তাই হয়ত আমার বোনটাও পিছন ফিরে তাকায় না,আমিও সরে যাই দরজার ওপাঁশ থেকে। নিস্তব্ধের না বলা ভালবাসা স্পর্শ করে যায় আমাদের সম্পর্কের স্মৃতিগুলোকে।

৪.

বাবার সাথে পেনশনের টাকা তুলতে এসেছি। বাবার আয়ের বিকল্প পথ এটা,এপেনডিক্স অপারেশনের পরপরই বাবা সরকারি চাকরি বাদ দিয়ে এন জি ও তে ঢুকেন। আমার বাবা খুব কঠোর ধরণের মানুষ,তার আত্বসম্মানবোধটা একটু বেশি রকমের বেশি। আমাদের পরিবার যে খুব একটা স্বচ্ছল তা না,আবার দিন আনতে পান্তা ফুরোয় এরকম অবস্থাও হয়নি কোনদিন,তবুও আমাদের পরিবারে শখের অবস্থান সবসময় প্রয়োজনের বিপ্রতীপ। বাবাই একা হাতে সামলে রেখেছেন আমাদের প্রয়োজন,হয়ত ভবিষ্যতেও রাখবেন। আমার বাবা কঠিন হলেও,তার ভেতরের বাবার মাঝে এক ধরণের বন্ধুত্বের,মমত্বের আবছায়া রয়েছে। এই আবছায়াটা কখনই কাঠিন্যের সাথে পেরে উঠেনা,বাবাই উঠতে দেননি। হয়ত ভয় পেতেন ভালবাসার প্রকাশটা হয়ত চাহিদা বাড়িয়ে দিবে আমাদের। একারণেই বাবা ছেলের সম্পর্কে একটা ফাঁক রয়ে গেছে ছোটবেলা থেকেই। হয়ত দূরত্বটা এখান থেকেই শুরু। আমি সবার কথা জানিনা,তবে আমাদের সবার মাঝেই একটা জিনিস মিল,পরিবারের প্রতি কিভাবে যেন এক দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যায়। আমরা চাইনা,তবুও হয়ে যায়। আমার মাকে আমি কোনদিন মা দিবসের শুভেচ্ছা জানাইনি,বাবাকেও কোনদিন কৃতজ্ঞতা জানাতে পারিনি। কেনই যেন পারিনা আমরা,বাস্তবটা আসলেই ভিন্ন। দূরত্বটা আমরাও বুঝি,কিন্তু কমানো যায়না কেন যেন। চিরায়ত ভালবাসাটা প্রকাশ করতে স্বাছন্দ্যবোধ করিনা,হয়ত এ কারনেই ভালবাসাটা প্রকৃত হয়। যে ভালবাসার প্রতিক্ষণে স্মরণ করিয়ে দিতে হয় তা হয়ত ভালবাসাই না,নিছক প্রাপ্তির আকাঙ্খা।ভালবাসাগুলো বলে দিতে হয়না,অনুভবে,অস্তিত্ব সাথেই টিকে থাকে তা। আমার মা বাবার সাথেও সম্পর্ক হয়ত এরকমই হয়ে গেছে। দূরত্বতেই হয়ত এটা কার্যকরী। মাঝে মাঝে অবাক লাগে জীবনের এই জটিল রসায়ন নিয়ে ভাবতে। নি:সন্দেহে একজন স্রষ্টা আছেন,যিনি নিপূণহাতে রসায়নের এই জটিল বিক্রিয়াগুলো নিয়ন্ত্রন করেন। মানুষের বিবর্তন হচ্ছে,যান্ত্রিকতা বাড়ছে,তবুও রাত শেষে বাড়ি ফিরলে এই যান্ত্রিকতা মায়ের আচলে লুকিয়ে যায়। কিভাবে যেন এগুলো হয়ে যায়,ব্যাখ্যাতীত এই ঘটনাকে ঘিড়েই আবর্তিত হই আমরা। এজন্যেই শত সহস্র অপ্রাপ্তিতে নিজেকে বড় সুখি লাগে আমার্। এই সুখটাকে কোনদিন হারাতে চাইনা আমি।

৫.

আমি তন্ময় হয়ে বসে আছি ছাদে। বাড়িওয়ালার শখের পায়রার বাক বাকুম ডাক শুনছি। আজ একটা বিশেষ দিন,অনেকদিন পর চাকরী পেলাম আজ। দীর্ঘ প্রতীক্ষার সমাপ্তি হয়ত,বেতন ভালোই,হয়ে যাবে আমার সুখগুলো কিনতে। নিজেকে কিছুটা দামী দামী মনে হচ্ছে আজ।হটাত করেই সবার আড়ালের আমিই যেন আজ মধ্যমণি হয়ে গেছি। আজকের সূর্যাস্ত আমাকে তার সকল আভায় রাঙ্গিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। বড্ড অদিনেই সুখবর পেলাম আমি। ঊনত্রিশ বসন্ত পেরিয়ে আসা আজকের সন্ধ্যায় সেই নয় মাস আগে ফিরে যেতে ইচ্ছে করছে। প্রিয়তার অভাবটা আজ বেরসিকের মত হাসছে আমাকে দেখে। একটুকরো খুশি ভাগ করে নিতে আজ বড় দরকার ছিল মেয়েটার্। এইত গত বছর সকল.বাঁধাকে দূরে সরিয়ে লাল বধূর সাজে সেজেছিল প্রিয়তা,আমিও গিয়েছিলাম সেদিন। সেই বর্ষার দিনে দুহাতের কদম কানে গুজে দিয়ে এসেছিলাম। সাধারণ গন্ডি থেকে অসাধারণ হতে পারেনি প্রিয়তা। হয়ত হতে চাওয়ার ইচ্ছেটা মরে গিয়েছিল ততদিনে। আমিও তো অসাধারণ নই যে আমাদের ভালবাসাটা কালিক সমাপ্তির ঊর্ধে থাকবে। হয়ত সেটা ভালবাসাই ছিলনা। বাস্তবতার কাছে শুধু এক টুকরো অবাস্তব চাওয়া। মায়ারও বিয়ে হয়ে গেল মাস দুয়েক আগে। আমার বোনটা হয়ত সেই সংসারেও নিজেকে গুটিয়েই রাখবে। প্রাপ্তির খাতাটা হয়ত সে কোনদিন সেলাইই করবে না। আসলে মায়া,প্রিয়তা কাওকেই দোষ দেয়া যায়না। প্রকৃতি মাঝে মাঝে আমাদের সুখের লোভ দেখায়। আমরাও ভুলে যাই পরণতি । কিন্তু সুখটা যেদিন হারাতে শুরু করে সেদিন আর বাস্তবতা স্বপ্ন বলে কিছু দেখায় না। বড্ড সাদাকালো করে দেয় জীবনটাকে। মধ্যবিত্তের ছকের ভেতর থেকে বেরুতে পারিনি আমিও,তাইত মা চাকরির খবরে পাত্রীর কথা তুললে নিরবই ছিলাম আমি। ছকের জীবনটায় বাধা পরে গেছি আমরা,এই জীবনটাতেই সুখ খুঁজে নিতে চাই।আমিযে খুব অসুখি তা না,সুখেই আছি আমি। চারপাশের প্রাপ্তির খাতার দশমিক অংশটাও সুখ দিয়ে যায় আমাকে। অতৃপ্তির সুখ বিস্মিত করে,অবাক হয়ে ভাবি সুখটা আমাদের মাঝেই কত সহজে লুকিয়ে থাকে। শুধু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে তা চোখে পড়েনা,আমরা ফেলতেই চাইনা। আমরা তুলনায় আটকে থাকি,সুখের তুলনাটা খুব সহজেই করে ফেলি,কিন্তু দু:খটা? কষ্ট পাওয়ার শত কারণের মাঝে সেই কষ্টে হাসার কারণ থাকে সহস্রাধিক। ভীষন সুখি মানুষ আমি,সুখ আমাকে একটু বেশীই ভালবাসে,তাইত আলিঙ্গন করে নেয় আমাকে। মৃদু হাসি আমি। সূর্য ডুবে যাচ্ছে,তার সকল আলো দিয়ে আধারে রেখে যাচ্ছে আমাদের্। আচ্ছা রাতটা কেন আসে?সুখের খাতার সাদা পাতা দেখতে,নাকি আদিমতার নেশাটা লুকিয়ে দিতে?হয়ত কোন চাঁপা আর্তনাদ কেই পথ খুঁজে দিয়ে যায় লাল সূর্য। রাতটা বড় নি:সঙ্গ কাটে আমার্। একমাত্র রাতেই আমার আমির সাথে পরিচিত হই আমি। আজ রাতটা শুধু আমার জন্যে। চাঁপা আর্তনাদ কে বালিশ চাপা দিয়েই ঘুমোতে যাব আমি। হয়ত ঘুমাতে পারব,অথবা বালিশে কোন বর্ষার দমকা নামবে। আসলে আমরা অনিশ্চয়তার মাঝে বাস করি। এই অনিশ্চয়তার জন্যেই হয়ত প্রাপ্তির সুখটা এত দামী। একজন অতি সাধারণ সাদামাটা আমি যে এই অনিশ্চয়তার সম্ভাব্যতার ভগ্নাংশে বেঁচে থাকি।

 

(শেষ)

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত