মৃত জীবন

মৃত জীবন

“বুবু আমি ওকে ডিভোর্স দেব।” সমাপ্তির কথা শুনে চমকে উঠে সূচনা। সামনে বসা এই পাথরের প্রতিমাটি কী আসলেই তার আদরের ছোট বোন?
সাত সকালে কলিংবেলের শব্দে ধড়ফড় করে জেগে উঠে সূচনা। প্রথমে বুঝতেই পারেনি যে ওটা কলিংবেলের শব্দ। ভেবেছিল এটাও বুঝি স্বপ্নেরই অংশ। যেই স্বপ্নটা ও প্রায়ই দেখে। এক বছরের টুকুকে কোলে নিয়ে সমুদ্রের পাড়ে দাড়িয়ে আছে ও, বিশাল সব ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। আস্তে আস্তে ঢেউ গুলো বড় হতে থাকে। প্রচণ্ড ভয়ে নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে ওর। এক সময় ঢেউ গুলো ওদের দুজনকে ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে। সূচনা সাঁতার জানে না। ডুবে যেতে যেতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে টুকুকে। ঠিক সেই সময় দূরে দাড়িয়ে থাকা তমালকে দেখতে পায় ও। “একি, তমাল কেন হা হা করে হাসছে?” সেই হাসির শব্দে আকাশ বাতাস কাঁপতে থাকে, চাপা পড়ে যায় সমুদ্রের শো শো গর্জন। ডুবে যাওয়ার আগ মুহূর্তে ও দেখতে পায় তমালের হাতে হাত রেখে দাড়িয়ে আছে একটি মেয়ে। মেয়েটির মুখ কোনদিন দেখতে পায় না ও। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে একই স্বপ্ন। আজ ডুবে যাওয়ার আগেই কলিং বেলের শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল।
কয়েক মুহূর্ত লাগলো বুঝতে এটা স্বপ্ন ছিল, ও জেগে উঠেছে। আর সেটা বুঝতেই এক রাশ স্বস্তি। হাল্কা গোলাপি নাইটির গলার কাছটা ঘেমে ভিজে গেছে। তমাল পাশেই অঘোরে ঘুমাচ্ছে, চল্লিশ পেড়িয়ে এখনো ধরে রেখেছে সাতাশের তারুণ্য। কি ভেবে বারান্দায় পা বাড়ায় সূচনা। ভোরের আলো ভাল করে ফোটেনি। সলজ্জ বধূর মতো ঘোমটার ফাঁক দিয়ে একটু আধটু উঁকি দিচ্ছে সূর্যের আলো। এই সময়টা বড্ড ভালো লাগে সূচনার। ঘুঘুর ডানায় লুকিয়ে রাখা নরম আলো মিশে আছে তরল আন্ধকারে। চারদিক কি ভীষণ পবিত্র, অথচ রহস্যময়। বুক ভরে সেই পবিত্র বাতাসে নিঃশ্বাস নেয় সূচনা। হাত বাড়িয়ে সেই আলো আধারিটাকে আলতো করে ছুঁতে ইচ্ছা করে। এই নির্জনতাটুকু একান্তই ওর। ওর একান্ত নির্জনতাকে খান খান করে ভেঙ্গে দিয়ে কলিং বেল বেজে উঠল, “ওহ এই শব্দেই তাহলে এতো সকালে ঘুম ভেঙ্গেছে আজ। এতো সকালে কে এলো?”
দরজা খুলে সমাপ্তিকে দেখে ভীষণ অবাক হয়েছে সূচনা। ভয়ও লাগছে একটু। হটাত করে কোন খবর না দিয়ে নাইট কোচে ঢাকা আসার মেয়ে সে না। সূচনা যেমন এলো মেলো, অস্থির, আবেগি, সমাপ্তি ঠিক তার উল্টো। ভীষণ ধীর স্থির, বাস্তববাদী মেয়ে। তবে বড্ড জেদি। সূচনা বাবা, মায়ের বড় আদরের মেয়ে। বাবার নাকি এক ডজন মেয়ের শখ ছিল। আদর করে প্রথম মেয়ের নাম রেখেছিলেন সূচনা। মাকে নাকি বলতেন “দেখ না মাত্র শুরু করলাম, ঠিক ঠিক আমার এক ডজন মেয়ে হবে।” মা কপট রাগ দেখাতেন। ওদের সেই পাগল বাবা সমাপ্তিকে পেটে রেখে ত্রিশ বছরের মাকে বিধবা করে হটাত করেই একদিন বিনা নোটিশে ওপাড়ে চলে গেলেন। সূচনার বয়স তখন দশ। সমাপ্তি বাবাকে দেখেনি। দুটো মেয়ে নিয়ে হাবুডুবু খাচ্ছিলেন যুবতী মা। তার উপরে সূচনাটার গড়ন বাড়ন্ত, পনেরতেই মনে হতো আঠার। চেহারায় বেশ চটক আছে, মেয়েটা একটু বোকাও। এই মেয়ে নিয়ে মায়ের রাতের ঘুম হারাম হয়ে যাচ্ছিল। বাড়িওয়ালার বখাটে ছেলের হাত থেকে মেয়েকে বাঁচানোর জন্যই সাত পাঁচ না ভেবে তমালের সাথে বিয়েতে রাজি হয়ে যান তিনি। তমাল দেখতে বেশ হ্যান্ডসাম, চা বাগানে চাকরি করে। আঠারোর সূচনার মন গলাতে তাকে একটুও কসরত করতে হয় নি।
সমাপ্তি তার মতো না। বুদ্ধি রেখে চলে। সাহসী, শান্ত এই মেয়েটাকে পারার ছেলেরাও ঘাটাতে সাহস পায় না। মেয়েটার মধ্যে কোথায় যেন একটু পুরুষালী ভাব আছে। আড়ালে তাকে ওরা ডাকে “খাণ্ডারনি।” সে দেখতেও খুব সাদা মাটা। ওদের মাও যেন জানতেন এই মেয়েটা তার ছেলের মতোই। তাছাড়া ওর পড়া লেখায় আগ্রহ আছে। তাই মাস্টার্সের আগে ওর বিয়ের কথা বলতে সাহসই পাননি। প্রস্তাবও যে খুব বেশী আসছিল তা না। ও স্কুলের চাকরিটা পাওয়ার পর বহু কষ্টে ওদের জেলা শহরের উকিল সেলিমের সাথে বিয়ের ব্যাবস্থা হয়। সেলিমদের যৌথ পরিবার। ওর বৃদ্ধা মা আর বড় ভাবী ওর সাথেই থাকে, ভাই শয্যাশায়ী দীর্ঘ দিন ধরে। হয়তো সমাপ্তির চাকরিটাই বিয়ের বাজারে ওর দাম বাড়িয়েছিল।
মাত্র দু মাস আগে ওর বিয়ে হয়েছে, বলতে গেলে এখনো গায়ে হলুদ মেহেদির গন্ধ। ভোরের আধো আলো ছায়াতে ওকে কেমন অপার্থিব দেখাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল ও যেন এই জগতে নেই। ডিভোর্সের কথা শুনে চমকে উঠে বোনের হাত দুটো নিজের হাতে টেনে নেয় সূচনা। কি ভীষণ ঠাণ্ডা হাত দুটো। ওর চোখে কোন জল নেই। “কি হয়েছে সমু তোর?” “ঝগড়া হয়েছে?” বলতে গিয়েও থেমে গেল সূচনা ওর চোখের দিকে তাকিয়ে।
“আমি ওকে খুন করতাম, করতে রুচি হল না। তাই বিদায় দিয়ে চলে এসেছি ঘেন্নায়। ” একটু থেমে বলতে শুরু করে সমাপ্তি,
“কাল বিকালে স্কুল একটু আগে ছুটি হোল। বাসার সামনে এসে দেখি ওর মোটর সাইকেল। একটু অবাক হলাম, এসময়ে বাসায়? বেডরুমে পা দিয়ে আমার সমস্ত গা রি রি করে উঠলো। সেলিম আর বড় ভাবী ………। আমাকে দেখে লাফ দিয়ে উঠে প্যান্ট ………।” বুবু আমি সাথে সাথে বেড়িয়ে এসেছি। আমি আর ফিরে যাব না। একাই থাকবো।
সূচনার গা কেমন অবশ হয়ে যাচ্ছে। শুনতে শুনতে ও চলে গেল আজ থেকে পনর বছর আগের এক সন্ধ্যায়। এক বছরের টুকুকে ঘুম পাড়িয়ে মালতীকে কাছে বসিয়ে ও গিয়েছিল পাশের বাংলোর মিসেস খানের সাথে আড্ডা দিতে। মিসেস খান সেদিন রাতের ট্রেনে ঢাকা যাবেন। তাই ঘণ্টা দুয়েকের আড্ডাকে আধা ঘণ্টায় ইতি টেনে ফিরে এসেছিল বাংলোয়। সন্ধ্যা যাই যাই করছে, কিনতু বাংলোটা অন্ধকার, কেউ বাতি জ্বালে নি কেন এখনো? ক্রিবে টুকু কাঁদছে গলা ফাটিয়ে। তার পাশে ওর বিছানায় মালতীর শ্যামলা বুকে তমাল ….. ওদের কোনদিকে কোন খেয়াল নেই। মালতী ওর বছর দুয়েকের ছোট। ওর দেহের প্রতিটা বাঁকে আছে সর্বনাশা মাদকতা, শ্যামলা ত্বকে চিক চিক করে লাবণ্য। মেয়েটার চোখে আগুণ, হাসিটা আরও বেশী জ্বালা জ্বালা। সৌন্দর্যের কমতি তো সূচনারও নেই, তবে ওর সৌন্দর্যে আগুণ নেই। সেই সন্ধ্যায় সমস্ত অপমান মাথায় নিয়ে থেকে গিয়েছিল সূচনা। ওর নিজের জন্য, তার চেয়েও বেশী টুকুর জন্য। ওর যে যাওয়ার কোন জায়গা নেই, বৃদ্ধা মা তখনো কোন মতে সমাপ্তির পড়া লেখা চালাচ্ছে। ভাগ্যিস মা সেই যুদ্ধটা করেছিল। তাইতো আজ সমাপ্তি মাথা উঁচু করে বেড়িয়ে আসতে পেরেছে। নিজের পায়ে দাঁড়াবে বলে, বেঁচে থাকবে বলে স্বপ্ন দেখছে। নাহলে তাকেও সূচনার মতো একটা মৃত জীবন কাটাতে হতো।

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত