শেষ স্মৃতি

শেষ স্মৃতি

আজ থেকে বছর চারেক আগে, যখন আমি পড়ালেখার প্রয়োজনীয় অধ্যায় চুকিয়ে মোটামুটি একটা ৫ ডিজিটের চাকরি খুজছিলাম। ফ্যামিলির ছোট ছেলে হিসেবে আমার কাধে কোনো দায়িত্ব না থাকলে ও, নিজের জীবন টা তো নিজের ই। তেমন ই এক চাকরি অন্বেষণে যাওয়ার পথে নিলার সাথে আমার পরিচয়। মেয়েটার মুখ দেখেই বুঝেছিলাম “কিউতের দিব্বা” টাইপ কথা গুলার আসলে ও বাস্তবে অবয়ব হয়। কাধে মেরুন কালারের ব্যাগ আর হাতে ছোট্ট একটা খাম নিয়ে মেয়েটা অপেক্ষা করছিলো।

আমি সচরাচর কাউকে ই এমন খুটে খুটে দেখি না। তবে সেদিন আমার জায়গায় যে ই হতো নীলা কে ওইভাবে হয়তো দেখে যেতো আমি যখন কল্পণা রাজ্যে বিচরণ করছিলাম হঠাৎ ই মনে পড়লো আমার তো ইন্টার্ভিউ আছে। গাড়ি থামানোর জন্য হাত দিতেই সামনে একটা প্রাইভেট কার টাইপ একটা গাড়ি এসে থামলো। আমি যেই দরজা খুলতে যাবো, ও পাশ থেকে নিলা গাড়িতে উঠলো আর ড্রাইভার আমাকে বললো, ভাই আপনি অন্য গাড়ি দিয়ে যান। তখন আমার মাথায় স্ফুলিঙ্গ ঝড়ছিলো, আমার সামনে থাকা সুন্দরীর দিকে বিন্দুমাত্র ভ্রুক্ষেপ না করে ই ড্রাইভার কে বললাম, আমি গাড়ি থামালাম, আর উনি উঠে যাবেন?

তার পর, সে চির প্রতিক্ষীত রমণী নিলা আমার দিকে থাকিয়ে বললো, গাড়িটা আমার। যদি আপ্নে চান আপনাকে লিফট দিতে পারি। নো প্রব্লেম।  আমি তখন কি বলবো বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমতা আমতা করে বললাম, নাহ ঠিক আছে আমি চলে যাবো।  নিলা হঠাৎ জোরপূর্বক দাবি খাটিয়ে ই বললো, আরে আসুন না, কোনো সমস্যা নাই। আমি গাড়িতে উঠলাম কিন্তু একদম নিশ্চুপ রয়েই বসে। মৌনতা কাটতে নিলাই নিজ থেকে কথা বলতে লাগলো। আমার নাম জিজ্ঞাসা করার পর অনন্য সেই রমণী ও সেই অতি সাধারণ প্রশ্ন টি করলো, আমি কি করি ইদানীং ইচ্ছা হয় গলায় বোর্ড লাগিয়ে বের হই যে আমি চাকরি খুজি।

যাইহোক নিলার সাথে আমার পরিচয় ও হয় নি ওর সাথে রাগা টা বাজে দেখায় তাই যথারিথি উত্তর দিলাম সবেমাত্র এম এ শেষ করলাম। এখন চাকরি খুজি, ইভেন এখন ই একটা ইন্টার্ভিউ আছে। নিলা আমাকে পরে আর কোনো প্রশ্ন করলো না, আমি গন্তব্যে এসে গাড়ি থেকে নেমে “থ্যাংকস “এত টুকু বলেই চলে গেলাম। সেদিন অনেক জামেলার কারণে আমার মন একটি বারের জন্য ও নিলার কথা মাথায় আনতে পারে নি । রাত প্রায় ২ টা হবে, হঠাৎ ই একটা অচেনা নাম্বার থেকে কল আসলো। আমি আধঘুমা অবস্থায় কল টা ধরতেই, ও পাশ থেকে আওয়াজ আসলো..” আসসালামুআলাইকুম আমি নিলা আমি আশ্চর্য হয়ে প্রশ্ন করলাম,

: আপনি আমার নাম্বার পেলেন কিভবে?
: মি. আবির, তাড়াহুড়ায় তো আপনি নিজের বায়ো ডাটার একটা কপি আমার গাড়িতে রেখে গেছেন।
: ওহ, খেয়াল করি নি। এগুলা অনেক কপি নিয়ে ঘুরা লাগে তো….
: হুহ, আচ্ছা আমি একটা রিকুয়েস্ট করলে রাখবেন?
: না রাখার মতো করবেন না অবশ্যই…
: আমার সাথে আগামীকাল, দেখা করতে পারবেন সকাল ৭ টায়, কুয়াশার মধ্যে?
: আগামীকাল তো আমার ইন্টার্ভিউ, আচ্ছা পরশু হবে।
: ঠিক আছে, পরশু। তাইলে এখন ঘুমান। গুড নাইট।
: আচ্ছা গুড নাইট।

ঐদিন রাত, আমি শুধু একটাই কথা ভাবতেছিলাম অপরিচিত একটা মেয়ে একদিনের সাক্ষাতে আমার সাথে দেখা করতে চায় ব্যাপার কি? ২ দিন পর ঠিক সকাল ৬:৫৫ তে আমি হাজির, গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে একদম সাধারণ বেশে। হঠাৎ ই দেখি আমার সামনে আকাশী নীল একটা শাড়ি পড়ে নীলা আমার সামনে, হাতে ২ টা সূর্যমুখী ফুল, চুল গুলো কুয়াশার মধ্যে ও স্নিগ্ধ আর উড়ো উড়ো মনে হচ্ছিল আমার কাছে এসেই শুভ সকাল বলে সূর্যমুখী ফুল টা আমার হাতে ধরিয়ে দিলো তার মুখ টার উজ্জ্বলতা কমে গেছে দেখে বললাম

:কি হয়েছে আপনার, চেহারা এত্ত মলিন কেনো?
: আমি ভেবেছিলাম, আপনি ও আমার জন্য ফুল বা কিচ্ছু নিয়ে আসবেন।
: ওহ, আসলে আমি বুঝতে পারি নি এভাবে কারো সাথে ভোরবেলা হঠাৎ দেখা করতে আসলে কি করা লাগে…
: হইছে হইছে আর মুডি হতে হবে না। চলেন কোথাও গিয়ে বসি,
: এখন কোথায় গিয়ে বসবেন।
: আপনার এসব চিন্তা করা লাগবে না, ব্যবস্থা আমি করে রাখছি।

তারপর নীলা সামনে আর আমি তার পিছে পিছে গেলাম একটা পার্ক এর রেস্টুরেন্ট এ। আমরা যখন সামনে সামনি বসে, নীলা আমার দিক থেকে চোখ টা ও ফিরিয়ে নিচ্ছে না। আমি স্বভাবতই ই কথা বলতে বলতে মানুষের মনে বিরক্তির সৃষ্টি করে দিতাম। কিন্তু ঐদিন কেনো জানি কথাই বের হচ্ছিলো না হয়তো নীলার কথা গুলা শুনতে অনেক ভালো লাগছিলো তাই হঠাৎ ই নীলা মাথা ঘুরিয়ে নিচে পড়ে গেলো আমি তাড়াতাড়ি করে ওকে কোলে তুলে কোনোমতে হাসপাতালে নিয়ে গেলাম নীলার ফোন থেকে ওর বাসায় কল করে ইনফর্ম করার কিছু পর ই নীলার ভাই এসে হাজির তারপর যে খবর টা শুনলাম আমার জীবনের মোড় ঘুরে দেওয়ার ক্ষেত্রে সেই খবর টাই ছিলো সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ।

নীলার ভাইর কাছ থেকে জানতে পারলাম নীলার লাং ক্যান্সার। ঐ মুহুর্তেই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম। এত্ত সুন্দর একটা মেয়ে কিন্তু তবুও আর ৫ টা মানুষের মতো তার বাচার অধিকার নাই। বিধাতা তার জীবন কুপির জ্বালানী ফুরিয়ে দিয়েছেন। নীলার হাতে খুব বেশি একটা সময় নাই। কিন্তু নীলা এই ব্যাপারে মোটেও কিচ্ছু জানে না। ওর ভাইয়ার কাছ থেকে জানতে পারলাম বাবা মা হারানোর পর উনি ই নীলার একমাত্র অভিভাবক। সেদিন কেনো জানি না অন্যরকম একটা শিহরণ বয়ে চলে গেলো আমার গায়ে। পরক্ষণেই আমি ওর ভাই এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলাম। আমার আজ ও মনে আছে বাড়ির ছাদে সারা টা রাত আমি জেগেছিলাম ঐদিন।

মনের ভিতর কিসের যেনো একটা হাহুতাশ ছিলো। ৩ দিন পরে একটা কুরিয়ার সার্ভিস এ করে খবর এলো আমার চাকরির সংবাদের। চাকরির প্রথম মাস এ ট্রেনিং এর জন্য বাইরে যেতে হবে তাই পুরো একমাস আর নীলার খোজ করা হয় নি।  ১ মাস পর, আবারো সেই জায়গায় যেখানে সকাল ৭ টায় কুয়াশার মধ্যে দেখা করেছিলাম অই খান টায় আমি কোনো এক দরকারে দাঁড়িয়ে। আশা করি নি নীলার সাথে আর দেখা হবে। হঠাৎ করে কে যেনো পিছন থেকে আমার চোখে জড়িয়ে ধরলো। হাত টা ধরতেই আমার বুঝতে দেরী হলো না এটা নীলা।

: কি মিস্টার? কই ছিলেন আপনি এত্তদিন? ফোন এ ট্রাই করে ও পেলাম না।
: নাহ আসলে, আমার নতুন চাকরি হয়েছে তো। তাই ১ মাস ট্রেনিং এ বাইরে যেতে হইছিলো।
: গুড নিউজ শুনাইলেন মিষ্টি মুখ করাবেন না। আচ্ছা আপনি কি আসলে ই এত্ত নিরস, নাকি কিচ্ছু হয়েছে আপনার?
: আরে নাহ, তা হতে যাবে কেনো চলুন কোথাও বসি গিয়ে।

তারপর ১ দিন ২ দিন করে নীলার সাথে দেখা সাক্ষাত কথা বার্তা বেড়েই চলছে। আমি বুঝতে পারতেছিলাম নীলার প্রতি আমি দূর্বল হয়ে পড়ছি দিন দিন। নিজের মন কে শক্ত করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়েই নিলাম। একদিন বিকালে নীলার ভাইয়ার সাথে কথা বলতে গেলাম আমার আর নীলার ব্যাপারে। ওর ভাই ব্যাপার টা শুনে নরমালী নিতে পারলেন না। কারণ উনার ব্যাপারে উনি খুব ই রক্ষণশীল আর উনি চাইতেন না আমি আমার জীবনের সাথে পৃথিবীর এই ক্ষণস্থায়ী মেহমান কে জড়িয়ে নেই। আমি তবুও অনেক রিকুয়েস্ট করে নীলার ভাই কে বুঝালাম। এখন শুধু নীলার মতামত নিতে পারলে ই হলো।

একদিন সন্ধ্যাবেলা নীলাকে না বলেই ঘুরতে নিয়ে গেলাম একটা চমৎকার জায়গায়। চারিদিকে ফানুস আর জোনাকির আলোয় মনোরম একটা জায়গা। ঐদিন ই নীলা কে বলে দিলাম আমার মনের কথা। যেই নীলা আমাকে নিরস বলতো তার মুখে চাঞ্চল্য আর চোখে আনন্দের হাসি সত্যি ই ভালো লাগছিলো… তখন একটা কথা ই মনে হচ্ছিলো, এটা জরুরি নয় আমরা কতদিন বাচি, জরুরি হচ্ছে আমরা ঐদিন গুলা তে কেমন করে বাচি তারপর নীলা ও আমার হাত ধরে আমার সাথে পথ চলার সাহস দেখালো। একে একে সব হলো। খুব শীঘ্রই আমাদের বিয়ে টা ও সেরে নিলাম। খুব ভালই যাচ্ছিলো আমাদের দিন কাল, ঠিক যেমন টা একসময় কল্পনা করতাম। রাগী জেদি একটা বউ, যে রাগের মাথায় কড়া কড়া কথা শুনাবে, আর কিছু পরেই বরফের মতো গলে গিয়ে বলবে, দেখো মাথা ঠিক ছিলো না, অগুলা ভুলে যেও।

কিন্তু বিধাতার বিধান যে আর ভাঙা যায় না, বিয়ের ৬ মাস পর চিরতরে নীলা কে হারাতে হয় আমার। আজ ৪ বছর হয়ে গেলো নীলার সাথে আমার প্রথম দেখা হওয়ার। আজ ও আমি সেই যায়গা টা দাঁড়িয়ে। সকাল ৭ টায় কুয়াশার মাঝে। নীলার জন্য হাতে সূর্যমুখী ফুল টা নিয়ে আমি অপেক্ষমান।
জানি নীলা আসবে না। তবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত নীলার স্মৃতি নিয়ে এভাবে ই চলে যাবে আমার জীবন….

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত