শেষ প্রহরের গল্প

শেষ প্রহরের গল্প

মুনতাসির তনয় শততমবারের মত বিশাল একটা ম্যাসেজ লিখে ব্যাকস্পেস চেপে ধরে তনয় । নেশা লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে সাফার নামের পাশের সবুজ বৃত্তটার দিকে । বৃত্তটা উধাও হয়ে যায় কিছুক্ষনের মাঝেই , তখনও নেশাটা কাটেনা ওর । নেশাটা বড্ড যন্ত্রনা দিচ্ছে আজকাল । সামান্য একটা চোখের দেখা থেকে বাচ্চা টাইপের একটা মেয়ের উপরে এত বড় একটা নেশা কল্পনাও করেনি সে ! কিছুক্ষন ওভাবেই বসে থাকা , তারপর ল্যাপটপের ডালা লাগিয়ে উঠে চলে আসা হুট করেই । গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় তনয় । ভীষণ শীত পড়েছে ইট,কাঠ,পাথরের এই শহরে ।

শীতের স্বভাবজাত বিষণ্নতাটুকুও আজকাল স্পর্শ করেনা ওকে । অথচ কবিতা লেখার জন্য শীতের বিষণ্নতা একসময় খুব পছন্দের সাবজেক্ট ছিলো ওর ! লিখতে ভীষন পছন্দ করা ছেলেটার মাথা এখন ফাঁকা হয়ে থাকে একদম ! ল্যাপটপের ডালা জোরের সাথে বন্ধ করে উঠে বারান্দায় দাঁড়ানো , দৈনন্দিন এই রুটিনটার পরিবর্তন হয়না অনেকদিন । অথচ এই দৈনন্দিন রুটিনটাই ওর স্বাভাবিক, উড়ন্ত, ভীষণ তীব্রতার এক জীবনে কতবড় ওলটপালট এনেছে, মেয়েটা কি তা জানে ? জানেনা নিশ্চয় … অথচ শুরুটা অস্বাভাবিক ছিলনা খুব একটা । ভার্সিটি শুরুর দিনগুলোতে ডিপার্টমেন্টের তিন ল্যান্ডিং এর সিঁড়ির দ্বিতীয় ল্যান্ডিং এ যেদিন মেয়েটার সাথে হুট করে দেখা হলো , সামান্য কিছু কথা আর রুমে এসে স্টুডেন্ট লিস্ট থেকে নাম বের করে ফেসবুকে একটা রিকুয়েস্ট পাঠানো ছাড়া খুব বেশি কিছুই হয়নি সেদিন ! শুধু সেদিন না , সেদিনের পর অনেকগুলো দিন কেটে গেছে খুব নিস্পৃহ ভাবে ।

ভীষণ ব্যস্ত , নিস্পৃহ সেইসব দিনে নিজের অজান্তেই সাফার নামটা বুকের বাম পাশটায় কখন বসতে শুরু করেছে , বুঝতেও পারেনি তনয় । ক্লাসরুম আলাদা ছিল , দেখাও হতোনা খুব একটা , দেখেছিল মাঝখানে একবার । ফার্স্ট ইয়ারদের জন্য যাওয়া বাধ্যতামূলক এরকম একটা মিছিলের পাশ দিয়ে যেদিন চলে গেছিলো সাফা , সেইদিন । মুখ চোখ কাল করে কি ভয়টায় না পেয়েছিলো মেয়েটা , মনে পড়তেই ঠোঁটের পাশের সূক্ষ হাসিটা আটকাতে পারেনা তনয় ! সেই ভীত চোখের মেয়েটা তনয়ের কাছে নেশার মত হয়ে গেছে ধীরে ধীরে । তীব্র শীতের এক বিকেলে নাম না জানা কোনো নদীর ধার দিয়ে তার হাত ধরে হাঁটছে এরকম একটা স্বপ্ন তনয় প্রায় দেখতো । প্রায় বাস্তব সেসব স্বপ্নে সুখ সুখ ভাবটা এত প্রবল ভাবে থাকতো , তনয় অনিয়মের চূড়ান্তে যেয়েও , নিয়ম করে অপেক্ষা করত স্বপ্ন গুলোর জন্য কিংবা কে জানে সেই সুখ সুখ ভাবটার জন্য সেই দ্বিতীয় দেখার পর অনেকগুলো দিন পার হয়ে গেছে ।

এর মাঝে শুধু একদিন খুব কাছের এক বান্ধবীকে সাফার ছবি দেখিয়ে সে বলেছিল , মেয়েটা কিন্তু খুব কিউট! বান্ধবীটা ধরে ফেলছিল চট করে , ক্রাশ খাইস নিশ্চয় ! না , না প্রশ্নই আসেনা এত দৃঢ়তার সাথে বান্ধবীকে নাকি নিজেকেই ফাঁকি দিয়েছিল তনয় কে জানে ! বুকের বাম পাশে বসতে থাকা নামটা ভাবিয়েছিল ধীরে ধীরে , পাত্তা দেয়ার সময় তনয় কখনোই পেতনা ! হলে থাকার উড়ন্ত দিনগুলোতে সময় আটকে থাকেনা কোনোভাবেই ! তখন ব্যস্ততাটুকুর পুরোটা জুড়ে কেবল নিজের পৃথিবীটাই ছিল , সেই পৃথিবীটা জুড়ে একসময় কেবল মেয়েটা থাকবে সেটাও কি তনয় ভেবেছিল ! সেমিস্টারের শেষ দিকে এসে ক্লাস,ল্যাব টেস্ট,কুইজ সবকিছুর শেষে প্রায় ২ মাস পর যখন পরীক্ষার আগের বন্ধটা শুরু হয়েছিল , আর দশজনের মতই ক্লান্ত ছিল তনয়ও ।

বাসায় এসে খালি ঘুমিয়েই ছিল প্রায় দুই দিন । কে জানতো সেই ভীষণ ক্লান্তির শেষে পুরোনো লেখালেখির ভূতটা মাথায় চাপবে । আরো অনেকগুলো বারেরমত এইবারও মনে হয়েছিল , দ্বিতীয়বারে মত লেখালেখির শুরুটা সে আসলে কখনই করতে পারবেনা ! প্রায় দুই বছর আগে ছেড়ে দেয়া লেখালেখিটা যে শত চেষ্টাতেও এর আগে শুরু করতে পারেনি ! কে জানে কেন , স্রষ্টার ইচ্ছা ছিল নিশ্চয় , এইবার সে পেরেছিল । প্রায় সাত দিনের চেষ্টাতে একটা ছোটো গল্প লিখেছিল । নাম,নায়িকা ,মেইন ক্যারেক্টার সবই সাফা ! কেন সাফা মেয়েটাই গল্পের সবকিছুতে ছিল,কেন তাকেই গল্পের নায়িকা বানিয়েছিল সেটা পরে অনেক ভেবেও বের করতে পারেনি তনয় ! হুট করে মাথায় এসেছিলো নাকি অনেকদিনের অনভ্যাসে কোনো ক্যারেক্টার মাথায় আসছিল না তাই অবচেতন মনের প্রথম নামটাই সে বেছে নিয়েছে সেইটাও একটা রহস্য ।

একটা ব্যপার অবশ্য ছিল , সাফা নামটা তনয়ের নিজের খুব পছন্দের ছিল , অসম্ভব পছন্দের ! নামটার মাঝে কিছু একটা ছিল , কিছু একটা যেটা তনয় কে আকর্ষণ করত চুম্বকের মত । গল্পটার নাম কিংবা মেইন ক্যারেক্টার সাফার নামে হলেও আসলে সমস্যা ছিলনা খুব একটা , সমস্যা ছিল পুরো গল্পের মেইন ক্যারেক্টারের বর্ণনাতেও তনয় আসলে সাফাকেই কল্পনা করেছে । তাকেই চোখের সামনে রেখে সে পুরো গল্পটা লিখেছে ! সেই কল্পনাতেও একটা খুঁত অবশ্য ছিল , মেয়েটার গালে আসলে টোল পড়তনা কখনই । সেটা অনেক পরে আবিষ্কার করেছিল তনয় ! তবু তনয়ের কল্পনাতে সেই খুঁত এখনও আছে । তনয় সেটা কোনোদিন পরিবর্তনের চেষ্টা করেনি ,করবেও না । খুঁত সহ কিছু কল্পনা থকতে হয় , কল্পনাটুকুতে খূঁত থাকতে পারে , কিন্তু তনয়ের সুখটুকু ছিল নিঁখুত , এক্কেবারে নিঁখুত ! গল্পটা লিখতে লিখতেই তনয় আবিষ্কার করেছিল ওর বুকের বাম পাশটায় গেঁথে যাওয়া সাফা নামটার কথা , নামটার পেছনে লুকিয়ে থাকা একটা মানুষের কথা ! তার মনের অনেক অংশ জুড়েই তখন কেবল সাফা নামের বাচ্চা একটা মানুষের আনাগোনা ।

ছুটে বেড়াতে থাকা সেই বাচ্চা মানুষটার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই তনয় প্রথমবারের মত অনুভব করেছিল,সুখ সুখ অনুভূতিটা । সেই পরবাস্তব সুখ সুখ অনুভূতিটার টানেই কিনা কে জানে,প্রতিদিন সাফার ওয়ালে ঢুকে ওর ছবির দিকে সম্মোহিতের তাকিয়ে থাকাটা তনয়ের কাছে নেশার মত হয়ে গেছিল ! সাফা নামটা কিংবা সাফা মেয়েটার অথবা দুটোরই কি তীব্র নেশাতেই না ডুবেছিল তনয় ! সেই নেশার ঘোরে প্রতিদিন রাতে নীল সাদা দুনিয়ায় সম্মোহিতের মত অপেক্ষা করত সে ! মাঝে মাঝে কথা বলার চেষ্টা করে দেখেছে ,পাত্তা পাইনি খুব একটা ! বেশিরভাগ দিন ম্যাসেজ সিন হইত বাট রিপ্লাই আর পাওয়া হতোনা ! যে দুই একবার ম্যাসেজ সিন করে রিপ্লাই দিয়েছিল , তখনই কথায় কথায় শুনেছিল , মেয়েটা গান করে ! রাজ্যের জড়তা আর ভয় নিয়ে তনয় বলেছিল , শুনাইও একসিন তোমার গান কেন,আমার গানই শুনতে হবে,কেন ! ? নেশা যখন হয়েইছে,সবদিন দিয়েই হোক ! বলেছিল তনয় ।

কিভাবে এতটা নেশা তনয়ের হয়েছিল , কিভাবে মেয়েটা তার অস্তিত্বের মাঝে ঢুকে গেছিল , সেটার আগে পরে অনেক গল্প ছিল ! সেসব না হয় আজকে থাক ,উপন্যাস হয়ে যাবে প্রায় ! সেই নেশাগ্রস্ত চোখে , সম্মোহিত কল্পনায় দিনের পর দিন পার হয়েছে , তনয় শুধু সাফার নেশাতেই ডুবেই গেছে , আরো গভীরে , আরো গভীরে । সেমিস্টার পরীক্ষা হয়েছে , নতুন সেমিস্টারের ক্লাস ও শুরু হয়েছে , শুধু নেশাটার হেরফের হয়নি এতটুকুও ! তারপর হুট করেই যেদিন ক্যাম্পাসের সবচেয়ে উচ্ছন্নে যাওয়া , ভীষণ প্রতিভাবান ছেলেটা ক্যাফের বারান্দায় হাঁটতে হাঁটতে আনমনে বলেছিল অ! ওই মেয়ের তো বয় ফ্রেন্ড অনেকগুলো পরিচিত মুখের ভীড়ে কথাটা তনয় শুনেছিল,ভীষণ নিস্পৃহ ভঙ্গিতে ! অনেকগুলো কাজ হাতে নিয়ে বের হওয়া দিনটাতে জ্বরের উছিলায় কিছু না করেই হলে ফেরত গেছিল তনয় ! আকাশে তখন মেঘ ছিল , জমাট বাঁধা কাল রঙের মেঘ ।

স্রষ্টা প্রকৃতির রঙ কে কিভাবে কিছু কিছু মানুষের খুব কাছাকাছি নিয়ে আসেন সেইটা তনয় কোনোদিনও বুঝতে পারেনি ! উড়ন্তভাবে শুরু হওয়া ভার্সিটি জীবনটা আসলে তনয়ের থেমে গেছে ওখানেই ! বিষণ্নতাটুকু সঙ্গী হয়েছে নিয়ম করে ! গিটারের তারে মাইনর কর্ড গুলোই বেজে যায় প্রতিনিয়ত ! সবচেয়ে প্রিয় মানুষগুলোর সঙ্গও হাসাতে পারেনা অনেকদিন ! মা যেন বুঝতে না পারে সেজন্য নিজের সাথেই অভিনয় করে যেতে হয় প্রতিনিয়ত ! সেই আমি আগের আমিই আছি সেটা বুঝানোর জন্য বাসায় থাকার প্রতিটা মুহূর্তে ঠোঁটের পাশে এক চিলতে হাসি ধরে রাখে তনয় ! মা তো , হাসির পেছনের বিষণ্নতাটুকু টের পেতে সময় লাগেনা খুব একটা ! তবুও স্বীকার করা হয়ে ওঠেনা তনয়ের ! শুধু ধীরে ধীরে নিজের ভেতরের যন্ত্রনাটুকু বাড়তে থাকে তার ! সেই যন্ত্রনাটুকু বুকে নিয়ে এখনও প্রতি রাতে সাফার ছবিগুলোর দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে তনয় ! সে দৃষ্টিতে আজও নেশা থাকে,সম্মোহনের নেশা! শুধু অনুভূতির জায়গাতে বিষন্নতাটাও মিশে যায় , শেষ প্রহরের বিষণ্নতা।।।

সমাপ্ত

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত