অপেক্ষা

অপেক্ষা

তেইশ বছরের গণ্ডি পেরিয়ে চব্বিশ বছরে পা দিলো তুলি… আজকাল এলাকার রাস্তা দিয়ে চলতে গেলেও তার কেমন আনইজি লাগে।

রমিজের চায়ের দোকানে বসে থাকা উঠতি বয়সের ছেলে গুলাও কেমন নোংরা চোখে তাকায় ওর দিকে…

তুলির ভাইটা ওর থেকে চার বছরের ছোট… কই তাকে তো এমন বিড়ম্বনার মধ্যে পরতে হয় না…. কারণ সে ছেলে বলে?

ছোট বেলা থেকেই আশেপাশের মানুষ গুলা বিশেষ করে পুরুষ মানুষ গুলা সবসময় কিভাবে জানি ওর দিকে তাকায় …

সেই দৃষ্টি তুলির ভালো লাগেনা।ওর দিকেই কেন এমন লোলুপ দৃষ্টিতে তাকায় সবাই??

এতে তার দোষটা কি সে খুঁজার চেষ্টা করছে গত এগারো বছর ধরে।

আশেপাশের নোংরা পরিবেশের কথা চিন্তা করতেই বিষণ্ণতা আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে তুলিকে….
পুকুরের পানিতে পা ডুবিয়ে চুপচাপ বসে থাকে তুলি….
.
তুলির এইখানে থাকতে ভালোলাগেনা… কিন্তু দায়িত্বজ্ঞানহীনের মত তো আর দাদীকে ফেলে রেখে চলে যেতে পারেনা সে…

যেমনটা তার বাবা- মা করেছে…..
.
তুলি দাদীর কাছে শুনেছে একুশ বছর বয়সে তার বাবা ঢাকা চলে যায়।সেইখানে গিয়ে বিয়ে করে এক পূর্ব বিবাহিত মহিলাকে।

মহিলা আগের স্বামি ও তিন ছেলে মেয়ে ফেলে রেখে চলে আসে তুলির বাবার সাথে। সেই মহিলা তুলির মা..
তুলির মা গ্রামে আসার পর বছর না গড়াতেই তুলি জন্ম গ্রহণ করে…
তার চারবছর পরে জন্মগ্রহণ করে তুলির ভাই রায়হান…
এই সময়টাতে নাকি তার বাবা-মা সুখেই ছিলো…
এরপরেই শুরু হয় সংসারে যত অশান্তি।তুলির বাবা জড়িয়ে পরে আরেকজন মহিলার সাথে…
.
সেই মহিলাও ছিলেন পূর্ব বিবাহিত। সেই মহিলারও আগে একটা বাচ্চা ছিলো।সেই মহিলাও স্বামী সন্তান ফেলে চলে এসেছিলো।

এরপর তুলির মা তুলি আর তুলির ভাইকে রেখে কই যে হারাইলো কেউ জানেনা।কেউ বলতে পারেনা।

কেউ কখনো খোঁজ নেয়ার চেষ্টায় করেনি।তুলির মা নিজেও কারো সাথে যোগাযোগ করেনি।

তুলি আর রায়হান আজও জানেনা তাদের নিজের মা আদৌ বেঁচে আছে কিনা….
.
তুলির বাবা তার পরের বউকে নিয়ে ঈশ্বরদী বাসায় থাকে…বহু আগে মাঝে মাঝেমধ্যে আসতো…

দশ পাঁচ টাকা হাতে ধরিয়ে দিয়ে চলে যেত… গত বছরে একবার রাস্তায় বাবার সাথে দেখা হয়েছিলো।
কিন্তু তুলি কোন কথা বলেনি।এর পর আর দেখা হয়নি।

শুধু মাত্র এই লোকটার জন্য আশেপাশের মানুষ আজকে ওর দিকে নোংরা চোখে তাকানোর সাহস পায়।

এই লোকটার কামবাসনার জন্যে তুলির শৈশব-কৈশোর কষ্টের কাটায় জর্জরিত।

খারাপ না হওয়া সত্ত্বেও সমাজের লোকজন তুলির গায়ে খারাপের ট্যাগ লাগিয়ে দিয়েছে এই লোকটার চরিত্রের জন্য।

আর এই সব কিছুর জন্য দায়ী এই লোকটা… বাবা বলতেও কেমন একটা লাগে তুলির নিজের কাছে…
.
তুলির বয়স যখন বারো তখন থেকেই তুলি লক্ষ্য করলো ওর চারপাশের পরিবেশ কেমন দ্রুত বদলে যেত থাকলো।

কেউ তুলির সাথে মিশতে চায় না।

আগে বাড়ির আশেপাশে যারা খেলতো তুলির সাথে তারা তখন তুলিকে দেখলেই মুখ বাঁকা করে ভেংচি কাটতো…

স্কুলে কেউ তুলির পাশে বসতে চাইতো না…কেউ না.. আর কলেজে উঠে তুলি নিজেই মিশতে পারেনি কারো সাথে।
.
দাদা-দাদী ছিলো বলেই পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে পেরেছে তুলি আর রায়হান….

দাদু মারা যাওয়া প্রায় বছর দুয়েক হতে চললো…

দাদুর গোপালপুর মোড়ের দোকানটা ছিলো বলেই অভাবের চরম কষ্টটা তুলি আর রায়হানের বুঝতে হয়নি…
চাচাও মাঝেমধ্যে বাজার করে দিত।তবে চাচীর থেকে লুকিয়েই তাকে সবটা করতে হত..

মাথার উপরে ঢাল হিসাবে চাচা এখনো আছে বলেই কেউ কখনো কুপ্রস্তাব দেয়ার সাহস দেখায়নি। তবে নোংরা দৃষ্টিতে তাকায় ঠিকই…..
দাদু মারা যাওয়ার পরে দোকানটা এখন রায়হান দেখাশোনা করে…ছেলেটার বুদ্ধিশুদ্ধি বেশ ভালো।
.
তুলির চাচা খুব চেষ্টা করছেন ভাতিজী কে একজন ভালো পাত্রের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য।

তুলি শিক্ষিত, ছোটখাটো চাকুরী করে কিন্তু তাতে কি?

মা-বাবার চরিত্র তো আর ভালো না।আজকে বিকালে ছাব্বিশ নাম্বার পাত্রের দেখতে আসার কথা ।

এরাও কি সবার মত বাবা-মায়ের চরিত্র দিয়ে তুলির চরিত্র বিচার করবে? মোটা অংকের টাকা চাইবে??

নাকি ছেলেটা তুলির নিষ্পাপ চোখ জোড়ার দিকে তাকিয়ে বলবে – ” আমার জীবনসঙ্গিনী হিসেবে এই মেয়েটিকেই চাই, আর কিছুর প্রয়োজন নেই”
.
পুকুর পারে বসে বসে তুলি এসব ভাবে আর দীর্ঘশ্বাস ফেলে।দোষ না করেও দোষের বোঝা তাকে বয়ে বেড়াতে হচ্ছে।

কপালে যে এইটাই ছিলো।না হলে তার কপালেই এমন মা-বাবা জুটলো কেন?
.
জীবনে সবাই স্ট্রাগল করে।কেউ করে বেঁচে থাকার জন্য, কেউ করে মানসিক প্রশান্তির জন্য।

কখনো কখনো, কারো কারো, সংগ্রামটা হয়তো আমাদের চামড়ার চোখের সামনে পরে।

কেউ কেউ হয়তো একটু খানি আফসোস করে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ব্যাপারটা ভুলে যায়।আর কেউ কেউ বাঁকা চোখে তাকায়…
তবে কষ্টটা শুধুমাত্র তারাই অনুভব করে যারা সংগ্রাম করে বেঁচে থাকে। তুলিও বেঁচে আছে।একটুখানি আশা নিয়ে।হয়তো কেউ আসবে?

চোখে চোখ রেখে বুঝিয়ে দিবে আমি এসে গেছি, নোংরা মানুষ গুলোর লোলুপ দৃষ্টি থেকে তোমাকে বাঁচিয়ে আমার বুকে আগলে রাখার জন্য…
.
কথা গুলা ভাবতেই তুলির সমস্ত শরীর হাল্কা কেঁপে ওঠে…

যদি এরকমটা সত্যিই হয়?

সত্যিই এমনটা হবে তো নাকি অন্য কিছু অপেক্ষা করছে তুলির জন্য?…

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত