সহজ মৃত্যু

সহজ মৃত্যু

রাফি!
এইতো কিছুদিন অাগে বাবা মারা গেলো।
অার অাজ’ই মা মারা গেছে।
পৃথিবীতে অামাদের সবথেকে অাপনজন ‘বাবা-মা’।
এই মুহূর্তে রাফির বোন অর্থির মায়ের মৃত দেহের কাছে থাকার কথা কিন্তু অর্থি সেটা করতে পারছে না। বাবার কাছে ওয়াদা বদ্ধ ছিলো ভাইকে বড় করবে মানুষের মতো মানুষ করবে।

সেই ওয়াদা রাখতে বাহিরে কাজ করতে হচ্ছে,পুরুষের দুনিয়ায় মেয়েটি নিজেকে পুরুষের মতো শক্তিশালী মনে করে লড়াই করে যাচ্ছে যদিও একা মেয়েটি প্রতিনিয়ত হেরে যাচ্ছে,পারছে না এই পৃথিবীর দুষ্টু প্রকৃতির মানুষগুলোর সাথে।

বাবা মারা যাওয়ার দিন মা সান্তনা দিয়েছিলো বাবা অামার মানুষ পৃথিবীতে বেশিদিন বেঁচে থাকে না।
কোনো মানুষের জন্ম যখন হয়ে যায় তখন মৃত্যু হতেই হয়। এটা নির্ধারিত, জন্ম হলে মৃত্যু অনিবার্য।
মায়ের কথাগুলো মনে পরে চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছে অঝরে,এই পানি কাউকে দেখাতে চাচ্ছেনা রাফি তারপরও মনে হচ্ছে মা কি দেখতে পাচ্ছে সে কাদঁছে।

তারপরই অাবার মনে হলো মা কি করে দেখবে সে তো চুপিচুপি কান্না করতেছে।অার যদি মা দেখে ফেলে তাহলে রাফি বলবে চোখে কিছু একটা পরেছে সে জন্য সে কাদঁতেছে।

রাফির চোখ থেকে পানি পরার পরিমান বেড়েই চলেছে। কোনো শব্দ হচ্ছে না,কেউ বুঝতেও পারছে না। মনের ভিতরে যে কষ্ট হচ্ছে যন্ত্রণা হচ্ছে সেটা কেউ দেখতে পাচ্ছে না। রাফি দেখাতেও যাচ্ছে না। ও চাই না ওর কষ্টগুলো অন্য কেউ দেখুক। অাপন মানুষগুলো নিজের কাছে থেকে হারিয়ে গেলে তখন অার পৃথিবীতে বাচঁতে ইচ্ছে করে না,মনে হয় ওদের সাথে যদি যেতে পারতাম তাহলে হয়তো অার একা হয়ে যেতাম না। একা থাকার ও অানন্দ অাছে!কিন্তু পৃথিবীতে যে একা থাকা যায় না!

বুঝার মতো ওর পাশে তো অাজ অার কেউ নেই। বোন যে কাজে গেছে ফিরতে যে রাত হবে। এতগুলো মানুষ ওর পাশে থাকার পরও অাপন মানুষগুলো না থাকার কারণে নিজেকে বড্ড একা মনে হচ্ছে। কখনো এই একা থাকার যন্ত্রণাটা উপলব্ধি করতে হয়নি রাফিকে। সবসময় এতোটা অাদরে ভালোবাসায় বড় হয়েছে। পরিবারের এতো অভাব থাকা সত্ত্বেও তার কোনো ইচ্ছার অপূর্ণতা কেউ রাখিনি।

সকাল গড়িয়ে বিকেল হতে চললো। মা মারা গেছে ভোরে ফজরের অাজানের সময়। তখন অাপু বাসায় ছিলো না। গতকাল ও ঢাকা গিয়েছিলো কোনো এককাজে। যাওয়ার সময় বলেছে ফিরতে তার দু-একদিন দেরি হতে পারে। তবে কিছুক্ষণ অাগে সে জানিয়েছে তার ভালো একটা চাকরি হয়েছে সে অাজই বাড়ি ফিরছে। একটু ফাকেঁ জিজ্ঞেস করে নিয়েছে মায়ের কিছু লাগবে কিনা। রাফি যদিও বুঝতে দেইনি অর্থিকে। সে কিছুটা সময় নিয়ে বলেছে যে মা বলেছে অর্থির যেটা ভালো লাগে সেটাই নিয়ে অাসতে। অর্থিও অার কথা বাড়ালো না। সাথে সাথে ফোনটা কেটে দিলো। ফোনটা রাখার পর রাফি ভেবেছিলো অর্থি হয়তো বুঝতে পারি নি অার রাফি তাকে বলতে চাচ্ছিলো না। একটু পর অাবার অর্থির ফোন। রাফির হ্যালো শুনে অর্থি জিজ্ঞেস করলো কিরে কিছু হয়েছে। রাফি কিছুক্ষণ চুপ থাকলো!অর্থি অাবার জিজ্ঞেস করলো রাফি অামার কথা শুনতে পাচ্ছিস? রাফি তথমত খেয়ে গেলো।তখন অাস্তে করে বললো হ্যা অাপু বলো? তর কিছু লাগবে?অর্থি জিজ্ঞেস করলো। রাফি না!বললো।সাথে “পারলে তাড়াতাড়ি ফেরো” এই কথা বলে দিয়ে ফোনটা কেটে দিলো। ফোনটা রাখার পর রাফির মাথায় হাজারো চিন্তা এসে ভীর করলো। অর্থি কিছু বুঝতে পারেনি তো।বুঝতে পারলে নিচ্শয় অাবার ফোন দিবে।

কিন্তু দুপুর হয়ে গেলো অর্থি অার ফোন ও করে নি অার এখনো এসে পৌছাতে পারেনি। রাফিরা অাগে গ্রামেই থাকতো এর মাঝে কিছু বছর ওরা ঢাকা শহরে ছিলো। এর মাঝে কিছুটা বছর বলতে পাচঁ-সাত বছর। তখন ওদের বাবা বেচেঁ ছিলো। এখন অার বেচেঁ নেই।

গত বছরের শেষের দিকে ওরা গ্রামে চলে অাসে গ্রামে অাসার পরই ওদের বাবা মারা যায়। যদিও ওরা গ্রামে কিছুদিন বেড়াতে এসেছিলো।

কিছুদিন থাকার পর অাবার মায়ের কথায় ওরা শহরে চলে গিয়েছিলো কিন্তু সপ্তাহখানেক অাগে মা বলতেছে গ্রামে অাসতে।

কেউই অাসতে চাইনি পরে অবশ্য অাসতে হলো। মা হয়তো বুঝতে পেরেছিলো যে সময় খুব কম এখন না গেলে হয়তো ওনার কাছাকাছি থাকতে পারবো না। মা বাবার সঙ্গ পেতেই হয়তো গ্রামে অাসতে চেয়েছিলো।

বাবা মারা যাওয়ার পর থেকেই মা বিভিন্ন রোগে অাক্রান্ত হয়। অামাদের দুই ভাইবোনকে কিছুই বলেনি। কেমন যেনো চুপচাপ হয়ে গিয়েছিলো প্রথম প্রথম অামরা ভেবেছিলাম যে বাবা মারা যাওয়ার পর হয়তো মা এমন চুপচাপ হয়ে গেছে। কিন্তু কিছুদিন পর মায়ের রুমে গিয়ে দেখি মায়ের একটা গামছায় রক্ত। তখন অামি দৌড়ে গিয়ে অাপুনিকে দেখাই তখন অামি অার অাপুনি মাকে জিজ্ঞেস করি কিন্তু মা অামাদের কিছু বলেনি। একটা ধমক গিয়েছিলো। তখন থেকে মাকে একটু চোখে চোখে রাখতে চেষ্টা করি। একদিন অনেক কষ্টেও হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারি নি। যদি হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারতাম তাহলে হয়তো মা অারও কিছুদিন অামার সাথে থাকতো।

বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছি! কি যেনো মনে করে বসে পরলাম। হয়তো কিছু একটা অনুভব করছি! কষ্ট হচ্ছে অার পারছি না। এতোক্ষণ দাড়িয়েঁ ছিলাম মায়ের কাছে,কষ্ট হচ্ছে তাই চলে এসেছি । মা কি মন খারাপ করলো। নিশ্চয় করেনি। অামি তো মায়ের লক্ষীটি তাই না? সেদিন অামার জন্মদিন ছিলো। খুব ইচ্ছে হচ্ছিলো কিছু একটা খাবো সবাই মিলে ভালো মন্দ। অনেকদিন ভালো কিছু খাওয়া হয়নি। বাবা মারা যাওয়ার পর বোন একটা কারখানায় কাজ পেয়েছিলো। গ্রামের পরিচিত এক চাচার কল্যাণে কাজটা পাওয়া।নয়তো না খেয়েই মরতে হতো অামাদের। তো সেদিন অামি মাকে একটুও বুঝতে দেইনি যে অামি ভালো কিছু খেতে চাই অাজ। কিন্তু মা অামার জন্য এত্তো এত্তো কিছু রান্না করলো যা অামি রীতিমতো ভয় পেয়ে গেলাম। সেদিন মাকে জড়িয়ে কেদেঁছিলাম অার বলেছিলাম মা দেখো অামি যেদিন ভালো একটা চাকরি করবো তখন অার অামাদের কষ্ট থাকবে না অাপুকেও এতো কাজ করতে হবে না এতো কষ্ট করতে হবে না। ভাবতে পারিনি সেদিনই ছিলো মাকে শেষ জড়িয়ে ধরা। মা সবসময় বলতো কখনো বাজে সঙ্গীদের সাথে চলবে না অার অামি কখনোই ভালো খারাপ কেনো বন্ধুদের সাথে চলি নি।

অামার বন্ধুই তো ছিলো তিনজন মা,বাবা অার অাপুনি। যদিও মা এতোটা লেখাপড়া করার সুযোগ পাইনি। তারপর ও মা অামাকে সবসময় সাহিত্যিকদের মতো কথা বলে বলে উপদেশ দেওয়ার চেষ্টা করতেন। খুব ভালো লাগলো মায়ের কথাগুলো। এখন হয়তো সেগুলো শুধুই স্মৃতি। স্মৃতি ভালো হোক খারাপ হোক সেটা অামাদের বয়ে বেড়াতে হয়।

অাজ চাকরি করার ইচ্ছেটা হারিয়ে গেছে। কার জন্যই বা চাকরি করবো। স্বপ্ন যে দেখেছিলাম সেই স্বপ্নের প্রধাণ বস্তু মা যে ছেড়ে চলে গেলো। বাবার স্বপ্নটা যে স্বপ্নই রয়ে গেলো। স্বপ্ন পূরণ করতে কত কত লড়াই করতে হয় অামাদের। রাতদিন কত পরিশ্রম,কত রাত জেগে পড়তে হয়,খাওয়া দাওয়া ভুলে অামরা নিজের স্বপ্ন পূরণে উদ্দমী হয়। কিন্তু যখন স্বপ্ন পূরণের ইচ্ছেটা মরে যায় তখন সেই কষ্টগুলো অার করতে হয়না। স্বপ্নের জন্যই মানুষ বেচেঁ যায় অার যখন স্বপ্নটা মরে যায় তখন সেই মানুষটাও মরে যায়। পৃথিবীতে অাসার কারণটাই হারিয়ে ফেলে একসময়। বেচেঁ থেকেও মৃত্যু হয় সেই মানুষটার৷ সেই মৃত্যুটা হলো সহজ মৃত্যু।

অর্থি সেদিন ফিরেছিলো তবে বেশ রাত হয়ে গিয়েছিলো।
অর্থির জামার হাতের একদিকের কিছুটা অংশ ছিড়ে গিয়েছে। খুব হাতাহাতি না হলে জামার অংশ ছিড়তে পারে বলে মনে হয়না!

মাথার একপাশে রক্ত লেগে অাছে।
চুল গুলো এলোমেলো হয়েছে,একহাতে দু-তিনটে ব্যাগ অারেকটা হাতে একটা খাম হয়তো কোনো চিঠি বা অন্য কিছু থাকতে পারে।

বাড়িতে পা রাখার পর সবকিছু অন্ধকার দেখছিলো। অালো জ্বলেনি কেনো? অাজ, সেটা নিজের মনেই মনেই জিজ্ঞেস করলো অর্থি। সেই অন্ধকার তো অামি কিছুক্ষণ অাগে উপলব্ধি করে এসেছি। পুরুষতান্ত্রিক সমাজে অামি যে নির্যাতিত হয়ে এসেছি। কথাগুলো মনে পরতেই চোখ বেয়ে পানি পরতে লাগলো। কোনোমতে চোখের পানি মুছে রাফিকে ডাকতে শুরু করলো! কিন্তু রাফি যে কোনো সাড়া দিচ্ছে না। অার যে কোনোদিন সাড়া দিবে না সেটা কি জানে অর্থি। প্রিয় অাদরের ভাই যে অর্থিকে রেখে চলে গিয়েছে সেটা কি বুঝতে পারছে অর্থি অার যখন বুঝবে জানবে রাফি নেই তখনই বা কি অবস্থা হবে অর্থির?

অাস্তে অাস্তে বারান্দা পেরিয়ে ঘরে ডুকতেই দেখে দুচার খানেক মানুষ ঘরের ভিতরে বসে গুন গুন অাওয়াজে কোরঅান তিলোয়াত করছে। চারপাশে অাগরবাতির দোয়ায় অারো অন্ধকার লাগছে ঘরটা।

অর্থি এখনো খেয়ালই করেনি যে দুটো মানুষ মাটিতে শুয়ে অাছে। হঠাৎ একপলক দৃষ্টি গিয়ে পরলো একটা হাতের দিকে। এই হাতটা তো রাফির,সিগারেট দিয়ে যে হাতটা জ্বালিয়ে দিয়েছিলো পাড়ার মাস্তানরা। অর্থিকে বাঁচাতেই তো সেদিন রাফির হাতের এই অবস্থা।স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে। হাতের ব্যাগ গুলো অচমকায় মাটিতে পরে গেলো দৌড়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরলো ভাইকে। কি হলো কি হলো রে..ভাই? তুই মাটিয়ে এমনভাবে শুয়েছিস কেনো? অর্থি এখনো খেয়ালই করেনি মাও যে পাশে শুয়ে অাছে?

মা এবং ভাইকে এমনভাবে শুয়ে থাকতে দেখে অর্থি কি বলবে সেটার ভাষা হারিয়ে ফেলেছে। হাসতে হাসতে নিজেই বলছে,মা তুমি কিভাবে এমনটা করলে রাফি না হয় ছোট মানুষ কিছু বুঝতে পারেনি কিন্তু তুমি তো পারতে অামাকে তোমার সাথে নিয়ে যেতে কি?পারতে না!

বলো না মা পারতে না..অামায় নিয়ে যেতে?

অামায় একা কেনো রেখে গেলে ওই বাইরের নোংরা মানুষগুলোর জন্য, ওদের খাবার হিসেবে অামায় রেখে গেলে।
তুমি কি দেখতে পাচ্ছো মা ওরা অামার কি অবস্থা করেছে তুমি কি পারছো দেখতে…

এবার রাফির দিকে তাকিয়ে ওর হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করছে কেনো পুড়িয়ে ছিলি নিজের হাতটা বোনকে রক্ষা করতে পারলি অবশেষে রক্ষা করতে পারলি? বলনা বোনটাকে রক্ষা করতে পারলি?

পারলি না শেষে হেরে গেলি,অার হেরে গিয়ে অামায় রেখেই চলে গেলি, অার হ্যাঁ অাসল কথা তো বলাই হয়নি এই যে অাজ রেজাল্ট দিছে তুই মেডিকেলে চান্স পেয়েছিস।
বাবার স্বপ্ন যে পূরণ করেছিস।
উঠ না ভাই শুধু বাবার স্বপ্ন পূরণের জন্য উঠ!
অাজ উঠবি না!

সেদিন অামি দেখেছিলাম হেরে যাওয়া বাবাকে.!কোনো সন্তান কি কখনো ভাবতে পারে তার বাবা হেরে যাক।
অার সেদিনই ওয়াদা করেছিলাম তকে অামি ডাক্তার বানাবো, কষ্ট করে হলেও টাক অামি জোগাড় করবো। এই দেখ টাকা নিয়ে এসেছি তুই ভর্তি হতে যাবি না উঠ না ভাই উঠ!

রাফি সেদিন অার উঠেনি।
ছোটবেলায় রাফির ক্যান্সার হয়েছিলো। টাকার অভাবে বাবা চিকিৎসা করাতে পারেনি।

একদিকে পরিবারকে চালানো অন্যদিকে একমাত্র ছেলের ক্যান্সার। এটাই কি হেরে যাওয়া বাবা”
তাই চেয়েছিলো ছেলে ডাক্তার হবে”কিন্তু সেটা পূরণ হওয়ার শেষ মুহূর্তে এসে সবকিছু নিঃশেষ হয়ে গেলো।

বলেছিলাম না পুরুষের দুনিয়ায় মেয়েরা লড়াই করে জিততে পারে না৷ যদি ভুলেও একবার জিতে যায় তাহলে পরের বার হারটা নিশ্চিত। প্রথমবার ভাই বাঁচাতে পারলেও শেষে কিন্তু হেরে গিয়েছিলো অর্থি। অার রাফি সে তো সেদিন হেরে গিয়েছিলো যেদিন পৃথিবীতে এসেছিলো। এটাই হয়তো সহজ মৃত্যু !

সমাপ্তি

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত