ছেড়া ঘুড়ি

ছেড়া ঘুড়ি

ছাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে নিহাস।তার চোখ পাশের বাসার ছাদে।সেখানে একটি মেয়ে ঘুড়ি উড়াচ্ছে।খুব সুন্দর ঘুড়িটা।নিহাস জানে একটু পর কি হবে।মেয়েটি ঘুড়িটা উড়িয়ে দেবে।এটা নিহাসের পরিচিত দৃশ্য। সে এই বাসায় আসার পর থেকেই দেখে ওই বাসার মেয়েটি প্রতিদিন নিজের হাতে খুব সুন্দর করে একটা ঘুড়ি বানায়।ঘুড়িটাকে মনের মত করে সাজায়।তারপর বিকালে ছাদে যেয়ে কিছুক্ষন উড়িয়ে ঘুড়িটা ছেড়ে দেয়।
মেয়েটির নাম ভ্যালা।নিহাস প্রথম যেদিন নামটা শোনে সেদিন খুব হেসেছিল।মানুষের নাম আবার ভ্যালা হয় কিভাবে।ভ্যালার নামটা জানতে কিন্তু নিহাসকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল।কারন ভ্যালা কারো সাথে মেশে না।নিহাসের পাশের বাসার ৬তলায় ভ্যালা আর তার ছোটো বোন ভিরু থাকে।ভিরু খুব দুষ্টু।সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে ঘুরে সন্ধায় বাসায় আসে।ভ্যালা তাকে কিছু বলে কিনা জানে না নিহাস।হয়তো বলে না।কারন ভিরু দুষ্টু হলেও খারাপ ছেলেমেয়েদের সাথে মেশে না।ও হ্যা।ভিরু কিন্তু খুব বকবক করে।এই ভিরুকে দেড় মাস তেল মারার পর নিহাসকে সে ভ্যালার নাম বলেছে।গত এক বছর অনেকভাবে ভ্যালার সাথে কথা বলার চেষ্টা করে নিহাস।কিন্তু ভ্যালা?সে কথা বলা দূরে থাক।নিহাসের দিকে ফিরেও তাকায়নি।নিহাসের মনে হয় ভ্যালার চোখ সবসময় সাহায্য খুজছে।যদিও সে তার চোখের দিকে তাকানোর সুযোগ তেমন ভাবে কখনোই পায়নি। এক দুবার দেখেছে শুধু।

নিহাস এই বাসায় প্রথম যেদিন আসে সেদিন সে খুব রেগে ছিল।কারন সব ফার্নিচার তাকে একা একা তুলতে হয় দোতলায়।যায়হোক সে বিকালে খুব ক্লান্ত হয়ে ছাদে যায়।ছাদে বসে থাকতে থাকতে হঠাত পাশের বাসার ছাদে চোখ পড়ে।বাসাটা একদম কাছে।এতই কাছে যে ওই ছাদ থেকে লাফ দিয়ে এই ছাদে খুব সহজে চলে আসা যায়।সে সেখানে দেখতে পায়,খুব সুন্দরি একটি মেয়ে ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছে।মেয়েটি ফরসা না।কিন্তু খুব মায়াবী।একটা সাদা রঙের কামিজ পরে আছে।মাথায় ওড়না দেওয়া।এভাবে একটা মেয়ে এত সুন্দর করে ঘুড়ি ওড়াতে পারে তা নিহাসের জানা ছিল না।তাই সে মন্ত্রমুগ্ধের মত তার দিকে তাকিয়ে ছিলো।প্রায় ১০মিনিট পর নিহাস দেখে মেয়েটা দাত দিয়ে ঘুড়ির সুতা কেটে দেয়।খুব অবাক হয় সে। সে মেয়েটাকে ডাকে,”শুনুন,এটা করলেন ক্যান?এত সুন্দর ঘুড়ি উড়িয়ে দিলেন?অনেক ভালই তো উড়াচ্ছিলেন।”সেদিন একটা কথারও জবাব দেয় না ভ্যালা।এমনকি তাকিয়েও দেখে না।
তারপরের দিন আবার নিহাস ছাদে ওঠে।সেদিন সে ছাদে উঠেই পাশের বাসার ছাদে তাকায়।হ্যা আজকেও রয়েছে সেই মেয়েটি।আজকে আরো সুন্দর একটা ঘুড়ি উড়াচ্ছে সে।আর আজকেও একটা সাদা ড্রেসই পরে আছে সে।তবে কালকের টা না।নিহাস আজকে ভাবল”হয়তো কালকে ওর কোনো কারনে মন খারাপ ছিলো তাই ঘুড়িটা উড়িয়ে দিয়েছে।আজকে এত সুন্দর ঘুড়িটা বোধহয় উড়াবে না।কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে একটুপর এই ঘুড়িটাও ভ্যালা উড়িয়ে দেয়।ভ্যালা সম্পর্কে কৌতুহল আরো বাড়তে থাকে নিহাসের।তাই সে পরদিনও আসে ছাদে। সেই একি ব্যাপার ঘটে।মেয়েটি ঘুড়ি উড়িয়ে দেয়।মজার ব্যাপার হচ্ছে মেয়েটি প্রতিদিন সাদা ড্রেস পরে।নিহাস এরপর প্রতিদিন ছাদে ওঠে।আর প্রতিদিন মেয়েটা একি কাজ করে।নিহাস তার সাথে কথা বলার খুব চেষ্টা করে।কিন্তু একদিনও ভ্যালা তার দিকে তাকায় না।এতে নিহাসের কৌতূহল আরো বেড়ে যায়।
সে ভ্যালার সম্পর্কে খবরাখবর নিতে থাকে।সে জানতে পারে মেয়েটির নাম ভ্যালা।সে এবার নিহাসের সাথেই একই ভার্সিটিতে পড়ে।তারা দুইবোন। তার মা বেচে নেই।এর বেশি কিছু জানা সম্ভব হয়নি নিহাসের পক্ষে।ভ্যালার সাথে নিহাসের মিল আছে।ভ্যালার মা নেই আর নিহাসের বাবা নেই।
একবছরের মধ্যে নিহাসের ভ্যালা সম্পর্কে আগ্রহ কয়েকগুন বেড়ে যায়।কিন্তু কোনো ভাবেই ভ্যালা তার সাথে কথা বলে না।কিন্তু তাও নিহাস প্রতিদিন ছাদে ওঠে আর ভ্যালার ঘুড়ি ওড়ানো দেখে।ভ্যালার সাথে কথা বলার আশা যখন নিহাস প্রায় ছেড়েই দিয়েছে তখন যে সুযোগ এভাবে আসবে তা সে কল্পনাও করেনি।সেদিন নিহাস ছাদে উঠে দেখে ভ্যালা এদিকেই তাকিয়ে রয়েছে।নিহাসকে দেখেই সে চোখ সরিয়ে নিয়ে আবার ঘুড়ি ওড়ানোতে মন দেয়।কিন্তু নিহাস লক্ষ্য করছে বারবার সে আজকে নিহাসের দিকে তাকাচ্ছে।যেন কিছু বলতে চায়।তারপর ঘুড়ি উড়িয়ে দিয়ে নিহাসের দিকে তাকিয়ে বলে,”তুমি প্রতিদিন ছাদে আসো কেনো?”
হঠাত করে ভ্যালার কথা শুনে নিহাস কিছুক্ষনের জন্য ভাষা হারিয়ে হেলে।তার কারন দুটো।এক-ভ্যালা তুমি করে বলছে।আর দুই-তার কণ্ঠস্বর তার চেহারার মতই খুব সুন্দর আর মায়াবী।সে কোনো মতে উত্তর দেয়-“এ এমনি”
“না আমি জানি তুমি এমনি আসো না,সত্যি করে বলো কেনো আসো।”ভ্যালা খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল।
“তোমাকে দেখতে আসি”কথাটা নিহাসের খুব দ্রুত আর ভয়মিশ্রিত কন্ঠে বলে।
“জানতাম।”
“জানতে?”নিহাস ভুরু কুচকে জিজ্ঞেস করল,”তাহলে জিজ্ঞেস করলে ক্যান যে আমি কেনো আসি?”
“দেখলাম তুমি সত্যি কথা বলো কিনা।”ভ্যালা মুচকি হেসে বলল।
এতগুলো দিনের মধ্যে কখনো নিহাস ভ্যালাকে হাসতে দেখেনি।তার দিকে হা করে তাকিয়ে থাকতে লাগল।ভ্যালার মুখে গোধুলির রক্তিম আভা এসে পড়েছে।খুব সুন্দর লাগছে তাকে।নিহাস অনুভব করল তার বুকের ধুকপুকুনি খুব বেড়ে গেছে।খাঁচা থেকে যেন হৃদপিন্ড বেরিয়ে আসতে চাচ্ছে।ভ্যালার কথায় তার চমক ভাংলো,
“তুমি অন্যান্য ছেলেদের মত না।অনেক ছেলেই আমার জীবনে এসেছে।কিন্তু আমার পাত্তা না দেয়াই তারা কেও ২মাসের বেশি টেকেনি।কিন্তু তুমি অনেক আলাদা।একবছর ধরে আমার পিছে লেগে আছো আমার পাত্তা না দেয়ার পরও।”তার পর নিহাস কে অবাক করে দিয়ে একলাফে নিহাসদের ছাদে চলে আসল।তারপর নিহাসের একদম গা ঘেষে দাঁড়িয়ে বলল,”তাই আজকে তোমাকে সত্যি কথাই বলছি।আমি তোমাকে ভালবাসি।”
নিহাস হা করে ভ্যালার দিকে তাকিয়ে থাকল।সে খেয়াল করল ভ্যালার চোখের কোনে অশ্রু।বিকেলের পড়ন্ত রোদে তা চিকচিক করছে।নিহাস কি করবে বুঝতে না পেরে খুব জোরে ভ্যালাকে জড়িয়ে ধরল।আর ভ্যালার কানের কাছে মুখ এনে বলল,”আমিও খুব খুব ভালোবাসি তোমায়।খুব।”তারপর ভ্যালার কপালে হালকা করে একটা চুমু দিয়ে নিচে চলে আসে।ভ্যালাও নিচে চলে যায়।

নিহাস রাতে ডিনার করছিল।হঠাত তার একটা ফোন আসে।নাম্বারটা অচেনা।সে ফোন ধরে কানে দিয়ে বলে,”হ্যালো কে?”
“চিনবা না আমাকে” ওপাশ থেকে মিষ্টি কন্ঠে একটা মেয়ে বলে।
“কে বলেছে চিনব না?”নিহাস ভাত চিবুতে চিবুতে বলে।
“তাই বলো তো আমি কে।”
“বলব না।”
“চিনতে পারোই নি তো বলবা কি?”
“অবশ্যই চিনেছি।তুমি আমার ভ্যালা।”
“এই ভ্যালাটা আবার কে?”ভ্যালা হেসে বলে।
“ভ্যালা হলো একটা পাগলি।আমার পাগলি।”নিহাসও হেসেই বলে।
“তাই?তোমার পাগলি?”
“হু।”নিহাস বলে,”আমার নাম্বার পেলে কোথায়?”
“ভিরু দিয়েছে।”
“ও তাই।”
“হু।কি খাচ্ছ?”
“তুমি কিভাবে জানলে আমি খাচ্ছি।”নিহাস অবাক হয়ে বলে।
“ম্যাজিক”
“আচ্ছা ম্যাজিশিয়ান ম্যডাম আমি আপনাকে রাতে ফোন দেই?”
“ক্যান বিজি?”
“হু থালাবাসন মাজবো।”
“ও।আচ্ছা ঠিকাছে।”
“জিজ্ঞেস করলা না তো আমি ক্যান থালাবাসন মাজবো? ”
“আমি জানি তাই।”
“তুমি জানো?”নিহাস আবার অবাক হয়,”বলতো ক্যান?”
“কারন আজকে তোমার মা অসুস্থ।”
“ঠিক বলেছো।তুমি আসলেই ম্যাজিশিয়ান।”
“হু।আচ্ছা বাই।”
“হু বাই”
নিহাস ফোন রেখে দেয়।আজকে তার মুড খুব ভালো।কারনটা অবশ্যই ভ্যালা।সে আজ সকালেও এটা কল্পনা করতে পারে নি যে ভ্যালা তার সাথে কথা বলবে।তাও এত আপন হয়ে।সে এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না যে যাকে সে এতদিন ধরে চেয়েছে।নিজের করে পেতে চেয়েছে সেই ভ্যালা তার কাছে এভাবে ধরা দেবে।নিজেকে হঠাত করেই খুব ভাগ্যবান মনে হতে লাগল।সে অপেক্ষা করছে।কখন থালাবাসন মাজা শেষ হবে আর সে ভ্যালার সাথে কথা বলবে।

আজ নিহাস আর ভ্যালার রিলেশন ১মাসের বেশি।এই কয়দিনে তারা অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়েছে।এখনো ভ্যালা ছাদে ঘুড়ি উড়ায় আর নিহাস দেখে।তবে এখন আর আলাদা ছাদে বসে নয় এখন দুজন এক ছাদেই বসে গল্প করে। ভ্যালা কিন্তু এখনো সাদাই পরে।তারা এখন পারলে সারাদিন ফোনে কথা বলে।সারাদিন কি হল,কে কি করল,কে কি বলল সব এখন একে অপরকে না বললে চলেই না।এর মধ্যে তারা একে অপরের অনেক সিক্রেট যেমন জানতে পেরেছে তেমনি একে অপরের ভাললাগা মন্দলাগা সম্পর্কেও জানতে পেরেছে।
কিন্তু নিহাসের হাজার জিজ্ঞেসের পরেও ভ্যালার ছেড়া ঘুড়ির রহস্য বের করতে পারেনি।নিহাস যতই জিজ্ঞেস করুক না কেন ভ্যালা একটাই জবাব দেয়,-“এখনো সময় হয়নি,সময় হলে আমি ঠিক বলব।”

এখন সকালে ঘুম থেকে উঠে নিহাস আগে তার মোবাইলটা চেক করে। যে আগে ওঠে সে মেসেজ দিয়ে বলে দেয়।সকালে কি খাবে, খাবার কে বানাবে এসব্ও জিজ্ঞেস করে তারা।।এভাবেই কাটছে তাদের দিন।নিহাস তার বাসায় মা আর ছোট ভাইকে ভ্যালার সম্পর্কে বলেছে।ভ্যালাও তার বাবাকে বলেছে।দু পক্ষই এতে খুশিমনে রাজি হয়েছে।

কালকে ভ্যালার বার্থডে। কথাটা ভিরু নিহাস কে বলেছে।তাই সে আর নিহাস মিলে ভ্যালার জন্য একটা সারপ্রাইজ বার্থডে পার্টি রেখেছে।নিহাস, নিশান মানে নিহাসের ছোট ভাই আর ভিরু বসে প্লান করছে পার্টিরর।এমন সময় ভ্যালার ফোন আসায় নিহাস উঠে পড়ে,
“হ্যা ম্যাডাম বলেন”
“কি করো?”
“এইতো বাইরে আছি,”কথাটা মিথ্যা।
“কিন্তু আমার কেন জানি মনে হচ্ছে তোমরা বাসায় আছো”ভ্যালা মুচকি হেসে জবাব দেয়।
“তোমরা মানে?”নিহাস অবাক হওয়ার ভান করে।
“তোমরা মানে তুমি,নিশান আর ভিরু”ভ্যালা এমন ভাবে উত্তর দেয় যেন সে পাশেই বসে আছে,”আমার অনেক কাজ আছে তাড়াতাড়ি ভিরুকে পাঠিয়ে দাও।”
“আচ্ছা”তারপর নিহাস ভিরুর দিকে তাকিয়ে বলে,”এই যে দাভরানি আপনাকে ডাকছে।”
ভিরু চলে যায়।কিন্তু নিহাস ভ্যালার কথা শেষ হয়না।
“অই ভ্যালা”নিহাস হঠাৎ বলে।
“বলো”
“তোমার বার্থডে কবে গো?”
“আমার বার্থডে? “ভ্যালা বেশ অবাক হয়
“নাহ আমার বার্থডে “নিহাস ঠাট্টা করে বলে।
“অ”
“অ মানে?বলো না তোমার বার্থডে কবে?”
“জানিনা”
“কিহ নিজের বার্থডে জানো না?”
“না।মনে নেই”
“ভেরি গুড”তারপর নিহাস ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,”আচ্ছা বাই পরে কথা হবে”
“আচ্ছা বাই”

আজকে ভ্যালার বার্থডে। প্লান মাফিক ভিরু তাকে নিয়ে বাইরে যায়।আর নিহাস ঘর সাজাতে থাকে।আজকে রান্নাও সে করবে।বাইরের কেও আসবে না।শুধু ভ্যালা নিহাস ভিরু আর নিশান।ভ্যালা কখনো তেমনভাবে বাইরে যায় না।তাই সে বারবার জিজ্ঞেস করছে “কোথায় যাচ্ছি আমরা?”ভিরু জবাবে শুধু মুচকি হাসে।

এদিকে নিহাস সব কাজ সেরে,রান্না করে গোসল সেরে ফেলেছে।নিশানকে দিয়ে ইতিমধ্যেই কেক আনিয়ে নিয়েছে।সব কিছু ঠিক ঠাক করে দুপুরে ভিরু ফোন দিয়ে বলে ভ্যালাকে নিয়ে আস।
ভিরু স্কুটি বাসার নিচে রেখে একটা কাপড় দিয়ে ভ্যালার চোখ বেধে দেয়।
“এই এই কি করছিস?”ভ্যালা অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করে।
“চুপ করে থাকো বুঝতে পারবে।”
তারপর ভ্যালা আরো অবাক হয় যখন লিফট থেকে নেমে ভিরু বাসায় বেল বাজায়।
“কিরে বেল দিচ্ছিস ক্যান?আমরা দুজনি বাইরে।”
“হু তো?”
“তো কি ভুতকে বেল দিচ্ছিস?”
“হু বাসার ভিতর দুটো ভুত আছে।”
এমন সময় নিহাস এসে দরজা খুলে দেয়।তারপর ভ্যালার কাধে হাত দিয়ে তাকে নিয়ে ভিতরে আসে।তারপর

“হ্যাপি বার্থডে”সবাই একসাথে চিল্লিয়ে ওঠে।
“মানে কি এসবের?”নিহাস ইতিমধ্যেই ভ্যালার চোখ খুলে দিয়েছে।
“আজকে আমার কিউট ভাবির বার্থডে “নিশান হেসে বলে।
“আমার বার্থডে তোমাদের মনে আছে?”ভ্যালা আনন্দে ফেটে পড়ছে।
“থাকবেই তো।”নিহাস বলে।
“আচ্ছা তাড়াতাড়ি কেকটা কাটো তো”ভিরু বলে ওঠে।
“ও বাবা আবার কেকও আছে।”ভ্যালা আরো অবাক হয়।
“হু আছে তো”

তারা কেক কেটে আনন্দ করছে এমন সময় হঠাৎ করে নিহাস পিছে থেকে ভ্যালার কাধে হাত রাখে।ভ্যালা ফিরে তাকালে সে হাটুগেড়ে বসে হাতে গোলাপ নিয়ে ভ্যালাকে বলে,”will you marry me?”
ভ্যালার মুখের হাসি মিলিয়ে যায়।তাও সে ফুলটা নিয়ে আস্তে করে মাথা ঝাকায়।তারপর নিহাস ভিরুকে লক্ষ্য করে বলে,”ও ম্যাডাম প্যাকেটটা নিয়ে আসেন ”
ভিরু একটা প্যাকেট নিয়ে নিহাসের হাতে দিলে সে তার ভিতর থেকে একটা নীল শাড়ি আর কিছু নীল কাচের চুড়ি বের করে ভ্যালার হাতে দিয়ে বলে “যাও এগুলো পরে আসো।তারপর আমরা ঘুরতে যাবো।”
ভ্যালা কিছু না বলে সেগুলো নিয়ে রুমে চলে যায়।কিছুক্ষণ পর যখন বেরিয়ে আসে তখন তাকে দেখতে আসলেই অনেক সুন্দর লাগছিল।নিহাস হা করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।সাদা ছাড়া অন্য কোনো রঙ এ যে ভ্যালাকে এত মানাবে তা নিহাস কল্পনাও করে নি।নীল শাড়ি, নীল কাচের চুড়ি,চিকন করে কাজল আর ছাড়া চুলে পুরো অপ্সরীর মত লাগছে।নিহাস চোখ ফিরাতেই পারছে না।কিন্তু ভ্যালার মুখে হাসি নেই।নিহাস মন্ত্রমুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকতে থাকতেই বলল,”চলো যাই”

ভ্যালা আর নিহাস আশুলিয়া এসছে।রাস্তার উপর গাড়ি রেখে তারা নদী দেখছে।এখানে আসার কথা অবশ্য ভ্যালাই নিহাসকে বলেছে।নিহাস ভ্যালার কপালে আলতো করে চুমু দিয়ে বলল,”তোমাকে আসলেই আজকে অনেক সুন্দর লাগছে।”
“তাই?”
“হু।”তারপর হঠাৎ করে বলল,”একটা সত্যি কথা বলবা আজকে?”
“কি?”
“দাড়াও এক সেকেন্ড”কথাটা বলে নিহাস গাড়ির পিছের সিট থেকে একটা খুব স্বাধারন ঘুড়ি নিয়ে আসে।তাতে লেখা,

নাম -নীল হাসান আকাশ
নং-০১৭********

“তোমার এই ছেড়ে দেয়া আর এই ঘুড়িটার রহস্যটা একটু বলবা প্লিজ আজকে।”নিহাস রিকুয়েস্ট করে।
ভ্যালা তার হাত থেকে ঘুড়িটা নিয়ে বলে,”হ্যা বলব।আজকেই বলার সময় হয়েছে।”
নিহাস শোনার জন্য তাকিয়ে আছে।ভ্যালা বলা শুরু করে,
“আজ থেকে ৩ বছর ৭মাস ১২দিন আগে আমি ছাদের উপর বসে আছি।এমন সময় এই ঘুড়িটা উড়ে এসে আমার সামনে পড়ে।আমি তুলে নিয়ে নাম আর নাম্বারটা দেখার পর খুব কৌতুহল হয়।আমি রাতে ফোন দেই।একটা ছেলে ধরে।তার সাথে কথা বলে জানতে পারি সেই নীল।সে সকালে রাজশাহী থেকে ঘুড়িটা উড়িয়ে দেয়।কৌতুহলের কারনে তার সাথে প্রায়ই কথা বলতাম।১মমাস পর আবিষ্কার করলাম আমি তার প্রেমে পড়েছি।সেটা জীবনের প্রথম প্রেম ছিল।জানতে পারি নীলও আমাকে ভালবাসে।এভাবে আমাদের মাঝে রিলেশন হয়।দেখতে দেখতে ১বছর কেটে যায়।এর মধ্যে নীলের বোনের বিয়ে ঠিক হয়।আমাকেও দাওয়াত দেয়।আমি রাজশাহী যাই।সেদিন নীলকে প্রথম দেখি।তার বোনের বিয়ের ওখানে সবার সামনে নীল আমাকে প্রপোজ করে,”তারপর নিহাসের দিকে তাকিয়ে বলে,” ঠিক যেভাবে আজকে তুমি আমাকে প্রপোজ আজ প্রপোজ করেছো। সেদিন খুব আনন্দ লাগছিল।নীলের বাবা মা আমাকে তাদের হবু বৌমা বলে পরিচয় দেয়।
আমি ঢাকা চলে আসি।দিন কাটতে থাকে।নীল আমার জীবনটা একদম ঘুছিয়ে দেয়।অগোছালো লাইফটা সুন্দর করে দিয়েছিল।রজনীগন্ধা যখন পাইকারি বাজারে থাকে তখন দেখলেই গা গুলিয়ে ওঠে।কিন্তু সেখান থেকে যখন দু একটি এনে ফুলদানীতে রাখলে তা দেখলেই মন ভাল হয়ে যায়।ফুল সে একই থাকে শুধু অবস্থা ভেদে তার সৌন্দর্য ফুটে ওঠে।আমার লাইফটাও এমন ছিল।খুব বাজে।কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করত না।কিন্তু নীল আমার জীবনে এসে আমাকে এমন একটা সুন্দর ফুলদানীতে রাখল যে রাতারাতি আমাকে নিয়ে সবাই একরকম মাতামাতি শুরু করল।
নীল কয়েকদিন পর ঢাকা আসতে চায়।আমিও খুশি মনে রাজি হয়ে যাই।সে এসে তার মামা বাড়িতে থাকে।একদিন আমরা দেখা করতে আসি।আর মজার ব্যাপার হচ্ছে আমরা যেখানে দেখা করতে চাই সেই জায়গাটাতেই আমরা এখন দাঁড়িয়ে আছি।যায়হোক আমি আগে আগে আসি।এসে এখানে বসে অপেক্ষা করছি আর নদী দেখছি এমন সময় পিছে ফিরে তাকিয়ে দেখি নীল আমাকে রাস্তার ওপাশ থেকে ডাকছে।আমি তাকে এপাশে আসতে বলে আবার নদীর দিকে তাকাই।এমন সময় চিৎকার শুনে পিছে ফিরে দেখি…”এটুকু বলে ভ্যালা শিউরে উঠলো।
নিহাস লক্ষ্য করল তার চোখের কোনে অশ্রু। গোধুলির শেষ আলো পড়ে চিকচিক করছে।নিহাসও ধরা গলায় বলল,”তারপর”
ভ্যালা বলে চলেছে,”তারপর পিছে তাকিয়ে দেখি একটা ট্রেলার এসে নীলকে ধাক্কা দিয়েছে।তার রক্তাক্ত শরীর মাটিতে পড়ে আছে।ছুটে গিয়ে তার মাথা আমার কোলে রেখে তার পালস চেক করি।না।নেই।বেচে নেই। বেচে নেই আমার নীল।

তারপর আমি নিজেকে হাসপাতালের বেডে আবিস্কার করি।আশেপাশে ডক্টররা ছিলো।বাবা ছিল,ভিরু ছিল।কিন্তু না নীল নেই।তাহলে কি সে আসলেই আর নেই।বাবার সাথে কথা বলে জানতে পারি আজ ৩ দিন আমি সেন্সলেস হয়ে পড়ে আছি।নীলের মৃত্যুতে আমি এতবড় শক খাই যে ১ বছর পুরা পাগলের মত হয়ে গিয়েছিলাম।সুস্থ হওয়ার পর থেকেই আমি প্রতিদিন এভাবে একটা খুব সুন্দর একটা ঘুড়ি বানাই তারপর সুতা ছিড়ে উড়িয়ে দি।কারন নীলও তো আমাকে একটা ঘুড়ির মতই খুব সুন্দর করে সাজিয়েছিল।তারপর উড়িয়ে দিয়ে ছেড়ে দিল।”
ভ্যালা কথা শেষ করে নিহাসের দিকে তাকালো।দেখতে পেলো তারও দুইগাল বেয়ে অবিরাম অশ্রু ধারা বয়ে চলেছে।তারা কতক্ষণ যে একে অপরের দিকে তাকিয়ে ছিল তারা জানে না।নিহাসই প্রথম ধরা গলায় বলে,
“এত কষ্ট ছিল তোমার এই ছোট্ট বুকে”
তারপর ভ্যালা কিছু না বলে নিহাসকে জড়িয়ে ধরে বলে,”যেও না।প্লিজ কোথাও যেও না।কথা দাও আমাকে ছেড়ে কখনো কোথাও যাবা না।কথা দাও”
নিহাস ভ্যালার মাথায় মুখ রেখে বলে, “না যাব না।আমার পাগলিকে রেখে কোথাও যাব না।”

এদের ভালবাসার সাক্ষী হয়ে থাকল গোধুলীর রক্তম আভা,কিছু অবোলা পাখি আর নদীর কলকল ধনি।হয়তো নীল এখানেই কোথাও আছে।সে দেখছে ভ্যালাকে।কিংবা সে ফিরে এসেছে।হ্যা সে ফিরে এসেছে নিহাসের রূপ নিয়ে।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত