দাওনা বাড়িয়ে দু’হাত

দাওনা বাড়িয়ে দু’হাত

১ . মধ্যদুপুরের উজ্জ্বল রোদের মাঝেও একমুহূর্তের জন্য মৃদু একটা বাতাস খেলা করে যায় । ভীষণ শীতল সেই বাতাসের মাঝে মুখ ডুবিয়ে চাইলেই আমি হাজার বছর কাটিয়ে দিতে পারব । কিন্তু চোখধাধানো রোদের মাঝে সেই মিষ্টি বাতাস কখন এসে যে ক্লান্ত মুখটি ছুঁয়ে দেবে তা আগে থেকে বোঝার কোন উপায় নেই । আমি সেই মিষ্টি বাতাসটিকে এখন খুব করে চাইছি । মাঝদুপুরে রোদের ভেতর রিকশায় বসে থেকে আমি সেই বাতাসটির জন্যে অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন কাজ পেলাম না । এরকম দুপুরে খুব বিপদে না পড়লে আমি কখনো বের হইনা , আজ বিপদে পড়েই আমাকে বের হতে হল ।

আমি ভীষণ আনরোম্যান্টিক এবং বোরিং টাইপের মানুষ । একঘেয়ে সবকিছুতেই আমার ভীষণ বিরক্তি । আকাশ কালো হয়ে ঝুম বৃষ্টি নামলে আমার বান্ধবীরা যখন খালি পায়ে বৃষ্টিবিলাস করে , আমি তখন আমার নীলছাতাটা খুলে শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকি আর রাস্তার কাঁদার দিকে তাকিয়ে একটু পরপর ভীত দৃষ্টি দেই । ক্লাস শেষে সবাই যখন ক্যাম্পাসে মজা করে আড্ডা দেয় আমি তখন চুপচাপ বাসায় এসে পড়ি । আমি জানি বন্ধুদের আড্ডায় উপভোগ করার অনেক কিছু আছে , কিন্তু আমি আসলে কেন যেন এরকম অদ্ভুত টাইপের ।একা একা সময় কাটাতেই কেন যেন আমার ভীষণ ভাল লাগে । ক্লাসের পড়াশুনার বাইরে বিভিন্ন ধরনের বই নিয়েই আমি খুব আনন্দে দিন কাটিয়ে দিতে পারি । এরকম অদ্ভুত একটা মেয়ের সাথে সবার বন্ধুত্ব হয়না , আমি নিজেই আশা করিনা । কিন্তু তাও আমার বান্ধবীরা আপ্রান চেষ্টা করে যায় আমাকে বদলাবার । আজকে মধ্যদুপুরে আমাকে বের করানোটা তাদের একটি প্রচেষ্টা । ঈদের কয়েকদিন পর আমার বন্ধুরা আজ সবাই বের হচ্ছে । সবাই মিলে কোথাও খেতে যাবো ,এই প্রস্তাব শুনে আমার অন্য তিন বান্ধুবি যখন হৈহৈ করে রাজি হল , বেরসিক এই আমি তখন বলেছিলাম ,” এত রোদে ? আচ্ছা দেখি ” অবশেষে ছাড় পাইনি । ঈদের একসপ্তাহ পর আজ দুপুরে নীরা এসে যখন খুব করে ধরল , যেতেই হবে , আমি তখন অসহায়ের মত আম্মুর দিকে তাকালাম । আম্মু প্রশ্রয়ের হাসি দিয়ে নীরাকে বলল ,” মেয়েটাকে বেঁধে নিয়ে যাও তো , কোথাও যেতে চায়না । দড়ি লাগলে বলো ” অতঃপর আমি নীরার সাথে রিকশায় বসে আছি । আমার আরো দুজন বান্ধবি আলাদাভাবে রওনা দিয়েছে , আমরা পৌঁছানোর আগেই তাদের পৌঁছাবার কথা । সেগুনবাগিচার কোন এক অখ্যাত রেস্তোরায় নীরা আমাকে নিয়ে গেল , সেখানকার কোপ্তা বা কোন একটা কাবাব নাকি ভীষণ টেস্টি । আমি যেহেতু কম বেড়াতে যাই তাই ওদের উপরই আমার ভরসা রাখলাম । রেস্তোরায় ঢুকতেই দেখি আমাদের বিশ্বঝগড়াটে তাথৈ এক ছেলের সাথে (দেখে মনে হল হোটেল বয় ) গলার রগ ফুলিয়ে ঝগড়া করছে । কাহিনী কি সেটা জানতে কাছে গেলাম , যা বুঝলাম তা হল এই হোটেল বয় কোথাও থেকে একবালতি পানি আনছিল , ঠিক সেই টাইমে তাথৈ এর সাথে সংঘর্ষের ফলে কিছু পানি তার ওড়না আর পায়জামা ভিজিয়ে দিয়েছে । তাথৈ এখন ক্ষতিপুরন চায় । হোটেল বয় হাবলা হয়ে গেছে ,কি বলবে সে । আমি তাথৈকে গিয়ে বললাম ,” বাদ দে না , বয়দের সাথেও ঝগড়া করবি ?” হোটেল বয় অথবা ঐ টাইপের ছেলেটি কাঁদোকাঁদো হয়ে আমার দিকে তাকাল ,এদিকে তাথৈ আমার কথায় দ্বিগুণ তেজে জ্বলে গেল । উপরওয়ালার ইচ্ছাতেই বোধ হয় ঠিক তখনই একজন সুদর্শন ছেলের আবির্ভাব হল ।ছেলেটি নিজেকে ম্যানেজার হিসেবে পরিচয় দিয়ে ক্ষমা চাইল এবং বলা যায় সাথে সাথেই ক্ষমা ( ভালবাসাসহ ) পেতে সক্ষম হল । আমি অবাক হয়ে দেখলাম, সেই ছেলেটিকে দেখামাত্রই তাথৈ এর মন ঠান্ডা হয়ে গেল । সেই হোটেল বয় ততক্ষনে চম্পট । তবে আমি ১০০ % নিশ্চিত , তাথৈ এখন সপ্তাহে একবার হলেও এখানে খেতে আসবে । যতক্ষণ ওদের সাথে থাকলাম কথার টপিক জুড়ে সেই হ্যান্ডসাম ম্যানেজার সাহেবই ছিলেন । সেদিনকার ভ্রমন শেষে বাসায় ফিরে রাতে যখন ফেসবুকে বসলাম , দেখলাম তখনও আমার প্রত্যেক বান্ধবির স্ট্যাটাসে সেই সুদর্শন ছেলেটি বর্তমান । তাকে নিয়ে আমার কোন আগ্রহ নেই বলে আমার বান্ধবিরা ভীষণ হতাশ । রাগে আর বিরক্তিতে এফবি তে আর থাকলামই না । বন্ধুদের সাথে প্রথম খেতে গিয়েই আমি যে এমন একটি অর্থহীন অদ্ভুত ঘটনার মুখোমুখি হবো সেটা আমি কখনই ভাবিনি । তবে যা হবার ভালই হয়েছে , ওদের সাথে আমি অন্তত আর কোথাও যাচ্ছি না ।

২. আমি ভীষণ রগচটা টাইপের মেয়ে , অল্পতেই আগুন হয়ে যাই । আমার আব্বু আম্মু ৮০% সময়েই আমার মন জুগিয়ে চলার চেষ্টা করে আর আমার একমাত্র ছোট ভাই সামি ভয়ে আমার কাছেই আসে সময় মেপে মেপে । সামি ক্লাস সিক্সে পড়ে । আলজেব্রা করতে গিয়ে এপর্যন্ত সে যতবার ধরা খেয়েছে তাতে আমার বাবা মা পুরোপুরি হতাশ । সামি আমার কাছে পড়তে আসেনা , অথবা ভয় পায় ,কিন্তু একটা কথা আমি একবাক্যে স্বীকার করি যে পড়ানোর ধৈর্য আমার খুবই কম , একটা জিনিস দুইবারের জায়গায় তিনবার বলতে গেলে আমার মাথায় আগুন লেগে যায় । আমি প্রায়ই মায়ের আহাজারি শুনি , বাসার মাঝে ঢাবিতে কেমিস্ট্রি পড়ুয়া মেয়ে থাকতেও কেন তাদের ছেলে আলজেব্রায় লাড্ডু পাবে । আমি ও মাঝে মাঝে চিন্তা করি , কিন্তু নিজেকে বদলাতে পারিনা ।

একদিন ক্লাস শেষে আমার বাসায় আসতে আসতে বিকেল হয়ে গেল । বাসায় ঢুকে ড্রয়িং রুমের পাশ দিয়ে আসার সময় দেখলাম সোফায় সামি আর তার পাশে অন্য একটা ছেলে বসে কথা বলছে । প্রথমে ভাবলাম হয়ত সামির কোন বন্ধু , কিন্তু কন্ঠ শুনে মনে হল ছেলেটি আর যাই হোক সামিদের বয়েসী না । আমি একটু থেমে পর্দার আড়ালে চোখ রাখলাম । ছেলেটিকে দেখে আমি নড়তে ভুলে গেলাম এবং তাকে চিনতে পারার পর আমি আকাশ থেকে পড়লাম । উৎসাহী পাঠকেরা হয়ত এক আর একে দুই মিলিয়ে নিজেরাই বুঝে নিয়েছেন যে ছেলেটি হয়ত সেগুনবাগিচার সেই হোটেলের ম্যানেজার । কিন্তু তাদের উৎসাহে ছাই ফেলে আমি বলছি , ম্যানেজার হলে হয়ত তাথৈয়ের জন্য হলেও ভাল হত , কিন্তু সোফায় যে ছেলেটি বসে আছে সে ঐ হাবলা হোটেল বয় ছাড়া আর কেউ না ! আমি টলতে টলতে নিজের রুমে ব্যাগটা রেখে বসে পড়লাম । একটু পর দেখি আম্মু খুশি খুশিমুখে এসে বলল ,” মুন রে , সামির জন্যে একটা বুয়েট ছাত্র খুঁজছিলাম , পেয়ে গেছি , আয় কথা বলবি ” বুয়েট ছাত্র ?হোটেল বয় আবার বুয়েট ছাত্র হয় কি করে ? উৎকণ্ঠা চেপে কাহিনীর বাকি অংশ দেখতে আম্মুর সাথে ড্রয়িং রুমে গেলাম । আম্মু বলতে লাগল ,” তোর শেফালি আন্টির ভাসুরের ছেলে ।”আম্মুর বান্ধুবির কোন অভাব না থাকায় শেফালি আন্টি কে, সেটা সেই মুহূর্তে মনে পড়ল না । কিন্তু ঐ হোটেল বয়কে ছেচা দেবার জন্যে একটা ” খায়াফালামু” লুক নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম । ছেলেটি যখন আমাকে দেখল , তখন সে আকাশ থেকে না পড়লেও আমি মোটামুটি নিশ্চিত সে মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংকের ছাদ থেকে পড়ল । কয়েকমুহূর্ত পর বলল ,” আমি আবীর ” ।

আম্মু বলল ,” মুন , আবীর বুয়েটে থার্ড ইয়ারে পড়ে , সামিকে আলজেব্রা পড়ানোর জন্যে ওকে রাখলাম । ” এনাফ , দিস ইস এনাফ , এই ছেলেকে আর সুযোগ না দিয়ে আমি বললাম , ” আম্মু , এই ছেলে মোটেও বুয়েটে পড়েনা , একটা হোটেলের বয় সে ।পয়সা কামাবার জন্য যে সে এসে বলবে আমি বুয়েটে পড়ি আর তোমরা তাকে ঘরে এনে বসাবা ? এই ছেলেকে আমি সেগুনবাগিচায় একটা হোটেলে বালতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছি ।তাথৈয়ের গায়ে পানি ও ফেলে দিছিল , আর নাম বলছে আবীর , খোজ নিয়ে দেখ আসল নাম খাবীর । যত্তসব ! ” আম্মু হতবাক হয়ে বলল ,” কি বলছিস পাগলের মত ?” আবীর বা খাবীর যাইহোক , সে একটু কাশল ,” আন্টি , আমি ক্লিয়ার করছি , আসলে ওইদিন আপনার মেয়ে আমাকে একটা হোটেলে বালতি হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছে তো , তাই এসব ভেবেছে । আসলে সেগুনবাগিচার ঐ রেস্তোরা আমার কাজিনের ,কাছেই আমাদের বাসা , আপনি তো গিয়েছেনই । ওইদিন হঠাত পানি সাপ্লাই বন্ধ হওয়াতে আমার কাজিন আমাকে ফোনে বলে আমি যেন বাসা থেকে এক বালতি পানি নিয়ে যাই দোকানের থালাবাটি ধোয়ার কাজে লাগাতে । তখনি আপনার মেয়ে সেখানে আসেন । ” এতটুকু বলে সেই ছেলে আমার দিকে তাকাল ,” আপনি বুঝতে পেরেছেন ?” আমার চেহারার প্রশ্নবোধক চিহ্নটা পড়তে পেরে সে পকেট থেকে একটা আইডি কার্ড বের করে বলল ,” প্লিজ , চেক ইট । ” আমি চেক করার জন্য এগুলাম , দেখলাম আম্মু হাসি চাপতে চাপতে বলল ,” বাবা , তুমি কিছু মনে করোনা , ও একটু বোম্বাই মরিচ টাইপের ” ” না আন্টি , আমি ইন্সিডেন্টটা বুঝতে পেরেছি ” ” একটু বসো বাবা , চা না খেয়ে যেওনা ।” আম্মু যখন চা আনবার উদ্দেশ্যে চলে গেল ,আমি তখন তার বুয়েটের আইডি কার্ড চেক করায় ব্যস্ত । ছেলেটা দাঁত কেলিয়ে হাসতে হাসতে বলল , ” ম্যাডাম , ভাল করে দেখুন , আমার নাম কিন্তু মোটেও খাবীর না , আবীর । ” আমি পাত্তা না দিয়ে বললাম ,” আইডি পিকে তো গ্লাস পরেন নি ” ” গ্লাস না পরেই তুলেছি , আশা করি চেহারা মিলে গেছে ” আমি আবীরের দিকে তাকালাম । ব্ল্যাক টিশার্ট , জিন্স আর চশমায় তাকে দেখতে একচুয়েলি হোটেল বয়ের মত দেখাচ্ছেনা । আমার হঠাত করে মনে হল , আমি আসলেই বেশি বেশি করি , ব্যাপারটা মাইল্ডলি ক্লিয়ার করা যেত । আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম ,” আই এম সরি মিঃ আবীর , ফর মাই বিহেভিয়ার ” আবীর হেসে ফেলল ,” অলরেডি ফরগোট । নাম কি আপনার ? কোথায় পড়ছেন ?” ” মুন , পড়ছি ঢাবিতে কেমিস্ট্রি নিয়ে, ফার্স্ট ইয়ার ” আবীর হাহা করে হাসতে লাগল । আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম ,” হেই হাসছেন কেন ?” ” আপনার রগচটা ভাবেই আন্দাজ করেছি আপনি ঢাবির ” ”মানে ?” ” না মানে , ঢাবির পোলাপাইনদের মাঝে একটা জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও ভাব থাকে তো তাই ” হঠাত করেই আমার প্রচন্ড রাগ হল । আবীর নামের সেই বিটকেলে ছেলেটিকে আমার উকুনের মত পিষে মারার ইচ্ছে হল । এতক্ষন খারাপ ব্যবহারের জন্য যে আফসোস হচ্ছিল সেই আফসোস কর্পূরের মত উবে গেল । সামির দিকে তাকিয়ে দেখলাম , সে গোবেচারার মত একবার আমার দিকে আরেকবার ওর বদমাইশ টিচারের দিকে তাকাচ্ছে । আমি আবীরের দিকে সত্যিসত্যি একটা ” জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও ” দৃষ্টি দিয়ে তড়ংবড়ং করে জ্বলতে জ্বলতে বেরিয়ে গেলাম ।

বুয়েটের ছেলেগুলিকে এইজন্যে আমি দেখতে পারিনা, বেশি বেশি ভাব । বেতমিজ পোলা , তোর ভাবের আমি খেতা পুড়ি , আই বার্ন ইয়োর ব্লাঙ্কেট অব ভাব !

৩. আবীর সপ্তাহে তিন দিন এসে আমার জন্য আমার বাসাটিকে মোটামুটি জাহান্নাম বানিয়ে দিল । প্রথম দিন যখন সে পড়াতে আসল ওইদিনই তার সাথে আমার পাণিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধটি লাগল ।আম্মু সেদিন চা নাস্তা বানিয়ে আমাকে বলল সামির পড়ার রুমে দিয়ে আসতে । খুব ভাল , আমি স্বাভাবিকভাবেই দিতে গেলাম । কিন্তু ট্রে টা টেবিলে রেখে যখনই চলে আসব , শুনি সে ডাকছে , ” মুন , একটু শুনেন ” , আমি ফিরে তাকাতেই উনি পানির গ্লাসটা দেখিয়ে বলল ,” গ্লাস টা ধুয়ে আনবেন ? গ্লাসটা ময়লা ” আমি রাগে কথাই খুঁজে পেলাম না , তার দিকে তাকিয়ে ” তুই ছাই হয়ে যা ” দৃষ্টি দিতে দিতে বেরিয়ে গেলাম । শেষে তার ” দয়াবতী আন্টি ” গ্লাসটা পালটে দিয়েছিল বলে সামির কাছ থেকে জেনেছিলাম ।

আবীর সামিকে সন্ধ্যায় পড়াতে আসতো , যে সময়টাতে আমি কফিমগ নিয়ে বারান্দায় সময় কাটাই । বিপদ হল, আবীর যে রুমে পড়াতো তার পাশেই আমাদের বাসার বারান্দাটা । কিন্ত আমি যেহেতু দুর্বল নই , তাই ” তুই কে রে ” টাইপের ভাব নিয়ে বারান্দায় গিয়ে অন্য দিকে ঘুরে কফি খেতাম । একদিন অসাবধানে ঘাড় ঘুরাতেই দেখলাম , আবীর গালে হাত দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে , তার বিশিষ্ট মনযোগী ছাত্র তখন ” কোপায়লামু ” ভঙ্গীতে অংক করছে । আমাকে তাকাতে দেখেই আবীর একটু অপ্রস্তুত হয়ে সামির দিকে চোখ সরাল । মনে মনে বললাম ,” বজ্জাত ছেলে , চোখ সরাইলা ক্যান ? মুনের সাথে টাংকিবাজি ?” মুখ শক্ত করে আমি ওর রুমে ঢুকলাম , আবীরের সামনে গিয়ে বললাম ,” আবীরসাহেব , কাগজ দিব ? কবিতা লিখবেন ?” আবীর গা জ্বালানো হাসি দিয়ে বলল ,” কাগজতো সামনেই আছে । কবিতা লিখলে আপনি অবশ্যই জানবেন ,কেমন ?” এই বলে সামির দিকে তাকিয়ে বলল ,” দেখি ভাইয়া , খাতা দাও ” আমি জ্বলতে জ্বলতে চলে আসলাম । এভাবে সে প্রায়ই আমাকে লুকিয়ে লুকিয়ে দেখত এবং বিভিন্ন কারনে আবীর আর আমার পাণিপথের যুদ্ধ নিয়মিত ঘটতে লাগল ।

এক বৃষ্টির বিকেলে কার্জন হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি । আমার বিপদের দিনে সব রিকশাওয়ালা মামারা কেন জানি জমিদার হয়ে যান । তারা সব রিকশায় বসে ঘুমাবে , তাও প্যাসেঞ্জার নিবেনা । আমি কাদা থেকে বহু কষ্টে নিজেকে বাঁচিয়ে রিকশা ডাকছিলাম এবং ব্যর্থ হচ্ছিলাম । এমন সময়ে দেখলাম, আমার সামনে একটা রিকশা এসে থামল । আমি হতবাক হয়ে দেখলাম , প্লাস্টিকের কাগজ সরিয়ে প্রশ্নবোধক ভাব নিয়ে যে আমার দিকে তাকাল , সেই ছেলেটি আবীর । আমার ছানাবড়া চোখের দিকে তাকিয়ে বলল , ” রিকশা খুজছেন ?” আমি বললাম ,” হ্যা ” ” আজকে রিকশা পেতে প্যারা আছে । আমার সাথে আসতে পারেন , আমি আপনাদের ওদিকেই যাবো ” আমি তার অভিসন্ধি বুঝে মুখ শক্ত করে তাকালাম । আমার চোখে মুখে তখন ” থাবড়া চিনোস ?” টাইপের ভাব । আমি বললাম , ” আমি আপনার সাথে কেন যাবো ?নিজেকে কি খুব চালাক ভাবেন ? ”

আবীর আহত চোখে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকল , তারপর রিকশা থেকে নামলো । আমাকে বলল ,” আমি দুঃখিত । আপনি এটাতে উঠে চলে যান । প্লিজ না করবেন না ” আমি না করিনি , তবে অবাক হয়েছি । এভাবে সহজেই রিকশা পেয়ে আমার মনে বিজয়ের আনন্দ আসা উচিত ছিল ,কিন্তু সারাটা রাস্তায় আমার নিজেকে কেন যেন ভীষণ পরাজিত লাগল । আমি বাসায় গিয়ে বুঝতে পারলাম ,অনেক দিন পর আমার ভীষণ মন খারাপ লাগছে । মন খারাপের কারন আবীর নামের এই বেতমিজ ছেলেটি ।

সেদিনের পর থেকে আমার আর আবীরের পাণিপথের যুদ্ধ কিভাবে যেন থেমে গেল । বারান্দায় দাঁড়িয়ে মনের ভুলে না , আমি ইচ্ছে করেই আবীরের দিকে তাকাতাম ,কিন্তু তিনি তখন তার ছাত্রকে পড়ানোয় ব্যস্ত । আমার এতে খুশি হওয়া উচিত ,কিন্তু আমি হতাশার সাথে আবিষ্কার করলাম আমার কেন যেন কষ্ট হচ্ছে । আমার মন খারাপের রাতগুলি বাড়তে লাগল ,সেই মন খারাপের কারনগুলি একদম ছেচড়া মার্কা । আবীর আমার দিকে তাকায়নি ,হাসেনি ,আবীর কথা বলেনি এগুলি কি মন খারাপের কোন কারন হতে পারে ? কে যেন আমার কানের কাছে দিনরাত বলতে লাগল ,” মুন, তুই শ্যাষ !”

দুতিন দিন যাবার পর আমি মরিয়া হয়ে বুঝতে পারলাম , আমি আবীরের প্রেমে পড়েছি , যে সে ভাবে না , একদম আছাড় খেয়ে পড়েছি ।আচ্ছা এটা কিভাবে হয় ? আনরোম্যান্টিক মেয়ে হিসেবে আমার এত গর্ব এই ছেলেটা এইভাবে কেমন করে ভেঙ্গে দিল ?আমি উত্তর পাইনা ।ইদানিং আবীরকে দেখলেই আমার কেমন যেন কান্না পায় । সে যেদিন আসেনা সেদিন ও কান্না পায় , তাকে যেদিন দেখি সেদিনও আনন্দে কান্না পায় । এরকম ন্যাকা ন্যাকা কান্না রোগ আমার কেন হল বুঝলাম না , সব দোষ আবীরের । কিন্তু সে তো একদম ভদ্র হয়ে গেছে । তার কলিংবেলের আওয়াজে দরজা খুলে আমি যখন তার চোখে সেই দুষ্টুমি খুঁজি , সে তখন রোবট মার্কা হাসি দেয় । আবীর, আমি তোমাকে কিভাবে বুঝাই তোমার জন্য আমার মাঝে কি হয়ে গেছে । আমার সব দর্পচূর্ণ করে, পানিপথের যুদ্ধে আমাকে হারিয়ে দিয়ে কেন আমার গলায় অবহেলার তলোয়ার চেপে ধরেছ ? হয় মেরে ফেল , না হয় হাতটা বাড়িয়ে দাও । এই ছেলে, তোমাকে আমি কিভাবে বুঝাই ,তোমার জন্যে আমি মরে যাচ্ছি ।

সামির ফাইনাল পরীক্ষার রেজাল্ট দিয়েছে । সে গনিতে ৯৫ পেয়েছে । আবীর নাকি দুইমাস আসবেনা ,সামির ক্লাস শুরু হলে আসবে । শোনার পর থেকে আমার মাথা টলছে । আব্বু আম্মু যখন সামিকে বাহবা দিয়ে বলছে ,” আবীর সামিকে পালটে দিয়েছে ” , আমি তখন মনে মনে চিৎকার করছি , ” আবীর মুন কে শেষ করে দিয়েছে ।”

৪. দুইদিন ধরে শুধু ভেবে চলেছি কিভাবে আগের মত হয়ে যাব । ক্লাসের পড়াশোনা নিয়ে বসে থেকেছি , লাভ হয়নি । সায়েন্স ফিকশান নিয়ে হা করে বসে থেকেছি , মেজাজ বিগড়ে গেছে । শরৎচন্দ্র নিয়ে বসলাম , পড়তে পড়তে আবীরের কথা মনে পড়ল , কেঁদে বালিশ ভিজাচ্ছি । যা একটু ঘুমাচ্ছি , স্বপ্নের মাঝে সেই বদমাইশ এসে দাঁত কেলিয়ে হাসে , তার মায়া মায়া চোখের দিকে তাকাতে গিয়ে ঘুম ভেঙ্গে যাচ্ছে । এইটা কোন জীবন না । এইভাবে আমি বাঁচতেও পারবোনা । প্রচন্ড ঘোরের মাঝে পড়ে গেছি ।

বিকেলে ক্লাস শেষ করে একা একা হাঁটছিলাম । যে আমি কিনা রিকশা ছাড়া কোথাও নড়িনা তার এই অবস্থা হওয়াটা একটু অদ্ভুত বটে । ইদানিং এটা আমার প্রিয় একটা কাজ হয়ে গেছে । হঠাত আমি আবিষ্কার করলাম সেই বান্দর শহীদ মিনার প্রান্তরে দাঁড়িয়ে মরিচের গুঁড়া মাখানো লাল শসা খাচ্ছে । ঊর্ধ্বশ্বাসে আর রাগে মাথা হ্যাং হয়ে গেল । আমি ” যাবনা যাবনা ” করতে করতে কখন ঠিক তার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম টেরই পেলাম না । আবীর তার বিখ্যাত রোবটিক হাসি দিয়ে বলল ,” কি খবর মুন ?” আমি দাঁত কিড়মিড় করে বললাম ,” খবর তোমার মাথা ” ” শসা খাবা ? সোহরাওয়ারদী হল থেকে খাওয়া শুরু করছি । ঝালের জন্য অল্প করে করে খাচ্ছি । টেস্ট করে দেখবা ?” আমি লজ্জার মাথা খেয়ে বললাম ,” আমাদের বাসায় আসো না কেন ? আর কোথাও গিয়ে টাংকি মারতেছ ?” আবার সেই বিখ্যাত ” কেলানো ” , ” টাংকি তো এখনি মারতেছি । শসা টেস্ট করতে বললাম না ?” আমি চোখ পাকিয়ে বললাম ,” তোমার মত ছেলেকে দিনরাত উঠতে বসতে থাবড়ানো উচিত । উঠার সময় থাবড়া , বসার সময় থাবড়া ।” কিছুক্ষন পর সে আমার দিকে তাকাল , অদ্ভুত একটা দৃষ্টিতে , এই দৃষ্টির মানেই বোধ হয় ভাল লাগা । ” তুমি কি আমার প্রেমে পড়েছ ?” ” কাজ নাই আমার ? ঘুশি মেরে তোমার চশমা আমি গুঁড়া করে দিব ” ” সেটা তুমি পারবা , কিন্তু তার আগে বল ,প্রেমে পড়ছ আমার ?” আমার নিজেকে অনেক অসহায় লাগল । একবার ভাবলাম , পালিয়ে যাই , পালিয়ে বাঁচি । কিন্তু তার আগেই সে বলল ,” তুমি কিন্তু ধরা খেয়ে গেছ ।” আমি থমথমে গলায় বললাম ,” ভাল হইছে ” আবীর শসা খাওয়া শেষ করে বলল ,” মুন , একটা কবিতা পড়বা ?আমার লেখা প্রথম কবিতা, তোমাকে দিবো বলে একমাস ধরে পকেটে নিয়ে ঘুরতেছি ।” আমার জবাবের অপেক্ষা না করেই সে মানিব্যাগ হাতড়ে আমাকে ভাজ করা একটা কাগজ ধরিয়ে দিল । কাগজটা খুলে পড়া শুরু করলাম । আমায় একটুখানি শুভ্র সুখ দেবে ? তাতে আমার নীল কষ্ট মিশিয়ে আমি তোমায় এনে দেবো নীলচে চাঁদ । আমায় দেবে তোমার আলোর মতন হৃদয় ? তাতে আমার আবীরমাখা মন মিলিয়ে আমি তোমায় এনে দেবো নতুন প্রভাত । দাওনা বাড়িয়ে দু’হাত !

আমি আমার ঝাপসা হয়ে যাওয়া চশমাটা খুলে ওর দিকে বাড়িয়ে বললাম ,” কাঁদতে কাঁদতে চশমা ঘোলা হয়ে গেছে । মুছে দাও । ” ঝাপসা চোখে তাকিয়ে দেখলাম ,আবীর ওর শার্টের হাতা দিয়ে গভীর মনোযোগে আমার চশমা মুছে দিচ্ছে ।

আচ্ছা ,এই ছেলেটা এমন বদমাইশ প্রজাতির ভাল কেন ?

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত