বই চুরি

বই চুরি

লাইব্রেরী থেকে এই পর্যন্ত চোদ্দটা বই চুরি করেছি। আজকে চুরি করলে হয়ত পনের সংখ্যাটা পুরন হবে। তবে চুরি বলা ভুল হবে।এগুলো নিজের মালিকানা করার ইচ্ছে নেই। বিশটা বই পুরন হওয়ার পরে এক সাথে ফেরৎ দিবো। এ যাবত যত বই নিয়েছি,সব গুলোই পুরাতন। একটি বইও নতুন নয়। তবে বই গুলো এই লাইব্রেরীর কেনা নয়। এখানে সব দান করা বই।

আজকেও অনেক কষ্টে বইটা চুরি করে বাসায় নিয়ে এসেছি। কিন্তু বইটা খোলার পরে অনেক জোরে ধাক্কা খেয়েছিলাম। বলতে গেলে ভূত দেখার মতই চমকিয়ে উঠেছি।
কারণ,বইটার ভেতরে একটি সাদা পৃষ্ঠায় লেখা ছিল।

‘ভেতরে একটা চিঠি আছে। খুব কষ্ট করে তোমার জন্য লিখেছি। তুমি চিঠিটা পড়লে হয়ত আমি বেঁচে যাবো।’
মারাত্মক ভাবে কৌতুহল চেপে বসেছিল। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ঘাটলাম। কিন্তু কোনো চিঠি পেলাম না। তবে একটা জিনিস খেয়াল করতে ভুলে গেছি। প্রত্যেকটা পৃষ্ঠাতে কিছু কিছু শব্দ মার্ক করে পাশে লেখা ছিল। দেখা সত্ত্বেও এটা অতটা আমলে নিইনি।

রাগ করে বইটা পাশে রেখে চুপ করে বসে রইলাম। জানালা দিয়ে বাহিরে তাকিয়ে আছি।
ভাবতে লাগলাম।
চিঠিটা কি এই বইয়ের ভেতরে আদৌ কি ছিল ?
নাকি যাকে বইটা দেওয়া হয়েছিল,সে চিঠিটা নিয়ে বইটা রেখে চলে গেছে।
বিষয়টা মিলাতে পারছিলাম না।
সারাদিন ভাবার পরে সন্ধায় বইটা নিয়ে বসলাম। ইরানী লেখকের বই। বাংলা ভাষায় অনুবাদ করা।
প্রথম পৃষ্ঠায় বেশ কয়েকটা শব্দ মার্ক করা।
যথেষ্ট- ছয় দেখতে-তেরো।
এভাবেই। তবুও মাথায় কিছু ঢোকেনি আমার।
দেড় দিনে বইটা শেষ করার পরে আবার ভাবলাম। এই সংকেত গুলো কি হতে পারে।
বইটা যদিও মারাত্মক রোমান্টিক ছিল।
খাতা নিয়ে বসে সব শব্দ উঠালাম। প্রায় শব্দে বিভিন্ন নম্বর দেওয়া।
এবার দেখা যাচ্ছে,এই শব্দ গুলো যদি যোগ করা হয়। তাহলে বিশাল বড় না হলেও ছোট খাট একটা চিঠি হয়েই যাচ্ছে।

এক নম্বর ধরে সিরিয়ালে শব্দ বসাতে শুরু করলাম।
” তুমি লাইব্রেরীর কাজ করছো। এটাই যথেষ্ট আমার জন্য। আর কিছু লাগবে না আমার। সেদিন রাগের মাথায় অনেক কিছু বলে ফেলেছি । মাফ করো আমায়। ক্ষমা করে দাও। তোমাকে পাশে না পেলে মরা ছাড়া অন্য কোনো পথ নেয়। তুমি একটি বার দেখতে এসো। আমি তোমার হাত ধরে বেরিয়ে যাবো। তা না হলে প্রতিটা দিন বিক্রি হতে হবে আমাকে। আমাকে বিক্রির মেয়ে বানিও না। আমি তোমার গুলিস্তা হতে চাই। তোমার হুর হতে চাই। আমাকে দয়া করে বিক্রির মেয়ে বানিও না। আমাকে বাঁচিয়ে তোমার সেই নগ্ন বুকে আবার চেপে ধরো। কোনো দিন কষ্ট দিবো না তোমাকে। ছোট কাপর বিহীন শাড়ি পরে নাচবো তোমার সামনে । সারা রাত তোমার মাথাতে হাত বুলিয়ে দিবো। তোমার বুকে শান্তি খুঁজে নিব। তবুও রাগ করে জুলুম করোনা আমার প্রতি। দয়া করে বিক্রির মেয়ে বানিও না আমাকে। তোমার হুরকে এত নিচে নামিয়ে দিও না ।

তোমার কাছে,তোমার হুরের এই ইচ্ছা। সে তোমার বুকে সারা জীবন শান্তিতে মাথা রেখে যেন,কাটিয়ে দিতে পারে।”
পুরোটা ঠিক করার পরে একটা পাথুরে মুর্তি হয়ে গেছিলাম। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল,এই চিঠিটা যেন আমার জন্যই তৈরি করা হয়েছে।

কপালের ঘামটা মুছে এই চিঠিটার কিছু অর্থ খুঁজতে চেষ্টা করলাম।
কত ভালবাসা আর কত কৌশল দিয়ে যে ,এই চিঠিটা তৈরি করেছে। সেটা গভীর চিন্তাতে মগ্ন হয়েও ভাবা শেষ হবে না।

প্রথম লাইনটা দেখে একটি মুখ ভেসে আসলো সামনে। সেটা এই বুড়ো লাইব্রেরীয়ান। মামার কাছে শুনেছি,যুদ্ধের অনেক আগে থেকেই তিনি এখানে আছেন।
তাহলে কি এই চিঠিটা !

নাহ,অন্য কারোতো হতে পারে। কিন্তু যদি এই বুড়োটারি হয় ? চিঠিটা আর বইটা হঠাৎ তার সামনে মেলে ধরার দরকার।

পরের দিনও এই চিঠিটা নিয়ে গবেষনা চালালাম। এত নিখুত ভাবে কি করে সম্ভব একটা গোপন চিঠি লেখা। আর এই গোপন চিঠির রহস্যটাই বা কি হতে পারে ?
সেটা ভাবার পরেও কোনো উত্তর মিলছিল না।

বিকেল বেলায় গেলাম বুড়োর সেই রুমে। আমার প্রায় আসা যাওয়ার কারণে অনেকটা খাতির জমে গেছে। রুমে গিয়ে দেখি,আলিশান ভাব নিয়ে একটা পত্রিকা সামনে মেলে ধরে আছে। খুব মনোযোগ দিয়ে পড়ছে।
তার সামনের সোফাতে বসতে বসতেই বললাম।

দাদু, এত পড়ে জীবনে করবেনটা কি। সারা জীবনতো এই লাইব্রেরীতেই পার করে দিলেন।
হ্যারে,দাদা। ঠিকি বলেছিস। কি আর করবো বল। তোদের মত পাঠক আছে বলেই এখনও এই বুড়োটা জিতে আছে। তোরাইতো আমার শক্তি।

একটা মুচকি হাসি দিলাম। তারপর হাতের বইটা বুড়োর সামনে মেলে ধরে জিজ্ঞেস করলাম।
দাদু,এই বইটা কখনও পড়েছেন। দারুন একটা বই কিন্তু। মারাত্মক রস রসে রোমান্টিক।
আমি তখন তার দিকেই তাকিয়ে ছিলাম। আমার কেন যেন মনে হচ্ছিল,আমি ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছি হয়ত।
বুড়োর চেহারাটা এমন ভাবে কুচকিয়ে গেছে । মনে হচ্ছিল,এখনি হয়ত কোনো অঘটন ঘটে যাবে।
চোখের চশমাটা সরিয়ে আমাকে আতঙ্কের স্বরে জিজ্ঞেস করে।

এ,এ,এই বইটা তুই পেলি কোথায় ?
কেন ,ওই গোডাউনের পেছনের তাকে।
দেখি বইটা দেখি।
আমার হাত থেকে ছো মেরে বইটা নিয়ে নিল।
পাগলের মত কি যেন খুঁজছে। অস্থিরতার মাত্রা যেন তারিয়ে বেড়াচ্ছে তাকে।
এখন মনে হচ্ছে। সন্দেহটি ঠিকি ছিল। কোনো ভুল মানুষকে সন্দেহ করিনি।
তখন বুড়োর হাতে আমার সাজানো চিঠিটা ধরিয়ে বললাম।
দাদু,প্রত্যেকটা কোড সহ নিখুত ভাবে মিলিয়ে দিয়েছি। মন দিয়ে পড়ে নিয়েন।
কথাটা শেষ করে বাসার দিকে হাটা দিলাম।
পেছনে তাকানোর ইচ্ছে ছিল না। হয়ত অন্যরকম একটা চেহারা দেখতে হতো। থুরথুরে বুড়ো হয়ে গেছে। কিন্তু সেই পুরোনো উষ্ণ সৃতিটা মুছে যায়নি। বইটা হাতে পাওয়ার পরে সেই অস্থিরতাটাই তার প্রমান।
পরেরদিন সব বই গুলা ফেরৎ দিতে আসলাম। এসে শুনি বুড়ো মারাত্মক জ্বরে আক্রান্ত।
আহারে বেচারা বুড়া। ধকল নিতে পারেনি মনে হয়।

রুমে গিয়ে দেখি কম্বলের নিচে শুয়ে আছে । পাশে বুড়োর নাতনি তার মাথায় হাত বুলিয়ে ঘুম পারানোর চেষ্টা করছে হয়ত।

আমাকে দেখে পিচ্চিকে বাহিরে যেতে বলে।
বুড়োর দৃষ্টি তখন বাহিরের দিকে। জানালা ভেদ করে তাকিয়ে আছে।
গম্ভির কন্ঠে কথা বলতে শুরু করে।

ঊর্মিলা আত্মহত্যা করেছিল। কোনো কারণ জানতে পারেনি কেউ। আর আমিও তাকে বাঁচাতে পারিনি। অনেক ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলাম,সেই চিঠিটা পড়ার জন্য। কিন্তু চিঠিটা পাইনি। ভেবেছিলাম,পথে হয়ত সেটা হারিয়ে গেছে। তারপর ছুটি নিয়ে কোলকাতা যাবো ভেবেছিলাম। কিন্তু বিশাল সমস্যার কারনে ছুটিটাও পাইনি।
এর মধ্যে হঠাৎ একদিন খবর পাই। ঊর্মিলা আর নেই। বইটাও কোথাও হারিয়ে ফেলেছিলাম।

কিন্তু আজ এত বছর এই বইটা আমাকে সেই দিনটাতে দাড় করিয়ে দিয়েছিল। মনে হচ্ছিল,আমার ঊর্মিলা এখনও আছে।

আসলে তোর মত বুদ্ধি ছিল না । চাপের মুখে মাথাটাও খাটাতে পারিনি তখন। এই নির্বুদ্ধিতার কারণেই হয়ত হারাতে হয়েছে তাকে।

ঊর্মিলার দুলাভাই ছিল নারী বিক্রেতা।মা মারা যাওয়ার কারনে মেয়েটাকে এই জাহান্নামে যেতে হয়েছিল। হতে পারে,দুলাভাইয়ের ভয়েই এই ভাবে গোপন চিঠি লিখেছিল।
যাক গে,বাদ দে ওসব।

তুই যে,এত দিন পরে তার কথা এভাবে মনে করিয়ে দিয়েছিস। সেটাই বা কম কিসের।
লাইব্রেরীটা ঘেটে দেখ। আরো কত চাপা ইতিহাস পরে আছে। যেগুলো আমার থেকেও মারাত্মক জঘন্যকর।
বুড়োর সাথে কথা শেষ করে এসে বসে বসে ভাবছি। আহ,এই বুড়োটা কত নিখুত ভালবাসটা হাত ছাড়া করলো। যদিও এটা একটি সত্য ঘটনা।

কিন্তু আমাদের কাছে এগুলো ইতিহাস ছাড়া আর কিছুই নয়। কারণ,এমন ঘটনা সমাজে প্রায় বিলুপ্ত পথে। এখন ভালবাসা মানে সারা জীবন পাশে নয়। খানিক সময় সুখের জন্য !

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত