ক্যানভাসের গল্প

ক্যানভাসের গল্প

যুক্তরাষ্ট্রের সিয়াটলের ছোট্ট একটা সুপার শপ থেকে বেরিয়ে তুষারপাত দেখে বিরক্তিতে ভ্রু কুঁচকে ফেলল নীরা। সুপার শপটির দুই ব্লক পরেই একটি বহুতল ভবনের দোতালায় তার ফ্ল্যাট। এতটুকু রাস্তা এই প্যাচপেচে অবস্থায় হেঁটে যেতে হবে ভেবেই তার এত বিরক্তি। বামহাতে বেশ বড়সড় একটা ব্যাগে গৃহস্থালি টুকিটাকি জিনিস। ডানহাতে উলের মাফলারটি ভাল করে জড়িয়ে নিল গলায়। কোটের পকেটে হাত ঢুকিয়ে হাঁটতে শুরু করলো । নিজের বিল্ডিংয়ের সামনে এসে রাস্তার অন্যপাশে হঠাৎ চোখ আটকে যায় তার। দীর্ঘকায় এক পুরুষ বাঙালী কায়দায় গায়ে চাদর জড়িয়ে দৃঢ় কিন্তু দ্রুতপদে হেঁটে যাচ্ছে। বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে নীরার। শুভ্রদা!
এগারো বছর পরে দেখেও ঠিক চিনতে পারে নীরা। এগারো বছর পরও ঠিক আগের মতই মানুষটিকে দেখে বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে তার। শুভ্রদা এখানে কেন? পলকেই মোড়ের ওপাশে হারিয়ে যায় মানুষটি। মনে হল একটা ক্যানভাস দু’হাতে বুকের কাছে ধরে রাখা। পা দুটো অবশ হয়ে আসে নীরার।

আগামীকাল সানডে। সারাদিন ফ্রি। তবে সন্ধ্যার দিকে সিয়াটলের একটা মিউজিয়ামে ফটো এক্সিবিসন আছে। নীরার কলিগ মিসেস ফ্লোরেট তাকে এক্সিবিসনের একটা টিকিট আর ডিনারের দাওয়াত দিয়েছে। বেচারি এমন করে ধরেছে যে যেতেই হবে। তার এক আর্টিস্ট ফ্রেন্ডেরও নাকি ছবি থাকবে সেখানে। কিন্তু নীরার মনই তো ভাল নেই! ধূসর রঙের চাদর গায়ে জড়ানো দীর্ঘকায় মানুষটি যে তার মন উথালপাতাল করে দিয়েছে। সারা রাত তার ঘুম হলো না। সকালবেলা গেল উদাস ভাব নিয়ে বসে থেকে। সন্ধ্যার এক্সিবিসনের কথাও তার মনে নেই। বিকেলে মিসেস ফ্লোরেটের ফোনে ঘোর কাটে তার। বাইরে যাওয়ার জন্য তৈরি হয়।

মিউজিয়ামের প্রধান ফটকের সামনেই মিসেস ফ্লোরেটের সাথে দেখা হয়ে যায় নীরার। কফি কালার ফার কোটে দারুণ সুন্দর লাগছে মিসেস ফ্লোরেটকে। মিষ্টি হেসে এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেন নীরাকে। এখানে আসার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে ভিতরে নিয়ে চলেন।
চমৎকার সব ফটো। মুগ্ধ হয়ে দেখছে নীরা। চেরি ফুল, সুউচ্চ পর্বতমালা, মেঘযুক্ত আকাশ- প্রকৃতির নানা বিষয় ক্যানভাসে বেশ মুনশিয়ানার সাথেই ফুটিয়ে তুলেছেন আর্টিস্টরা। মিসেস ফ্লোরেট অবশ্য গল্প জুড়ে দিয়েছেন এক্সিবিসনে আসা এক দম্পতির সাথে। এসব ছবি দেখার চেয়ে গল্প করায় তার আগ্রহ বেশি কিনা!
হঠাৎ একটা ছবি দেখে দাঁড়িয়ে যায় সে। একদম বাঙালী ঘরানার ছবি। বকুল গাছের তলায় এক কিশোরী বকুল ফুল কুড়াচ্ছে। কিশোরীর চঞ্চলতা একদম স্পষ্ট মেয়েটির মুখে। যেন গাছটি তার সামনেই। চোখের সামনে সে কিশোরীটির প্রতিটি অভিব্যক্তি দেখতে পাচ্ছে। এমন জীবন্ত ছবিটির আর্টিস্ট কে? ক্যানভাসের এক কোণায় নাম সাইন করা, শুভ্র। আবার চমকে ওঠে নীরা। শুভ্র! কোন শুভ্র? পেছনে কোনো মানুষের উপস্থিতি টের পেয়ে ঘুরে দাঁড়ায় সে। বিস্ময় বেড়ে যায় আরেক ধাপ। মানুষটা শুভ্রদা। তার শুভ্রদা। আসলেই কি তার? বিস্ময় চাপা দিতে পারে না সে। অস্ফুটে বেরিয়ে আসে, শুভ্রদা, তুমি এখানে?
শুভ্র নামের মানুষটিও যে কম চমকায়নি তা তার চেহারা দেখেই বোঝা যায়। তবে মুহূর্তেই সামলিয়ে নেয় সে। শিশুসুলভ হাসি মাখা মুখে স্বাভাবিকভাবেই বলে, আমিও তো সেটাই ভাবছি নীরু। তুই এখানে কেন?
নীরু নামটা শুনে আবার হাত- পা অবশ হয়ে আসে নীরার।

নীরা তখন সবে দশম শ্রেণীতে পড়ে। আর শুভ্রদা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের শেষ বর্ষ। দু’জনের পরিবারই কলাবাগানের একটা কলোনিতে থাকে। রক্ষণশীল পরিবারের নীরার বাবা সরকারী ব্যাংকের ম্যানেজার। মা কলেজের লেকচারার। আর শুভর বাবা একটা সরকারী অফিসের কেরানী। মা গৃহিণী। শুভ্রদার দারুণ জনপ্রিয়তা ছিল এলাকায়। দেয়ালে দেয়ালে বা রাস্তায় আল্পনা আঁকা, নানা অনুষ্ঠানে সব কিছুর ব্যবস্থা করে দেওয়া, হলি বা পহেলা বৈশাখে সবার গালে আঁকানো – সবকিছুতেই শুভ্রদা ছিল অপরিহার্য। লাজুক নীরা অবশ্য কখনও কথা বলেনি শুভ্রদার সাথে। তবে সবার মুখে মুখে তার কথা শুনে ভালই চেনে। এসএসসি পরীক্ষার মাস তিনেক আগে এই শুভ্রদাকেই কোথা থেকে বাবা ধরে এনে বললেন, সামনে তো পরীক্ষা। কিছুই পড়িস না। শুভ্র অনেক ব্রিলিয়ান্ট। আজ থেকে ও তোকে পড়া দেখিয়ে দেবে।
অবাক হয় নীরা। এলাকার হিরো তাকে গণিত করাতে পারবে নাকি! তবে বাবার কথার ওপর তো আর কথা হয় না।
পরেরদিন থেকেই পড়াতে আসে শুভ্র।
নীরা মনোযোগী ছাত্রী। সিলেবাসও তার মোটামুটি কমপ্লিট। আবার নতুন করে কী পড়বে? তাই পড়ার চেয়ে গল্পই হয় বেশি। শুভ্রদা শুধু যে ভাল আঁকিয়ে, তাই – ই নয়। হাত নেড়ে নেড়ে গল্পও বলে সুন্দর।
নীরা মুগ্ধ হয়ে শোনে।
এই মুগ্ধতা কবে যে তাকে তীব্র ভালবাসায় আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলেছে তা নিজেও জানে না।যখন জানলো তখন আর ফিরে আসার পথ ছিল না।

একটা প্রয়োজনীয় বই কিনতে স্কুল শেষে নীলক্ষেতে যায় নীরা। বই কেনা শেষে দেখে শুভ্রদা যাচ্ছে একটা বইয়ের দোকানের দিকে। ডাক দেয় সে। ফিরে তাকিয়ে নীরাকে দেখে মৃদু হেসে এগিয়ে আসে শুভ্রদা। জিজ্ঞেস করে, বই কিনতে এসেছিস? হাতের বইটা দেখিয়ে নীরা উত্তর দেয়, কেনা শেষ। এখন বাসায় যাব।
তুমিও কিনবে নাকি? হ্যাঁ, উত্তর দেয় শুভ্রদা।
নীরা বলে, কিনে বাসায় যাবে তো? তুমি দেখো বই, একসাথে বাসায় যাব।
ঠিক আছে নীরু, তুই অপেক্ষা কর, আমি বইটি কিনে নিয়ে আসি। মৃদু হেসে এগিয়ে যায় শুভ্রদা। নীরার মেজাজ গরম হয় ‘তুই’ করে বলাতে। আরও বেশি বিরক্ত লাগে তার যখন সুন্দর নামটাকে সে বিকৃত করে ‘নীরু’ ডাকে। রাগে গজগজ করতে করতে অপেক্ষা করে সে। মানুষটা বই ঘাঁটতে ব্যস্ত। আর কোনোদিকে খেয়াল নেই যেন। চুপচাপ তাকে দেখছে নীরা। পাক্কা আড়াই ঘণ্টা পর হাতে দুইটি বই নিয়ে এসে হেসে বলে শুভ্রদা, দস্যু বনহুরের বই দু’টো পেলাম। একদম প্রথমদিকের প্রিন্ট। দারুণ না?
সংবিৎ ফিরে পায় নীরা। আরে! আড়াই ঘণ্টা হয়ে গেছে সে একভাবে দাঁড়িয়ে ছিল এই মানুষটার অপেক্ষায়।

নীরা তখন শুভ্রদার শুভ্রতায় বিবশ। সে ঠিক করে ফেলেছে পরীক্ষার আগের দিন শুভ্রদাকে বলে দেবে তার ভাল লাগার কথা। আর বলবে শুভ্রদা যেন তার একটা ছবি এঁকে দেয়। ভরা জ্যোৎস্নায় সে নীল শাড়ি পড়ে একটা পুকুরপাড়ে বসে থাকবে। পুকুরের পানিতে তার ছায়া দেখা যাবে। এমন একটা ছবি।

পরীক্ষার আগের দিন শেষ বিকেলে ছাদে দাঁড়িয়ে নীরা জানায় তার ভালো লাগার কথা। শুভ্রদা উদাস দৃষ্টি নিয়ে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তার দিকে। তারপর হেসে বলে, তুই মজা করছিস, তাই না নিরু? না! দৃঢ় গলায় বলে নীরা। আবার হাসে শুভ্রদা।
নরম সুরে বলে, দেখ নীরু, তুই মুসলিম আর আমি হিন্দু। সমাজ তো দূরে থাক, আমাদের পরিবারও এটা মানবে না। আর আমার মত গরীব ঘরের ছেলের সাথে তোকেই বা মানাবে কেন? শোন, তুই এখনও অনেক ছোট। এসব আবেগ বড় হলে থাকবে না। তাই পড়ালেখায় মন দে। পরীক্ষাটা ভাল করে দিস।
নির্মম কথাগুলো বলে চলে যায় শুভ্রদা। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে নীরার। শুভ্রদা এমন করতে পারলো!

ভেঙ্গে পরে না নীরা। তার শুভ্রদা তাকে ভাল করে পরীক্ষা দিতে বলেছে। মানুষটার কথা সে ফেলবে কিভাবে!
খুব ভাল পরীক্ষা দেয় নীরা। এ কয়দিনে অবশ্য দেখা হয়নি শুভ্রদার সাথে। আজকে গিয়ে দেখা করে আসবে। কিন্ত বড় একটা চমক অপেক্ষা করছিল নীরার জন্য। শুভ্রদা নেই!
স্কলারশিপ নিয়ে সে আমেরিকা চলে গিয়েছে। একবার জানানোর প্রয়োজন মনে করল না নীরাকে!
প্রচণ্ড অভিমান হয় তার।

তারপর অনেক জল গড়িয়েছে। নীরার বাবার চাকরীর বদলির জন্য ওরা চট্টগ্রাম চলে আসে। ততদিনে ইন্টার পাস করে নীরা তখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে।শুভ্রদার কোনো খবর নেই। মানুষটা যেন একদমই হারিয়ে গিয়েছে তার জীবন থেকে।মাঝে মাঝে তীব্র হাহাকার সৃষ্টি হয় নীরার মনে।
একদিন খবর আসে শুভ্রদার বাবা নাকি হার্ট এট্যাক করে মারা গেছেন। নীরার বাবা গিয়েছিল শেষকৃত্যে। অনেক ভাল সম্পর্ক ছিল কিনা দুই পরিবারের।
নীরাকেও নিয়ে যেতে চেয়েছিল। কিন্তু যায়নি সে।
অভিমান এত সহজেই ভাঙ্গে নাকি!

শুভ্রদা নাকি এসেছিল! সব আনুষ্ঠানিকতা শেষে মাসিমাকে নিয়ে গেছে সাথে করে আমেরিকায়। বাবা আসার পর উৎসুক হয়ে থাকে নীরা সব কথা শোনার জন্য।
কত কথাই তো বলল বাবা। শুভ্রদা নাকি অনেক সুন্দর হয়েছে আগের থেকে। বেশ ভাল মাইনের একটা জবও করে।
কিন্তু নীরার কথা তো কি কিছু বলেনি শুভ্রদা? বাবা তো কিছু জানালো না।
আবার একরাশ অভিমান জন্ম নেয় নীরার মনে।

একটা রোড এক্সিডেন্টে নীরার মা-বাবা দু’জনেই মারা যায়। ভীষণ একা হয়ে যায় সে। গ্রাজুয়েশন শেষ করে সেও স্কলারশিপ নিয়ে চলে আসে আমেরিকায়। পোস্ট গ্রাজুয়েশন কোর্সের পাশাপাশি একটা ছোটখাটো জবও জোগাড় করে ফেলে।ভালই চলছিল সব।

তারপর এতদিন পর এই বিপত্তি! এত আরাধ্য মানুষটি আজকে আবার তার সামনে। সেই মৃদু হাসি মুখে। চোখে উদাস উদাস দৃষ্টি। নীরার বুকে চিনচিনে সুখের মত ব্যথা।
দু’জনে হেঁটে একটু ফাঁকা জায়গায় এসে দাঁড়ায়। তারপর শুভ্রদা, বলে ওঠে নীরা, আজকাল পত্রিকাসহ আশেপাশে তো তোমার ভালই নামডাক শুনছি! কিন্তু সেই শুভ্রই যে তুমি এটা ভাবতে পারিনি। আঁকিয়ে হিসেবে ভালই নাম কুড়িয়েছো।
হ্যাঁ, নাম, যশ,খ্যাতি- সবই কুড়িয়েছি। শুধু সুখটাই কুড়াতে পারলাম না; উদাস গলা শুভ্রদার।
কেন? মানে কী? অবাক হয় নীরা এমন কথায়।
আরে ছাড় তো, তোর খবর বল। মৃদু হাসিটা আবার ফিরে আসে শুভ্রদার মুখে। কী খবর বলবে নীরা? শুভ্রদা বিহীন তার অন্ধকারময় জীবনের খবর? নাকি চরম অভিমানের দীর্ঘ এগারোটি বছরের দীর্ঘশ্বাসের খবর? নাকি মা- বাবা হারিয়ে নিঃসঙ্গতার খবর?
মাসিমাও নাকি আর নেই!
মনটা খুব খারাপ হয় নীরার।
শুভ্রদা নাকি ভালই আছে শুনেছিল সে। কিন্তু এখন তার পোশাকের মলিনতা আর চেহারার ক্লান্তি চোখ এড়ালো না নীরার।
মানুষটা কি সত্যিই ভাল আছে?

একই শহরে থাকে দু’জনে। এত বছর পর আবার খুঁজে পেয়েছে নিজেদের। কিন্তু নীরার যথেষ্ট আগ্রহ থাকলেও শুভ্রদা সেই উদাসীনই। সেদিন এক্সিবিশনে দেখা হওয়ার পর নীরা তার ভিজিটিং কার্ড চেয়েছিল। দেয়নি। তার নাকি কার্ড নেই! এমনকি টেলিফোন নম্বরটাও দেয়নি। তাই নীরাই তার কার্ড দিয়ে এসেছিল। সে অপেক্ষায় থাকে শুভ্রদা কখন যেন ফোন দিয়ে বলবে, নীরু, চল দেখা করি। কিন্তু ফোন আসে না। আবার অভিমান জমা হয় নীরার।
যোগাযোগ না হলেও বেশ কয়েকবার দেখেছে সে শুভ্রদাকে। প্রতিবারই রাস্তায় তাড়াহুড়ো করে যেতে দেখেছে, দু’হাতে বুকের কাছে উল্টো করে ধরা একটা ক্যানভাস।
কথায় কথায় একদিন মিসেস ফ্লোরেটের কাছে নীরা জানতে পারে যে সেও শুভ্রকে চেনে। তার সেই আর্টিস্ট ফ্রেন্ডের মাধ্যমে শুভ্রর সাথে পরিচয় মিসেস ফ্লোরেটের।
নীরা এটাও জানতে পারে যে শুভ্রদা আজকাল জব-টব আর করে না। দু’পয়সা যা রোজগার তা ওই ছবি এঁকেই। মদ আর সিগারেটের নেশা প্রচুর। জব ছাড়ার পর জমানো যা টাকা ছিল সব দুইহাতে উড়িয়ে এখন খুবই করুণ দশা।
বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে নীরার।
কেন এমন করে শুভ্রদা?

শুভ্রদা হয়ত পালিয়ে পালিয়ে বেড়ায় নীরার কাছে থেকে।অন্তত নীরার তো তাই মনে হয়। তারপরও একদিন দেখা হয়েই গেল শুভ্রদার সাথে। নীরা অফিস থেকে ফিরছিল আর শুভ্রদা যথারীতি সেই ক্যানভাসটা নিয়ে যাচ্ছিল কোথাও। তার চোখ দু’টো লাল, পদক্ষেপ টালমাটাল। নীরা জিজ্ঞেস করে, কী ব্যাপার শুভ্রদা, তোমাকে তো পাওয়াই যায় না! একটা ফোন তো দিতে পারো।
হাসে শুভ্রদা। বলে, সময় পাই না রে নীরু।
ক্যানভাসটার দিকে তাকায় নীরা। উলটো করে ধরে রাখা, কী আঁকানো আছে দেখা যায় না। নীরা ওটার কথা জিজ্ঞেস করায় শুভ্রদা বলে, জানিসই তো এখন ছবি বিক্রি করেই দিন চলে আমার। কিন্তু আজকাল ছবিও আর আঁকতে পারছি না জানিস! এটা আমার আঁকা সবচেয়ে দামী ছবি। বিক্রি করতে চাচ্ছি, কিন্তু যে যত দামই বলুক না কেন, দিয়ে দেওয়ার সময় আমার মনে হয় দামটা কম হয়ে যাচ্ছে। তাই অনেক দিন হলো ঘুরছি কিন্তু বিক্রি করতে পারছি না।
কিছুটা অবাক হয় নীরা। বলে, কত দামে বিক্রি করতে চাও বলো, আমি তার দ্বিগুণ দাম দিয়ে নেব ছবিটা। দেখি, দেখাও তো আমাকে।
হাত বাড়ায় সে। কিন্তু ঝটকা দিয়ে সরে যায় শুভ্রদা। অদ্ভুত ঘোর লাগা লাল চোখে তাকিয়ে থাকে নীরার দিকে, তুই নিবি? কিন্তু তুইও এটার মূল্য দিতে পারবি না যে!
কথাগুলো বলেই নীরাকে আর কোনো সুযোগ না দিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যায় শুভ্রদা।

পরদিন সকালে মিসেস ফ্লোরেটের ফোনে ঘুম ভাঙ্গে নীরার। ঘুম জড়ানো চোখে বেশ বিরক্তি নিয়েই ফোন ধরে সে। কিন্তু মিসেস ফ্লোরেটের কথা শুনে ঘুম উবে যায় তার। পুরো পৃথিবী যেন স্তব্ধ হয়ে যায়।
শুভ্রদা মারা গেছে!
ওপাশে মিসেস ফ্লোরেট বলেই যাচ্ছেন, খুব ভাল ছেলে ছিল, বুঝলে? কেন যে এমন করে আত্মহত্যা করতে গেল কে জানে!
কোনো কথাই ঢুকছে না নীরার কানে।
তার চোখে একরাশ শূন্যতা।
পৃথিবীতে এবার যে সে সত্যি সত্যিই একা হয়ে গেল।

কলিংবেল বাজল বেশ কয়েকবার। কিন্তু ওঠার শক্তি নেই যেন নীরার। শুভ্রদার মৃত্যুর খবরের আঘাতে সে একদমই ভেঙ্গে পরেছে।
আবার বেল বাজলে সে দরজা খুলে দেখে একটা পার্সেল এসেছে।
বেশ বড় একটা বক্স আর একটা চিঠির খাম। কে পাঠিয়েছে জানে না কারণ প্রেরকের নাম লেখা নেই।
ছোট্ট একটা চিঠি-
নীরু,
আমার জীবনের মূল্যবান দু’টি জিনিস তোমার জন্য।
আমার ভালবাসা আর ছবিটি। যেটার মূল্য শুধু তুমিই দিতে পারবে।
– শুভ্র

ভীষণ অবাক হয় নীরা।কাঁপা কাঁপা হাতে বক্সটি খোলে। বের করে আনে ক্যানভাসে আঁকা ছবিটি।
ভরা জ্যোৎস্নায় নীল শাড়ি পড়া একটি মেয়ে পুকুরে পা ডুবিয়ে বসে আছে। পুকুরে তার ছায়া।
মেয়েটি আর কেও না, নীরু!
ছবিটি বুকে জড়িয়ে আকুল হয়ে কাঁদতে থাকে নীরা।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত