ঝাল থেরাপি

ঝাল থেরাপি

আমার সামনে নিলি বসে আছে। নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি জানি আজ নিলির মেজাজ মারাত্মক খারাপ। সেজন্য সে এভাবে তাকিয়ে আছে। তার যখন আমার উপরে মেজাজ গরম হয় তখন এভাবে তাকিয়ে থাকে। সে হঠাৎ এত রেগে গেল কেন সেটা ভেবে পাচ্ছি না।

অন্যদিন খেতে বসলে কেমন মায়া মায়া দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে। তখন তার কাছে আমার একটা আবদার থাকে, মেয়েটা হাসি মুখে আমার এই আবদার পূরণ করে। নিজের হাতে খাইয়ে দিয়ে বলে,
“তুমি দিন দিন অলস হয়ে যাচ্ছো! এরকম আবদার আর করলে খবর আছে। ”

আমি চুপচাপ খেয়ে রুমে চলে যাই। আজকের ব্যপারটা সম্পূর্ণ অন্যরকম। আমি এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে অসহায় দৃষ্টিতে নিলির মুখের দিকে তাকালাম। মেয়েটার নির্লিপ্ত চাহনি দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। কোনোমতে বললাম,

– নিলি, আজকে ক্ষিধে নেই। আমি উঠি?
নিলি কোনো জবাব দিচ্ছে না, কিন্তু তার চোখ থেকে আগুন ঝড়ে পরছে। তার মানে হচ্ছে, তুমি ওঠো একবার, তারপর আমি তোমার ব্যবস্থা করছি। আমি একের পর এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে গিলে চলেছি। আমার ঠোঁট,

জিহ্বা, গলা, খাদ্যনালি, পেট জ্বলছে। চোখ থেকে টপটপ করে গাল বেয়ে পানি পড়ছে।
আমি মাথা নিচু করে একের পর এক লোকমা ভাত মুখে দিয়ে চলেছি। চেয়ারের শব্দ হওয়ায় আমি চোখ তুলে সামনে তাকালাম। নিলি চেয়ার থেকে উঠে, রান্না ঘরের দিকে যাচ্ছে। আমি আবার গাল ফুলিয়ে চোখ নিচের দিকে করে ভাতের প্লেটের দিকে তাকিয়ে রইলাম। নিলি রান্নাঘর থেকে এসে আমাকে বলল,

– এটা খাও!
আমি মাথা তুলে নিলির দিকে না তাকিয়ে তার হাতে থাকা দইয়ের বাটিতে হাত দিলাম। কয়েক চামচ দই খেয়ে স্থির হয়ে বসে রইলাম। নিলি আমার চোখ মুছে দিয়ে বলল,

– রুমে যাও! আমি এই গুলো গুছিয়ে আসছি।
আমি কিছু না বলে রুমে এসে বিছানায় বসলাম। মুখ হা করে জিহ্বা বাইরে বের করে বসে রইলাম। জিহ্বা থেকে লালা ঝড়ছে, আর চোখ থেকে পানি। আমি এবার ফুপিয়ে কেঁদে উঠলাম। কষ্টে চিৎকার করে কান্না করতে ইচ্ছে করছে। নিলি হয়েছে একদম আমার মায়ের মতো। বিয়ে করে নিয়ে আসার পর মায়ের সব গুন খুব ভালো করে রপ্ত করেছে সে।

আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। ফাইনাল পরীক্ষা চলছিলো স্কুলে। শেষ পরীক্ষাটা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে বন্ধুদের সাথে কৌতূহল এর স্বীকার হয়ে সিগারেট ধরিয়ে টান দিচ্ছিলাম। বাবা আমাকে দেখে তখন কিছু বলেননি।
সোজা বাড়ি এসে মা কে সব খুলে বললেন।
সাথে এক্সট্রা বুদ্ধি হিসেবে বললেন,

“আজকে তরকারি’তে ঘরের যত মরিচ আছে সব দিবে৷ তারপর তোমার ছেলেকে সেগুলো খাওয়াবে। ”
মা বাবার বুদ্ধি শুনে মুচকি হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। মানে উনার বুদ্ধি পছন্দ হয়েছে। আমি বাসায় ফিরার পরে চিৎকার করে মাকে “খেতে দিতে বলেছিলাম”। খাওয়ার টেবিলে মা সামনে বসে ছিলেন। উনার হাতে যেটা বেমানান ছিল সেটা হচ্ছে বিছানা ঝাড়ার ঝাড়ু।

আমি কিছু বুঝতে না পেরে, টেবিলে বসে তরকারি দিয়ে ভাত মেখে খাওয়া শুরু করার আগে মায়ের মুখের দিকে একবার তাকিয়ে দেখলাম। মা খুব মনযোগ দিয়ে আমার খাওয়া দেখছেন। আমি ভ্যাবলার মত প্রথম লোকমা মুখে দিয়ে দুটো চিবানি দিতে বুঝলাম আমার মুখে আগুন ধরে গেছে।

ব্যস যখনি মুখ থেকে ভাত ফেলতে যাব, মা ঝাড়ু দিয়ে বারি দিলেন। আমি ভাত না ফেলে উনার দিকে তাকিয়ে দেখি কিছু বলছেন না। আমার চোখে ইতিমধ্যে জল চলে এসেছে। শুধু টপটপ করে গড়িয়ে পড়ার বাকি। মুখ থেকে দ্বিতীয় বার ভাত ফেলার চেষ্টা করতে আবার দ্বিতীয় বারি পড়লো আমার উপরে।
খুব কষ্টে ভাতের নলা টা গিলে জিজ্ঞেস করলাম,

“ মেরে ফেলবে না কি? এত ঝাল মানুষ খায়? ”
মা শুধু কঠোর চাহনি দিলেন, তারপর গম্ভীর গলায় বললেন,

“খোকা! আজকে তোকে পুরো এক প্লেট ভাত খেতে হবে! এক লোকমা ভাত বাইরে ফেলা যাবে না। কথা না বাড়িয়ে তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ কর! ”

অবস্থা বেগতিক দেখে আমি চুপচাপ খেতে থাকলাম। চোখ থেকে অঝোরে পানি ঝড়ছে। খাওয়া শেষে উঠে রুমে চলে গেলাম। তারপর জিহ্বা বের করে হা করে বসে রইলাম। মা এসে দই দিলেন। তারপর বললেন,

“সিগারেট খেতে নেই খোকা। এরপর যদি আর কোনো ভুল হয় এই থেরাপি চলতে থাকবে মনে রাখিস। নিজের ভালো চাইলে, আর কোনো ভুল কাজ করবি না। আর দই টা খেলে ঝাল কমবে, খেয়েনে। ”

আমি কিছু না বলে কয়েক চামচ দই খেয়ে মুখ ফুলিয়ে বসে রইলাম। সে কি অভিমান হয়েছিল আমার। তারপর পুরো দুই দিন না খেয়ে ছিলাম। মায়ের দেওয়া ঝাল থেরাপি আর আমি পাইনি।

নিলি আর আমি বাড়ি থেকে পালিয়ে বিয়ে করি। এতবড় অপরাধ করার পরেও মা আমাকে এই থেরাপি দেননি।
কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি, উনি সেই থেরাপিটা কৌশলে নিজের ছেলের বউয়ের মাধ্যমে দিয়েছেন। নিলিকে বলে দিয়েছেন হয়তো, যদি কোনোদিন উলটাপালটা কিছু করে, এই থেরাপি দিবে। তাহলে সব ঠিক হয়ে যাবে৷

আর নিলি অক্ষরে অক্ষরে আমার মায়ের কথা পালন করছে। একটু কিছু হলে ঝাল থেরাপি শুরু হয়। গত তিন মাস ধরে চলছে এই থেরাপি।

নিলি রুমে এসে আমার পাশে বসলো। আলতো করে গালে হাত ভুলিয়ে দিয়ে বলল,

– আমাকে রাগিয়ে দিলে কেন? জানো না আমার রাগ উঠলে কি করি আমি?

আমি তার চোখের দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলাম। বুঝে উঠতে পারছিলাম না কখন আমি তার সাথে কি করেছি! তারপর গাল ফুলিয়ে বললাম,

– আমার দোষটা কি বলবে? কি করেছি আমি?
নিলি আমার কালো টিশার্ট টা নিয়ে এসে বলল,

– এটাতে কিসের গন্ধ করছে?

নাকের কাছে নিয়ে গন্ধ শুকে বুঝলাম নিলি কেন রেগেছে। সন্ধ্যায় ফারদিনের সাথে দেখা হয়েছিল। ছেলেটা পাশে দাঁড়িয়ে সিগার খাচ্ছিলো। বিকট দূর্গন্ধ আর সেই সিগারের গন্ধ আমার জামায় লেগে আছে। বাসায় আসার পর রান্নাঘরে নিলি কে জড়িয়ে ধরেছিলাম।

জামাতে সিগারের গন্ধ পেয়ে কিছু না বলে আমার উপরে ঝাল থেরাপি প্রয়োগ করেছে। আমি মায়ের দেওয়া থেরাপি এখনো ভুলিনি, আজকে আবার নিলির থেরাপি। জীবন টা একেবারে ঝালময় হয়ে গেল।

নিলি কে কিছু না বলে টিশার্ট টা ছুড়ে ফেলে ফারদিন কে কল দিয়ে ইচ্ছেমত কিছু ঝাড়ি দিলাম। নিলি সব শুনে মুখে তালা মেরে বসে রইলো। আমি বালিশ নিয়ে রুম থেকে বাইরে চলে যাওয়ার প্ল্যান করে বিছানার দিকে এগিয়ে গেলাম। বালিশ হাতে নেওয়ার পরে নিলি আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল,

– আমাকে ছাড়া একা ঘুমাতে পারবে?

মেয়েটার কথা শুনে সব রাগ মূহুর্তে আগুন থেকে ঠান্ডা বরফ হয়ে গেল। চুপচাপ বিছানায় শুয়ে পড়লাম। নিলি উঠে গিয়ে বাতি নিভিয়ে দিয়ে বলল,

– তুমি আস্ত একটা গাধা।

আমি কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে রইলাম। নিলি বিছানায় উঠে আমার পাশে শুয়ে পড়লো। তারপর বলল,

– তুমি এভাবে কেন শুয়ে আছো? সোজা হও তো।

আমি সোজা হওয়ার পরে, নিলি শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকে মুখ গুজে চুপচাপ শুয়ে রইলো। কয়েক সেকেন্ড পরে, কপালে তার ঠোঁটের স্পর্শ পেলাম। তারপর কানের কাছে ফিসফিস করে বলল,

– ভালবাসি।

তার এই অভ্যাসটা আমার খুব ভালো লাগে। তার কাছে বদভ্যাস হলে ও আমার কাছে প্রিয় অভ্যাস। আমি নিলি কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে, চুলে বিলি কেটে দিতে থাকলাম। কেটে যাবে এভাবে নিলি আর আমার একানব্বই তম রাত।

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত