অচেনা কামড়

অচেনা কামড়

পূর্বা আমাকে প্রায়ই ব্লক দেয় আবার আনব্লক করে রিকু দেয়। আমি বাধ্য ছেলের মতো রিকু এক্সেপ্ট করতে থাকি। এইবার আমি আর রিকু এক্সেপ্ট করলাম না। আমি এবার ব্লক দিয়ে দিলাম। টের পেলাম পূর্বার অবস্থা তো সিরিয়াস। ঘন ঘন আমাদের বাসায় আসছে। চেহারায় গভীর উদ্বিগ্ন স্পষ্ট। চোখেমুখে অস্বস্তির রেখা! আমার ছোটবোনের সাথে অন্যমনষ্ক হয়ে দু’য়েক কথা বলে আর আমার দিকে ঘন ঘন তাকায়।

আমার সাথে কথা বলে না। প্রায় মাস খানেক হবে কথা বাদ হয়েছে। আমি বাদ করেছি। পূর্বার আচার-আচরণ আমার কাছে অস্বস্তিকর লাগছিল। এমন সব বিহেভ করা শুরু করলো যেন মনে হল আমি ও’র বিএফ। ঘন ঘন আমাদের বাসায় আসা তারপর আমাকে খোঁচা দিয়ে কথা বলা। সামনাসামনি হলে অধিকার খাটানোর আওতায় পড়ে এমন সব আচরণ করা। এইসব শুরু করেছিল আমার ছোটবোন তিনার জন্যই। পূর্বার সাথে তিনার বন্ধুত্ব হবার পর প্রথম প্রথম আমাকে ভাইয়া ডাকতো, আপনি সম্বোধন করতো। কিন্তু আস্তে আস্তে দেখলাম, তিনা আমাকে পঁচিয়ে কথা বলতো, আমাকে টেক কেয়ার করতো সেইগুলায় পূর্বার বিচরণ। এইসব করতেই পারে সমস্যা নেই, ভাই ভেবে করতেই পারে। কিন্তু ধীরেধীরে ভাই ডাকা বাদ, তুমি করে ডাকা শুরু। ন্যাকা, ন্যাকা কথা বলা শুরু করলো।

চটর-পটর স্বভাবের মেয়ে। বেশি কথা বলে। কি করে না করে কোনোকিছুর ঠিক-ঠিকানা নেই। অল্প বয়স তাই আবেগের সীমা নাই। আমার মোটেও পছন্দ নয় এই স্বভাবের মেয়েদের। পূর্বাকে তো নয় নয়ই! আচরণ যখন বাড়াবাড়ি পর্যায়ের মধ্যে চলে গিয়েছিল তখন একদিন ডাকলাম।মুখটা আবেগের সাগরে বার কয়েক ডুব দিয়ে এনেছিল মনে হয়। চেহারায় অস্বস্তি, উত্তেজনা স্পষ্ট। আমি একটু ধমক স্বরেই বললাম, “এই পিচ্চি মেয়ে কি হচ্ছে এসব?”
কেঁপে উঠলো। মাথা নিচু করে হালকা স্বরে বলল,”কি?”
“এসব কি শুরু করলে? বয়স তো মনে হয় ১৬ স্পর্শ করেনি ঠিকঠাক মতো। এখনই যদি এতো পাকনামি করো তাহলে তো নিজের ক্যারিয়ার নষ্ট করে ফেলবে। আবেগকে কন্ট্রোল করো। সবচে বড় কথা তোমাকে আমার অসহ্য লাগে। এতো চটর-পটর করে! ওহ গড! আমার আশপাশে যেন আর না দেখি তোমাকে, কথা বলা তো দূরে থাক।”
আমার কথা হজম হয় নি মনে হয়। বলে উঠলো, “পারবো না!”
চোখ লাল করে বললাম, ” কি?”
” আচ্ছা বলবো না। আপনি কিন্তু ঠিকই কথা বলতে আসবেন আমার সাথে।”
” তাই নাকি!”
” হুম।”
” এখন তাইলে ব্যাক হয়ে হাঁটা দিন। কথা বলি না- কি দেখা যাবে পরে!”
আমার মুখে আপনি সম্বোধন যে বিদ্রূপমাখা ছিল তা বুঝে নিয়েই মুখ কালো করে বড় বড় পা ফেলে চলে গেল।

তারপর আর কথা হয়নি। এই একমাস পূর্বা অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করছিল। আমি বলিনি। তাই আর সাহস পায় নি কথা বলার। আজ সকালে তিনাকে কলেজ নিতে এসে আমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছিলো, “আইডি নষ্ট করে দিবো ব্লক না খুললে!”
তিনা অবাক হয়ে বলল, “কি আবোল – তাবোল বলিস? ব্লক কিসের? আমিতো তোকে ব্লক করিনি! ”
তিনা বুঝতে পারেনি। আমি ঠিকই বুঝতে পেরে গেলাম আমাকে যে বলছে। আমি কিছু না বলে কলেজের জন্য বের হলাম। পিছনে একবার চেয়ে দেখলাম পূর্বা তিনাকে সাতপাঁচ বুঝাচ্ছে।

আমি কখনোই পূর্বার মতো মেয়ে আমার জীবনে আশা করি না। শান্ত, শিষ্ট, স্বল্পভাষী এবং পরিষ্কার মনের অধিকারী মেয়ে আমার জীবনসঙ্গী হবে, সেরকমটাই চাওয়া। অবশ্য এটাও ঠিক এখনের যুগে এই সকল গুণ একসাথে এরকম মেয়ে পাওয়া বিরল বলা চলে। তবে পূর্বার মতো চঞ্চল, আধুনিক, বাচাল স্বভাবের মেয়ে কখনোই চাইবো না। এখন সময় এসেছে পূর্বাকে বুঝানোর। বয়স কম তাই আবেগের বশে এরকম করছে, যখন মন-মানুষিকতা আচার আচরণে আরো পরিপক্বতা আসবে তখন ভুল বুঝতে পারবে। বুঝতে পারবে যে আমি রাইট চয়েজ নই ও’র জন্য।

কলেজ থেকে বাসায় ফিরে দেখি তিনার সাথে পূর্বা বসে টিভি দেখছে। আমাকে দেখে কাশি দিয়ে উঠলো। তিনা বুঝে নি, বুঝার কথাও না। আমি বুঝেছি এটা আমাকে নিয়ে ফাইজলামির বহিঃপ্রকাশ। তিনা না থাকলে একটা চড় বসিয়ে দিতাম। ফ্রেশ হয়ে এসে দেখি পূর্বা চলে গেছে। যাক! তিনাকে বললাম, “দরকারে – অদরকারে পূর্বা আমাদের বাসায় আসে কেন?”
তিনা আমার কথা শুনে অবাক হয়ে কপাল ভাঁজ করে বলল, “মানে কি? আসলে তোর প্রবলেম কি?”
” অনেক প্রবলেম। বলবি অপ্রয়োজনে আর না আসতে।”
” কিন্তু কেন?”
আমি আর কিছু না বলে রুমে চলে আসি। শুতে যাব। তিনা এসে বলল, “পূর্বা কিছু বলেছে?”
” আবাল চিনস? আবালের মতো কথাবার্তা বলে। আমি সহ্য করতে পারি না। ”
” কি এমন বলল তুই রেগে যাচ্ছিস!”
” উফ! তোকে বুঝাতে পারবো না। তুই দরকার লাগলে ওদের বাসায় যা। আর আরেকটা কাজ কর। এখন এখান থেকে যা তো!”
তিনা চলে গেল ।ধ্যাত! মিসটেক! তিনার কাছে পূর্বাকে নিয়ে এসব বলা ঠিক হয় নি। খামোখা এখন আজাইরা জটিলতা সৃষ্টি করবে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি আমার পাশে কাগজ ভাঁজ করে রাখা। চোখ কচলাতে কচলাতে খুলে রীতিমত বড় ধরণের শক খেলাম। লিখা, ” আমি আপনাকে ভালবাসি। — ইতি (P) ”

এটা পূর্বার কাজ। কি সাংঘাতিক মেয়ে! ভাগ্য ভাল তিনা ও মা আসেনি রুমে। কিন্তু আমার রুমে এটা আসলো কিভাবে? এক মিনিট ভাবার পর জানালার দিকে চোখ পড়ায় আর ভাবতে হয়নি। তিনাকে কলেজে নিতে এসে এই জানালা দিয়ে পারমাণবিক বোমা ছেড়েছে। কপাল ভাল কেউ রুমে আসেনি। হাউ ডিয়ার ইউ ইডিয়ট গার্ল!

বিকালে পূর্বাদের বাসার পাশেই ক্রিকেট খেলিতেছিলাম। পূর্বা যেই বাসা থেকে বের হলো তখনই খেলা বাদ দিয়ে পূর্বার সামনে আসলাম। নিশ্চিত তিনার সাথে ঢং করতে যাবে এবার। আমাকে দেখে মুখটা চুপসে গেল। অন্যসময় হলে আবেগে আপ্লুত হয়ে যেতো।

” কথা বলার ইচ্ছা ছিল না কিন্তু না বলেও পারলাম না। তুমি কিন্তু সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছ। ”
আমার কথাশুনে পূর্বার আতংকিত মুখে মৃদু হাসি ফুটে উঠলো।
” বলেছিলাম না আপনি আগে কথা বলবেন। তাইই হলো। এবার আমার দ্বিতীয় বাণী শুনবেন?
প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকালাম। বলল, “আপনি আমার প্রেমে পড়বেন। ”
কথাটা বলেই পূর্বা চলে যাবে। আমি সামনে গিয়ে বললাম, “একদিন বলেছি তোমার চালচলন, কথাবার্তা, আচরণ কিছুই আমার পছন্দ নয়। তারপরেও এতো কনফিডেন্স!”
” দেখেনই না কি হয়।”

বলে আমাদের বাসার দিকে চলে গেল। আমি অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। এটা কোনভাবেই সম্ভব না। হতে দেওয়া যায় না। সারাক্ষণ চটর-পটর করা মেয়েটিকে বিয়ে করলে কখনোই একটা সুখী, স্বাভাবিক জীবন কাটাতে পারবো না।

এরকম করে কয়েকদিন কেটে গেল। চার পাঁচদিন হল পূর্বা আমাদের বাসায় আসেনি। ভেবেছিলাম বেড়াতে গেছে। কিন্তু গতকাল কলেজ যেতে দেখি ছাদে ফুলের টবে পানি দিচ্ছে। তাহলে আসলো না কেন? নাকি অবশেষে আমার কথা বুঝতে পারছে। এইটা ভেবে একটু স্বস্তি লাগলো। তবে বিশ্বাস হলো না আমার কথা মগজে ঢুকিয়েছে। আমাদের এলাকায় এলো দুবছর হলো। দু’বছরের একদিন ও মনে হয়নি এই মেয়ে সুস্থ মস্তিষ্কের। তিনা এসে বলল, ” ভাইয়া তুই ভাত বেরে খেয়ে নে আমি পূর্বাদের বাসায় যাচ্ছি পূর্বাকে দেখতে।”
মা ঘুমাচ্ছেন তাই পূর্বাকে বলেছিলাম ভাত দিতে। কমপক্ষে এক ঘন্টা আগে বলে এসেছিলাম। টিভি দেখা শেষ হল তো আসলো এখন। বললাম, ” কেন? কি হইছে? ”
” ও মা তুই জানিস না পূর্বা যে অসুস্থ?
” না। কি অসুখ?”
” খুব জ্বর!”

এইকথা বলে চলে গেল। গতকাল তো ছাদে দেখে তেমন দুর্বল লাগে নি! তাইতো বলি আসে না কেন? তারমানে আমার ভাবনা ভুল। একটা ফাজলামি চিন্তা মাথায় আসলো। অসুস্থ মানুষ দুর্বল হয়ে যায়, তাই চেহারা নষ্ট দেখায়। পূর্বার দিকে তাকাতে এমনিতেই আমার ভাল লাগে না। যদি অসুস্থ পূর্বার কুঁকড়ানো মুখের পিক তুলে সাথে রাখি তাহলে ছবিটা দেখে আর এই জীবনে পূর্বার প্রতি আগ্রহ জন্মাবে না। একজন অসুস্থ মানুষের বাসায় যেয়ে সুন্দর করে তার ছবি তোলা! এই চিন্তা মাথায় কি করে আসলো? মাঝেমাঝে অদ্ভুত সব চিন্তা করি। চরম অদ্ভুত!

দু’দিন পর পূর্বা এসে বলল, “আপনি খুব খারাপ। আমি জ্বরে মরি মরি অবস্থা ছিল। দেখতে আসলে কি হতো? খুব ক্ষতি হয়ে যেতো?”

তিনাকে টিভি দেখা নিয়ে খুব বকেছিলাম সকালে আর একটা চড় ও মেরেছিলাম। তাই মন খারাপ ছিল। বাসার পাশে একটা টঙ দোকানে বসেছিলাম। তখন পূর্বা এসে বলল। এমনিতেই মন খারাপ ছিল তার উপর আবার পূর্বা এসে আহ্লাদিত কণ্ঠে কথা বলা শুরু করলো। মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। বললাম, “এই তুই যদি এই জ্বরে একদম গায়েব হয়ে যেতি পৃথিবী থেকে তাহলে বরং ভাল হতো। গায়েব হসনি দুর্ভাগ্য আমার। ”

পূর্বা চুপচাপ আমার কথা শুনে হালকা হেসে উত্তর না দিয়ে চলে গেল। কোনোদিকে তাকাতাকি নেই।সোজা বাসায় ঢুকলো। আজব এক ক্যারাক্টার! এতো কথা শুনাই তবুও গায়ে মাখে না!

কয়েকদিন কেটে গেল। সেইদিনের পর থেকে পূর্বা আর আমাদের বাসায় আসে না। আমার দিকে ফিরেও তাকায় না। যখন তিনা আমার দিকে সন্দেহজনক দৃষ্টি নিয়ে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে পূর্বার না আসার কারণ জানতে চায় তখন আমি আনন্দ পাই, আমিও সাতপাঁচ বুঝিয়ে দেই। আন্দাজ করে দেখেছি তিনা হয়তো জেনে গেছে। যখন পূর্বাদের পরিবার কিংবা পূর্বাকে নিয়ে কোনো কথা উঠে তখন কেমন সন্দেহ চোখে তিনা আমার দিকে তাকায়।তিনার সাথে কথা বলতে গেলেই পূর্বাকে নিয়ে কিছু বলবেই বলবেই। পড়াতে গেলে বেশি বলে। সাহস করে সরাসরি কিছু না বলতে পারলেও আকার-ইঙ্গিতে অনেক কিছু বুঝিয়ে দেয়। আমাকে অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলে দিচ্ছে ক’টা দিন ধরে। একটু আগে এসে বলে, “ভাইয়া পূর্বাদের বাসায় তো আজ বিকালে আমাদের খাওয়া। তুই যাবি?

বাবা আর পূর্বার বাবার পাশাপাশি দোকান তাই দুই পরিবারে একটু বেশিই সখ্যতা। সেজন্য মাঝেমধ্যে কিংবা ছোটখাটো অনুষ্ঠানে খাওয়াদাওয়া হয় দুই পরিবারে। আমি কি বলবো? আমার না যাওয়ার কি কারণ থাকতে পারে? বললাম, “যাব তো। যাব না কেন? ”
” তাই? ভাল।”

হাসতে হাসতে চলে গেল। আমার রাগ উঠলো। এরকম খোঁচা দিয়ে কি বুঝাতে চায়! দৌড়ে গিয়ে তিনার চুল টেনে ধরতেই তিনা বলল, “উফ! দেখো বাবা কে আগে লাগতে আসে। পূর্বার সাথে ঝগড়া করছে বলে ভাইয়া আজ ওদের বাসায় খেতে যাবে না। আমি ভালভাবে বুঝালাম যাওয়া উচিৎ। সেটা বুঝাতেই আমাকে মারতে আসছে। সেইদিনই ভাইয়ার দোষ ছিল। আমার না।”

সামনে চেয়ে দেখি বাবা খরচ হাতে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনা এটা করলো কি! কোথায় ঝগড়া করলাম! না, আর ঘটনা এগুতে দেওয়া যায় না। এটা ক্লিয়ার করতেই হবে। বাবার একদৃষ্টিতে চোখ লাল করা দেখে ছেড়ে দিলাম।

ইচ্ছা ছিল খেতে যাব না। কোনো উপলক্ষ নেই। উপলক্ষ ছাড়া খেতে না গেলেও কিছু হবে না। কিন্তু তিনার ওরকম কথার জন্যই যেতে হলো। সোফায় কিছুক্ষণ বসে থাকার পর দেখি পূর্বা আসলো। শাড়ি পরে এসেছে। এসে আমার আর তিনার বিপরীত দিকে বসলো। শাড়ি পরলো কেন? আমাদের সৌন্দর্য দেখাচ্ছে নাকি? কোনোকাজেই আসবে না সে সৌন্দর্য আমাদের দেখিয়ে। আফসোস ন্যাকা বালিকাটার জন্য।
তিনাকে বললাম, “দেখ কতো ঢং করে। আমরা কি বাইরের লোক যে আমাদের কাছে শাড়ি পরে আসতে হবে!”
তিনা মুচকি হেসে বলল, ” ওয়েট ব্রো। ”
বাবা আমার পাশে এসে বসলেন। বাবা আমার পাশে এসে বসলেন কেন? কিছুই বুঝতে পারলাম না। বাবা আস্তে আস্তে বললেন, ” যা করবো সব যেন অনুকূলে থাকে, কিছুই যেন প্রতিকূলে না যায়। সজীব চাইছে আগে থেকেই যেন ঠিক করা থাকে। বর্তমান যুগের তোরা, তোদের দিয়ে বিশ্বাস নাই।”

কি ঠিক করা? ওয়েট! ওয়েট! পূর্বা শাড়ি পরে এসেছে, আগে থেকে ঠিক করা থাকুক। তার মানে কি! এটা কি করে সম্ভব? আমি কখনো চাই না এটা হোক। আমার ফ্যামিলি এরকম করবে চিন্তার বাইরে আমার। বাবা উঠে পূর্বার বাবার পাশে গিয়ে বসলেন। তিনা উঠে পূর্বার পাশে গিয়ে বসলো। আমার দিকে তাকিয়ে শুধু হাসে। মেজাজটা গরম করে ফেললো। ফ্রেন্ড আবির ফোন দিয়ে বলল ওর মা অসুস্থ। আমি তাড়াতাড়ি যেন যাই। রক্ত লাগবে। আমার রক্তের গ্রুপের সাথে মিলেছে। মা’কে বুঝিয়ে চলে গেলাম। ফিরতে ফিরতে রাত হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে দেখি মা,বাবা আর তিনা বৈঠকে বসেছে। আমি ফ্রেশ হয়ে খাওয়ার জন্য আসতেই বাবা বললেন, ” তখন ও’ভাবে চলে গেলি কেন? তোর পড়াশোনা শেষে বিয়ে হবে।”

আবিরের সাথে ব্যস্ত থাকায় আমি ভুলেই গেছিলাম সে কথা। ভেবে আবার রাগ উঠে গেল। কিছু বলতে যাব তখন মা বললেন, “সৌরভ দেখ, তোর বাবার সাথে পূর্বার বাবার দারুণ সখ্যতা। একমাত্র মেয়ে। আর উনি আমাদের খারাপ সময়ে পাশে ছিলেন। তিনি অসুস্থ। একমাত্র মেয়ের ভাল চেয়ে বিশ্বস্ত জায়গায় বিয়ে দিতে পারেন না কি? ”

মা’র কথাগুলো অতি দরদি লাগল। এতো দরদি কথা দিয়ে চলে না। এখন দেখছেন মেয়েটা কতো ভাল। কিন্তু বিয়ের পরেই আসল রূপ দেখাবে। খুব ভাল করেই এই চঞ্চলাকে চিনি আমি। বললাম, “তোমরা বিশ্বস্ত বলে আমিও যে বিশ্বস্ত। সেটার নিশ্চয়তা আছে?

বাবা চোখ বড় বড় করে তাকাতেই আমি উঠে রুমে চলে এলাম। আমি কিছু বলতে পারবো না। সবকিছু উনার মতামতে হবে। বাবার উপর রাগ করে না খেয়ে ঘুমিয়ে গেলাম। তিনা এবং মা দু’বার করে এসেছিলেন। আমি গভীর ঘুমের ভাণ ধরে সাড়া দেই নি।

খুব সকাল উঠে রান্না ঘরে চুপচাপ খেতে যাই। কিছুক্ষণ পর দেখি বাবা পানি খেতে আসলেন। আমি খুব লজ্জা পেলাম। রাতে রাগ করে খাইনি। এখন ঘুম থেকে উঠেই খেতে! না জানি কি ভাবছেন!
বললেন,” মেয়েটা খুব ভাল রে! দেখিস আমাদের সাথে মানিয়ে চলবে! ”
“রে” যোগ করে কথার মাঝে বিশেষ আকাঙ্ক্ষা এনে বলায় শুনে বুকের মাঝে মৃদু কম্পন বয়ে গেল। চোখেমুখে তৃপ্তির ছোঁয়া দেখে কেন জানি খুব ভাল লাগলো। এমন কোমল কণ্ঠে শেষ কবে কথা বলেছিলেন ভুলে গেছি। সবসময় আমার প্রতি রাগী স্বভাবের মানুষটার মুখে নরম কণ্ঠে কথা শুনে বলতে ইচ্ছে হল, ” ইয়েস বাবা! ইয়েস! খুব ভাল মেয়ে। তুমি নিশ্চিত থাকো। যা বলবে তাইই হবে। বাবা তুমি আমাকে চোখ লাল করে আদেশ দাও, ওভাবে কোমল কণ্ঠে নয়। ওভাবে বললে মনে হয় আমি তোমার কথা শুনছি না তাই কাতর হয়ে অনুরোধ করছো। আর কখনো এমন ভাবে বলবে না!”

কিছু বলতে পারিনি। চুপচাপ হাত ধুয়ে উঠে যাই। রুমে এসে অনেকক্ষণ পূর্বাকে নিয়ে ভাবলাম। পূর্বা কি আমার মনের মতো হতে পারবে?

কি যে করি! যা হয় তাই মেনে নিতে হবে। পূর্বা সম্ভবত আমার উপর রেগে আছে। সেদিন দুনিয়া থেকে গায়েব হয়ে যেতে বলছিলাম। বিকালবেলা মা অনেকক্ষণ ধরে জোরাজুরি করছিলেন পূর্বাদের বাসায় যেতে। পূর্বার বাবা আমাকে ডেকেছিলেন। কিন্তু আমার কিরকম যেন লাগছিল। বিশেষ করে খুব লজ্জা লাগছিল। এরা এখন আমাকে কিভাবে নিবে, কি বলেই বা ডাকবে। খুব অস্বস্তি নিয়ে গেলাম। দরজা নক করতেই পূর্বা দরজা খুললো। চোখের চাহনি দেখে মনে হল আমি আসবো যে আশা করে নাই। ঘুরে সোজা ও’র রুমের দিকে ঢুকলো। আঙ্কেল এসে যা বললেন তার সারমর্ম হল এই, পূর্বাকে ও’র মামার বাসায় পৌঁছে দিতে হবে। উনি যেতে পারবেন না ব্যস্ততায় আর অসুস্থতায়। মনে মনে ভাবলাম, আমাকে হয়তো এরজন্যই অনেক আগে থেকে কিনে রাখা হইছে। সেইফ এন্ড ইউজেবল।

পরের দিনই যেতে বের হলাম। মনে হলো পূর্বা আমার সাথে যেতে অখুশি । এটা কেমন কথা! এতোদিন আমাকে পাগল করে ফেলছিল। এখন বিপরীত পথে হাঁটা দিচ্ছে। ট্রেনেও চুপচাপ বসে রইলো। আমি শুধু মতিগতি বুঝার চেষ্টা করলাম। পিচ্চি মেয়ের ঝাঁজ তো অনেক! অনেকক্ষণ পরে মুখে খুলে বলল, “পানি খাবো।”

এতক্ষণ একইভাবে জানালার দিকে তাকিয়েছিল। পানি এনে দেওয়ার সময় শুধু একবার তাকালো। তাও ভালভাবে নয়। কপাল ভাঁজ করে তাকিয়ে বোতল নিলো। আমি ভেবে পাই না। এমন করছে কেন। আমি আমার পরিবারের কথা ভেবে নিয়ে অনিচ্ছা সত্ত্বেও গুরুত্ব দিতে থাকলাম। এখন আমাকেই অবহেলা করে। সম্ভবত ভাবছে আমাকে তো পাবে নিশ্চিত হয়ে গেল। এখন শোধ নিবে আমার প্রতিটা অবহেলা, ঘৃণার। এরকম চিন্তা যদি হয় তাইলে বেশ ভাল চিন্তাই বলা যায়। তবে আমি একটু এক্সপার্ট এই লেভেলে। প্রেম না করলেও ভালই জ্ঞান আছে। আমাকে কি করতে হবে খুব ভাল করে জানা আছে।

কিছুক্ষণ পর পর ঘুমের ভাণ ধরে পূর্বার কাঁধে মাথা বারবার ফেলি আর বারবার তুলে সরিয়ে দেয়। এভাবে কিছুক্ষণ করার পর আর করলাম না। ধাপে ধাপে আগাতে হবে। পূর্বাকে পৌঁছে দিয়ে চলে আসলাম।

পাঁচদিন পর পূর্বা ওর মামাতো ভাইয়ের সাথে আসে। এই কয়দিন তিনা আমাকে জ্বালিয়ে খেয়েছে। আমি যাই করি না কেন সব কিছুতেই সন্দেহ করে। সেড মুভি দেখলে, মোবাইলে সেড গান শুনলে, বসে বসে অন্যমনষ্ক হয়ে কিছু ভাবতে থাকলেই এসে বলবে, “ভাইয়া তুই পূর্বার কথা ভাবছিস, তাই না?” “পূর্বা নেই বলে মন খারাপ বুঝি!”

এরকম হাজারটা কথা বলবে। আমি চুপ করে থাকি। আমি কিছু বললেই সে অহেতুক কথা বলা শুরু করে টোটালি একটা জটলা শুরু করবে। তাই পূর্বা এসে যাওয়াতে কিছুটা হলেও স্বস্তি আসবে।

আসার পর পূর্বা আমাকে পাত্তাই দেয় না। এড়িয়ে চলে। তিনার সাথে কথাবলার খুব প্রয়োজন হলে ওদের বাসায় ডেকে নেয়। আমাদের বাসায় আসে না। আমি অবাক হই মেয়েটির এমন কাণ্ড দেখে। ক’দিন আগেও তো এরকম তো ছিল না! এখন এমন হলো কেন?

রুমে বসে এফবি চালাচ্ছিলাম। হঠাৎ পূর্বার গলার আওয়াজ পেলাম, এরকমই মনে হচ্ছিল। ভাবনা ঠিক। পূর্বা আসলো তিনার সাথে কলেজ শেষ করে। হঠাৎ আসলো যে! যেয়ে দেখি মা’র সাথে কথা বলছে। শুধুমাত্র শুনলাম তিনা বলল, “একসময় তো রোজ খেতে হবে!”

তারমানে পূর্বাকে খাওয়ার জন্য মা আসতে বলছিলেন। কি আহ্লাদ! আমি কাউকে কিছু না বলে খাবার টেবিলে বসে গেলাম। দেখি কিভাবে আমার সামনে এবার থাকে। এসে বসলো মাথা নিচু করে। তিনা বলল, “ভাইয়া তুই পরে খেলে কি হতো? আসছিস পূর্বাকে জ্বালাতে। ”

তিনার কথাশুনেও চুপ করে রইলো। ভাইবা বোর্ডে ইন্টার্ভিউ দিতে বসছে সম্ভবত। তাহলে ভালকরেই ইন্টার্ভিউটা নেই। মা এসে খাবার দিতে দিতে বললেন, “লজ্জা করো কেন মা। মাঝেমাঝে আসিও। আমাদের তো একদম ভুলে গেলে। আমি কি তোমার আরেক মা নই, আমাদের ভুলে গেলে চলবে?”
মা’র কথার পর আমি বলে উঠলাম, “একদম সঠিক কথা।”
মা চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকালেন। আমি বিরসভাবে বললাম, “না এমনি বললাম। আসা একদম উচিৎ নয়।”
মা আরো রেগে গিয়ে বললেন, “পরে খাবি তুই। যা এখান থেকে। যা।”
আমাকে জোর করে উঠিয়ে দিলেন। উঠতে উঠতে বললাম, “আসলে আসা উচিৎ কি না বুঝতে পারছি না। ”
” তোকে বলছি নাক গলাতে? যা তো!”
আমি পূর্বার দিকে একটু রাগ নিয়ে তাকিয়ে রুমে চলে আসলাম। যাক বাবা ভালই দিলাম! আমি বাইরে অপেক্ষা করছিলাম। আমাদের বাসা থেকে বের হতেই পূর্বার হাত ধরে বললাম,” কি গো এমন করো কেন?”
” হাত ছাড়েন।”
” ওরেব্বাস! এইটুকু পিচ্চি মেয়ের এতো দেমাগ!”
” শুনেন, আমি পিচ্চি না। ওকে?”
” বুঝলাম। তো বিয়ে করবে আমাকে অথচ আমাকে এড়িয়ে চলো। কেন এগুলা করো? ওইদিন গায়েব হয়ে যেতে বলেছিলাম বলে বুঝি?”
কিছু বলল না। চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইলো।
” আসলে তখন তো তোমাকে পছন্দ করতাম না। তাই এরকম বলছিলাম। কিন্তু এখন..
অবশেষে পূর্বা মুখ খুললো।ব লল, ” এখন কি বলেন বলেন? ”
একটু সময় নিয়ে বললাম, “এখন ভালবাসি ”

আমার কথাশুনে আর এক মুহূর্তও অপেক্ষা করেনি। বড় বড় পা ফেলে ওর বাসায় ঢুকে গেলো। বুঝলাম না শক খাইলো নাকি! আমাকে বিয়ে করবে যখন বলতেই তো পারি!”
রাতে পড়ছিলাম। অপরিচিত নাম্বার থেকে ফোন আসলো।ধরতেই বলল,” কি সৌরভ সাহেব আমি যা বলেছি তাই হলো তো?”
পূর্বা ফোন দিল। বললাম, ” কি?”
” মনে করে দেখেন।”
” ধুর! বললে বলো।
” ধমকান কেন? একদিন বলেছিলাম না আপনি আমাকে ভালবাসবেন। হলো তো?”
” হুম। ”
” আমি যা বলি তাই হলো তো? ”
” হুম।”
” কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের সাথে জানানো যাচ্ছে যে কর্তৃপক্ষ আপনাকে আর পছন্দ করে না। ”
” মানে কি? ”
” কাল আমার সাথে দেখা করিয়েন বুঝিয়ে বলবো। ”
” ওকে।”

আর পড়িনি। সারারাত ঠিকমতো ঘুম হয়নি। আমাকে পছন্দ করে না! এইটা কি মজা ছিল? এই প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে ভাবতে রাত পার হয়ে গেল। পূর্বা সকালে ম্যাসেজ দিয়ে বলল, ” ক্লাস শেষে অপেক্ষা করিয়েন। ”
আমার ক্লাস শেষে পূর্বার জন্য অপেক্ষা করলাম। পূর্বার ক্লাস আরো এক ঘন্টা পর শেষ হলো। তিনা আজ আসে নি। এসে বলল, ” সরি প্র‍্যাক্টিকেল ক্লাস করায় লেইট হয়ে গেল।”
” নো প্রবলেম। চলো। ”

একটা ক্যাফেতে বসলাম। কিছুক্ষণ পর বলল, ” একদম সরাসরি বলছি। আসলে আমার প্রতি তোমার ফিলিংস শূন্য দেখে আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমার কোনোকিছুই তোমার পছন্দ নয়। আমি যেন হারিয়ে যাই। বুঝলাম আর হবে না। তাই তোমাকে পাওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা বন্ধ করে দিলাম।”

পূর্বার মুখে আবার তুমি ডাক শুনে ভাল লাগলো। আমি বললাম, “বুঝলাম। পেইন দেওয়ার জন্য সরি। এখন তো সিদ্ধান্ত, বিয়ের সময় আসলে আমাদের বিয়ে হবে। তাই থাক না এসব…”
আমাকে থামিয়ে দিলো।
গম্ভীর মুখ করে বলল, ” না। আসলে সৈকত নামের একটা ক্লাসমেট আছে আমার। তিনাকে জিজ্ঞেস করলে ও’র সম্পর্কে জানতে পারবে। যেদিন থেকে তুমি চিরদিনের মতো হারিয়ে যেতে বললে। সেদিন প্রচণ্ড রেগেছিলাম। এতোটাই রেগেছিলাম যে সৈকতের কাছে সব শেয়ার করলাম। সৈকত আমাকে সুন্দর করে বুঝিয়েছিল যে, “জোর করে প্রেম হয় না, তোমাকে ভুলে যেতে, যদি বাসো তাহলে এমনিতেই আসবে তুমি একদিন।” ওর কথা ভেবে দেখলাম ভুল বলে নি। সৈকত প্রত্যেকদিন তোমার সম্পর্কে খোঁজখবর নিতো। এতে করে ফেসবুকে, ফোনে, কলেজে অনেক কথা হতো। কিভাবে যেন অনেক ক্লোজ হয়ে গেছিলাম। তারপর একদিন কথায় কথায় বলে দিলো আমাকে পছন্দ করে। হাতটা বাড়িয়ে দিলো। আমিও ওর হাতে হাত বাড়িয়ে দিলাম। তবে তাকে হ্যাঁ, না কিছু বলিনি। খুব ভুল করেছি সৌরভ? ”

আমি বোকা হয়ে গেলাম। কি হওয়ার কথা আর কি হল! বললাম, ” না। ভুল না। তারপর? ”
” তারপর কি আর, এরপর থেকে তো জানো। আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও বাবার কথায় হ্যাঁ, হ্যাঁ বললাম। এখন তুমি একমাত্র ভরসা! ”
” আমি? কিভাবে? ”
” তুমি আমাদের বিয়ের কথাবার্তা বন্ধ করে দিবে। তুমি ছাড়া কেউ পারবে না। ”
কিছুক্ষণ ভাবতে থাকলাম। তারপর বললাম, ” ওকে।ডান।”
” থ্যাংকস! ”

এরপর খুব সাধারণভাবে দিন কেটে যেতে লাগলো। পরিবারে চলে পূর্বাকে নিয়ে আধিক্যেতা। পূর্বাও সেগুলা হজম করে তৃপ্তিসহকারে। এখন প্রত্যেকদিন আমাদের বাসায় আসে। নিশ্চিত হয়ে গেছে এখন আর কোনো সমস্যা হবে না আসায় যাওয়ায়। আমি এখনো কিছু বলিনি কাউকে। পূর্বাই মানা করছে। বলল, “আরো কিছুদিন যাক। বিয়ে তো আর অনেকদিন পরে দিবে বলছিলেন। এখন বললে দুই পরিবারেই সমস্যা হতে পারে।”
পূর্বার কথা ঠিকি আছে। এখন বলার কোনো প্রয়োজন নেই।

প্রায় একমাস এভাবে যাওয়ার পর পূর্বা একদিন আমার রুমে এসে বলল,  কেমন আছো? ভাইয়া! ”
আমাদের বাসায় নিয়মিত আসলেও এই প্রথম আমার রুমে আসলো। আর আমি নিজের রুমেই এখন দিনের অধিকাংশ সময় কাটাই। তাই পূর্বার সাথে দেখা হয় না খুব একটা।
মনে হলো ভাইয়া ডাকটা একটু গাঢ় করে ডাকলো। উপহাস করে নাকি! ভালই মজা নেয়।
” হুম। বলো?”
” কি খবর। আমার সাথে তো দেখি কথাই বলো না এখন আর! আমার এরকম আচরণে কষ্ট পাইছো কি?”
” না।”
” তাহলে চেহারার একি অবস্থা?”

আসলে আমার মনে পূর্বার জন্য স্থায়ী আসন তৈরি হয়ে গেছিলো। সেটা খুব ভাল করেই বুঝলাম যেদিন সৈকতকে নিয়ে কথা বলল। মেনে নিতে পারছিলাম না। তাই চেহারার বারোটা বাজলো। বললাম, “আসলে সময় করতে পারছিলাম না। তাই আর কি মুখ পরিষ্কার করতে যাওয়া হয় নি। তো কি মনে করে আসলে?”
” এমনি। কেন দেখতে আসা যায় না বুঝি? ”
” যায়। বিশেষ উদ্দেশ্য ছাড়া তুমি আসার পাত্র নয় তো!”
” দাড়ি, গোঁফ কেটে একদম পরিষ্কার হও। বুঝেছো? ”
” সেই বিষয়ে তোমাকে এসে জ্ঞান দিতে হবে না।”
” হুম। সরি!”

সরি’ বলে চলে গেল। অদ্ভুত লাগলো! আমার কেয়ার করতে আসছে নাকি! আমার তো এতো কেয়ারের প্রয়োজন নাই! লক্ষ্য করলাম তিনা পূর্বাকে নিয়ে আমাকে অনেকদিন হলো খোঁচিয়ে কথা বলে না। পূর্বা কি তিনাকেও বলে দিয়েছে? তিনার মুখ পাতলা। ও মা’কে বলে দিবে। কিন্তু বলেনি সম্ভবত।

সন্ধ্যার পরে তিনাকে বললাম, “শোন। পূর্বাকে আমি বিয়ে করবো না।”
টিভি দেখছিল। অবাক চোখে তাকিয়ে বলল, “কি বলিস? কেন?”
“পূর্বাকে আমি পছন্দ করি না নিশ্চয় টের পেয়েছিস। কেন করি না জানিস? একটা মেয়েকে আমি পছন্দ করি দীর্ঘদিন ধরে। বাবার কথা ভেবে আর বলা হয় নি কাউকে। বাট ওই মেয়েকে ছাড়া আমি থাকতে পারবো না।”

তিনা থ হয়ে গেল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আমার দিকে। এভাবে তাকিয়ে থাকা দেখে আমি নিশ্চিত হলাম পূর্বা কিছু বলেনি তিনাকে। বললাম, ” তুই ম্যানেজ করতে হবে বাবা, মা’কে। পারবি না?”
তিনা রেগে গিয়ে বলল,” চুপ। তুই পূর্বাকে বিয়ে করবি। অন্য কোনো মেয়ে থাকলে তাকে ক্যানসেল কর।”
” পূর্বাকে বুঝিয়ে বলে দিস। ”
” না…!”

অনেক জোরে জোরে বলছিল তাই আমি কেটে পড়লাম। নয়তো মা এসে গণ্ডগোল বাঁধবেন। আমি ভেবেছিলাম পূর্বা দারুণ খুশি হবে এই ভেবে যে, আমি কিভাবে পূর্বাকে নট করলাম আমার থেকে। কিন্তু তিন চারদিন গেল পূর্বার সাথে সামনাসামনি হলাম দু’বার, দু’বারই মুখ কালো করে এড়িয়ে গেল। আমাদের বাসায় ও আসছে না।

বিকালে কলেজ থেকে ফিরছিলাম। তিনা ফোন দিলো। বলল, ” ভাইয়া, তাড়াতাড়ি সদরে হাসপাতালে আস।”
আমি হাসপাতালের কথা শুনে একটু চমকে গেলাম। বাবার কি হার্টের প্রবলেম বেড়েছে! নাকি মা’র প্রেসার বেড়েছে! হাসপাতালে গিয়ে দেখি তিনা, পূর্বার মা আর বাবা বসে আছেন। আমাকে দেখে যেন রেগে গেলেন বাবা। অদ্ভুত! আমাকে আসতে বলে আমার উপরই আবার রাগ!
“কি হইছে?”
বাবা রেগে বললেন,” মেয়েটিকে তুই কি বলছিস?”
মেয়েটি! পূর্বার কিছু হয়নি তো! আমার হার্টবিট বেড়ে গেল। নার্স ডাকায় বাবা আর পূর্বার মা ভীতরে গেলেন। আমি যেতে চাইলে তিনা আমার হাত ধরে থামিয়ে দিলো। অবাক হয়ে ওর দিকে তাকালাম। তিনার চোখেমুখে আতংক স্পষ্ট। বলল, “ভাইয়া পূর্বা তোর উপর রাগ করে হাত কেটেছে রে। ”
তিনার কথাশুনে মাথা ভনভন করতে লাগলো। আমি কি করলাম!
” কেন? আমি কি করছি?”
” আমি পূর্বাকে বলে দিয়েছি তুই যে অন্য আরেকটা মেয়েকে ভালবাসিস, পূর্বাকে না।”
” পূর্বাও তো আমাকে বাসে না। সৈকত নামের তোদের এক ক্লাসমেটকে পছন্দ করে।”
” সৈকত নামে আমার কোন ক্লাসমেট নেই। মিথ্যা বলছিল তোকে। পূর্বা চেয়েছিল তুই যেমন ও’কে পেইন দিছিস। সেরকম দিবে তোকে। আমার কাছে অনুমতি চেয়েছিল। আমিও তোদের এই কাহিনী মজা ভেবে উপভোগ করার জন্য অনুমতি দিয়ে দেই। সব দোষ আমার! আমি না বললে হাত কাটতো না।”

তিনা এসব বলে মুখ কালো করে ফেললো। এতদূর কাহিনী তাহলে! ভালই গেইম খেললো পূর্বা। আর আমার পাগলি বোন ও কম না বৃটিশ নয়তো দেখি। আমাকে নিয়ে গেইম খেলে! বললাম, ” খুব সিরিয়াসভাবে কাটছে?”
” হুম রে। রক্ত প্রচুর ক্ষয় হয়েছে।”
মাথা নিচু করে বলল। আমি বললাম, “আমি অন্য কোনো মেয়েকে পছন্দ করি না রে। তোদের মতো গেইম খেললাম। তুই পূর্বাকে নিয়ে আমাকে তখন কিছু বলতি না, চুপ থাকতি। তাই পরীক্ষা করতে যেয়ে বলছি। পূর্বার হাত কাটার জন্য আমিও দায়ী! ”
মাথা নিচু করে ফেললাম। তিনা হেসে দিলো। বলল, ” সমানে সমান। যা ভিতরে। গিয়ে পূর্বাকে বুঝা। ”

আমি দেরি না করে ভিতরে গেলাম। হাত সম্ভবত বেশি কাটছে। ব্যাণ্ডেজ বেশি করে দেওয়া। আমাকে দেখে অন্যদিকে মুখ করে নিলো। খুব করে চাইছি বাবা আর পূর্বার মা বাইরে যাক। নয়তো এই অভিমান ভাঙ্গা যাবে না এখন। আমার মনের কথা সম্ভবত উনারা বুঝে গেলেন। উঠে বাইরে চলে গেলেন। পূর্বার পাশে যেয়ে বসলাম। চোখ টলটল করছে। চুন থেকে পান খসলেই কেঁদে দিবে। আমিও চাই কাঁদুক। বললাম, ” আসতে চাই নি। খুব জোরাজুরি করছেন মা। নয়তো এখন নাক ডাকিয়ে ঘুমে থাকতাম। ”
পূর্বা এবার ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগলো। কান্নার আওয়াজ বৃদ্ধি পেতে লাগলো। সমস্যা হবে বাড়লে। বললাম, ” এভাবে নিজের ক্ষতি করলে কেন?”
অন্যদিকে মুখ করে বলল,” আমার ইচ্ছা।”
” সৈকত খুব পেইন দিছে? ”
” না।”
” তাহলে কে পেইন দিছে?”
” তুমি।”
” আমি কই দিলাম।”
” কাকে লাভ করো তুমি?”
পূর্বা চোখ বড় করে সরাসরি একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
” তোমাকে।”
” মজা করো, তাই না?”
” তিনাকে যা বলছিলাম তা মজা। কিন্তু তোমাকে যা বলছি তাই-ই সত্য গো।”
” কিভাবে বিশ্বাস করবো?”
” চলো বিয়ে করে ফেলি এখনই।”
” ধ্যাত! কেন এমনটা করলে? কতো পেইন পাইছি জানো? ”
” তুমি কেন সৈকত চোরাকে নিয়ে মজা করলে? কতো পেইন পাইছি জানো?”
” আমার কথা আমাকে তাই না?”
” হু।”
” ডান হাত ভাল থাকলে এখন কান মলে দিতাম। আমার সাথে মজা! ”
” বাম হাত দিয়ে দাও মলে।”
” না। বাম হাত দিয়ে স্বামীর কানে ধরা ঠিক না।”
” ওহ! তাইলে কামড় দেও!”
” হি হি। ওকে।”
আমার মাথা বাম হাত দিয়ে ওর মুখের কাছে নিয়ে আমার কানে কামড় না দিয়ে কানেকানে বলল,” ভালবাসি তোমাকে।”
আমি ঢুক গিললাম মাথা তুলে।
” কি হলো?”
” এটা কোন স্টাইলের কামড় ছিল?”
পুর্বা মৃদু হাসলো। তিনা রুমে ঢুকে বলল, ” এতক্ষণ ধরেও কি ভাইয়া বুঝানো হয় নি? যা তো। বাবা ডাকে।”
আমি কেবিন থেকে উঠে গেলাম। আসার আর সময় পায় নি। পালটা কামড় দেওয়ার আর সুযোগ পাই নি।

জানি বাবার সামনে গেলে কিছু গালি খাবো। কেন এমন করলাম, এই সেই। তারপর অসহায় কণ্ঠে বলবেন, “মেয়েটা খুব ভাল রে। দেখিস খুব সহজেই আমাদের সাথে মিশে যাবে। ”

আমি মাথা নিচু করে সব হজম করবো। খুব ভাল করেই হজম করবো। সেদিন না পারলেও আজ অনেক সাহস নিয়ে আমাকে বলতেই হবে, “ইয়েস বাবা। ইয়েস। পূর্বা খুব ভাল মেয়ে। আমি ও’কেই বিয়ে করবো। নিশ্চিত থাকো।”

যাবার আগে পূর্বার দিকে একবার তাকালাম। আমার দিকে চেয়ে চেয়ে তিনার সাথে কথা বলছে। আরো আগে এই মেয়েকে সঠিকভাবে চিনলে এরকম অনেকগুলা কামড় উপহার পেতাম! যাইহোক সেইগুলা এখন নিয়মিত আদায় করে নিতে হবে!
পই পই করে হিসাব করে!

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত