সূর্য্য কুমার

সূর্য্য কুমার

গল্প লিখেেন -শাওন

জলিল সাহেবের পুত্র আবু-ইবনে্ হুসাইন ওরফে সূর্য্য প্রতিদিন ৫টায় ঘুম থেকে উঠে সালাত আদায় করার পর, হাঁটতে বের হয়। রাস্তায় যেসব খাবার/পানীয়​পাওয়া যায় তা নির্দ্বিধায় গলধকরন করে, তারপর সকাল দশটায় বাড়ি ফিরে সে, বাবা মাকে সালাম জানিয়ে টেবিলে নাস্তা করতে বসে।তার এমন আদবকায়দা শিখিয়েছেন তার দাদাজান।বড়দের দিকে চোখ তুলে তাকিয়েও কোনদিন কথা বলে না সূর্য।শুধু তাই না বন্ধুদের কাছেও সে মহাপুরুষ… প্রেম তো দূরের কথা মেয়েদের দিকে তাকাতেও নাকি তার বিরক্তি লাগে।তার মতে নারী জাতি শুধু সাজুগুজু করতেই জানে কাজের কাজ কিছ্ছু জানে না।ছোট বেলা থেকে বয়েস স্কুল কলেজে পড়ায় তার মেয়েদের প্রতি কোন ধারণা নেই। এছাড়া তার চৌদ্দ গুষ্টির সব নারীরাই সাজ নিয়ে মহা ব্যস্ত থাকায়,তার এমন ধারণা জন্মানোটা অস্বাভাবিক কিছু না।
আজ সকাল দশটায় ও যথারীতি বসেছে নাস্তার টেবিলে,তার বাবা বললেন,’বাপ সুইয্য ইঞ্জিনিয়ার পাছ কোরছো, ওনেক শিখখিত হইছো, ওখন আলা ব্যবছায় মন লাগাও।’
-‘আব্বা একি বলছেন আমি ইঞ্জিনিয়ার…..! কি করে ভাঙারির ব্যবসা করবো ..?’ অবাক হয়ে বলল সূর্য।
‘-কেন ভাঙারিরে ইন্জিনিয়ান টিকনিকে কায়দায় আনবা’
তিন বোনের একমাএ ছোট​ ভাই সূর্যের রোল সর্বদা ৫০,৪৯ই হতো তবুও ক্যাডেট কলেজে​ চান্স হয়ে গিয়েছিল সূর্যের। ক্যাডেট থেকে বের হয়ে বুয়েটে ইঞ্জিনিয়ারিং​ পড়ার সুযোগ ও পায় সে।এমন সোনার টুকরা ছেলে পেয়েও তার আত্মীয়রা সন্তুষ্ট না।
‘কি কইবার চাও ..?আমি ছিখখিত না ? বিএ পাছ কইরাওতো বাপ দাদার ব্যবছা ধরছি,তো তুমি পারবা না কেলা…?কুটি টাকার ব্যবছা আমাগো,অহনো এলাকার মাইনসে সালাম দেয়,’-রেগে বললেন সূর্যের​ বাবা।
-‘আমার আব্বাজান যা করবার চায় তাই করবার দেন না’ -গলার হারটা ঠিক করতে করতে বললেন​ সূর্যের মা।
‘আমার বাপে হালারপো, আমার পোলাডারে ধেনু বানাইছে’-রাগে গজগজ করে বললেন সূর্যের বাবা।বলার ও কারন আছে .!একবার সূর্য ওর বাবার সাথে নামাজ পড়তে যাচ্ছিল পথে ওর বাবার চাচার সাথে দেখা হয়, সূর্যকে ওর বাবা বলল “বাপ সুইয্য সালাম দাও” -‘আসসালা…মুলাইকুম তারখাম্বা ‘ কারন ভদ্রলোক তার খাম্বার পাশে দাঁড়ানো ছিল আর সূর্য লোকটিকে দেখেনি দেখেছে খাম্বা তাই সালাম খাম্বাকেই দিয়েছে।এই ব্যাপারটা নিয়ে পরিবারে তোলপাড় কম হয়নি।
রাগ হয়েও, সূর্য খাবার খাচ্ছে কারন তার দাদা বলেছেন রাগ করে খাবার রেখে উঠতে নেই, তাহলে খাবারের অসম্মান হয়।
দুপুরে খাওয়া শেষ করে সাইকেল নেয়ে বের হয়েছে সূর্য, মেজাজ খুব খারাপ লাগছে তার ।আজ সারা বিকেল সাইকেল চালাবে আর সেই সাথে লাইব্রেরী থেকে কিছু বই কিনবে​।স্কুলে সাইকেল রেসে সে সর্বদা ১ম হতো।এটা শখের কাজের অন্যতম একটা কাজ।তাই মেজাজ খারাপ হলেই সূর্য সাইকেল চালায়।
ফেরার পথে দ্রুত বেগে সাইকেল চালাচ্ছে সূর্য আর ভাবছে ‘আব্বার বাড়ি গাড়ি কিচ্ছু লাগবে না প্রয়োজনে রাস্তায় ঘুমাবো তাও ভাঙারির ব্যবসা করব না।’এমন সময় ধরাম করে শব্দ হল কেউ একজন সাইকেলে ভীষণ জোরে আঘাত পেয়ে ডান পাশে পড়ে গেল আর সূর্য পড়ল বাম পাশে সাইকেলের নিচে সেই সাথে সাইকেলে ঝুলানো বইগুলোও ছিটকে পরে গেল রাস্তায় । সূর্য লক্ষ্য করলো মূহুর্তেই রক্তাত্ব হয়ে গেছে রাস্তাটা।
.
‘আমার যমুনার জল দেখতে কালো স্নান করিতে লাগে ভালো যৌবন ভাসিয়া গেল জ.ও.ওলে..’ ঘাটলার শেষ সিড়িতে পা ভিজিয়ে কে যেন গুন গুন করছে।সূর্য দূর থেকে খেয়াল করে, সামনে এগুতেই সে ঘুরে তাকিয়ে হেলে ধুলে পানি থেকে উঠে এল। নূপুরের​ রিনিঝিনি শব্দ আর তার হাসির শব্দ মিশে একাকার।এ যেন এক অপ্সরী……! আর অদ্ভুত ভাবে তার গা থেকে আলো বিচ্ছুরিত হচ্ছে।লাল রঙের বাঙালী ধরনের শাড়ি পরা, এলো চুল, কপালে ছোট্ট লাল বিন্দু, চোখ জুড়ে কাজল, মুখ ভর্তি পান চিবুচ্ছে সে।হাসার সময় পানের রস মুখ থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে কিন্তু কেন যেন বেরুচ্ছে না।তার চোখ চিনতে সূর্য মোটেও ভুল করলো না অবাক হয়ে বলল ‘ইন্দুবালা’।পাশে রাখা সূর্যের দাদির রূপার চিলঞ্চী হাতে নিয়ে ফিক করে পানের পিক ফেলল ইন্দুবালা, মূহুর্তেই হাতের চিলঞ্চীটা কবুতর হয়ে আকাশে উড়ে গেল। হেসে গলিয়ে ইন্দুবালা বলল -‘সূর্য বাবু দীঘির জলের মাঝের নীল পদ্মটা এনে দেবেন..?’
বাকশূন্য সূর্য কিছু না বুঝেই দীঘির জলে ঝাঁপ দিল। হাবুডুবু খেতে খেতে বলতে লাগলো ‘ইন্দুবালা আমি’তো সাঁতার’ই জানি না,পদ্ম কি করে আনবো…..!’আর ঘাটলায় ইন্দুবালা তা দেখে হেসে গলে পড়ছে।
দীঘির পানি খেতে খেতে ঘুম ভাঙলো সূর্যের, ঘড়িতে রাত ৩.৩৯ বাজে।ঘুমের মধ্যে মৃত্যু দেখে কিছুটা ভয় পেলেও বেশ ভালো লাগছিল ইন্দুবালার কথা ভেবে।
মেয়েটার নাম সত্যিই ইন্দু কিনা কে জানে …..?
তার ঘরে মৃদু স্বরে গান বাজছে। “পেয়ার হোয়া ইকরার হোয়া” রাত ১২ টা থেকে এ গান বাজছে, তার দাদার পছন্দের​ গান তার দাদা জোর করেই এ গানটা তাকে শুনাতো কিন্তু সে গানটার মাথামুন্ড এতোদিন কিছুই বুঝতো না কিন্তু আজ তার হৃদয়কে ছেদ করছে এই গান তাই রাতে শোবার পর মৃদু শব্দে গানটি শুনছে। বিছানায় উঠে বসে, সূর্যের​ চোখ পড়লো “হিমুর হাতে কয়েকটি নীলপদ্ম” বইটিতে।সেদিন দূর্ঘটনায় এই বই পরিবর্তন হয়ে, সূর্যের ​কাছে চলে এসেছে। এমন বই সে কোন দিন পড়েনি।তবুও বইটা সম্পূর্ন পড়ে ফেলেছে। বিজ্ঞানের জাদু, অংকের খেলা এসব তার ছোট বেলার পড়ার বই।বড় হওয়ার সাথে সাথে বইয়ের মান বৃদ্ধি পেয়েছে কিন্তু বিষয় বস্তুর কোন পরিবর্তন হয়’নি। বইটি হাতে নিয়ে আবার পাতা উল্টালো সূর্য “প্রিয় ইন্দু তোমার হিমুকে তোমার হাতে সোপে দিলাম” ইতি তোমার ইতি হিহিহিহি” কেউ একজন ইন্দু কে বইটি গিফট করেছে।
২য় পাতায় যা লেখা তা বুঝতে সূর্যের​ বেশ সময় লাগলো অনেক জটিল বাক্য গুচ্ছ।

“”উগ্র বিষ শরীরে প্রবেশ করিলে পাঁচ মিনিটের মধ্যেই তাহার চরম ফল ফলিয়া শেষ হইতে পারে, কিন্তু বিষ মনে প্রবেশ করিলে মৃত্যুযন্ত্রণা আনে–মৃত্যু আনে না।”” _রবীন্দ্রনাথ

পরোক্ষণেই চোখে ভাসছে ঐ ঘটনা। প্রথমে বুঝতেই পারেনি, যে কি হল…?কেউ ‘মাগোওও’ বলে চিৎকার দিয়ে পড়ে গেল । রক্ত দেখে হকচকিয়ে গিয়েছিল সূর্য ।সাইকেল সরিয়ে উঠে দাঁড়াতেই দেখলো একটা মেয়ে ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে হাত ঝেরে মাটি থেকে উঠতে চেষ্টা করছে। মেয়েটির চুলগুলো ওগোছালো গায়ে কাঁদা আর রক্ত দিয়ে হলুদ কামিজ মেখে গেছে।গোধূলি​ লগ্নে তাকে অসম্ভব মায়াবী লাগছিল।মায়া উবে গেল যখন সে বলে উঠলো-‘চার চোখ দিয়েও চোখে দেখেন’না নাকি? আমার ঔষধ গুলো সব শেষ ঈশশ ….!’
‘থাক চল দেরি হচ্ছে’-বলল পাশের মেয়েটা, রিকশা ডেকে চলে গেল ওরা।বড্ড বোকা বোকা লাগলো সূর্যের, যখন দেখলো ওগুলো রক্ত ছিল না ঔষধ ছিল।
সকালে সূর্যের ঘুম ভাঙলো ১০টায় ঘর থেকে বেরিয়ে আসতেই দেখলো তার চাচাতো বোন লাডলী দাঁত কেলিয়ে হাসছে।ইন্টার ৩য় বর্ষে পড়ছে সে,(ফেল করে) তবুও​ সাত সকালে লিপস্টিক মাখা বন্ধ হয়নি তার।বাংলা, উর্দু আর হিন্দি মিলিয়ে অদ্ভূত এক ভাষায় কথা বলে লাডলী ।-‘ ভাইয়া তোমার হাত মে কেয়া হুওয়া?’ ওর তুম রাত ভোর কিউ গানা শুনরাহাথা? সামাঝগায়া তোমার শাদীর মহরত চালা আয়া… ইছলিয়ে বাড়িই মাকো বাতানা পারেগা ‘ বলে দাঁত কেলিয়ে হাসতে লাগলো।
-“এক থাপ্পর দিয়ে তোর সব দাঁত ফেলে দিব, বিয়াদব কোথাকার কতো দিন না বলেছি তুই এমন ধরনের ভাষায় আমার সাথে কথা বলতে আসবি না”-রেগে বলল সূর্য। ফিক করে হেসে দৌড়ে পালিয়ে গেল লাডলী।
.
চৈত্রের প্রখর রোদ….!এতো রোদে মানুষ তো দূরের কথা কোন প্রাণীও রাস্তায় থাকে না,কিন্তু ইন্দু খুব দ্রুত হাঁটার চেষ্টা করছে, পা যেন চলতেই চাইছে না ।ভীষন ব্যাথা হচ্ছে তাই খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে তাকে। আজ কোন বাস তার কপালে জোটে’নি।চুলগুলো​ পিঠে ঘামে লেপটে আছে, মুখ খানা রোদে রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। তবুও কিছু করার নেই একটা রিপোর্ট জমা দিতে হবে দুপুর ১২টায়।
‘এক্স কিউজ মি’- কে যেন পেছন থেকে ডাকলেন।ইন্দু ঘুরে তাকিয়েই সেদিনের ঘটনা মনে পরে গেল।ইন্দু বিরক্ত মুখে মুখ ঘুরিয়ে জোরে হাঁটার চেষ্টা করলো।
‘আপনার পায়ের কি অবস্থা ?আমি দুঃখিত যে আমি আপনার কোন খোঁজ নিতে পারি’নি, বুঝতে পারছি আপনার খুব কষ্ট হচ্ছে, কোথায় যাবেন বলুন ?আমি পৌঁছে …।’-অনর্গল বলতে লাগলো সূর্য।ইন্দু তাকাতেই সূর্য থেমে গেল।
‘অনেক ধন্যবাদ বলার জন্য,এখন আপনার কাজে অগ্রসর হলে আমি খুশি হব।’
‘আমার এখন কোন কাজ নেই । প্লিজ বলুন আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি, আমি সত্যিই খুব লজ্জিত সেদিনের বিষয়ে।’- মাথা নিচু করে বলল সূর্য।
তার নিষ্পাপ গোল মুখ’টা দেখে ইন্দুর ভীষণ মায়া লাগলো, তাছাড়া নিজের পায়ের অবস্থাও খুব খারাপ। সে বলল- ‘কারোয়ান বাজার যাবো।’
এখন এ মানব মানবী সাইকেলে, সূর্য ড্রাইভার আর ইন্দু রাগান্বিত প্রেসেন্জার।আধ ঘন্টায় তারা পৌঁছে গেল। ইন্দু রিপোর্ট​ জমা দিয়ে টাকার খাম হাতে নিয়ে ভাবলো বাবার জন্যে​ ঔষধ কিনতে হবে, সেদিন ঐ দুর্ঘটনায় বেশ কিছু ঔষধ নষ্ট হয়েছিল।ভাই বোনদের মাঝে ইন্দুই বড়।বাবা অবসরপ্রাপ্ত​ স্কুল শিক্ষক।সে কারনে ভাবনাটা ইন্দুর একটু বেশি।সে চায় না বাবা তাকে নিয়ে ভাবুক।ইডেন কলেজে শেষ বর্ষের ছাত্রী ইন্দু। টিউশনি আর রিপোর্ট করেই কিছু টাকা রোজগার করতে হয় তাকে।রিপোর্টেও বেশ ঝামেলা, পরিচিত এক রিপোর্টার​ তাকে​ রিপোর্ট করতে দেয় কিন্তু​ সংবাদপত্রে নাম প্রকাশ​ হয় সেই রিপোর্টারের, ইন্দুর নাম নয়,টাকা নিয়েও হাজারো বাহানা করে।অফিস থেকে বের হয়ে ইন্দু দেখলো গোলমুখের ছেলেটি সাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাকে দেখে বলল ‘কোথায় যাবেন বলুন পৌঁছে দিচ্ছি’
‘আপনি এখনো যাননি,না ধন্যবাদ আশা করি এখন বাস পাবো।’
‘আপনার পায়ের জন্য বাসে উঠতে সমস্যা হবে আমি আপনাকে পৌঁছে দিচ্ছি, প্লিজ চলুন।’
‘ঠিক আছে যেখান থেকে উঠেছি ওখানে চলুন।’
দুজনেই নির্বাক, রাস্তা দেখছে ২০মিনিট অতিক্রম হল হঠাৎ একটা বাস সামনে দিয়ে আসছে সূর্য পাশ কাটিয়ে যেতে আপ্রাণ চেষ্টা করলো কিন্তু পারলো না, ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলল, সাইকেল যে কোন দিকে গেল তা কেউই বুঝতে পারলো না। মূহুর্তের মধ্যে লোক জরো হয়ে গেল রাস্তায়।
.
(২মাস পর)
সাত সকালে ইন্দুকে বের হতে হয়েছে কারন তার নতুন ছাত্রের সকাল ১০টায় পরীক্ষা।সে কারনে তার মা ইন্দুকে এই ভোর বেলাতেও পড়াতে যেতে বলেছে।অংক খাতার সামনে ভাবতে লাগলো আজ হঠাৎ রাস্তায় সেই গোল মুখ ছেলেটাকে দেখলাম, ‘বট তলায় বসে হেসে হেসে শরবত বিক্রেতার সাথে কথা বলছিল,হাতে বেলের শরবত।ছেলেটাকে দেখে ভালো ফ্যামিলির মনে হয়েছে। কিন্তু কিভাবে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে গল্প করছিল শরবত বিক্রেতার সাথে। এমন ক্ষমতা বিধাতা খুব কম মানুষদের দিয়ে থাকেন, যারা সব শ্রেণীর মানুষের সাথে মিশতে জানে ছোট থেকে বৃদ্ধদের সাথে।ছেলেটার পরনে সাদামাটা শার্ট আর প্যান্ট পায়ের গোড়ালীর দিকে ভাজ করে খানিকটা উপরে ওঠানো, এর মানে সে ভোরের নামাজ পড়েছে।ভোরের নামাজ যারা আদায় করে তাদের মুখে অদ্ভুত এক জ্যোতি আচ্ছন্ন করে রাখে’ এ কথা বাবা বলেছিল ।এই ছেলেটার মুখেও এমন জ্যোতি বিচ্ছুরিত​ হচ্ছিলো ।
ইন্দুর মনে পড়লো দুর্ঘটনার​ দিনের কথা।
সূর্যের বাড়ির সবাই হসপিটালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে, মহিলারা বিলাপ করছে জোরে স্বরে, তারা সকলেই গলায় হার পরিহিত, দেখে মনে হচ্ছে তারা বিয়ে বাড়িতে এসেছেন।
রাগী একজন নার্স এসে তাদের ধমকাধমকি করে গেলেন। এসব দূরে দাঁড়িয়ে ইন্দু লক্ষ্য করছিল অল্প বয়সী একটা মেয়ে ওকে দেখে হাসছে মেয়েটা এগিয়ে ইন্দুর কাছে এসে জিজ্ঞেস করল ‘আপনার নাম বুঝি ইন্দু ।’
‘হ্যাঁ কিন্তু তুমি জানলে কি করে ।’
‘আপনার একটা বই সূর্য ভাইয়ার কাছে দেখছিলাম, প্রতিদিন ভাইয়ারে বইখান পড়বার দেখি ।’ বলেই মেয়েটা ফিক করে হেসে চলে গেল। কিছুখন পর সূর্যের​ বন্ধু​ বিমূল আসলেন।যাকে আমি সূর্যের ফোন থেকে ফোন করেছিলাম, ছেলেটা দেখতে একদম নায়কের মতো, কিন্তু তার দৃষ্টি সংযত নয় দিকবিদিক ছোটাছুটি​ করছে যা ইন্দুর রাগ ক্রমশ বৃদ্ধি করার জন্য যথেষ্ট।
‘চলে যাচ্ছেন….?..সুন্দরী কেউ রোগীর পাশে থাকলে পুরুষ ডাক্তার ভালোভাবে রোগী দেখেন আর আমারও ভালো লাগতো যদি থাকতেন…আচ্ছা আপনার কোথাও লাগেনি তো দূর্ঘটনায়…?’
‘গোড়ালির হাড় একটু নড়ে গেলে আহামরি কিছু হয় না,এক মাসেই ঠিক হয়ে যাবে আশা করছি…।’-প্রায় ভেংচি কেটেই বলেছিল ইন্দু।
-‘শুনুন এক্সিডেন্ট’টা কিন্তু আপনার জন্যই হয়েছিল।’
-‘সেটা আমি জানি….. ওনাকে বলবেন আমি দুঃখ প্রকাশ করেছি।’
-‘সেটা আপনি বললেই ভালো হয়’না একটা ছেলে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসলো, আর তার কাছে দুঃখ প্রকাশও করতে পারবেন না…!
-‘আমি তাকে বলি’নি আমাকে সহযোগিতা করতে এগিয়ে আসুন।’
-‘ছেলেটা আপনাকে………..সে
এক মাস ধরে প্রতিদিন আপনার জন্য অপেক্ষা করে কেন জানেন…?’
-‘আমি জানতে ইচ্ছুক নই ‘-বলেই চলে এসেছিল ইন্দু।
বাসায় ফিরে ইন্দু আয়নায় নিজের প্রতিচ্ছবিটা দেখলো কি আশ্চর্য অচেনা একটা ছেলের জন্য এতো মায়া লাগছে কেন..?বেকার একটা ছেলে সারাদিন রাস্তায় ঘুরে তাও আবার হাবলুদের মতো দেখায়।এই ছেলের জন্য দরদ উথলে পরার কিছু নেই।
.
বিকাল ৫ টা বাজে সূর্যের এক কাপ চা খাওয়া শেষ,আরো এক কাপ চা হাতে নিয়ে পকেট থেকে কাগজটা খুলে দেখলো আর ভাবলো সত্যিই কি ৫ টায় আসতে বলেছে ইন্দু ।
হলুদ ছোট্ট একটা কাগজ চার ভাজ করা যার একপিঠে ছোট্ট একটা কবিতা লিখা
“‘তুমি সূর্য আর আমি চাঁদ
করেছে আমায়,
তোমার আলোয়,
জ্যোৎস্না রাঙিত রাত।”‘
আর নিচে লিখা
‘এই কাগজ হাতে পেয়ে যদি আপনি এক্সাইটেড​ হয়ে দুর্ঘটনায় এক ঠ্যাং আবার ভাঙ্গেন তাহলে আমি আরেক ঠ্যাং খুশি হয়ে ভেঙ্গে দিয়ে যাব’।অন্যে পিঠে লিখা ‘বিকাল ৫টায় বটতালার চায়ের দোকানে আমি অপেক্ষা করবো।’
মনে মনে হাসলো সূর্য ।আবার ভাবলো লাডলীকি ওর সাথে মজা করলো কাগজটা দিয়ে…? এতে তো ইন্দুর নামও লিখা নেই, কিন্তু লাডলী জীবনেও এমন কবিতা লিখতে পারবে না। ৫.০৫ বেজে গেছে লাডলীর উপর ভীষণ রাগ হচ্ছে ….!! ‘আশেপাশে না তাকালে বুঝবেন কি করে যে, কে আছে আর কে নেই ..?’
হঠাৎ কারো কথা শুনে চমকে ঘুরে তাকাতেই সূর্য দেখলো ইন্দু দাঁড়িয়ে তারপাশে।
আজ তার পরনে আসমানী রঙের শাড়ির সাথে সাদা রঙের ব্লাউজ,চোখে কাজল আর খোপায় সাদা গোলাপ গুজে দেয়া, ঠোঁটভর্তি একগাদা লিপিস্টিক যা সূর্যের বরাবরই অপছন্দ কিন্তু আজ প্রথম তার মনে হলো লিপিস্টিক মেয়েদেরই জন্য ।
‘বলুন তো আমার পরনে কি ….?’
‘সূর্য না তাকিয়েই বলে ফেললো – আপনি আজ আসমানী রঙের শাড়ি পরেছেন।’
‘কি করে বললেন..মি.সূর্য ? আপনিতো আপনার পায়ের দিকেই তাকিয়ে আছেন।’
‘কারো ক্ষেত্রে না দেখেও অনেক কিছু বলে দেয়া যায়।’
লেকের ধারে হাঁটতে হাঁটতে.. ইন্দু বলল -এ ‘যুগের ছেলেরা বুঝি সাইকেল শখ করে চালায় …? সারাক্ষন রাস্তায় রাস্তায় না ঘুরে চাকরির কথাও তো ভাবতে পারেন…!’
আমি সাইকেল চালাতে খুব পছন্দ​ করি আর চেষ্টা করছি, মনমতো চাকরি হচ্ছে না আব্বা চাচ্ছেন আমাদের ব্যবসাটাই আমি করি।ভাঙারির ব্যবসা আমাদের।
‘কতো দূর পড়াশোনা করেছেন …!
এমন প্রশ্নে সূর্য ভীষণ মজা পেল, বলল-‘এইতো মেট্রিক দিয়েছিলাম।’
‘ও তাহলে ব্যবসাটাই করুন….অন্তত বলতে পারবো বিজনেস ম্যান।’ হঠাৎ সূর্যের দিকে তাকিয়ে ইন্দু বলল -‘কখন থেকে দেখছি আপনি মাটির দিকে তাকিয়েই আছেন, আশেপাশে ও তাকান, আমার কবিতাটা লিখাই বুঝি বৃথা গেল, ঠিক আছে আমি চললাম।’পাশ ফিরে ইন্দু এক কদম পা এগুলো ওমনি সূর্য বলল
‘ইন্দুবালা কোথায় যাচ্ছ…? দাঁড়াও….চাঁদের তো নিজস্ব কোন আলো নেই, সূর্যের​ আলোতেই তো সে আলোকিত হয়।’
মুখ ঘুরিয়ে ফিক করে হেসে ইন্দু বলল -“বাহহ এতো জ্ঞান আপনার….!” থাকতে পারি যদি কবিতা আবৃত্তি করে শুনান…..নতুবা শিখে আসেন অন্যদিন আসবো !!!
কার কবিতা শুনতে চাও ….? জিজ্ঞেস করলো সূর্য,ভয়ে হৃদয়ে ঘন্টা বাজছে ভাবলো এই মেয়ে কোন কবির কবিতা শুনতে চায় কে জানে….?
জন কিটস সৌন্দ্যোর্যের কবি…!
সূর্যের​ মনে পড়ছে না। পড়েছিল সে কিন্তু এই মুহূর্তে মাথায় আসছে না।মাথায় শুধু বৈদ্যুতিক তার ভর্তি যন্ত্র।
ইন্দু চোখ কুঁচকে বলল-এরপর আসলে শিখে আসবেন কেমন চললাম…!
দু’পা এগুতেই সূর্য বলল-
Two souls but with a single thought
two hearts that beat as one.
-John keats

গল্পের বিষয়:
রোমান্টিক
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত