প্রেমাংশুর রক্ত চাই

প্রেমাংশুর রক্ত চাই

মানুষ

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষগুলো অন্যরকম,
হাঁটতে পারে, বসতে পারে, এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যায়,
মানুষগুলো অন্যরকম, সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ।

আমি হয়তো মানুষ নই, সারাটা দিন দাঁড়িয়ে থাকি,
গাছের মতো দাঁড়িয়ে থাকি।
সাপে কাটলে টের পাই না, সিনেমা দেখে গান গাই না,
অনেকদিন বরফমাখা জল খাই না ।
কী করে তাও বেঁচে থাকছি, ছবি আঁকছি,
সকালবেলা, দুপুরবেলা অবাক করে
সারাটা দিন বেঁচেই আছি আমার মতে । অবাক লাগে ।

আমি হয়তো মানুষ নই, মানুষ হলে জুতো থাকতো,
বাড়ি থাকতো, ঘর থাকতো,
রাত্রিবেলায় ঘরের মধ্যে নারী থাকতো,
পেটের পটে আমার কালো শিশু আঁকতো ।

আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে আকাশ দেখে হাসবো কেন ?
মানুষগুলো অন্যরকম, হাত থাকবে,
নাক থাকবে, তোমার মতো চোখ থাকবে,
নিকেলমাখা কী সুন্দর চোখ থাকবে
ভালোবাসার কথা দিলেই কথা রাখবে ।

মানুষ হলে উরুর মধ্যে দাগ থাকতো ,
বাবা থাকতো, বোন থাকতো,
ভালোবাসার লোক থাকতো,
হঠাৎ করে মরে যাবার ভয় থাকতো ।

আমি হয়তো মানুষ নই,
মানুষ হলে তোমাকে নিয়ে কবিতা লেখা
আর হতো না, তোমাকে ছাড়া সারাটা রাত
বেঁচে থাকাটা আর হতো না ।

মানুষগুলো সাপে কাটলে দৌড়ে পালায় ;
অথচ আমি সাপ দেখলে এগিয়ে যাই,
অবহেলায় মানুষ ভেবে জাপটে ধরি ।

যুদ্ধ

যুদ্ধ মানেই শত্রু শত্রু খেলা,
যুদ্ধ মানেই
আমার প্রতি তোমার অবহেলা৷

হুলিয়া

আমি যখন বাড়িতে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
শোঁ শোঁ করছে হাওয়া।
আমার শরীরের ছায়া ঘুরতে ঘুরতে ছায়াহীন
একটি রেখায় এসে দাঁড়িয়েছে৷

কেউ চিনতে পারেনি আমাকে,
ট্রেনে সিগারেট জ্বালাতে গিয়ে একজনের কাছ থেকে
আগুন চেয়ে নিয়েছিলুম, একজন মহকুমা স্টেশনে উঠেই
আমাকে জাপটে ধরতে চেয়েছিল, একজন পেছন থেকে
কাঁধে হাত রেখে চিত্কার করে উঠেছিল;- আমি সবাইকে
মানুষের সমিল চেহারার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছি৷
কেউ চিনতে পারেনি আমাকে, একজন রাজনৈতিক নেতা
তিনি কমিউনিস্ট ছিলেন, মুখোমুখি বসে দূর থেকে
বারবার চেয়ে দেখলেন-, কিন্তু চিনতে পারলেন না৷

বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি,
অথচ কী আশ্চর্য, পুনর্বার চিনি দিতে এসেও
রফিজ আমাকে চিনলো না৷
দীর্ঘ পাঁচ বছর পর পরিবর্তনহীন গ্রামে ফিরছি আমি৷
সেই একই ভাঙাপথ, একই কালোমাটির আল ধরে
গ্রামে ফেরা, আমি কতদিন পর গ্রামে ফিরছি৷

আমি যখন গ্রামে পৌঁছলুম তখন দুপুর,
আমার চতুর্দিকে চিকচিক করছে রোদ,
শোঁ-শোঁ করছে হাওয়া৷
অনেক বদলে গেছে বাড়িটা,
টিনের চাল থেকে শুরু করে পুকুরের জল,
ফুলের বাগান থেকে শুরু করে গরুর গোয়াল;
চিহ্নমাত্র শৈশবের স্মৃতি যেন নেই কোনখানে৷

পড়ার ঘরের বারান্দায় নুয়ে-পড়া বেলিফুলের গাছ থেকে
একটি লাউডুগী উত্তপ্ত দুপুরকে তার লক্লকে জিভ দেখালো৷
স্বতঃস্ফূর্ত মুখের দাড়ির মতো বাড়িটির চতুর্দিকে ঘাস, জঙ্গল,
গর্ত, আগাছার গাঢ় বন গড়ে উঠেছে অনায়াসে; যেন সবখানেই
সভ্যতাকে ব্যঙ্গ করে এখানে শাসন করছে গোঁয়ার প্রকৃতি৷
একটি শেয়াল একটি কুকুরের পাশে শুয়েছিল প্রায়,
আমাকে দেখেই পালালো একজন, একজন গন্ধ শুঁকে নিয়ে
আমাকে চিনতে চেষ্টা করলো- যেন পুলিশ-সমেত চেকার
তেজগাঁয় আমাকে চিনতে চেষ্টা করেছিল৷
হাঁটতে- হাঁটতে একটি গাছ দেখে থমকে দাঁড়ালাম,
অশোক গাছ, বাষট্টির ঝড়ে ভেঙ্গে যাওয়া অশোক,
একসময়ে কী ভীষন ছায়া দিতো এই গাছটা;
অনায়াসে দু’জন মানুষ মিশে থাকতে পারতো এর ছায়ায়৷
আমরা ভালোবাসার নামে একদিন সারারাত
এ-গাছের ছায়ায় লুকিয়ে ছিলুম৷
সেই বাসন্তী, আহা, সেই বাসন্তী এখন বিহারে,
ডাকাত স্বামীর ঘরে চার- সন্তানের জননী হয়েছে৷

পুকুরের জলে শব্দ উঠলো মাছের, আবার জিভ দেখালো সাপ,
শান্ত-স্থির-বোকা গ্রামকে কাঁপিয়ে দিয়ে
একটি এরোপ্লেন তখন উড়ে গেলো পশ্চিমে – -৷
আমি বাড়ির পেছন থেকে দরোজায় টোকা দিয়ে
ডাকলুম,— “মা’৷
বহুদিন যে-দরোজা খোলেনি,
বহুদিন যে দরোজায় কোন কন্ঠস্বর ছিল না,
মরচে-পরা সেই দরোজা মুহূর্তেই ক্যাচ্ক্যাচ শব্দ করে খুলে গেলো৷
বহুদিন চেষ্টা করেও যে গোয়েন্দা-বিভাগ আমাকে ধরতে পারেনি,
চৈত্রের উত্তপ্ত দুপুরে, অফুরন্ত হাওয়ার ভিতরে সেই আমি
কত সহজেই একটি আলিঙ্গনের কাছে বন্দী হয়ে গেলুম;
সেই আমি কত সহজেই মায়ের চোখে চোখ রেখে
একটি অবুঝ সন্তান হয়ে গেলুম৷

মা আমাকে ক্রন্দনসিক্ত একটি চুম্বনের মধ্যে
লুকিয়ে রেখে অনেক জঙ্গলের পথ অতিক্রম করে
পুকুরের জলে চাল ধুতে গেলেন; আমি ঘরের ভিতরে তাকালুম,
দেখলুম দু’ঘরের মাঝামাঝি যেখানে সিদ্ধিদাতা গণেশের ছবি ছিল,
সেখানে লেনিন, বাবার জমা- খরচের পাশে কার্ল মার্কস;
আলমিরার একটি ভাঙ্গা- কাচের অভাব পূরণ করছে
ক্রুপস্কায়ার ছেঁড়া ছবি৷

মা পুকুর থেকে ফিরছেন, সন্ধ্যায় মহকুমা শহর থেকে
ফিরবেন বাবা, তাঁর পিঠে সংসারের ব্যাগ ঝুলবে তেমনি৷
সেনবাড়ি থেকে খবর পেয়ে বৌদি আসবেন,
পুনর্বার বিয়ে করতে অনুরোধ করবেন আমাকে৷
খবর পেয়ে যশমাধব থেকে আসবে ন্যাপকর্মী ইয়াসিন,
তিন মাইল বিষ্টির পথ হেঁটে রসুলপুর থেকে আসবে আদিত্য৷
রাত্রে মারাত্মক অস্ত্র হাতে নিয়ে আমতলা থেকে আসবে আব্বাস৷
ওরা প্রত্যেকেই জিজ্ঞেস করবে ঢাকার খবর:
— আমাদের ভবিষ্যত্ কী?
— আইয়ুব খান এখন কোথায়?
— শেখ মুজিব কি ভুল করেছেন?
— আমার নামে কতদিন আর এরকম হুলিয়া ঝুলবে?

আমি কিছুই বলবো না৷
আমার মুখের দিকে চেয়ে থাকা সারি সারি চোখের ভিতরে
বাংলার বিভিন্ন ভবিষ্য়্ত্কে চেয়ে চেয়ে দেখবো৷
উত্কন্ঠিত চোখে চোখে নামবে কালো অন্ধকার, আমি চিত্কার করে
কন্ঠ থেকে অক্ষম বাসনার জ্বালা মুছে নিয়ে বলবো:
‘আমি এসবের কিছুই জানি না,
আমি এসবের কিছুই বুঝি না৷’

=======================
কবিতার রফিজকে স্মরণ করে কবি নির্মলেন্দু গুণের এই লেখাটিও অনেক জনপ্রিয়। প্রিয় পাঠকদের জন্য তুলে দিলামঃ

‘হুলিয়া’ কবিতার রফিজ আর নেইঃ – নির্মলেন্দু গুণ

একটানা দশ বছর দেশ শাসন করার পর, নিজেকে লৌহমানব বলে ঘোষণাকারী পাকিসত্মানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মুহম্মদ আইয়ুব খানের সিংহাসন তখন প্রলয়ঙ্করী ছাত্র-গণঅভু্যত্থানে ছিন্নভিন্ন৷ আইয়ুবের স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন ইয়াহিয়া খান নামে এক জেনারেল, যার চেহারা দেখে বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে যে অন্যদের না হলেও অনত্মত ঐ বীরপুঙ্গবের পূর্ব-পুরম্নষরা নিশ্চয়ই বানর ছিলো৷ ঐরকম একটা সময়ে আমি আমার ‘হুলিয়া’ কবিতাটি লিখি৷ প্রকাশিত হওয়ার পরপরই আমার ‘হুলিয়া’ কবিতাটি দ্রম্নত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তিমন্ত্রে উজ্জীবিত স্বাধিকারকামী বাঙালির রম্নদ্রপদভারে ঢাকার রাজপথ তখন নিশিদিন প্রকম্পিত হচ্ছে৷ রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের লৰে আয়োজিত বিভিন্ন দলের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে দেশের আবৃত্তিকাররা ঐ কবিতাটিকে আবৃত্তি করতে শুরম্ন করেন৷ আমি নিজেও সুযোগ পেলেই যত্রতত্র ঐ কবিতা পাঠ করি৷

তখন সবচেয়ে জনপ্রিয় কলাম ছিলো আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা ‘তৃতীয় মত’৷ পূর্বদেশ পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হতো৷ বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজনীতিক ও লেখক-সাংবাদিকের অবশ্যপাঠ্য ছিলো ঐ কলাম৷ সেই গাফফার ভাই জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র আয়োজিত একটি তরম্নণ কবিদের কবিতা পাঠের আসরে আমার কণ্ঠে হুলিয়া কবিতার আবৃত্তি শুনে খুশি হয়ে তাঁর ঐ জনপ্রিয় কলামে আমার কবিতাটি নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা করেন৷ তার ফলে কবিতাটি জনপ্রিয়তা লাভের পাশাপাশি রাজনৈতিক গুরম্নত্ব লাভ করে৷ গাফফার চৌধুরীর লেখা পড়ে (তৃতীয় মত: আবদুল গাফফার চৌধুরী, ২৪ জুলাই ১৯৭০) বঙ্গবন্ধু স্বয়ং ‘হুলিয়া’র কবির সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করেন৷

আমি তখন দৈনিক ‘পিপল’ পত্রিকায় কাজ করি৷ আমার জীবনের প্রথম সবেতন চাকুরি৷ বঙ্গবন্ধুর আগ্রহের কথা জেনে ‘পিপল’ পত্রিকার সম্পাদক আবিদুর রহমান তাঁর কাগজে কর্মরত ‘হুলিয়া’র কবিকে বঙ্গবন্ধুর কাছে নিয়ে যাবার দায়িত্ব নেন৷ ঐ কবিতায় একটি প্রশ্নবোধক পঙক্তি আছে-

‘শেখ মুজিব কি ভুল করছেন?’

জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরী আমার কবিতার ঐ পঙক্তিটি উদ্ধৃত করে তাঁর কলামে লিখেছিলেন, ‘ঃএ যেন বাংলার ৰুব্ধ তারম্নণ্যের স্বগতোক্তি৷ এই প্রশ্নের জবাবের চাইতে বড় সত্য এই মুহূর্তে জন-চেতনায় আর কিছু নেই৷’ আমার মনে হয়, বঙ্গবন্ধু তাঁর নেতৃত্ব সম্পর্কে আমাকে সংশয়মুক্ত করার জন্যই আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছিলেন৷ ব্যক্তিগতভাবে না চিনলেও তিনি আমাকে নামে জানতেন৷ ছয় দফাভিত্তিক স্বাধিকার আন্দোলন শুরম্ন করার অভিযোগে তিনি যখন আইয়ুবের কারাগারে বন্দি, তখন আমি তাঁকে নিয়ে একটি দীর্ঘ কবিতা লিখেছিলাম৷ কবিতাটির নাম ‘প্রচ্ছদের জন্য’৷ কবিতাটি ‘সংবাদ’-এ প্রকাশিত হয় ১৯৬৭ সালের ১২ নভেম্বর৷ কবিতাটি তাঁর হাতে পেঁৗছলে তিনি খুব খুশি হন৷ ওটাই ছিলো তাঁকে নিয়ে বাংলাদেশের কোনো কবির লেখা প্রথম কবিতা৷ তাই পরিচয় না হলেও, তাঁর মতো স্মৃতিধরের পৰে আমার নামটি তাঁর ভুলে যাবার কথা নয়৷ আমিও একদিন বঙ্গবন্ধুর কাছে যাবো বলে আবিদ ভাইকে কথা দিয়েছিলাম৷ কিন্তু সেই কথা রৰা করা সম্ভব হয়নি৷ তিনি রাজনীতি নিয়ে সঙ্গত কারণে, আর আমি আমার কবিতা নিয়ে অসঙ্গত অকারণে এতোটাই ব্যসত্ম হয়ে পড়েছিলাম যে, ২৫ মার্চের আগে আমি বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাবার সময় করে উঠতে পারিনি৷ কিন্তু তখন বড় বেশি দেরী হয়ে গিয়েছিলো৷ তাঁর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি৷ তিনি অন্দরমহলে আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের সঙ্গে দেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনায় ব্যসত্ম ছিলেন৷ প্রতিদিনের মতো বিকেলের পর সেদিন তিনি আর বাইরে আসেননি৷ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে চলতে থাকা আলোচনার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘোষণা না দিয়েই পাক-প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সঙ্গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন৷ আর ঐ রাতেই ভুট্টোর উপস্থিতিতে ঢাকায় শুরম্ন হয় অখণ্ড পাকিসত্মানের কফিনে শেষ পেরেক ঠোকা, পাকসেনাবাহিনীর ললাটে চিরকলঙ্ক লেপনকারী অপারেশন সার্চ লাইট অভিযান৷ আর সেই অভিযানের পটভূমিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে ঐ রাতেই স্বগৃহে পাকসেনাদের হাতে গ্রেফতার বরণ করেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব৷

ঐ মহাকাব্যিক উপাদানসমৃদ্ধ কবিতায় বর্ণিত অনেকগুলি চরিত্র রয়েছে৷ তার মধ্যে একটি চরিত্রের নাম হলো রফিজ৷ কবিতাটিতে তাঁর উপস্থিতি বর্ণিত হয়েছে এভাবে :

‘বারহাট্টায় নেমেই রফিজের স্টলে চা খেয়েছি৷

অথচ কী আশ্চর্য! পুনর্বার চিনি দিতে এসেও

রফিজ আমাকে চিনলো না৷’

‘হুলিয়া’ কবিতা নিয়ে বাংলাদেশে একাধিক চলচ্চিত্র ও দৃশ্যকাব্য তৈরি হয়েছে৷ তানভীর মোকাম্মেল পরিচালিত ‘হুলিয়া’ ছবিতে রফিজের চরিত্রে অনবদ্য অভিনয় করেছিলেন প্রখ্যাত অভিনেতা, নাট্যকার ও পরিচালক আতাউর রহমান৷ ঐ কবিতাটি ১৯৭০ সালে প্রকাশিত কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘পূর্ববাংলার শ্রেষ্ঠ কবিতা’ সংকলনে অনত্মর্ভুক্ত হওয়ার ফলে পশ্চিমবঙ্গেও কবিতাটি জনপ্রিয়তা লাভ করে৷ ১৯৭১ সালে আমি যখন কলকাতায় যাই তখন তার প্রমাণ পেয়েছিলাম৷ কবি শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের মাধ্যমে পরিচিত হওয়ার পর ‘হিন্দুসত্মান টাইমস’-এ কর্মরত প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক-গল্পকার নরেন্দ্রনাথ মিত্র ‘আনন্দবাজার’ পত্রিকা অফিসে বুকে জড়িয়ে ধরে আমাকে ঐ কবিতাটির জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন৷

আমি যখন ‘হুলিয়া’ লিখি, তখন আমাদের বারহাট্টা রেলস্টেশনে রফিজের একটি চায়ের স্টল ছিল৷ আমার হুলিয়া কবিতায় বর্ণিত রফিজ কোনো কাল্পনিক চরিত্র নয়৷ স্কুলে রফিজ আমার সহপাঠী ছিলো৷ সহপাঠী হলেও সমবয়সী নয়৷ পরীৰায় উপর্যুপরি ফেল করার কারণে রফিজ অনেকের মতো একসময় আমারও সহপাঠী হয়৷ কিন্তু তাঁর সঙ্গে আমার বয়সের বিসত্মর ফারাক ছিলো৷ স্কুলজীবনে ৭/৮ বছরের বড় হওয়াটা চাট্টিখানি কথা নয়৷ আমাদের সহপাঠী হলেও তাই আমরা তাঁকে শুধু বড় ভাই নয়, আমাদের শিৰকদের মতোই সমীহ করে চলতাম৷

শুধু ‘হুলিয়া’ কবিতা নয়, ‘আমার ছেলেবেলা’ ও ‘আমার কণ্ঠস্বর’ গ্রন্থে একটি গুরম্নত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে রফিজের প্রচুর উলেস্নখ আছে৷ সেখানে আমি রফিজকে আমার দেখা প্রথম স্বাধীন মানব হিসেবে বর্ণনা করেছি৷ তার সঙ্গত কারণও ছিলো৷ বছরের পর বছর পরীৰায় ফেল করার স্বাধীনতা ছিলো রফিজের৷ আর ফেল করা তো দূরের কথা, শতকরা ৬০ ভাগের নিচে নম্বর পাওয়ার স্বাধীনতাও তখন আমার ছিলো না৷ সেই রফিজের নেতৃত্বেই আরও অনেকের সঙ্গে আমি প্রথমবারের মতো বিনা টিকিটে বারহাট্টা থেকে মোহনগঞ্জ পর্যনত্ম রেল ভ্রমণের অভিজ্ঞতা লাভ করেছিলাম৷ (দ্র: আমার ছেলেবেলা)৷

এক পর্যায়ে পরীৰা পাশের অসম্ভব সংগ্রামে ইতি দিয়ে রফিজ তাঁর গোপালপুরের বাড়ি সংলগ্ন বারহাট্টা রেল স্টেশনে একটি চায়ের স্টল খুলে বসে৷ এমনিতেই রফিজের স্টলটি ভালো জমে উঠেছিলো৷ আমার হুলিয়া কবিতা প্রকাশের পর এলাকায় রফিজের চায়ের স্টলটির গুরম্নত্ব আরও বৃদ্ধি পায়৷ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে যারা বারহাট্টায় যেতেন, তাদের মধ্যে যারা কবিতামোদী ছিলেন, ‘হুলিয়া’ কবিতার সঙ্গে যাদের পরিচয় ছিলো, তাদের অনেকেই বারহাট্টা রেল স্টেশনে নেমে রফিজের স্টল ও তার মালিক রফিজের সন্ধান করতেন৷ ফলে আমার ‘হুলিয়া’ কবিতার কারণে ক্রমশ রফিজ আমাদের এলাকার একজন দর্শনীয় মানুষে পরিণত হন৷ ‘হুলিয়া’ সম্ভবত সবচেয়ে বেশি পঠিত সর্বকালের জনপ্রিয় বাংলা কবিতার একটি৷ ‘হুলিয়া’ সম্পর্কে আমার মনত্মব্যটি ভুল হলে বলবেন, লজ্জা করবেন না৷ ফলে ‘হুলিয়া’ কবিতার মতো রফিজও সারা দেশে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে৷

‘পুনর্বার চিনে দিতে এসেও রফিজ আমাকে চিনলো না’৷ হুলিয়া কবিতার এই পঙক্তিটি অবশ্য রফিজের জন্য খুব সুখের ছিলো না৷ আমার কবিতার ভক্তকুল ‘হুলিয়া’ কবিতার ঐ পঙক্তিটিকে আৰরিক অর্থে সত্য বলে ধরে নিয়ে রফিজের ওপর একবার চড়াও হয়েছিলো৷ আমাকে না চেনার কারণে রফিজকে খুব নাসত্মানাবুদ হতে হয়েছিলো৷ পরে অবশ্য আমার হসত্মৰেপে আমার কবিতার ভক্তকুল ও আমার প্রিয় বন্ধু রফিজের মধ্যে সৃষ্ট ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটে৷

রফিজ আমাকে নিয়ে সঙ্গতকারণেই খুব গর্ব করতো৷ আমাকে সে সর্বদা কবি বলে সম্বোধন করতো৷ স্ত্রী-কন্যা নিয়ে তাঁর দিনকাল ভালোই কাটছিলো৷ কিন্তু অতিরিক্ত মদ্যপানের বদভ্যাসের কারণে তাঁর জীবনে ক্রমশ দুঃসময় নেমে আসে৷ তদুপরি রেলপথের গুরম্নত্ব বাসপথের কাছে যখন ক্রমশ মার খেতে থাকে, তখন রফিজ এক পর্যায়ে তার টায়ের স্টলটি বিক্রি করে দিয়ে ময়মনসিংহ শহরে চলে যায় এবং ময়মনসিংহ রেলস্টেশনে একটি গলায় ঝুলানো ভ্রাম্যমান পানবিড়ির দোকান চালু করে৷ কোনোমতে কষ্টেসৃষ্টে তার দিন কাটে৷

অনেকদিন রফিজের সঙ্গে বিচ্ছিন্ন থাকার পর, ২০০০ সালের কোনো একদিন অনেক খুঁজে আমি এক সন্ধ্যায় ময়মনসিংহ রেল স্টেশনে গিয়ে রফিজকে আবিষ্কার করি৷ তাঁকে দেখে আমার খুব কষ্ট হয়৷ নানাবিধ অসুখে ভুগে তাঁর স্বাস্থ্য তখন খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিলো৷ আমার এক ছাত্র (১৯৬৪ সালে আইএসসি পরীৰা দেয়ার পর ফল বেরম্ননোর আগ পর্যনত্ম আমি কিছুদিন বারহাট্টা স্কুলে মাস্টারি করেছিলাম) ময়েজউদ্দিন তখন ময়মনসিংহের জেলা প্রশাসক৷ আমি তাঁর মাধ্যমে রফিজকে কিছু আর্থিক সাহায্য প্রদানের ব্যবস্থা করেছিলাম৷ জেলা প্রশাসক ময়েজউদ্দিন তাঁকে কিছু কাজ এবং আর্থিক সাহায্য দেয়ার প্রতিশ্রম্নতি দিয়েছিলো কিন্তু জোট সরকার ৰমতায় এসেই মুক্তিযোদ্ধা জেলা প্রশাসক ময়েজউদ্দিনকে গুরম্নত্বহীন পদে বদলি করে দিলে ময়মনসিংহের মুক্তিযুদ্ধের পৰশক্তি ও আমার বন্ধু রফিজ খুব ৰতিগ্রসত্ম হয়৷

তারপর থেকে অনেকদিন আমি রফিজের কোনো খবর রাখি না৷ গ্রামেও যাওয়া হয় না৷ এবার দুর্গা পূজার সময় প্রায় বিশ বছর পর আমার গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম৷ তখন রফিজ গ্রামের বাড়িতে আছে বলে লোকমুখে শুনেছিলাম৷ এও শুনেছিলাম যে সে খুব অসুস্থ৷ কিন্তু পথে পথে মানুষজনের আবদার রৰা করতে গিয়ে ঢাকায় ফেরার পথে রফিজের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ গ্রহণ করিনি৷ ভুলে গিয়েছিলাম৷ যদিও রফিজের বাড়ির কাছ দিয়েই আমি রিকশায় গিয়েছি৷ সেদিন আমাকে কেউ রফিজের কথা কেন যে মনে করিয়ে দেয়নি?

মা দুর্গাকে বিসর্জন দিয়ে ঢাকায় ফিরে আসার দু’দিনের মাথায় আমার ছোটো ভাই আমাকে ফোন করে রফিজের মৃতু্যসংবাদ জানালে আমি শুধু কষ্ট নয়, তাঁর সঙ্গে শেষ-দেখার সুযোগটি চোখের খুব কাছে পেয়েও গ্রহণ করতে না পারার বেদনায়, অপরাধবোধে জর্জরিত হতে থাকি৷ ২৭ নভেম্বর ২০০৭, মঙ্গলবার সকাল ১০-৪০ মি. ‘হুলিয়া’ কবিতা-খ্যাত আমার বন্ধু রফিজ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে এই পৃথিবী থেকে চিরবিদায় নেয়৷

আমি অত্যনত্ম বেদনার্ত হৃদয়ে এই রচনার মাধ্যমে রফিজের রম্নহের মাগফিরাত কামনা করছি৷ তাঁর প্রিয়পরিজন, বন্ধু-শুভানুধ্যায়ী ও পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানাচ্ছি৷ বিদায় বন্ধু! বিদায়৷ আমাকে তুমি ৰমা করো৷

গল্পের বিষয়:
কবিতা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত