শ্বাশ্বত গল্প

শ্বাশ্বত গল্প

“শ্বাশ্বত গল্পকথা” নামকরণের কারণ হলো আমরা এমন কিছু গল্প আপনাদের উপহার দেবো, যেগুলো কালের দীর্ঘ পরিক্রমায় আজো অম্লান রয়ে গেছে এবং থাকবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এসব গল্প কালজয়ী কবি সাহিত্যিকদের কথা কিংবা কবিতা অবলম্বনে গৃহীত হয়েছে। জীবন ঘনিষ্ঠ এসব গল্প মানব জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে বারবার ঘুরে ফিরে আসে এবং শিক্ষা দিয়ে যায় গতিপথ নির্ধারণের। যে সব কবি সাহিত্যিক মৃত্যুর মধ্য দিয়ে ক্ষণস্থায়ী এ জীবনের ওপারে অনন্ত জীবনের অধিবাসী হয়েও আমাদের জীবন চলার দিক নির্দেশক হয়ে আছেন আজো, তাদের প্রতি রইলো অমাদের অকৃত্রিম শ্রদ্ধা ও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা। আপনারা যারা এসব গল্প পড়বেন তাঁরা যদি এসব গল্প পড়ে জীবনের গতিপথ নির্ধারণ করতে সামান্যতম হলেও সক্ষম হন কিংবা জীবনের চড়াই উৎরাইকালে সঠিকভাবে স্টিয়ারিং ধরতে শেখেন তাহলেই আমাদের শ্রম সার্থক বলে মনে করবো। ধ্রুপদী এই গল্পগুলো অমর মনীষীদের বিশাল সাহিত্য ভাণ্ডার থেকে সংকলন করেছেন বিশিষ্ট গবেষক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মিস আফসুনে কানভারি। আর অসম্ভব মেধার পরিচয় দিয়ে এগুলো সম্পাদনা করেছেন বিশিষ্ট গবেষক ও প্রশাসক ইরানের জাতীয় সম্প্রচার সংস্থার পূর্ব এশিয়া ও উপমহাদেশের শ্রদ্ধেয় মহাপরিচালক জনাব আলি সাকিয়ন। ধৈর্যের সাথে কষ্ট করে সময় দেওয়ার জন্যে আপনাদের অনেক অনেক ধন্যবাদ।–অনুবাদক

‘পরিমিতি’

অনেক অনেক দিন আগের কথা। অভাবগ্রস্ত ছোট্ট একটি পরিবার। অনেকেই বলে থাকেন অভাবে নাকি মানুষের স্বভাব নষ্ট হয়। কিন্তু স্বভাবের কারণেও যে মানুষ জীবন সংসারে অভাব ডেকে আনে, সে কথা ভাবতে শেখায় এই পরিবারের কর্তা ব্যক্তি। লোকটি ছিল একেবারেই কিপ্টে, যাকে বলে হাড়কিপ্টে। হাড়কিপ্টে হলো তারাই যাদের অঢেল সম্পদ থাকার পরও শুধু ‘নাই নাই কিচ্ছু নাই নাই’ করে আর সেটা বোঝানোর জন্যে তারা ফকিরের মতো চলাফেরা করে। পয়সা খরচ হয়ে যাবে- এই চিন্তায় তারা ভালো কিছু খায় না, সুন্দর কিছু পরেও না। দিন রাত কেবল পয়সার ওপরে পয়সার কয়েন রেখে কয়েনের টাওয়ার বানানো যায় কীভাবে- সে চিন্তাতেই মগ্ন থাকে। খালি টাকা পয়সা জমায়। এই পরিবারের কর্তা লোকটিও ছিল ঠিক সে রকম। পয়সা খরচ না করার অজুহাত হিসেবে সে নিজেকে বোঝাতোঃ ‘খরচ করলে তো ফকির হয়ে যাবো, অভাব অনটনে ভুগতে হবে। পরে মানুষের কাছে হাত পাততে হতে পারে। আমি চাই না অভাবের কারণে কারো কাছে হাত পাতি। আমি দরিদ্র, আমি ফকির এটা কেউ মনে করুক- তা আমি চাই না।’ লোকটার এই চিন্তাটাকে একেবারে খারাপ বলা যেত না, যদিনা তার বউ ছেলে মেয়েকে অসম্ভব কষ্টে দিন কাটাতে হতো। তার পরিবারের সদস্যরা যতোই তাকে একটু সুন্দর জীবন, একটু আরামের জীবন যাপনের কথা বলতো, একটা ভালো কিছু কিনতে চাইতো, মজার কিছু খেতে চাইতো, কিছুতেই তার মন গলতো না। তার কানে কোনো কথাই তোলা যেত না। স্ত্রী ছেলে মেয়ে যা-ই বলতো, তাদের কথা তার এক কান দিয়ে ঢুকে আরেক কান দিয়ে বেরিয়ে যেত, মাথায় ঢুকতো না। তার খালি দিন রাত একটাই ছিল চিন্তা, একটাই ছিল ভাবনা কী করে আরো বেশি টাকা জমানো যায়।

এক রাতে ঘটে গেলো অপ্রত্যাশিত এক ঘটনা।

সবাই ঘুমিয়ে পড়লো। লোকটার বড়ো ছেলেটা শুয়ে পড়লেও তার কিন্তু ঘুম এলো না। লোকটা ভেবেছিল ছেলে তো ঘুমিয়ে পড়েছে। সে আস্তে আস্তে পা টিপে টিপে ঘরের দরোজা খুলে বেরিয়ে পড়লো। ছেলেটার খুব কৌতূহল সৃষ্টি হলো। সেও আস্তে করে উঠে পড়লো। দরোজা দিয়ে বেরিয়ে বাবা কী করে কোথায় যায় লুকিয়ে লুকিয়ে দেখতে লাগলো। লোকটা তার ঘরের পেছনে রাখা ময়লার স্তুপের কাছে গেল। ছেলেও নিঃশব্দে বাবার পেছনে পেছনে গিয়ে লুকিয়ে থাকলো। বাবা এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখলো কেউ তাকে দেখছে কিনা। যখন নিশ্চিত হলো যে কেউ দেখছে না, তখন মাটির ওপর থেকে একটা কাঠের টুকরো সরালো। কাঠ সরিয়ে মাটি খুঁড়তে শুরু করলো। খোঁড়াখুঁড়ি শেষে মাটির নিচ থেকে একটা কলসি বের করলো। কলসিতে টাকা বা মুদ্রার কিছু কয়েন রাখলো এবং কলসির মুখটা বন্ধ করলো। তারপর কলসিটাকে গর্তে পুঁতে রেখে মাটি দিয়ে আবার ঢেকে রাখলো। ছেলে লুকিয়ে লুকিয়ে বাবার জমানো গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে গেল। মনে মনে বললোঃ “হায়রে দুনিয়া পূজারি, হায়রে হাড়কিপটা! তুমি তোমার টাকা পয়সা মাটির নিচে লুকিয়ে রেখে আমাদেরকে বলো তোমার হাতে টাকা পয়সা নাই, আর দুঃখিনী মা না খেয়ে না দেয়ে কী কষ্টেই না দিন কাটাচ্ছে। হায়রে বেচারা মা আমার! ক্ষুধা পেটে নিয়ে ছেলে মেয়েদের না খাওয়াতে পেরে কান্নাকাটি করতে করতে ঘুমায়। ছেলে মেয়েরাও না খেয়ে ঘুমায়। আর আমার কৃপণ বাবা টাকা খরচ না করে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখে। তোমাকে এমন শিক্ষা দেবোরে বাবা! জীবনে আর কোনোদিন টাকা লুকানোর চিন্তাই করবে না।” এইসব ভেবে চিন্তে ছেলে তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে গেল। ঘরে গিয়েই বাবা যাতে বুঝতে না পারে সেভাবে বাবার আগেই তাড়াতাড়ি বিছানায় গিয়ে শুয়ে পড়লো। একটু পরেই বাবা ঘরে ফিরে এলো এবং বিছানায় গিয়ে নিশ্চিন্ত মনে ঘুমিয়ে পড়লো। এমন ঘুম দিলো একেবারে নাক ডেকে। ছেলে যখন বুঝতে পারলো বাবা গভীর ঘুমে অচেতন, তখন বিছানা থেকে উঠে পা টিপে টিপে ঘর থেকে বেরিয়ে পড়লো। দ্রুত চলে গেল মাটির নিচে লুকানো টাকা পয়সা ভর্তি কলসির কাছে। মাটি খুঁড়ে কলসি বের করে আনলো। কলসির জায়গায় পাথর একটা রাখলো। এরপর এমনভাবে ঢেকে দিলো যেন দেখতে আগের মতোই মনে হয়। কলসির মুখ খুলে তো ছেলের চোখ ছানাবড়া। সে ভেবেছিল কলসিতে হয়তো মুদ্রার কিছু কয়েন থাকবে। কিন্তু না, কলসির ভেতর কয়েনের সাথে সোনা রূপাও ভরা। ছেলে এগুলো দেখে তো একদম ক্ষেপে গেল। মনে মনে ভাবলো বাবা তো নিশ্চয়ই শিগিগিরই জেনে যাবে ব্যাপারটা। সেজন্যে সিদ্ধান্ত নিলো সকল স্বর্ণ গয়না টাকা পয়সা দ্রুত খরচ করে ফেলবে। এইসব ভেবেচিন্তে সে ঘরে গিয়ে আগের মতোই ঘুমিয়ে পড়লো। পরদিন সে ঘরের জন্যে আসবাবপত্র, বাসন কোসন ইত্যাদি কিনলো। আর নিজের জন্যে, মায়ের জন্যে, বাবার জন্যে, ভাইবোনদের জন্যেও নতুন নতুন জামা কাপড় কিনলো।

বাবা এই অবস্থা দেখে ভেবেছিলো ছেলে বুঝি নতুন কোনো কাজকর্ম শুরু করেছে, বেতন টেতনও ভালেই পাচ্ছে। মনে মনে খুশিই হলো। ছেলের আনা ভালো ভালো এবং মজার মজার খাবার দাবার মনের আনন্দে খেতে লাগলো। বাবা দীর্ঘকাল ধরে যেসব সম্পদ জমিয়েছিল ছেলে অল্প কদিনের মধ্যেই সেসব খরচ করে ফেললো।

কিছুদিনের মধ্যেই বাবা আবারো তার রাতের কাজটি করতে গিয়ে বুঝে ফেললো ছেলের কারসাজি। দীর্ঘশ্বাসসহ একটি ‘আহ’ ধ্বনি বেরিয়ে এলো তার পোড়া বুকের গভীর থেকে। বাসায় ফিরে গিয়ে দেখলো তার ছেলে বিছানায় বসে আছে। মনে হচ্ছে যেন বাবার আগমনের প্রতীক্ষায় বসে আছে। কীভাবে বাবা আহাজারি করে দেখতে চায় সে। কিন্তু বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হয় নি। বাবার চীৎকার চেঁচামেচি শুনে সে দেখবে কি নিজেই হতভম্ব হয়ে গেল। সে কি চীৎকার। কিন্তু তাতে কোনো লাভ তো নেই, ততোক্ষণে সব তো খরচই হয়ে গেছে। ছেলে টু-শব্দটি না করে শুয়ে পড়লো। পরদিন সকালে ছেলে বাবাকে বললোঃ বাবা! নিজেকে কেন শুধু শুধু কষ্ট দিচ্ছো। এই কটা দিন তুমি কি একটু হলেও ভালোভাবে কাটাও নি। আমি যে তোমার টাকাগুলো খরচ করে ভালো ভালো খাবার দাবারের আয়োজন করলাম, তোমার কি ভালো লাগে নি। খাবারগুলো মজা লাগে নি! আমরা তো সারাজীবনে এতো মজার খাবার খাই নি কোনোদিন। তুমি এতো কষ্ট করে নিজের পেটকে কষ্ট দিয়ে, আমাদেরকে কিচ্ছু না খাইয়ে না দাইয়ে খামোখা কার জন্যে টাকা-পয়সা জমাচ্ছো। টাকা পয়সা থেকেও কেন নিজেকে, নিজের ফ্যামেলিকে কষ্ট দিচ্ছো? আমি তোমার টাকা-পয়সা, গয়নাগাটি ভর্তি কলসির জায়গায় পাথর একটা বসিয়ে রেখেছি। মনে করো ঐ পাথরটাই তোমার সেই কলসি। তুমি তো খরচ করতে চাও নি, তাই ঐ সোনার কলসি আর পাথরের মাঝে তো কোনো পার্থক্য নেই তোমার জন্যে।

কৃপণ বাবা সারা জীবনের অর্জন হারিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লো। ছেলে বাবার কান্নাকাটি দেখে বললোঃ বাবা ! তুমি তোমার টাকাপয়সা খরচ না করে এভাবে জমাতে জমাতে হঠাৎ যদি মরে যেতে, আমাদেরকে তো বলে যাবারও সুযোগ পেতে না যে অমুক জায়গায় তমুক জিনিসটা আছে। একবারও কি ভেবেছো তখন কী লাভ হতো! সোনার কলসিতে তোমার জমানো সম্পদ পঁচে যেত। না নিজে খেতে, না আমাদের নসিবে হতো। ধরে নিলাম আমাদেরকে বলে যেতে পারতে, তাতে তোমার কী লাভটা হতো। উল্টো বরং তোমার মৃত্যুতে সবাই খুশি হতো সোনাদানার সন্ধান পেয়ে। বাবা আমার! এ কাজটা করো না দয়া করে! প্রত্যেক কাজেই পরিমিতি আর ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করো।

বাবা ছেলের কথাগুলো শুনে নিজের ভুল বুঝতে পারলো। ছেলের জন্যে গর্বে তাঁর অশ্রুসজল চোখেও ফুটে উঠলো আনন্দের মুচকি হাঁসি। অস্ফুট কণ্ঠে শুধু বললোঃ “আমার সারাজীবনের সঞ্চয় কদিনেই শেষ করে দিয়ে তুমিও কি ভারসাম্যহীন কাজ করো নি।”

ছেলে মাথাটা নুইয়ে রাখলো।

গল্পের বিষয়:
শিক্ষনীয় গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত