ভাগ্যের পরিবর্তন

ভাগ্যের পরিবর্তন

শ্রাবণের বিকেল। টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। সোজা বাংলায় যাকে ইলশেগুঁড়ি বলে। ইলশেগুঁড়ি আমার ভালোই লাগে,, মনে হয় কৃত্রিম কোনো ঝর্ণার নিচে দাড়িয়ে আছি।

কিন্তু আজকে কোনোপ্রকার অনুভূতি কাজ করছে না। কারণ হয়ত আড়াই হাজার টাকা। সন্ধ্যার মধ্যেই আড়াই হাজার টাকা দরকার, অথচ আমার হাতে আড়াই টাকাও নাই।

হাতে টাকা না থাকলে পৃথিবীর সব অমৃতও পানসে লাগে। সেখানে আর নতুন করে বৃষ্টির জলের দরকার হয় না।
হোস্টেল থেকে বেড় হয়ে সামনে এগুতেই একটা রিকসা পেলাম। রিকসায় উঠতে যাবো হঠাৎ মনে হলো পার্সে কুড়ি টাকার একটা নোট একটা

এয়ারটেল সীম আর একটা টিটি টিকার কার্ড ছাড়া আর কিছুই নেই। রুমমেট এর কাছ থেকে ধার করা এই কুড়ি টাকাই আজকের সম্বল।

বিপদআপদ এর কথা তো বলা যায় না তাই ফোন কানে নিয়ে ব্যস্ততার ভঙ্গি দেখিয়ে রিকশাওয়ালা বললাম, ‘মামা, আপনি যান। আমার সামনে একটু কাজ আছে’।
রিকশাওয়ালা খানিকটা বিরক্ত হয়ে বিরবির করে কি যে বলে চলে গেল। যাক গে উনি কি বলে বলুক সেটাতে কান দিয়ে লাভ নেই_ এই বলে নিজেকে বুঝিয়ে হাটা শুরু করলাম।

প্রায় ২০মিনিট হাটার পর আমার ছাত্রীর বাসায় পৌছলাম। দোতলায় উঠে কলিংবেল চাপতে যাবো এমন সময় দেখি দরজায় ইয়া বড় একটা তালা ঝুলছে।

তালাটা আদৌ ইয়া বড় না কিন্তু আমার কাছে মনে হচ্ছে বিশ্বের সবথেকে বড় তালাটাই এখানে কেউ ঝুলিয়ে দিয়েছে। ধপ করে সিড়ির মধ্যে বসে পড়লাম।

ফোন দিলাম ছাত্রীর আম্মুর নাম্বারে। পরপর কয়েকবার রিং হবার পর ফোন রিসিভ করলেন ছাত্রীর আম্মু রোজিনা খানম।
‘আসসালামু আলাইকুম আন্টি।
‘ওয়ালাইকুমুসসালাম। কী খবর তোমার’?
‘জ্বি আন্টি একটু সমস্যায় আছি। যদি টিউশনির টাকাটা একটু দিতেন তাহলে ভালো হতো আন্টি। খুব দর…’
কথাটা আর শেষ করতে দিলেন না।
‘আমি তো তন্বী আর তাজিম কে নিয়ে ওদের দাদুর বাসায় এসেছি মা’
‘আচ্ছা। কবে আসবেন আন্টি’।
‘এইতো মা, রবিবার যাবো’।
কথাটা শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল। আমার টাকা দরকার এখন আর উনি দিবেন রবিবার!
‘আচ্ছা’ বলে ফোনটা রেখে দিলাম।
.

রাস্তায় হাটছি। সাথে কুড়ি টাকার একটা কচকচে নোট। এখন এই আড়াই হাজার টাকা কোথায় গেলে পাবো ঠিক ভেবে পাচ্ছি না।

এদিকে মিলি বলে দিয়েছে আজকের মধ্যেই ওর টাকাটা লাগবে। একটা বিশেষ প্রয়োজনে টাকাগুলো নিয়েছিলাম ওর কাছ থেকে।

কিন্তু ধার নিয়ে যাকে দিয়েছি সেই প্রেমিক; আমার সেই ভালোবাসার মানুষটা আমাকে ছেড়ে গেছে প্রায় দেড় মাস হলো। এখন সে অন্য কারো স্বপ্নে বিভোর।

এখন অবশ্য ওসব ভেবে আর মন খারাপ হয় না। মধ্যবিত্ত মেয়েদের সপ্ন দেখেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। তারা ছোট বেলা থেকেই দু’টো শব্দের সাথে পরিচিত আর তা হলো অশান্ত আশা, অপ্রাপ্তি। অবশ্য আমি একটু বেশিই পরিচিত এই শব্দ দু’টোর সাথে। তাই ওসব ব্রেকাপ-ট্রেকাপে খুব একটা কষ্ট হয় না। বরং মনে হয় এটা তো হবারই ছিল।যাক সেসব কথা।

এখন ধার যেহেতু করেছি সেহেতু শোধ তো করতেই হবে। কারো কাছ থেকে ধার নিয়ে যে ধার শোধ করবো সে উপায়ও নেই।

যেদিকে তাকাই সেদিকেই দেখি সবাই অভাবের সাগরে হাবুডুবু খাচ্ছে। আচমকাই মামাতো বোন শাম্মীর কথা মনে পড়ল।
খানিকটা আশার আলো খুঁজে পেলাম ; এবার কিছু একটা উপায় হলেও হতে পারে। সাত-পাঁচ না ভেবে মামার বাসার দিকে হাটা ধরলাম।
মামা-মামী মারা গেছে মাস ছয়েক আগে। মামী মারা যাবার তিন মাসের মাথায় মামাও চলে গেলেন। মামা-মামীর ভালোবাসা দেখে আমরা সবাই হিংসে করতাম।

সত্যি বলতে তাদের দুজনের এমন ভালোবাসা সদ্য বিয়ে হওয়া দম্পতির মাঝেও আমি দেখিনি। তাই আল্লাহ হয়ত দু’জনকে বেশিদিন আলাদা রাখতে চাননি।
প্রায় পাঁচ মিনিট পর বাসার সামনে আসলাম। বাসায় ঢুকতে যাবো এমন সময় গ্রামের বাড়ির এক ভাবীর সাথে দেখা। আমাকে দেখার সাথে সাথে ভাবী চিল্লায়ে উঠলেন,
‘কিরে চৈতি, চৈতি না?’
হিজাবে মুখ ঢাকা থাকায় ভাবী হয়ত একটু দোটানায় পড়েছিলেন।
আমি মুখে হাসি টেনে বললাম,
হ্যাঁ চৈতি। আপনি হঠাৎ এখানে কেন ভাবী?
ক্লিনিকে আসছি, সুমির(উনার মেয়ে) সিজার হইছে আপডেট কেয়ারে। তা.. তুই কি মামার বাসায় আসলি?
আমি হ্যাঁ সূচক মাথা নেড়ে বললাম শাম্মীর সাথে একটু দরকার ছিল।
‘দরকার ছিল! গিয়ে দ্যাখ বাসায় নাই কেউ।আমি ফেরত আসলাম’। বলে ভাবী চলে গেল।
আমি স্তব্ধ হয়ে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। আসলে সত্যিই অভাগী যেদিকে যায় সাগর শুকায়। বাবা মা উপার্জনক্ষম, বড় ভাই নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত।

টাকার প্রয়োজন হলে তিনহাজার, দেয় দেড়হাজার। দিয়ে বলে কষ্ট করে মাসটা চালায়ে নিস। কষ্ট করে চালাতে গিয়েও মাসে দেড় দু’হাজার ধার পড়ে যায়।

ভাবীর ভাষায় আমি নাকি টাকা গিলি। তাই ভাইয়ার কাছেও আর টাকা চাইতে ইচ্ছে করে না। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে একটা টিউশনি পাইলাম তাও আবার ঠিকমতো টাকা দেয় না।
শাম্মীকে ফোন দিয়ে জানতে পারলাম ও কোচিং-এ গেছে। ফিরবে সন্ধ্যায়। যাহোক এই সময়টুকু ছাদে কাটিয়ে দিই।
আস্তে আস্তে সিড়ি বেয়ে ছাদে উঠলাম। ছাদের খোলা হাওয়া আর মাথার উপরে শত শত কাকের কা কা চিৎকার। মন ভালো হবার মতো একটা পরিবেশ।

এখন বৃষ্টি নেই তবে আকাশে মেঘ জমে আছে। ছাদে বসে গুনগুন করে গান গাইতে লাগলাম আর এই ছাদটাকে ঘিরে পুরনো দিনের কথাগুলো মনে পড়তে লাগলো।

এভাবে দেড় ঘন্টা কাটিয়ে দেওয়ার পরও শাম্মী আসলো না। আবার ফোন দিলাম। এবার সত্যি কান্না পেল।

এতক্ষণ অপেক্ষা করার পর যদি কেউ শুনতে পায় যার জন্য অপেক্ষা করা হচ্ছে সে আসবে না। সে আবার তার মামার বাসায় গেছে। তাহলে তো খারাপ লাগারই কথা।
.

আনমনে হাটছি। উদ্দেশ্য হোস্টেল। আকাশটা মোটামুটি পরিষ্কার। কিছুক্ষণের মধ্যেই সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসবে। রুমে ঢোকার পর কিভাবে রুমমেটকে বুঝাবো মনে মনে রিহ্যার্সেল করতে লাগলাম। তবে আজ রুমমেটের অপমান সহ্য করতে হবে একপ্রকার নিশ্চিত। তাই অপমান সহ্য করার মানসিক প্রস্তুতি নিতে লাগলাম। চোখ ফেঁটে জল আসতে চাচ্ছে।

বারবার নিজের ভাগ্যকে দোষ দিচ্ছি। একটু উচ্চবিত্ত ঘরে পাঠালে তার কি খুব ক্ষতি হতো_

এভাবে আল্লাহকে দোষারোপ করতেছি আর চোখ দিয়ে টপটপ করে জল গড়িয়ে গালে এসে নিকাবটাকে ভিজিয়ে দিচ্ছে।
‘আসসালামুআলাইকুম’ আম্মার বয়েসী এক ভদ্রমহিলাকে দেখতে পেলাম সালাম দিয়ে পাশ কাটিয়ে চলে যাচ্ছে।

সত্যি এতটাই আনমনে হয়ে পড়েছি যে পাশ দিয়ে কেউ যাচ্ছে কি না সে খেয়ালও নেই। হঠাৎ বুঝতে পারলাম না আমার কি হলো।

দৌড় দিয়ে আন্টিটার কাছে গিয়ে বললে লাগলাম, ‘আন্টি আমার উপর কখনো রহমত বর্ষিত হবে না। বরং আপনি বলুন তোমার উপর গজব বর্ষিত হোক’।
ঘটনার আকস্মিকতায় উনি হয়ত হতবাক হয়ে পড়েছিলেন। পাগল না হলে অপরিচিত কাউকে এভাবে বলার কথা না। ‘
নিজেকে সামলে নিতে তার কয়েক সেকেন্ড সময় লাগলো। তারপর তিনি বললেন, ‘মা, তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি কাঁদছো।

তোমার চলার ধরন, নিকাব পড়ার ধরন দেখে মনে হচ্ছে তুমি ভদ্র ঘরের মেয়ে। কিন্তু মা, তুমি হয়ত কোনো কারণে বিচলিত, চিন্তিত।

শোনো মা, কারণ যাই হোক না কেন অন্তরে হতাসা রাখা কাফিরের পরিচয়। শারীরিক, মানসিক, অর্থনৈতিক যে কোনো কারণ হোক না কেন হতাস হয়ো না মা।

সবসময় তোমার থেকে নিচের দিকে তাকাবে, তাহলে দেখবে তুমি তাদের থেকে অনেক অনেক ভালো আছো।’ একনাগারে কথাগুলো বলার পর থামলেন অপরিচিতা আন্টি।

কেন জানিনা উনার কথাগুলো আমি সম্মোহিত হয়ে শুনছিলাম। উনার কথাগুলোর কোনো জবাব দিতে পারলাম না।
‘নাম কী তোমার মা?’
আমি নাম, কোথায় থাকি সব বললাম। উনি একটা ঠিকানা ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
‘প্রতি শুক্রবার এখানে তালিম করি আমরা। ইসলামী বৈঠক। যদি সময় পাও তো এসো’। বলেই সালাম দিয়ে তিনি চলে গেলেন।

আমি কার্ডটা হাতে নিয়ে উনার গমন পথে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলাম।
.
আমি হাটছি আর ঐ আন্টির কথাগুলো ভাবছি। মনটা একটু হলেও হালকা লাগছে।

সত্যিই আমরা দ্বীনের পথ থেকে এতটাই সরে এসেছি যে সামান্য বিষয়েও অনেক বিচলিত হয়ে নিজের ভাগ্যকে গালাগাল দিই। আল্লাহ তো সংগ্রামী মানুষকে পছন্দ করেন।

তাই ইচ্ছে করেই কষ্ট দিয়ে ধৈর্যের পরীক্ষা নেন। অথচ না বুঝেই হতাস হয়ে পড়ি আর এটার নাম দিই ডিপ্রেশন।
নাহ, আজকে থেকে পরিবর্তন হতে হবে। সত্যিই পরিবর্তন হওয়াটা খুব জরুরী। অজান্তেই হাতের মুঠিটা শক্ত হয়ে আসলো।

হাটছি দ্রুত,, হাতে একটা পার্স, একটা কুড়ি টাকার কচকচে নোট, একটা এয়ারটেল সীম আর একরাশ প্রশান্তি……….।

গল্পের বিষয়:
শিক্ষনীয় গল্প
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত