একটি মিথ্যে স্বপ্ন ও তার আকুতি

একটি মিথ্যে স্বপ্ন ও তার আকুতি

রাত শেষে পৃথিবীকে সর্বলোকে দৃশ্যমান করার মত পর্যাপ্ত আলো পুবের আকাশটা এখনো ছড়ায় নি।বাইরে তাকালে কিছুই স্পষ্ট দেখা যায় না।আবছা অন্ধকারের রেশ এখনো রাতের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে।ইকরিটা ইদানিং বড্ড দুষ্ট হইছে।রাত আর প্রভাতের মাঝামাঝি একটা সময় আছে যখন ঘুমটা বেশ গভীর হয়।আর এই সময়টাতেই ইকরির চিল্লাচিল্লিতে বাসার সবার ঘুমের বারোটা বাজে।মাস চারেক আগে বড় ভাইয়া একটা টিয়া পাখি কিনছে,পাখিটা খুব সুন্দর করে কথা বলতে পারে। আমার পিচ্চি বোনটা আদর করে ওটার নাম রাখছে ইকরি।ওর ধারনা পাখিটা নাকি সিসিমপুরের ইকরির মত কথা বলে।আজও ইকরির চিল্লানিতেই ঘুমটা ভেঙে গেল।

বেশ কিছুক্ষন ধরে চোখের পাতাযুগলের উপর জবরদস্তি চালালাম কিন্তু তারা তীব্র প্রতিবাদ জানালো।তাই খানিকটা বাধ্য হয়েই বিছানা ছাড়লাম।ধীর পায়ে হেঁটে গেলাম ইকরির কাছে,ডাইনিং রুমের পাশের বারান্দায়।আমাদের বাসার সবচেয়ে সুন্দর জায়গা এটা।এখান থেকে সামনে যতদূর চোখ যায় বিস্তৃত মাঠ………
আর সেখানে সবুজের ছড়াছড়ি,মনে হয় যেন বিশাল একটা সবুজ চাদর বিছানো হয়েছে।কতক্ষন তাকিয়ে আছি মনে নেই।কড়া রোদের ঝিলিকের উষ্ণ পরশ আমাকে সম্বিত ফিরিয়ে দিল।হঠাত্‍ করেই পাশের বিল্ডিংয়ে দৃষ্টিটা যাত্রা বিরতি দিল।

বিল্ডিংটা প্রতিদিনই দেখি,নতুন কিছু নয়।তবে যা দেখে দৃষ্টি থমকে দাঁড়াল তা হল,বিল্ডিংটার বারান্দায় একটা লম্বামত ছেলে একটা পিচ্চিকে কি যেন দেখাচ্ছে। কি আর হবে আকাশ হয়ত!এটা আজব কোন দৃশ্য নয়,তবুও এত মনোরম ছিল দৃশ্যটা!

হঠাত্‍ই হারিয়ে গেলাম আমার নিজস্ব কল্পনার ভুবনে……ঘুম ভেঙে বিছানায় স্বামী পুত্র কাউকেই না পেয়ে,খুঁজতে খুঁজতে চলে এলাম বারান্দাটায়।দেখি বাপ ছেলে মিলে সকালের প্রথম বাতাস স্নিগ্ধ অনুভূতি মাখিয়ে প্রতিটা নিঃশ্বাসের সাথে উপভোগ করছে।আমাকে দেখে বাবুর বাবা একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলল, এই যে আলসে মেয়ে! ঘুমকুমার অবশেষে ছাড়ল তোমায় ?

আমি উত্তর দিতে যাবো,এমন সময় ভাবনাচ্ছেদ ঘটিয়ে পিছন থেকে উষা বলল,এই আপু তুমি কি কানে তুলা দিয়েছ? মা ডাকছে তোমায়। কচুর ছড়া!!পৃথিবীতে কি ডাকার সময়ের অভাব পড়েছিল নাকি?এরপর ব্যস্ততার সাখে সখ্য করে আর যাইনি বারান্দায়।ভুলেও গেছলাম সেদিনের কথা । ঘটনাবহুল এই ছোট্র জীবনে প্রতিনিয়ত নিত্যনতুন ঘটনা ঘটতেই থাকে।আর ঘটনাগুলো এত দ্রতু ঘটে যে ছোটখাট অতীত ঘটনা মনে রাখার অবকাশ আমাদের থাকেনা।

বেশ কয়েকদিন পর কোন এক কারনে আবারো সকালে বারান্দায় গেলাম। আজো ছেলেটাকে দেখলাম তবে আজকে পিচ্চিটা নেই।মোটা ফ্রেমের চশমার নিচ দিয়ে ছেলেটা এমনভাবে বাইরে তাকিয়ে আছে, যেন আজই সে প্রথমবারের মত বাইরের জগতটাকে দেখছে।যে জগতে শুধুমাত্র তার একার আধিপত্য, যেখানে এই ব্যস্ত সংসারের বস্তা বস্তা চিন্তার লেশমাত্র নেই।আমিও কেন জানি নির্লজ্জের মত তাকিয়ে থাকলাম তার দিকে বেশকতক্ষন। নাহ্ তেমন নজরকাড়া সৌন্দর্যের অধিকারী নয় সে। তবে মুখটার মধ্য কোথায় যেন একটা অদ্ভুদ মায়া লেপটে আছে।একবার তাকালে তাকিয়েই থাকতে ইচ্ছে করে।

এরপর প্রতিদিন সকালে উঠে বারান্দায় যাওয়া আর সেই মায়াময় আগুন্তুকের দিকে তাকিয়ে থাকা আমার প্রতিদিনের রুটিন হয়ে গেল।শুধু কি তাই!সে রীতিমত স্বপ্নের চড়ুই হয়ে আমার মনের চিলেকোঠায় এসে বাসা বাঁধল। দূর ছাই!এই এক ঘোড়ার ডিমের বিশ্রী বয়স,যাকে দেখি তাকেই ভালো লাগে।মনে হয় সবসময় স্বপ্নের পসরা সাজিয়ে বসে থাকি,কাউকে দেখলেই তাকে নিয়ে কল্পনার আকাশে উড়াল দিই।

কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল ছেলেটা কোনদিন কৌতুহলবশতও আমার দিকে তাকায় নি।তাই একদিন দুষ্টুমি করে টিয়াকে শিস দেয়া শিখালাম।আর এই শিসের শব্দ শুনেই কোন একদিন টিয়াকে দেখার ছলে সে আমার দিকে একপলক তাকিয়েছিল।এরপর আর কোনদিন তাকে দেখিনি।আজো আমি রোজ প্রভাতে বারান্দায় যাই আর প্রতিটা মুহূর্তে অপেক্ষায় থাকি, একদিন আমি সত্যিই আবার দেখা পাবো তোমার।আবারো বিনিময় হবে ছোট্র একটা পলকের।আর সেখানে ঠাঁই করে নিবে হাজারো অব্যক্ত কথা।

হে ক্ষনিকের খেলাঘরে গড়ে ঊঠা মনমন্দিরে আসন পাতা প্রেমদেবতা, তোমার কাছে আমার আকুল আকুতি…….আর একবার ফিরে এসে আমার মিথ্যে স্বপ্নগুলোকে রঙধুনুর সাত রঙে রাঙিয়ে দিয়ে যাও !

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত