সত্যের সন্ধ্যান

সত্যের সন্ধ্যান

পরপর দুইবার কন্যাসন্তান জন্ম দেয়ার জন্য রাবেয়া বেগম
কে অপয়া, অলক্ষী নানা অপবাদ শুনতে হয়। শুধু মুখে বলেই
ক্ষান্ত নয় ওর শ্বাশুড়ি আছিয়া বেগম আর বড় জা
খাদিজা বেগম ওর উপর মানুষিক ও শারিরীক নির্যাতন
করতেও কুন্ঠাবোধ করেনা। রাবেয়া বেগমের শ্বাশুড়ির
মতে ওর বড় জা হচ্ছে লক্ষী কারণ তার দুই সন্তানই ছেলে
আর ছেলেরা হচ্ছে সোনার কাঠি।
রাবেয়ার প্রথম মেয়ে আয়েশা জন্ম নেয়ার পর একমাস ওর
শ্বাশুড়ি ওর সাথে কথা বলেনি। পরেরবার ছেলে সন্তান
হবে এই ভেবে তিনি একটু সুস্থির হোন। কিন্তু আয়েশাকে
তিনি কোনোদিনও একটু আদর করেননি, মনের ভুলেও
একদিন এই নিষ্পাপ শিশুকে কোলে নিয়ে দেখেননি।
.
খুব বেশি একটা লেখাপড়া করতে পারেনি রাবেয়া
বেগম। পনেরো বছর বয়সেই সিঙ্গাপুর প্রবাসী হোসেন
আলীর সাথে তার বাবা তাকে বিয়ে দেয়। লেখাপড়ার
প্রতি রাবেয়ার প্রচন্ড আগ্রহ ছিল। সে মনে মনে স্বপ্ন
দেখতো লেখাপড়া করে সে বড় হবে। মানুষের মত মানুষ
হবে সবাই তাকে একনামে চিনবে। কিন্তু মুহূর্তের মধ্যে
কালবৈশাখী ঝড়ের মত সব উলোট-পালোট হয়ে গেল।
তার স্বামী হোসেন আলী বিয়ের পর একবার সিঙ্গাপুর
গিয়ে আর যায়নি। দেশেই ব্যবসাপাতি শুরু করে দেয়। আর
এই কারণে সমসময় রাবেয়াকে সবাই কটু চোখে দেখতে।
তাদের ভাষ্যমতে রাবেয়া বেগম হোসেন আলীর উপর
কবজ করেছে তাই হোসেন আলী বউকে ছেড়ে কোত্থাও
যাচ্ছেনা।
.
বিয়ের দুই বছরের মাথায় আয়েশার জন্ম হয় এতে সবার মুখ
কালো । একমাত্র হোসেন আলীর মুখে সেদিন হাসি
দেখা গিয়েছিলো। শ্বাশুড়ি আর জায়ের খোটা শুনতে
পুত্র সন্তানের আশায় রাবেয়া বেগম আরেক সন্তান নিতে
বাধ্য হয়। কিন্তু এবারও কন্যা সন্তান হওয়ায় রাবেয়া
বেগম যেন গুরুতর অপরাধ করে ফেলেছে যা ক্ষমার
অযোগ্য। ওর উপর অমানুষিক নির্যাতন করা হয় আর এর
প্রতিবাদ করায় হোসেন আলীকেও কম কথা শুনতে হয়নি।
বাধ্য হয়ে হোসেন আলী স্ত্রী সন্তান কে নিয়ে পরিবার
থেকে আলাদা হয়ে যায়। নিজের ইচ্ছায় আলাদা হওয়ার
কারণে আলী হোসেন সম্পত্তির কোনো ভাগ পায়না।
এতে তারমনে কোনো আফসোস নাই। স্ত্রী আর সন্তানদের
রিজিক জোটানোর মত শক্তি সামর্থ্য আল্লাহ তায়ালা
এখনো কেড়ে নেননি।
.
ছোট মেয়ের নাম রাখে ফাতিমা। হোসেন আলী বলে তার
মেয়েদেরকে আমাদের প্রিয়নবী হযরত মুহাম্মদ (স:) এর
আদরের কন্যা ফাতিমার মত করে গড়ে তুলবেন। পরকালে
যেন এই দুই মেয়ের উছিলায় সে জান্নাত লাভ করতে
পারে।
তাই পাঁচ বছর পর হোসেন আলী ও রাবেয়া বেগম তার দুই
সন্তান কে হাফিজিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়।
তাদের আশা এই সন্তানদের জন্যই তারা অনেক সম্মান
পাবে। তার দুই সন্তানই তাদের একদিন সত্যের সন্ধ্যান
দিবে। তারা যে আজ সত্যের সন্ধ্যানে ইসলামের পথে পা
বাড়িয়েছে।
.
হোসেন আলী কয়েকবার তার মায়ের সাথে দেখা করতে
গিয়েছে কিন্তু তার মা তাকে দুরদুর করে তাড়িয়ে
দিয়েছে। বলেছে বউ আর বাচ্চাদের ছেড়ে যদি আসতে
পারে তবেই যেন ও মায়ের কাছে আসে তার আগে না।
হোসেন আলী এখন আর মায়ের কাছে যায়না কিন্তু
লোকমুখে মায়ের খবর ঠিকি নেয়। মাঝেমধ্যে মায়ের
জন্য ভাইয়ের কাছে টাকাও পাঠায়। মায়ের যেন কোনো
অসুবিধা না হয় সে জন্য ভাইয়ের কাছে অনেক অনুরোধ
করে ও।
.
অনেকদিন কেটে গেছে। আছিয়া বেগমের শরীরটাও
ভালো যায়না এখন। সারাক্ষণ অসুখবিসুখ লেগেই থাকে।
ছেলের বউ খাদিজা বেগম দেখাশোনা করে তার। নামে
শুধু দেখাশোনা কাজের বেলায় নাই। দুই নাতি আর নাতবউ
ভুলেও তার কাছে আসেনা। উচ্চস্বরেই তারা বলে যে বুড়ি
মরলেই তারা বাঁচে। মাঝে মাঝে আছিয়া বেগমের তার
ছোট ছেলের বউ রাবেয়া বেগমের কথা মনে পরে। কত
ভালো ছিলো বউটা। ওর সব কথা মুখ বুজে সহ্য করতো
একটুও প্রতিবাদ করতো না।
তার দুই নাতনীর কথা মনে পড়ে, ওরা মনে হয় অনেক বড়
হয়েছে।
.
একদিন পাশের বাড়ির ছালেহা বানু আছিয়া বেগমের
কাছে এসে বলে তাদের বাড়িতে আজ মহিলাদের তালিম
ও জিকির করা হবে। শহর থেকে দুইবোন কে আনানো
হয়েছে। ওরা পারিশ্রমিক ছাড়াই মহিলাদের কাছে
ইসলামের দাওয়াত দিয়ে বেড়ায়। দুইজনই কওমি মহিলা
মাদ্রাসার শিক্ষিকা।
আছিয়া বেগম বলে সে যাবে। এই শেষ বয়সে আল্লাহর
বাণী শুনে যদি মন একটু হালকা হয়। ছালেহা বানু আর
খাদিজা বেগম ধরে ধরে আছিয়া বেগম কে তালিমে
নিয়ে গেলেন।
যথারিতী তালিম শুরু হলো। জিকির আজগার করার পর
একবোন আইয়ামে জাহিলিয়া যুগের একটি ঘটনা বর্ণনা
করে।
.
সে যুগে কন্যাসন্তান জন্ম নিলে তাকে অভিশাপ স্বরুপ
দেখা হতো। এমনকি হত্যা করতেও কোনোরকম কুন্ঠাবোধ
করত না। এইরকম কাজ করেছিলেন আমাদের প্রিয় নবীর
একজন সাহাবী দাইয়াতুল ক্বলবী। তিনি তার কন্যাসন্তান
কে জীবিত মাটির নিচে পুতে দিয়েছেন। তার মেয়ের
কান্না সেদিন তার মন গলাতে পারেনি।
মেয়ে সন্তান যে আল্লাহর রহমত স্বরুপ এ বিষয়ে
বিস্তারিত বর্ণনা দেয়।
আছিয়া বেগম এই কথাগুলো শুনে তার সব অতীত মনে পরে
যায়। তিনিও তো শুধুমাত্র মেয়ে সন্তান জন্ম দেয়ার
কারণে তার ছেলের বউ রাবেয়াকে কত অপমান করেছে।
তার নাতনিদের একদিন কোলে পর্যন্ত নেয়নি। সব স্মৃতি
আছিয়া বেগমের মনে দাগ কাটলে লাগলো। অনুতাপের
আগুনে ওর বুক জ্বলে ছারখার হতে হতে শুরু করল। সে
ওখানেই উচ্চস্বরে বুক চাপরে কাঁদতে লাগলো। কেউ
তাকে থামাতে পারলোনা। তখন ওই দুই বোন এসে
নানাভাবে তাকে বুঝিয়ে শুনিয়ে শান্ত করে তোলে।
বলে রাখা ভালো এই দুই বোনই হোসেন আলী আর
রাবেয়ার সন্তান আয়েশা এবং ফাতিমা।
.
আছিয়া বেগমের এমন করে কান্নার কারণ আয়েশা ও
ফাতিমা জানতে চাইলে আছিয়া বেগম কাঁদতে কাঁদতে
সব কথা বলে। কিভাবে কন্যা সন্তান জন্ম দেয়ার তার
ছেলে ও ছেলের বউকে অবহেলা করেছে। তার ছেলের
বউয়ের উপর অত্যাচার করেছে।
আজ সে তার সব ভুল বুঝতে পেরেছে। তিনি বারবার
বলছেন তার কোনো ক্ষমা নেই।
ফাতিমা বলে যখন কেউ ভুল করে ভুল বুঝতে পেরে তওবা
করেন আল্লাহ তায়ালা তার সব গুনাহ মাফ করে দেন।
আপনি আল্লাহর রহমতে ভুল বুঝতে পেরেছেন, সত্যের
সন্ধান পেয়েছেন। আল্লাহ তায়ালা মহান তিনি নিশ্চই
আপনার সব অপরাধ ক্ষমা করে দিবেন। আয়েশা বলেন
দাদীমা আপনি এভাবে আর কাঁদবেন না। আয়েশার মুখে
দাদী ডাক শুনে তার দুই নাতনির কথা মনে পড়ে।
.
আছিয়া বেগম কে তার বাড়িতে আনা হয়, সাথে ফাতিমা
আর আয়েশা দুজনেই আসে।
আছিয়া বেগম তার ছেলে, ছেলের বউ আর দুই নাতনি কে
দেখার জন্য উতলা হয়ে পড়েন তিনি।
হোসেন আলীর কাছে খবর পাঠানো হলে তিনি রাবেয়া
বেগম কে নিয়ে ছুটে আসেন মায়ের কাছে।
হোসেন আলীর কাছে আছিয়া বেগম জানতে পারে এই দুই
মেয়েই তার নাতনি। তার দুই নানতিকে জড়িয়ে ধরে সে
আবার কাঁদতে লাগে। এ কান্নাতো মিলনমেলার কান্না,
সুখের কান্না। এতদিন পর আজ তিনি সত্যের সন্ধ্যান পেলেন।

কোনটা সঠিক এতদিন পর আজ তিনি বুঝতে পারলেন।

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত