একটি গল্প

একটি গল্প

মুয়াজ্জিনের আজানে ঘুম ভেঙে গেল। আকাশ টা হালকা হালকা পরিষ্কার হতে চলছে। নামাজ পড়তে হবে। যাই ওজু টা করে নেই। এই মেঘলা উঠো। এই আর কত ঘুমাবে। এই উঠো না। হাত দিয়ে দেখলাম আশে পাশে কেউ নাই। ও তুমি তো স্বার্থপেরর মত চলে গেছ। বয়স বাড়ার সাথে সাথে স্মৃতিশক্তি লোভ পেতে শুরু করছে। গত ১ লা জানুয়ারি ওরা আমার ৬০ তম জন্মদিন পালন করলো। আমি তো এমন ছিলাম না। একবার পড়লেই পড়া মুখস্থ হয়ে যেত। আমার ছোটবেলার সব কথা বলে দিতে পারতাম। মা অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকতো। আবির কিভাবে পারিস বাবা এত কথা মনে রাখতে? আমার ব্রেন অনেক শার্প ছিলো। কিন্তু আজও মনে হচ্ছে মেঘলা আমার সাথেই আছে। তুমি বড় স্বার্থপর মেঘলা। তুমি তো আমায় কথা দিয়েছিলে আমাকে ছেড়ে চলে যাবে না। সব সময় আমার সাথে থাকবে। ছোটবেলায় যখন আমি বাবাকে হারাই তখন আমি খুব কষ্ট পাই। তখন মা বলেছিল কাঁদিস না বাবা, সবাই তো আর চিরদিন বেঁচে থাকে না। আমি আছি না। আমি সব সময় তোর কাছে থাকবো। তোকে ছেড়ে কখনো যাবো না। তারপর যখন বড় হলাম তখন মা খুব অসুস্থ হয়ে পড়লো।

অস্থির হয়ে পড়লাম। মেঘলা তখন তো তুমি আমাকে সান্তনা দিতে মায়ের কিছু হবে না। মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল তার ছেলের বউ কে দেখবে। বিবাহে আবদ্ধ হলাম তোমার সাথে। কিছুদিন পরে মা পুরাপুরি সুস্থ হয়ে গেল। মন ভাল থাকলে শরীর ও ভাল থাকে। ইচ্ছা ছিল নাতি নাতনীর মুখ দেখবে, কিন্তু ইচ্ছাটা আর পূরন হলো না, টাটা বাই বাই বলে চলে গেল, না ফেরার দেশে। তখন তো তুমি বলেছিলে আমাকে ছেড়ে কখনো যাবে না। কিন্তু আজ কেন চলে গেল। তুমি এমন কেন মেঘলা…? কেন এতোটা স্বার্থপর হতে পারলে?

ওজু করে নামাজ পড়তে হবে। উঠতে প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছে। পা দিয়ে তেমন হাটতে পারি না। পারি না ঠিকমতো সোজা হয়ে দাড়াতে। বার্দ্ধক্য আমাকে তীলে তীলে শেষ করে দিচ্ছে। যে পা দিয়ে দৌড় প্রতিযোগিতার শীর্ষ স্থান ছিল সব সময় আমার দখলে, ফাস্ট বল করে ব্যাটসম্যানদের উইকেট ভাঙা ছিল দৈনন্দিন রুটিন, অপরের টিমকে গোল দেওয়ার জন্য সব সময় থাকতাম মরিয়া। আজ সে পা দিয়ে ঠিকমতো হাটতে পারি না। কষ্ট হয়ে যায় নিজের শরীর টাকে বহন করতে। আমার পা মনে হয় বলছে, এবার আমাকে ছুটি দেও। আর কত…?

অনেক কষ্টে ওজু শেষ করে নামাজ পড়ে নিলাম। মসজিদে নামাজ পড়া সম্ভব হলো না। শরীরটা খারাপ থাকলে প্রায়শই বাসায় নামাজ পড়তে হয়।
এখনো সকাল হয়ে পারে নি। ইচ্ছা করছে একটু হাটতে। কিন্তু শরীরটা সায় দিচ্ছে না। আমি এতো সকালে কখনো ঘুম থেকে উঠতাম না। ঘুমাতে যেতাম ফজরের আজানের সময়। সারারাত অনলাইনে থাকতাম। খুব ভাল ফেইসবুক ব্যবহার করতাম। কিন্তু এখন আর লগ ইন করা হয় না।

এখন একটু কোরআন শরীফ পড়া যাক। আমি কোরআন শরীফ পড়তে পারি না। কোরআন শেখার সময়টা আমার কখনওই হয় নাই। কখনো গুরুত্ব দিতাম না। আমার দৌড়ছিল বেশি বেশি সার্টিফিকেট অর্জন করা। কিন্তু কোরআন শেখার সময়টুকু দিতে পারি নাই। ধর্মীয় জ্ঞান না থাকলে সকল শিক্ষাই অর্থহীন। বেশি পাওয়ারের চশমা দিয়ে বাংলায় অনুবাদন করা কোরআন শরীফ পড়া শুরু করলাম। জীবনে অনেক সার্টিফিকেট অর্জন করেছি। সব তুলে রাখা আছে। মৃত্যুপথ যাত্রী হিসাবে কিছুই নিয়ে যেতে পারবো না।

সকাল হয়ে গেল। বউমা হয়তো এখনো ওঠে নি। আমার একমাত্র ছেলে রিহান, বউমা রিধি এবং নাতনী দিয়া। ছেলেটা ভাল একটা চাকুরি করে, বউমা ডাক্তার। খুব মিষ্টি দেখতে। সবসময় ব্যস্ত থাকে। নাতনী দিয়া। কি লক্ষী একটা মেয়ে। একদম তার দাদীর মতো হইছে। মায়ের খুব ইচ্ছা ছিল কিন্তু দেখে যেতে পারলো না। জানো মেঘলা আমি না দিয়ার সাথে তোমার গল্প করি। দিয়া তোমাকে অনেক মিস করছে। আচ্ছা মেঘলা আমাদের প্রথম কোথায় দেখা হয়। তোমার কি মনে আছে? সেদিন দিয়া আমাকে প্রশ্ন করলো কিন্তু আমি উত্তর দিতে পারি নাই। আমার না দিন দিন স্মৃতিশক্তি হ্রাস পাচ্ছে। আমি কিছুই মনে করতে পারছি না। মেঘলা কেন আমার এমন হলো। কেন কেন কেন…?

সকাল ৮ টা। টেবিলে নাস্তা দেওয়া হয়েছে। কাজের মেয়ে নাস্তা দিছে। বউমা অনেক ব্যস্ত নাস্তা বানানোর সময় কোথায়। আমি কখনো এতো সকালে নাস্তা করতাম না। সকাল ১০ টা বাজে মায়ের অনেক চিল্লাচিল্লির পর ঘুম দিয়া উঠতাম। টেবিলে নাস্তা দেওয়া থাকতো কোনদিন খেতাম আবার কোনদিন না খেয়েই কলেজ কিংবা মাঠে চলে যেতাম। খবার টেবিলে অপেক্ষা করছি কেউ আসছে না।

– রিহান, বউমা কোথায় তোমরা?
: আসছি বাবা।
– কি ব্যাপার খাবে না?
: বাবা আজ বড্ড লেট হয়ে গেছে। আমি ক্যান্টিনে খেয়ে নিবো। তুমি নাস্তা করো বাবা। আমি আসছি।
– বউমা তুমি বসো।
— আমি দিয়াকে নিয়ে খেয়েছি। দিয়ার স্কুলের লেট হয়ে যাচ্ছে। আপনি খেয়ে নিন।
– বউমা এক কাপ চা দিতে পরবে।
— বাবা লেট হয়ে গেছে। আমি বুয়াকে বলে যাচ্ছি।
– আচ্ছা সাবধানে যাবে।
— আচ্ছা বাবা।

-টাটা দাদা ভাই।
-বাই দিয়া।

নাস্তা করতে ইচ্ছা করছে না। টেবিল থেকে উঠে জালনার পাশে দাড়িয়ে আছি। আকাশ দেখছি। সব সময় আকাশ দেখার মাঝে আমি আনন্দ খুজে পেতাম। যখন খুব একা থাকি তখন আকাশ দেখি। আকাশ খুব বন্ধসুলভ খুব তাড়াতাড়ি সবাইকে আপন করে নেয়। যেমন নিয়েছিল মেঘলাকে। আমি যখন অফিসের কাজে খুব ব্যস্ত থাকতাম। তখন মেঘলাকে বলতাম আকাশ দেখতে। আকাশ দেখলে একাকিত্ব দূর হয়। মেঘলা প্রথম প্রথম খুব রেগে যেত। পরে রাত দুপুরে ঘুম থেকে ডেকে আকাশ দেখাতো। কিছুই করার ছিলো না, মুখ বুজে সব ছেলে মানুষী সহ্য করতে হতো।
মেঘলা তুমি কোথায়..? কোথায় চলে গেলে?
-খালু এই নিন আপনার চা।

কাজের মেয়ে, আমার জন্য চা নিয়ে আসছে। আপনার কিছু লাগবে..?
না। আমার কিছু লাগবে না। তুমি এখন আসতে পারো]

একা একা জালনার পাশে দাড়িয়ে আছি। জানা নেই আর কতখন থাকবো। একাকিত্ব তিলে তিলে আমাকে শেষ করে দিচ্ছে।
চশমা পড়ে লাঠি ভর দিয়ে বাসা দিয়ে বের হলাম। হাটতে খুব কষ্ট হচ্ছে। যাই মেঘলার সাথে দেখা করে আসি। হাটতে হাটতে মেঘলার কাছে আসলাম। মেঘলা খুব অভিমানী ছিলো। জানিনা কোন অপরাধে মেঘলা আমাকে ছেড়ে চলে গেল।

আসসালামু আলাইকুম মেঘলা। কেমন আছো তুমি? শরীরটা ভাল। তুমি না আমাকে বলতে তোমাকে ছাড়া থাকতে প্রচন্ড কষ্ট হয়। তাহলে তুমি তো এখন দিব্বি আমাকে ছাড়া থাকছো। আমাকে তোমার মনে পড়ে না? তুমি এতটা স্বার্থপর হলে কিভাবে। জানো মেঘলা। আমি না তোমাকে খুব মিস করি। হ্যা সবাই ভাল আছে। তুমি কেমন আছো। আমার শরীর টা বেশি ভাল নেই মেঘলা। আমার খুব কষ্ট হচ্ছে। আর সবচেয়ে বেশি কষ্ট হয় একা একা থাকতে। আমি এভাবে থাকতে পারবো না মেঘলা। পারবো না তোমাকে ছাড়া থাকতে। সবাই আমাকে ছেড়ে স্বার্থপরের মতো চলে গেছে। আমাকে একা রেখে আমি যে থাকতে পারবো না। পারবো না মেঘলা। ছোটবেলা বাবাকে হারালাম। মা ছিল আমার সব। তারপর মা চলে গেল তুমি তো মেঘলা কথা দিয়েছিলে আমাকে ছেড়ো কখনো যাবে না। তাহলে তুমি কেন কথা রাখলে না। কেন? কেন? কেন?

-দাদু তুমি কাঁদছো কেন। তুমি না বলছো মৃত্যু মানুষের কববের সামনে কাঁদলে সে খুব কষ্ট পায়। দাদী আপু তো খুব কষ্ট পাচ্ছে। প্লিজ তুমি কেঁদো না। আমি আছি না। আমি আছি বাবা আছে, আম্মু আছে। বাবা শুনলে প্রচন্ড কষ্ট পাবে। কেঁদো না দাদু। আমি তোমার চোখের জল মুছে দিচ্ছি।
-আমার লক্ষী দিয়া। স্কুল ছুটি হয়েছে…?
-হ্যাঁ দাদু। তুমি না বলেছিলে আজকে তুমি আমাকে গল্প শুনাবে?
-হ্যাঁ। বাসায় চলো।

নদীর স্রোতের মতো চলতে থাকে আমাদের জীবন। খনে খনে রূপ পাল্টায়। চলতে চলতে কখন যে সময় টা ফুরিয়ে যাবে কেউ বুঝতে পারে না। পাওয়া না পাওয়ার আক্ষেপ থেকেই যায় আমাদের জীবনে। প্রতিটা মানুষই আক্ষেপ নিয়া মৃত্যুবরন করে। সৃষ্টিকর্তা আমাদের মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছে এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি কি হতে পারে। কিন্তু জীবন থাকতে কেউ আমরা উপলব্ধি করতে পারি না।

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত