অভিমান

অভিমান

আমি ক্লাস থেকে বের হতেই দেখলাম ইতি আর একটা ছেলে মাঠ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে।ছেলেটাকে আমি চিনি।নাম তাসফি।খুব ভদ্র ও মিশুক প্রকৃতির ছেলেটা।পড়ালিখায় ও বেশ ভালো।সুদর্শনও বটে।আমি কিছু সময় ওদের গমন পথের দিকে তাকিয়ে ছিলাম।যে কেউ দেখলে কয়েক সেকেন্ডে বলে দিবে যে এরা এক জোড়া।এরা কপোত কপোতী। এরা প্রেমিক। ওদের দিকে তাকাতেই আমার কেন জানি একটা বাজে অনুভুতি হল।খুব কষ্টও হল আমার।বুকের ভিতর কেমন জানি শিউরে উঠল।বাঁ’পাশটা একটু ভারি হয়ে গেল।আমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে চলে এলাম।ভালো লাগছে না।আরো দুইটা ক্লাস বাকি আছে এবং সেগুলো খুবই গুরুত্বপূর্ন।তাই আমি আর বাড়িতে ফিরলাম না।ভার্সিটি থেকে বের হয়ে একটা দোকানে গেলাম।একটা সিগারেট ধরিয়ে খুব জোরে টানতে লাগলাম।ইতির এমন আচরণ আমার আর ভালো লাগে না।কেন জানি খুব কষ্ট হয়।

এই তো সেদিন।স্যার একটা গুরুত্বপুর্ন নোট দিয়েছিল।নোটটা শেষ পরিক্ষার জন্যেও খুব প্রয়োজনীয়। নোটটা ওর কাছে ছিল।আমার সাথের বন্ধুদের সাথেও ছিল।কিন্তু খুব ইচ্ছে হল ওর কাছ থেকে নোটটা নিব।যেন একটু কথা বলতে পারি।আর যাই হোক দুজনেই এক সময় খুব ভালো বন্ধু ছিলাম।নিশ্চই ও না করবে না।ক্লাস শেষে ও আর ওর বন্ধু মিহিন বের হল।আমি পিছন থেকে বেশ কয়েকবার ডাক দিলাম।ও শুনেও না শুনার ভান করে চলে যেতে লাগল।আমি দৌড়ে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।ও আমাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে লাগল।আমি অসহায় হয়ে বললাম,

:কি রে চলে যাচ্ছিস ভালো কথা।আমার কথাটা শুনে যা?
ও আমার দিকে না তাকিয়ে ওর বন্ধু মিহিনকে বলল,
:ওকে বলে দে ওর মত ছেলের কথা শুনার সময় আমার নেই।ওকে যেন আমি আর না দেখি।খুব ঘৃণা হয় ওকে দেখলে আমার।
এই বলে ও চলে গেল।

মিহিন মেয়েটা অসহায় ভঙ্গিতে আমার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে ছিল।এর পর চলে গেল।আমি হাত দিয়ে চোখের কোনায় অবাধ্য হয়ে বেরিয়া আসা জলটা কে লুকিয়ে পেললাম।

এমন অনেক গুলো ঘটনা আছে যেটা ও আমার সাথে স্কুল এবং কলেজ লাইফ থেকে করে আসছে।তখনও খুব খারাপ লাগত।প্রিয় মানুষ গুলোর এমন আচরণে সত্যি খুব কষ্ট লাগে।অবশ্য এই কষ্ট পাওয়ার কারণটা আমি নিজেই।নিজেই নিজের বিপদ ডেকে নিয়ে এসেছি।ইতির মা সম্পর্কে আমার মায়ের কোন এক ভাবে আত্মীয় হয়।সেই সুবাদে ওর সাথে আমার পরিচয়।ওদের বাড়ি আমাদের বাড়ির বেশ কয়েকটা বাড়ির পর।তাই সম্পর্কটা একটু গাঢ় ছিল।দু’জনে একই সাথে পড়তাম।

ক্লাস সিক্সে থাকাকালিন আমি একটা বোকার মত কাজ করি।কি বুঝে হুট করে ওকে প্রপোজ করে দেই।কিন্তু তখনও আমি ভালোবাসা কি সেটা ঠিক ভালো ভাবে বুঝতাম না।আবেগের সাথে খুব একটা পরিচিত ছিলাম না।মেয়েটাও কি বুঝে আমার প্রপোজাল একসেপ্ট করে।অবশ্য এর পূর্বেও আমার সাথে ওর খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল।তাই হয়ত গ্রহন করেছে।এরপর থেকে আমার প্রেম খুব ভালো ভাবেই এগুচ্ছিল।

কত?দুই তিন মাস হয়ত ওর সাথে ঠিক মত কথা বলতাম।ওকে ওর বাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসতাম।কিন্তু এর পরেই আমার মাঝে তুমুল পরিবর্তন ঘটে।নিজেকে অন্য ভাবে আবিষ্কার করি।শারিরিক গঠন,চিন্তা ভাবনা সব কিছুই যেন অন্য ভাবে শুরু হয়।নিজেকে খুব বড় মনে হত আমার।ওর ধারে কাছে ঘেঁষতে ইচ্ছে হত না।কথা বলতে মন চাইত না।এক সময় ওকে এড়িয়ে চলতে শুরু করে দেই।যা ইতি মোটেও মেনে নিতে পারেনি।ফল স্বরূপ হুট করেই ওর সাথে আমার ব্রেকআপ হয়ে যায়।ব্রেকআপ অবশ্য সে নিজেই করেছে।

এই ছিল আমার দোষ।এর জন্যে আমি আজ পর্যন্ত ওর কাছে ক্ষমা চেয়ে এসেছি।কিন্তু ক্ষমা বদলে পেয়েছি কিছু কটাক্ষ বানি।কিছু অপমান।দু একটা চড়ও।কেন জানি মেয়েটা আমাকে এখন আর সহ্য করতে পারে না।খুব অসহ্য করে আমাকে।খুব!যা আমি মেনে নিতে পারি না।সাহস হয় না ওর সামনে এ মুখ নিয়ে দাঁড়াতে।তবুও বেহায়ার মত বার বার যাই।কারন আমি ওকে এখন ভালোবাসি।খুব ভালোবাসি।ওর এ অবহেলা থেকেই হয়ত ওর প্রতি আমার আবার নতুন করে ভালোবাসা জন্মায়।ক্ষুধার্ত কাক যেমন গৌধুলি লগ্নে এক রাশ বেদনা নিয়ে আপন নিড়ে যায়, তেমনি প্রতিদিন আমাকে এক বুক বেদনা নিয়ে ফিরতে হয় বাড়িতে।নিজেকে আজকাল চার দেয়ালের ভিতরেই আঁটকে রাখি।কেন জানি বাইরে বের হতে ইচ্ছে হয় না।ভালো লাগে না কোন কিছু।ভালো লাগে না আর।

সিগারেটটা শেষ হতেই একটা চুইঙ্গাম মুখে দিয়ে ভার্সিটির ভিতরে চলে এলাম।কিছুক্ষণ পরেই ক্লাসটা শুরু হবে।তাই চলে এলাম।ক্লাসের সামনে আসতেই দেখলাম ইতি আর ছেলেটা ক্লাসের দিকে এগিয়ে আসছে।ইতি হাসছে। মাঝে মাঝে দু’একটা কথা বলছে।সাথে ছেলেটা তাল মিলাচ্ছে।বাহ্! ভালো তো।বেশ ভালো।হঠাৎ আমার দিকে চোখ পড়তেই মেয়েটার হাসিটা উধাও হয়ে গেল।ক্ষণিকের মাঝেই ওর মুখের চাহনিটা পাল্টে গেল।আমি চোখ নামিয়ে খুব দ্রুত ক্লাসে ঢুকে গেলাম।আমি ওর বিরক্তির কারণ হতে চাই না।ওর হাসি মাখা মুখটা মলিন হয়ে যাক এ আমি চাই না।কষ্ট হলেও হবে।তবুও ও খুশি থাক।ভালো থাক ইতি।

ক্লাসে দুজনে এক সাথেই বসেছে।খুব মনযোগ দিয়ে স্যারের লেকচার শুনছে।ওরা খুব ভালো পড়ালেখায়।ওরা খুব ভালো বুঝেও। তারপরেও খুব মনযোগ দিয়ে স্যারের লেকচার শুনছে।আমি মাঝে মাঝে ওদের দিকে তাকাচ্ছি।আবার স্যারের লেকচার শুনছি।হঠাৎ-ই আমার মনে হল আমি স্যারের লেকচারের কিছু অংশ বুঝি নি।তাই হুট করে দাঁড়িইয়ে গেলাম।স্যারকে বললাম,
:স্যার আমি … … … এটা বুঝি নি।পুনরায় যদি একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিতেন তাহলে খুব ভালো হ।।

কিছুটা অনুনয় করে বললাম।
পুরো ক্লাস নিরব ছিল।আমি কথাটা বলাতেই সবাই হা হা করে হেসে উঠল।ইতিও।খুব হাসছে।যেন আমি বড়সড় কোন কৌতুক বলেছে।ওর পাশে বসে থাকা তাসফিও হাসছে।আমার কেন জানি খারাপ লাগল। খুব খারাপ লাগল।এখানে হাসার কি আছে?আমি কি খারাপ কিছু বলেছি?হ্যাঁ মানছি আমি পড়ালেখায় তাদের সমান না।তাই বলে এভাবে আমাকে অবজ্ঞা করবে।স্যারও কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।আমি মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম।খুব কান্না করতে ইচ্ছে হচ্ছে আমার। চোখের ভেতরের পানি গুলো যেন বের হয়ে আসছে।তবুও তা আটকানোর অদম্য চেষ্টা করলাম।আমি নিচের তাকিয়ে রইলাম।ততক্ষণে অনেকে অনেক রকম কথা বলা শুরু করে দিয়েছে।কিন্তু ক্লাসে স্যার উপস্থিত এবং তিনি কিছু বলছেনও না।আমি মাথা তুলে স্যারের দিকে তাকাব ঠিক তার কিছু সময় আগেই স্যার রাগত স্বরে ধমক দিয়ে বললেন,

:তোমাদের কি জ্ঞান ধর্ম বলতে কিছু নেই?এত বড় ক্লাসে উঠেছ অথচ কোথায় হাসবে আর কোথায় হাসবে না সেটাও শিখলে না?কি শিখিয়েছে তোমাদের মা বাবা?নৈতিক শিক্ষা পাও নি?
এই বলে স্যার থামলেন।কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন। আমার দিকে তাকিয়ে আবার বললেন,
:ও একটা জিনিস জানতে চাইছে আর তোমার সেখানে হেসে সেটা উড়িয়ে দিচ্ছ।আজ যদি ওর অবস্থানে তোমাদের কেউ হত তাহলে কেমন লাগত একটু ভেবে দেখ তো?
ক্লাসে এক প্রকার নিরাবতা নেমে এল।সবাই মাথা নিচু করে আছে।স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে আমাকে লেকচারটা বুঝিয়ে দিলেন।অনেকটা সময় পেরিয়ে যায় বুঝাতে।ক্লাস শেষে যাওয়ার সময় স্যার বললেন,
:তোমাদের পরবর্তি ক্লাস হবে না।তাই একটু সময় নিয়ে বুঝালাম।
এই বলে তিনি হেটে চলে গেলেন।আমিও তাড়াহুড়া করে বেরিয়ে গেলাম।কলেজ গেইট দিয়ে বের হয়ে একটা রিক্সা নিয়ে বাড়িতে চলে এলাম।আজও কিছু কষ্ট, কিছু বিষন্নতা,কিছু অভিমান নিয়ে ফিরে এলাম বাড়িতে।বড্ড অভাগা আমি।বড্ড অভাগা।

আমি অনেকটা খুশি হয়ে মায়ের দিকে তাকালাম।তার সামনে চিঠিটা ধরলাম।উনি কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলেন।কিছু একটা পড়লেন তিনি। এর পরেই উনার মুখটা উজ্জ্বল হতে লাগল।কিছুটা কান্না মিশ্রিত হাসি দিয়ে তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরলেন।আমিও মাকে জড়িয়ে ধরলাম।হ্যাঁ!আমার চাকরি হয়েছে।খুব ভালো একটা চাকরি।ঢাকায় চাকরি হয়েছে।অবশ্য এটা আমার ইচ্ছা ছিল।এই অভাগা শহরে আর থাকতে ইচ্ছে হয় না।খুব কষ্ট এই শহরে।খুব অভিমানী এই শহরের।তাই নিজেকে কিছু সময়ের জন্যে এখান থেকে আলাদা করার চেষ্টা করছি।
খাবার টেবিলে হঠাৎ-ই মা বলে উঠল,

:একটা খুশির খবর আছে। শুনবি?
আমি মায়ের দিকে না তাকিয়ে খেতে খেতে বললাম,
:হুম। বল!
:ইতির বিয়ে ঠিক হয়েছে।পারিবারিক ভাবে তারা নাকি পাত্র ঠিক করে ফেলেছে।
আমি এ কথা শুনার পরেই কেশে উঠলাম।মা পানি এগিয়ে এলাম।আমি পানি খেয়ে বললাম,
:ডেট ঠিক হয়েছে?
:হুম।কয়েক দিন পর।তারিখটা আমার ঠিক মনে নেই।
:ও আচ্ছা।আর শুন মা?
:হুম বল।
:আমি কাল চলে যাচ্ছি।
:সে কি?এত তাড়াতাড়ি যাবি কেন?
:এমনি? ওখানে তাড়াতাড়ি গিয়ে সব কিছু গোছগাছ করতে হবে।
মা খানিকটা মন খারাপ করে বলল,
:ওওও।বিয়েতে আসবি না?
:নাহ্।তুমি গেলেই হবে।আমি যাব না।
:কেন?ইতির বিয়ে আর তুই যাবি না?
:হ্যাঁ!আমি যাব না।

এই বলে উঠে গেলাম।কিছুদুর গিয়ে আবার মায়ের দিকে ফিরলাম। আমার দিকে কেমন জানি অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে আছে।আমি তা উপেক্ষা করে বললাম,
:ভোরেই রওনা হব।
আমি মাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে রুমে চলে এলাম।

সিগারেটে শেষ টান দিয়ে ওটা ফেলে বাসে উঠলাম।উঠার পর আমার মেজাজটা কেন জানি বিগড়ে গেল।আমার বাসের সিট ছিল মাঝখানের একটা সিটে।কিন্তু সেটা নাকি ট্রান্সফার করে একেবারের পিছনের সিটের সামনের সিটে নিয়ে নেওয়া হয়েছে।এবং সেটা একটা মেয়ের পাশে।এমনকি মেয়েটা বসেছে জানালার পাশের সিটটায়।যেটা আমি একেবারেই মেনে নিতে পারি নি।সিট ট্রান্সফার করেছে ভালো কথা, জানালার পাশের সিটটা দিলে কি হত।নিজেকে কন্ট্রোল করতে অনেক কষ্ট হচ্ছিল।তবুও নিজেকে যথেষ্ট সংযত রেখে একেবারে টিকেট টাই ট্রান্সফার করে ফেললাম।পরের বাসে করে যাব।আর যাই হোক কোন মেয়ের সাথে আমি এতদুর যেতে পারব না।

বাস থেকে নেমেই কাউন্টারের পাশে একটা চেয়ারে গা এলিয়ে দিলাম।বড্ড ক্লান্ত লাগছে।রাতে বেশি ঘুমাতেও পারি নি।তাই হয়ত।ব্যাগটা পাশে রেখে কানে ইয়ার ফোনটা গুঁজে দিলাম।গান চলছে।আমি গান শুনছি।ভালো না লাগলেও ভালো লাগানোর চেষ্টা করছি।আচ্ছা!
ও তো বিয়ে করে ফেলবে।আচ্ছা ওর বর জানি দেখতে কেমন হবে। আমার থেকে সুন্দর!হতে পারে।ওর পছন্দ বলে কথা।আচ্ছা ছেলেটা কি তাসফি?হ্যাঁ! তাই হতে পারে।কেননা আমাদের ফাইনাল পরীক্ষার বেশ কিছুদিন পরেও আমি তাদের এক সাথে দেখেছি।কোথাও যেন যাচ্ছে।

হঠাৎ-ই কেউ আমার পাশে বসল।আমি কল্পনা থেকে ফিরে কিছুটা চমকে গেলাম।আরে! এ তো বাসের সেই মেয়েটা।এখানে কি করছে?ও কি সেই বাসে করে যায় নি?কেন?আমি একটু নড়ে পাশের একটা চেয়ারে গিয়ে বসলাম।মেয়েটাও উঠে এসে আমার পাশে একেবারে গায়ের সাথে গা মিলিয়ে বসেছে।আমি উঠে যাব ঠিক তখনই মেয়েটা আমার হাত ধরে ফেলল।আমি ঝট করে হাত ছাড়িয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলাম।কিন্তু তা হল না।আমি ভ্রু কুঁচকে বললাম,

:কি হচ্ছে টা কি?লজ্জা সরম নেই আপনার?
:তোর খুব অভিমান তাই না?

আমি বাক রুদ্ধ হয়ে ওর দিকে তাকালাম।আরে এ তো সেই কন্ঠ যে কন্ঠ শুনার জন্যে আমি বার বার অপমানিত হয়েছি।বার বার অপদস্থ হয়েছি।ইতি! ইতি এখানে?কিন্তু ও এখানে কেন?ওর তো এখানে থাকার কথা না?আমি নিজেকে সংযত রেখে বললাম,
:হাত ছাড়ুন!
ও নিজের মুখটা উন্মুক্ত করল।আমার দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
:আপনি করে বলবি?
:আপনি হাত ছাড়ুন।
:না।ছাড়ব না।দেখি তুই কি করতে পারিস।

আমি কিছু বললাম না।এক ঝটকায় হাতটা ছাড়িয়ে নিলাম।আমি আবার উঠে যাব ঠিক তার আগেই ও আমার হাতটা আবার চেপে ধরল। ওর মুখটা একে বারে আমার মুখের সামনে নিয়ে এল।আমার মুখটা ওর দিকে ফিরানোর চেষ্টা করল।কিন্তু আমি তা হতে দিলাম না।যত বার এমন করেছে আমি ঠিক ততবারই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছি।শেষ বার ও আমার মুখটা ওর দিকে ফিরিয়ে খুব শক্ত করে চেপে ধরল দু হাত দিয়ে।যেন আবার না ফিরিয়ে নিতে পারি।আমিও আর সে চেষ্টা করলাম না।এখন আমার মুখ ঠিক ওর মুখ বরাবর। আমার চোখ এখন ওর চোখ বরাবর।আমি ওর লাল হয়ে যাওয়া চোখ দুটো দেখলাম।মুখের উপর ক্লান্তি,গ্লানি,কষ্টের ছাপ স্পষ্ট। আরে কি হয়েছে ওর?এমন করছে কেন? আমি চোখ থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম।ও কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।কিছু বলল না।আমিও কিছু বললাম না।চুপ করে থাকলাম।একটু পর ও বলল,

:খুব অভিমান তোর তাই না?
আমি ভনিতা না করে বললাম,
:না! কোন অভিমান নেই আমার।কারো উপর কোন অভিমান নেই আমার। কোন অভিমান নেই।
ও ভেজা কন্ঠে বলল,
:খুব কষ্ট হত তখন, তাই না?
আমি কিছু বললাম না।অন্য দিকে তাকিয়ে রইলাম।কেন জানি চোখ গুলো ভিজে আসছে।ও আবার বলল,
:বুকের বাঁ’পাশটা খুব ব্যাথা করত নাই না।আচ্ছা তুই এত অপমান,এত অপমান সহ্য করতি কিভাবে বল তো?
আমি এবারেও কিছু না বলে চুপ করে রইলাম।ও এবার কান্না করে দিল।একেবারে কেঁদে কেঁদে বলল,
:তুই বিশ্বাস কর আমি এগুলো ইচ্ছে করে করি নি।সেই কবেই তোর উপর আমার সব রাগ জলের ন্যায় হয়ে গিয়েছিল রে।
ও একটু থামল। আমি সে সুযোগে বললাম,
:তাহলে কেন করেছিলি বলৎকেন? কেন আমাকে এত কষ্ট দিয়েছিস।একটা ভুলের শাস্তি কেন এত পেতে হবে? বল?কেন এত পেতে হবে?
:তোকে বুঝাতে চেয়েছিলাম আমি কতটা গুরুত্বপূর্ন তোর জীবনে।আমাকে কতটা প্রয়োজন তোর। এটা তোকে বুঝাতে চেয়েছি আমি।
:তাই বলে এত কষ্ট? এত দিতে হবে?
ও কিছুটা নরম স্বরে বলল,
:ক্ষমা করে দে আমায়।প্লিজ।ক্ষমা করে দে?
:ক্ষমা! আমি তোকে ক্ষমা করব কেন?তুই তো ভুল করিস নি? তোকে কেন ক্ষমা করব আমি। কেন?
:ভুল আমিও করেছি রে।খুব বড় ভুল করে পেলেছি আমি।খুব বড়!
আমি কিছু বললাম না।উঠে দাঁড়ালাম। ও বসা থেকেই বলল,
:কই যাচ্ছিস।
:তুই বাড়ি চলে যা ইতি।তুই বাড়ি চলে যা।আমি একা ছিলাম,আছি। সমস্যা হবে না।আমি থাকতে পারব।তুই চলে যা।খামখা কেন আমার জন্যে অন্য কেউ কষ্ট পাবে?
ও পিছন থেকে বলল,
:মানে কি? কি বলতে চাইছিস তুই?
:ওমা! তুই বুঝিস না মনে হয়।
:আমি সত্যিই বুঝিতে পারছি না রাকিব।কি বলতে চাইছিস তুই।
:কেন? তাসফিকে ভুলে গেলি নাকি? যার সাথে তোর বিয়ে হতে যাচ্ছে?
:কি সব আবোলতাবোল বকছিস।তাসফিকে আমি বিয়ে করব কেন?
:কেন তুই জানিস না?ফাজলামো করিস?
:আমি সত্যিই বুঝিতে পারছি না রাকিব।প্লিজ আমাকে বুঝিয়ে বল।
:আমি ওর দিকে ফিরে ওর দিকে একটু এগিয়ে গেলাম।বললাম,
:তাসফির সাথে তোর রিলেশন ছিল না?
:না।আমি আর ও জাস্ট ফ্রেন্ড ছিলাম।
:ফ্রেন্ডরা কখনও এমন ভাবে চলে না।তুই আর ও যেভাবে চলতি!
:আরে ওটা তো তোকে দেখানোর জন্যে ছিল।
:মানে?
:মানে তোকে দেখলেই আমি আর ও একটু পাশাপাশি হাটতাম।যাতে তোর একটু জ্বলে।
:তার মানে তুই আমাকে জ্বলানোর জন্যে এমন করেছিস?
:হুম।
আমি খানিকটা বোকা হয়ে গেলাম।কিছুটা অভিমান নিয়ে বললাম,
:যাহ্।তোর সাথে কোন কথা নেই।যা এখান থেকে যাহ্।
:নিজে মনে হয় করেন নি? নিজেও তো মিহিনের সাথে এক সাথে হাটতেন।এক সাথে কথা বলতেন।তখন কি আমার জ্বলত না? খুব ইচ্ছে করত মিহিনটাকে গিয়ে ক’টা কথা শুনিয়ে দেই।চুল গুলো টেনে ছিড়ে দেই।কিন্তু সেই ইচ্ছেটাকে ধামাচাপা দিয়ে রাখতাম।তবুও কষ্ট হত রে।ভিশন কষ্ট হত।যেন কেউ তোকে আমার কাছ থেকে নিয়ে যাচ্ছে।মনে হত এই তোকে হারিয়ে ফেললাম।

কথা গুলো বলতে বলতে মেয়েটা ক’ফোটা জল ফেলল।আমি কিছু বললাম না।একটু চোখ তুলে ওর দিকে তাকালাম এবং ওর দিকে তাকিয়েই রইলাম।সব কিছুর পরেও একটা সন্দেহ আমার থেকেই গেল।ও যদি আমাকে এতই ভালোবাসে তাহলে বিয়ে করতে চাচ্ছে কেন? ব্যাপারটা খোলাসা করতে হবে।কিছুটা মন খারাপ করে বললাম,
:তোর বর কি করে?
আমার কথা শুনে ও কান্না মিশ্রিত হাসি দিল।আমি কেবল সেদিকে তাকিয়ে রইলাম।হাসি থামিয়ে বলল,
:এইত!কিছুদিন আগে একটা চাকরি পেয়েছে।
না!কথাটা শুনে মনে শান্তি পেলাম না।আমি নিশ্চিত মেয়েটা আমার সাথে রহস্য করছে।এবং ওর হাসিতে আমি রহস্য স্পষ্ট দেখতে পেলাম।ওর দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললাম,
:নাম কি?
:রাকিব!
:কিহ?
:হ্যাঁ।রাকিব।আমার রাকিব।
আমার রাকিব? আমি একটু ব্যাথিত হলাম।বললাম,
:শেষমেশ আমার নাম হতে হল তোর বরের?
ও একটু চাপা হাসি দিয়ে বলল,
:ওমা! সেকি? তুইই তো আমার বর।তোকেই তো বিয়ে করব আমি।
:মানে?
:মানে যা শুনছিস তাই?
:কিন্তু কিভাবে?
:কি ভেবেছিস তুই? তোকে আমি এমনি এমনি ছেড়ে দিব।আমার সাথে ব্রেকআপ করলি কেন?এটার শাস্তি হল এটা।
আমি কিছুটা উচ্ছ্বাসিত হয়ে বললাম,
:বলিস কি? এমন হলে তো আমি বার বার ব্রেকআপ করতে রাজি।
:অ্যাই!খবরদার! ব্রেক আপের
কথা যদি আর একবার মুখে আনিস তাহলে তোকে খুন করে পেলব।
:আমিও আর জীবনে সেই ভুল করব না।

তারপর আবার নিরাবতা। খুব নিরাবতা। আমার কেন জানি ভালো লাগতে শুরু করছে।অদ্ভুত সেই ভালো লাগা।কিছুক্ষণ পর ওর দিকে তাকিয়ে দেখলাম ও মিটি মিটি হাসছে।আমি তাকিয়ে আছি।হঠাৎই ও বলে উঠল,
:তুই তখন কি পাগলামি টাই না করতি।জানিস, আমি মাঝে মাঝে আড়াল হয়ে খুব হাসতাম।
তারপর ও উচ্চস্বরে একটা হাসি দিয়ে বলল,
:পাগল একটা!

সত্যিই! পাগল আমি। ওকে ইম্প্রেশ করার জন্যে কত কিছুই না করেছি।ও আমার পাশে এসে বসল।একেবারে গায়ের সাথে গা লাগিয়ে।মিষ্টি সুভাস আসছে ওর গা থেকে।একটু পর আমি ওর হাত ধরলাম। কাউন্টার খালি।মানুষ জন তেমন নেই।কিন্তু কিছুক্ষণ পরেই দেখা যাবে মানুষ কাকে বলে।আমার খুব ইচ্ছে হল ওকে চুমু খাই।কিন্তু লজ্জায় পারছি না।ইতিও হয়ত বুঝতে পেরেছে।তবে কিছু বলে নি ও।শুধু আমার চোখের দিকে তাকিয়ে আছে।আমার চোখ গেল ওর গোলাপি ঠোট দুটোতে।আমার কি হল আমি জানি না।চট করেই ওকে চুমু খেলাম।অনন্য শিহরন জাগানো চুমু।আহঃ।অসাধারণ সেই অনুভুতি।

ও কিছুক্ষণ আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।যেন বিশ্বাস করতেই পারছে না।আমি কিছু বললাম না।লজ্জায় মাথা নিচু করে রাখলাম।ও আমার বাঁ হাত চেপে ধরে বলল,
:অসভ্য একটা! এখন আবার লজ্জাও পায়।
এই বলে মেয়েটা আমার বাজুতে মাথা রাখল।বাঁ পাশটার শুন্যতা যেন ফুরিয়ে গেল।ক্ষত গুলো যেন ভালোবাসায় ভালো হয়ে গেল।কয়েক মূহুর্তের জন্যে যেন কষ্ট গুলো হারিয়ে গেল।সেখানে স্থান পেল একটু ভালোবাসা।একটু ভালোবাসা।
কিছুক্ষণ পরেই উদিত হবে নতুন সূর্য।রচিত হবে একটা নতুন ভালোবাসার গল্প।যেখানে হারিয়ে যাবার ভয় খুব ক্ষীণ।

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত