শূণ্যতায় বাস

শূণ্যতায় বাস

১।
সকালের ফ্লাইটে নেমেই এয়ারপোর্ট থেকে সরাসরি অফিসে এসেছে হাসান। এক সপ্তাহ না থাকায়, অফিসের কাজে স্বাভাবিকভাবেই কিছুটা চাপ পড়েছে। যদিও এ কয়দিন নীলা তার নিজস্ব এমব্রোডায়েরি এর বিজনেস দেখার পাশেও হাসানের এক্সপোর্ট ইমপোর্টের ব্যবসার যতটুকু পেরেছে দেখেছে। এছাড়া ফোন ও ইন্টারনেট তো আছেই। তারপরেও নিজের উপস্থিতি ব্যবসায় একটি বড় বিষয়।
টেবিলের উপরে বেশ কিছু স্টিকারে ইংলিশে নোট লেখা। যেগুলো বিষয়ে নীলা বুঝতে পারে নাই, সেগুলির নোট। প্রথমেই কোম্পানি কোড, তারপরে অর্ডার নাম্বার, শেষে যে বিষয়গুলোতে তার মনে হয়েছে দেখা দরকার, সেগুলো কম কথায় স্পষ্ট করে লিখে রেখেছে। নীলা হাসানের চেয়ে বিজনেস বিষয়টি কোন অংশেই কম বোঝে না। নীলা হাসানের চেয়েও বেশী গোছান। দুজনকেই অসম্ভব ব্যাস্ত সময় কাটাতে হয়। নতুন আরও দুটি বিজনেস শুরু করার পথে এখন হাসান ও নীলা। হাসানের নিজস্ব বিজনেস প্রথম আট বছরে যা এগিয়েছে, নীলা আর হাসান মিলে তার পরবর্তী সাত বছরে এগিয়ে নিয়েছে অনেক অনেকগুন। দেশের উদীয়মান ব্যবসায়ীদের নাম আসলে, সবার আগে হাসান আর নীলার নাম আসে।
অফিসে সকাল নয়টায় ঢুকেই হাসান দ্রুত তার ক্যালেন্ডার দেখে শিডিউল ফিক্স করে। সাড়ে দশটা পর্যন্ত ফাইলে সিগনেচার আর নীলার লিখে রেখে যাওয়া নোটের কাজগুলো করা। মোসলেম চৌধুরী ট্রাষ্টি বোর্ডের সাথে মিটিং সাড়ে দশটা থেকে সাড়ে এগারোটা। মোসলেম চৌধুরী হাসানের পিতার নাম। সাড়ে এগারোটা থেকে বারটা পর্য্যন্ত – এবার প্রথম মোসলেম উদ্দিন স্বর্ণপদক পেতে যাচ্ছে যে মেয়েটি, তার সাথে সাক্ষাৎ। হাসানদের থানা শহরের কোন স্কুল থেকে মেট্রিকে এই মেয়েটি প্রথম রংপুর বিভাগের মধ্যে সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছে। হাসানের ভাল লাগে। হাসান তার ব্যবসার বাইরেও কিছু সমাজসেবামূলক কাজ করে। তার বাবার নামে স্কলারশিপ সহ বেশ কিছু সেবামূলক প্রতিষ্ঠান সে চালায়, এলাকায় যদিও খুব একটা যাওয়া হয় না।
ঠিক সাড়ে এগারোটায় হাসান তার বোর্ড রুমে যায়। মেয়েটির সাথে সে ছবি তুলে। এখন মেয়েটি ও তার গার্ডিয়ানের সাথে খানিকক্ষণ কথা বলবে হাসান। সেটির উপরে ভিত্তি করে পত্রিকার নিউজের বাইরেও, তার কোম্পানির বাৎসরিক রিপোর্ট ও ক্যালেন্ডারে হয়তোবা সেই ছবি শোভা পাবে। হাসান তার পিএসকে বলে, ওনাদের তার অফিসে নিয়ে আসতে।
রুমে আসার পরে হাসান মেয়েটিকে অফিসের একটি প্যাড দিয়ে বলে, তার অনুভুতি লিখতে।
হাসানের হাতে মেয়েটির বায়োডাটা। হাসান চোখ বুলায় তাতে। নাম – দিলরুবা আখতার। পিতা – মোঃ মোবারক আলী। মাতা – রোখসানা আখতার। মেয়ের নাম মায়ের নামের সাথে মিল রেখে রাখা হয়েছে। মেয়েটি দেখতেও হয়েছে অবিকল তার মায়ের মত। কতটুকু মায়ের মত? সেটি হাসান ছাড়া কেউ বুঝতে পারবে না। রোখসানা আখতার নামটি হাসানের কাছে বড্ড অপরিচিত লাগে। রেশমী। সেদিনের সেই রেশমী নামের মেয়েটিই যেন তার সামনে বসে প্যাডে তার অনুভুতি লিখছে। মেয়েটির পাশে বসে থাকা তার মা, রেশমীর দিকে হাসান চোখ তুলে তাকাতে পারছে না।

২।
রেশমী প্রথমে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকলেও শেষে রাজী হয়েছিল বাসা থেকে বেড়িয়ে এসে কোর্ট ম্যারেজ করতে। কিন্তু, হাসান বলেছিল –
– আমাদর দুই পরিবারেরই সম্মান আছে। পালিয়ে কেন? তুমি বাসায় বলে বিয়েটা আটকাও।
হাসান আসলে পরিবারের মান সম্মানের চেয়ে বেশী ভয় পেয়েছিল, অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে। তাই, বিষয়টি রেশমীর উপরে নিজের অজান্তেই চাপিয়ে দিয়ে নিজেকে নির্দোষ ভাবতে চাইছিল। রেশমি তখন ইন্টার পাশ করেছে সবে। হাসান বিশ্ববিদ্যালয়ে থার্ড ইয়ারের মাঝামাঝি। রেশমির বাবা হাই স্কুলের শিক্ষক, হাসানের স্যার। রেশমিকে ছোটবেলায় কয়েকবার দেখলেও, ইন্টার পাশ করার পরে প্রথম হাসান মনের চোখ থেকে রেশমীকে দেখে ওদের বাসায়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে যাবার আগে হাসান স্যারের সাথে দেখা করতে আসে। বাসার গেটে প্রায় দুজনের মধ্যে ধাক্কাটা লেগেই গিয়েছিল। রেশমী তখন ক্লাস টেনে। তার কিশোরী সুলভ আচরনে সে হাসছিল আর দৌড়িয়ে কোন কারণে বাসা থেকে বেরোচ্ছিল। একদম এত কাছ থেকে হাসান সেদিন রেশমীর মুখটা দেখেছিল যে, এখনও সেই মুখটা হাসান চোখ বন্ধ করলে দেখতে পায়। হাসান রেশমীর শরীরের একটি গন্ধও পেয়েছিল, স্পষ্ট মনে আছে। এক অদ্ভুত সুন্দর মাদকতায় ভরা এক ভিন্ন জগতের গন্ধ মনে হয়েছিল হাসানের কাছে। কয়েক মুহুর্ত, কয়েক মুহুর্ত পরেই রেশমী স্বাভাবিক হয়ে হাসানকে বাসায় যেতে পথ ছেড়ে দেয়। রেশমীর লজ্জিত লাল মুখ দেখে হাসান বুঝেছিল, রেশমী বড় হয়ে গেছে। পরের দুই সপ্তাহ হাসান শুধু যেন একটি সমুদ্র সম ভালবাসায় ভেসেছে আর ডুবেছে। তিন সপ্তাহের মাথায় প্রস্তাব ও একমাসের মধ্যেই প্রেম। এরপরে তিনটি দুর্দান্ত বছর। রেশমীর দাদার ইচ্ছে অনুযায়ী, পাশের থানার প্রাইভেট কলেজের শিক্ষকের সাথে রেশমির বিয়ে হয়ে যায়।
রেশমীর বিয়েটা হাসানের জীবনে একটি ছোট, কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনে। হাসানের রেজাল্ট থার্ড ইয়ার পর্যন্ত বেশ ভালই ছিল। হাসান পড়ালেখায় অমনোযোগী হয় এবং যে অনিশ্চিত জীবনের জন্য হাসান রেশমীকে নিয়ে পালিয়ে যেতে ভয় পায়, সেটিকে জয়ের নেশা পেয়ে বসে। কম্পিউটার এক্সেসরিজ কিনে বিক্রি করা দিয়ে হাসানের অর্থোপার্জনের শুরু, সেটির শেষ কোথায় হাসান নিজেই জানে না। কিন্তু এই চল্লিশ ছুঁই ছুঁই বয়সেই হাসান কয়েকশত কোটি টাকার মালিক। অনিশ্চয়তাকে হাসান জয় করে ফেলেছে।
টুংটুং করে মধুর স্বরে এলার্ম বেজে উঠে। সময় পৌনে বারটা। হাসান ফোন করার আগেই মেধা ফোন করেছে। মেধা তাদের একমাত্র পাঁচ বছরের মেয়ে, ঢাকার একটি নামকরা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে কেজি ওয়ানে পড়ে। এই সময়টিতে মেধা স্কুল থেকে ফিরে। ফেরার পরে সে বাবার সাথে কথা বলে। কথা হয় ইংরেজীতে। হাসান মেধার অনুরোধের জিনিসগুলি টুকে নেয় স্টিকি নোটে। পাঠিয়ে দেয় অফিসের পিএস মেয়েটিকে। মেয়েটি তড়িৎকর্মা। সে জিনিসগুলো কিনে সুন্দর করে প্যাক করে গাড়ীতে রেখে দিবে।

৩।
হাসান রেশমীর মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করে –
– কি হবার ইচ্ছে বড় হয়ে?
– বাবার মত শিক্ষক হব।
হাসানের হটাৎই মনে একটু ধাক্কা লাগে। সে তো নিজেও শিক্ষক হতেই চেয়েছিল। মেয়েটির বাবা তো সেও হতে পারত। এসব কি ভাবছে? ভেবে, হাসান ফিরে আসে বাস্তবতায়। মেয়েটিকে বলে –
– তোমার নানা কিন্তু আমার স্যার ছিলেন। খুব ভাল পড়াতেন।
– জ্বী আমি শুনেছি। আপনি তো খুব একটা গ্রামের বাড়ীতে যান না।
এ পর্য্যায়ে, হাসান না পারলেও রেশমীই প্রথম কথা বলে –
– আপনাকে ছোটবেলায় যেরকম দেখেছি, ঠিক সেরকমই আছেন, বদলাননি। ভাবি তো মনে হয় নিজেও খুব ব্যস্ত। একবার দেশে গিয়েছিলেন বিয়ের পরে, তখন দুর থেকে দেখেছিলাম।
– হ্যাঁ, অসম্ভব ব্যাস্ত, ও তো আরেকটি অফিস দেখে।
কেক ও মিষ্টি দেয়া হেয়েছিল নাস্তায়। হাসান এই প্রথম তার খোলসের বাইরে বেড়িয়ে বলে –
– কিছু মনে না করলে লাঞ্চ করা যেত একসাথে। অফিসেই লাঞ্চের ব্যবস্থা আছে। বারটা তো প্রায় বেজেই গেল।
রেশমী কিছু বলার আগেই মেয়েটি বলে –
– আংকেল, আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ। প্লিজ কিছু মনে করবেন না আংকেল। আমি ড্রেস সহ আরো কিছু কেনাকাটা করব। কালই রংপুর চলে যাব। ক্লাস শুরু হয়ে যাবে।
রেশমী সাথে সাথেই বলে –
– মেয়েটা এত বড় হয়েছে, কিন্তু নিজে থেকে কিছু কিনতে পারে না। আমাকে লাগবেই।
হাসান প্যাডের কাগজটি রেশমীর দিকে এগিয়ে দিয়ে তাকেও কিছু লিখতে বলে। কাগজটি দেবার আগেই হাসান আরেক দফা অবাক হয় দেখে, চেহারার মত মেয়ের হাতের লেখাও হুবহু মায়ের মতই। হাসানের অকারণেই বুকটায় কেমন জানি একটি শূণ্যতার চাপ অনুভুত হয়। রেশমীদের বিদায় দেবার পরপরই হাসান অনুভব করে, আজ তার কোন কারণ ছাড়াই বড্ড নিঃসঙ্গ লাগছে। সেটি বানের পানির মতই হু হু করে বাড়তেই থাকে। টেবিলের উপরে রেশমী পানির বোতলটা রেখে গেছে। সেটি নিয়ে রেশমীকে ফেরত দিতে ছোটে, হাসানের মত বিজনেস ম্যাগনেট। হাসান বোঝে না যে, পানির বোতল ফেরত দেবার অজুহাতে দেখা করবার বয়স অনেক আগেই পেরিয়ে এসেছে সে।

৪।
লিফটের ভেতর হাসানের হটাৎই মনে হয় –
– মেধার সমস্ত আব্দার, সমস্ত জিনিস যখনই চেয়েছে, হাসান ও নীলা কিনে দিয়েছে। শেষ কবে হাসান নিজে দোকানে ঢুকে মেধার জন্য কিছু পছন্দ করে কিনেছে? মনে নেই। সবই তো পিএস রেডি করে গাড়ীতে তুলে দেয়। নীলাও একই কাজই করে। অথচ, রেশমীকে এখনও তার মেয়ের জন্য কেনাকাটা করতে হয়। একটা শক্ত ভালবাসার বাঁধন হাসান বোঝে। সাথে এটিও বোঝে যে, সেটি তার পরিবারে অনুপস্থিত। হাসানের আজ মেধার কাছে নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয়।
নিচে নেমে হাসান প্রথমে আশেপাশের গাড়ী দেখতে গিয়ে ভুল বুঝতে পারে। রিক্সা খুঁজতে গিয়ে হাসান দেখে –
– ফুটপাথ ঘেষে মা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। পানির বোতলটা দেখতে গিয়ে হাসান খেয়াল করে, অপর হাতে সে রেশমী ও তার মেয়ের অনুভুতি লেখা প্যাডের পাতাটি ধরে আছে। হাসান পড়ে দেখে, কৃতজ্ঞতা জানানো এবং দোয়ার কথাই লেখা। অফিসের প্যাডের ডানদিকের কোনায় – “সাজেশন” নামে একটি ছোট্ট ঘর আছে। হাসানের চোখ সেখানে আটকিয়ে যায়। রেশমী লিখেছে –
– “রুমে পানির বোতল রাখা উচিৎ ও নিয়মিত পান করা উচিৎ।”
গতমাসে সিঙ্গাপুরে হাসান ও নীলা ফুল মেডিকেল চেকআপ করিয়েছে। হাসানের কিডনিতে সামান্য সমস্যা ধরা পড়েছে, তবে সেরকম কিছু নয়। ডাক্তার প্রতিদিন ৪ লিটার পানি খেতে বলেছে। কাজ আর টাকার মাঝে পানি খাবার মত সময় হাসানের হয়না। প্রথম দুদিন নীলা মনে করে দিলেও, দুজনই সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি প্রচন্ড ব্যাস্ত থাকে। নিজের শরীরটা নিয়ে ভাববার কথা, আজ রেশমীই মনে করিয়ে দিল? পানির বোতলটি কি রেশমী ইচ্ছে করেই রেখে গিয়েছে? তার তো হাসানের অসুস্থ্যতা জানবার কথা নয়। হাসানের প্রচন্ড তৃঞ্চা পায়। হাসান রেশমীর হাতের ছোঁয়ামিশ্রিত পুরো বোতলের পানি, এক চুমুকেই শেষ করে। মনে হয়, যেন বহুদিন পরে আজ সে পানি পান করল। পানি পানে যে এত আনন্দ ও স্বাদ থাকতে পারে, হাসান আজ সেটিও বোঝে। রেশমী ও তার মেয়ে ফুটপাথ ঘেষে হেঁটে যাচ্ছে এখনও। যে অনিশ্চয়তায় হাসান রেশমীকে পেয়েও হারিয়েছে, সেই হাসানের এখন ব্যাংক ভর্তি টাকা। কিন্তু, নিজেকে কেন জানি না, হাসানের আজ খুব অসহায় মনে হয়। বুকটা চৈত্রের কাঠ ফাটা রোদে যেন চিড় ধরা মাটির মত মনে হয় তার কাছে।
দুরে রেশমি ও তার মেয়ে…. হেঁটে যাচ্ছে… হাসান ঝাপসা দেখে…

৫।
মতিঝিলের একটি বহুতল ভবনের নীচে, বাংলাদেশের একজন বিলিওনিয়ার বিজনেস ম্যাগনেট দাড়িয়ে –
– “চোখে জল, বাম হাতে প্যাডের একটি কাগজ আর তার তৃঞ্চার্ত ও শূণ্যতায় ভরা মনের মতই ডান হাতে শূণ্য একটি পানির বোতল।

গল্পের বিষয়:
অন্যান্য
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত