কালো মায়াবতী

কালো মায়াবতী

একটা মেয়ের সাথে নাকি আমার বিয়ের কথাবার্তা চলছে। ভদ্র পরিবার, মেয়ের শিক্ষাও ভালো। বিএসসি পাশ। বয়স একটু বেশী, ২২ বছর। মেয়েটা নাকি একটু কালো। তাই পাত্রপক্ষ আগে বাড়ে না। আমার চাচাজান সে মেয়েটিকেই আমার জন্য পছন্দ করলো।
.
মেয়েটিকে আমি দেখেছি ঢাকা থাকার সময়। মেয়ের মামা একটা ছবি ডাকের মাধ্যমে পাঠিয়েছেন। আহামরি তেমন কিছু না মেয়েটা। একটু শ্যাম বর্ন। কিন্ত চিঠিতে তো লিখলো,মেয়েটি নাকি কালো।
আমি ছবির খামটা হাতে নিলাম। ইটালিয়ান হরফের স্টাইলে লিখা আছে,”রঙ্গিলা স্টুডিও”। ছবিটাতে আলাদা কাজ করা হয়েছে জানি। সে যাই হোক, আমার এতো কিছু না দেখলেও চলবে। তবে আমার নজর কেড়েছে মেয়েটির দু চোখ। চোখ যে এত সুন্দর হতে পারে, তা আমার জানা ছিলো না। যে দেখেছে মেয়েটির ও দুচোখ,সে কখনো ভুলতে পারবে না। আমি শিওর, এই চাপা মেয়েটার চোখের প্রেমে অনেকেই ডুব দিয়েছিলো। আমিও ডুবে গেলাম। এই মেয়েটির প্রেম সাগরে। মেয়েটিকে আমার চাই ই চাই।

গ্রামে ফিরে এলাম। দীর্ঘ বিশ বৎসর পর। কেনো এতোদিন আসিনি, সেটা আরেক ইতিহাস। ক্রমান্বয়ে বলবো।

আজ আমার বিয়ে। চাচা,কাজিন,এলাকার কয়েকজনকে নিয়ে আমি বিয়ে করতে গেলাম। রিক্সায় চড়ে।
রিক্সাটির নাম,”ছাবেরা পরিবহন” তার নিচে লিখা “বিবাহের জন্য রিজার্ভ দেয়া হয়”। আট মাইল দূর থেকে ভাড়া করে আনা হয়েছে। গঞ্জ থেকে। গঞ্জের একমাত্র রিক্সা। বিবাহের সময় কাজে লাগে। আমরা মেয়েদের বাড়ি এসে গেছি। আমি সামনে এগুচ্ছি, চাচা বললো,রুমাল কই? নাকে মুখে রুমাল দাও। আমি বললাম, আনি নি তো। চাচা এমন করে তাকালো,যেনো মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে গেছে।
.
মেয়েদের কোনো আহামরি আয়োজন ছিলো না। এরা নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। আমাদের পরিবারও আগে এমন ছিলো। ছোটো বেলায় মা বাবাকে হারিয়েছি। ছোটো চাচার কাছে ছিলাম কিছুদিন। তারপর যে কোনো এক কারনে ঢাকা চলে যাই। বাকীটা ইতিহাস। আর আসিনি। এইবার এলাম,বিয়ে করতে। চাচার সাথে চিঠিতে যোগাযোগ হতো। যাই হোক, মেয়ের বাবা নাকি বিশ হাজার টাকা আর এক ভরি স্কর্ণ দেবেন।
আমার চাচা দেনমোহর ধার্য করেছেন ত্রিশ হাজার টাকা। এসবে আমার কোনো মাথা ব্যাথা নেই। আমি মেয়েটিকে চাই। আর কিছু নয়।
.
বিয়ে করে বৌ নিয়ে আসলাম। চাচাতো ভাই বোনেরা সবাই খেপাচ্ছে আমাকে। “কালীর জামাই” বলে।
আমি এসব গায়ে মাখাচ্ছি না। আমি ডুবে আছি আমার স্বপ্নে। কখন কালো কাঁজল ডাগর ডাগর আঁখি দুটি দেখবো। কতটা মায়া সে চোখে নিয়ে আমার দিকে তাকাবে আমার বৌ? ইশ্…….. আমার যে আর তর সইছে না গো…..! কতক্ষন বসে ছিলাম জানিনা। ধ্যান ভাঙ্গলো পাশের ঘরের ভাবির কটুক্তি তে। কি ভাইসাব? খবর কি? বিবি ঘরে আইনা দেখি একেবারে ধ্যানে চইলা গেলা? হি হি হি….. যাও, যাও…. অনেক রাইত হইছে। শুনো ভাইসাব, ঘর কিন্ত আন্ধার, মোম জ্বালাইয়া দিছি। মোমের আলোয় বিবিরে দেইখা আবার ভূত কইয়া চিল্লাইয়োনা। হি হি হি……..
.
আমি কিছু বলিনি। শুধু হাঁসলাম। গুটি গুটি পায়ে রুমের দিকে এগুতে লাগলাম। খাটের কাছে পৌছে গেছি। মেয়েটি লম্বা ঘোমটা দিয়ে বসে আছে। আমি গলা খাঁকারি দিলাম। মেয়েটি নড়েচড়ে উঠলো। আমি বলতে লাগলাম, তোমার নাম কি? মেয়েটি আস্তে করে বললো, “মাইমুনা আক্তার ইরি” ইরি কোনো নাম? বাবায় রাখছে, আমার কি দোষ? আমি আবার বললাম, শুনো ইরি, আমি তোমার বর। তুমি আমার বৌ। আমি জানি,এতক্ষন অনেক কথার তীক্ষ্ণ বান হজম করেছো। করতে তো হবেই, কারন তুমি কালো। কালো হয়ে জন্ম নেয়া যে আজন্ম পাপ। তবে তুমি এসব নিয়ে ভেবো না। তুমি শিক্ষিতা,রুচিশীল মেয়ে। এসব নিয়ে ভাবলে চলবে না। পৃথিবীর কে কি বললো না বললো,তাতে তোমার কি? আমি তোমার বর। আমি কি বলেছি সেটা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কারো কথায় কষ্ট পেয়ো না। লেগে থাকো,তুমিই পারবো।
কালো তো অনেকেই আছে। এটা পাপ নয়। বরং আশীর্বাদ। বেঁচে থেকো ঠিক ততদিন,যতদিন আমি ভালোবেসে যাবো তোমায়। তুমি আমার অর্ধাঙ্গিনী। মনে রেখো,তুমি আমি একই স্বত্ত্বা। ভয় এবং সংকোচ করো না। আমি তো আছি। কি? ভয় পাবে? নিজেকে ছোটো ভাববে? বলো?মেয়েটি কিছু বলছে না। হঠাৎ করে মনে হলো, ইরির দেহটা কেঁপে কেঁপে উঠছে। আরে,মেয়েটা তো কাঁদছে। আমি তার পাশে বসলাম।
তার দু বাহুতে ধরলাম। আলতো ঝাঁকুনি দিলাম। ইরির মাথার কাপড় সরে গেলো। ইরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে, জল ছলছল চোখে টলমল। আমি ইরির চোখের দিকে তাকিয়ে আছি। আমার দৃষ্টি ফেরাতে পারিনা সে চোখ হতে। মনের মাঝে একটা কথা ধাক্কা দিচ্ছে, ওরে মায়া….. তুই এতো মায়া কেনো? এতোটা মায়াবতী কেনো? কি মায়া! কি মায়া! কি মায়া! মনের অজান্তে মুখ ফসকে বলে ফেললাম, মায়াবতী আমার………
.
সপ্তাহ্ খানেক হলো বিয়ে করেছি।ইরিদের বাড়ি ছিলাম দুদিন। ঢাকা ফেরার সময় হয়ে গেছে। ঢাকা ফেরার আগের দিন চাচীকে বললাম,ইরিকে আমি নিয়ে যাবো। চাচি বললো,নয়া বৌ। কদিন শ্বশুড় বাড়ি থাকুক। মাস দুয়েক পরে এসে নিয়া যাইস। আমি ইরিকে বললাম,কি হলো? যাবে নাকি থাকবে? ইরি বললো,কয়েকদিন থাকি এখানে আর বাবার বাড়ি, তারপর আপনে আইসেন। তখন যামু। আমি আর কিছু বললাম না। সেদিন রাতে আমি আর ইরি অনেক গল্প করেছি। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছিলো। জোরে বজ্রপাতের শব্দে ইরি আমার বুকে মুখ লুকালো। কি হয়েছিলো সেদিন? পদ্মা বান ডেকেছিলো, ভাসিয়ে নিয়েছিলো সব।
আমি আর ইরি সেদিন বৃষ্টির শব্দে আর নদীর বানে ভেসেছিলাম। কুল কিনারা পাইনি সেদিন আমরা কেউ। সব ভেসে যাক,বান সব কেড়ে নিক। আমরা ডুবে থাকি ভালোবাসার নদীতে। ভাসতে থাকি প্রেমের বানে।
.
আমি চলে এলাম ঢাকা। সপ্তাহে দু তিনটা চিঠি আদান প্রদান হয়। মাসখানেক পর একদিন একটা চিঠিতে রক্তের ফোঁটা দেখলাম দু তিনটে। আমার মনটা কেমন জানি করতে লাগলো। কি হয়েছে আমার মায়াবতীর? সাথে সাথে আমি চিঠি লিখলাম। সারাদিন অস্থির ছিলাম। রাতেও ঘুমাতে পারিনি। কখন চিঠি আসবে আমার মায়াবতীর? চিঠিতে ব্লাড কেনো? তিনদিন পর চিঠি পেলাম। চিঠিতে ইরি লিখেছে, তার হাত কেটে গেছে। সেই ব্লাড। আমি যেনো চিন্তা না করি। আমার বুক থেকে পাথর নেমে গেলো। তবে মায়াবতীকে দেখার জন্য মনটা উসখুশ করতে লাগলো। একটু ফ্রী হলেই চলে যাবো গ্রামে। সাথে করে নিয়ে আসবো আমার মায়াবতীকে। মায়াবতী আমার, কালো মায়াবতী।
.
গ্রামে এলাম। আমার গ্রামটা কিন্ত অঁজপাড়াতে। আমার চাচী আমাকে দেখে এগিয়ে এলো। মায়াবতী আড়ালে লুকালো। আমি দেখতে পেলাম। আর মুঁচকি হাঁসলাম। খাবার দাবার কমপ্লিট করে রুমে গেলাম।
মায়াবতী মাথা নিচু করে আছে। আমি শুধু বললাম, তোমার নাকে এটা কিসের দাগ? ইরি চমকে উঠে নাকে হাত দিলো। বললো,কই? কিছু নেই তো। আমি হেঁসে উঠলাম। ইরি কপট রাগের ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকালো। আর আমি দেখতে লাগলাম, রাগলে মানুষ লাল হয়। কিন্ত ইরি তো কালো। লাল আর কালো মিলে তো বেগুনী হবার কথা। কিন্ত ইরিকে দেখতে মোটেও বেগুনী লাগছে না। আর বেগুনী যেহেতু লাগছে না, সেহেতু ইরি কালো নয়। আর এম্নিতেও ইরিকে সুন্দর লাগছে। আমি কিছুক্ষন পর বললাম, কি?
ভালোবাসো আমাকে? ইরি বললো,যাহ্….. বলেই দৌড়ে বাইরে গেলো। দরজার ওপার হতে বললো, দোকানে গেলে একটা সাবান আর স্নো এনো। বলেই পাশের ঘরে চলে গেলো। আমি শুধু মনে মনে বললাম,
বৃথা প্রয়াস। সাবান আর স্নো দিয়ে কি হবে? বন্যেরা বনে সুন্দর, আর ইরি চাপা কালো তে। যাই,মায়াবতীর জন্য সাবান আর স্নো নিয়ে আসি।
.
ইরিকে নিয়ে ঢাকা আসছি। পথে ইরির কত প্রশ্ন! ঢাকা কেমন? সেখানে গেলে থাকবো কোথায়? আমি কি কাজ করি? ঢাকাতে চলতে তো অনেক টাকা লাগে। রাস্তাতে এতো গাড়ি কেনো? এই বিল্ডিংগুলো কার?
এতো বড় বড়! আমি শুধু হাঁসি। বাচ্চাদের মতো প্রশ্ন। কে বলবে,এই মেয়েটা বিএসসি পাশ?! হি হি হি,,,,,,,

একসময় গাড়ি হতে নামলাম। একটা বিল্ডিংয়ের সামনে দাড়ালাম। ইরি হঠাৎ চিৎকার করে উঠলো,
ফারাবী,দেখো দেখো… তোমার নাম। আমি তাকিয়ে দেখলাম। ইরি একটা নেমপ্লেটের দিকে আঙুল তুলে আছে। সেখানে লিখা,”আল-ফারাবী প্লাজা ২” আমি বললাম,চলো। একটু বাড়িটার ভেতর ঢুকি। ইরি বললো,চোর বলে মার দেবে। আমি ভেতরে যাচ্ছি, ইরি আমাকে অনুসরন করছে। বাসার দরজার কাছে আসতেই ইরি থেমে গেলো। সে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। যেখানে ইরির একটা ছবি অনেক বড় একটা ছবি ঝুলানো। আমি বললাম,কি হলো? আসো…… ইরি কিছুই বললো না। আমি ইরির দিকে এগিয়ে গেলাম। ইরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। সে দৃষ্টিতে অবাক বিস্ময়। একটু পর ইরি বললো, কে তুমি ফারাবী? কি কাজ করো তুমি? বলো,কে তুমি? আমি আলতো হাঁসলাম। আর ইরির কানে মুখ নিয়ে বললাম, আমি মায়াবতীর বর। ইরি কেঁদে উঠলো। আমি শুধু বলে উঠলাম,
আহারে…..
আহারে…..
আহারে…..
.
রাতে আমি ম্যাগাজিন পড়ছি। ইরি আমার সামনে এসে বসলো। আমি ম্যাগাজিন হতে মুখ তুলে তাকালাম। ইরি আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কি কঠোর সে দৃষ্টি! ইরি আমার দিকে এভাবে তাকাচ্ছে কেনো? আমি আবার ম্যাগাজিনের দিকে মনোনিবেশ করলাম। কিছুক্ষন পর ইরি হঠাৎ ম্যাগাজিন টা টেনে ছুঁড়ে ফেলে দিলো। আমি বললাম,
—- কি হয়েছে ইরি?
—- কি হবার বাকী আছে ফারাবী?
—- মানে কি?
—- এ বাড়ি কার?
—- আমার।
—- এটার নাম “আল-ফারাবী প্লাজা ২” কেনো?
—- মানে?
—- মানে হলো এটা কি তোমার দুনম্বর বাড়ি?
—- হুম।
—- একনাম্বারটা কোথায়?
—- উত্তরা ৬ এ।
—- কি কাজ করো তুমি?
—- পরে বলবো।
—- এখন বলবে।
—- কি বলবো?
—- কি ককাজ করে দুটো বাড়ি বানিয়েছো?
—- পরে বলবো।
—- এখন বলো।
—- না বললে?
—- গ্রামে চলে যাবো আমি।
—- যাও,চলে যাও।
—- তোমার বলতে প্রবলেম কি?
—- সময় আসলে বলবো।
—- কখন হবে সময়?
পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেলে?
—- মানে?
—- আমার তো মনে হয় তুমি মাদক নয়তো চোরাকারবারি করো।
—- ইরি,মুখ সামলে কথা বলো।
শহরের সব বাড়ির মালিক কি মাদক ব্যাবসা করে?
—- তাদের বিজন্যাসের মূলধন ছিলো।
তোমার তো ছিলো না।
তুমি তো নিম্নবিত্তের সন্তান।
—- আজ উচ্চবিত্ত হলাম।
—- বিশ বৎসর কোথায় লুকিয়ে ছিলে?
—- এসব প্রশ্ন এখন করো না।
সময় হলে আমিই বলবো।
—- না,করবো।
—- রাত তো অনেক হলো ঘুমাও।
—- না,আমার প্রশ্নের জবাব চাই।
তোমার বিশ বৎসর লুকিয়ে থাকা, দুটো বাড়ি করা, বিজন্যাস করা,এসব রহস্য। তুমি রহস্য তৈরী করেছো। এর জট না খোলা অবধি আমি আর তোমার সাথে কথা বলবো না।
—- তো কি করবে?
—- গ্রামে চলে যাবো।
—- সত্যিই?
—- হ্যাঁ। তোমার ড্রাইভারকে বলো, আমাকে গ্রামে দিয়ে আসতে।
—- এখন?
পাগল হয়েছো? এতো রাতে গ্রামে যাওয়া নিরাপদ নয়।
—- আমি তো তোমার কাছেই নিরাপদ নই।
—- ইরি…….
—- আমার নাম উচ্চারন করো না। আমি গেলাম,বাই।
.
আমি পুরো পাথর হয়ে আছি। কি হলো এটা? আমি চোরাকারবারি? আসি মাদক ব্যাবসা করি? ইরি আমার কাছে নিরাপদ নয়? ইরি সত্যিই চলে গেছে? আমার মাথায় কিছু আসছে না। কি করবো আমি? আমি অতলে হারিয়ে যাচ্ছি। পায়ের নিচে মাটির নাগাল পাচ্ছি না। আমি তলিয়ে যাচ্ছি। কেউ তুলতে পারবেনা আমাকে। কি করে তুলবে? কে তুলবে? আমার মায়াবতী ছাড়া? ইরি আমাকে বুঝেনি। বোঝানোর সময়টুকুও দেয়নি। নিজের আপনজন যখন নিজেকে বোঝেনা, তখন যে নিজেকে কতটা অসহায় লাগে,
সেটা বিশ বৎসর আগে একবার আর আর দ্বিতীয়বারের মতো বুঝলাম। খুব ক্লান্ত লাগছে নিজেকে। বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। দু চোখে জলের ধারা। মায়ের মুখটা অস্পষ্ট ভেসে উঠছে চোখে সামনে।
মনে হচ্ছে, মা মাথায় হাত বুলাচ্ছে। আহ্, কি শান্তি। আমার চোখ বন্ধ হয়ে আসছে। আমি ঘুমের ঘোরে চলে গেছি। ঘুমের মাঝেই দেখতে পেলাম, আমি আর ইরি খালি পায়ে ঘাসের উপর হাঁটছি। ইরি হঠাৎ প্রজাপতির পেছনে ছুটতে লাগলো। আমিও তার পেছনে। প্রজাপতি ফুলে গিয়ে বসলো। ঘাসফুলের উপর।
ইরি হাত বাড়িয়ে আছে, কখন প্রজাপতি তার হাতে বসবে। আমি ঘাসের উপর বসে তা দেখছি। ইরি প্রজাপতি ছুঁয়ে দেবার অপেক্ষায়। আমি মনে মনে বলছি, প্রতীক্ষার প্রহর রে….. তুই আর কত দূর? শুনতে কি পাস না রে…. হৃদয় ভাঙ্গার সুর?….
.
ঘুম হতে উঠলাম। ঘড়ির দিকে তাকাতেই আমার চোখ ছানাবড়া! দশটা বাজে?! আমার অফিস! কোনোরকম ফ্রেশ হয়ে অফিসে ছুটলাম।
.
জিএম সাহেব একটা খাম দিয়ে গেলেন। খামটা খুললাম, একি লিখা দেখছি আমি?! বাংলাদেশের বছরের শ্রেষ্ঠ রেমিটেন্স অর্জনকারী প্রতিষ্ঠান হিসে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ হতে আমাকে পুরুষ্কার প্রদান করা হবে। আমার যে বিশ্বাসই হতে চায় না। আমার সকল কষ্ট আজ স্বার্থক। আমার সব স্বপ্ন পূরন হয়ে গেছে।
আসি পেরেছি স্বপ্ন ছুঁতে। আজ আমি পূর্ন। হঠাৎ করেই ইরির কথা মনে পড়লো। আজ তো আমি তাকেই চেয়েছিলাম। কিন্ত সে চলে গেলো। আমাকে একবারো বলার সুযোগ দিলো না। মেয়েরা এমন কেনো গো?
এতো অবুঝ কেনো? হ্যাঁ, বলবো। আমি সব বলবো। আমাকে বলতেই হবে। আমি মাদক ব্যাবসায়ী নই,আমি চোরাকারবারি নই। আমি সৎ ছিলাম। বলবো সব গল্প আমি, আমার বড় হবার গল্প।
আড়ালে থাকা বিশ বৎসরের গল্প। পুরুষ্কার যেদিন পাবো,সেরা রেমিটেন্স এডওয়ার্ড যখন পাবো,তখন সে অনুষ্ঠানে বলবো। ইরি, ভুল বুঝলে কেনো আমাকে? আজ তো তোমাকে দরকার আমার। কেনো তুমি এমন করে রেখে গেলে আমাকে ইরি? তুমি কি জানতে না? আমি কতটা শূন্য ছিলাম। তোমাকে হারানোর অনেক ভয় ছিলো, আমার যত কিছু সবটুকু তোমাকে ধরে রাখার জন্যই ছিলো। আমি মৃত্যু ভয় পেতাম না।
আজও পাই না। কিন্ত প্রতিনিয়ত তোমাকে হারানোর ভয় থাকতো আমার। প্রচন্ড ভয়। কি তীব্র ভাবে আমাকে ঘিরে রাখতো শীতল স্পর্শে। আমি সরাতে চাইলেও ভয়টা সরতো না। কিন্ত দেখো,আজ তুমি ঠিকই হারিয়ে গেলে। ভয়ের জয় হলো, ফারাবী হেরে গেলো। এই প্রথমবার হেরে গেলাম আমি। তুমি জানোনা, কতটা শূন্য আমি। তবে যাবার বেলায় আমাকে পূর্ণ করে দিয়েছো তুমি। বুকের পাঁজরের প্রতিটা খাঁজ কষ্টে ভরা। হৃদয়টা ও কষ্টে ভরে গেছে। কি নিদারুন কষ্টে আমি পূর্ন হয়ে গেলাম।
.
আজ আমি দাড়িয়ে আছি ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিস্টিটিউটে। আজ আমাকে স্বীকৃতি প্রদান করা হবে দেশ সেরা রেমিটেন্স অর্জনকারী হিসেবে। আমাকে সম্মানিত করা হবে পুরুষ্কার দ্বারা। কিন্ত সেদিকে আমার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। আমার মন ছটফট করছে, ইরির জন্য। ড্রাইভারকে পাঠিয়েছি ইরিকে আনার জন্য। ইরি কি আসবে? নাকি সে আসবেনা? না,তাকে আসতেই হবে। আমার জীবনের গল্প শোনার জন্য। যা এতোদিন গোপন ছিলো। মঞ্চে বক্তৃতা দিচ্ছেন বানিজ্য মন্ত্রী। তার কথা আমার কানের আশেপাশে ঘুরপাক খাচ্ছে,
মস্তিষ্কে নয়।
.
আমার ডাক পড়লো। আমাকে কিছু বলতে বলছে। আমি ধীর পায়ে এগিয়ে যাচ্ছি মঞ্চের দিকে। এক পা সামনে আগাই, আবার পেছন ফিরে তাকাই। যদিবা ইরির দেখা পাই। কিন্ত ইরির দেখা নাই। মঞ্চে গেলাম। সবাই আমার দিকে তাকিয়ে আছে। হয়তো আমার সফলতার গল্প শোনার জন্য। আজ আমি বলবো। সব বলবো,না বলা কথা। আমি শুরু করলাম।
.
আসসালামু আলাইকুম। আমি আল-ফারাবী। আল-ফারাবী গ্রুপ বাংলাদেশ লিমিটেডের প্রতিষ্ঠাতা এবং পরিচালক। আমার আজকের বড় হওয়া, ই এ্যাওয়ার্ড পাওয়া এতো সহজ ছিলো না। আমি ছিলাম অঁজপাড়াতে জন্ম নেয়া নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান। আমার বয়স যখন পাঁচ বৎসর, তখন রোড এক্সিডেন্টে আমার মা বাবা মারা যান। আমি জানিনা,তখন আমার কি পাপ ছিলো। স্রষ্টা কেনো এতোবড় শাস্তি আমাকে দিলেন। আমি মা বাবা ছাড়া বড় একা। এগিয়ে এলেন আমার চাচা। নিজের কাছে রাখলেন আমাকে। তিনিও নিম্ন বিত্ত। তার দুটো ছেলে একটা মেয়ে ছিলো। অভাবের সংসার। একবেলা খেলে দুবেলা খেতে পারতাম না। বড়ই কষ্টে ছিলাম।  স্কুলে ভর্তি হলাম। পাশাপাশি ছাগল চরাতাম। ক্লাস করতে পারতাম না। আমি যখন ক্লাস থ্রী তে উঠি, তখন আমার চাচার ছোটো ছেলে চাচার পকেট থেকে একশো টাকা চুরি করে। তখন যা চাচার কাছে অনেক টাকা। কিন্ত দোষ চাপে আমার উপর। আমার চাচী আমাকে অনেক মেরেছেন সেদিন। আগেও মারতেন,তবে সেদিন এতো মেরেছেন যে, শরীরের কয়েক জায়গা থেকে রক্তও বেরিয়েছে। তারপর আমার চাচাতো ভাই দুজন আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেয়। আমি দুর্বল, তার উপর জ্বরও এলো। সেদিন রাতে অনেক বৃষ্টি হয়েছে। সারারাত বৃষ্টিতে ভিজলাম। সকালে কোনোরকম বড় রাস্তায় এলাম। একটা ট্রাকের উপর উঠলাম।তারপর ঘুম। ঘুম ভাঙ্গার পর দেখি, আমি রাস্তার উপর আর অনেক লোক আমাকে দেখছে। আমি ভয় পেয়ে কান্নাকাটি করি। ট্রাকের হেলপার আমাকে মারতে উদ্যত হয় চোর বলে। আশেপাশের লোকজন দেখছে। অবস্থা যখন বেগতিক, তখন কোথা থেকে এক ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন। তিনি আমাকে তুলে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেলেন।
.
তারপর তার বাসায়। তিনি আমাকে ট্রিটমেন্ট করালেন। তার নাম ছিলো শিবলী চৌধুরী। উনার কোনো সন্তান ছিলো না। আমাকে সন্তানের মতো করে বড় করতে লাগলেন। আমি উনাকে বাবা ডাকি। স্কুল, কলেজ পার করে ঢাকা ভার্সিটি থেকে পদার্থবিজ্ঞান এ মাস্টার্স কমপ্লিট করি। তারপর বিজন্যাস দেখাশোনা করি। এদিকে আমার নিজের চাচার সাথে চিঠিতে কথা হতো। আমার চাচা জানে,আমি একজন রিক্সাচালক। এখানে এসে অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত পড়েছি। উনি আমাকে বাড়ি যাবার কথা বলেছেন। সেই সাথে বিয়ে করারও। আমাকে একটা মেয়ের ছবি দিয়েছিলেন। মেয়েটি কালো,শিক্ষিতা তবে মায়াবতী। আমি বিয়ে করেছিলাম কালো মায়াবতীকে। অনেক ছোটো পরিসরে আয়োজন ছিলো। আমার শ্বশুর পেশায় কেরানী। এ নিয়ে আমার কোনো দুঃখ নেই। কেননা,মায়াবতী আমার। কালো মায়াবতী চিরকাল আমার।
আমি আমার মায়াবতীকে নিয়ে যখন আমার বাসায় আসি, তখন সে চমকে উঠে। আমাকে নানা প্রশ্ন করতে থাকে। এই বাড়ি,গাড়ি কার? কিভাবে বানিয়েছি? আমি কি করি? শেষ পর্যন্ত সে আমাকে মাদক ব্যাবসায়ী আর চোরাচালানকারী হিসেবে আখ্যায়িত করেছে। আমি তাকে কিছু বলতে পারিনি। আমি আজকের দিনের অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্ত সে অপেক্ষায় থাকেনি। সে চলে গিয়েছে। আমি তাকে আনার জন্য গাড়ি পাঠিয়েছি। কিন্ত সে এখনো আসেনি। আমি জানিনা,সে আসবে কিনা? আমি তাকে বলতে চেয়েছিলাম, আমার জীবনের গল্প। আমার লুকিয়ে থাকার বিশ বৎসর। আমার আজকের রেমিটেন্স এ্যাওয়ার্ড পাবার পেছনের গল্প। কিন্ত সে শুনেনি। আমি কি তাহলে হারিয়ে ফেলেছি আমার কালো মায়াবতী কে। হারিয়ে ফেলেছি আমি।
.
এইটুকু বলে আমি থামলাম। মঞ্চের সবাই আর দর্শক শ্রোতারা তাকিয়ে আছে আমার দিকে। আমি তাকিয়ে আছি হলরুমের দরজার দিকে, যদি বা ইরি আসে। কিন্ত ইরি আসছেনা। মাথা নিচু করে আছি। চোখ জলে ভরে গেছে। টিস্যু দিয়ে চোখ মুছতে লাগলাম। এমন সময় শুনতে পেলাম, কে যেনো বললো, “ফারাবী” আমি চমকে উঠে তাকালাম। আরে, সামনে তো ইরি। আমার কালো মায়াবতী। আমি তার দিকে তাকিয়ে হেঁসে দিলাম। মায়াবতী কাঁদছে। আমি মঞ্চ হতে নামলাম। ইরির হাত ধরলাম। ইরিকে মঞ্চে নিয়ে আসলাম। আরি ডুকরে ডুকরে কাঁদছে। আমি হাঁসছি,যদিও চোখে জল। বিজন্যাস এসোসিয়েশানের সভাপতি আর বানিজ্যমন্ত্রী আমার হাতে এ্যাওয়ার্ড তুলে দিলো। আমি সেটা দিয়ে দিলাম ইরিকে। ইরি আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পড়লো। আমি ইরিকে জড়িয়ে ধরলাম। সবাই হাততালি দিচ্ছে। আমি চোখ বন্ধ করে আছি। চোখের সামনে ভেসে উঠলো, ইরি খালি পায়ে ঘাসের উপর বসে আছে। তার সামনে সেদিনের প্রজাপতিটা। প্রজাপতিটা হঠাৎ করে ইরির হাতের উপর বসলো। ইরি বাচ্চাদের মতো হাঁসতে লাগলো।
ওমা গো…..
কি সুন্দরটাই না লাগছে আমার মায়াবতীকে। আমার কালো মায়াবতীর হাঁসির ঢেউয়ে বাঁধ ভেঙ্গে উছলে পড়লো ভালোবাসা আমার। আমি শুধু তাকিয়ে দেখতে লাগলাম। আর আস্তে করে এগিয়ে গেলাম তার দিকে। কানের কাছে মুখ নিয়ে শুধু বললাম, অপূর্ব সুন্দর……..
.

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত