মেঘ নেমে এলো,সোনা ঝরা রোদ্দুরে

মেঘ নেমে এলো,সোনা ঝরা রোদ্দুরে

আজ খুব খুশি খুশি লাগছে অনন্তকে। সকাল সকাল ঘুম ভেঙ্গে গেছে খুশিতে। এমনিতে বেলা এগারোটার আগে বিছানা থেকে উঠা হয়না। সকালের নাস্তা দেরীতে করার জন্য প্রতিদিন মায়ের অনেক বকা শুনতে হয়। কিন্তু আজ খুব সকালেই উঠতে হলো। কতদিন পর সকালের লাল সূর্যটা দেখা গেছে! কতদিন ঠিক মনে পড়েনা। মনে পড়ে শৈশবে গ্রামে থাকা অবস্থায় মক্তবে যাওয়ার জন্য প্রতিদিনই খুব সকালে উঠতে হত। কি যে বিরক্তিকর ছিলো ওই জাগরণ।

মক্তবে যাওয়া পর্যন্ত সারা পথে চোখে রাজ্যের ঘুম লেগে থাকতো। মক্তব মাঠে সবার চেচামেচি আর হুজুরের বেত দর্শনই ঘুমটা সরাতে পারতো। অথচ আজ সকালে জেগে উঠাটা কত আনন্দের। কি এক অদ্ভূত অস্থিরতা কাজ করছে বুকের ভেতর। একবার এই সকালেই পিসিটা খুলে রবীন্দ্রসংগীত শোনা হলো। ‘আমার ও পরানো যাহা চায়’ থেকে ‘আমার হিয়ার মাঝে’। রবীন্দ্রসংগীত শোনার মধ্যেই আকাশ দেখতে ভীষম ইচ্ছে হলো অনন্ত’র। আকাশটা বড্ড রঙ্গিন। পূব আকাশে যেন আগুন লেগে আছে। নীরাকে ফোন দিতে ইচ্ছে করছে। দেয়া যায়? না এখন তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে লাভ নেই। বেচারী ঘুমাক। একটা সময় সকাল সকাল আকাশ না দেখে ও ঘুম ভাংতো অনন্তর। খুব ভোরে নীরার ফোন দেয়ার বাতিক ছিলো। রাজ্যের ঘুম নিয়ে অনন্ত এই ফোনের অপেক্ষায় থাকতো। নীরার ফোন ছিলো স্বপ্নের মতো। কত ইচ্ছে, আকাঙ্ক্ষা আর গল্প জায়গা পেত নীরার মুখে। অথচ আজ অনেকদিন সকালে নীরার সাথে কথা হয়না।

অনেকদিন অনন্তর ঘুম ভেংগে যেত নীরার ফোনের অপেক্ষায়। অপেক্ষায় ক্লান্ত হয়ে চিৎকার দিতে ও ইচ্ছে করতো। আর নীরবে চোখের জল তো সামান্য ব্যাপার। কথা কিন্তু অন্য সময়ে ও হত না। নীরা কি এক অদ্ভূত কারণে যোগাযোগ বন্ধ করে দিল। শত অনুনয় ও পারেনি নীরার মন গলাতে। প্রতিদিন নীরার ফোনের অপেক্ষা করতে করতেই অনন্তর সময় কেটে যেত। দুনিয়ায় আর কোন বিষয় থাকতে পারে, অনন্তর ভাবনায় নিশ্চয় থাকেনা। অনন্ত’র দিন কাটতো নীরার সাথে কথা বলার অপেক্ষায়, রাত কাটতো কি অসহ্য যন্ত্রণায়, নীরার সাথে কথা বলতে না পারায়। সকাল টা ও ভীষম মন খারাপে, নীরার কন্ঠ শোনা যায়না। এই দিনগুলোকে অনন্ত ভূলে যেতে চায়। কষ্টের দিনগুলো মনে রেখে কি লাভ? নীরা নিশ্চয় তার ভূল বুঝতে পেরেছে। না হলে গতকাল ফোন দিয়ে আজ দেখা করার কথা বলতোনা। কি মিষ্টি কন্ঠেই না তার উচ্চারণ ছিলো, ‘’অনন্ত, কেমন আঁছো? আগামীকাল ক্যাফে ভিক্টোরিয়ায় আসতে পারবা?’’। অনন্ত’র না করার সাহস কিংবা ইচ্ছে কোনটিই ছিলোনা।

সে শুধু বলতে পেরেছিলো, কখন? বিকেল তিনটায়, তখন রোদ তেমন উত্তপ্ত থাকেনা – নীরার উত্তর। এরপরই আম্মু পাশে বলে ফোন কেটে দিয়েছিলো নীরা। আহা! কি অদ্ভূত মাদকতা। অনেকদিন পর অনন্ত এতো খুশি। নীরার এতোদিনের দুরত্ব পোষে রাখার জন্য তার কোন অনুযোগ নেই। নীরা যখন স্যরি বলবে, এতেই সব কষ্ট ভূলা যাবে। আর কিছু বলতে না দিয়ে জড়িয়ে ধরতে হবে পাগলী টাকে। নীরা আর অনন্তের পরিচয় আর যোগাযোগের গল্পটা একটু বলে নেয়া যাক। অনন্ত বরাবরই নিরীহ গোছের ছেলে। সারাক্ষণ চুপচাপ থাকতেই পছন্দ। সারাদিন ঘরে বসে টিভিতে ক্রিকেট নিয়ে মেতে উঠতেই তার পছন্দ। সাকিবদের জায়গায় নিজেকে ভেবে ক্রিকেট দেখার মজাটাই অন্যরকম। এইচ এস সি’র পর বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তির জন্য একটা কোচিং সেন্টারের শরনাপন্ন হয়েছিল সে। সবাই কোচিং সেন্টারে যাচ্ছে দেখে তাকে ও পরিবারের চাপে এখানে আসতে হলো। নতুন নতুন কিছু মুখ। বড্ড পানসে লাগছিলো। সবাই কত সিরিয়াস, একা অনন্তই যেন এখানে সময় কাটানো মোডে।

অনন্ত’র কাছে কোচিং এর বিষয়াদি ভাববার মতো মনে হয়না। অধিকাংশই তো আগে পড়া। তাই কোচিং পিরিয়ডে বার বার বাইরে বের হওয়া, পত্রিকার খেলার পাতা পড়া নিয়েই সময় কাটে তার। এভাবেই সময় যাচ্ছিলো। কয়েকটা ক্লাশ পরই তাদের মডেল টেস্টে অংশ নিতে হয়েছিলো। ওখানেই নীরা চরিত্রের আগমণ। কিভাবে যেন ওই মডেল টেস্টে অনন্তই সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়েছিলো। অবাক অনেকেই, অবাক অনন্ত ও। সবাই সিরিয়াস তার মাঝে সে কিভাবে? যাই হোক এই সর্বোচ্চ নাম্বার প্রাপ্তির কারণে তার সাথে পরিচিত হতে চাওয়া কিংবা কথা বলতে আগ্রহী সহপাঠীর সংখ্যা বেড়ে গিয়েছিলো। নীরা ও তাদের একজন। নীরারা তিন বান্ধবীর একটা দল ছিলো। তাদের মধ্যে দেখতে মোটাসোটা অন্তুই এসে কথা জুড়েছিলো। এতো অবহেলার পর ও সর্বোচ্চ নাম্বার পাওয়ার রহস্য কি? এরপর কথা, আড্ডা, গান। হ্যা, নীরা তাদের মধ্যে প্রাণবন্ত স্বভাবেরই মেয়ে। কত কথা যে বলতে পারে। দেখতে ও বেশ। অনন্তর হঠাত ভালো লাগতে শুরু করে। তার মধ্যেই একদিন নীরা মেয়েটি জানান দেয় তার ভালোবাসার। অনন্ত’র না করার কোন কারণ ছিলোনা। এরপর কত উচ্ছাসেই না দিন যাচ্ছিলো। কোচিং সেন্টার থেকে ক্যাফে হাউজ।

লেকের পাড় থেকে সবুজ উদ্যান। কত বিচরণ। হাসি গান আর পাশাপাশি হাত ধরা দুজন। যেন স্বপ্ন কথা বলা শুরু করছিলো তাদের দুনিয়ায়। সারাদিন পাশাপাশি গল্পের পর সারা রাত কেটে যেতো সেলফোনের কথোপকথনে। কতো মুঠোবার্তা চলতো। পূর্ণেন্দু পুত্রীর কথোপকথন নির্ঘাত ফেল তাদের কথামালায়। এর মধ্যেই অনন্ত ভর্তি হয় একটা পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর নীরার কোথাও হয় না। সে পরবর্তীতে প্রাইভেট ভার্সিটিতে ভর্তি হয়। এরপর কয়েকমাস চুটিয়ে আড্ডা হতো। এখানে সেখানে, সেলফোনে। এরপরই নীরার ব্যস্ততার শুরু। ক্লাস টেস্ট, অমুক এক্সাম এসব বাহানায় কথা বলা কমতে থাকে। অনন্ত ও মেনে নেয় এসব। শেষে একটা সময় যোগাযোগের আর কিছুই থাকেনা। অনন্ত ফোন দিলে ও রিসিভ হত না। নানা সময়েই সেলফোন অফ। অনন্ত ভাবনায় থাকে, পড়াশোনায় ব্যস্ততার কারণে যোগাযোগ ও বন্ধ হয়ে যেতে পারে? হিসাব মেলেনা। তবুও কিছু করার থাকেনা। তারপর একদিন হঠাৎ দেখায় নীরা জানান দিয়েছিলো, অনেক ঝামেলায় আছি। কিছুদিন যোগাযোগ থাকছেনা। সময় হলে আমিই ফোন দিবো। তুমি ফোন দিয়ে ঝামেলা বাড়িয়োনা। কিছু বুঝার আগেই নীরার চলে যাওয়া দেখতে হয়েছিল। তারপর এতোদিন পর, অন্তঃত তিন মাস পর নীরা’র ফোন। কত আবেগী কন্ঠ ওর। প্রথম দিনগুলোর মত।

ক্যাফে ভিক্টোরিয়া। কতবার এখানে আসা হয়েছে অনন্ত’র! কত গল্প, কত উচ্ছাস আর কত ফিস ফিসানি। একবার অনেক্ষণ বসে থাকায় তাদের কেবিনের এসি টা বন্ধ করে দিয়েছিলো এখানের কেউ। কি যে লজ্জা পাবার মতো ব্যাপার। বাইরে বেরিয়ে ঠিকই তারা বিষয়টায় আনন্দ পেয়েছিলো। অনন্ত অপেক্ষায় থাকে। সেকেন্ড মিনিট পেরিয়ে আধা ঘন্টা যাবত সে নীরার অপেক্ষায় আছে। নীরার সেলফোনে ট্রাই করেছিলো আসার পর, সেল ফোন বন্ধ আছে। এর আগে অবশ্য নীরা ফোন দিয়ে নিশ্চিত করেছে আসার ব্যাপারটা। তবে দেরী কেন? না অপেক্ষার ক্ষণ সত্যিই কষ্টকর। তারচেয়ে বরং নীরা আসার পরের অংশটুকু একটু অনুমান করা যাক। নীরা কি এতোদিনের দুরত্বের জন্য কান্না করবে। তার শুকিয়ে যাওয়া নিয়ে চিন্তায় পড়বে। না, কোন অবস্থাতেই নীরার চোখে জল আনা যাবেনা। অনন্ত নীরার হাসিখুশি মুখটাই দেখতে চায়। হোক না আবেগে চোখে পানি। তবুও কান্না করা চলবেনা। নীরার ব্যস্ততা আর অসুবিধার বিষয়টি অনন্ত অনুধাবন করতে পেরেছে বলতে পারলে নিশ্চয় নীরা খুশি থাকবে। হঠাত ‘হাই, অনেক্ষণ বসিয়ে রাখলাম, না?’ বাক্যে অনন্তর ভাবনায় ছেদ পড়ে। পরীর মতো সেজে আছে নীরা। কত্ত সুন্দর লাগছে ওকে। অনন্তর কাছে মুহুর্তেই পৃথিবীটা ঝলমলে লাগে। আহা! কত্তদিন পর পরী সামনে দাঁড়িয়ে। আগের চেয়ে অনেক সুন্দরী।

অনন্ত’র বার বার ভাবনায় ছেদ পড়ে নীরার পরের কথায়। হঠাত একটি মুখ সামনে আসে। ফ্যাশনেবল , হাল আমলের দুরন্ত একটা ছেলে। নীরা’ই পরিচয় করিয়ে দেয়। ‘ও তূর্য! আমার ব্যাচমেট।‘ হাই হেলোর পর, নীরা’র বাকি বক্তব্যগুলোর জন্য অনন্ত প্রস্তুত ছিলোনা। ‘অনন্ত, আমি আর তুর্য দুজন দুজনকে ভালোবাসি। আমি জানি তোমার সাথে আমার কিছু দিনের জানাশোনা কিংবা যোগাযোগ ছিলো। এটা একটা ভূল সিদ্ধান্ত ই বলবো। আবেগী হয়ে এই সিদ্ধান্তে গেছিলাম। এখন আমরা তো অনেক কিছুই বুঝি, তাই না? আমি কি বলতে চাচ্ছি, বুঝতে পারছো? অ্যাকচুয়াল্লি ওর সাথে সম্পর্কের পরই তোমার সাথে যোগাযোগ টা আর হয়ে উঠেনি। হঠাৎ তোমাকে মনে হলো, তোমাকে বলা উচিত। তাই এতোদিন পর। অনন্ত আমি কি বলবো আর! নিশ্চয় তোমার জন্য কেউ অপেক্ষায় আছে।

আরো কিছু হয়তো নীরার বলার ছিলো। অনন্ত’র সময় কই! অনন্ত এখান থেকে পালাতে পারলে বাচে। কিংবা তুর্য ছেলেটাকে কলার চেপে ধরলে কেমন হয়? না এসব করা যাবেনা। এই ছেলের দোষ কি? আর এই ছেলেকে আঘাত করে অযথাই কেন নীরার চোখে জল আনতে যাবে অনন্ত? সে তো কোনভাবেই নীরার চোখে জল দেখতে চায় না। অনন্ত অনেক কষ্টে ‘ভালো থেকো’ শব্দটি ই শুধু উচ্চারণ করতে পারে। তার ও মেলা কাজ জমে আছে। অন্তঃত এই ক্যাফে ভিক্টোরিয়া থেকে পালানোটাই বড় কাজ।

 

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত