অভিমানী ঝগড়া

অভিমানী ঝগড়া

আমার বউকে আমি মোটেই ভয় পাইনা….
আজকাল আমার অজান্তে তাহলে এসব চলছে?
ছোটবেলার বন্ধুর সাথে ফোনে কথা হচ্ছিল।বহুদিন পরে আলাপ হচ্ছিল।কথার প্রসঙ্গে বউ নামক এই প্রয়োজনীয় সম্পদটা তুলেছিলাম।ও বলছিল ও নাকি ওর বউকে ভীষন ভয় পায়।আমি মান সম্মানের কথা চিন্তা করে গর্বিত ভাব নিয়ে বলেই দিলাম, আরে বোকা আমার বউ তো আমার ধমক শুনেই কেঁদে দেয়।উঠতে বললে উঠে, বসতে বললে বসে।কে জানত আমার পিছনে দাড়িয়ে আছে সে।আচ্ছা বউ হয়েছে বলে কি মাথা খেয়েছে নাকি।স্বামীর সব কথায় কানপাতা লাগবে কেন।স্বামীর কি একটু স্বাধীনতা থাকতে নেই।
থাকতে হয় বই কি, খুব আছে আমার স্বাধীনতা।কথাটা শোনার পর আমার দিকে পুরো পাঁচমিনিট চোখ কটমট করে তাকিয়ে ছিল।তারপর এমন একটা শান্ত দৃষ্টিতে চোখ ঘুরিয়ে নিল,মনে হল সে যেন কচি খুকি।কিছুই শোনেনি,আর শুনলেও ভুলে গেছে।কিন্তু আমি তো চিনি আমার এই বউ রাজরানীকে,রাগ অভিমান কিভাবে পুষে রাখতে হয় সেটা ও খুব ভালভাবেই জানে।আমি তো জানি এর ফল আমায় ঠিকই ভোগ করতে হবে….
যা ভেবেছিলাম ঠিক তাই হল,এইতো একটু আগে রাতের খাবার দিয়ে গেল,পটল ভাজি লবনে এতই পুড়েছে যে মুখে দিলে তৎক্ষনাৎ বমি করতে হবে,তারপর মাছের তরকারিতে ঝালের পরিমান এমন যে,মুখে দিলে আগুন বেরোবে।কিন্তু নাহ কিছুই করার নেই আমার।যদি টু শব্দ করি তাহলে আর রক্ষে নেই…
তারপর খাওয়া দাওয়া শেষ হলে গম্ভীরভাবে হুঙ্কার ছাড়ল…
আমার এখনই আইসক্রিম চাই…
আচ্ছা তোমরা বল হে,ও কি বাচ্চা মেয়ে,বিয়ে দিলে পাঁচ ছয়টা ছেলেমেয়ের মা হত।আর তার কিনা শখ হয়েছে বাচ্চাদের মত।ধ্যাত ওর তো বিয়ে হয়ে গেছে।বিয়ে হয়েছে তো কি তার এই শখ আহ্লাদ ঠিকই থেকে গেছে…
আইসক্রিম নিয়ে ফিরেছি অনেকক্ষন,আইসক্রিম গলতে গলতে তার আসল রুপ ধারন করেছে,তবুও আমার বউয়ের সেদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই।বুঝতেই পারছ এটা তার একটা ফন্দি মাত্র,আমাকে শাস্তি দিতে বাইরে পাঠিয়ে আইসক্রিম কিনিয়ে ছেড়েছে এত রাতে…
নাহ এভাবে আর পারা যায়না।কি এমন দোষের কথা বললাম রে বাবা,এখনও শাস্তি চলছে।মশার কামড়ে নিচে শুয়ে শুয়ে কপাল চাপড়াচ্ছি।উহু এই প্রথম নয়, যে আমি নিচে ঘুমাচ্ছি।ঝগড়া হলেই আমার জায়গা ফ্লোরে হয়….
সকালবেলা ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষন,কিন্তু এখন বুঝতে পারছি ঘুমটা না ভাঙাই হয়ত ভাল ছিল…
আমার বউ নেই…
উহু পালিয়ে যায়নি,গেছে বাপের বাড়ি।রেখে গেছে চিরকুট…
“আমাকে আর পাবেনা”
এটা কোন কথা হল।আচ্ছা তোমরাই বল,এটা এমন কোন কারন হল কি,যার জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে হবে।ফোনে অনেকবার ট্রাই করেছি তবুও রিসিভ করছেনা…
কোন উপায় না পেয়ে দুপুরেই ছুটতে হল শ্বশুর বাড়ি।কিন্তু নাহ আমার এই বউটা বড্ড দুষ্টু,উহু দুষ্টু নয় বজ্জাতের হাড়ি।শ্বশুর বাড়ি এসেছি একঘন্টা হল তবুও একটি বার শোনার প্রয়োজন বোধ করলনা আমি খেয়েছি কিনা…?
মহারানীকে দেখ,দিব্যি খাবারের থালা নিয়ে বসে গেছে।একেই বলে, অনুরোধের ফল এমনই স্বার্থপর…
হ্যা কত কষ্ট সয়ে যে এই মহারানীটাকে পেতে হয়েছে আমার বলতে গেলে রাত ফুরিয়ে যাবে।তবু বলি সংক্ষেপেই বলি..
ওর নাম মায়া।অবশ্য আমি জানতাম না যদিও।আমার খালাত বোনের সাথে পড়ত।একবার হল কি,খালাদের বাড়িতে ঘুরতে এসে বিকেলে ছাদে ঘুড়ি উড়াচ্ছিলাম।খেয়াল করিনি হঠাৎ আমার ঘুড়ির পাশে আরেকটা রঙিন ঘুড়ি উড়তে শুরু করেছে।মাথায় দুষ্টু বুদ্ধি চাপল ঘুড়িটা কেটে দিলাম।কেটে দিয়ে নিজেকে একমূহুর্তের জন্যে মহারাজা মনে হচ্ছিল।কিন্তু মনে হওয়াটা বেশিক্ষন স্থায়ী হলনা।কিছুক্ষন বাদেই দুম দুম আওয়াজ করতে করতে এক নারীর আগমন ঘটল।আমি ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম।দেখলাম ঠিকই কিন্তু ততক্ষনে আমার হাতে ঘুড়ির কাটা সুতোটা ধরা থাকল।বুঝতেই পারছ দাঁত দিয়ে সুতোটা চোখের পলকে কেটে দিয়েছে।নাহ কিছুই বলতে পারিনি।সত্যি বলতে আমি ওর হাতটা দেখছিলাম।এত সুন্দর নখ আমি আগে কখনও দেখিনি।তখনও আমি ওর মুখ দেখিনি।শুধু হাতটাই দেখছি।তারপর একটা খিল খিল হাসির শব্দ শোনা গেল।চমক ভেঙে ওর মুখের দিকে তাকাতেই একটা ভ্যাংচি কেটে চলে গেল…
পরে খালাত বোনের থেকে ওর পরিচয় জানতে পারলাম।এবং সেদিন বিকেলেই ওকে প্রপোজ করেছিলাম।আমি এখনও পর্যন্ত বুঝে উঠতে পারিনি সেদিন আমি অত সাহস কোথায় পেয়েছিলাম।সত্যি বলতে কোন মেয়ের সামনে একলা দাড়ালে আমার হার্টবিট এত বেড়ে যেত মনে হত আমি বুঝি মরেই যাব।তবুও কিভাবে যেন বলে ফেলেছিলাম…
তখন অবশ্য ও শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিল।পরে আমার খালাত বোনের সাথে বলেছিল।আমি নাকি হনুমানের মত দেখতে।নাক থ্যাবড়া,বেঢপ।নিজের গুনকীর্তন শুনে যতটা না খারাপ লেগেছিল তার চেয়ে বেশি আগ্রহ জন্মেছিল ওর উপর…
তারপর প্রায়ই যেতাম ওদের ওখানে।চোখে চোখ পড়লে চোখ সরিয়ে নিত,এমন একটা ভাব করত যেন আমি অতি ঘৃনার পাত্র।তবুও আমার যেন আরও বেশি ভালবাসতে ইচ্ছে করত।আমার ঠ্যাং ভেঙে দেওয়ারও হুমকি দিয়েছিল…
সত্যি বলতে আমি একটু অন্যরকম।হয়ত এখানে আমি একটু বেশি বোকামি করে গেছি।অপমানিত হওয়ার পরও কোন প্রতিবাদ করিনি।কিন্তু একটা কথা কিন্তু স্বীকার করতে হবে,যদি কাউকে মন প্রান দিয়ে ভালবাসা হয়,তবে সেই ব্যাক্তির হাজার কটু বাক্যও অমৃতের মত লাগে।আর আমি জীবনে একবারই প্রেমে পড়তে চেয়েছিলাম।হয়ত পাব হয়ত পাবনা।তবুও একটা নারীকে ভালবেসে জীবন পার করে দেওয়ার মত ইচ্ছে আমার ছিল…
কতবার যে আমার নিয়ে যাওয়া ফুলগুলো রাস্তার ধুলোয় পদদলিত হয়েছে তার ইয়ত্তা নেই।তবু আমার মনে কেমন যেন একটা বিশ্বাস জন্মে গেছিল ওকে আমি পাব….
আমাকে বাউন্ডুলে বলে ডাকত ও…
একদিন ওদের ওখানে একটা মেলায় গিয়েছিলাম।মেলায় গিয়ে আমার এক ক্লাসমেট বান্ধবীর সাথে দেখা।কথা বলছিলাম তার সাথে।কিন্তু কোথা থেকে হুট করে মায়া এসে আমার মুখে কষে একটা থাপ্পড় মেরে বলতে শুরু করল…
খুব তো নাটক করতেন,ভালবাসেন আমাকে।আমার হাতের নখ দেখে নাকি আপনি পাগল হয়ে গেছেন।দু একদিন আমার পিছনে ঘুরে আপনার ধৈর্য হারিয়ে গেল।এই নাকি আপনার ভালবাসার নমুনা।এই আপনাদের জন্য এখন ভালবাসাটাই হারিয়ে যাচ্ছে,কাউকে ভালবাসলে তার জন্য অপেক্ষা করতে হয়।ওর চোখমুখ লাল হয়ে উঠেছিল।বুঝেছিলাম ও আমাকে…..
সত্যি বলতে আমি লজ্জা বোধ করছিলাম।অকারনে ভুল বোঝা এই মেয়েদের একটা স্বভাব বুঝলে।মনে মনে ঠিকই ভালবাসবে,কিন্তু মুখে বলবে না।তারপর যদি একটা ছুতো পায় সেটা দিয়েই নাকানি চুবানি দিবে।অথচ সত্যিটা জানার প্রয়োজন বোধ করবেনা…
নাহ ভুল বুঝে চলে যেতে দেয়নি।অবশ্য সত্যিটা জানার পর ওর মুখটা হয়েছিল দেখার মত।লজ্জায় লাল হয়ে উঠেছিল।মাথা নিচু করেছিল।একটু পরে আমার হাতে একটা গোলাপ গুজে দিয়ে চলে গিয়েছিল….
সেইদিন রাত্রিবেলা ফোন দিয়ে সে কি ঝাড়ি আমাকে।আমি কেন আগে বলিনি ওটা আমার বান্ধবী ছিল।বান্ধবীর সামনে ও ভীষন লজ্জা পেয়েছে।
ওর কথা শুনে বুঝেছিলাম ও আমাকে ভালবেসে ফেলেছে।তবু কেন জানি কি মনে হল,আমি বললাম মায়া তুমি যদি আমাকে ভালবেসে থাক তবে ভুলে যেও।হয়ত আমি ভীষন খারাপ,তোমার দেওয়া বাউন্ডুলে নামটার মত আমি সত্যিই বাউন্ডুলে…
এটুকু বলেছিলাম শুধু।সাথে সাথে ফোন কেটে দিয়েছিল।তারপর হাজারবার ট্রাই করেও রিসিভ করাতে পারিনি।দুইদিন না খেয়ে ছিল শুধু মাত্র এই কথাটার জন্য।তারপর ওকে নিজে হাতে খাইয়ে দেওয়া লেগেছিল তবেই রাগ ভেঙেছিল।সত্যি বলতে আমি নিজেকে গর্বিত মনে করি এই কারনে যে,যাকে আমি মনে প্রানে চাইতাম,হয়ত সে সহজে ধরা দিতে চায়নি,তবু ধরা সে দিল,এবং পাগলের মত ভালবাসাও উপহার দিল আমাকে….
আমি ওকে কেন কিছু বলিনা শুনবে?ভেবনা আমি পুরুষ জাতির কলঙ্ক স্ত্রীকে ভয় পাই।হ্যা স্ত্রীকে একটু আধটু ভয় পেলে তাতে পুরুষের জাত যায়না।বরং একে অপরকে বুঝলে ভালবাসাটা বৃদ্ধি পায়…
ওর একটা সমস্যার কথা আমি শুরু থেকেই জানতাম।ছোটবেলায় ওর হার্টের অপারেশন হয়।শ্বাসকষ্ট হত ভীষন।এখন আপাতত সুস্থ।সত্যি বলতে আমি যে ওকে করুনা করছি এমনটা ভেবে বসনা।আসলে ওর মুখের দিকে তাকালে এতটা মায়া হয় যে আমি নিজেকে গুলিয়ে ফেলি।তারপর ভালবাসায় যদি ঝগড়া অভিমান না থাকে তবে ভালবাসা যে গভীর হয়না….
.
এই দেখ পুরোনো কথা বলতে বলতে দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে চলল।গোসল করে পেটে দুটো দানাপানি তো দিতে হবে।আমার মহারানীর রাগ অত সহজে ভাঙবে না।নাকে ধরছি কানে মলছি আর কখনও অমন কথা মুখেও আনবনা…
খাওয়া দাওয়া শেষ করে রওনা দিব বলে সবাইকে সালাম জানাচ্ছি।তখনও আমার মহারানী আমার সাথে একটি কথাও বলেনি।অনেক্ষন আগে একবার দেখেছিলাম এখন আর দেখতেও পারছিনা…
শ্বশুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে রিক্সায় উঠে বাড়ির ঠিকানায় যেতে বললাম।মন খারাপ হচ্ছিল তাই অন্যমনষ্ক ছিলাম।হঠাৎ করে যখন ধপাস করে আমার পাশে কেউ বসে পড়ল তখনই খেয়াল হল,আমার পাশে কেউ বসেছে।এবং শুধু বসেই শান্ত হয়নি রিক্সাওয়ালাকে একটা পার্কের ঠিকানায় যেতে বলল।
আমি ওর মুখের দিকে তাকিয়ে আছি।চোখদুটো ছল ছল করছে ওর।আমার হাতটা চেপে ধরে রেখেছে।কাঁধে মাথাটা রেখেছে।চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা নোনা পানি পড়ছে আমার হাতে…
সত্যি বলতে আমার বলার মত কোন ভাষা নেই।আমাকে বলল এত রাগ তোমার,বাড়ি চলে যাচ্ছ একটিবার আমাকে বলে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করলেনা।কি ভেবেছিলে তোমাকে ছেড়ে সত্যিই দূরে যাব।উহু পারবনা তো, আর এটা তুমি জান শুভ্র।তুমি কেন বোঝনা শুভ্র আমি তোমাকে ভালবাসি বলেই তোমার উপর এই ছোট ছোট অভিমান করি।তুমি আমার রাগ ভাঙিয়ে বুকে টেনে নিবে এটাই তো আমার শান্তি।পাগল বর আমার তোমাকে ছাড়া কি আর যাওয়ার জায়গা আছে আমার…
কি বলব এই পাগলীকে।কিছু যে বলব ঠোঁটটা কাঁপছে আমার,বুকটা ভারী ভারী লাগছে,সত্যি তো ওর এই অভিমান ভাঙানো তো আমারই দায়িত্ব…
এই যে সাহেব শুধু আমাকে বাচ্চা বল তুমি কি হে,পিচ্চি ছেলের মত কাঁদছ কেন এখন,শোন বলে রাখছি,আজকে আমরা সন্ধ্যা পর্যন্ত ঘুরব,আমার হাত ভর্তি চুড়ি চাই,ফুসকা খাব,তোমার শার্ট নোংরা করব তবেই ছাড়ব….
.
ঠিক যা যা বলেছিল তাই তাই করেছে।এখন হাঁটছি ধীরে ধীরে।ঝুম বৃষ্টি নেমেছে।ওর দিকে তাকিয়েই হাঁটছি।ঠোঁটের ওপর ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টির পানি জমেছে,ঈষৎ কাঁপছে…
হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকাল ভীষন জোরে…
আমার পিচ্চি বউ আমার বুকে লেপ্টে গেছে।চোখের কাজল লেপ্টে গেছে।হে হে হে পেত্নিটাকে আর ছাড়ছি না।কোলে তুলে নিয়ে হাঁটছি….বৃষ্টি তখনও ঝুম ঝুম শব্দ তুলে চলেছে….

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত