কালো অধ্যায়

কালো অধ্যায়

আমি অনেক সিনেমা দেখেছি,ছোটোবেলা
য় সিনেমায় কারও কান্না দেখলে নিজের ই কান্না পেতো। কিন্তু আম্মুর মুখে শুনতাম এগুলো নাকি শুধু ই অভিনয়। কিন্তু আজও আমি একটি কাহিনী শুনেছি, ছেলেটি আমাকে তার কথাগুলো বলার সময় তার কান্নার শব্দটা আমার কাছে সমস্ত সিনেমাকে হার মানিয়েছে।
তার প্রতিটি লিখা শব্দের মাঝে আমি অনুভব করতে পেরেছি তার বুকের জমাটবদ্ধ কষ্টগুলো আর চোখের কোণে ভেজা স্থানটাকে। তার সে অনুভূতিটা আমার সাধ্যমত তুলে ধরতে চেষ্টা করেছি মাত্র………………]
.
.
গল্পটি বরিশাল বিভাগের বরগুনা জেলার। একটি টিনএজ সম্পর্ক বলা যায়। সাধারণত অষ্টম শ্রেণীর ছেলেমেয়েদের মাঝে প্রায়ই একটি দুর্বলতা পরিলক্ষিত হয়ে থাকে। এ সময়ে ওদের কাছে সব কিছুই রঙিন চশমার মতো। ওরা যেদিকে তাকায়,যাকে দেখে সব কিছুই রঙিন মনে হয়, মনের মাঝে একধরনের ভালোলাগার অনুভূতি কাজ করে। তেমনি আবিদের মাঝেও অনুভূতিগুলো ছুঁয়েছিলো। শুধু আবিদ বললে হয়তো বা ভুল হবে, আবিদ আর নিসার দুজনের ই অনুভূতিগুলো এক রকমের ই ছিলো বলা যায়। আবিদ আর নিসা দুজন ই ২০১৪ সালে অষ্টম শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে ২০১৫ সালে নবম শ্রেণীতে উঠেছে। আবিদ ছিলো বরগুনা পলিটেকনিক স্কুলের ছাত্র এবং নিসা ছিলো বরগুনা গার্লস স্কুলের ছাত্রী। গল্পের শুরুটা ছিলো তখন থেকে ই…….
.
.
আবিদ আর নিসা দুজন ভিন্ন স্কুলে পড়তো। দুজনেই সবে মাত্র নবম শ্রেণীতে ভর্তি হয়েছে। তারা ছিলো এক ই বিভাগের ছাত্র-ছাত্রী। তারা দুজন এক ই শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তো। সেই সুবাদেই তাদের দেখা হয়েছিলো। কথায় আছে- ‘লাভ এট ফার্স্ট সাইড’
কথাটা হয়তো আসলেই মিথ্যে নয়। আবিদ নিসাকে প্রথম দেখে চোখ ফেরাতে পারেনি, শুধু আবিদ বললে একটু ভুল হবে,যে কেউ ই নিসাকে প্রথম দেখলে হয়তো এভাবেই অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে চাইবে। নিসার বর্ণনা দিতে গেলে বলতে হয়- ‘মায়াবী তার চাহনি, হরিণের মতো কাজলটানা সে চোখ, প্রশস্ত কালো বর্ণের কেশ, আর উজ্জ্বল সে মুখমন্ডল, দেহের গড়ন টা ঠিক তেমন, যেমনটা হলে কাউকে সুকন্যা বলে অভিহিত করা যায়’। আর সে জন্য ই হয়তো আবিদের মনে ভালোলাগার রংগুলো গাঢ়ো হয়ে ছড়িয়ে গিয়েছিলো তার অন্তরেরমাঝে।
.
.
প্রতিদিন বিকেলে তারা প্রাইভেট পড়তে যেতো। ধীরে ধীরে দুজনের কথা হতে লাগলো। একে অপরকে জানা শুরু হলো। শুরু হলো দুটি মনের অনুভূতির আদান প্রদান। আবিদ আর নিসা একসাথে প্রাইভেট পড়লেও তাদের দুজনের বাড়ির বেশ দূরত্ব ছিলো। আবিদের বাড়ি ছিলো বরগুনা মহিলা কলেজের সাথে এবং নিসার বাড়ি ছিলো বরগুনা মহা-সড়কে। নিসা ছিলো খুব ই ভদ্র এবং ঠান্ডা স্বভাবের ও। কিন্তু একটু জেদী ছিলো। নিসার জেদটা আবিদের খুব ভালো লাগতো। ওই যে কথায় বলে- ‘ভালোবাসার মানুষের সব কিছুই ভালোলাগে। সে এলোমেলো থাকলেও ভালো লাগে, সে পাগলামি করলেও ভালো লাগে।’ ব্যাপারটা হয়তো তেমন টা ই ছিলো। সেম এজ সম্পর্কগুলোর মাঝে সবসময় ভালোলাগা,আর বোঝাপড়ার ব্যাপারগুলো ভালো কাজ করে। দুজনের পছন্দগুলো অনেক সময় এক ই রকমের হয়,একসাথে অনেকটা সময় কাটানো যায়। আবিদ আর নিসা এখন পর্যন্ত কেবল ভালো বন্ধু ই। কিন্তু আবিদ একা ই নিজের মনে নিসাকে নিয়ে স্বপ্নের জাল বুনতে শুরু করলো।
.
.
প্রতিদিন প্রাইভেট,আড্ডা আর দুষ্টামির মাঝেই কেটে গেলো ৮ টি মাস। জানুয়ারি থেকে আগস্ট মাস পেরিয়ে গিয়েছে। সময়ের সাথে সাথে আবিদের ভালোলাগা গুলো পরিণত হয়েছে ভালোবাসায়। আজ তা এক তীব্র রূপ ধারণ করেছে। আবিদের সব কিছুর মাঝেই আজ একটি নাম,’নিসা’,আবিদ
ের সব কিছু একজনকে ঘিরেই গড়ে উঠতে লাগলো ‘নিসা’, আবিদের সব কিছুতে আজ একজনের বসবাস ‘নিসা’। তাই আবিদ আজ নিসাকে তার মনের কথাটা জানানোর জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। ৭ ই আগস্ট। বিকেলে যখন ওরা প্রাইভেট পড়তে গেলো, আবিদ নিসাকে বললো-
– নিসা,তোমার সাথে একটা কথা ছিলো।
– হ্যাঁ আবিদ বলো।
– না মানে,আমি চাইছিলাম কথাটা ফোনে বলবো।
– আচ্ছা বেশ,ফোনেই বলো তাহলে।
– আচ্ছা।
প্রাইভেট শেষে দুজনেই বাসায় ফিরে এলো। কিন্তু আবিদের মনটা আজ ভীষণ উতলা। চঞ্চল হয়ে আছে আজ তার মন। বহুদিনের অপেক্ষা শেষে আজ সে নিসাকে তার মনের কথাটা জানাবে। কিন্তু আবিদের ভয়ের শেষ নেই। সে তো নিসাকে ভালোবাসে,কিন্তু নিসা তো তাকে ভালো না ও বাসতে পারে। নিসা কি ফিরিয়ে দিবে তাকে? নাহ,আবিদ আর ভাবতে পারছেনা। আবিদ আর কিছুই ভাবতে পারছেনা।
.
.
রাত ১১ টা,আবিদ কফি নিয়ে বেলকোণীতে বসে আছে। আবিদ হলো তার বাবা- মায়ের একমাত্র ছেলে। আবিদ তার বাবা- মা কে জানালে হয়তো কেউ তাতে আপত্তি করবে না। কিন্তু নিসা? নিসার বাবা- মা তো অনেক বড়লোক। তাদের তুলনায় আবিদদের আর্থিক অবস্থা অতি সামান্য। তারা কি মেনে নিবে এ সম্পর্ক?
ঘড়িতে যখন ১২ টা বেজে গেলো। নিসা নিজেই আবিদকে এসএমএস করলো। আবিদ ঘরে এসে কফিটা রাখলো। কিছুক্ষণ দুজন মজা করলো। এরপর নিসাকে বললো আজ ওকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলবে। নিসা উৎসুক হয়েছিলো কথাগুলো শোনার জন্য
– আচ্ছা নিসা,আমাকে তোর কেমন লাগে?
– অবশ্যই অনেক ভালো লাগে। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
– ফ্রেন্ড ছাড়া আমাকে তোর কেমন লাগে?
– ফ্রেন্ড ছাড়া মানে ঠিক বুজলাম না।
– নিসা আমি তোকে ভালোবাসি। (চোখ বন্ধ করে)
– হিহিহিহিহিহি…..(হাসির শব্দ ভেসে আসলো)
– তুই হাসছিস যে! আমি কি হাসির কিছু বলেছি?
– তুই না,বরাবরের মতো ই,শুধু মজা করিস।
– নিসা প্লীজ,আমি সিরিয়াস। আমি সত্যি তোকে খুব ভালোবাসি।
– আবিদ দেখ,আমি আর তুই খুব ভালো বন্ধু। এছাড়া আর কিছুই নয়। আর আমাদের বন্ধুত্বের মাঝে এসব কথা না আসাই ভালো। তুই আমার বেস্ট ফ্রেন্ড এটা ই অনেক।
– নিসা দেখ,আমি যেদিন তোকে প্রথম দেখি সেদিন থেকেই তোকে ভীষণ ভালো লাগে,আর আজকে এতোদিনে তোকে অনেকটা ভালোবেসে ফেলেছি রে। আমাকে একটু বোঝার চেষ্টা কর প্লিজ।
– আবিদ,রাত ২ টা বেজে গেছে। সকালে স্কুল আছে। ঘুমাবো আমি। গুড নাইট।
– নিসা,নিসা প্লীজ শোন নিসা………..
…………………
অপর প্রান্ত থেকে ফোনের লাইনটা কেটে গেলো।
.
.
রাত বাড়ছে,বাড়ছে রাতের গভীরতা,আর বাড়ছে আবিদের কষ্টের গভীরতা। এতোদিন যে আশায় দিন কেটেছে তার,আজ একটি কথাতে এভাবে সব শেষ হয়ে যাবে সেটা যেনো ভাবতেই পারছেনা আবিদ। আবিদ এই প্রথম এতো রাত জেগে আছে। আজ আবিদের কাছে রাতটা অনেক বড় মনে হচ্ছে। কষ্টের রাতগুলো অবশ্য অনেক বড় ই মনে হয়। ভোর ৪:৫০ হয়েছে। বিছানায় এসে শুয়ে শুয়ে নিসার কথা ই ভাবছে আবিদ। ভাবতে ভাবতেই কখন যেনো ঘুমিয়ে পড়লো।
ঘড়ির কাঁটায় সকাল ৭:০০ টা। আবিদের ফোনে নিসার একটি এসএমএস আসলো। ঘুম ঘুম চোখে আবিদ তাকালো ফোনের দিকে। নিসা লিখলো- ‘সত্যি বলতে আবিদ,আমারও তোকে ভীষণ ভালো লাগে, আর আমার মনে হয় তুই আমার জন্য একদম পারফেক্ট’।
আবিদ সাথে সাথে খাট থেকে উঠে বসলো। আবিদ নিজের চোখকে বিশ্বাস ই করতে পারছিলো না। আসলেই কি এটা সত্যি? নাকি কোনো কল্পনার জগৎ।
মনের মাঝে আজ যেনো অনুভূতির এক অন্যরকম ছোঁয়া। সেদিন ই ওদের ‘তুই’ এর পর্ব শেষ হয়ে গেলো। শুরু হলো নতুন করে দুজনের ‘তুমি’ এর সম্পর্ক।
.
.
আবিদ রোজ সকাল ১০ টার আগে ঘুম থেকে উঠতো ই না। কিন্তু তুই শব্দের সাথে সাথে আবিদও ধীরে ধীরে অনেকটাই পরিবর্তন হতে লাগলো। আবিদ এখন সকাল ৭ টায় ঘুম থেকে উঠে নিসার স্কুলের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, শুধু একটিবার তাকে দেখার জন্য। একটিবার দেখার সাথেই হয়তো আবিদের মনে সুখের দোলা বয়ে যায়, সাদাকালো মনটা হয়তো বার বার আজ নানা রঙে রঙিন হয়ে উঠছে। তাই হয়তো সকল কষ্ট আর বাধা দূর করেও প্রিয়তমার মুখখানা দেখে শীতল হয়ে যায় হৃদয়ের সব অস্থিরতা। আবিদ ১২ টার আগেই স্কুল থেকে পালিয়ে চলে যেতো নিসার স্কুলের পাশে। নিসার স্কুলের সামান্য দূরেই রয়েছে একটি কদমগাছ। সেখানে চলতো দুজনের কথাবলা,খুনসুটি আর আড্ডায় মেতে থাকা। আর রাতভর দুজনের কথাবলা সে তো রয়েছে ই। দিনগুলো যেনো সোনালি দিনের মতো হয়ে উঠতে লাগলো। প্রথম প্রথম অনেক লুকোচুরি করে সময়গুলো পার করলেও ধীরে ধীরে বন্ধুরা জানতে লাগলো। খুব ভালোভাবে কাটছিলো দিনগুলো সকলের সাথে। কিন্তু সুখ যেখানে থাকবে, সেখানে দুঃখের ছোঁয়া তো লাগবেই। ওদেরও হলো সেটা ই। সমস্যাটা দেখা দিলো সম্পর্কের তিন মাসের মাথায়।
.
.
নিসার আম্মু একদিন নিসাকে আবিদের সাথে ফোনে কথা বলতে দেখে ফেলল। কিন্তু তেমন কিছু একটা বলেনি,নিসা কথা ঘুরিয়ে নিয়েছিলো তাই। কিন্তু তবুও তার মায়ের মনে একটা সংশয় কাজ করা শুরু করলো। নিসার মা তখন ই নিসাকে বিয়ে দিয়ে দিবে বলে সিদ্ধান্ত নিলো। কিন্তু নিসার পড়াশোনার ক্ষতি হবে বলে নিসা অনেক কষ্টে বিয়েটা বন্ধ করলো। আবিদের পরিবারের অবস্থা বেশি ভালো নয়। নিসা আর আবিদ জানে যে তাদের ব্যাপারটা বাসায় মানবেনা। তাই তারা দুজন সিদ্ধান্ত নিলো ওদের এসএসসি পরীক্ষা শেষেই দুজন পালিয়ে যাবে। সম্পর্কটা চলছিলো ঠিকমতো। কিন্তু নিসার কাছে নিজের কোনো ফোন ছিলোনা। তার আম্মুরটা সে ব্যবহার করতো প্রয়োজন হলে। কিন্তু এ ব্যাপারের পর থেকে ওর আম্মু ওকে বেশিক্ষণ ফোন দিতো না। অন্যদিকে আবিদের সাথেও ভালোভাবে কথা বলতে না পারায় খুব খারাপ লাগতে শুরু করলো। নিসার মাথায় জেদ চাপল সে ফোন কিনবে, বাসায় বলেছিলো কিন্তু তাকে ফোন দেয়া হবেনা। তাই নিজের টাকা জমিয়ে সম্পর্কের ছয় মাসের মাথায় সে একটি ফোন কিনলো। ফোন কিনার ১০-১২ দিনের মাথায় দুজনের মাঝে একটু কথা কাটাকাটি হয়,তখন নিসা অনেক কান্নাকাটি করেছিলো। দুর্ভাগ্যবসত তার মামি তাকে কান্না করতে দেখে ফেলে। আর ওর ব্যাগ থেকে ফোনটা ও বের করে নিয়ে যায়। শুরু হলো আরও একটি নতুন সমস্যার।
.
.
নিসা ওর ফোন দিয়ে শুধু আবিদের সাথেই কথা বলতো। তাই নিসার ফোনে শুধু আবিদের নাম্বার ই ছিলো। ওর বাড়ির সকলে ফোন থেকে আবিদের নাম্বার নিতে বেশি সময় লাগেনি। ওর মামা আবিদকে ফোন দিলো। ফোন দিয়ে তিনি আবিদের সাথে বেশ ভালোভাবে কথা বলেছিলো। তিনি এ সম্পর্কে কোনো বাধা দিবেন না, তাদেরকে যথাসম্ভব সহায়তা করবেন এমন ও আশ্বাস দিয়েছিলো। কিন্তু আসলে এটা ছিলো কেবল তার একটি কৌশল। সে আবিদের সাথে কৌশলে কথা বলে আবিদের বাড়ির ঠিকানাটা আবিদের কাছ থেকে নিয়ে নিলো। আবিদ পরে তার বন্ধুদের থেকে ব্যাপারটা জানতে পারলো।
আবিদ এটা জানার পর থেকে ২-৩ দিন লুকিয়ে ছিলো। নবম শ্রেণীতে পড়া একটি ছেলের আর কতটা ই বা সাহস থাকার কথা! আবিদকে খুঁজতে নিসার মামা আর মা আবিদের বাড়িতে আসার সময় রাস্তায় আবিদের বাবার সাথে দেখা হয়। এই কয়েকদিনের মাঝে আবিদের সাথে নিসার কথাবলা সম্পূর্ণ বন্ধ ছিলো। নিসার মামা আর মা আবিদের বাবাকে ছোটো লোক,লোভী অনেককিছু ই বলে অপমান করছিলো সেদিন। রাস্তার সকলে তাকিয়েছিলো আবিদের বাবার দিকে। সেদিন আবিদের বাবা ছিলো নির্বাক। যে নির্বাকতা আজও কাটেনি আবিদের বাবার!
.
.
বিকেলে নিসা আবিদকে ফোন দিলো। ফোন দিয়ে অনেক কান্নাকাটি করলো। আবিদ নিসার কষ্ট সহ্য করতে না পেরে বন্ধুদের সাথে নিয়ে নিসাদের বাড়িতে গেলো। কিন্তু নাহ, নিসার মায়ের তিক্ত কথাগুলো ভক্ষণ করে চলে আসতে হয়েছিলো সেদিন। নিসার মা আবিদদের বাড়িতে গেলো সন্ধ্যায়। এবার আবিদের মা কে ও অনেক কথা শুনিয়ে আসলো। আবিদের মা নির্বাক-শ্রোতার মতো শুধু শুনে গেলো আর দেখে গেলো। পরবর্তীতে ক্ষমা প্রার্থনাও করলো। নিসা আর আবিদের ১-২ মাসের মতো যোগাযোগ বন্ধ ছিলো। কিন্তু সময়ের সাথে কখন যে আবার সব শুরু হয়েছে হয়তো ওরা নিজেরাও তা অনুধাবন করতে পারেনি। কিন্তু এ সমস্যাগুলোর পর থেকে আবিদ আর নিসা আবারও সবকিছু শুরু করলেও খুব সাবধানে চলছিলো সবকিছু। নিসা হচ্ছে ঘরের বড় মেয়ে, ছোটো একটা ভাই আর বোন আছে। নিসার আম্মু নিসার ভাইকে অনেক আদর করতো কিন্তু নিসাকে সারাদিন গালমন্দ করতো আবার শরীরে হাত ও তুলতো। আবিদের খুব কষ্ট হতো যখন সে এসব শুনতো।
.
.
দেখতে দেখতে ২০১৫ সালও পেরিয়ে গিয়েছে। সম্পর্কটা একটি বছর শেষ করে দু’বছরে পদার্পণ করেছে। শত বাধা পেরিয়েও আজ ওরা এক ই সাথে। আবিদ রোজ প্রাইভেট পড়তে যাওয়ার সময় কদম গাছের নিচে দাঁড়িয়ে নিসার জন্য অপেক্ষা করতো। দুজন সেখানে দাঁড়িয়ে কথা বলতো। একদিন আবিদ অপেক্ষা করছিলো, নিসা সে সময় আবিদের কাছে গিয়ে একটি শপিং ব্যাগ দিলো। আবিদ জিজ্ঞেস করলো এর ভিতরে কি আছে? নিসা বললো বাসায় গিয়ে খুলবে। ভিতরে একটি টি-শার্ট রয়েছে। নিসা যাওয়ার পর আবিদকে এসএমএস করে বললো- আগামীকাল বিকেল ৩:৩০ মিনিটে টি-শার্ট টি পড়ে কমদগাছের নিচে অপেক্ষা করবে। আবিদ ভাবলো নিসা যখন ওকে কিছু দিয়েছে,ওর ও উচিত নিসাকে কিছু দেওয়া। অনেক ভেবে নিসার জন্য একটি পায়েল কিনলো। কিন্তু পরেরদিন নিসা সেটা নিতে চাইলো না। বললো যে পরিয়ে দিতে হবে। আবিদ বরাবর ই বেশ লাজুক প্রকৃতির। এ দু’বছরে কখনোও নিসার সাথে পাশাপাশি হাত ধরে হাঁটাও হয়ে উঠেনি। আজ নিসাকে আবিদ নিজের হাতে পায়েল পড়িয়ে দিয়েছে। অনেকদিন পর আজ নিসা অনেক খুশি, নিসাকে খুশি দেখে আবিদেরও ভালো লাগছে ভীষণ।
.
.
সম্পর্কটা এভাবেই চলতে লাগলো। ওদের এসএসসি পরীক্ষা এসে গেলো। দু’জন ই অনেক ভালো রেজাল্ট করলো। এখন দুজনের কলেজে ভর্তি হওয়ার সময় হয়ে গেলো। কিন্তু স্কুল থেকে মার্কসীট আনতে হবে। নিসা ১১জুন স্কুলে যাবে। আবিদকে বলেছে অবশ্যই আসতে। ১১ জুন সকাল থেকে ভীষণ বৃষ্টি ছিলো। তবুও
আবিদ ছাতা নিয়ে যথাসময়ে হাজির হয়েছিলো। নিসারা তিনজন বান্ধবী মিলে আবিদের সামনে আসছিলো। কিন্তু ওদের সাথে ছাতা ছিলো দুইটি। নিসা কাছে এসে আবিদের ছাতার নিচে চলে আসে। এটাই ছিলো আবিদ আর নিসার প্রথম এতোটা কাছে আসা।
দু’জন ই লজ্জা পাচ্ছিলো ভীষণ। দুষ্টামির ছলে ছাতাটা বন্ধ করে দুজন ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে স্কুলে এলো। নিসা স্কুলে চলে আসলো আর আবিদ বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলো। ফেরার পথেও দু’জন আবার দেখা করে। কিন্তু কে জানতো এভাবে আর কখনোও একসাথে পথচলা হবেনা! আর কখনোও প্রিয়তমার পরশে শীতল হবেনা আবিদের হৃদয়! সময়ের সাথে বদলে যাবে জীবনের গতিপথ!
.
.
এরপর ফোনেই ওদের কথা হতো। আর কখনোও এর মাঝে দেখা হয়নি। ২০ জুন ছিলো নিসার জন্মদিন। আবিদ চেয়েছিলো আবিদের উপহারটি ই যেনো হয় নিসার জন্মদিনের শ্রেষ্ঠ উপহার। আবিদ তাদের দুজনের ছবি দিয়ে একটি ভিডিও তৈরি করে। যার মাঝে দু’বছরের অনেক স্মৃতি জড়িয়ে ছিলো আর জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানানো হয়েছিলো। নিসা ভিডিওটি দেখে অনেক বেশি খুশি হয়েছিলো। কিন্তু তারা কেউ ই ভাবতে পারেনি এটা ই তাদের সবথেকে বড় কাল হয়ে দাঁড়াবে। ২০ তারিখ সকালে ছিলো নিসার কলেজে ভর্তির তারিখ। নিসা সকালে আবিদকে কয়েকবার ফোন দিয়েছিলো। নিসা তার মায়ের সাথে কলেজে গেলো। বেলা ১২ টায় একবার আবিদ কলেজে গিয়েছিলো। সেখানে দূর থেকে নিসাকে একবার দেখে চলে এসেছিলো। কিন্তু কেউ ই হয়তো জানতো না এটা ই ছিলো দু’জনের জীবনের শেষ দেখা। বিকেল ৫ টা পর্যন্ত অনেকবার দু’জনের কথা হয়। কিন্তু কেউ ই হয়তো বুঝতে পারেনি এটা ই তাদের শেষ কথা!
.
.
নিসাকে দেয়া আবিদের জন্মদিনের ভিডিওটি নিসা তার ফোনে ডাউনলোড করে রেখেছিলো। নিসাকে আবিদ বার বার বারণ করা সত্বেও নিসা সেটা ডিলিট করেনি। নিসার বাড়ির লোকজন অবশেষে সেটি দেখতে পারে এবং শুরু হয়ে যায় জীবনের শেষ সমস্যা। ওর বাড়ির লোকজন ওকে অনেক কথা বলে ভয় দেখিয়েছিলো এবং নিসা আবিদকে এসএমএস এ বলেছিলো – ‘তুমি সাবধানে থেকো। আমরা আবারও একটি বড় সমস্যায় পড়েছি ‘। কিন্তু আবিদ কেনো যেনো কথাটাকে সিরিয়াসভাবে নেয়নি।
সেদিন রাতেই নিসার বাড়ির লোকজন নিসাকে বিয়ের জন্য রাজি করায়। কিন্তু একটি মানুষ একজনের সাথে দেখা স্বপ্নগুলো কিভাবে অন্যজনের সাথে বাস্তবায়ন করবে? দুটি বছর,৭৩০ দিন। প্রতিটি দিন দুজনের মনে আজও জীবন্ত, আজও চোখে ভাসে প্রতিটি দিনের কথা। সবকিছু ভুলে অন্য কাউকে আপন করে সব কিছু শুরু করা কি এতোটা সহজ! সহজ হলেই হয়তো দুটি জীবনের পরিস্থিতি আজ অনেকটা সহজ হয়ে উঠতো। জীবনটা নতুন কোনো রঙে সাজতে পারতো।
.
.
নিসা রাজি হয়নি বিয়েতে। তার মা তাকে অনেক মারধর করলো,সাথে বাজে গালমন্দ। সেদিন রাতে আর নিসার সাথে কথা হয়নি আবিদের। পরদিন সকাল
৭:০৭ মিনিটে আবিদের ফোনে নিসার দুটি কল আর দুটি এসএমএস আসে। আবিদ ঘুমন্ত অবস্থায় থাকায় তা দেখতে পারেনি। ২১ তারিখ সকালে আবিদের কলেজের ভর্তির কার্যক্রম ছিলো। সকাল ১০ টার মাঝেই সকল কার্যক্রম শেষ। শুধু একটি ফরম পূরণ করা বাকি ছিলো। অনেক কোলাহলে ঘিরে ছিলো চারপাশ আর ভিড়ের মাঝে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে আবিদা। হঠাৎ ১০:৩০ মিনিটে ফোনে ৩ টি এসএমএস আসলো। যার মধ্যে প্রথম এসএমএস টি ছিলো—
‘আমি তোমায় খুব ভালোবাসি। সারাজীবন তোমার সাথে কাটাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তা আর হলোনা।
আমার পরিবারের লোকজন তা হতে দিলোনা। আমি তোমাকে খুব ভালোবাসি। আমাকে মাফ করে দিও। মৃত্যু ছাড়া আমার আর কোনো পথ বাকি নেই’……..
পরের এসএমএস দুটিতে ফোন করতে বলেছিলো। কিন্তু আবিদের ভাগ্যটাই ছিলো খারাপ। আবিদের ফোন সাইলেন্ট থাকার কারণে সে ১০:৪৫ মিনিটে এসএমএস গুলো দেখতে পায়।
.
.
আবিদের বুকে মোচড় দিয়ে উঠলো। সে জলদি করে ফোন দিলো। কিন্তু নাহ,কেউ ফোনটা ধরলো না। আবিদ কি করবে বুঝতে পারছিলো নাহ। সে নিসার বান্ধবীকে ফোন করে বললো নিসাদের বাড়িতে যেতে। কিন্তু অনেক দেরি হয়ে গেলো সবকিছুর। নিসার বান্ধবী নিসাদের বাড়িতে গিয়ে নিসার ঝুলন্ত দেহটা ছাড়া আর কিছুই পেলোনা। আবিদকে প্রথমে এসব জানানো না হলেও পরে তাকে জানানো হয়,আর আবিদ সবটাই আন্দাজ করতে পেরেছিলো। এখানেই শেষ হয়ে গেলো গল্পের। অবসান ঘটলো নিসা আর আবিদের সম্পর্কের।
ঘটনাটি মাত্র দুই বছরের। কিন্তু হয়তো দুই জনমেও আবিদ ভুলতে পারবেনা নিসাকে। আজও আবিদের বাবা কথা বলেনি তার সাথে। আবিদের এ কষ্টের অনুভূতি প্রকাশের ক্ষমতা আমার নেই।
.
.
আজও আবিদ আগের মতোই ভালোবাসে নিসাকে। হয়তো কখনোও শেষ হবেনা আবিদের এ ভালোবাসা। দুই বছরের ঘটনাটি হয়তো আমি দু’দিনে লিখে তুলতে পেরেছি আর আপনারাও ২০মিনিটে পড়তে পেরেছেন। কিন্তু নিসাকে ঘিরে আবিদের দু’বছরের অনুভূতিগুলো প্রকাশ করার মতো পদ্ধতি আমার জানা নেই, আমার ক্ষমতা নেই। এভাবেই অপরিণত বয়সের অনুভূতি আর পরিবারের লোকেদের জন্যই শেষ হচ্ছে সমাজের নিষ্প্রাণ ছেলে- মেয়েগুলো। হোক না ওদের অবুঝপনা, হোকনা আবেগের সময়টুকু, এ ভালোবাসায় ছিলোনা তো কোনো লোভ,অহংকার বা কোনো নোংরামী ! তবুও অকালেই এভাবে ঝড়ছে প্রাণগুলো। শুধু বেঁচে থাকে ভালোবাসা। ২১ শে জুন হয়তো ইতিহাসের পাতায় কোনো প্রভাব ফেলেনি, নিসার নাম ওঠেনি। কিন্তু আবিদের জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত এই ২১ জুন হয়ে থাকবে এক কালো অধ্যায়!!!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত