ইরাবতী

ইরাবতী

শীতের দিনেও মুষল ধারায় বৃষ্টি পড়ছে জলবায়ু যেন ভিন্ন রুপে সাঁজতে চাচ্ছে…
তাই বৃষ্টিতে ভিজে প্রথম দিন ভার্সিটি আসলাম,
আগে কোন দিন ভার্সিটি আসিনি..
ডিপার্টমেন্ট এর সামনে দাঁড়িয়ে আশেপাশে ঘুরে নিজের ডিপারমেন্টকেই খুজতে লাগলাম..
ডানে বামে তাঁকিয়ে জিজ্ঞাসা করার যখন কাউকেই পাচ্ছিলাম না..
তখনই ছাতা মাথায় দিয়ে আসা একটা মেয়ে কে দেখে জিজ্ঞাসা করলাম..

-এই যে আপু শুনছেন মানবিক ডিপার্টমেন্ট টা কোন দিকে?
মেয়েটা এমন ভাব নিয়ে তাকালো আমার দিকে..
যেন তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে আপনার বাবার নানার দাদার নাম কি..?

-মাথা টা তুলে সোজা ১২০ ডিগ্রী উপরে তাকান আপনার ডিপার্টমেন্ট পেয়ে যাবেন..
হাদারাম একটা..

মাথা তুলে যখন উপরে তাকিয়ে দেখি গোটা গোটা অক্ষরে লেখা “মানবিক” তখন নিজেকে হাদারাম ভাবা ছাড়া উপায় ছিল না..

এরপর আরেকবার অবাক হয়েছিলাম যখন তাকে আমার নিজের ডিপার্টমেন্ট এ দেখি..
গোলগাল একটা চশমা পরে বইয়ের দিকে এমন ভাবে তাকিয়েছিলো যেন বইয়ের পৃষ্ঠায় আলিফ লায়লা অথবা হাতিম বা অন্য কিছু হচ্ছিলো..

জানিনা তখন বয়স কত হবে হয়ত নয় বা দশ বছর হবে শুক্রবার করে আলিফ লায়লা হত..
তখন সবাই বেশ মনযোগ দিয়ে দেখতাম..
আমাদের গ্রামে মোটে তিন থেকে চারটা টিভি ছিল.. আমার মা বেশ ভক্ত ছিল আলিফ লায়লার..
শুরু হওয়ার আগে মা আমাকে নিয়ে সবার প্রথমে বসে পড়তো..
যেহেতু টিভিটা আমাদের ছিল তাই সবাইকে উক্ত্যক্ত করার অধিকার শুধুমাত্র আমার ছিল..

এই মেয়েরও মনে হয় এরকম অভ্যাস ছিলো..
তাই এত মনযোগ দিয়েছে বইয়ে..
একবার ভাবলাম গিয়ে জিজ্ঞাসা করব কিন্তু পরক্ষনেই ভাবলাম প্রথমেই যে রুপ দেখেছি এবার আর সেটা দেখতে চাচ্ছি না..
বই থেকে মাথা না তুলেই যখন আমাকে বলতে লাগলো..

-কি সমস্যা..?
(কিছুটা অবাক হলাম..
এই মেয়ের কয়টা চোখ..?)

-কই কিছু না তো..
না মানে বলছিলাম আপনি কি প্রথম বর্ষের..?

-না চতুর্থ বর্ষে পড়ি..
ঘুরতে এসেছি এখানে..

– ও আচ্ছা সরি আপু..
ঘুরেন ভাল করে..

-হাদারাম,আমি প্রথম বর্ষের..

-তাহলে মিথ্যে বললেন কেন..?

– কখনো দেখেছেন..?
সিনিয়র আপু প্রথম বর্ষের ক্লাসে বসে থাকে..

সেই প্রথম দিন আপনি করে ডেকেছিল এরপর থেকে তুই ছাড়া একটা কথাও বলেনি..

প্রত্যেকদিন আমাকে জ্বালানোটা যেন ওর ওয়াজিব একটা কাজ হয়ে গেছিলো..
আমার পাশের চেয়ারটাতে বসে বলত..
কি খবর হাদারাম..?
কেমন আছিস..?
আমার চশমা খুলে নিয়ে ওর চশমাটা আমাকে পরিয়ে দিত..
আমি কুয়াশাচ্ছন আকাশের মত দেখতাম এটা কি সত্যি ওর হাসি..
এত সুন্দর করে কেউ হাসতে পারে..
জানা ছিল না..

আমার কাছে মনে হত ঠিক ছোট বাচ্চাদের যেমন খেলনা কিনে দিলে খুশিতে গদগদ করত তেমনটাই করতো ও..
কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে বসে যখন ফোন চাপতাম তখন কোথা থেকে যেন একটা চিপসের প্যাকেট নিয়ে এসে আমাকে বলতো..
নে খা সকালে থেকে তো কিছু খাস নি..

প্যাকেটটা যখন হাতে নিতাম তখন দেখতাম হয় নুডুলস নয়ত খিচুড়ী..
আমাকে বোকা বানিয়ে খুব খুশি হত ইরাবতী..
হ্যাঁ মেয়েটার নাম ইরাবতী..

অনেক মিষ্টি একটা নাম, আর নামটার মানেও মিষ্টি বা পৃথিবী…
আমি মাঝে মাঝে অবাক হয়ে যাই, এই মেয়েটা কি ভাবে জানে আমি এগুলা পছন্দ করি..
কখনও তো বলিনি ইরাবতী কে এগুলো আমার অনেক প্রিয়..

-হাদারামের মত তাকিয়ে আছিস কেন..?
আমি জানি তুই খেয়ে আসিস নি..
নে শেষ কর তারাতারি..
তোর মুখ দেখলেই এমনতেই বুঝা যায় যে তুই খাস নি..
অনেক মায়াময় তোর মুখটা জানিস..

ভাবলাম একবার জিজ্ঞাসা করি..
কেউ তো আমাকে এমন করে বোঝে না তুই কেন এত বুঝিস..?
আবার ভাবি ও না বুঝলে কে বুঝবে আমার ব্যাপারে.. বলতে ইচ্ছা করে জানিস না আমি হাদারাম..?

ক্যাম্পাসের সবাই যখন আমার পোষাক আশাক দেখলে ক্ষ্যাত ছাড়া কিছুই বল তো না..
আর ভাবার কারণ ও আছে অনেক…
কখনও ভাবিনি ইরাবতী মত ভালো একটা বন্ধু পাবো..

মনে হয় যেন বানরের গলায় মুক্তার মালার মত লাগে..
অবশ্য খারাপ দেখা তো না শিবের গলায় সাপ যদি অলংকার হয়..?
ইরাবতীর পাশে হাদারামও মানায়..
ইরাবতী কে মাঝে মাঝে আমার বড্ড অচেনা লাগে মেয়েটা কিসের যেন একটা বিষন্নতায় ভোগে..

দেখা যায় মাঝরাতে ফোন দিয়ে বলবে..

-আচ্ছা তোর জ্যোৎস্না ভালো লাগে..
মাঝ রাতে উঠে ছাদে হাত দুটো মুক্ত পাখির মত মেলে দিয়ে হিম শীতল বাতাস অনুভব করতে ইচ্ছে করে..?

আমি শুধু মুগ্ধ হয়ে তার কথা শুনে যেতাম আর ভাবতাম..
এত সুন্দর ভঙ্গিমায় মেয়েটা কিভাবে কথা বলতে পারে..
আমি পারি কেন না..?

একবার একটা কাব্য রচনা করে নিয়ে গিয়েছিলাম..!
রচনাটা পড়ে ইরাবতী কি যে হাসি হেসে ছিলো মনে হচ্ছিল অক্সিজেনের বদলে লাফিং গ্যাস শুষে নিয়েছে..

বৃষ্টিতে ভিজলে মেয়েটার জ্বর আসাটা যেন বাধত্যামুলক হয়ে দাড়িয়েছিল..
কিভাবে যেন বুঝেও যেত যে আজ বৃষ্টি আসবে আর সে দিনই ইচ্ছে করে ছাতা টা রেখে আসতো ইরাবতী..

পরেরদিন যখন আমি ছাতা নিয়ে আসি সেদিন বৃষ্টির কোন পাত্তা পাওয়া যেত না..
এজন্যই ইরাবতী হয়ত আমাকে হাদারাম বলে..
বৃষ্টির হিমশীতল পানির ছোয়ায় যখন কাপতাম তখন ইরাবতী কে দেখতাম মেয়েটা অবলিলায় দুহাত মেলে আকাশের কান্না কে আলিঙ্গন করছে..

-শোন না কাব্য..?
বৃষ্টির কনাগুলো যখন আমাকে ছুয়ে যায় তখন আমাকে কি বলে জানিস..?
“মুছে দিয়ে যাচ্ছি আমার বিশুদ্ধতায় তোমার উচ্ছিষ্ট অনুভুতি গুলো..
যা তোমাকে তোমার মনের অগোচরে খরোস্রোতা এনে দেয়”

আমি মোটা ফ্রেমের ঝাপসা চশমা টা একটু উপরে ঠেলে মুখটা বৃত্ত্যের আকার নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে কথা গুলোর মানে খুজতাম..
ইরা তখন আমার দিকে তাকিয়ে হাসে ,হাসিটা অনেক তৃপ্তির..
পরম শান্তির লাগে মনে..
দাগ কেটে যায় মনের অগোচরে..

-কিরে পানির স্বাদ নেয়ার চেষ্টা করছিস নাকি..?
জানিস বৃষ্টি আমার এত পছন্দ কেন..?

-কেন..?

-বৃষ্টির শুদ্ধতায় আমার চোখের নোনতা কষ্টটার স্বাদ পালটে দেয়..
বৃষ্টির মিষ্টাতার কাছে আমার নোনতা অনুভুতিগুলো সুখের স্বাদ নিতেই চায় আজিবন মনে হয়..

ইরার কথার মানে খুজতে গিয়ে যখন নিজেকে গুলিয়ে ফেলি তখন ভাবি মেয়েটা এত কঠিন কথা কিভাবে বলে..?
মেয়েটা সত্যি লেখালেখি করলে নিমিষেই বড় কোন লেখিকার খাতায় ওর নামটা উঠে আসতো..

শহর থেকে কয়েক কিলো পরেই একটা সবুজ মাঠ ছোট একটা নদী বয়ে গেছে আর মাঠের চারপাশ দিয়ে শুভ্রতায় ভরে গেছে কাশফুল..
এখানে ইরা আর আমি প্রায় আসি..
ইরার নাকি এটা অনেক পছন্দের জায়গা..
খোলা আকাশের নিচে ইরা মুক্ত পাখির মত দাপিয়ে বেড়ায়..
শুভ্রতায় ভরা একটা কাশফুল ছিড়ে যখন দখিনা হাওয়ায় সে ফুলের শুভ্রতা উড়িয়ে দেয় আমি তখন চাতক পাখির মত চেয়ে দেখি..

কৃষ্ণচুড়া তার পছন্দের ফুল বড় মাঠটার পশ্চিমে একটা কৃষ্ণচুড়ার গাছ আছে…
মগডালে পাখির বাসার মতো দুটো থোকায় ফুল ধরেছে..
আমাকে বলত..

-তুই গাছে উঠতে পারিস..?

-না কখনো উঠিনি যদি পা পিছলে পড়ে যাই..?

– ভিতুর ডিম একটা…
যা এখান থেকে…

বলেই মেয়েটা মুখ ভার করে নদীর পাড়ে বসে ঢেউয়ের নৃত্য দেখছিলো আমি পিছন থেকে বললাম ইরাবতী..?

কিছুটা রাগি ভাবে নিয়ে তাকালো আমার দিকে..

-শোন..
তোকে যদি কেউ দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া কৃষ্ণচুড়ার একটা পাপড়ি দেয় তুই রাগ করবি..?
আর তাতে যদি দু ফোটা ঘামের গন্ধ লেগে যায়..?
তুই কি পরম যত্নপূর্বক তা গ্রহন করবি..?
নাকি রাগ করে ফেলে দিবি নদীর ওই পানিতে…?

ইরা আমার দিকে তাকিয়ে ভূত দেখার মত চমকে উঠলো..
অবশ্য গাছে চড়তে গিয়ে আমি ভূতের থেকে কোন অংশে কম হইনি শার্টের বোতাম দুইটা ছিড়ে গেছে কোনুই কেটে রক্ত বের হচ্ছে..

– কি করেছিস তুই এসব..?
তোকে গাছে চড়তে বলেছে কে হাদারাম..?
দুমড়ানো কেন তুই যদি আমাকে শুকিয়ে যাওয়া দুটো পাপড়ি এনে দিস..
আমি সযত্নে তুলে রেখে দিবো..
কাব্য তোর ছোটবেলার সব জিনিস কি আছে..?
(কিছুটা ভ্যাবাচেকা খেলাম কথাটায়)

-না তো..
তবে কয়েকটা আছে..?

-কেন আছে জানিস..?
সেগুলো তোর অতি প্রিয়..?
আর মানুষ তার অতি প্রিয় জিনিস কে যে কোন মুল্যে তার কাছে রাখতে চায়..!
আমার কাছে তোর দুমড়ানো মোছড়ানো ফুলটাও ততটাই প্রিয়..
আমি হা করে ইরার কথা শুনতাম..
মেয়েটার অনেক কথার মানেও জানতাম না..
কখনও জানাও হবে না হয়ত…

ডাইরী খুলে যখন ইরার হাসি মাখা মুখটা দেখতাম.. সারাদিনের ক্লান্তিটা নিমিষেই উধাও হয়ে যেত..
ছোট বেলা থেকে ডায়েরী লিখতাম বেশ কয়েকটা ডায়েরী হারিয়েও ফেলেছি শেষ সম্বল বলতে এটাই আছে..

যখন ইরা কে নিয়ে ভাবি..
খুব সুন্দর করে কাব্য লিখতে ইচ্ছে করে..
কিন্তু কি করব..
আমি একফোটাও কাব্য রচনা করতে পারি না..
আসলে কাব্য জিনিসটাই আমার ভালো লাগে না..
কেন যে বাবা মা এত নাম থাকতে কাব্য নামটাই আমার রেখেছিলো..
নামটা কাব্য না হয়ে #কাব্যহীন হলে ভাল হত..

কবিতা উপন্যাসের কথাগুলো আমি বুঝি না..
হয়ত সেই লেখার ভাষাগুলো অতীব গভীর বলে..
স্কুল লাইফে পড়া অবস্থায় নিপা নামে একজন ম্যাডাম ছিলেন,যিনি বাংলা পড়াতেন..
একদিন বলে বসলেন..
কাব্য একশব্দে একটা মানুষের দূর্নাম ও সুনাম করো তো..

আমি ভ্যাবাচেকা খেয়ে ওনার দিকে তাকিয়ে বললাম “আমি পারবো না”

নিপা ম্যাডাম একগাল হেসে বললো..
“ভয়ংকর সুন্দর..

ম্যাডাম কে জিজ্ঞাসা করলাম..
-কিভাবে কি হলো এই শব্দ দ্বারা..?

-দেখো আমরা যখন এই শব্দটা কাউকে বলি তখন আমরা ভাবি তার অনেক সুনাম গাইছি বা সেও এটাই ভেবে নেয় যে তুমি তার অনেক সুনাম গাইছো..
বাস্তবিক ভাবে তুমি তার সুনাম এবং দুর্নাম দুটোই করেছো..

-কি ভাবে বুঝতে পারলাম না তো..?

-আমরা যখন বিভৎস কোন জিনিস দেখি কি বলি..?
‘কি ভয়ংকর’ আর যখন অপরুপ জিনিস দেখি তখন কি বলি..?
‘বাহ কি সুন্দর’..
বুঝেছ এবার?

ইরা কে নিয়ে লিখতে বসলে যেন শব্দের জোয়ার ভেসে যায় কথার ফোয়ারা সৃষ্টি হয় মনের অগোচরে…
কলম যেন থামতেই চায় না..
যত দেখি ততই নতুন লাগে ভাবি একবার গিয়ে বলি..

-আচ্ছা তুই একটা উপন্যাস অথবা একটা অনেক বড় গল্প কিংবা একটা নদী হস নি কেন..?
তাহলে হয়ত এতদিনে পড়ে নয়ত সাঁতরিয়ে পার হয়ে যেতাম..
প্রতিদিন এভাবে পড়তে বা সাঁতরাতে হত না..
কোনদিনও বলা হয়ে ওঠে না কথাটা..

গ্রীষ্ম বর্ষা কেটে যায় ফাল্গুনও যে চলে যায়..
তবুও আমার বলা হয়ে উঠলো না..
ইরা অনেক ভালবাসি গো তোমায়..

ক্রেমশই সময় যেতে থাকে তার নিজের গতিধারায়..
আমার ভেতরের ব্যাকুলতা বাড়তে থাকে..
ইরার মধ্যমা আঙুলটা ছুয়ে দেখতে ইচ্ছে করে..
এই আঙ্গুলেই তো আংটি পড়িয়ে ভালবাসার পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ করে..
ইচ্ছে করে কুয়াশায় মোড়ানো সকালে খালি পায়ে শিশিরে ভেজানো ঘাসের উপর ইরার হাতটা ধরে হাটে চলি দুর অজানায়..
মনে কথাগুলো মনেই চেপে রাখতে হয়..
কিছু একটা হারানোর ভয়ে…

যখন সেমিস্টার পরীক্ষার শেষে সবার মুখে যুদ্ধে জয় লাভ করার মত হাসি আসে..
ইরার মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায় কেমন মলিনতা ভর করে লালচে ওই নিষ্পাপ গাল দুটিতে…
ঠোঁটা যেন হাজার বছরের উপবাসী ছিলো..

সেই প্রথম বর্ষ থেকে আজ পর্যন্ত এই প্রশ্নের উত্তরটা পাইনি..
যতবার জিজ্ঞাসা করেছি ইরা আমাকে এড়িয়ে গেছে..

-ইরাবতী..?
তোর বাসায় যেতে ভাল লাগে না তাই না.?
ক্যাম্পাসেও তো কারো সাথে খুব একটা মিশতে দেখি না..?
তুই কেন এমন..?
আচ্ছা আমাদের বাসায় যাবি..?

– হা হা পাগল..?
তোর মায়ের ঝাটার বাড়ি খাবো..?
আর আমাকে নিয়ে গেলে তোকেও বাড়ি ছাড়া হতে পারে..
তখন থাকবি কই গাছতলায়..?

-হুম গাছতলায় থাকবো..
খড় দিয়ে একটা কুড়েঘর বানাবো দক্ষিনে আর পুর্ব দিকে দুটো জানালা রেখে দিবো..!
একটা দিয়ে দখিনা বাতাস আর একটা দিয়ে চাদের আলো ঢুকবে..

-হইছে স্যার এবার কল্পনার জগত থেকে বেরিয়ে আসেন..?
আমার বাস চলে এসেছে ব্যাকগুলো তুলে দিবি নাকি আমিই তুলবো..?

-তুলে দিচ্ছি..

-কাব্য আমাদের যদি আর দেখা না হয় কখনো..?
জানিস কেন আমার বাড়ি যেতে ইচ্ছে করে না..?
আমার মা আমাকে এতটুকুও ভালোবাসে না রে..
আমি যে এতবড় একটা মেয়ে তবুও আমার গায়ে ওনার হাত তুলতে একটুও বাধে না..?
বাসায় গেলে আমাকে একবারের জন্য জিজ্ঞাসা করে না কেমন আছিস মা..?
উল্টো এখান থেকে গিয়ে রাতে তার হাত পা টিপে দিতে হয়..?
জানিস ওনার ভালোবাসার কত চিহ্ন আমার শরীরে আছে..?
কত জায়গা কেটে আর ছিড়ে গেছে..?

(ইরার মুখে কথাগুলো শুনে মাথা নিচু হয়ে গেলো,
চোখের কোণ বেয়ে গরম পানির উপস্থিতি অনুভব করলাম)

জানিস, আমি যখন কাঁদি তখন আমার মা মনে হয় খুশি হয় তার ঠোটের কোনে একটা বাকা হাসি লেগে থাকে..!
সবাই আমাকে বলে উনি তোর সৎ মা..
আমি আজও বিশ্বাস করি উনিই আমার মা..
আচ্ছা তুই বল মা তো মা ই হয় তাই না..?
মা’দের কখনো রং হয়..?
মা শব্দটার কি আলাদা নাম হয় বল..?
শোন কাব্য..
আমাকে একটা কথা দিবি..?
আমি যদি কখনো হারিয়ে যাই আমাকে খুজবি না..?

কথাটা শুনে বুকের মাঝখানটা ডুকরে কেঁদে উঠলো,
খড়োস্রোতা নদীর মত লাগলো নিজেকে..
হাতের অপর পিট দিয়ে চোখের পানিগুলো মুছে নিলাম…
ইরার দিকে তাঁকিয়ে বললাম..

সত্যি তো মা’দের কোন ভাগ হয় না, কোন আলাদা ডাক হয় না..
তাহলে কেন আজ এইরকম বৈসম্য আমি জানি না রে..

আর হারিয়ে যাবি মানে..?
কোথায় হারাবি..?
ফাইনাল পরীক্ষা তো হলো এরপর শুধু রেজাল্ট আর কাগজপত্র নিতে আসতে হবে ভার্সিটিতে,তুই আসার আগে আমাকে ফোন দিস..
তাহলে দেখা হবে…
অশ্রু ছলছল চোখে ইরাবতী কে বিদায় দিলাম…

আমি ভাবেছিলাম..
ইরা আমাকে ফোন দিবে..
কখনও ভাবিনি আমার ধারনা ভুল করে দিবে ইরাবতী.. বাসায় যাওয়ার পর আজ পর্যন্ত প্রায় ছয় মাস হলো..
একটা ফোন পাইনি ইরাবতীর..
আমার কাছে থাকা নাম্বারটা বন্ধ পেয়েছি..
বাসার ঠিকানা পর্যন্ত আমাকে জানতে দেয়নি ভার্সিটিতেও যোগাযোগ করে কিছু পাইনি..
কোন ভাবে শুধু শহরের নাম টা জানতে পেরেছিলাম..

কিন্তু এতবড় শহরে তো একটা মানুষকে খোজা মানে খড়ের গাদায় সুই খোজার মত অবস্থা..
কখনও ভাবিনি ইরাবতী এভাবে হারাবে আমার জিবন থেকে…
কিছুটা ভেঙ্গে পড়েছিলাম, কিন্তু বিশ্বাস হারাইনি.. ইরাবতীর সাথে আমার আবার দেখা হবেই এই বিশ্বাসস্থাপন করেই চলেছি প্রতিনিয়ত..

একটা ইন্টারভিউ এর জন্য ডাক পেয়েছি..
নেহাত মায়ের মুখে একটু হাসি দেখবো বলে যেতে হচ্ছে..

আমার ডায়েরিটা আর চিঠিটা খুজে পাচ্ছিনা যেটা সবসময় আমার বুক পকেটে থাকত..
(ইরাবতী কে নিয়ে লেখা)
হয়ত রুম্মেটদের বই খাতার সাথে চলে গেছে..
ইরাবতীর শেষ স্মৃতিটাও খুজে পেলাম না..
আচ্ছা ইরাবতীর তো আমার বাড়ির ঠিকানা এমন কি মায়ের নাম্বার পর্যন্ত জানাছিল তার কি উচিত ছিল না একটাবার ফোন দেয়ার..?
(কোন উত্তর আজ আমার জানা নেই)

ইরা মেয়েটা অদ্ভুদ ভাবে মিশে গেছে আমার জিবনের সাথে..
আমি হাজার চেষ্টা করতাম মেয়েটাকে ভুলে থাকতে..
ইরার স্মৃতিগুলো যেন ইচ্ছে করেই আমাকে মনে করিয়ে দেয় ইরার কথা..

রোজ সকালে ঘুম থেকে উঠে একটা ব্যাগ আর কিছু ফাইল পত্র কাধে ঝুলিয়ে..
লোকাল বাসের আমজনতার সাথে বাক যুদ্ধ করতে করতে অফিস যাওয়া-আসায় হাপিয়ে উঠছিলাম প্রতিনিয়ত মনে হচ্ছিল সব ছেড়ে বনবাসে চলে যাই..

মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতেও পারতাম না, কিছু করতেও পারতাম না..
দু্র্বিসহ্য লাগছিলো জিবনটাকে এভাবেই কি চলবে..? নেহাত ভাগ্যের খেলা বলে মেনে নিয়ে ছিলাম..

আজ বাস পাইনি হেটেই রওনা দিয়েছিলাম রাস্তার ধার থেকে এক ঠোঙা বাদাম কিনে রাস্তায় পড়ে থাকা ক্যান টাকে ফুটবল বানিয়ে বাউণ্ডুলেদের মত হাটছিলাম..

ল্যাম্পপোষ্টের হলদে আলোয় নিজেকে বড্ড অচেনা লাগছিল..
মনে হচ্ছে আমার আমি কে সেই কবেই হারিয়ে ফেলেছি এখন যা আছে তা শুধুই খোলস মাত্র..

একটা মানুষ যে এভাবে আরেকটা মানুষ এর উপর প্রভাব ফেলতে পারে ইরা আমার জীবনে না আসলে কোন দিনই জানতাম না..

রাতের এই নিকশ আধার আমার অনুভুতি গুলোতে আলো ফুটতে দেয় না..
হাটতে হাটতে কখন বাড়ির কাছে এসে পড়েছি খেয়াল নেই..

ছোট একটা বাড়ি কয়েকটা ঘর ফুলের গাছ..
আর ইলেক্ট্রিক খাম্বার মত একটা শুকিয়ে যাওয়া গাছ,
গাছটা কাটা হয়না..
মা বলে এটা নাকি দাদা তার নিজের হাতে লাগিয়েছিল এটাই তার শেষ স্মৃতি..

দরজায় বেল বাজাতে ইচ্ছে করছিলো না তাই ঠক ঠক আওয়াজ করলাম..
ছোট বোন বেরিয়ে দরজা খুলে দিলো..
পিচ্চিটাকে আজ যেন একটু বেশিই খুশি লাগছিল.. ব্যাগটা রেখেই ছাদে গেলাম পিচ্চিটাকে কফি দিতে বললাম..
ছাদে কয়েকটা গাছ আছে চাঁদের মৃদ্যু আলোতে এদের বেশ মায়াবী মনে হয়..
ইরাবতীর কাজল কালো চোখ দুটির গভীরতার কাছেও এই মায়াবী গাছগুলো তুচ্ছ মনে হয়..
চাঁদটাকে আজ একটু বড় মনে হচ্ছে..
ঠিক যেমন দোকানদারগুলো মাঝে মাঝে বলে..
নাও বাবা আজ একটু বেশিই দিলাম..

কাচের চুড়ির টুং টাং শব্দে ধ্যান ভেঙ্গে গেল ভাবলাম ছোট বোন হয়ত চুড়ি পরেছে..
পিছনে না ঘুরেই বললাম রেখে যা..

“আচ্ছা প্রেমিক-প্রেমিকাদের তুমি বাদ দিয়ে তুই করে বলা যায় না..?
তাজা গোলাপ না দিয়ে সদ্য ঝড়ে পড়া একগুচ্ছ কৃষ্ণচুড়া দিয়ে বলা যায় না ভালোবাসি..?
কিংবা প্রাইমারি স্কুলে থাকাকালিন বইয়ের ভাজে থাকা জংলি ফুল দিয়ে বলা যায় না ভালোবাসি..?
কিংবা স্কুলের পিছনে থাকা বকুলের ফুল দিয়ে বলা যায় না ভালবাসি..?
সেও বলবে ভালোবাসি কিন্তু বাকিদের মত তাজা গোলাপ দিয়ে নয়..?
শুভ্রতায় ভরা কাশবনের একগুচ্ছ কাশফুল দিয়ে..
যখন সূর্য্যি তার আলো নিভিয়ে গোধুলী বয়ে আনবে তখন..
যখন পশ্চিম আকাশটা রক্তিম আভায় ছেয়ে যাবে..
বলবে….
বলতে চাই শুনছিস..?
আলো তো নিভে গেল আমি আবার আলো হয়ে আসতে চাই তোর জীবনে..!
এভাবে রক্তিম আকাশ নয় নীল আকাশ হতে চাই..!
জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তোর হাতে হাত রাখতে চাই দিবি..?(ইরাবতী)

-কি হাদারাম..?
ডায়েরী আর বুক পকেটের চিঠিটা খুইয়ে এখন বুঝি দেবদাস..?(ইরাবতী)

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত