ছিঁচকাঁদুনে

ছিঁচকাঁদুনে

তিন্নি- এই তোকে নিয়ে না আর পারা যায়না জানিস তো।
সায়ন- আমি কি করব, আমার কান্না পেলে, জানিস ই তো আমি কান্না পেলে কন্ট্রোল করতে পারিনা নিজেকে, তুই তো সব জানিস, তাও এরম বলবি?
তিন্নি- হ্যাঁ জানি, তা বলে ওভাবে? বয়েস টা তো হচ্ছে নাকি? একটু তো ম্যাচুওরড হ রে
সায়ন- না আমি পারবোনা, কি করব প্রতিবার ভাবি এবার আর কাঁদবনা, তাও কেন যে এরম হয়
তিন্নি- নে এবার তো ফোনটা করে বাড়িতে বল যে ফ্লাইট ঠিক টাইমে ল্যান্ড করে গেছে, আমি দেখি ক্যাবটা বুক করি, আর হ্যাঁ শোন, ওই বাড়িতে ও ফোনটা করে দিস, আমি পরে মাকে কল করে নেব।
সায়ন- হ্যাঁ, হ্যালো, আমরা পৌঁছে গেছি ভালোভাবে, চিন্তা করোনা তোমরা। পরে কথা হবে, এখন রাখি। বাবা কে বলে দিও, হ্যাঁ আমি ওই বাড়িতেও কল করে দিচ্ছি, তিন্নি ঠিক আছে।
সায়নের মা- মেয়েটার খেয়াল রাখিস বাবা, তোদের জন্যে খুব মন খারাপ করে রে। ভালো থাকিস তোরা।
তিন্নি- এই কি রে? উফ! আবার ফোনেও শুরু করলি নাকি? চল, ক্যাব চলে এসছে
সায়ন- হ্যাঁ চল
তিন্নি- এই কদিন কিভাবে কেটে গেল বুঝতেই পারলাম না, খুব মিস করছি রে মামনি আর বাপিকে
সায়ন- আর বাবাকে করছেনা বুঝি তার আদরের পরী? তিন্নির মাথায় হাতটা বুলিয়ে দিয়ে বলল সায়ন ক্যাব এ
তিন্নি- করি রে, সবসময় করি। কি করব বল? উপায় কি?
সায়ন- তোকে তো কতবার বলি, ট্রান্সফার নিয়ে নিতে। শুনিস আমার কথা?
তিন্নি- আমি চলে গেলে তোর কি হবে? পারবি এই শহরে একা থাকতে? কেঁদেই দিন কাটিয়ে দিবি তখন
সায়ন- হে হে হে। তাই বুঝি?
তিন্নি- তা না তো কি? এত বড় হয়ে গেলি তবুও দেখ ফ্যাচফ্যাচ করে কাঁদবে ফেরার সময়। আমায় দেখিস কখনও কাঁদতে? তোর

মত অত ইমোশনাল নই আমি। বড় হয়েছিস, তাও ছেলে, এরম করলে চলে বল? মামনির কথাটা ভাব, কত কষ্ট পায় বলতো?

সায়ন- আচ্ছা আমার যদি এবারে অনসাইট টা হয়ে যাবি, কি করবি তুই ভেবেছিস?

তিন্নি- কি আবার, পাত্তারি গুটিয়ে সোজা কোলকাতা। যদি ভেবে থাক আমি তোমার সাথে বিদেশ ঘুরতে যাব, ওসব হবেনা বস্।

বুড়বুড়িগুলোকে এখানে একা ছেড়ে, পারবোনা রে, তার চেয়ে তুই বরং ওখানে একটু সামলে নিস।
সায়ন- হুম
তিন্নি- কি হল? ওমনি মুড অফ হয়ে গেল তো?, তুই না সত্যি। আচ্ছা বল আমাদের বিয়েই প্রায় দু বছর হতে চলল, তার আগেও কলেজ থেকে হিসেব করলে ন বছর ধরে তোকে চিনি, আমরা এখন অনেক বড় হয়েগেছি সায়ন, আমাদের সামনে অনেক দায়িত্ব, এইটুকুতেই এত ইমোশনাল হলে চলে বল?
সায়ন- (ক্যাবে তিন্নির মাথাটা নিজের কাঁধে নিয়ে) তিন্নি তোর মনে পড়ে, সেই কলেজে প্রথম যেদিন তোকে দেখেছিলাম, হস্টেলের সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলি, কাকু কাকিমা তোকে রেখে যাওয়ার পর……
তিন্নি- হি হি হি। তখন ওটাই আমার প্রথম দিন ছিল বাবা মাকে ছেড়ে একা থাকার, আর তুই সেদিন বীরপুরুষের মত এসে আমায় বলেছিলি চাইলে তোর মোবাইল থেকে কল করতেই পারি, আমার ফোনে টাওয়ার ছিলনা বলে….সেই শুরু, তারপর তো দিন যত এগোল, বন্ধুত্বও তত বাড়ল বল….সব ভাবলে মনে হয় এইত সেদিনের কথা।
সায়ন- (জানলা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে) হ্যাঁ সেই…..খেয়াল করে তিন্নি ঘুমিয়ে পড়েছে কাঁধে মাথা রেখেই…..

আজও সায়নের মনে পড়ে জয়েন্টের কাওন্সিলিং এর দিনটা, সায়নের কিছু পরেই নাম ছিল তিন্নির ওরফে সুলগ্না সেনের। কাকুর

সেদিনের সেই চিন্তিত মুখটা বারবার মনে পড়ছে, ওইদিনই প্রথম টুকটাক কথা হয় সায়ন আর ওর বাবার সাথে তিন্নির বাবার।

তিন্নি তখন ভেতরে ছিল, তাই আর সায়নের জানাই হয়নি কোন কলেজে হল তিন্নির। পরে কলেজে এডমিশনের দিন তিন্নির বাবা

সায়ন কে দেখে নিজেই এসে কথা বলে, কাকিমাও কথা বলে সায়ন আর ওর বাবা মায়ের সাথে। তিন্নি এসবের কিছুই জানে না,

যেচে কথা বলা তাও আবার অপরিচিতদের সাথে, একদম ই পছন্দ করেনা তিন্নি, ওকে ওইদিন ই প্রথম দূর থেকে দেখে সায়ন,

এডমিশনের লাইনে দাঁড়িয়ে ছিল।ওদের হস্টেলে রেখে যাওয়ার সময় সায়নের হাতটা ধরে কাকু মানে তিন্নির বাবা বলেছিল ,

মেয়েটাকে একটু দেখ, ওত কাউকেই চেনে না, আর ও খুব অভিমানি, কাউকে কিছু বলবেও না, তাই এখানে তেমন আমি

কাউকেই চিনি না, তোমার সাথে পরিচয় হল তাই বলে গেলাম, ভালো থেকো বাবা। জানিনা সেদিন কাকুর কথাগুলোয় কি এমন

ছিল, বারবার তোর কথা ভাবাতে চাইছিল, মা বাবাও যাওয়ার সময় বলে গেল ভালোভাবে থাকিস। তাই সেদিন সন্ধ্যে বেলা ইচ্ছে

করেই গেছিলাম তোদের হস্টেলের দিকে, আমিও নতুন ছিলাম, তেমন কিছুই চিনি না, তবুও কেন জানিনা সেই প্রথম কারুর

জন্যে ভেবেছিলাম, এর আগে কখনও নিজের পড়া, খেলা বাদ দিয়ে কারুর জন্যে এত ভাবিনি। তুই হয়তো ভেবেছিলি সেদিন ছিল

আমাদের হঠাৎ দেখা, না রে পাগলি ওটা হয়ত ওপরওয়ালার ঠিক করাই ছিল। তুই তারপর প্রায়ই মন খারাপ করতিস কাকিমার

জন্যে, আর কেঁদে ভাসাতিস, তোকে হাসাতেই আমিও কাঁদতাম, বিশ্বাস কর তুই প্রথম এই উড়নচণ্ডী ছেলেটাকে দায়িত্ববোধের

বাধনে বেধেছিলিস। তুই আমাকে প্রথম থেকেই দেখতিস একটুতেই কেঁদে ফেলতে, নারে পাগলি, ওগুলো সব ছিল তোকে

হাসিখুসি দেখার প্রয়াস মাত্র, আমার কান্না দেখে যখনই তুই হেসে উঠতিস, জানিনা কি যে ভালো লাগত, হয়ত ওটাকেই ভালবাসা

বলে। সেই দেখে তুই আমার নাম দিলি ছিঁচকাঁদুনে। খুব হাসি পেয়েছিল, ভালও লেগেছিল। তারপর তোর সেই ফার্স্ট সেমে

রেজাল্ট খারাপ হওয়ার পরে কান্না, সেদিন মনে আছে , আমি তোকে বলেছিলাম, আমিও তোর মত অনেক কেঁদেছি, না রে,

আমার ওত সহজে চোখে জল আসে না , শুধু তোকে বোঝানর জন্যে যে নম্বরটাই জীবনে সব নয়। এইভাবেই কেটে গেল চারটে

বছর, কাম্পাসিং এ তোর সেই প্রথমবারে জবটা না হওয়ার জন্যে কত কেদেছিলি, আর সারারাত আমি তোকে ফোনে

ভুলিয়েছিলাম, তখন থেকেই আমার ভয় হত জানিস, তুই এত ইমোশনাল , ভবিষ্যৎ এ তুই কঠিন পরিস্থিতি সামলাবি কি করে?

কত চেষ্টা করতাম তোকে হাসিখুশি রাখার, বোঝাতাম জীবনটা অনেক বড়, অনেক কিছু বাধা আসবে, পেরতে আমাদেরই হবে।

আমি বাড়িতে অনেকদিন আগেই আমাদের কথা জানিয়েছিলাম, বাট চেয়েছিলাম তুই যেদিন মেনে নিবি সেদিনই সম্পর্কটা

পরিণতি পাবে, ওটাই ছিল সেইদিন, যেদিন তোর জবটা হয়ে গেল, বিশ্বাস কর ওই প্রথম আমি ভগবানের কাছে তোর জন্যে কিছু

চেয়েছিলাম, সেইদিন অনেক রাত হয়ে গেছিল, তুই ফেরার পথে আমার হাতটা ধরে বলেছিলি, ভেবেছিলি আমার দ্বারা তোকে

প্রপোজ করা কখনও সম্ভব নয়, সেটা নয়, আমি চাইনি জোর করে কিছু চাপাতে। যাই হোক, এরপর জবের জন্যে যখন শহর

ছাড়লি, সেদিন ও খুব ভয় পেয়েছিলাম, কিভাবে মানিয়ে নিবি নতুন শহরে, না পেড়েছিস তুই, তখন ভাবতাম কি জানি, আমার

উপর বেশী ভরসা করে ফেলছিস না তো? পারবি তো নিজেকে সামলে নিতে?এরপর খুব মনে পড়ছে বিয়ের দিনটা, তোর সেই

কান্না, কাকু আমার হাতটা ধরে বলেছিলেন, ” ওকে একটু দেখ বাবা”, নাহ, আজ আর কোন চিন্তা নেই। আজ আমার তিন্নি সত্যিই

বড় হয়ে গেছে, পারবে নিজেকে সামলে নিতে। এখন আমার ছিঁচকাঁদুনে বউটা কান্না লুকিয়ে হাসতে শিখে গেছে যে। দায়িত্ব নিতে

শিখে গেছে। কত খেয়াল রাখছে সবার, আমি এটাই চেয়েছিলাম রে।

তিন্নি- ইশ! একটু চোখটা লেগে গেছিল রে। চলেই এলাম তো
সায়ন- হ্যাঁ, এইতো আর পনেরো-কুড়ি মিনিট।
তিন্নি- তুই যাবি আজ অফিস?
সায়ন- না রে। তুই ও আজ যাস না, চল একটা দিন নিজেদের মত কাটাই।
তিন্নি- দ্যাখ অলরেডি অনেক ছুটি চলে গেছে আমার, আর না।
সায়ন- ওকে এজ ইউ উইশ।
তিন্নি- তুই কি করবি সারাদিন? ঘুমবি নিশ্চয়ই?
সায়ন- না রে, একটু কাজ আছে, ভিসার কাজ গুলো সেরে রাখি, তোকে বলা হয়নি লাস্ট উইকেই অফারটা পাই, বাড়িতে সবাই জানে, তোকেই বলিনি, তোর আনন্দটা নষ্ট করতে চাইনি।
তিন্নি- কবে যাচ্ছিস?
সায়ন- দেরি আছে, আশাকরি ততদিনে তোর কলকাতায় ট্রান্সফারটা হয়ে যাবে। পারবি তো একা থাকতে?
তিন্নি- পারবনা মানে? এই ছিঁচকাঁদুনে কে এতদিন সহ্য করলাম , আর এটুকু পারবনা, চল আজ তাহলে সেলিব্রেট করি, অফিস তো থাকবেই। হি হি হি
সায়ন- চল, ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নিয়ে বেরোই। সত্যি আজ খুব রিলাক্স লাগছে। তিন্নির কপালে আলতো চুমু খেয়ে বলল সায়ন।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত