ক্যানিয়ন

ক্যানিয়ন

উইংচ্যাপের টুংটাং আওয়াজে ঘোর কাটিয়ে উঠতেই দেখি, ঘড়িতে ঠিক বিকেল পাঁচটা বাজে ।

অনেকদিন পর আজকের দিনটা ছিল আমার ইচ্ছেমত আলসেমি খোঁজার দিন ।

তাই এক মগ আগুন গরম কফি নিয়ে বারান্দায় বসেছিলাম সময় কাটানোর জন্য ।

জানেন পাঠক, আমার বাসার এই ছোট্ট বারান্দাটির কখনো মন খারাপ হয় না ।

বলতে পারিনা, একটা বারান্দার কি কখনো নিজস্ব অনুভূতি থাকতে পারে ? বোধ হয় , পারে ।

নাহলে এক মগ কফি নিয়ে এই বারান্দায় বসলে আমার নিজের সাথে এত বোঝাপড়া কেমন করে হয়ে যায় ?
কফিতে শেষ চুমুক দেবার আগেই কল রিঙ্গের আওয়াজ পেয়ে উঠে দাঁড়াই আমি।

টেবিলের ওপর রাখা মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে দেখি ছোটফুপি – স্কাইপিতে কল দিয়েছে ।

কল রিসিভ করতেই সে চিবিয়ে চিবিয়ে বলল,
“ কি ইরা ? খুব ভাল্লাগছে এখন তোর, তাইনা ?”
চোখ থেকে চশমাটা খুলে নিয়ে ঘোলাটে দৃষ্টিতেই স্কাইপি স্ক্রিনের দিকে তাকালাম আমি ।

ফুপির চোখ পাকানো এক্সপ্রেশান দেখে ফিক করে হেসে ফেলতেই সে রীতিমত চিৎকার করে আমাকে বলল,
“বেয়াদব মেয়েমানুষ ! হাসবিনা একদম !”
আমি হাসি থামানোর প্রানপন চেষ্টা করে মুখে আঙ্গুল ঠেকিয়ে বললাম ,
“ ওককে ! এই থামলাম আমি । আর হাসবোনা । খেপে আছো কেন বল তো ?”
“ ইরা, তোকে বলেছিলাম আমি – এইসব ছাড় তুই !”
আমি কফিতে শেষ চুমুকটা দিয়ে নাক টেনে বললাম ,
“ কি ছাড়বো বলতো ?”
“ চুপ কর ! তোকে বললাম আমেরিকান ছেলেটার সাথে ডেইট কর – সেলফি আপ-দে ।

ওই পাজির পা ঝাড়া লোকটাকে তো এখনো লিস্টে রেখে দিয়েছো – ওকে দেখাও , তাকে ছাড়া তুমি বিন্দাস আছো !”
“ আসল কথা, তুমি চাচ্ছো শায়নকে আমি জেলাস বানাই, তাইতো ? বুঝেছি ।”
ফুপি হাল ছেঁড়ে দিয়ে বলল, “ তুই কি চাস বলতো ?”
আমি এক মুহুর্ত চুপ থেকে বিশাল একটা নিঃশ্বাস ফেলে বললাম ,
“ আরো কিছু বছর এই পৃথিবীর কার্বন ডি অক্সাইড বাড়িয়ে ধাম করে মরে যেতে চাই ।”
“ তুই মর না – এক্ষুনি মর । নাইলে ব্লক দিব আমি তোকে , কেমন ?”
আমি অট্টহাসি দেবার আগেই ফুপি কল কেটে দিয়ে অফলাইন হয়ে গেল । ভদ্রমহিলা রেগে আছে ভীষন ।

রাগ করার অবশ্য একটা কারন আছে – স্টিফেন নামে আমার এক আমেরিকান কলিগ আমাকে অনেকদিন ধরেই পটানোর চেষ্টা করছিল।

বহুবার সহ্য করার পর সেই ভদ্রলোককে আজকে আমি সিরিয়াসলি রিজেক্ট করে দিয়েছি ।

অথচ কোন এক অদ্ভুত কারণে ফুপি একে একদম এ প্লাস মার্কস দিয়েছিল । তাই আমার এই কাজে সে খেপে আগুন হয়ে আছে ।

অবশ্য এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই । আমার কাজকর্মে রাগ করাটা তার জন্য আলুভর্তা- ডিমভাজির মতই নরম্যাল হয়ে গেছে ।

আর আমি তো জানি , সে কেন আমাকে নিয়ে এত চিন্তা করে !
কফিমগটা নামিয়ে রেখে আমি আমার কোলের ওপর রাখা অফহোয়াইট কালারের এনভেলাপটিকে ছুঁয়ে দিলাম ।

জানেন পাঠক, এই এনভেলাপটার মাঝে পুরনো হয়ে যাওয়া একটা বিয়ের ইনভাইটেশান কার্ড রয়েছে ।

খুব সম্ভবত কার্ডটার বয়স প্রায় পাঁচ বছর পেরিয়ে গেছে । অথচ এখনো একে দেখলে আমার পুরো পৃথিবীটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে যায় !
এই পর্যায়ে এসে পাঠককে বরং আমার ব্যাপারে কিছ কথা বলে নিই । জানেন পাঠক, আমি মেয়েটা আগে থেকেই ভীষণ বোকা ছিলাম ।

তাই খুব বোকার মতই একটা সময় আমি ভাবতাম , যদি কখনো কাউকে ভালবাসি তো চুপ করে থাকব না !

একদম ছেলেটার কলার চেপে ধরে বলব , ভালবাসতেই হবে আমাকে ।

খুব বোকাবোকা ভাবনা, তাইনা পাঠক ? অথচ দেখুন, বাস্তবতা কি অদ্ভুত !

আর এই অদ্ভুত বাস্তবতা সত্যিই আমাকে যখন ভালবাসতে শেখাল , আমি বিস্ময়ের সাথে আবিষ্কার করলাম – আমার সামনে একটা পথই খোলা ।

আর সেই পথটা ধরে আমাকে নাকি চুপচাপ সরে যেতে হবে !

যে ছেলেটাকে ছাড়া আমার দম নিতেও কষ্ট হয় , এই একটা জীবন আমাকে নাকি তাকে ছাড়াই বাঁচতে হবে !
খুব ছেলেমানুষি জেদে আমি তাকে আঁকড়ে ধরতে গেলাম । কিন্তু তার চোখের দিকে তাকিয়ে দেখলাম , সেই চোখে আমার জন্য কোন জায়গা নেই ।

তার নিঃশ্বাস আমার নামটা উচ্চারন করতে পারেনা ।

আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যেতে লাগল , কিছু বুঝে উঠবার আগেই আমি ডুবে যেতে থাকলাম এক অচেনা চোরাবালিতে !
কয়েকদিন পর এই আমিই আর তার কলার চেপে আমাকে ভালবাসতে বাধ্য করবার কথা ভাবতে পারলাম না ।

সেই অধিকারটুকু যে আমার নেই । আমাকে সে চায় না , ভালবাসেনা কিংবা তার জীবনে আমার অস্তিত্ব খুবই নগন্য –

এরকম অনেকগুলো বুলেট এসে আমার হৃদয়ের মাঝখানে আঘাত করতে লাগল দিনের পর দিন ।

তাকে ছাড়া ভাল থাকবার কোন সুযোগ আমার নেই , তবুও আমি প্রতিদিন তাকে ছেড়ে যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগলাম ।

ভাবলাম , আমি চলে গেলে সব ঠিক হয়ে যাবে । আমি তো একাই ছিলাম , আরো একটু বেশি একা হয়ে গেলে আর কি ক্ষতি হবে আমার ?
প্রিয় পাঠক, একটা জিনিস আমি খুব ভালভাবে বুঝে গিয়েছিলাম – আমি যতদিন তার কাছাকাছি থাকব, ইচ্ছেয় অনিচ্ছেয় তাকে বিরক্ত করব।

হ্যা , বিরক্ত ! আমি নিজেকে থামাতে পারতাম না কিছুতেই । তাই দূরে সরে যাওয়াটাই আমার একমাত্র অপশান ছিল ।

ঠিক করলাম, নিজের এই ভাগ্যকে মেনে নেব ।

দূরে চলে যাব – যত দূরে চলে গেলে এই একটা জীবনে সে আমার অস্তিত্ব আর খুঁজে পাবেনা কোনদিন !
আমার আগের জীবনটায় যদি ফিরে যেতে পারতাম , কতইনা ভাল হত ! যে জীবনে সে ছিল না । কেন যেন মানুষ শুধু বদলেই যায় ।

মানুষের ভাল লাগাগুলো বদলে যায় । দুজনের মাঝে একজন মুভ অন করতে পারে , আর অন্যজন চুপচাপ হয়ে যায় – মৃত মানুষের মত।

জানেন পাঠক, আমার ক্ষমতা থাকলে আমি ওকে চলে যেতে দিতাম না ।

দুই হাতে ওর শার্টের হাতা খামচে নিয়ে বলতাম , “ শায়ন , তোমাকে ছাড়া বাঁচতে আমার অনেক ভয় করে ! শায়ন ! শায়ন !”
কিন্তু আমি পারিনি, আমার শেষরক্ষা হয়নি । শায়ন অন্য একজনকে পছন্দ করত ।

তার পছন্দ করা মেয়েটার নাম কি অথবা সে দেখতে কেমন – এসব কোন কিছু জানতে চাইবার সাহসই আমি পাইনি কোনদিন ।

নিজের জীবনটাকে যদি কোরিয়ান কোন ড্রামা হিসেবে আমি দেখতে পেতাম , তাহলে চোখ বন্ধ করে আমাকে বলা হত সেকেন্ড লিড ।

জানেন পাঠক , সেকেন্ড লিডদের আমার কখনোই ভাল লাগত না – নায়ক নায়িকার মাঝে শুধু কাবাব মে হাড্ডিগিরি !

অথচ দেখুন, আমার নিজের জীবনে আমি নিজেই কিনা হয়ে গেলাম সেকেন্ড লিড ।

যে হাজার চেষ্টা করলেও তার ভালবাসাকে ছুঁয়ে দিতে পারবেনা কোনদিন !
শায়ন যেদিন আমাকে তার বিয়ের কার্ডটা দিয়েছিল , সেদিন ছিল গ্রীষ্মের এক রোদ্দুর বিকেল ।

এক হাতে মুভ এন পিকের আইসক্রিম নিয়ে অন্য হাত দিয়ে আমি কার্ডটা ধরে রেখেছিলাম ।

সেদিনের সেই বিকেলে এই কার্ডটা আমার কাছে আমার ভালবাসার ছাড়পত্র এনে দিয়েছিল ।

যে ছেলেটা আমাকে কোনদিন একটা মুহুর্তের জন্যেও ভালবাসতে পারেনি…… ,

সেদিন আমি তার কাছ থেকে এক জীবন একাকীত্ব কিনে নিয়ে ঘরে ফিরেছিলাম ।
চলে আসবার আগে নিজের সব সংকোচ ঝেড়ে ফেলে বলেছিলাম ,
“ আচ্ছা শায়ন, আমাকে কি তোমার কখনো ভাল লেগেছিল ? এই ধর , খুব অল্প সময়ের জন্য ?”
সে শুধু একটু হাসবার ভান করে বলেছিল , “তোমাকে তো আমার সবসময়ই ভাল লাগে ইরা, তোমাকে আমার কেন খারাপ লাগবে ?

কিন্তু তুমি যেই সেন্সে ভাল লাগবার কথা বলছো , ইরা – আমি আসলে সেই সেন্সে… আমি আসলে…”
শায়নের অবস্থা দেখে অতি দুঃখেও আমার হাসি চলে এসেছিল ।

এই ছেলেটা আমাকে কোনদিন ভালবাসতে পারেনি – এটা কি তার অপরাধের মাঝে পড়ে ?
আমি তবু দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিলাম, “ তুমি সত্যি বিয়ে করে ফেলছো, তাইনা ? সত্যি আমার এখন গিভ আপ করা উচিত, তাইনা ?”
“ ধুর বোকা মেয়ে – রাজপুত্র আসবে তোমার জন্য !”
আমি ওর চোখের দিকে শান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলেছিলাম,
“ শায়ন, রাজপুত্র আসবার আগেই তুমি এসেছিলে কেন ?”
শায়ন উত্তর দিতে পারেনি ।

আমি অপেক্ষা করেছিলাম কয়েক মুহুর্ত – তারপর তাকে পাথরের মত বসিয়ে রেখে আমি সেদিন চলে এসেছিলাম ।
সেদিনের সেই বিকেলে আমার ছেলেমানুষী হৃদয়টা ভীষণ বোকার মত মরে গিয়েছিল ।

মরে যাবার আগে আমাকে ডেকে বলেছিল , “ইরা ! এভাবে কাউকে চাইতে নেই । এভাবে কাউকে চাইতে হয়না ।

এতটা বোকামি কখনো করতে হয়না, ইরা !”

তারপর দিনে দিনে কেটে গেল অনেকখানি সময় – আমি নিজেকে নিয়ে বাঁচবার জন্য বেঁচে রইলাম।

শুধু আমার অস্তিত্ব থেকে শায়নকে আমি মুছে দিতে পারলাম না ।
নিউজার্সিতে আমার ছয়তলার ছোট্ট এপার্টমেন্ট থেকে ডেলাওয়ার রিভারের একটা সাইড চোখে পড়ে সবসময় ।

কোন কোনদিন মাঝরাতে ঘুম ভেঙ্গে আমি আমার স্বচ্ছ জানালা দিয়ে সেই দিকে তাকিয়ে থাকি ।

আমার জানালার সামনে জমাট বাঁধা অন্ধকার ।

আমিতো শায়নের কাছ থেকে অনেক দূরে চলে এসেছি – তবু এতগুলো দিন পরেও তার নামটা উচ্চারন করলেই আমার চোখ ফেটে কান্না আসে কেন ?

খুব জানতে ইচ্ছে করে – এই দুর্ভাগা ভালবাসার গল্পে সবটুকু কাঁদবার জন্য আমি একাই পড়ে আছি কেন ?
শায়ন , আমার মুক্তি নেই কেন ?
বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বার সময় , আমি আর শায়ন একই ক্লাবে ছিলাম । আমি গান লিখতাম , আর ও চুপচাপ ওর গীটারে সুর তুলত ।

একদম শেষবর্ষে আমি যখন র‍্যাগ প্রোগ্রামের জন্য একটা ইংরেজী গান লিখলাম –

টানা তিনদিন আমাকে পাশে বসিয়ে রেখে গানটার সুর করেছিল শায়ন ।

ও বলেছিল, এই গানের সুর পারফেক্ট কিনা সেটা নাকি আমি ছাড়া আর কেউ বলতে পারবেনা !

আমি গানটার নাম দিয়েছিলাম – ক্যানিয়ন
-“ আচ্ছা ইরা , তোমার কি গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে বেড়াতে যাবার অনেক শখ ?”
-“অনেক কিনা বলতে পারিনা , তবে একটু একটু শখ আছে ।”
-“মিথ্যে ! অনেক শখ না হলে কেউ ক্যানিয়নের কাছে লাভস্টোরি বলতে চায় নাকি ?”
আমি ধরা খেয়ে হেসে ফেলেছিলাম । শায়ন গীটার থেকে আঙ্গুল সরিয়ে আমার চুলগুলো এলোমেলো করে দিয়ে বলেছিল ,
“ ক্যানিয়নের দিকে হাঁটা দেবার আগে পারলে আমাকে ডেকো । আমিও শুনতে চাই তোমার গল্প ।”
ঠিক সেদিন থেকে আমি শায়নের নামে মনে মনে জ্বালিয়েছিলাম একশ একটি ফানুশ ।

সে হয়ত একজন বন্ধু হিসেবেই আমার সাথে কথা বলত – কিন্তু আমি আর তাকে বন্ধুর চোখে দেখতে পারলাম না ।

তারপর একদিন ঘুম ভেঙ্গে জানতে পারলাম , শায়ন যাকে পছন্দ করে – সে অন্য কেউ ।

জানতে পারলাম শায়ন যাকে ভালবাসে , আমি হাজারবার মরে গেলেও কখনো সেই মানুষটি হতে পারব না !
স্টেটসে চলে আসবার পর , আমি ক্যানিয়নে গিয়েছি বেশ কয়েকবার – কিন্তু শায়নকে ডাকা হয়নি কোনদিন ।

প্রতিবার ক্যানিয়নে গিয়ে আমি একই গল্প বলি – একই শ্রাবনে প্রতিবার ভিজি । তবু আমি আমার এই গল্পটাকে বদলে দিতে পারিনি কিছুতেই ।
মাঝেমাঝে মন খুব বেশি খারাপ লাগলে আমি ছোটফুপিকে যন্ত্রণা দিতে তার শিকাগোর এপার্টমেন্টে চলে যাই ।

ভদ্রমহিলা আমাকে নিয়ে যদিও অনেক চিল্লাপাল্লা করে , কিন্তু তার জীবনটা আমার হলে আমি বোধহয় বাঁচতে পারতাম না বেশিদিন ।
আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়ি , তখন আমার ভার্সিটি পড়ুয়া ফুপির একটা রিলেশান ছিল । আটমাসের মাথায় সেই রিলেশানটা ভেঙ্গে যায় ।

আমার সবসময় হাসিখুশি থাকা ফুপিটা কেমন যেন নিভে গিয়েছিল ।

তার কাছে যখন জানতে চাইতাম , ফুপি তোমার কি হয়েছে –

তখন সে মলিনভাবে হাসত , আর সেই হাসি দেখে প্রচন্ড মেঘে আঁধার হয়ে আসত আকাশ ।
স্টেটসে আসবার দেড় বছরের মাথায় , ফুপিকে আমার কথাগুলো বলেছিলাম ।

শুনে সে চোখ পাকিয়ে বলেছিল , “ দ্যাখ ইরা ! এসব কিছুনা –তুইও ভুলে যেতে পারবি, ব্যাপার না !”
তার কথা শুনে আমি হেসে ফেলেছিলাম । সেই হাসি দেখে ফুপি চমকে উঠে বলল,
“ এভাবে হাসতে শিখেছিস কেন ? এই হাসি মানুষকে ভেতর থেকে শেষ করে দেয় – জানিস ?”
এই কথার উত্তর আমি দিতে পারিনি ।
“ ফুপি মনে আছে ? আমি যখন ক্লাস নাইনে পড়তাম – তোমার ব্রেক আপ হল …”
ফুপি হাসল । অবিকল আমার মত হাসি । বাবা বলত , আমাদের দুজনের চেহারায় নাকি অদ্ভুত রকম মিল ।

তাই ফুপির নাম ‘নীরা’র সাথে মিলিয়ে আমার নাম রাখা হয়েছিল ইরা ।
-“ জানিস ইরা , আমার সেই আটমাসের সম্পর্কটায় – ছেলেটাকে আমি যে কি ভালবাসতাম !

অথচ আমি তাকে চিনতামই না, সে ই এপ্রোচ করেছিল ।

দিনে দিনে সে আমার চারপাশের দেয়ালটা ভেঙ্গে দিয়েছিল – আর একদিন আমি তার জন্য আমার হৃদয়টা খুলে দিয়েছিলাম ।

আমাদের গল্প শুরু হল ।

খুব ছেলেমানুষি অভিমানে আমি যখন চুপ করে থাকতাম , সে বলত – আমি রেগে থাকলে সে নাকি ঘুমাতে পারবেনা !

আমি কথা বলা থামিয়ে দিলে সে নাকি ভাল থাকতে পারবেনা !

জানিস ইরা – আমি এত বোকা ছিলাম , সেই রাতে আমি পৃথিবীর সবচাইতে সুখী রাজকন্যার মত ঘুমাতে গেলাম ।

বোকার মত ভাবলাম – এই ছেলেটিকে আমি বুঝি “ আমার” বলতে পারব !”
-“ তারপর ?”
-“ যে সম্পর্কটা দুজনের ইচ্ছেয় শুরু হয়েছিল , সেটা শুধুমাত্র একজনের ইচ্ছেয় ভেঙ্গে গেল ।

আমি তোকে বুঝাতে পারব না ইরা , সে যখন আমাকে বলল ,

..এই রিলেশানটা তার আর ভাল লাগছেনা – আমি সেদিন ঠিক সেই মুহুর্তে মরে গিয়েছিলাম ।

আর তার পরের মুহুর্তে আমি বুঝতে পেরেছিলাম , আমার কোন কিছুতেই তার আর কিছু আসে যায়না !

আমি তাকে মুক্তি দিলাম ,সেই মানুষ – যাকে আমি আমার সব ইগোর উর্দ্ধে গিয়ে ভালবেসেছিলাম ।”
-“ ফুপি …”
-“ আমার কাছে সে আর ফিরে আসেনি । জানতে ইচ্ছে হয় , আমাকে একা ছেঁড়ে দিয়ে ও এখন কতটা ভাল আছে ।

তাই বোকার মত এখনো আমি তার অপেক্ষায় থাকি ।

আমি জানি, তার এখন সুন্দর একটা পরিবার আছে , জানিস – ওর বউটা একদম পরীর মত !

আমি তবু অপেক্ষায় থাকি ,

হঠাত যদি কোন এক ভোরে সে আমাকে একটা ইমেইল দিয়ে জানতে চায়, “ নীরা, এতদিন পরে তুমি কি এখনো একা ?

তোমার কি খুব ক্লান্ত লাগে ? তুমি এখন কেমন আছো, নীরা ?”

আমি তার অপেক্ষায় থাকি – সেই ইমেইলটাকে চোখের সামনে নিয়ে আমি পাগলের মত কাঁদবার অপেক্ষায় থাকি !”
এতটুকু শুনবার পর আমি আর থাকতে পারিনি। রুম থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম এক ছুটে ।
ফুপিকে দেখে মাঝেমাঝে অবাক লাগে আমার। কি অসাধারন একজন মানুষ – চাইলেই তার জীবনটা গুছিয়ে নিতে পারত সুন্দর ভাবে।

কিন্তু অতীতটাকে আঁকড়ে ধরে সে তার জীবনে আর অন্য কোনকিছুতে থেমে থাকে নি ।

এখানেই একটা ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা করছে , বুকের ভেতর একটা মৃত আগ্নেয়গিরি চেপে রেখে তবুও সে হাসিখুশি থাকছে ।
ফুপির কথা ভাবতে ভাবতেই খেয়াল করি, আমার অবকাশের বিকেল একটু একটু করে সন্ধ্যা হচ্ছে। একটা নিঃশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়াই আমি।

রেডি হতে হবে , আজ রাতে আমার ফ্লাইট । ক্যানিয়ন আমাকে ডাকছে ।
আমি যে ইঞ্জিনিয়ারিং ফার্মে জব করি , সায়েম নামের একটা ছেলে গত কয়েকমাস ধরে সেখানে কাজ করছে ।

ছেলেটি আমার বেশ কয়েক বছরের জুনিয়র – মিশুক হবার কারণে অফিসের সবার সাথেই ভাল সম্পর্ক তার।

স্ত্রীকে এই দেশে নিয়ে এসেছে বলে তার গ্রুপের সবাইকে দাওয়াত দিল একদিন । দাওয়াত পেলাম আমিও ।
সাধারনত আমার কোন রকম অনুষ্ঠানে যাওয়া হয়না ,

আর চুপচাপ থাকি বলে আমি গেলাম কি না গেলাম সেটা নিয়েও কারো মাথাব্যথা থাকেনা ।

এক কথায় বলা যায় , আমাকে কেউ ঘাটাতে আসে না ।

একসাথে কাজ করার কারণে আমার এই স্বভাব সায়েমও জানত , তাই দাওয়াতের দিন সে নিজে গাড়ি নিয়ে আসল আমাকে নিয়ে যাবার জন্য।

আমার না যাওয়ার আর কোন উপায় থাকল না ।
টোনাটুনির সংসারে ভালই আয়োজন করেছিল ছেলেটা ।

খাবার পর্ব শেষ হতেই সবাই মিলে আড্ডা – সেই সাথে ছোট্ট একটা গেইম শো ।

ঠিক হল, লটারিতে যার কাছে যেটা পড়বে তাকে সেটা করে দেখাতে হবে ।

আমার কাছে পড়ল – গান । খালি গলায় গান গাইতে হবে ।
সেদিন এত আনন্দের মাঝেও আমার লেখা সেই বিষণ্ণ সুরের ‘ক্যানিয়ন’ কেন গেয়েছিলাম জানিনা –

তবু একটাবারের জন্যেও আমার মনে হয়নি , এই গানটি এই পরিবেশের সাথে যায়না ।
যেহেতু গাড়ি নিয়ে আসিনি , তাই সেই রাতে সায়েমই আমাকে পৌঁছে দিয়েছিল ।

ইঞ্জিন চালু করেই সে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলেছিল,
“ ইরা আপু – একটা কথা জানতে চাই – বলবেন ?”
“কি কথা ?”
“আপনি – যে গানটি গাইলেন , কোথায় শুনেছেন এই গান ?”
আমি হেসে ফেললাম , “ ভার্সিটিতে একটা প্রোগ্রামের জন্য লিখেছিলাম ।”
“ আপনিই গেয়েছিলেন ?”
“ না । “ এক মুহুর্ত থেমে বললাম , “ যে সুর করেছিল , সে গেয়েছে ।”
সায়েম গাড়িটা রাস্তার একপাশে পুলঅভার করে আমার দিকে তাকিয়ে বলল ,
“ ইরা আপু, আপনি কি শায়ন নামের কাউকে চিনতেন ?”
আমি ঝট করে সায়েমের দিকে চোখ তুলে তাকাই । সোডিয়ামের হলদে আলোয় ছেলেটার চোখ ছলছল করছে ।
“ আপনিই সেই মানুষ আপু ? আপনিই সে ? আমি যখন ভাইয়ার কাছে জানতে চাইতাম , ভাইয়া – এই গানটা তোর এত প্রিয় কেন ?

সে উত্তর দিত, এই গান আমার স্পেশাল মানুষটির লেখা – তাই । অনেকদিন বলেছি, ভাইয়া , পরিচয় করিয়ে দে ।

ভাইয়া বলত , অপেক্ষা কর । আগে নিজেদের পরিচয়টা হয়ে নিক । আপু, আপনাদের মাঝে কি হয়েছিল আমি জানিনা ।

আমি শুধু জানি , ভাইয়া নিজে কষ্ট পেয়েছে – তার প্রিয় মানুষটিকেও কষ্ট দিয়েছে ।

অনেকদিন বুঝিয়েছি , তার সেই একটাই উত্তর , ও ভাল থাকুক ।”
আমার দুই চোখে প্রচন্ড রকম বিস্ময় । আমি ক্লান্ত গলায় বললাম ,
“ আমি কিছু বুঝতে পারছিনা সায়েম ! শায়নতো অন্য একটা মেয়েকে পছন্দ করত । তুমি ভুল করছ ।

এই গানটা হয়ত আমার লেখা ।

কিন্তু ওর সাথে আমার যেদিন শেষবারের মত দেখা হয়েছিল, ও আমাকে ওর বিয়ের কার্ড ধরিয়ে দিয়েছিল ।”
সায়েম হাসল, “ মিথ্যে বলেছে । সে শুধুই বোকার মত মিথ্যে বলে গেছে ।

আপু, অনেকদিন অসুস্থ থাকবার পর আমাদের মা গতবছর মারা গেছেন ।

কয়েক বছর আগে হঠাত করেই তার মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছিল । মা কোন মেয়েকে সহ্য করতে পারতেন না ।

এমনকি আমাদের বোনকেও না । মেয়ে দেখলেই ডাইনী বলে চিৎকার করে উঠতেন ।

কয়েকবার মেরে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন বলে আমরা বোনকে পর্যন্ত হোস্টেলে দিয়েছিলাম ।

ঠিক সেই সময়টাতেই ভাইয়া মিথ্যে বলেছিল আপনাকে ।”
“ কিন্তু শায়ন আমাকে মিথ্যে বলল কেন ?” সায়েমের কথাগুলো বিশ্বাস হতে চাইছিল না আমার ।
“ সেটাই । ভাইয়া বলত , আপনাদের একে অন্যের জন্য ফিলিংসটা নাকি মিউচুয়াল । তবু সে আপনাকে কিছুই বলে নি ।

আমি জানিনা কেন । তার সাইকোলজিটা আমি শুধু আন্দাজ করেছিলাম , ভাইয়া মাকে ছাড়তে পারত না ।

এদিকে তার জন্য আপনাকে কতদিন ওয়েট করতে হবে –

সেই ব্যাপারেও হয়ত সে কনফিউশানে ছিল , তাই সবকিছু শেষ করে দিয়েই সমাধান খুঁজতে চেয়েছিল ভাইয়া !”
সেদিন আমি সায়েমের কোন কথার আর উত্তর দিতে পারিনি । বাসায় ফিরে চুপচাপ শুয়েছিলাম অর্ধমৃতের মত ।

শায়ন আর শায়নের মিথ্যে – আমি এই দুটোর ভার নিতে পারছিলাম না কোনভাবেই ।
পাঁচটা বছর, শায়ন – তুমি কষ্টের মানে জানো ? সত্যি জানো ?
পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে আমি সায়েমের একটা টেক্সট পাই – “ আপু, ভাইয়া অ্যারিজোনাতে ।

আমার স্ত্রীকে এখানে রেখে সে চলে গেছে ক্যানিয়নের টানে । আপু , প্লিজ এই একটিবার আপু , প্লিজ !”
আমি একটা নিঃশ্বাস ফেলে ডেলাওয়ার রিভারের দিকে তাকিয়ে থাকলাম । ক্যানিয়ন আমার কান্না দেখেছে ।

আমি যদি না চাই – ক্যানিয়ন তোমাকে ক্ষমা করবেনা শায়ন ।
বাইরে সায়াহ্ন আঁধার ছড়িয়েছে – লাগেজের হ্যান্ডেলটা টেনে নিয়ে আমি দরজার দিকে এগিয়ে গেলাম ।

কেন যেন ক্যানিয়নের সামনে আমি শায়নের দীর্ঘশ্বাসের শব্দ শুনতে পাচ্ছি ।
পরিশিষ্টঃ
There was a story
I have known
I am gonna tell you
This afternoon
Oh Canyon
Oh Canyon
Are you alone?
শায়ন ওর গীটারে মৃদু মৃদু সুর তুলে গান গাইছে ।

আর আমি স্টুপিডের মত তার পাশে বসে প্রানপনে নিজের কান্না চেপে যাচ্ছি । এখানে কেন এসেছি আমি ?
– “আমি দুঃখিত , ইরা ।”
-“তুমি মিথ্যেবাদী ।”
-“ আমার কোন উপায় ছিল না , বিশ্বাস করো । আমি মাকে ছাড়তে পারতাম না – আমি জানতাম , তুমি অপেক্ষা করতে ।

কিন্তু কতদিন ? তোমার ক্যারিয়ার , তোমার জীবন – আমি আটকে রাখবার অধিকার খুঁজে পাইনি ইরা ।”
আমি চুপ করে তাকিয়ে থাকলাম । শায়ন আমার হাত ধরে বলল,
“প্লিজ , কিছু বল !”
– “ আমার দিকে তাকিয়ে দেখ, শায়ন । আমি কত ভাল আছি দেখ ! কি ? বুঝতে পারছোনা ?”
-“আমি সত্যিই দুঃখিত, ইরা ।”
– “শায়ন, আমার একটা শখ ছিল জানো ?

খুব ঝলমলে একটা দিনে , ক্যানিয়ন থেকে কলোরাডো রিভারের দিকে তাকিয়ে কাঁদতে কাঁদতে আমি মরে যাব ।

খুব কষ্ট না পেলে এই জিনিস কি সম্ভব বল ? তোমাকে আমার ট্রিট দেওয়া উচিত ।”
– “ইরা…”
-“ কেন শায়ন ? বলতে পারো , কেন আমি এখানে এসেছি ? তোমাকে ফিরে চাইতে ? না , আমি তোমাকে আর চাইনা ।

এই একটা জীবনে আমার মত ইরারা হাজারবার মরে গেলেও তোমাদের কিছু আসে যায়না, শায়ন ।

আমি শুধু বলতে এসেছি , আমার কোন রিগ্রেট নেই । তোমাকে পাইনি বলে এতটুকু রিগ্রেট ও নেই আমার ।

আমি সবটাই মেনে নিয়েছি । এতটা দূরে চলে এসেছিলাম , শুধু যেন তুমি ভাল থাকো এই ভেবে ।

তাই আমার জন্য নিজেকে অপরাধী ভেবোনা – ভেবে নিও আমাকে তুমি চিনতে না কোনদিন !

সব মুছে ফেলো – ভালভাবে বেঁচে থাকো । আমি তোমাকে শুধু এই একটা কথাই জানাতে এসেছি । আর কিছুনা !”
শায়ন হাহাকারের মত গলায় বলল,
-“ আমাকে ক্ষমা করো , ইরা ! আমি ভাল নেই ।

There can’t be any way – আমি ভাল থাকতে পারি না ! আমার অনেক ভুল !”
আমি শায়নের পাশ থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম,
“ ভুলে যাও, শায়ন । ক্যানিয়ন তোমাকে ক্ষমা করে দিয়েছে ।”
আমি চলে যাচ্ছি । আমার চোখ থেকে ঝরঝর করে পানি পড়ছে ।

হাজারটা ভোঁতা অনুভূতির মাঝেও আমি কলরাডো রিভার থেকে ভেসে আসা স্রোতের শব্দ শুনতে পাচ্ছি একটু একটু করে ।
আমি আমার পেছন পেছন আসতে থাকা শায়নের পায়ের আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি ।
I was always behind the curtain
All I wanted is to show you my shadow
Now if you leave me,
I will sing like a hurt swallow
Oh canyon
That’s my story I never told anyone
Oh canyon
Have you ever loved someone?
আমি একরাশ হতাশা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকি ।

এই ছেলেটিকে আমি কেন এভাবে ভালবাসতে গেলাম , কলোরাডো রিভার কি এর উত্তর দিতে পারবে ?

গল্পের বিষয়:
দু:খদায়ক · ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত