ভালবাসা কারে কয়

ভালবাসা কারে কয়

Hello … একবার বাড়ি আসতে পারবে ? খুব জরুরী !মানে আসতেই হবে ।
# Meeting এ আছি | Call back করছি ।
ফোনটা রাখার পর থেকেই পুষ্করের কাজে ঠিক মন বসছিল না । কিন্তু সদ্য promotion পেয়ে মাইনের সাথে কাজের চাপও এক ধাক্কায় বেশ অনেকটাই বেড়ে গেছে ।গত কয়েক মাস যাবত্‌ এই অফিসের কাজের চাপ সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছে তাকে । But no worry….সে যথেষ্ট দক্ষতার সাথেই কাজগুলো আয়ত্ত করছে । আজ আবার কুড়ি জনের interview,সাথে MIS report এর ঝামেলা । এইসব নিয়ে গতকাল রাত থেকেই একটু চিন্তায় ছিল । তাই সক্কাল সকাল আপাত bachelor Mr পুষ্কর রয় কোট-টাই এ অফিসে হাজির । কিন্তু কাজের মাঝে প‌্রমিতার ফোনটা ওকে বেশ বিচলিত করে তুলেছে এখন । যাইহোক একটু manage করে break নিয়ে উদ্বিগ্ন মনে বোনকে ফোন করল সে । মনের মধ্যে নানান্‌ প‌্রশ্ন ।
পুষ্করের বাবা গত হয়েছেন প‌্রায় দুইবছর । কলকাতার পৈতৃকভিটেতে এখন সদস্য বলতে মা আর বোন প‌্রমিতা । বোন ইদানীং তার research work নিয়ে খুবই ব্যস্ত থাকে । তাহলে কি মায়ের কিছু……???
চিন্তাগুলো ক্রমশঃ ঘনীভূত হচ্ছিল মোবাইলের প‌্রত্যেকটা রিং এর সঙ্গেসঙ্গে ।
অবশেষে,ওপার থেকে যা শুনল তাতে পুষ্কর স্তম্বিত হয়ে পড়ল। কোনোরকমে “আচ্ছা আমি আসছি,যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ।” বলে রেখেদিল ফোনটা । Desk এ ফিরে কিছুতেই কাজে মন বসাতে পারছিল না সে । কি করে এমনটা হতে পারে ?না না এও কি সম্ভব? কিন্তু বোন তো এতবড় ভুল করতে পারে না ।এইসব ভাবতে ভাবতে পুষ্কর তার Boss এর কাছে emergency leave নিয়ে Company র দেওয়া flat এর দিকে রওনা দিল ।
পঁয়ত্রিশের কোঠায় দাঁড়িয়ে পুষ্কর । নানান চড়াই উতরাই এর মধ্যে দিয়ে জীবন নিজের গতিতে ঠিকঠাক এগিয়েই চলছিল।এরমধ্যে ঝিনুক এর গভীর প‌্রেম তার জীবনে সংযোজন করেছে অন্য এক মাত্রা । একটু গুছিয়ে নিয়েই ঝিনুকের বাড়িতে গিয়ে নিজেদের গাট্ছড়া বাঁধার ব্যবস্থা সে পাকা করে ফেলবে । আর বোন এখন বিয়েতে interested নয় । সে পড়ুক যতদূর সে
চায় । যতই হোক – পুষ্করের চেয়ে বছর পাঁচেকের ছোট প‌্রমিতা , তার বড়ই আদরের।
অফিসের থেকে taxi নিয়ে আসার পথে হঠাত্‌ পুষ্করের ছেলেবেলার নানান কথা মনে পড়তে লাগল । Office,career,girlfriend এসব করতে গিয়ে কেমন যেন যান্ত্রিক হয়ে পড়েছে সে ।
শিশুবেলা প‌্রায় ভুলতেই বসেছিল । কিন্তু আজ যেন বারে বারে সেইসব মুহূর্তগুলো ফিরে ফিরে চোখের সামনে ভেসে উঠছে ।
শুভ্রাংশু আকা সকলের প‌্রিয় বাবিন ।
পুষ্করের একমাত্র পিসি-পিসেমশায়ের একমাত্র সুযোগ্য পুত্র শ‌্রীমান শুভ্রাংশু চৌধুরী ।পুষ্করের বাবার চেয়ে তাঁর একমাত্র বোন অনেকটাই ছোট ছিলেন । সেই সুবাদে পিসি কম বন্ধুই বেশী ছিলেন তিনি ।পুষ্কর আর প‌্রমিতাকে – সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মচারী প‌্রভাতাংশু চৌধুরী অর্থাত্‌ পিসেমশাই খুবই ভালবাসতেন ।ওদের দল আরও ভারি হল যখন বাবিন এল পরিবারের সদস্য হয়ে । খুবই সুন্দর দেহ-মনের অধিকারি ছিল বাবিন । যে কেউই ওকে দেখে ভালো না বেসে পারবেনা ।
ও একটু লাজুক স্বভাবী ছিল ।আর সবচেয়ে বেশী ওর পেছনে লাগা হত – ওর ভূতের ভয়ের জন্য ।
রাগ হলে বা লজ্জা পেলে বেচারা কিছু বলতে পারতনা,শুধু ওর ফর্সা মুখটা টুকটুকে লাল হয়ে উঠত।দারুণ নাম্বার নিয়ে পাশ করে সে Engineering এ chance পেল । সবই তো ঠিকই চলছিল । কোনোরূপ বদনেশাও তার ছিলনা । সত্যিই গর্ব করার মতোই ছিল সে । তবে কেন এমনটা হল ???এইতো কয়েক মাস আগের কথা – বাবিন পুষ্কর’কে ফোন করেছিল। কোনো একটা কারণে upset মনে হয়েছিল । কিন্তু তেমন কিছুই তো বলেনি সেদিন !
# সাব stop আ গয়া ।
আচম্বিতে পুষ্কর দেখল তার গন্তব্য এসে গেছে ।
একটু অন্যমনা হয়ে পড়েছিল । তাড়াতাড়ি নির্দিষ্ট ভাড়া মিটিয়ে দ‌্রুত flat এর দিকে পা বাড়াল । কোনোরকমে flight এর টিকিট পেয়েছে সে। টাকাপয়সার হিসাব এমন সময় রাখা যায়না । শুধুই মনে হচ্ছে – গিয়ে যেন দেখে বাবিন সেই লাজুক হাসি দিয়ে একইভাবে স্বাগত জানাচ্ছে তাকে।
এখনকার এটা আরেক রকম সমস্যা – train late,flight delay,network problem,traffic jam….. পুষ্কর যেন আর ধৈর্য রাখতে পারছে না । অন্যসময় হলে শেষের কয়েক ঘন্টায় পুষ্করের অন্তত এক প্যাকেট সিগারেট শেষ হয়েই যেত ।
ঝিনুকের সাথে এই নিয়ে মাঝেমাঝে একটু আধটু গন্ডগোল বেঁধে যায়- পাগলী’টা কি করে যে ফোনের ওপ‌্রান্ত থেকে টের পেয়ে যায় কে জানে !!
আজ কিন্তু অবাক কান্ড । একটা সিগারেট ও পুষ্করের খেতে ইচ্ছে করছে না ।সে যেন নিজের মধ্যেই নেই । Flight এ চেপেও নানান চিন্তা পাক দিয়ে উঠছে মাথায় । বোন বলছিল- বাবিন ঘরে একলা ছিল !!
পিসেমশাই VR নিয়েছেন কয়েকমাস আগে । কর্মজীবনের ব্যস্ততা কাটিয়ে তাই পিসিমণিকে নিয়ে জগন্নাথ দর্শনে পুরী গিয়েছেন।
আচ্ছা…বাবিন গেলনা কেন?ওকি জানত ?
না কি এমনিই বাবা-মা কে একটু একান্তে ছাড়তে চেয়েছিল ? ?
পুষ্কর মনে মনে চিন্তা করল, পিসিমণিরা আগামীকাল পৌঁছবেন । আজ গভীর রাত্রি হলেও সে ঠিক পৌঁছে যাবে ।ওনাদের এখনও জানানো হয়নি ।এসে যখন জানবে কি যে হবে???
উফ্ আর ভাবতে পারছেনা পুষ্কর ।
সমস্তরকম চিন্তায় মাথার দুইপাশ যেন দপদপ করতে লাগল । পুষ্কর দু চোখ বুজল ।
তাড়াহুড়োর মধ্যে শুধুই পিঠের একটা ব্যাগ নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিল ; তাই luggage collect করার জন্য অপেক্ষা করতে হলনা। কোনোরকমে একটা taxi র ব্যবস্থা করেই ক্লান্ত শরীরটাকে তার মধ্যে চালান দিল । এই কয়েক ঘন্টায় পুষ্করের মনে হল সে যেন শারীরিক নয় , মানসিক বিপর্যস্ত বেশী ।
চোখের সামনে বাবিন-পিসি-পিসেমশাই এর হাসিখুশী মুখগুলোই শুধু বারে বারে ভেসে উঠছে ।
পুষ্কর অফিসে অনির্দিষ্ট কালের ছুটি নিয়ে এলেও সে জানে , তাড়াতাড়ি না ফিরতে পারলে আবার অনেক কাজ জমে যাবে । কিন্তু বাড়ি না পৌঁছানো অবধি সে যে কিছুই ঠাওর করে উঠতে পারছেনা । কোনোরকমে কাঁধের ওপর ব্যাগটা ফেলে রাত্রি সোয়া বারোটা নাগাদ সে বাড়ি পৌঁছল । আশেপাশে সব ঘুমে অচৈতন্য । তাই calling bell না বাজিয়ে, দরজায় শুধুই টোকা মারল তিনবার ।
বোন বোধহয় জেগেই ছিল ।আর থাকবে নাই বা কেন? এমন একটা পরিস্থিতিতে ঘুম কি আর আসে । যাইহোক ,শনিবারের গভীর রাত্রে পৌঁছেও পুষ্কর কোনোরকমে কয়েক ঘন্টা বিশ‌্রাম নিয়ে, সকালে কি কি করণীয় মনে মনে গুছিয়ে ফেলল।
এখন তাকে শক্ত হতেই হবে । এসময় পিসিদের পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ নেই । সকালে উঠেই সে সোজা চলে গেল কাকার বাড়ি । আরও কয়েকজন মিলে যাবতীয় কার্য সম্পন্ন করল ।
পিসিদের কথা আলাদাভাবে উল্লেখ করার বোধ করি প‌্রয়োজন নেই ।তবে মিতবাক্‌ পিসেপিসেমশাই সারাদিন একটাই কথা বলে চলেছেন:”হা ঈশ্বর তুমি এ কোন পাপের শাস্তি দিলে?এরচেয়ে যদি ওর একটা অঙ্গহানি করতে তাও তো আমার ছেলেটা প‌্রাণে বেঁচে থাকত !!!

আজ রবিবার,তাই পোস্টমর্টেম হবার সুযোগ কম । যাইহোক, পুষ্করের ভাবতে অবাক লাগছে, হৃত্‌পিণ্ডের লাব-ডাব বন্ধ হয়ে যাওয়ায় “বাবিন” এখন শুধুই “BODY” …। সকলে তো তাই ই বলছে- “বডি টা এদিকে নিয়ে আয়, বডি টা মর্গে রাখ্…” ইত্যাদি ইত্যাদি ।
পুষ্কর কলেজ জীবনে প‌্রচুর সমাজসেবামূলক কাজকর্ম করত । জীবন-মৃত্যু র অনেক খেলাই দেখেছে সে ।খান পঁচিশেক অন্তেষ্টিক‌্রিয়ার অভিজ্ঞতাও হয়েছে তার ।কিন্তু আজ পিসতুতো এই লাজুক অথচ মেধাবী ভাইটার আকস্মিক মৃত্যুটাকে সে কিছুতেই মেনে নিতে পারছেনা ।
এখনও জানা যায়নি – এটি আত্মহত্যা না অন্যকোনো ব্যাপার ! পুষ্কর এখন আর তার ভাই এর মিষ্টি সরল মুখটা মনে করতে পারছে না ।
কালো কষ্টিপাথরের মতো একটা অসাড় মুখমণ্ডল কেবলই চোখের সামনে …. ….!!!!!
বাবিন কে চেয়ারে বসে পাওয়া গিয়েছিল । আশেপাশে, হত্যা বা আত্মহত্যা করার মতো তেমন কিছুই প‌্রমাণ পাওয়া যায়নি ।সম্ভবত ভোররাতের দিকেই থেমে গিয়েছিল বাবিনের হৃত্‌পিণ্ড । কিন্তু অমন ফর্সা টুকটুকে ছেলেটার মুখটাই কেন কালো হল? সে ভোররাতে চেয়ারেই বা কেন বসেছিল ?
এইসব কথা ঘুরপাক খাচ্ছে পুষ্করের মাথায় ।এরই মধ্যে অফিসের ফোনও আসতে শুরু হয়েছে । যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ফিরে গেলেই ভালো ।পুষ্কর স্বার্থপর নয় । কিন্তু সে জানে , যে গেল তাকে ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয় । আর সব কিছু ছেড়ে বাবিনের স্মৃতির মধ্যে ডুবে থাকলেও তার চলবে না ।কারণ সকলের জীবন যেমন চলছিল তেমনি চলবে বা চালাতে হবে । জীবন গতিশীল । মৃত্যুতেই বুঝি তার গতি রোধ হয় । ওপারে কি আছে পুষ্কর জানেনা । তাই মনে মনে শুধু বললঃ ” ভাই তুই যেখানেই থাক ভালো থাক “। বাবিনের অন্তেষ্টিক‌্রিয়া নিয়মমাফিক সম্পন্ন হল। পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট আসতে দেরী আছে । পুষ্কর আর দেরী করতে চাইলনা । যাবতীয় কাজ মিটে যাবার এক-দুই দিনের মধ্যেই আবার উড়োজাহাজে সে ফিরছে তার ব্যস্ততম কর্মজীবনে।এখন কিন্তু অন্য জিজ্ঞাসা পুষ্করকে তাড়া করছে ।

পুষ্কর শুনেছিল , বাবিনের অনেক কাছের বন্ধুদের থেকে – যে সে একটি মেয়েকে ভীষণ ভালবাসত । কিছুমাস আগে , কোনো এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে সে মারা যায়।বাবিন যথাসম্ভব সাহায্যও করেছিল তার পরিবারকে । কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি; অকালেই ঝরে পড়েছিল তার প‌্রেমের মুকুল । বাবিন নাকি মৃত্যুর পর , মেয়েটির মাথার-সিঁথি সিঁদুর দিয়ে রাঙিয়ে দিয়েছিল । মৃতমেয়েটির পরিবার তার দেহসত্কারের তেমন কোনো ব্যবস্থা করে উঠতে পারেনি । এর বেশী তারা আর কিছু বলতে চায়নি।পরের দিকে বাবিন ও কেমন আরও বেশীরকমের চুপচাপ হয়ে পড়েছিল । সুন্দর হাসিটাও মলিন হয়ে গিয়েছিল ঠোঁটের কোণে । বুদ্ধিদীপ্ত চোখগুলো একেবারে নিষ্প‌্রভ দেখাত । বাড়ির কেউ তেমনভাবে ছেলের এই পরিবর্তনটা হয়ত লক্ষ্য করেনি । মুখচোরা বাবিনটা বরাবরই নিজের ঘরেই বইপত‌্র নিয়ে মেতে থাকত । আর ভূতের ভয়টা কিন্তু তখনও যায়নি তার ।সে একা কখনও থাকতে চায়তো না । তবে কেন সেদিন সে একাই বাড়িতে রয়ে গেল ?সে কি কিছু অভাবনীয় দেখেছিল? মৃত্যুর দুইদিন পরে ও পুষ্কর দেখেছে লাল রক্ত বাবিনের নাক দিয়ে গড়িয়ে পড়তে । ফর্সা দেহে শুধু মুখটাই কি নিকষ কালো ! বাবিনের ঘর থেকে শুধুমাত্র একটা গলার চেন পাওয়া গেছে , সম্ভবত ওর প‌্রেমিকা ওকে উপহার হিসেবে দিয়েছিল । এর বেশী প‌্রমানস্বরূপ আর কিছু পাওয়া যায়নি ।
পুষ্করের মন তো কিছুই মিলিয়ে উঠতে পারছেনা । এটা কি নিছকই দেহের মৃত্যু না কি আত্মার সাথে আত্মার মিলন !!! একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়ে পুষ্করের চিন্তাভাবনায় কেমন যেন সব জট পাকাতে লাগল । এরই মধ্যে গুগল ঘেঁটে চেষ্টা করেছে অনেক কিছু জানবার । কিন্তু কোনো সদুত্তর পুষ্কর পায়নি । তার অবচেতন মন যেন তাকে বারংবার বলছে -” জীবনের সব প‌্রশ্নের উত্তর কি পাওয়া যায়?”: আচ্ছা ……আমাদের চিকিত্‌সাবিজ্ঞান ও কি সঠিক ব্যাখ্যা দিতে সক্ষম হবে !! কে জানে ?
পোষ্টমর্টেমের রিপোর্ট আসতে এখনোও বাকি ।।।

……………………………………….সমাপ্ত………………………………………..

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত