ভালোবাসার খেয়াতরী

ভালোবাসার খেয়াতরী

– উফফ বাবা রে…একে বলে গরম! নাও ধরো বাজরের থলে টা। মোবাইলে দেখাচ্ছে আজকে টেম্পারেচার ৩৩°, দাও দাও ঠান্ডা ঠান্ডা এক গ্লাস লেবুজল দাও তো গিন্নি, পারা যাচ্ছে না আর।

কর্তা মশাই বাজার থেকে ফিরেই গরমের দাপটে কি কি অসুবিধা হচ্ছে তা ব্যাক্ত করছিলেন। আমিও বাজারের থলে হাতে প্রত্যুত্তরে হু হাঁ করছিলাম। উনি আবার মনে করালেন,

– লেবুজল দাও গো তাড়াতাড়ি, এত্ত গরম…।

আমাকে রান্নাঘরের দিকে যেতে দেখে আবার বললেন,

– তোমার জন্যেও নিয়ে এসো, একসাথে দুজনে মিলে লেবু শরবত খাবো, বেশ জমে যাবে ব্যাপার টা।
আমি হেঁসে বললাম,

– বেশ প্রেম প্রেম পাচ্ছে যেন আজ তোমার, কি ব্যাপার?
আড়চোখে চেয়ে বললেন,
– তা প্রেম আমার শীত, গরম, বর্ষা সব সময়ই পায় গো গিন্নি….

আমি মুখ টিপে হেঁসে রান্নাঘরের দিকে রওনা হলাম স্পেশাল লেবুজল বানাবো এই উদেশ্যে। মনেমনে ভেবে নিয়েছি আজকে ফেসবুকের ‘খাবো খাবো_ খাও খাও’ গ্রুপে একটা জম্পেশ ছবি দেবো লেবু শরবতের। ডেইলি দেখি ঝুম্পা, টুম্পা, স্বর্ণা, বর্না রা এত এত সুন্দর সুন্দর ছবি দিচ্ছে গ্রুপে। এই জুস, সেই জুস,এই পানীয়, সেই পানীয় আর কত বর্ণাঢ্য পরিবেশন। উফফফ…চোখ জুড়িয়ে যায় ছবি গুলি দেখলে পর। আমিও আজকে স্পেশাল লেবু শরবত বানিয়ে, লেবুর স্লাইস গ্লাসে লাগিয়ে, পুদিনা পাতা ছড়িয়ে বেশ সুন্দর করে সাজিয়ে, ডেপথ এফেক্ট লাগিয়ে, ফিল্টার দিয়ে ফটো ক্লিক করব লেবু শরবতের। তারপর ফেসবুকের খাওয়ার গ্রুপে ছবি পোস্ট করবো, সবাই বাহ্ বাহ্ করে উঠবে ছবি দেখে।

খুশিতে গুনগুন করতে করতে বাজারের ঝোলা টা থেকে সব ফল সব্জি বের করে নিচ্ছি, কিন্তু এ কি! এ কি কাণ্ড!লেবু? লেবু গেলো কই? লেবু তো নেই… কর্তা মশাই কে জিজ্ঞেস করলাম,

– হ্যাঁ গো লেবু কোথায়? বাজারের থলে তে সব আছে কিন্তু লেবু তো নেই!
আঁতকে উঠে কর্তা মশাই বললেন,

– কি বলছ গিন্নি? লেবু নেই! আমি কি তবে ভুলে গেলাম লেবু নিতে? যাহ বাবা! লেবু শরবত খাবো ভেবেছিলাম…
আমার মাথাটা গরম হয়ে গেল। ঝাঁঝিয়ে বললাম,

– তুমি তো খাবে ভেবেছিলে, আর আমি? আমি কত কি পরিকল্পনা করেছিলাম, সব ভেস্তে গেল।
উনি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন,

– পরিকল্পনা…. লেবুজল নিয়ে আবার কি পরিকল্পনা?
আরো রেগে গিয়ে বললাম,

– সে তুমি বুঝবে না। তুমি তো আর ‘খাবো খাবো_ খাও খাও’ গ্রুপের মেম্বার না, তোমাকে বলেও লাভ নেই।
এই বলে ধূপধাপ করে পা ফেলে বিরক্তি ভাব দেখিয়ে চলে এলাম আবার রান্নাঘরে। পেছন পেছন কর্তা মশাইও এসে বললেন,

– তা এক গ্লাস জলই দাও নাহয়।
এক সেকেন্ড চুপ করে থেকে বললাম,

– নিজেই নিয়ে নাও, আমি দিতে পারব না। আমার পরিকল্পনা ভেস্তে গেল তোমার জন্যে, জল ফল যা দরকার নিজে নিয়ে নাও আমি যাচ্ছি আমার কলির কৃষ্ণ সিরিয়াল দেখার টাইম হয়ে এলো।

আমি তখন টিভি দেখায় মগ্ন উনি হঠাৎ বললেন,
– দাও দেখি রিমোট, দেখি একটু খবরের চ্যানেল টা। তোমার সিরিয়ালে তো এখন ব্রেক দিয়েছে।
আমি আরো তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে বললাম,
– না, কেনো? খবর তুমি পরে দেখে নিও।
– কিন্তু গিন্নি পরে তো আই.পি.এল শুরু হয়ে যাবে, খেলা ফেলে খবর….
– অত শত জানি না, এই সময়ে আমি সিরিয়াল দেখি, রিমোট ফিমোট দেওয়া যাবে না।
– রেগে আছো কেনো গিন্নি? কিছু হয়েছে?

আমি কি উত্তর দেব ভেবে পাচ্ছিনা, এমন সুবোধ বালক হয়ে কথা বলছেন উনি… একে তো ছবি তুলে পোস্ট করার ইচ্ছে টা মাটি চাপা পড়লো আর এখন আমার সিরিয়াল দেখায় বেঘাত ঘটানোর চেষ্টা। কিন্তু কিছু তো একটা বলতে হবে তাই বললাম,

– না তেমন কিছু না, ওই তোমায় লেবু শরবত করে খাওয়াতে পারলাম না তাই আরকি একটু…
উনি খুব খুশি হয়ে হাসতে হাসতে হাত নেড়ে বললেন,

– না না ঠিক আছে, কাল নিয়ে আসবো লেবু, কাল বানিয়ে দিও, এখন যদি একটু রিমোট টা….?
– না, আগে সিরিয়াল শেষ হউক।
উনি আর কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ পত্রিকা নিয়ে বসে গেলেন।

রাতে খাবার টেবিলে বসে মুখ গোমড়া করে বললেন,

– একি!! শুধু রুটি আর ঢেঁড়স ভাজা? আর কিছু নেই? এ সব খাওয়া যায় বুঝি??
আমি বললাম,

– খুব যায়। কেনো যাবে না? দুপুরে তো খেলে ভাত, মাছ, ডাল। রাতে এত এলাহী কিছু করতে পারব না বাপু, গরম তোমার একার নয়, আমারও লাগে। এতই শখ যখন তো আমি যখন রুটি করছিলাম তুমি এসে ভাজা টাজা কিছু একটা করে নিতে! সারাদিন এত খাটনী আর ভালো লাগে না।
উনি ঝট করে বললেন,

– কেনো রবিবারে তো তোমায় কিছু করতে হয় না গিন্নি। ওইদিন তো আমিই রান্না করি, আর আমার রান্না করা মাংস তো তখন চেটে পুটে খাও।

– ইস্, ন্যাকা! মাংস তে নুনের পরিমাণ, মশলার পরিমাণ টা তো আমাকেই বলে দিতে হয়।
– হ্যাঁ তো মশলা আর নুনের পরিমাণ বলে দাও বলে এত ধাপ দেখানোর কিছু নেই।
– কি বললে? আমি ধাপ দেখাচ্ছি? আমি? আমায় বলতে পারলে এ কথা টা?
– হ্যাঁ, কেনো বলতে পারবোনা, আলবত পারবো। দিনে দিনে তোমার খুব ইয়ে হয়ে গেছে গিন্নি, কথায় কথায় ঝগড়া, তর্ক, কথা কাটাকাটি শুরু করে দাও খালি।

– কি?  আমি ঝগড়া করি?? আমায় ঝগড়ুটে বলছো?
– হ্যাঁ করই তো ঝগড়া। সন্ধ্যে থেকে শুধু মুখ ঝামটা দিয়ে কথা বলছো।
– আচ্ছা, এই ব্যাপার? ঠিক আছে। আমি কালই চলে যাব মেজদার বাড়ি। আর এ মুখো হব না, আমায় ঝগড়ুটে বলা।

– হ্যাঁ, তাই যাও… যাও তোমার মেজদা, বড়দা, যে দাদার বাড়ি যেতে মন চায় চলে যাও।
– হ্যাঁ হ্যাঁ চলে যাব। তোমার মতন লোকের সাথে থাকা টাও ভুল।
– হ্যাঁ যাও। ভুল লোকের সাথে থাকা নিষ্প্রয়োজন। তুমি যাও, গেলে আমিও মুক্তি পাই। পাড়ার দুই বন্ধু বিকাশ ও সমীর কে নিয়ে আমিও বেশ জমাটি আড্ডা দিতে পারব বাড়িতে তুমি না থাকলে, সাথে আই.পি.এল, সিগারেট আর অবাধ খাওয়া দাওয়া। জোমাটো, সুইগি থাকতে এখন রান্নারও কোনো ঝামেলা থাকবেনা। তুমি বরং তাই করো, চলেই যাও মেজদার বাড়ি।

আমি যেন চোখে অন্ধকার দেখছি, মাথা বনবন করে ঘুরছে এনার কথা শুনে। এত সাহস! যে লোক টা বাড়িতে শান্ত নম্র হয়ে থাকে সে কিনা আমায় সমীর, বিকাশ, জোমাটো, সুইগি এসব দেখাচ্ছে। হুংকার দিয়ে বললাম

– তলে তলে এত? হ্যাঁ? লজ্জা করলো না বলতে কথা গুলো? ঠিক আছে আমার কোনো মূল্য নেই যখন তো আমি থাকবো কেনো তোমার সাথে, থাকবোনা। কালই চলে যাব, নিজের ইয়ার দোস্ত নিয়ে ফুর্তি করবে তো? করো, আমি আপত্তি করবো না। এই বলে হনহন করতে করতে চলে এলাম শোয়ার ঘরে।

বেশ কিছুক্ষন পর ধীরে ধীরে দরজা খুলে কর্তা মশাই ভেতরে এসে বললেন,
– বলছিলাম কি গিন্নি…
আমি রাগে ওপাশ ফিরে শুলাম। উনি এক দুবার কেশে গলা পরিষ্কার করে বললেন,
– লেবু পেয়েছি গো।
আমি ঘাড় ঘুরিয়ে বিরক্তি সহকারে জিজ্ঞেস করলাম – কি?
উনি একগাল হেঁসে বললেন,

– হ্যাঁ, তুমি খেয়াল করো নি হয়তো। ধনেপাতার পলিথিন টার ভেতর রাখা ছিল গো লেবু গুলো ধনেপাতা সঙ্গেই, দেখলাম এখন।

আমি উঠে বসলাম তখন। উনি বললেন,
– তা গিন্নি… মানে, তুমি কি… তুমি কি সত্যিই কাল মেজদার বাড়ি চলে যাবে গো গিন্নি?
আমি ওনার দিকে চেয়ে, মুখ টিপে হেঁসে, ভেংচি কেটে বললাম,
– না গো যাবো না। আমি চলে গেলে কে তোমায় লেবু শরবত করে খাওয়াবে শুনি?
দুজনেই হেঁসে ফেললাম… এভাবেই রাগ, খুনসুটি, আনন্দের মধ্যে দিয়ে ভেসে চলেছে আমাদের ভালোবাসার খেয়াতরী…

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত