ভালোবাসার অন্তরালে

ভালোবাসার অন্তরালে

কাল রাতে মুনের ভাল ঘুম হয়নি, সারারাত মাথায় ভোঁতা যন্ত্রণা হচ্ছিল। মাঝে মাঝে চোখ লেগে আসছিল, তখন আম্মাকে স্বপ্ন দেখছিল। আম্মার মুখটা খুব মলিন দেখাচ্ছিল, আম্মাকে মাঝে মাঝে স্বপ্নে দেখে মুন, কিন্তু কখনও এমন মলিন দেখেনি।

চার দিন হলো মুন বাবার বাড়িতে এসেছে, নাহিদকে বলে এসেছে ও আর ফিরে যাবেনা। সমস্যা হচ্ছে, ও যে আর নাহিদের কাছে ফিরে যাবেনা এই কথাটা এখনও বাবার বাড়ির কেউ জানেনা। বাবার বাড়ি মানে ভাইয়ার বাড়ি, ভাইয়া আর ভাবীই মুনের বাবা মা। ভাইয়া আর ভাবীই ওকে নিজেদের মেয়ের মত করে বড় করেছে।

মুনের জন্মের এক বছর পর মুনের আব্বা মারা যায়, আর আম্মা মারা যায় যখন, তখন মুন ক্লাস নাইনে পড়ে, চৌদ্দ বছর বয়স। ভাইয়া নতুন বিয়ে করেছে তখন, ভাবীর গায়ে তখনও নতুন শাড়ির ভাঁজ ভাঙ্গা গন্ধ পাওয়া যেতো।
তখন ওরা থাকতো কুমিল্লা, কান্দিরপাড়ে আব্বার বিশাল জায়গা নিয়ে বাড়ি। বাড়ির নাম রাবেয়া মঞ্জিল। মুনের দাদীর নাম ছিল মোসাম্মাৎ রাবেয়া খাতুন। মুনের আব্বা নিজের মা’কে অসম্ভব ভালোবাসতেন, মায়ের স্মৃতি রক্ষা করার জন্যই বাড়ির নাম দিয়েছেন রাবেয়া মঞ্জিল। বাড়ির নামটা মুনের কখনওই পছন্দ হতোনা, ভাইয়াকে কতদিন বলেছে, “ ভাইয়া, আমাদের এত সুন্দর বাড়িটার নাম এমন পচা কেন? রাবেয়া মঞ্জিল কোন নাম হলো?”

ভাইয়া তখন ইঞ্জিনিয়ারিং এর ছাত্র, কী সুন্দর দেখতে, তেমনই স্মার্ট। মুনকে ভাইয়া অনেক আদর করতো, ওর মুন নামটাও তো ভাইয়াই রেখেছিল। ওর আসল নামটা যা ক্ষ্যাত মার্কা, ছফুরা খাতুন। ছফুরা খাতুন কোন নাম হলো? একদিন স্কুলে এক বন্ধু ওকে জিজ্ঞেস করেছিল, “ ছফুরা মানে কি?”

তখন ওরা ক্লাস ফাইভে পড়ে, বন্ধুটা ছিল হিন্দু, সবাইকে নামের মানে জিজ্ঞেস করতো। মুন তো ছফুরা নামের মানে জানেনা, তাই বলেছিল,” আমাদের এক প্রিয় নবীর স্ত্রীর নাম ছফুরা”।

তখন বন্ধুটা হাততালি দিয়ে বলেছিল, “ ও, তাইলে তুমি নবীর স্ত্রী”?
মুন বন্ধুটাকে খুব পছন্দ করতো, তাই রাগ না করে বলেছিল, “ এই কথা বলতে হয়না। আমারে নবীর স্ত্রী কইলে গুনাহ হইবো”।

তখন বন্ধু বলল, “ আইচ্ছা যাও, তোমারে নবীর স্ত্রী কমুনা, কিন্তু তুমি দেখতে এত সুন্দর, ছফুরা নামটা তোমারে মানায় নাই। তোমার নাম যদি মৌসুমী হইতো, নাহলে শাবনূর তাইলে ভালো হইতো। ওরা নায়িকা, তুমিও নায়িকার মত সুন্দর”।

সেই থেকে মুনের মাথায় নাম নিয়ে চিন্তা ঢুকে যায়। বাড়ি ফিরে আম্মাকে বলেছিল, “ আম্মা আমার নাম পাল্টাইয়া দাও, আমি ছফুরা খাতুন নাম চাইনা। আমার নাম দাও মৌসুমী”।

ওদের বাড়ির সবাই খুব পর্দানশীন ছিল, আম্মা বোরকা ছাড়া কোনদিন বাইরে বের হয় নাই। আম্মা অসুস্থ শরীর নিয়েও ত্রিশ রোজা রাখতো, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, কোনদিন নামাজ কাজা করে নাই। মৌসুমী নাম শুনেই আম্মা বলল, “ ছফুরা খাতুন অনেক ভালো নাম, তোর আব্বা রাখছে। এই নাম পাল্টামু ক্যান?
-এইটা ক্ষ্যাত নাম, আমি নায়িকার মত সুন্দর, আমার নাম নায়িকার মত হইতে হইব।
-মৌসুমী হিন্দুগো নাম। তোর নাম মৌসুমী রাখলে গুনাহ হইবো।
-তাইলে আমার নাম শাবনূর রাখো।

-চুপ থাক, বেশরম মাইয়া, সিনেমার নাচনেউলিগো নামে নাম রাখতে চায়। তুই কি সিনেমায় নামবি?
-সিনেমায় নামবো ক্যান? সিনেমা করে বইলা কি ওরা খারাপ নাকি? নায়িকারে তুমি নাচনেওয়ালী কও ক্যান? তোমারে কইয়া লাভ নাই, আমি আমার নাম পাল্টাইতে চাই। ভাইয়ার কাছে কমু। ভাইয়া আমার সুন্দর নাম দিব।

-ভাইয়ার কাছে কইয়া লাভ নাই, তোর পাখনা গজাইছে, আমি দর্জির কাছে তোর জন্য বোরকা বানাইতে দিছি, সামনের মাস থিকা বোরকা পইরা ইস্কুলে যাবি। সিনেমার নায়িকা হওয়ার শখ বাইর করতাছি।

বোরকার কথা শুনেই মুনের মাথা গরম হয়ে গেলো, এমনিতেই সেদিন মল্লিকা বলল যে ওর রূপের সাথে ছফুরা খাতুন নাম মানায়না, কেমন খ্যাত খ্যাত লাগে, এখন যদি বোরকা পইরা স্কুলে যাইতে হয়, তাইলে ওর ইজ্জত থাকব? ভাইয়ার কাছে আম্মার নামে নালিশ করতেই হবে। আম্মা ভাইয়ার কথা শুনবে। ভাইয়াকে সবাই ভালোবাসে। সেই দিন সন্ধ্যাবেলাতেই মুন ভাইয়ার জন্য এক বাটি ঝালমুড়ি নিয়ে ভাইয়ার রুমে গেলো, মুড়ির বাটি দেখেই শাহেদ হেসে ফেলে, “ কী ব্যাপার, কার নামে নালিশ নিয়ে এসেছিস?”

-কারুর নামে নালিশ আনি নাই।
-নালিশ ছাড়া তুই কখনও ঝালমুড়ি এনেছিস আমার জন্য?
-নালিশ না, ভাইয়া আমি কি দেখতে সুন্দর?
-তুই পরীর মত সুন্দর।
-ভাইয়া, পরীর নাম ছফুরা খাতুন হয়?

-হতে পারে, পরীর আব্বা যদি আদর করে পরীর নাম ছফুরা খাতুন রাখে। তা এই প্রশ্ন কেন?
-ভাইয়া, আমার প্রাণের বন্ধু মল্লিকা বলছে, আমি নায়িকার মত সুন্দর কিন্তু আমার নামটা ক্ষ্যাত মার্কা। মল্লিকা কইছে, আমার নাম যদি মৌসুমী বা শাবনূর হইতো, তাইলে ভালো হইতো।

-কিন্তু মৌসুমী আর শাবনূরের নাম তো আসল নাম না, ওদের আসল নাম ছালেহা বানু, কইতরী বেগম। সিনেমায় নামতে গেলে নাম বদলাইতে হয়। তুই কি সিনেমায় নামবি?
-ভাইয়া, এত কথা বুঝিনা, আমার একটা সুন্দর নাম দাও। আমার রূপের সাথে যেন মানায়।
-তোর বয়স কত? মোটে ক্লাস ফাইভে পড়িস, এখনই রূপ বুঝে গেছিস?
-ক্লাসের সবাই আমারে সুন্দরী কয়, আমার চোখ নাকি হরিণের চোখের মত সুন্দর।
-হুম বুঝতে পারছি, সাবধান থাকিস, আর কয়দিন পর পাড়ার ছেলেরা তোর হাতে চিঠি ধরিয়ে দিবে।
-ভাইয়া, এত কথা বুঝিনা, তুমি আমার নাম পালটে দাও

-দূর পাগলী, জন্মের সময়কার দেয়া নাম আমি বললেই পালটে যাবে? কোর্টে গিয়ে এফিডেফিট করতে হবে। তার চেয়ে তোর স্কুলের নাম ছফুরা খাতুনই থাক, আমি বরং আজ থেকে তোকে ‘মুন’ বলে ডাকবো। তোর রূপের সাথে মানাবে, মুন মানে চাঁদ, তুই চাঁদের মত সুন্দর। নামটাও অনেক স্মার্ট, কি বলিস?
-পছন্দ হইছে নামটা, কাল থেকে কেউ আমার নাম জিজ্ঞেস করলে আমি বলমু, আমার নাম মুন। তুমি আম্মারে কইয়া দাও, আমারে যেন আর ছফু কইয়া না ডাকে।
-আচ্ছা, বলে দেব। এখন গিয়ে পড়তে বোস।
-ভাইয়া, আম্মা কইছে, আগামী মাস থিকা আমারে বোরকা পইরা বাইরে যাইতে হইব। ভাইয়া আমি মইরা গেলেও বোরকা পরুমনা। মল্লিকা তাইলে আমারে ‘নানী’ ডাকবো।
শাহেদ হেসে ফেললো, বললো, ‘তুই কি মল্লিকাকে ভয় পাস? মল্লিকাকে ভয় পাস কেন?

-মল্লিকারে ভয় পাইনা, ওই আমার প্রাণের বন্ধু। কিন্তু মল্লিকারে ক্লাসের সবাই অনেক দাম দেয়, ওইতো ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল। অনেক ভাল গান গায়, টিচাররাও ওরে অনেক খাতির করে। মল্লিকা যদি আমারে ‘নানী’ ডাকে, ক্লাসের সবাই নানী ডাকবো। আমি বোরকা পরুম না।

-মুন, আম্মা নিশ্চয়ই তোর ভালোর জন্যই বোরকা বানাতে দিয়েছে। আমি মেয়েদের কাপড় চোপর নিয়ে কিছু বলতে গেলে আম্মা আমাকেই বকা দিবে।
-না, ভাইয়া তুমি বললে আম্মা শুনবে।
-আমি আম্মাকে বুঝিয়ে বলবো। এবার তুই পড়তে যা।

ভাইয়া আম্মাকে কি বুঝিয়েছিল মুন জানেনা, আম্মা মুনকে বোরকা পরার কথা আর বলেনি, তবে মুনের নতুন নাম পছন্দ করেনি। আম্মা মুনকে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ছফু বলেই ডেকেছেন।

আব্বাকে নিয়ে মুনের কোন স্মৃতি নেই, কিন্তু আম্মাকে নিয়ে অনেক স্মৃতি। আব্বার খুব বেশী ছবিও ছিলনা ঘরে। আব্বাও মনে হয় খুব ধার্মিক ছিলেন, ছবি তোলার পক্ষপাতি ছিলেননা। হজ্জ্ব করতে যাওয়ার আগে পাসপোর্ট করার সময় যে ছবি উঠিয়েছিলেন, আব্বার মৃত্যুর পর সেই ছবিকেই এনলার্জ করে বাঁধাই করা হয়েছিল। সেই ছবিটাই আম্মার শোয়ার ঘরে টানানো হয়েছিল। ছবি দেখে আব্বাকে যতটুকু চিনেছে মুন, ওর মনে হয়েছে আব্বা খুব ভীতু টাইপের মানুষ ছিল।ছবিতে দেখা যায় আব্বার মুখ ভর্তি দাড়ি, মাথায় নামাজী টুপি, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ লাইট জ্বলার সময় বোধ হয় আব্বা চোখ কুঁচকে ফেলেছিল, তাইতেই আব্বার ছবিটা কেমন ভয় পাওয়া দেখায়। ভাইয়া বলেছে, আব্বা মোটেও ভীতু ছিলেননা, আব্বা ছিলেন খুব সাদাসিদে স্বভাবের মানুষ। সারাক্ষণ নামাজ কালাম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন।

শাহেদের চেয়ে মুন প্রায় বারো বছরের ছোট। দুই ভাইবোনের মাঝে আম্মার আরও দুটো সন্তান হয়েছিল, দুজনেই আঁতুরঘরেই মারা গেছে। এরপর মুনের জন্ম, ছেলের পর কন্যা সন্তান পেয়ে মুনের আব্বা খুশী হয়েছিলেন, নাম রেখেছিলেন ছফুরা খাতুন। কিন্তু ছফুরাকে নিয়ে হাসি তামাশা করার সুযোগ পাননি, কন্যার বয়স এক বছর মাত্র, এক রাতে ঘুমের মধ্যেই তিনি মারা যান।

আব্বা মারা গেলেও মুনের আদর আহ্লাদে কম পড়েনি। শাহেদের কাঁধে পিঠে চড়েই মুন বড় হচ্ছিলো। মুন যখন ক্লাস এইটে পড়ে, শাহেদ ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করে সবে নতুন চাকরিতে ঢুকেছে। এক সন্ধ্যায় ভাইয়ার সাথে একটি শাড়ি পরা মেয়ে বেড়াতে এলো। মুনের এখনও মনে আছে, দরজায় নক শুনে মুন নিজেই দরজা খুলে দিয়েছিল। ভাইয়ার সাথে একজন সুন্দরী মেয়ে, জীবনে এই প্রথম ভাইয়াকে কোন মেয়ের সাথে দেখে মুন অবাক হয়ে গেলো। মুনদের বাড়িতে অনেক কড়াকড়ি আছে, মুন যেমন পারবেনা পাড়ার কোন ছেলের সাথে গল্প করতে, ভাইয়াকেও কোন মেয়ের সাথে মিশতে দেখা যেতোনা। সেই ভাইয়া একটা সুন্দরী মেয়ে নিয়ে হাজির!

সেদিন ভাইয়া একটু গম্ভীর ছিল, মুনকে বলল, “ আম্মাকে ডেকে আন”।
মুন দৌড়ে গিয়ে আম্মাকে বলল, “ আম্মা তাড়াতাড়ি আসো, ভাইয়া ডাকছে। ভাইয়ার লগে একটা সুন্দর মেয়ে আসছে”।

মুনের আম্মা মাথায় কাপড় টেনে বাইরের ঘরে আসলো, শাহেদ পাশে দাঁড়ানো মেয়েকে বললো, “ নিপা, আমার আম্মা। সালাম করো, আর এই আমার বোন, মুন”।

মেয়েটি নীচু হয়ে আম্মার পায়ে হাত ছুঁয়ে হাত নিজের মাথায় এমনভাবে ঠেকালো, হিন্দুরা এভাবে পেন্নাম করে। মল্লিকা পরীক্ষায় ফার্স্ট হয়ে টিচারদের ঠিক এভাবে সালাম করে, হিন্দুরা এটাকে বলে পেন্নাম। ভাইয়ার সাথে আসা মেয়েটিকে নিয়ে মুনের কৌতুহলের সীমা ছিলনা। এই মেয়েও কি হিন্দু?

মুনের আম্মা ছেলেকে জিজ্ঞেস করলো, “ কোন বাড়ির মেয়ে ও, বাপের নাম কি? তোমার সাথে তার কি পরিচয়?
শাহেদ বলল, “ আম্মা, ওর নাম নিপা, আমরা আজ বিয়ে করেছি। তুমি আমাদের দোয়া করো।“

-বিয়া করছো? আমারে জিজ্ঞাস করলানা, তুমি একলা একলা বিয়া কইরা ফালাইছো? এইটা কি শুনাইলা? এই মাইয়া তো কদমবুসি করতে জানেনা, ওর বাপের নাম কি? তুমি কার মাইয়া ভাগাইয়া লইয়া আসছো?

কয়েকদিন বাড়ির পরিস্থিতি খুব থমথমে ছিল। ভাইয়া হিন্দু মেয়ে বিয়ে করেছে, সেই মেয়ে কদমবুসি করতে জানেনা। নামাজ কলেমা জানেনা, আম্মা কাঁদতে কাঁদতে শেষ। মুন হতভম্ব হয়ে সব দেখে যাচ্ছিল, কয়েক দিন মুন স্কুলেও যায়নি। আম্মা খায়না দায়না, খালি কাঁদে, বাসায় নতুন একজন মানুষ, সেও তো কোন কিছু বুঝতে না পেরে ঘরে বসে থাকে। মুন ঘুরে ঘুরে যায় মেয়েটির ঘরে, বুঝতে পারেনা মেয়েটিকে ভাবী ডাকবে কিনা। একদিন মেয়েটি মুনকে কাছে ডাকলো, মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে বলল, “ আমাকে পছন্দ হয়নি?
মুন মাথা ঝাঁকিয়ে বলেছে, খুব পছন্দ হইছে। আপনাকে আমি কি ডাকবো?

-বড় ভাইয়ের বউকে কি ডাকে সবাই?
-ভাবী
-তুমিও আমাকে ভাবী ডাকবে।
-কিন্তু আপনিতো হিন্দু, হিন্দুরে কি ভাবী ডাকা যায়?
-আমি আর হিন্দু নেই। তোমার ভাইকে বিয়ে করার পর আমি মুসলমান হয়ে গেছি। আমাকে ভাবী ডেকো।

-ভাবী, আপনি যে মুসলমান হইয়া গেলেন, আপনার বাবা মা মনে কষ্ট পাইবোনা?

এই কথা শোনামাত্র নিপা মুনকে বুকে টেনে নিয়ে সে কি কান্না। সেকথা মনে পড়লে এখনও মুনের গায়ে কাঁটা দেয়। দিশে না পেয়ে মুন বলেছিল, “ ভাবী, আর কাইন্দেননা। আম্মা কান্দে, আপনিও কান্দেন, আমার ভাইয়া মনে কষ্ট পাইতাছে, ভাইয়ার জন্য আমারও কষ্ট লাগতাছে।“

-মুন, আর কাঁদবো না। আম্মাও আর কাঁদবেনা। আম্মাকে গিয়ে বলো, আমি উনার সাথে একটু কথা বলতে চাই।

সেদিন ভাবী আর আম্মার মধ্যে কি কথা হয়েছিল মুন তা জানেনা। কিন্তু সেই বিকেল থেকেই আম্মার মুখে হাসি। ভাইয়ার সাথে বসে পরিকল্পনা শুরু করলো, বিয়ের একটা অনুষ্ঠান করা দরকার। এই বাড়ির একটা ইজ্জত আছে, এই বাড়ির একমাত্র ছাওয়াল বিয়ে করবে আর তা কেউ জানবেনা, তা ঠিক নয়।

ভাইয়া বলেছিল, -আম্মা অনুষ্ঠান করেন কিন্তু কারো কাছে গল্প করতে পারবেননা বৌয়ের ধর্মীয় পরিচয় নিয়ে। আমি নিপাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছি, ওকে আঘাত দিতে পারবোনা।

ভাইয়ার অনুরোধে কাজ হয়নি, আত্মীয় স্বজনেরা আগেই জেনে গেছে আতর আলী মুন্সীর একমাত্র বেটা হিন্দু মাইয়া বিয়া কইরা আনছে। দাওয়াত পায় নাই এমন দূর সম্পর্কের আত্মীয়রাও এসেছিল, আত্মীয়স্বজনের ভীড় লেগে গেছিল বৌভাতের দিন। মুনের একটা দৃশ্য আজও মনে পড়লে কান্না পায়, গ্রাম থেকে আসা আত্মীয়রা ভাবীকে ‘গরুর গোশত’ খাওয়ানোর জন্য বিশেষ আয়োজন করেছিল। ভাইয়াকে ধারে কাছেও ঘেঁষতে দেয়া হচ্ছিলো না। শাদীঘর ডেকোরেটার থেকে অনেক বড় থালা আনা হয়েছিল, সেই বিশাল থালা ভর্তি পোলাও আর বড় কাঁচের বাটি ভর্তি গরুর মাংস এনে হাজির হয়েছিল। খালা, চাচী আর ফুফুরা থালা মাঝে রেখে সবাই গোল হয়ে বসেছিল।

ভাবীর চেহারাতে মুন কি দেখেছিল! কেমন যেন পাথরের মত মুখ, নাকি পুতুলের মত! রেবেকা খালাকে মুনের একদম পছন্দ নয়, রেবেকা খালা বলল, “ বৌ, নেও বিসমিল্লাহ বইলা শুরু করো।“

ভাবী এক টুকরা মাংস নিতে গিয়েও হাত থেমে গেলো, ফরিদা ফুফু বলল, “ থামলা ক্যান, পরথম পরথম ইট্টু খারাপ লাগব, অভ্যাস নাইক্কা ত, তোমার শাউড়ি কইলো, তুমি কলেমা পইড়া মুসলমান হইছো। মুসলমান হওয়ার পরে বড় গোশত খাইতে কোন বাধা থাকেনা। বিসমিল্লাহ কইয়া মুখে দেও, দেখবা অনেক মজা লাগব।“

ভাবীর হাতে খোদেজা খালা বড় এক টুকরা মাংস তুলে দিয়ে বলল, নেও খাও।
এইসব খালা ফুফুদের মুন এর আগে দেখেছে বলে মনে পড়েনা। আম্মা কই গিয়ে বইসা আছে, আইসা নিজের বইনেগো একটা বকা দেয়না কেন? ভাবী মাংসের টুকরা মুখের কাছে নিয়েই নাক মুখ কুঁচকে ফেললো। খোদেজা খালা বলল, বিসমিল্লাহ কইয়া কামড় দেও।

ভাবীও বলল, বিসমিল্লাহ, বলে দুই চোখ বন্ধ করে এক কামড় দিয়েই ওখান থেকে উঠে গেলো। খালা আর ফুফুরা তখন খুশীতে হই হই করে উঠেছিল, বউয়ের মুসলমানি হইয়া গেছে।

মুন দৌড়ে গেলো ভাবী যেদিকে গেছে , বাথরুমের দরজা বন্ধ, ভেতর থেকে বমি করার শব্দ আসছিল। মুন দরজা ধাক্কাচ্ছিল আর ডাকছিল, “ ভাবী ভাবী, দরজা খোলেন, ভাবী দরজা খোলেন।“

দশদিন পর মুন স্কুলে গেলো, মল্লিকার জন্য অপেক্ষা করছিল। লায়লা বলল, “ মল্লিকা ট্র্যান্সফার লইয়া চইলা গেছে। মল্লিকার বড়দি নাকি ভাইগা গিয়া তোর ভাইয়ারে বিয়া কইরা মুসলমান হইয়া গেছে।“

মুনের মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়লো, ভাবীতো বাপের বাড়ির কথা কিছুই বলে নাই। ভাবী মল্লিকার বড়দি, মল্লিকা যে বড়দির কথা গল্প করতো, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, রোকেয়া হলে থাকে। দুর্গাপূজার ছুটিতে যখন বাড়ি আসে মল্লিকার জন্য অনেক বই নিয়ে আসে। মল্লিকার বড়দি তাহলে ওর ভাবী? কিন্তু মল্লিকা ট্র্যান্সফার নিয়ে চলে গেলো কেন? মুনকে না বলে চলে গেলো?

লায়লা বলল, ওর দিদির বিয়া্র কথা পাকাপাকি হইতেছিল, কোন জমিদার বাড়ির পোলার লগে, হের মইদ্যে মাইয়া ভাইগ্যা গেছে মোল্লা বাড়ির পোলার লগে, লজ্জায় অপমানে মল্লিকার মা অসুস্থ হইয়া গেছে, তাইনেরে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়া ভর্তি করছে। মল্লিকার বাবারও সম্মান গেছে ত, এইজন্য মনে লয় মল্লিকারে ইন্ডিয়া পাঠায় দিব।

মুন সেদিন একটু সাহসী হলো, শরীর খারাপ লাগার কথা বলে স্কুল থেকে ছুটি নিয়ে মল্লিকাদের বাড়ি চলে গেলো। মুনকে দেখামাত্র মল্লিকা এমন চোখে তাকালো, সেই দৃষ্টি মুনের কলিজা পর্যন্ত বিঁধেছিল। মল্লিকার চোখে ছিল তীব্র ঘৃণা, মুন কি করবে ভেবে পাচ্ছিলোনা। মুনের চোখে জল চলে এলো, ভয়ে ভয়ে বলল, “ মল্লিকা, আমি কি কোন দোষ করছি? আমার সাথে রাগ দেখাও ক্যান? মাসীমার অসুখের খবর শুইনা আমি আইছি। ভাবী যে তোমার বড়দি, এই একটু আগে লায়লার কাছে শুনছি।“

মল্লিকা এগিয়ে এসে মুনের হাত ধরলো, ঘরে নিয়ে গেলো। বলল, “ মুন, বড়দি ভালো আছে?”
– মুন কাঁদতে কাঁদতেই বলল, আমি জানিনা। তবে এইটা জানি, ভাইয়া ভাবীকে খুব ভালোবাসে।
– -বড়দি কি জানে, মা অসুস্থ হইয়া হাসপাতালে আছে?
– -আমি জানিনা।

– -বড়দিরে কিছু জানাইসনা। থাউক, নিজের বাবা মা, বইনের চাইতেও বড়দি যখন একজন মুসলমান পোলারেই বেশী ভালোবাসছে, তারে তার অসুস্থ মায়ের কথা জানাইয়া লাভ নাই। মুন, আমার বড়দি খুব ভাল রে, আমারে অনেক ভালোবাসতো। তোরেও ভালোবাসবে। বড়দি খুব লক্ষ্মী মাইয়া, বাবা আর মা, দুইজনেই আমার চাইতে বড়দিরে বেশী ভালোবাসে।

-ভাবী আমারে অনেক আদর করে, আমিও ভাবীরে ভালোবাসি।
-বড়দিরে ভাবী ডাকস? তুই যখন ভাবী ডাকস, বড়দি কি বুঝতে পারে?

-ভাবীর লগে বেশী কথা হয় নাই।

-বড়দি কি এখন নামাজ পড়ে? বড়দির হিন্দু নাম পাল্টাইছে? বড়দি কি এখন গরুর মাংস খায়?

মুনের খুব কষ্ট হচ্ছিলো, তবুও বলল, ভাবীকে আমরা কিছু বলি নাই। ভাবী নিজে থেকেই নামাজ পড়া শিখেছে। কিন্তু আমাদের গ্রামের আত্মীয়স্বজনরা আইসা গরুর গোশত খাওয়াইছে। ভাবীর অনেক কষ্ট হইতেছিল, মুখের কাছে নিতে পারতেছিলনা, চউখ বুইজ্জা গোশতে এক কামড় দিয়াই বাথরুমে গিয়া বমি কইরা দিছে।

-সহসা মল্লিকার চোখে মুখে আবার সেই ঘৃণা ফুটে উঠেছে, মুন এসব বুঝতে পারে। কিন্তু বুঝতে পারছেনা ঘৃণা কাকে করছে মল্লিকা?

মুন বলল, ভাবী যখন বমি করছিল, আমার কষ্টে বুক ফাইটা যাচ্ছিল। আমিতো জানতামনা ভাবী যে তোর বড়দি, জানলে তো খালা ফুফুদের বাড়ি থিকা বাইর কইরা দিতাম। মল্লিকা, তুই আমার সাথে রাগ করিসনা, আমিতো কোন দোষ করি নাই।

-তোর সাথে রাগ করুম ক্যান? আমার বড়দি উচিত শিক্ষা পাইছে। বড়দির বিয়ার কথা পাকাপাকি হইয়া গেছে, বড়দি বাবা মায়ের মান সম্মানের দিকে তাকাইলোনা, ছোট বইনটার কথা ভাবলোনা, ভাইগ্যা গেলো। এখন খা, গামলা ভইরা গরুর মাংস খা আর বমি কর। এখন থিকা পাঁচ ওয়াক্ত মাটিতে কপাল ঠুয়াবি, সুর কইরা কোরান তেলাওয়াত করবি, রমজান মাসে সারাদিন রোজা রাইখা শুটকি লাইগা থাকবি, মোল্লা বাড়ির বউ হওয়ার তেল মজবো।

একরাশ ঘেন্না নিয়ে মল্লিকা একা একাই বলে যাচ্ছে, অপরাধীর মত মুখ করে মুন চুপ করে আছে।

মল্লিকা বলল, মুন, সামনেই আমার বৃত্তি পরীক্ষা। ফাইভে টেলেন্টপুলে বৃত্তি পাইছি, এইটেও পামু জানা কথা।

-তাতো পাবিই।
-মুন, আমার স্কুলে যাওয়া বন্ধ। ভিসা করতে দিছে, মায়ের শরীর একটু সুস্থ হইলেই আমারে কলিকাতা পাঠায়ে দিবে। আমি কলিকাতা গিয়া কি করমু? আমি কি কলিকাতা গিয়া তোরে পামু? আমার বৃত্তি পরীক্ষার কি হইব? আমি বাবা মারে কাছে পামু? তুইই বল, দোষ করলো বড়দি তার সাজা ক্যান আমি পামু? আমি কলিকাতা গিয়া কি করমু মুন?—বলেই মল্লিকা হাউ মাউ করে কাঁদতে লাগলো।

মল্লিকার কান্না দেখে মুনও আর কান্না ধরে রাখতে পারলোনা, দুই প্রাণের সখী গলা জড়াজড়ি করে কাঁদতে লাগলো।

দুই

শাহেদ যখন অফিসে যায়, নিপা দরজার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে। চৌকাঠ ডিঙ্গানোর আগ মুহূর্তে নিপার দুই গালে আলতো করে চুমু দিয়েই শাহেদ দ্রুত গাড়িতে গিয়ে ওঠে। এটি রোজকার অভ্যাস। মুনের চোখে এই দৃশ্য অনেকবার পড়েছে, কিছুই দেখিনি ভাব করে মুন চোখ সরিয়ে নিলেও মনে মনে খুশী হয়েছে। মল্লিকাকে ও বলেছিল সেই কত বছর আগে, ভাইয়া ভাবীকে খুব ভালোবাসে। ভাইয়া যে ভাবীকে এত ভালোবাসে, এতে মুনের মন থেকে অপরাধবোধ কিছুটা কমে। অপরাধবোধ কারণ এই ভাইয়া আর ভাবীর কারণেই মল্লিকার জীবনটা নষ্ট হয়ে গেলো। কলিকাতা গিয়ে মল্লিকা এখন কি করছে মুন তা জানেনা।

১৩ বছর পেরিয়ে চৌদ্দতে পা দিলো শাহেদ নিপার দাম্পত্য জীবন। সংসার আলো করে রেখেছে কিংশুক আর সূর্যমুখী নামের ফুটফুটে দুটো মেয়ে। কিংশুক পড়ে থার্ড গ্রেডে, সূর্যমুখী পড়ে ফার্স্ট গ্রেডে। দুই কন্যাকে স্কলাস্টিকায় নামিয়ে দিয়ে শাহেদ চলে যায় তার অফিসে। বনানীতে ‘কিংশুক বায়িং হাউজ’ নামে শাহেদের নিজস্ব গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি আছে, খুব জমজমাট ব্যবসা। নিপা আগে একটি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে সংবাদ পাঠ করতো, তিন বছর কাজ করে চাকরি ছেড়ে বুটিকের কাজ শুরু করেছে। খুব ছোট পরিসরে ওর কাজ, তবে ওর অনেক গ্রাহক আছে। সংবাদ মাধ্যমে কাজ করার এই এক লাভ, সমাজের বিত্তশালীদের সাথে পরিচয় হয়।

মুনের বিয়ে হয়েছে দুই বছর আগে, নিজের পছন্দের ছেলেকেই বিয়ে করেছে। মা মারা যাওয়ার পর মুনদের পরিবার থেকে কঠিন পর্দা প্রথা উঠে যায়। আম্মা যতদিন ছিলেন, ভাবী পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়তো, কোরান পাঠ করতো, ত্রিশ রোজাও রাখতো। ভাবী আসলেই খুব নরম মনের মানুষ, ভাইয়া আর ভাবী যদি একই ধর্মের মানুষ হইতো, তাইলে কোন কথাই থাকতোনা। মল্লিকাকেও দেশ ছাড়তে হইতোনা। যাই হোক, আম্মার মৃত্যুর পর ভাবী অনেকটাই স্বাধীনভাবে চলাফেরা করা শুরু করে। কান্দিরপাড় থেকে মোল্লা বাড়ির বউ স্বাধীনভাবে চলতে পারেনা। ভাইয়া ততদিনে গার্মেন্টস ফ্যাকটরি শুরু করেছে, ভাবীর কোলে কিংশুক এসেছে। মেয়ের নাম কিংশুক রাখার মধ্যে দিয়েই ভাবীর প্রথম স্বাধীন ইচ্ছের প্রয়োগ। কিংশুক নামটা মুনেরও খুব পছন্দ। ছোট্ট কিংশুককে কোলে নিয়েই ভাইয়া আর ভাবী উত্তরার এই অ্যাপার্টমেন্টে এসে উঠে।

মুন তখন ইডেন কলেজে ভর্তি হয়। ইডেন কলেজ থেকে ঢাকা ইউনিভার্সিটি। সেখানেই পরিচয় হয় নাহিদের সাথে, নাহিদ ঢাবিতে এম বিএ করছিলো। পরিচয়ের দেড় বছরের মাথায় ওরা বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নেয়, কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করেও ফেলে।

নাহিদ খুবই ভালো ছেলে, নাহিদকে নিপা আর শাহেদের দুজনেরই খুব পছন্দ হয়েছে। মুন এমন সাদামাটাভাবে বিয়ে করুক তা নিপা বা শাহেদ কেউই চায়নি। কিন্তু মুনের চাওয়াই পরিবারে শেষ কথা, মুন চেয়েছে কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করবে, তাই মেনে নিতে হয়েছে। মুনেরও দোষ নেই, সেই বছরেই নিপার ইউটেরাসে টিউমার ধরা পড়ে এবং ডাক্তার হিস্টেরেক্টোমির জন্য বলে। হিস্টেরেকটোমির ধাক্কা নিপা খুব ভালোভাবে সামাল দিতে পারছিলোনা। বিয়ের পর থেকে সার্জারীর আগে পর্যন্ত নিপার ফিগার ছিল দেখার মত। মুনের বন্ধুরা বলতো, “ তোর ভাইয়া খুব লাকী, একেবারে তরবারীর মত ধারালো ফিগারের বউ পাইছে”।

মুনও যোগ করতো, আরে, আমার ভাইয়া আর ভাবী পুরাই লাইলী মজনু। এত বছর হইছে বিয়া হইছে, এখনও প্রতি সকালে অফিস যাওয়ার মুহূর্তে লাইলীর দুই গালে মজনুকে চুম্মা খাইতে হয়, চুম্মা খাইয়া লাইলী দিন শুরু করে”।
বন্ধুরা যখন শুনতো, ভাবীর দুই বাচ্চা, তখন বিশ্রীভাবে চোখ নাচিয়ে বলতো, তোর ভাইয়া কোন কামের না। এত বছরেও তরবারী বাঁকা করতে পারে নাই।

কথা আরও অশ্লীলতার দিকে যাওয়ার আগেই মুন কথা ঘুরিয়ে ফেলতো।

তিন

মাথা ব্যথা ছাড়ছেইনা, বিছানা থেকে নামলো মুন। বাথরুমে গিয়ে চোখে মুখে পানির ঝাপ্টা দিল, ঘাড়ে পানির ঝাপটা দিল। মুখ মাথা তোয়ালে দিয়ে মুছে কিচেনে গেলো। ভাইয়ার বাড়িতে তিনজন কাজের বুয়া, বেল টিপলেই যে কেউ ছুটে আসে। মুন বেল টিপলোনা, নিজেই কেটলিতে চায়ের পানি চাপালো। ভাইয়ার অফিসে যাওয়ার সময় হয়েছে, চায়ের পানি ভাইয়া ভাবীর হিসেবেই নিয়েছে। সকালে ভাইয়া দুটো টোস্ট দিয়ে চা খেয়ে অফিসে যায়, ওখানেই ব্রেকফাস্ট করে। চায়ের পট, চায়ের কাপ টেবিলে সাজাচ্ছে, শাহেদ চলে এলো। মুনকে দেখে শাহেদের কপাল কোঁচকালো, “ মুন, রাতে ঘুমাস নাই?”

-ভাল ঘুম হয় নাই ভাইয়া। আম্মাকে স্বপ্নে দেখছি, আম্মা মুখ মলিন কইরা আছে। আমার মাথা ব্যথা করছে।
-ঘুম আসছিলোনা, আমাকে ডাকিস নাই ক্যান?
-তোমারে ডাকবো ক্যান ভাইয়া? আমি কি আগের মত ছোট আছি?

-তুই সারাজীবন আমার কাছে ছোটই থাকবি। আম্মার মুখ মলিন দেখছিস, তবুও আম্মারে স্বপ্নে দেখছিস, আমি আব্বা আম্মা কাউরেই স্বপ্নে দেখিনা।

মুনের কাছে মনে হলো, ভাইয়ার মুখটা খুব মলিন, কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত নাকি? পট থেকে চা ঢালতে ঢালতে মুন জিজ্ঞেস করলো, ভাবীর চা ঢালবো? ভাবী উঠেছে?

শাহেদ মুনের প্রশ্ন এড়িয়ে গেলো, বলল, আজ কিংশুক আর সূর্যমুখীকে তুই একটু দিয়ে আসতে পারবি? আমার আজ একটা মিটিং আছে বলে আগে বেরোতে হচ্ছে।

-পারবো ভাইয়া। তুমি নিশ্চিন্তে কাজে যাও।

শাহেদ বেরিয়ে গেলো, ভাবী সামনে এলো না! আজ নিয়ে তিনদিন, ভাইয়া বেরোনোর সময় ভাবী সামনে আসেনি। ভাবীর কি শরীর বেশী খারাপ? ভাইয়ার মুখটা কি এজন্যই মলিন দেখাচ্ছিল? স্বপ্নে আম্মার মুখটাও কেন মলিন দেখাচ্ছিল? এই পরিবারে কি কোন অশান্তি আসছে? নাহিদের সাথে মুন আর সংসার করবেনা, এই কারণেই কি সবার মন খারাপ?

কিংশুক আর সূর্যমুখীকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে এলো মুন। পাঁচ মিনিট চেয়ারে বসে যেন একটু দম নিল, সোজা চলে গেলো ভাইয়া ভাবীর বেডরুমে। ভাবী শুয়ে আছে ডান পাশ ফিরে, মুনকে দেখে উঠে বসতে বসতে বলল, “ আসো, বসো এখানটায়। চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন, তোমার কি মন খুব বেশী খারাপ? কাল সারারাত তোমার ঘরে বাতি জ্বলেছে, ঘুমাওনি মনে হয়।”

-হ্যাঁ ভাবী, মনটা খারাপ।

-নাহিদের সম্পর্কে কি ডিসিশান নিয়েছো?

-ভাবী, তোমার শরীর খুব খারাপ, কাল হালকা ঘুমে স্বপ্নে দেখেছি আম্মাকে, আম্মার মুখ খুব মলিন ছিল। আজ সকালে ভাইয়ার মুখ খুব মলিন দেখলাম। ভাবী আমার ভয় করছে।

-কিসের ভয় করছে?
-তোমার কি হয়েছে ভাবী? গত তিন দিন ভাইয়া অফিস যাওয়ার সময় তুমি সামনে আসোনি। এমনতো কোনদিন হয়নি।

-আমার শরীর বেশী ভালো নেই তাই সকালে বিছানা থেকে উঠিনা। এখন তুমি বলো, নাহিদ সম্পর্কে কি ডিসিশান নিলে?

-নাহিদের সাথে সংসার করবোনা।
-ফাইনাল?
-হ্যাঁ, ফাইনাল। আজ কালের মধ্যেই নাহিদকে জানিয়ে দেবো।
-নাহিদ কিন্তু খুবই ভালো ছেলে, তোমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে।
-কি করে বুঝলে আমাকে প্রচন্ড ভালোবাসে?

-প্রকৃত ভালোবাসার মধ্যে অভিনয় থাকেনা, এক ধরণের ঝিলিক থাকে, যে ভালোবাসার মর্ম বুঝতে পারে তার চোখেই শুধু ঝিলিক ধরা পড়ে।

-তোমার চোখে নাহিদের ঝিলিক ধরা পড়েছে?
-হুম, তোমার প্রতি নাহিদের ভালোবাসা আমার চোখে ধরা পড়েছে। যাক গে, নাহিদকে ডিভোর্স করবে কি কারণ দেখিয়ে ঠিক করেছো?

-নাহিদ বিয়ে করতে হয় বলেই বিয়ে করেছে, বিয়ের পর ছেলেরা নতুন বউ নিয়ে যে রকম আদিখ্যেতা করে, নাহিদের মধ্যে তা নেই।

-এই গ্রাউন্ড দেখিয়ে ডিভোর্স পাবে? সবাইতো আদিখ্যেতা করতে পারেনা, সবার ভালোবাসার প্রকাশ এক রকম হয়না।
-ভাবী, তোমার বিয়ের পর নতুন অবস্থায় তোমরা দিনে কয়বার সেক্স করতে?

মুনের মুখ থেকে এমন প্রশ্ন শুনে নিপা থতমত খেয়ে গেলো।
নিপার উত্তর শোনার অপেক্ষা নাকরেই মুন বলল, “ নাহিদ আমাকে খুব ভালোবাসে, তবে ভাইয়া যেমন ভালোবাসে আমায় ঠিক তেমন ভালোবাসা।“

-নাহিদ কি শারীরিক মিলনে অক্ষম?
-অক্ষম নয় তবে শারীরিক মিলনে তার কোন আগ্রহ নেই। মাসে এক দিন বা দুই দিন আমরা মিলি, সেটাও আমার আগ্রহে। এর সাথে আমি সারাজীবন কাটাবো কি করে?

-এমনতো হতে পারে, কোন বিষয় নিয়ে নাহিদ খুব চিন্তিত, টেনশান বা স্ট্রেস থাকলেও যে কারো সেক্সচুয়াল আর্জ কমে যেতে পারে। অনেক দিক ভেবে দেখতে হবেতো।
-অনেক ভেবেছি ভাবী, আর ভাবাভাবির মধ্যে থাকতে চাইনা।
-ডাক্তার দেখিয়েছো?

-দেখিয়েছি, ডাক্তার ওকে অনেক ম্যাগাজিন পড়তে দিয়েছে, অনেক ভিডিও দিয়েছে। নাহিদ সেগুলো দেখেনা, বললাম যে ওর আগ্রহ নেই।

ভাবী, আমার চোখে তুমি আর ভাইয়া হচ্ছো পৃথিবী শ্রেষ্ঠ দম্পতি। তোমাদের সুখী জীবন দেখেই আমি সুখী দম্পতির একটা নমুনা মনে মনে এঁকে রেখেছি, নাহিদ আর আমি তেমন দম্পতি নই।

-মুন, সংসার মানে রান্নাবাটি খেলা, ভেঙ্গে দিলেই ভেঙ্গে দেয়া যায়, কিন্তু কেউ সহজে ভাঙ্গতে চায়না।
-ভাবী, নাহিদের সাথে আমি সংসার করবোনা।
-করোনা, মনে এত ঘেন্না নিয়ে কারো সাথে জীবন কাটানো যায়না।
-নাহিদকে আমি ঘেন্না করিনা, ওর সাথে আমার সংসারে ম্যাচ হয়নি।

-মুন, আমাদের সুখী দাম্পত্য জীবনের গল্প শুনবে? তোমার ভাইয়াকে আমি এমন ভালোবেসেছিলাম যে তার জন্য সব ছাড়তে রাজী ছিলাম। তোমার ভাইয়া আমাকে প্রথম প্রেম নিবেদন করেছিল। তোমার ভাইয়ার আগেও আমাকে কত জনেই প্রেম নিবেদন করেছে, তাদের সকলের চোখের দিকে তাকিয়ে আমি ভালোবাসা খুঁজে পাইনি, সেখানে দেখেছি কামনার আগুন। আমার ফিগার খুব সুন্দর ছিল, বন্ধুরা আমাকে ঠাট্টা করে বলতো, “ সেক্স বম্ব’। বন্ধুরা আমাকে সেক্স বম্ব বলতো বলেই হয়তোবা আমি কারো প্রেমে পড়তে ভয় পেতাম। আমি ধরেই নিয়েছিলাম, আমাকে নয় আমার শরীরটাকেই এরা বেশী ভালোবাসে। যাকগে, তোমার ভাইয়ার চোখের দিকে তাকিয়ে আমি গভীর কালো জলে ডুবে গেলাম। ছেলেদের চোখ এত সুন্দর হয় আমার জানা ছিলোনা।

শুরু হয়ে গেলো আমাদের প্রেম। আমি যখন থার্ড ইয়ার অনার্স, বাড়ি থেকে আমার জন্য বিয়ের সম্বন্ধ দেখা শুরু হলো এবং খুব অভিজাত এক পরিবারের ছেলের সাথে বিয়ের কথা পাকাপাকি হয়ে গেলো। তখন তোমার ভাইয়া চাকরিতে ঢুকেছে। আমি তোমার ভাইয়াকে বললাম, “ চলো আমরা বিয়ে করে ফেলি”।

শাহেদ বলল, বিয়ে করতে চাও এখনই? আম্মাকে তোমার কথা কিছু বলা হয় নাই। আম্মাকে রাজী করাতে হবেতো।
-তোমার আম্মাকে আমার কথা বলো
-আচ্ছা আজই বাড়ি গিয়ে বলবো।
পরদিন শাহেদকে জিজ্ঞেস করলাম, আম্মাকে বলেছো?
-ভয় লাগে, ধর্মের ব্যাপারটা আম্মা মানবেন কিনা জানিনা। আম্মা নির্ঘাত তোমাকে মুসলমান হতে বলবে, তুমি কি ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে?

-কেন, আমাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে কেন? যার যার ধর্ম সে সে পালন করব।

পরদিন আমরা দুজন কাজী অফিসে গিয়ে বিয়ে করলাম, তোমাদের বাড়িতে উঠলাম। তুমি তখন কিশোরী, সব কথা হয়তো মনেও নেই। আম্মা নাওয়া খাওয়া বাদ দিলেন, পর পর তিন রাত তোমার ভাইয়া আমাকে আশ্বাস দিল যে আম্মাকে বুঝিয়ে শান্ত করবে। এবং বলতে বাধা নেই, তোমার ভাইয়ার ভালোবাসার খেলায় আমি কাবু হয়ে গেলাম। চার দিনের দিন আমি নিজেই আম্মার সাথে কথা বললাম। আম্মা ধার্মিক মানুষ, উনি উনার মত করেই বললেন যে আমাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতেই হবে।

ইসলাম ধর্ম গ্রহণ না করলে, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ না পড়লে উনি আমার হাতে পানিও খাবেনা। আমার আর পেছনে ফেরার পথ ছিলনা, বাবা মায়ের কাছে ফিরে যাব কোন মুখে? শাহেদকেও ছাড়তে পারবোনা, শাহেদও তার আম্মাকে মানাতে পারবেনা। তাই আমিই মেনে নিলাম, রাজী হলাম ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে। আম্মাকে খুশী করার জন্য নামাজ পড়ি, আম্মার সম্মান রাখার জন্য আত্মীয়স্বজনের মাঝে বসে নিজের ধর্ম, নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দিয়ে গরুর মাংস খেয়ে পাকাপাকিভাবে মুসলমান হয়ে গেলাম। মন থেকে বাবা মা ছোট বোনটাকে মুছে ফেলতে চাইলাম।

আম্মা আমার বিয়ের এক বছর পরেই মারা যাবেন জানলে আমি নাহয় সে পর্যন্ত অপেক্ষা করতাম, আম্মার মৃত্যুর পরেই শাহেদকে বিয়ে করতাম। তাহলে আমাকে এত অত্যাচার মুখ বুজে সইতে হতোনা। সেদিন তোমার আম্মাকে খুশী করতে গিয়ে তাঁর আত্মীয়স্বজনের অত্যাচার মুখ বুজে সয়েছিলাম ঠিকই, কিন্তু মানুষগুলোর নিষ্ঠুর এবং বর্বর আনন্দ উল্লাস দেখে আমার এমন ঘেন্না করছিল যে বাথরুমে গিয়ে বমি করেও গা ঘিনঘিনে ভাব কাটাতে পারিনি।

তবুও শাহেদকে নিয়ে আমি সুখী ছিলাম। শাহেদের শারীরিক ক্ষিদে খুব বেশী ছিল, তখন আমার বয়স কম ছিল বলে তার ক্ষিদে মেটাতে পেরেছি। তোমার কথাও ঠিক, শুধু ভালোবাসায় যেমন দাম্পত্য গড়ে উঠেনা, শুধু শারীরিক সম্পর্কের উপরও কিন্তু দামপত্য গড়ে উঠেনা। আমার আর শাহেদের মাঝে ভালোবাসাও ছিল, নইলে আমি কি করে পারলাম নিজের বাবা মা বোনকে ভুলে থাকতে? শাহেদইবা কি করে পারলো কান্দিরপাড়ের সেই গাঁইয়া আত্মীয়স্বজনের মাঝখান থেকে আমাকে সরিয়ে ঢাকা নিয়ে আসতে।

-ভাবী, আমার খুব ভালো লাগতো দরজায় দাঁড়িয়ে তোমার আর ভাইয়ার সকালের চুমু খাওয়ার পর্বটা।

-হুম, আগে আমারও ভালো লাগতো। শাহেদই বলেছিল, মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমরা একটা রীতি পালন করে যাব, দুজনের যে আগে ঘর থেকে বের হবো, সে অন্যজনকে চুমু খেয়ে বেরোবে। আমি কোনদিনই শাহেদের আগে বের হইনি, তাই শাহেদকেই চুমু খাওয়ার রীতি মানতে হতো। ইদানিং চুমুতে আবেগ বা ভালোবাসার ব্যাপারটা নেই। সকালে এক কাপ চা, দুপুরে ডাল মাছ ভাত, রাতে রুটি মাংস খাওয়ার মতই দরজার পাশে দাঁড়িয়ে আলতো চুমু খাওয়ার ব্যাপারটা।

-কি যে বলো ভাবী।

-ভালোবাসার গল্প এখনও শেষ হয়নি। আমাদের ভালোবাসার মোড় ঘুরতে শুরু করলো আমার ইউটেরাসে টিউমার ধরা পড়ার আগে থেকে। অপারেশানের আগে আমার তলপেটে খুব ব্যথা হতো, এর মধ্যেই রাত হলেই শাহেদ আমাকে কাছে টানতো। পেটে ব্যথা বললেও ও মানতে চাইতোনা। “ খুব সাবধানে করবো, খুব আস্তে করব, ব্যথা দেবোনা” জাতীয় ছেলেভুলানি গান গাইতে শুরু করতো। শাহেদকে তখন আমার প্রেমিক স্বামী মনে হতোনা, মনে হতো, সাক্ষাৎ অসুর। ভাইয়ার নামে খারাপ কথা বলছি বলে তুমি মন খারাপ করোনা মুন, এ শুধুই আমাদের দুই নারীর বেদনার কাব্য। এক রাতে ভালোবাসা শেষ হওয়ার পরক্ষণেই প্রচন্ড ব্লিডিং শুরু হলো। ব্লিডিং দেখে শাহেদের মাথা খারাপ হওয়ার জোগার। শাহেদের মুখের দিকে তাকিয়ে আমার মায়া লাগলো, বেচারার কি দোষ। ঈশ্বর তার দেহে এত কামভাব ঢেলে দিয়েছে, সব দোষ ঈশ্বরের।

অপারেশান শেষে বাড়ি ফেরার পর থেকেই দেখি শাহেদ দূরে দূরে থাকে। আমি ভাবি, সেদিন ব্লিডিং হয়েছিল তাই লজ্জায় সে দূরে থাকে। আমার মায়া লাগে, শাহেদকে কাছে টানি। কামকলার কত কৌশলইতো আছে, বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ করার চেষ্টা করি, শাহেদের সাময়িক তৃপ্তি হয়, আমিও মনে শান্তি নিয়ে ঘুমাই।

মুন, এবার সবচেয়ে কঠিন কথা বলবো, বছর দেড়েক আগে শাহেদ আরেকটি বিয়ে করেছে।

-না—–, ভাবী এ হতে পারেনা।

-আমিও ভাবতাম, এ হতে পারেনা। কিন্তু এটা হয়েছে। শাহেদ আমার কাছে অনুমতি চেয়েছিল, ইসলাম ধর্মের নিয়মেই আছে প্রথম বউ থাকতে দ্বিতীয় বিয়ে করতে চাইলে প্রথম বউয়ের অনুমতি লাগে। আমি অনুমতি দিয়েছি, অপারেশানের পর আমার দেহ ভারী হয়ে যাচ্ছে, এখন আমার সেই ফিগার আর নেই। তলপেটে কোন যন্ত্রপাতিও নেই, অপারেশান করে সব ফেলে দিয়েছে। কিন্তু শাহেদের ক্ষিদের থলিতো তাতে ভরবেনা। সে যেদিন আমায় বলেছে, “ ফিগারটা নষ্ট করে ফেলেছো, কি ধারালো ছিলো তোমার ফিগার, যে কোন পুরুষের মাথা খারাপ করে দেয়ার মত। অপারেশানের পর কি যে আলসেমীতে পেলো তোমায়, শরীরে মেদ জমে কি হয়েছে দেখেছো?”

সেদিন আমি কিছু বলিনি, শাহেদের মুখ থেকে এমন গা ঘিনঘিনে কথাগুলো শুনে হতভম্ব হয়ে গেছিলাম। এ কে, স্ত্রীর অসুস্থ অবস্থা নিয়েও মশকরা করে?

-ভাবী, আর বলোনা। ভাবী আর বলোনা। এখন বুঝতে পারছি, তুমি কেন সব বুঝেও বার বার নাহিদের কাছেই ফিরে যেতে বলছো। কিন্তু ভাবী, নাহিদের কাছে ফিরে গিয়ে তো আমিও এক সময় নাহিদকে ঘেন্না করতে শুরু করব পৌরুষহীনতার জন্য। সেটাও কি ঠিক হবে?

-জানিনা রে, তবে এটুকু বলি, সম্পর্ক ভেঙ্গে দেয়ার আগে আরেকবার সুযোগ দিয়ে দেখতে পারো।

-ভাবী, ভাইয়ার সেই বউ কোথায় থাকে?

-ঢাকা শহরেই কোথাও। তোমার ভাইয়া আজকাল সেখানেই থাকে। তুমি এসেছো বলে এই কদিন বাড়ি ফিরছে। তবে—–

-কি তবে?

নিপা চুপ করে ভাবতে লাগলো, “ থাক, কাল রাতের কথা মুনকে বলবোনা। কাল রাতের ঘটনা কাউকেই বলবোনা।

** দেড় বছর পর গত রাতে শাহেদ নিপাকে কাছে টানতে চেষ্টা করছিল, নিপা বার বার তা এড়িয়ে গেছে। নিপার অভিমান শাহেদ বুঝতে পারেনি, “ কি হলো, কত দিন পর তোমাকে একটু আদর করতে চাইছি” বলে আরেকবার কাছে টানতেই নিপা শাহেদের কোমরে এমন জোরে লাথি মারলো যে টাল সামলাতে না পেরে শাহেদ বিছানা থেকে পড়ে গেলো।

নিপার ব্যবহারে শাহেদ হতবাক হয়ে ঘুরে নিপার দিকে তাকাতেই দেখতে পেলো, রণরঙ্গিনি মূর্তি, হিসহিসিয়ে বলছে, “ লোভী, মাংসলোভী কুকুর কোথাকার, তোকে ভালোবেসে আমি বাপ মা বোন, সমাজ ছেড়েছিলাম। তোকে ভালোবেসে তোর মাকে খুশী করতে নিজ ধর্ম পরিত্যাগ করেছিলাম। তোর আত্মীয়স্বজনকে খুশী করতে আজন্ম লালিত সংস্কার ভেঙ্গে গরুর মাংস খেয়েছিলাম। তোর বোনটাকে আমি নিজের বোন ভেবে বুকে আগলে রেখেছিলাম।

যতদিন পর্যন্ত শরীরে রোগ ধরা পড়েনি ততদিন তোর ক্ষিদে মিটিয়েছিলাম। এভাবে ১১ বছর কাটিয়েছি, দুইটা ফুটফুটে মেয়ে উপহার দিয়েছি। আর তুই আমাকে কি দিয়েছিস? শরীর কি আমার সারাজীবন খারাপ থাকতো? ছয়টা মাস তোমার তর সইলোনা? তুমি আমার এতদিনের ভালোবাসা, প্রেম ভুলে আরেক মেয়েকে বিয়ে করে ফেললে? দেড় বছর আমি অপমানের কান্না কাঁদছি। আমি জানিওনা আমার বাবা বেঁচে আছে কিনা, আমার মা বেঁচে আছে কিনা, আমার ছোট বোনটার কি হাল কিছুই জানিনা, সব সয়েছি তোমাকে ভালোবেসে।

আর তুমি কিনা আমায় ত্যাগ করে আরেক মেয়ের সাথে ঘর বেঁধে ফেললে? তোমার দেহে এত ক্ষিদে, তোমার লজ্জাও করলোনা দেড় বছর বাইরে কাটিয়ে আজ আমার গায়ে হাত দিতে? এত চনমনে পুরুষত্ব দেহে বয়ে বেড়াও, প্রাণে একটু ভালোবাসা ধরে রাখতে পারোনা! ঘেন্না করি অমন পুরুষত্বকে, ঘেন্না ঘেন্না ঘেন্না।**

-ভাবী, তবে বলে থামলে কেন?

-ও কিছুনা, বলতে চেয়েছিলাম যে আরেক বিয়ে করলেও বোনের জন্য তার অনেক মায়া। বোনের জন্যই তিন দিন ধরে বাড়িতে আসছে।

-ভাবী, কিংশুক আর সূর্যমুখি পাপার কথা জানতে চায়না?
-আমি বলি, পাপাকে রাতে ফ্যাক্টরীতে থাকতে হয়, নাহলে ফ্যাক্টরীর কাজ ঠিকমত হয়না।
-ভাবী, আমাকে মল্লিকা বলেছিল, বড়দি খুব নরম মনের মানুষ। ভাবী, তুমি আসলেই নরম মনের মানুষ। নিজের ভাই বলে বলছিনা, যে কোন পুরুষ ভাইয়ার মত কাজ করলে তার বউ সহ্য করতোনা, কিন্তু তুমি নীরবে সইছো।

** নিপা মনে মনে বলল, ঝিনুক নীরবেই সয়ে যায়, আমিও এতকাল সয়েছি নীরবে, আর সইতে না পেরে গতকাল কঠিন জবাব দিয়েছি। **

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত