বলা হয়নি ভালোবাসি

বলা হয়নি ভালোবাসি

সদ্য যৌবনে পা রাখা এই আমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল, তাও একটা রিক্সা ওয়ালার সাথে।
সৎ মা যার আছে সেই বোঝে কতটা কষ্ট নিয়ে বিয়েতে মত দিতে হয়।
আমার কিছু স্বপ্ন ছিল।

হয়ত কখনো কেউ কোনোদিন জানবেনা। সেই ছোটবেলা থেকেই স্বপ্নগুলিকে কবর দিতে দিতে এসেছি। আমার বয়সী মেয়েরা যখন কিতকিত খেলায় বা পুতুল বিয়ে দেওয়ায় ব্যাস্ত তখন আমি ব্যাস্ত ছিলাম রান্নার কাজে, বিকেলে যখন ছাদে কাপড় তুলতে যেতাম। একদৃষ্টি তে ওদের কিত কিত খেলার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। বাবা টাও একবেলা কখনো খোজ নেয়নি মেয়ের, মেয়ে খেয়েছে কিনা? কখনো জিজ্ঞেস করেনি। বরঞ্চ সৎমায়ের সাথে তাল মিলিয়ে আমায় দিয়ে বিভিন্ন কাজ করিয়ে নিয়েছে। সবাই যখন স্কুলে যেত আমারো ভিষন স্কুলে যেতে ইচ্ছে করত। ওদের স্কুলে যাবার পথে তাকিয়ে থাকতাম। সেই জন্য সৎমায়ের হাতে কম মাইর খাইনি। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে একবার বাবাকে বলেছিলাম। আমাকে স্কুলে ভর্তি করে দেবে বাবা? পাশ থেকে বাবার বউ মানে আমার সৎ মা বলেছিল, তুই স্কুলে গেলে বাসার কাজ কে করবে? বাবা মায়ের কথার বিরুদ্ধে যেয়ে আমায় স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। সেদিন বাবার প্রতি আমার অন্যরকম একটা ধারনা হয়েছিল। সেই মুহুর্তে ভেবেছি বাবা আমাকে একটু হলেওতো ভালোবাসে। এই ভালোবাসার জন্য আমি সব কষ্ট মুখ বুজে সহ্য করতে পারব। পরে জানতে পারি আমাকে না পড়ালে, আমাকে বিয়ে দিতে অনেক টাকা খরচ করা লাগবে।

কথাটা জানারপর সারারাত ঘুমাতে পারিনি। বার বার মা’য়ের কথা মনে পড়ছিল। খোদা কে বলেছিলাম, আমার থেকে আমার মা’কে কেরে নেওয়ার কি খুব দরকার ছিল? উত্তর পায়নি। মানুষে বলে যা হয় ভালোর জন্য, এখানে আমার ভালোটা কোথায়? অনেক কষ্ট করে খেয়ে না খেয়ে এস.এস. সি টা দিলাম। রেজাল্ট ভালোই হয়েছিল। স্কুলের গন্ডি পেরিয়ে ভেবেছিলাম, কলেজে ভর্তি হব। কিন্তু তার আগেই আমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হল। আমি বাবার একমাত্র মেয়েছিলাম এখন অবশ্য ওনার দুটি ছেলে আছে। ছেলেগুলা আমার সাথে কথা বলতনা। সৎ মা ওদের কাছে আমার পরিচয় দিয়েছিল কাজের মেয়ে বলে। হয়ত আমার ভাইয়েরা কখনো জানবেনা আমি তাদের বোন ছিলাম। বিয়েটা আমার, গোপনীয়তা বজায় রেখেই দেওয়া হল। বাসর রাতে স্বামি ঘরে ঢুকতেই বলেছিলাম খবরদার আমার সামনে আসবেন না।

আমাকে ছোঁবেন না সেদিনের পর থেকে ও কখনো আমার ধারে কাছে আসেনি। হয়ত সেও বুঝেছিল আমার বিয়েটা আমার মতের বিরুদ্ধেই দেওয়া হয়েছে। রুম যেহেতু একটাই ছিল। তাই দুজনে একরুমেই থাকতাম। আমার অস্বস্তি হতো তাই আমি পাশ ফিরে শুয়ে থাকতাম। কথায় কথায় একদিন তার সাথে আমার কথা হয়েছিল, খুব বেশি সময়ধরে না। শুধু ও জিজ্ঞেস করেছিল তুমি কি পড়াশুনা করতে চাও? আমি সেদিন ওপাশে মুখ ঘুরিয়ে রেখেই বলেছিলাম। হুম, এরপর আমি কলেজে ভর্তিহলাম যদিও উনি আমাকে রিক্সায় করে দিয়ে আসতেন। আমার কলেজে, যখন উনাকে আমি কোনো টাকা দিতাম না। তখন বন্ধুরা বলত টাকা দিলি না যে, আমি সেদিন দাতে দাত চেঁপে মুখটা বাঁকিয়ে বলেছিলাম আমার বাবা একবারে টাকা দিয়ে দিয়েছে। ছোটোলোক তো তাই একেবারে ১মাসের টাকা অগ্রিম নিয়ে নিয়েছে। সেদিন আমি উনার চোখে জল দেখেছিলাম। তারপরেও উনি সব অশ্রু লুকিয়ে আমায় হাসিমুখটা দেখিয়ে চলে গিয়েছিল।

আমি খুব সুখে না থাকলেও কষ্টে ছিলাম না। ও বাড়ির মতো এখানে আমায় কাজ করতে হতোনা। আমার ইচ্ছা হলে করতাম না হলে করতাম না।

একদিন আমার খুব জ্বর এলে উনি পাশের রুমের ভাবিকে ডেকে আমার কপালে জলপট্টি দিয়েছিলেন তবুও নিজে আমাকে স্পর্শ করেন নি। মাঝে মাঝে উনি আমার জন্য খাবার নিয়ে আসতেন। খাবারগুলি টেবিলে রেখে উনি জেনো কি লিখতেন। উনি হয়ত চাইতেন আমি জেনো উনাকে ডেকেনিয়ে একসাথে খাই। আমি এসব বুঝেও না বুঝার ভান করতাম।

তবুও উনি মুখফুটে কিছুই বলতেন না। এমনকি উনি নিজের কাপর নিজে কেঁচে আমার কাপড় ও ধুইয়ে দিতেন।
আমার এইচ. এস. সি পরিক্ষা শুরু হল। আমি রাত জেগে পড়তাম, আমার সাথে সাথে উনিও রাত জাগতেন মাঝে মাঝে আমার জন্য মুড়ি মাখতেন। ঝাল পেয়াজ টোমেটো কুঁচি কুঁচি করে কেটে আমার জন্য সেরা ঝাল মুড়ি মাখার চেষ্টা করতেন। কিন্তু কোনোদিন মুখফুটে জিজ্ঞেস করেন নি। কেমন হয়েছে?

আমার কাছে সেরাই মনে হতো। এতো ভালোকরে মুড়ি মাখতেন যে আমি উনার মুড়ি মাখার প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম আমি উনার মুড়ি মাখা খাওয়ার জন্য উশখুশ করতাম। উনি বুঝতেন, তখনি হাসিমুখে মুড়ি মেখে দিতেন। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরেও আমি তাকে কোনোদিন বলেনি আপ্নিও খান আমার সাথে।

একদিন সন্ধায় পড়তে বসার সময় বইয়ের ভিতর একটুকরা কাগজে কি জেনো লেখা দেখতে পেলাম। আগ্রহ নিয়ে পড়ে দেখলাম সেখানে লেখা। “আজ আমার জন্মদিন, আপনি হয়ত ভাববেন রিক্সাওয়ালার আবার জন্মদিন। সে আপনি যাই ভাবেন না কেন? বিয়েরপর এই প্রথম জন্মদিন তাই ইচ্ছা না থাকা সত্বেও ভাবলাম সেলিব্রেট করব। আমি একটা শাড়ি রেখেছি আলমারির উপরের তাকে পড়বেন কিন্তু, এই একটা অনুরোধ রাখবেন। আমি জানি আপনাকে কমলা রঙে খুব ভালোলাগবে, আপ্নারো পছন্দ হবে”

উনার অনুপুস্থিতিতে আমি আলমারির তাক থেকে শাড়ি নিয়ে পড়লাম যদিও শারিটা আমার একদম পছন্দ হয়নি। কিন্তু উনার জন্মদিন তাই পড়লাম।

এরকিছুক্ষন পরেই দেখলাম উনি বেশ কিছু খাবার আনালেন। আর আমার দিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে রইলেন আমার চোখের সাথে চোখ পড়তেই লজ্জাপেলেন তাও লজ্জা ঘেন্নার মাথা খেয়ে উনি আমার দিকেই চেয়ে রইলেন। সেদিনের পর থেকে লোকটাকে একটু একটু ভালোলাগতে শুরু করল।

এর দুদিন পর আমি একটা আননোন নাম্বার থেকে উনার ফোনে একটা ফোন কল পেলাম। উনি আমার জন্য ফোনটা বাসায় রেখে যেতেন। ফোনএর ওপাশ থেকে ঐ খবর শোনার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলামনা। মুহুর্তেই নীল আকাশ কালো মেঘে ছেয়েগেল। আমার হৃদস্পন কম্পিত হতে লাগল, যখনি আমি শুনলাম অনিক আর নেই। আমি সেদিন রাস্তার দিকে ছুটে গিয়েছিলাম। দেখলাম রাস্তার অনেক লোকের ভীরের মাঝে উনার নিথর দেহ পড়ে আছে। কি বলব? কি করব? নিজেকে কি ভাবে শান্তনা দেবো বুঝে উঠতে পারলাম না।
সেদিন খুব কেঁদেছিলাম উনাকে জড়িয়ে ধরে।
বলেছিলাম।

উঠুন আপনার সাথে যে আমার অনেক কথা আছে। কতকথা জমিয়ে রেখেছি বলব বলে। সেদিনি প্রথম উনাকে আমি স্পর্শ করেছিলাম।

উনার মৃত্যুর ৩দিনের মাথায় টেবিলে রাখা ডায়েরীটাই চোখ যেতেই এক বুক আগ্রহ নিয়ে পড়তে লাগলাম।
ডায়েরীর ১ম পাতায় লেখা ছিল।

আজ আমি একটা লাল টুকটুকি বউ বিয়ে করে এনেছি। জানি আমার বউয়ের এই বিয়েতে মত নেই। আমি মুখ দেখেই মানুষের অন্তরের কথা বুঝতে পাড়ি।

২য় পাতা
বউটা আমায় বাসর রাতেই মুখের উপর নিষেধ করে দিয়েছে
আমায় ছোবেন না।

সেদিন কষ্ট হয়নি আমি এই কথাটা শোনার জন্য প্রস্ততু ছিলাম। কিন্তু প্রতিটা পুরুষের মতো আমারো আমার বউয়ের বুকে খুব ঘুমাতে ইচ্ছে করছিল।

সেই কবে মায়ের কোলে মাথা রেখে শেষ ঘুমিয়ে ছিলাম মনে নেই।
মা ও আর নেই বাবা নতুন বউ এনে আমায় বাসা থেকে বের করে দিল।

৩য় পাতা

বউটা আমার ঘুমাচ্ছে। ও কি জানে ওকে ঘুমানো অবস্থায় স্বর্গের পরীর মতো লাগে।
খুব ছুঁয়ে দেখতে ইচ্ছে করছে।

৪র্থ পাতা
আজ খুব কষ্ট লেগেছে
ও যখন সবার সামনে আমায় ছোটলোকের বাচ্চা বলেছে। বুকফাটা কান্না লুকিয়ে হাসি খুশি থাকার অভিনয় করেছিলাম। হয়ত ও বুজেছে…
এভাবেই এক এক করে পড়তে লাগল ডায়েরীর আর সব পাতা গুলো।

ও আরো লিখেছিল আজ বউকে নিজের হাতে মুড়ি মাখিয়ে দিয়েছি আমি ভেবেছি ও আমাকে খাইয়ে দিবে কিন্তু খায়ে দেয়নি।

তবুও আমি ওর প্রেমে পড়েছি বারংবার। ওর মুখ ভেঙচির প্রেমে পড়েছি। ওর ঘুমানো মায়াময় মুখের প্রেমে পড়েছি। আমি জানি ও একদিন আমাকে বুঝবে। একদিন আমাকে খুব ভালোবাসবে। একদিন ও নিজে থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। ও কে যে বউ বলে ডাকতে খুব ইচ্ছে করে ও কি এটা জানে?

ডায়েরী পড়াশেষে অঝরে কাঁন্নায় ফেটে পড়ে স্বপ্না।
মানুষটার বুকে এতটা কষ্ট জমাছিল কখনো বুঝতেই পারিনি। কখনো মানুষটিকে জড়িয়ে ধরা হয়নি।
আল্লাহ আমাকে আর একটিবার মানুষটিকে ফিরে দাও।
তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁন্না করাটা যে আজও বাকি আছে।
তাকে নিজের হাতে খাইয়ে দেওয়াটা যে আজও বাকি।

তাকে ভালোবাসি বলাটাও যে বাকি রয়ে গেছে। আমি যে তাকে খুব ভালোবেসে ফেলেছি মানুষটি সেটা না জেনেই যে চলে গেছে

একটিবার ফিরিয়ে দাওনা খোদা?
একটিবার শুধু।
দুজনে একসাথে মুড়ি খাবো
বন্ধুদের গর্বের সাথে বলব এই রিক্সাওয়ালাটাই আমার স্বামী। ওকে আমি খুব ভালোবাসি।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত