আমার দ্বিতীয় বিয়ে

আমার দ্বিতীয় বিয়ে

আমি আবার বিয়ে করতে চাই’ আমার এ কথায় পুরো ঘরে পিনপতন নীরবতা নেমে আসে। গত পাঁচ বছরে নানা পদের মানুষ দেখে দেখে আমি এখন বেশ মানুষের চোখের কথা বুঝতে পারি। ভাইরা, তাদের বৌ, ছোটবোনের চোখের চাহনী নানারকম ছিল। কারো চোখে ভর্ৎসনা তো কারো চোখে বিয়ের কত শখ তো কারো চোখে অবিশ্বাসের দৃষ্টি। যদিও এরা কেউই আমার ভরনপোষণ করেনা।

এমনকি আমার বিপদ আপদে প্রায়শই নিজেদের কাজের দোহাই দিয়ে দূরেই থাকে। তবু একান্ত নিজের রক্ত সম্পর্কিত বিধায় জানিয়ে রাখা। দূরের লোকে বাড়ি বয়ে কিছু বলে যাওয়ার চেয়ে আমার মুখেই জানা থাক। অথচ মজার ব্যাপার মাস দুয়েক আগে আমার এক খালাতো ভাইয়ের হুট করে বৌ মারা যাওয়ার মাস না ঘুরতেই ছেলে কিভাবে একা পালবে ছোট বাচ্চাকে সেই অজুহাতে এরাই সবাই মিলে বিয়ে দেয় তাকে। আমি মেয়ে বলেই বুঝি এতোগুলো বিস্মিত চোখের মুখোমুখি হতে হলো?

আমি নিলুফা। পড়াশোনায় খুব ভালো না হলেও আমার আগ্রহের ও একনিষ্ঠতার জোরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয়ে নতুন নতুন অনেক বন্ধু বান্ধবী হয়। ঢাকায় বাসা হবার সুবাদে কেউ কেউ না জানিয়ে হুটহাট বাসায় চলে আসতো। মা কিছু মনে না করলেও আমার অতি রক্ষনশীল বাবা ভয় পেলেন মেয়ে বুঝি উচ্ছন্নে গেলো এইবেলা। ছোট ভাই বোন গুলো আমার দেখাদেখি গোল্লায় যাবে ভেবে পাঁচ ভাই বোনের বড় আমার অমতে তাই মোটামুটি জোর করেই অনার্স দ্বিতীয় বর্ষে বিয়ে দেয়া হলো।

ছেলে দেখতে ভালো, আয় রোজগার ভালো, পরিবার ভালো হলেও যে জিনিসটা দেখা হয়না তা হলো ছেলে আর তার পরিবারের মানসিকতাটুকু। তাদের কাছে বিয়ে করা বৌ মানে দেনমোহর দিয়ে দাসী কিনে আনার মতো একটা ব্যাপার ছিল বুঝি। ঘরের সব কাজ সামলে তবেই পড়াশোনার সুযোগটুকু মিলতো। হাল ছাড়িনি তবু। ফাইনাল পরীক্ষার কারণে একদিন বাসায় রান্নার এক পদ কম হওয়াতে সে সবার সামনেই আমার সব বই ছুঁড়ে ফেলে দিল বাড়ির বাইরে। সাথে জোটে কিছু শারিরীক শাস্তি। তার পরিবারের অন্য কেউ টু শব্দটি করেনি যেন এটাই খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। আমার সেদিন খুব অভিমান হয়েছিল আমার বাবার ওপর। আমি কি তার কাঁধে এতোটাই ভারী বোঝা হয়ে গেছিলাম যে এমন একটা লোকের কাঁধে আমাকে ঝুলিয়ে দিতে হলো?

ভেবেছিলাম সেদিনই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো। কিন্তু মা বোঝালো এভাবেই নাকি মেয়েলোকের সংসার করতে হয়। তার ওপর জানতে পেরেছি আমি সন্তানসম্ভবা। আমার নিজের পড়াও শেষ হয়নি যে বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোন কাজ করে খাবো। তারপর থেকে দিনে দিনে শুধু কাজের আর সংসারের চাপই বেড়েছে সাথে বেড়েছে অত্যাচার। যার স্বামী পাত্তা দেয়না তার ওপর বুঝি সবাই অধিকার ফলাতে পারে। আমি সত্যি এখনো জানিনা কি তার কারণ? তবে লোকমুখে শোনা যারা বৌ পেটায় এটা নাকি তাদের নিজেদের রাগ বা হতাশা কমাবার একটা কৌশল যা এক ধরনের মানসিক রোগ।

আমার ছেলেটা হওয়ার পর কিছুদিন একটু ভালো ব্যবহার পেয়েছি। ভেবেছি বুঝি সব ঠিক হয়ে গেছে। তারপর একদিন যখন ভয়ে ভয়ে মাস্টার্সে ভর্তি হতে চাই বললাম, জীবনের সেরা মারটুকু বোধহয় সেদিন জুটেছিল কপালে। সারারাত ব্যথায় ঘুমাতে পারিনি। ভোরের আলো ফুটে ওঠার আগেই এক কাপড়ে ছেলেকে নিয়ে বেরিয়ে আসি। বাবা ব্যাপারটা সেভাবে মেনে না নিলেও আমার সারা গায়ের মারের ক্ষতটুকু দেখে আর ও বাড়িতে যেতে দেননি। ডিভোর্স হয়ে যায় আমার। ও বাড়ি থেকেও কেউ ছেলে বা আমাকে ফিরে পেতে জোর করেনি। বোধহয় বুঝতে পেরেছিল পাছে কেউ নারী নির্যাতনের কেইস করে দেয়। ছেলের যে খানিক মানসিক সমস্যা আছে তা বাড়ির সবাই জানলেও স্বাভাবিকভাবেই চেপে গেছে বিয়ের আগে।

প্রথম প্রথম বাবার বাড়ির সবাই সহানুভূতি দেখালেও দিনে দিনে আমি অনেকটা তাদের বোঝার মতো হয়ে যাই। ঘরের সব কাজ মায়ের পাশাপাশি আমার ওপরে এসে পড়ে। অন্তত দিন শেষে কেউ মার দিচ্ছেনা এটাই শুধু যা স্বস্তি। মায়ের সাহসে মাস্টার্সে ভর্তি হই পাশাপাশি কাজ নেই একটা এনজিওতে। কত দূরে দূরে ফিল্ড ওয়ার্কে পাঠাতো একেকদিন। দিন শেষে মনে হতো আজকেই বুঝি চাকুরী ছেড়ে দিতে হবে। বাড়ি ফিরে রোজ ছেলের নামে সবার কাছ থেকে অভিযোগ, ঘরের সবার জমিয়ে রাখা কাজ আর নিজের পড়াশোনার স্বপ্ন সব মিলে আমি যেন আরো হতাশার গভীরে চলে যাচ্ছিলাম দিনদিন। হন্যে হয়ে চাকুরীর আবেদন করছিলাম সবখানে। জুটেও যায় আগের চেয়েও একটা ভালো চাকুরী। কিন্তু বসের কুদৃষ্টি থেকে বাঁচতে মাস না ঘুরতেই সেটা ছেড়ে আসতে বাধ্য হই।

এরমধ্যেই বাবা মারা যায়। বড় দুইভাই বিয়ে করে। জায়গা সংকুলান না হওয়ার সমস্ত চাপ এসে পড়ে আমার ঘাড়ে। আমি আর আমার ছেলে শুধু শুধু একটা রুম দখল করে রেখেছি। মায়ের ভরনপোষণের ভার যেহেতু ভাইদের তাই মা ও জোর গলায় কিছু বলতে পারেনা। আমি পরে যাই অকূল পাথারে। সৃষ্টিকর্তা বোধহয় এক জীবন শুধু কষ্টই লিখে রাখেন না। আর তাই একটা প্রাইভেট ব্যাংকে চাকুরী জুটে যায়। ছেলেকে রাখা সমস্যা দেখে মায়ের কাছাকাছি বাসা ভাড়া নিয়ে সরে আসি। বাসার সবাই যেন আমার এ সিদ্ধান্তে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে। রোজদিনকার সংসারের অসন্তোষের চাপা উত্তাপ যে সবার গায়েই লাগছিল।

মা নিজে থেকে একটা বিশ্বস্ত কাজের লোক যোগাড় করে দেয়। নতুন বাসায় এসে প্রথম কয়েক সপ্তাহ মা ছেলে দুজনেই বেশ আনন্দে থাকলেও এই প্রথম অন্যরকম বিপত্তি টের পেতে শুরু করি। ভাইদের সাথে থাকতে যেটা টের পাইনি। এতোদিন হয়তো অফিসে ছেলে কলিগদের কারো না কারো বাজে নজরে খানিক হয়তো পরেছি। কিন্তু এখন বাড়িওয়ালা, পাশের বাসার প্রতিবেশী, মোড়ের দোকানের দোকানদার সবাই যেন আমার একলা থাকার সুযোগ নেয়ার চেষ্টা করে। যেন আমি একলা তাই আমার দেখভালের সব দায়িত্ব তাদের। পাশের ফ্লাটের প্রতিবেশী ভদ্রলোকের ভয়ে তো লিফটে ওঠাই বন্ধ করে দিয়েছি। অথচ ওনার স্ত্রী দেখা হলে আমার দিকে এমনভাবে তাকান যেন আমি ওনার স্বামীকে কুনজর দিচ্ছি। ভাবটা এমন একাকী মহিলারা শুধু অন্যের সংসারে নজর লাগায়।

এরকমই কিছু টানাপোড়েনের সময়ে একই অফিসে কাজ করা পলাশ একরাশ বসন্ত বাতাসের মতো হুট করে আমার জীবনে ঢুকে পরে। হয়তো দুজনের কষ্টগুলো একই ধারার দেখে, অথবা দুজনে একই পথের পথিক বলে। পলাশ তার বৌ কে হারিয়েছে বিয়ের বছর তিনেকের মাথায়। সেই থেকে তাদের বাবা ছেলের সংসার। বন্ধুর মতো পলাশ পাশে পাশে থেকে আমার জীবনটাকে শুধু সহজই করেনি জীবনের কষ্টগুলো দূরে ঠেলেও নিজের জন্য বাঁচতে হয় সেই সাহসটুকু যুগিয়ে গেছে। বাচ্চারা একে অপরের সাথে চমৎকার মানিয়ে নেয়াতে আর নিজেদের চিন্তা ভাবনা গুলোর মেলবন্ধন হয়েছে দেখেই বিয়ের সিদ্ধান্তে আসি দুজনে।

আমাকে জয় করার মতো পলাশ একে একে আমার বাড়ির লোকেদেরও জয় করে নেয় দিনে দিনে। আমার পাঁচ বছরের তিন ছেলেমেয়ের ভরভরন্ত সংসারে আমার পরিবারের মানুষজন এখন আসে দুদন্ড শান্তি কুড়িয়ে নিতে। অথচ এরাই কি না ছিল আমার দ্বিতীয় বিয়ের প্রধান অন্তরায়।

জীবনের এ প্রান্তে এসে আজ বুঝি জীবন আদতে কাউকে কিছু দেয়না। জীবনের থেকে নিজের প্রাপ্যগুলো যোগ্যতা দিয়েই ছিনিয়ে নিতে হয়। বেঁচে থাকার প্রয়োজনে নিজের জীবনের সিদ্ধান্তগুলো মাঝে মাঝে নিজেই নিতে জানতে হয়।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত