নিঃস্বার্থ ভালোবাসা

নিঃস্বার্থ ভালোবাসা

মৃন্ময়ী তার নাম, যাকে ঘিরে অামার ভাবনাগুলো বড় বেহায়ার মত অাঁকিবুঁকি করে মনের ক্যানভাসে। অাজ কত বছর পর তাকে দু’চোখ ভরে দেখছি! কিছুদিন অাগে অাঘাতটা বেশ লেগেছিল মাথায়। প্রচন্ড মাথা ব্যথায় জীবনের অবশিষ্ট সময়ের হিসেব শেষ হতে চলেছে অামার। অবশিষ্ট সময়ের অবশিষ্ট সংলাপ যেন অাজ বড় অসময়ে ধরা দিয়েছে ভালোবাসার মানুষটার সামনে। অামার সামনেই মৃন্ময়ী, অথচ, তার সাথে কথা বলা অামার অার হলো না। ঘুমন্ত মৃন্ময়ীর মায়াময় চেহারায় শুধু অামার দু’চোখে দর্শনসিক্ত প্রাপ্তি, কথোপকথন যেন অনুচিত প্রত্যাশার বালুচরে ঢাকা।

ডাক্তার জাফর সাহেব এসে অামার হাতে হাত রেখে বললেন, ” সাদমান, তোমার ভাইকে খবর দেয়া হয়েছে। মৃন্ময়ীর বাবা মাকে সব খুলে বলেছি। তোমার অার কিছু বলার থাকলে বলতে পারো। তোমার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে, সাদমান।”

অামার কন্ঠস্বর ধরে অাসছে, বুকের সেলাইয়ে কি যেন টান পড়ছে। তার চেয়ে বেশি টান পড়ছে মনের সূতায়। ভীষণ কষ্ট। নিভু নিভু চাহনিতে ডাক্তার জাফরকে বলি, ” একটা চিঠি লিখতে চাই, মৃন্ময়ীর জন্য। প্লিজ, না বলবেন না। কিছু না বলা কথা কলমের কালিতে লিখে জানিয়ে যেতে চাই মৃন্ময়ীকে। ”

হ্যা, ডাক্তার জাফর সাহেব অামার বলে যাওয়া কিছু কথা লিখলেন একটা সাদা কাগজে। অার অন্যদিকে, নার্সরা অপরেশনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। সাদা কাগজটা যখন ভাঁজ করে এক পাশে রাখা হলো, কিছু মূহুর্তের জন্য তখন মনে হলো, শেষ চিঠি কেন শেষ থেকে শুরু হওয়া নতুন কিছু নয়? ঘন্টা খানিক অপারেশনের পর সাদমানের নিথর দেহ নিয়ে যাওয়া হয় মর্গে, পোস্ট মর্টেমের পর সেখান থেকে রাখা হয় ফ্রিজে।

অপরেশনের দু’দিন পর, ডাক্তার জাফর মৃন্ময়ীর হাতে সাদমানের চিঠিটা দিয়ে বললেন, ” ইনিই অাপনাকে কিডনী দান করেছেন। মুমূর্ষুাবস্থায় তিনি অনুরোধ করেছিলেন অাপনাকে যেন অপারেশনের দু’দিন পর তার কথা বলি, তাকে একবারের জন্য অাপনার সামনে নিয়ে অাসি।” মৃন্ময়ী বিস্ময়ে চিঠিটা হাতে নিয়ে বলে, ” কার চিঠি? কাকে অামার সামনে অানবেন?”

ডাক্তার জাফরঃ ” চিঠি পড়লেই জানবেন। অাপনার জন্য তার লাশ দু’দিন ধরে রেফ্রিজারেটরে রাখা ছিল। তার অনুরোধেই এই ব্যবস্থা। ”

মৃন্ময়ী চিঠিটা হাতে নিয়ে পড়তে শুরু করলো, মৃন্ময়ী, চিঠিটা যখন তুমি পড়ছো, তখন অামি নেই এই পৃথিবীতে। নিষ্ঠুর বাস্তবতার কাছে হার মানতে হয়েছে অামায়। হয়তো ভেবে অবাক হচ্ছো, এ অাবার কে? চলো ঘুরে অাসা যাক পিছনের ফেলে অাসা অতীত থেকে। অনার্সে ভর্তির পর থেকে যার সাথে টুনকো বিষয় নিয়ে বোঝাপড়ার ভুলের কারণে তোমার ঝগড়া লাগতো, যার কাছে এসে সব কিছুর সমাধানের হদিস খুঁজতে, যার কাছে তোমার সকল অনুরোধ, অাবদার হয়ে টেকতো, অামি সেই সাদমান।

তোমার প্রিয় সাদমান। মনে পড়ে? হয়তো মনে নেই। মনে থাকার কথা নয়। অাজ দীর্ঘ বারো বছর গত হয়েছে অামাদের সোনালী অতীত, অামাদের ছাত্রজীবন। প্রথমদিনের পরিচয়ের পর থেকে এক ধরণের ভালোলাগা কাজ করতো তোমাকে ঘিরে। ভালোলাগা কখন যে ভালোবাসায় পরিণত হলো, তা খেয়ালই করিনি। কলেজে তোমার একদিনের অনুপস্থিতি অামাকে ভীষণ রকম অস্থির করে তুলতো — “এই বুঝি, কি যেন হারিয়ে ফেললাম।” তুমি বুঝতে কি না জানি না। তোমার চলন, বলনে অামি বরাবরই তোমাতে মোহগ্রস্ত হয়ে থাকতাম। অামাদের খুঁনসুটির কাহিনী ছিলো পুরো কলেজ জুড়ে। সবাই এক প্রকার ভেবেই নিয়েছিলো অামাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক অাছে। কিন্তু, তোমার জোরালো প্রতিবাদে সবার মুখ বন্ধ হয়ে যেতো। তুমি সবাইকে বলতে, ” উই অার যাস্ট ফ্রেন্ড।

অামার ভালোলাগার কথা তোমাকে বলতে গিয়ে বহুবার পিছু হটেছি, বলবো বলবো করে বলা হয়ে উঠেনি সেই কথা। কেন যেন মন সায় দিতো না। অার যখন সাহস করে দুঃসাহসের কাজটা করে বসলাম, তখন তুমি ভেবেই নিয়েছিলে অামি তা মজা করে বলেছি, তুমি হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলে। বেশ দৃঢ়তার সাথে তুমি বলতে সবাইকে, ” অাগে পড়ালেখা শেষ করে প্রতিষ্ঠিত হতে চাই। তারপর অন্যকিছু”। তোমার বলে যাওয়া এই কথায় নিজেকে এই বলে সান্ত্বনা দিয়ে রাখতাম যে, তুমি প্রতিষ্ঠিত হতে হতে অামি অামার অবস্থানও শক্তপোক্ত করে নিতে পারবো। তারপর একদিন হুট করে তোমার দোর গোড়ায় তোমার বাবা মায়ের সামনে তোমার জন্য মিনতি করবো। তোমাকে নিয়ে এই বিশ্বাস ছিলো যে অামার, তোমার জীবনে “তুমি ” নামক কোন তুমিকে তুমি অাসতে দেবেনা, অন্তত ছাত্রজীবনে না।

কত সহজ সরল চিন্তা ভাবনা ছিলো অামার তাই না? কিন্তু, অামার ভাবনার বাসরীরা মরা নদীর স্রোতে তখনি বহমিত হয় যখন জেনেছি, তোমাকে নিয়ে অামার ভাবনাটাই ছিলো ভুল। কেননা, দেরিতে হলেও পরে জেনেছি, ভালোবাসা বলে কয়ে অাসে না, মনের অজান্তে হয়ে যায়। যেমন অামার হয়েছে তোমার প্রতি, তোমার হয়েছে ধনীর দুলাল ” সুমন ” এর প্রতি। বেশ পরখ করে দেখতাম, অার পড়তাম বন্ধুর মজলিস থেকে তোমার হঠাৎ হারিয়ে যাবার গল্প। যত দেখতাম, তত পুড়তো, অামার এই বুকের ভিতরটা। অনেক কেঁদেছি, অনেক। খুব অাড়ালে অাবডালে অাছড়ে পড়তো অামার হৃদয় ভাঙ্গার টেউ। কেউ জানতো না, কাউকে বুঝতে দেইনি। হঠাৎ যখন শুনি, তোমার বাবা তোমাকে অন্য ছেলের ঘরণী করতে চলেছেন, তুমি হন্যে হয়ে ছুটে এসেছো অামার কাছে সমাধানের খোঁজে। তোমার কান্নাজড়িত ভাষাই বলে দিচ্ছিল, সুমন তোমাকে কতটা ভালোবাসার বেড়াজালে জড়িয়েছে।

সেদিন নিজেকে সামলিয়ে নিয়ে তোমাকে সুমনের কাছে দিয়ে অাসি। বুক ফেটে যাচ্ছিল, বোবা কান্নার জোয়ারে, তুমি শোননি, তোমাকে শুনতে দেয়নি। তবে অামি সেদিন অামি জেনে গেছি, তুমি তোমার ভালোবাসাকে সত্যিকারভাবে খোঁজে পেয়েছো। তোমার এই সুখের মাঝে অামি বাঁধা হয়ে দাড়াইনি, অাবার, সব সহ্য করতে কষ্ট হচ্ছিল। তাই, চট্টগ্রাম চলে অাসি। এখানেই মাস্টার্স কমপ্লিট করি। সাথে সাথে চাকরিও পেয়ে যায়। বেশ চলছিল জীবন। তবে, কাউকে অার এই মনের গহীনে টানতে পারিনি, যেখানে তোমার জায়গাটা বেশ মজবুত বুনিয়াদে অাছে। সেজন্যই হয়তো বিয়ে নামক অধ্যায়টা অার পড়া হয়ে উঠে নি। ফেসবুকের দুনিয়ায় কোন কিছু গোপন থাকে না। অনেক পরে জেনেছি, সুমন তোমার সাথে প্রতারণা করেছে। ভালোবাসার ফাদ পেতে তোমাকে নিয়ে খেলা করেছে। অার এখন তুমি অন্য কারো তুমি, যাকে তোমার বাবা পছন্দ করে তোমার সাথে বিয়ে দিয়েছেন। তোমাকে অার অামার করা হলো না।

অাজ কত বছর পর….কত বছর পর তোমার সাথে অামার দেখা। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস! কিছুদিন অাগে রোড এক্সিডেন্টে মাথায় অার বুকে প্রচন্ড অাঘাত পায়। ধীরে ধীরে বুঝতে পেরেছি অামার সময় খুব কম। হঠাৎ দেখলাম তোমার বাবাকে হাসপাতালের করিডোরে। ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে পারি, তোমার দু’টো কিডনীই নষ্ট হয়ে গেছে। তোমার বাবা তোমাকে বাঁচার জন্য যারপর নাই চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তাৎক্ষণিক ডাক্তারকে জানিয়ে দিলাম, তোমায় কিডনী অামি দিবো। জানো? অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, ব্লাড টেস্টে তোমার সাথে অামার সব মিলে গেছে। নিজের জীবন প্রদীপ ক্ষণস্থায়ী জেনেও বেশ খুশি লাগছে এই জেনে যে, অামি তোমার মাঝে দীর্ঘস্থায়ীর খুঁটি গেড়েছি। তোমার ভালোবাসার ক্যানভাসে অনেক রঙ্গীন প্রজাপতির মাঝে নিজেকে সামিল করেছি। তোমার অস্তিত্বে অামি মিশে গেছি। অামি তোমাকে বিষাদের কালো ছায়ায় হারিয়ে যেতে দেবো না। তাই, তোমার হাসিমুখ রাঙ্গাতে চেয়েছি।

তোমার চোখের সামনে তুমি না থাকলেও এই হৃদয় জুড়ে তুমি ছিলে, তুমি অাছো, তুমি থাকবে। জানো মৃন্ময়ী? কোন এক কবি বলেছিলেন, “তোমাকে খুঁজতে গিয়ে জেনেছি, প্রত্যেক মানুষ নির্দিষ্ট একটা প্লাটফর্মে নির্দিষ্ট কোন মেইল ট্রেনের অাশায় কারো জন্য দাড়িয়ে থাকে। অনেকের সেই ট্রেন অাসা অার হয়ে উঠে না, অনেকে শূণ্য প্লাটফর্মে দাড়িয়ে থাকতে থাকতে মলিন মুখে ফিরে যায়। ” অাচ্ছা, বলতো তুমি কি সেই কাঙ্গিত কাউকে তোমার প্লাটফর্মে খুঁজে পেয়েছো? ভীষণ কষ্ট হচ্ছে মৃন্ময়ী। অাধোঃ অাধোঃ কন্ঠে বলা কথা জানি না ডাক্তার জাফর কিভাবে বুঝে লিখতে পেরেছেন? তবু বুঝে নিও, তোমায় ভালোবাসতো এমন একজন, যে নিঃস্বার্থভাবে তোমার সুখ চেয়েছে। ভালো থেকো, ভালো রেখো ভালোবাসার জগতে।

সাদমান মৃন্ময়ী চিঠি পড়ে কাঁদতে থাকে। বড় অসময়ে ধরা দেয়া একটা ট্রেনের কাঙ্গিত মানুষের গল্প বড় অসহায়ভাবে মৃন্ময়ীর মনের মণি কৌটায় মৃন্ময়ীকে অধিকৃত করেছে। কিছুক্ষণ পর সাদমানকে অানা হয় তার কেবিনে। মৃন্ময়ী তার নিথর দেহ দেখে চিৎকার করে বলে উঠে, ” সাদমান, অামায় তুমি ক্ষমা করে দিও। তোমায় অামি চিনতে পারিনি।”

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত