অনুভব

অনুভব

প্রাইম হসপিটালে ভর্তি হওয়া এক ধর্ষিতার সাক্ষাতকার নেওয়ার জন্যই আসা। যদিও এ রকম সাক্ষাতকার প্রায় নিতে হতো। কিন্তু আজ যে মেয়েটার সাথে আমার কথা হলো আমি মোটেও এই সময়টার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। মেয়েটার পাশে গিয়ে দাঁড়াতেই থমকে গেলাম।কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে বুঝতে চেষ্টা করলাম আসলেই কি সেই মেয়েটা ? কিছুক্ষণ পর মেয়েটা হঠাৎ বলে উঠলো,

–জানতে এসেছেন , কি করে এসব হলো ?

মেয়েটার মুখ থেকে এমন কথা শুনে আমি অনেকটা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। কারণ আমি এখন পর্যন্ত মেয়েটাকে কোনো প্রশ্নই করিনি।

–জ্বী, আচ্ছা বলুন তো, কি করে হলো এসব ?আর নাম কি আপনার? আমি বিস্ময়জনিত ভাব কাটানোর চেষ্টা করলাম আর প্রশ্ন করা শুরু করলাম।

–ভাগ্যে বিশ্বাস করেন ? চোখ থেকে গড়িয়ে পড়া দু’ফোটা পানি মুছে মেয়েটা আমাকে উল্টো প্রশ্ন করলো।

–প্রতিটি মানুষ ই ভাগ্যে বিশ্বাসী।সেক্ষেত্রে আমার বেলায় তো আর ভিন্ন কিছু হবে না।আমি অবশ্যই ভাগ্যে বিশ্বাস করি।কিন্তু আপনি আমাকে প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন না করে, বরং আমার করা প্রশ্নগুলোর উত্তর দিন।
–বাহ্ । একটু প্রশ্ন করতেই এই রকম অবস্থা !

যাই হোক, কি জানতে চান বলুন ? মেয়েটার কথা শুনে কপালের চামড়া কুচকে গেলো।সাংবাদিকদের কৌশলে নিজের কাজটা অবশ্যই আদায় করে নিতে হয়। তাই ধৈর্য্য রেখে প্রশ্নটা আবার করলাম।

–আপনার এমন অবস্থা কি করে হলো সেটাই জানতে চাচ্ছি।
–আমি কাকন।

জানেন, জীবনে তিনটা সময়, তিনজন আপন মানুষ, আমায় খুব ঠকিয়েছে।প্রথমত হলেন আমার বাবা।দ্বিতীয়ত আমার মা।আর তৃতীয়জন কথার মাঝে মেয়েটা থেমে গেলো।উনার কন্ঠস্বর ভারী হয়ে আসলো।অঝোরে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।পাশে রাখা বাক্সবন্দী টিস্যুর থেকে এক টুকরো টিস্যু নিয়ে চোখের পানি মুছলো।তারপর বলতে লাগলো,

–এই যে বাক্সবন্দী টিস্যুগুলো দেখলেন, এগুলো কিন্তু বাক্সে খুব সুন্দর ভাবেই গুঁছিয়ে রাখা আছে, কিন্তু এগুলো কি নিরাপদ ?
–হঠাৎ টিস্যুর নিরাপত্তা নিয়ে পড়লেন যে ?
–উদাহরণ দিলাম।আমার জীবনটাও এই বাক্সবন্দী টিস্যুগুলোর মতই।
–আচ্ছা, আপনাকে কিভাবে উনারা ঠকিয়েছেন বলুন তো ?
–শুনেছি জন্মের আগেই নাকি বাবা সন্তানের স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করেছেন। আর মা আমাকে জন্ম দিয়ে নিজে মুক্তি নিয়েছেন পৃথিবী থেকে।কেমন নিষ্ঠুর আমার মা ! তাইনা ? চলেই যখন গেলেন তখন সাথে করে আমায় নিয়ে গেলেও পারতেন।

–আপনার বাবার সাথে আর দেখা হয়নি ?
–প্রয়োজন মনে করিনি।যদি মা বেঁচে থাকতেন তাহলে হয়তো বাবার খোঁজ করার প্রয়োজন মনে করতাম।
–আর তৃতীয়জন কে ? সেটা তো বললেন না !
–তৃতীয়জন হলো রুপম।

খুব বেশি ভালবাসতাম ওকে । মা বাবা’কে হারানোর পর ভাগ্যক্রমে এক নামী পরিবার আমাকে নিয়ে এসে লালন পালন করতে লাগলেন।বেশ স্বাচ্ছন্দ্যে আমার দিন কাটতে লাগলো। স্কুল,কলেজ,ভার্সিটি শেষ করলাম।আর তখন রুপমের সাথে সম্পর্ক এগিয়ে যেতে থাকলো।রুপমের ব্যাপারটা আমাকে যারা লালন পালন করেছেন সেই মা বাবাকে বললাম।কিন্তু উনারা মেনে নিলেন না। তাই রুপমের হাত ধরে বাড়ি থেকে বের হওয়ার প্ল্যান করলাম।রুপমও আমাকে সমর্থন করলো। কিন্তু আমি কি জানতাম, যে রুপম আমাকে ঠকাবে ? ও আর আসবেনা ! সেদিন অনেক রাত পর্যন্তু আমি ওর জন্য অপেক্ষা করেছিলাম,কিন্তু ও আসে নি।আর তখন কয়েকজন কাপুরুষ সেই সুযোগটা নিলো। রুপম আমায় ঠকিয়েছে।আমার জীবনটা ও নষ্ট করে দিয়েছে।

–আপনি কি জানেন , রুপম এখন কোথায় ?
–না, আমি জানিনা।আর জানার প্রয়োজনও মনে করিনা। বাক্যগুলো যে ভীষণ ঘৃণায় আর অভিমান মিশ্রিত ছিলো সেটা মেয়েটার চেহারায় প্রতিয়মান।
–জানেন তো,আমাদের জানার বা বোঝার মাঝেও কিন্তু অনেক ভুল আছে।

আপনি হয়তো শুনলে অবাক হবেন যে, আমি রুপমের বড় ভাই। আর রুপম সেদিন ঠিকই আপনার কাছে ছুটে যেত যদি সে বেঁচে থাকতো !

–মানে ?
–রুপম সেদিন হঠাৎ করেই মারা যায়।

তখন পর্যন্ত আমি বা আমরা কেউই জানতাম না যে রুপমের আপনার সাথে কোনো সম্পর্ক ছিলো।রুপম মারা যাওয়ার সপ্তাহখানেক পর ওর পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে আমি একটা ছবি খুঁজে পাই।আর সেই ছবিটি ছিলো আপনার। আমি এখানে আসার পর আপনাকে দেখে অনেকটা অবাক হয়ে যাই। রুপমের পড়ার টেবিলের ড্রয়ারে রাখা সেই মেয়েটির সাথে আপনার চেহারার অনেকটা মিল খুঁজে পাই।কিন্তু আমি তখন পর্যন্ত নিশ্চিত ছিলাম না যে, আপনি কি রুপমের ভালবাসার মানুষ ?

–তার মানে রুপমও আমায় ছেড়ে চলে গেলো ?

অশ্রুভেজা কন্ঠে মেয়েটা বলে উঠলো। আমি এক পা দু’পা করে মেয়েটার কাছ থেকে অনেকটা দূরে চলে গেলাম। ভাবতে লাগলাম, সত্যিকারের ভালবাসাগুলোর পরিণতি এভাবেই কেন হয় ? সেদিনের পর থেকে আর কাকনের সাথে দেখা হয়নি। দেখতে দেখতে প্রায় ৩টা বছর কেটে গেলো। পরিবার থেকে রুপমের চলে যাওয়ার শোক কাটানোর জন্যই আমাকে বিয়ে করানোর কথা মা বললেন।যদিও আপন মানুষগুলো এভাবে চলে যাওয়াটা মেনে নেওয়া যায়না বা ভুলা যায় না। পরিবারের সুখের জন্যই আমি বিয়ের জন্য রাজি হয়ে গেলাম।আর মা-বাবা পাত্রী দেখা শুরু করলেন। আসলে ভাগ্য জিনিসটা এমনই। আবার ঘুরেফিরে কাকনের সাথেই আমার দেখা হয়ে গেলো।পরিবারের সামনে কাকন আমাকে কিছু বলতে পারছিলোনা তাই আলাদা করে ডেকে নিয়ে বললো,

–দয়া দেখাতে এসেছেন ? নাকি করুণা ?
–বিয়ে করতে এসেছি । করবেন না আমাকে বিয়ে ?
–হাসালেন । ধর্ষিতার আবার কিসের বিয়ে ? যান, আপনার বাবা মা’কে নিয়ে এখান থেকে চলে যান।
–কাকন ,সুন্দর ভাবে বাঁচার উৎস খুঁজে দেখুন । মাথা নিচু করে বাঁচবেন কেন ? মাথা উঁচু করেই বাঁচুন।মানুষের অনুপ্রেরণা হয়ে বাঁচুন। ভালবেসেই জীবনটাকে সাজিয়ে নিন।আর আপনার জীবনটাকে সুন্দর করে সাজিয়ে দেওয়ার দায়িত্বটা পালন করার, যোগ্যতা কি আমার নেই ?

–ভালবাসতে পারবেন আমাকে ?
–সন্দেহ আছে ?
–অনেকটা ।
–চলুন না,একই গন্তব্যে হাঁটি।সময় বলে দিবে কতটুকু ভালবাসি আপনাকে !
–ঠকাবেন না তো ?
–নাহ্। ভাগ্যে বিশ্বাসী তো।
–আমিও ।

ভাগ্যে বিশ্বাসী ।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত