পাগলীটা

পাগলীটা

—-না নীলিমা, এইটা কখনো সম্ভব নয়।(আমি)
: কেনো সম্ভব নয়? (নীলিমা)
: আমি মামা-মামির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারব না।
: দেখ সুমন ভাইয়া, আব্বু-আম্মু এতে কি মনে করবেন, এসব আমি জানি না, জানতে চাইও না। আমি শুধু জানতে চাই তুমি আমাকে ভালোবাসো কি না?
: তুই কেনো বুঝতে পারছিস না, বেচে থাকার জন্য শুধু ভালোবাসাই যথেষ্ট নয়, জীবনে ভালোবাসা ছাড়াও আরো অনেক কিছুর প্রয়োজন আছে।আর তুই ভুলে যাচ্ছিস কেনো, তর ফ্যামিলি আর আমারফ্যামিলির মধ্যে অনেক বেশিই পার্থক্য। আমি তকে কোনোভাবেই সুখি রাখতে পারব না, আর মামা-মামি কখনোই তকে আমার হাতে তুলে দেবেন না।

: আমি এত কিছু শুনতে চাই না। তুমি শুধু বল আমাকে ভালোবাসো কি না। (একটু রাগের সাথেই বলল নীলিমা) নীলিমার এই প্রশ্নের উত্তরে আমি কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। তাই চুপ করে আছি।
: কি হল, কিছু বলছ না যে?
: না নীলিমা, আমি তকে ভালোবাসি না।

পাগলীটা আর কিছু বলে নি, কেঁদে কেঁদে রুম থেকে বের হয়ে গেছে। ওকে কি করে যে বলি, আমিও ওকে ঠিক ততটাই ভালোবাসি যতটা ও আমাকে ভালোবাসে।কিন্তু কি আর করার আছে? কোথায় ও আর কোথায় আমি। কোনোদিনই ওর আব্বু আমার হাতে উনার মেয়েকে তুলে দেবেন না, কোনোদিনই না। আমি সুমন, আর ঐ পাগলীটা অর্থাৎ নীলিমা হল আমার মামত বোন। নীলিমা আমার মামাত বোন হলেও ওর ফ্যামিলি আর আমার ফ্যামিলির মধ্যে অনেক পার্থক্য। আমার বাড়ি রাজশাহীতে। মা,বাবা আর ছোট একটা বোনকে নিয়েই আমার পরিবার। বাবা সামান্য একজন প্রাইমারী স্কুল শিক্ষক। অপরদিকে নীলিমার বাবা অনেক বড় একজন ব্যবসায়ী। আমার বাবার এক মাসের বেতন, নীলিমার এক সপ্তাহের হাত খরচ থেকেও কম। যাই হোক, আজ থেকে চার বছর আগে আমি ঢাকায় আসি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে চান্স পাওয়ার সুবাদে ঢাকায় আসা।

ঢাকায় ঐ মামার বাসা ছাড়া আমাদের আর তেমন কোনো আত্নীয় ছিল না। তাই আম্মুমামাকে বলে তাদের বাসায় আমারথাকার ব্যবস্থা করে দেন। শর্ত ছিল আমার পড়ার ফাঁকে ফাঁকে নীলিমাকেও পড়াতেহবে। নীলিমা তখন সবে মাত্র কলেজে উঠছে। এতে আমার কোনো আপত্তি  ছিল না, যখন আমি পড়তে বসতাম তখন তাকে সাথে নিয়ে বসতাম। তাছাড়া বিকালে একটা টিউশনি করতাম , এতে হাত খরচের টাকাটা ও ম্যানেজ হয়ে যেত। এবার নীলিমার কথায় আসা যাক। নীলিমাহল মা-বাবার একমাত্র আদরের মেয়ে। সোনার চামচ মুখে নিয়ে যার জন্ম। একমাত্র সন্তান হওয়ায় তার আব্বু-আম্মু ও কখনো তাকে কোনো কিছুর অভাব বুঝতে দেন নি। যার কারনে বাস্তবতাটা তার একটু কম বুঝারই কথা। মেয়েটা দেখতে যেমন সুন্দর তেমন চঞ্চল ও বটে, আর অসম্ভব রকমের দুষ্টু।

আমার কাছে যতক্ষণ থাকত(পড়ানোর সময়) ততক্ষণ ত শুধু দুষ্টুমিই করত। মূলত, ও পড়ার ফাকা দুষ্টুমি নয়, বরং দুষ্টুমির ফাঁকে ফাঁকে পড়ত। আর আমি যে কখন ওর ছোট ছোট দুষ্টুমিগুলোর প্রেমে পড়ে গেলাম, নিজেই বুঝতে পারি নি। কিন্তু আজ পর্যন্ত ওকে বলি নি, বলা উচিৎ ও নয়। কারন আমি গরীব ঘরের ছেলে আর গরীব ঘরের ছেলেদের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেক কিছুই করতে নেই। তবে নীলিমাও যে আমাকে ভালোবাসে তা সে যখন আজ আমাকে বলল এর আগ মুহুর্ত পর্যন্ত ও আমি বুঝতে পারি নি। আর এখন যেহেতু জেনে গেছি, সেহেতু আমার দায়িত্ব আরেকটু বেড়ে গেল। এবং এই মুহুর্তে আমার প্রধান দায়িত্ব হল নীলিমার কাছ থেকে দূরে সরে আসা। তাই সিদ্ধান্ত নিলাম যে, দুই-একদিনের মধ্যে একটা মেসের ব্যবস্থা করে ওদের বাসা থেকে চলে আসব। পরীক্ষার আর মাত্র তিন মাস বাকি আছে, এই তিন মাস একটু কষ্ট করে হলে ও মেসে থেকে যেতে হবে।

: মামা, আপনাকে একটা কথা বলার ছিল।
: কি কথা বাবা?
: আমার পরীক্ষার আর মাত্র তিন মাস বাকি আছে। তাই পরীক্ষার ভালো প্রিপারেশনের জন্য গ্রুপ স্টাডি খুবই প্রয়োজন। আর বাসায় ত ফ্রেন্ডদের আনা যাবে না, এজন্য আমি ঠিক করেছি নিজেই ফ্রেন্ডদের কাছে চলে যাব।

: কেনো তাদেরকে বাসায় আনতে পারবে না? তাদেরকে বাসায় নিয়ে এসেও ত গ্রুপ স্টাডি করতে পার। (নীলিমা পাশের রুমে পর্দার আড়াল থেকে সবকিছু শুনছে, পর্দার নিচ দিয়ে তার পা দেখা যাচ্ছে।)

: না মামা, আমি বাসায় এসব ঝামেলা করতে চাচ্ছি না। তাছাড়া আমি একটা মেস ঠিক করেও ফেলছি। এখন আপনার অনুমিত পেলে আগামীকালই আমি চলে যেতে চাই।
: আচ্ছা ঠিক আছে বাবা, তুমি যেটা ভালো মনে কর সেটাই কর।
: ঠিক আছে মামা।
.পরেরদিন বিকালে আমি আমার জিনিসপত্র সব প্যাক করছিলাম। এমন সময় নীলিমা আমার রুমে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিল।

: কি ব্যাপার, তুই দরজা বন্ধ করলি কেনো?
: তুমি আমার কারনেই চলে যাচ্ছ? (এক পা এক পা করে আমার দিকেই এগুচ্ছে)
: নীলিমা, মামা-মামি কেউ দেখে ফেললে সর্বনাশ হয়ে যাবে। (কিছুটা ভয়ের সাথে)
: আব্বু-আম্মু ছাদে বসে চা খাচ্ছে, তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।
: না, আমি তর জন্য যাব কেনো? আমি ত পরীক্ষার জন্য চলে যাচ্ছি।(আমতা আমতা করে বললাম)
: আমাকে ছেড়ে চলে যেওনা প্লিজ।-এই বলে নীলিমা আমাকে জরিয়ে ধরল। অনেক কান্না করতেছে মেয়েটা। বার বার একটা কথাই বলতেছে-
: প্লিজ, একটিবার বল যে, তুমি আমাকে ভালোবাসো।

(আমিও ত মানুষ, ওর কাছে অস্বীকারকরলেও, আমি ত জানি যে আমি ওকে কতটা ভালোবাসি। তাই আর নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারলাম না। জরিয়ে ধরলাম নীলিমাকে, খুব শক্ত করে। দুজনে মিলে খুব কেঁদেছিলাম সেদিন, খুব। কিছুক্ষণ পর নিজেকে সামলে নিলাম, ওকে ছেড়ে দুই হাত দিয়ে ওর মুখটা তুলে ধরলাম। কেঁদে কেঁদে পাগলীটা নাকের পানি, চোখের পানি সব এক করে ফেলছে। প্রচন্ড রকমের মায়াবী লাগছিল ওকে। তাই আর বেশিক্ষণ ওর চোখের দিকে থাকাতে পারলাম না, কারন মায়ার জালে বন্দী হওয়ার ভয় আছে যে। চোখটা নামিয়ে নিয়ে শুধু এতটুকুই বললাম –

: আমি স্যরি নীলিমা।-এই বলে আমার ব্যাগগুলো নিয়ে বাসা থেকে বের হয়ে আসলাম।

মামার বাসা থেকে মেসে আসছি আজ প্রায় ১০ দিন হয়ে গেছে। এই ১০ দিনের মধ্যে ১০ মিনিটের জন্যও আমি নীলমার কথা ভুলতে পারি নি। ঠিকমত ঘুমাতেও পারছিলাম না। চোখ বন্ধ করলেই পাগলীটার কান্না মাখা মুখটা ভেসে উঠে। এই ১০ দিনে আমি অন্তত এইটুকু বুঝতে পেরেছিলাম যে, পাগলীটাকে ছাড়া আমার চলবে না। আমার বেচে থাকার জন্য ওকে একটু বেশিই প্রয়োজন। কিন্তু আমি কি করব? তার বাবার সামনে গিয়ে তার হাত চাওয়ার মত সাহস যে আমার নাই। আসলে সাহস নাই বললে ভুল হবে, মূলত আমার সেই যোগ্যতাটাই নাই। এই বিশাল পৃথিবীতে নিজেকে খুব একা ও অসহায় মনে হচ্ছিল। বিছানায় শুয়ে শুয়ে নীলিমার কথাই ভাবছিলাম, এমন সময় আমার সেলফোনটা বেজে উঠল, আম্মুর ফোন-

: হ্যালো আম্মু
: কিরে বাবা, ভালো আছিস?
: হ্যা আম্মু, তুমি ভালো আছ?
: আমি ত ভালো আছি। কিন্তু তর কথাগুলো এমন শুনাচ্ছে কেনো, মন খারাপ?
: না আম্মু, সব ঠিক আছে।
: আচ্ছা শুন, তুই আগামীকালই বাড়িতে চলে আয়, জরুরি দরকার আছে।
: কেন আম্মু, হঠাৎ কি এমন জরুরি দরকার পড়ে গেল?
: তুই আগে আয়, এলেই বুঝতে পারবি।
: আচ্ছা ঠিক আছে।
.দীর্ঘ ছয় ঘন্টা জার্নির পর বাড়িতে পৌঁছলাম। বাড়ির ভেতর ঢুকে ত আমি অবাক, মামা-মামি আমাদের বাসায়!! মনে মনে একটু ভয় পেয়ে গেলাম। অনেক কিছুই মাথার ভিতর ঘুরপাক খাচ্ছিল।

: কি খবর সুমন, ভালো আছ?
: জ্বি মামা, আপনি কেমন আছেন?
: কি করে আর ভালো থাকি বাবা? তোমরা যা কর না! (আম্মু ও মামি আমার দিকে থাকিয়ে একটা রহস্যময় হাসি দিলেন, আমি আরেকটু ভরকে গেলাম।)
: কেনো মামা, কি করেছি আমি? (ভয়ে ভয়ে বললাম)
: তুমি যখন আমাদের বাসা থেকে চলে আসবা, তাহলে তোমার সব জিনিসপত্র নিয়ে আসবা না? তুমি তোমার একটা মূল্যবান জিনিস ফেলে আসছিলে, তাই সেটা নিয়ে এত দূর থেকে আমাদের আসতে হল। (আমি মামার কথার আগা-মাথা কিছুই বুঝতে পারছিলাম না)

: স্যরি মামা, আমি আপনার কথা ঠিক বুঝতে পারি নি।(রাজ্যের সব কনফিউশন আমার চেহারায়)
: ঐ রুমে তোমার সেই মূল্যবান জিনিস রাখা আছে, ঐখানে গেলেই সব বুঝতে পারবে।(আমার রুমটা দেখিয়ে মামা বললেন) আমি আমার রুমে চলে আসলাম। এসে দেখি নীলিমা সোফায় বসে আছে।

: কিরে ভালো আছিস? – নীলিমাকে জিজ্ঞেস করতে করতে আমি সমস্ত রুমে জিনিসটা খুজতেছি।
: কি খুজ এত?
: আরেহ মামা কি একটা মূল্যবান জিনিসের কথা বলছিলেন, ঐটাই খুজতেছি।
: কেনো, আমাকে চোখে লাগে না?
: মানে?
: মানে হল, আমি আব্বু আম্মু কে সব বলে দিয়েছি।
: সব বলে দিয়েছিস মানে, কি বলেছিস?
: বলেছি যে, আমি তোমাকে ভালোবাসি

এবং তুমিও আমাকে (এতটুকু বলেই আটকে যায় নীলিমা, কিন্তু আমার আর বুঝতে বাকি রইল না। আমি আনন্দিত হব নাকি অবাক হব বুঝতে পারছিলাম না, বিষণ সমস্যায় পড়ে গেলাম। আসলে পৃথিবীতে কিছু কিছু সমস্যা খুবই মধুর হয়)

: আমি তকে ভালোবাসি কি না, সেটা বুঝলি কিভাবে? (একটু ভাব নিয়ে জিজ্ঞাস করলাম)

: আরেহ হাদারাম, মেয়েরা সব বুঝতে পারে। (আমার ভেতরে যেন খুশির জায়গা হচ্ছে না, এত বেশি আনন্দ আর কোনোদিনন পাই নি আমি। একি, আমার চোখ দিয়ে পানি পরতেছে কেনো? থাকিয়ে দেখলাম নীলিমার চোখে ও পানি টলমল করতেছে।)

: কি হল, কাঁদতেছ কেনো? (নীলিমা)
: আমার বুকের বাম পাশটায় মাথা রাখ,

সব বুঝতে পারবি।-এই বলে দুই হাত বাড়িয়ে দিলাম। নীলিমাও আমার বাহুডোরে বন্দী হতে একটুও দেরী করল না। যেন সে ও এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিল অনন্তকাল ধরে। পাগলীটা কেঁদে কেঁদে আমার শার্টটা ভিজিয়ে ফেলতেছে। আমিও থামাব না, কাঁদুক না। এরকম কান্নার সুযোগ ত আর প্রতিদিন আসবে না!!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত