মেহমান

মেহমান

মন খারাপ থাকার কারনে আমি দুপুর থেকে না খেয়ে আছি। এখন বাজে সন্ধ্যা সাতটা। আবিদ রান্নাঘরে ঢুকে কিছুক্ষণ ধুড়ুম-ধাড়ুম শব্দ করে হাসিমুখে বেরিয়ে এল। হাতে আনারসের প্লেট। পাশে বসতে বসতে বলল, ‘তোমার প্রিয় ফল আনারস । বেছে বেছে নিয়ে এসেছি। আনারস খাওয়ার পর নিজের হাতে কড়া লিকারের দুধ চা করে খাওয়াব।’ আমি ভাল করে ওর মুখের দিকে তাকালাম। আমার সাথে ঠাট্টা করছে কি-না বুঝার চেষ্টা করছি। বুঝতে না পেরে শেষে চোখ মুখ শক্ত করে বললাম, “আনারস খেয়ে চা খেলে দেরি হয়ে যাবে। তারচেয়ে বরং চা করে নিয়ে এসো। একসাথে গুলে খেয়ে মরে যাই। আবিদ একমনে দুই মিনিট ভাবার পর জিহ্বায় কামড় দিয়ে বলল,

–একদম মনে ছিলনা। সত্যি!
–আজকাল তোমার মনের দারুন অবনতি হচ্ছে দেখছি। কিছুই মনে থাকছেনা। ব্যাপার কি?” আবিদ এক পিস আনারস মুখে দিয়ে বলল,
–আচ্ছা তোমার মন কেন খারাপ সেটা কিন্তু এখনও বলনি।
–আমার মন নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে হবেনা। তোমার কাহিনী কি সেটা বলো।
–কিসের কাহিনী?
–এইযে, তোমার আজকাল কিছুই মনে থাকছেনা। একটা কথা দুইবার বলতে হচ্ছে। কেমন অন্যমনস্ক হয়ে থাকো।

মাঝরাতে ঘুম ভাঙলে তোমাকে দেখা যায়না। একা একা ড্রয়িং রুমে বসে থাকো। এসব তো প্রেমে পড়ার লক্ষন। নতুন কারো প্রেমে পড়েছো নাকি! পড়ে থাকলে বন্ধু মনে করে বলে ফেলো।

–আচ্ছা যদি আবার কখনো প্রেমে পড়ি তাহলে সবার আগে তোমাকেই বলবো। এখন বলো কি হয়েছে। আমি কি কিছু করেছি? আমি গম্ভীর কন্ঠে বললাম,
–আজ আমার জন্মদিন ছিল।

আবিদের মুখ ফাটা বেলুনের মত চুপসে গেল। চুপচাপ বাকি আনারসগুলো খেয়ে প্লেট খালি করে ফেলল। তারপর দাড়িয়ে কাশতে কাশতে বলল,

_দেখো আমিতো ইচ্ছে করে ভুলে যাইনি। আমার মনে হয় না এটা মারাত্মক কোন অপরাধ।
–অবশ্যই এটা মারাত্মক কোন অপরাধ না। আমার জন্মদিন ভুলে গেছো ব্যাপার না। কিন্তু তোমার স্কুল কালের বান্ধবী তৃষার জন্মদিন ঠিকই মনে থাকে। ঠিক রাত বারোটায় ওকে ফেসবুকে উইশও করা হয়৷ এখন বল এটা তোমার কেমন বিচার?
–এটার পিছনেও আমার যুক্তি আছে। আসলে ফেসবুকে ঢুকতেই নোটিফিকেশন এল আজ তৃষার জন্মদিন। তাইউইশ করে ফেলেছি।
–হাসি থামাও। তোমার কোন যুক্তি আজকে আমাকে আটকে রাখতে পারবেনা।
–কোথায় যাবে? আপার বাসায়?
–জানোই যখন আর প্রশ্ন করছো কেন।
–উনাদের বাসায় আজ প্রচুর মেহমান এসেছেন। ভাইয়ের সাথে আজ দেখা হয়েছিল। শুনেছি বিছানা-সোফা ছাড়িয়ে এখন মেঝেতে বাস করছেন অনেকে।

প্রচন্ড মন খারাপ নিয়ে আমি রুমে চলে এলাম। মন খারাপ হলে আপার বাসায় যাওয়া আমার অনেক পুরনো অভ্যাস। মোবাইল হাতে নিয়ে আপাকে ফোন দিলাম। মনে হচ্ছে তিনি মহাব্যস্ত। তিনবারের কলে ফোন ধরলেন। অত্যন্ত বিরক্ত কন্ঠে বলল,

–ব্যাপারটা কি নিহা! ফোন যখন ধরছিনা তখন তোর বুঝা উচিত আমি ঝামেলায় আছি। এতবার কল দিচ্ছিস কেন? আমিও সমান তেজে বললাম,
–এতবার যখন কল দিচ্ছি তখন তোমারও বুঝা উচিত যে নিশ্চয়ই জরুরি কোন দরকার আছে।
–কি দরকার তাড়াতাড়ি বল।
–না থাক। তুমি তোমার ঝামেলা শেষ কর। আমি রাখছি।
–ন্যাকামি না করে বলে ফেল।
আমি ফ্যাকাশে গলায় বললাম,
–আজ আমার জন্মদিন ছিল। আবিদ সেটা ভুলে বসে আছে। শুধু তাই নয়, গতকাল ওর স্কুলের বান্ধবী তৃষার জন্মদিন ছিল। ওকে ঠিকই উইশ করেছে। আমার খুব মন খারাপ।
–বলিস কি! এটাতো ভয়ংকর কান্ড ঘটিয়ে ফেলেছে।
–একদম ইয়ার্কি মারবেনা। আমি সিরিয়াস।
–আমিও সিরিয়াস। তা তুই এখনও ওখানে কি করছিস? এতক্ষনে তো আমার বাসায় চলে আসার কথা।
–আমি চলে আসলে তোমার মেহমানদের কি করবে?
–কিসের মেহমান?

আমি কিছুক্ষন চুপ থেকে বললাম, “কিছুনা। আচ্ছা রাখি। জন্মদিন ভুলে যাওয়ায় আমার মন খারাপ ছিল। আর এখন আবিদের মিথ্যা বলায় আমার আরো মন খারাপ হওয়া উচিত। কিন্তু কোন এক অদ্ভুত কারনে আমার মন ভাল হয়ে গেল। সম্ভবত মাইনাসে মাইনাসে প্লাস হয়ে গেছে। ড্রয়িং রুমে ঢুকে আমি হতবাক হয়ে গেলাম। আবিদের মুখে আর হাতে রঙ লাগানো। ওর সামনে ছবি আকার ক্যানভাস। ক্যানভাসে আমার ছবি আকা হচ্ছে। ছবিটা এখনও পুরোপুরি শেষ হয়নি। আবিদ তাড়াহুড়ো করে সেটা শেষ করছে। তাড়াহুড়ো করার কারনে হাতে, মুখে রঙ লাগিয়ে ফেলছে। আমাকে দেখে বলল,

–ভেবেছিলাম জন্মদিনে সারপ্রাইজ দেবো। আমার সমস্ত ধ্যান ছিল ছবি আকায়। এত ব্যস্ত ছিলাম যে জন্মদিন কখন চলে এসেছে বুঝতেই পারিনি। আমি বললাম,
–তাহলে মাঝরাতে তুমি এই কাজ করতে?
–ইয়েস। এই নাও তোমার উপহার।
–কপালে টিপ দিয়েছো কেন? আমাকে টিপ পড়তে দেখেছো কখনো?
–আমার ইচ্ছে করলো তাই দিলাম।” আমি মুগ্ধ হয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে রইলাম। অতি আবেগে আমার চোখে পানি এসে গেল। চোখ মুছে বললাম,
–এই ছবিটা আমি আপাকে দেখাবো। চল আমার সাথে। আবিদ আৎকে উঠে বলল,
–ওই বাসায় মেহমান বললাম না!

এখন যাওয়া ঠিক হবেনা। তারচেয়ে বরং মোবাইলে ছবি তুলে পাঠিয়ে দাও।”
আবিদের নার্ভাস চেহারা দেখে আর লজ্জ্বা দিতে ইচ্ছে করলো না। আফসোসের সুরে বললাম, “ইশশ মেহমান আসার আর সময় পেলনা! মাঝরাতে হঠাৎ করেই আমার ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম কেন ভাঙলো সেটা মনে করতে গিয়ে আমার অন্য জিনিস মনে পড়ে গেল। তৃষা কপালে টিপ পড়ে! মনের দুঃখে আবার আপাকে ফোন দিলাম। এবারও তিনবারের রিং এ ফোন ধরলো।

–হ্যালো আপা!
–হু।
–তৃষা কপালে টিপ পড়ে!
–হু।
–আবিদ জন্মদিনে আমার ছবি একে গিফট করেছে। সেই ছবিতে আমার কপালে টিপ দিয়েছে। তুমি বলো, আমি কি কখনো টিপ পড়ি?
–হু?
–আমি কি কখনো টিপ পড়ি? টিপ তো পড়ে তৃষা।
–হু।

আমার মনে হলো আপার সাথে বেহুদাই কথা বলছি। ঘুমের ঠেলায় যখন কথা বলতে পারবেনা তখন ফোন রিসিভ করার কি দরকার! ফোনটা কেটে দিতে যাবো তখনই আপা বলে উঠলো,

–নিহা শোন!
–বলো।
–তৃষাও কখনো টিপ পড়েনা। ওর দুই ভ্রু এর ঠিক মাঝখানটাতে ছোট্ট কালো দাগের মত আছে। দেখলে মনে হয় টিপ পড়েছে। আর কিছুনা।
–তুমি এত সব খেয়াল করলে কখন? তাছাড়া তোমার তো ওকে চেনারই কথা না।
–তোর বিয়েতে দেখেছি। প্রচুর বকবক করতে পারে। অবশ্য কাজের আছে৷ আমাকে বিয়ের দিন অনেক সাহায্য করেছে। মনে রাখার মতই ভাল একটা মেয়ে।
— ও আচ্ছা। তা ভাল মেয়ে এখনও বিয়ে করছে না কেন?
–কারন ভাল মেয়েদের বিয়ে দেরিতেই হয়।
–তারমানে তুমি আমি খারাপ মেয়ে?
–তা হবে কেন। ওইটা তো আল্লাহপাকের হুকুম ছিল, এজন্য হয়ে গেছে।
–তো ভাল মেয়ের বিয়ে কি আল্লাহপাকের হুকুম ছাড়া হয়ে যাবে?
–মাঝরাতে আমার সাথে তর্ক করার জন্য ফোন দিয়েছিস?
–কেন ফোন দিয়েছি সেটা ভাল করেই জানো।
–হ্যা জানিতো। এমন চাঁদের মতো দেখতে বিশুদ্ধ একটা ছেলের গায়ে কলঙ্কের দাগ লাগানোর চেষ্টা করেছিস। এরজন্য তোর লজ্জ্বা পাওয়া উচিত।
–লজ্জ্বা না পাওয়ার জন্য আমি দুঃখিত।
–মুখ বন্ধ করে ঘুমা। আমাকে আর ফোন দিবিনা।

সকালবেলা আমার হাত থেকে একটা কাচের প্লেট পড়ে গেল। কিন্তু ভাঙলো না। প্লেট পড়ে না ভাঙায় আবিদ অতিরিক্ত রকমের খুশি হয়েছে। আমি প্লেট তুলে টেবিলে রেখে বললাম,

–তোমার ফেভারিট প্লেট নাকি? আজই তো বের করলাম।
–প্লেট আবার ফেভারিট হয়!
–আমার হয়। কিন্তু তোমার এই দাত বের করার কারন কি? আবিদ খুশি মনে বলল,
–শুনেছি কাচের জিনিস পড়ে যদি না ভাঙে তবে মেহমান আসে! আজ ঠিক দুপুর বারোটায় আমাদের বাসায় কেউ আসবে।
–ওরে বাবা! তা কে এই ভবিষ্যতবাণী করেছেন শুনি?
–আমার মা বলতেন।

ভেবেছিলাম কুসংস্কার নিয়ে কিছুক্ষন বক্তব্য দেব। কিন্তু আমি আর কিছু বললাম না। শ্বাশুরি আম্মাকে নিয়ে কোন কথা হবেনা। নয়তো এই সুন্দর সকালটা অন্ধকার রাতে পরিণত হয়ে যাবে। আবিদ আনন্দে আত্মহারা হয়ে আছে। অনেকদিনপর নাকি জমিয়ে আড্ডা দেবে। অথচ কার সাথে আড্ডা দেবে সেটাই জানেনা! এইমূহুর্তে আবিদকে একটা অবুজ শিশুর চেয়ে কম মনে হচ্ছেনা। শিশুকে ভুলিয়ে- ভালিয়ে অফিসে পাঠাতে হবে। মেহমান আসা উপলক্ষে সে আজ অফিসে যাবেনা বলে ঠিক করেছে। আমি হালকা কেশে গলা পরিষ্কার করলাম। কিন্তু কিছু বলার আগেই ওর মোবাইল বেজে উঠলো। স্ক্রিনে বসের নামটা ভেসে উঠতেই আবিদ লাফ দিয়ে উঠলো। সে এখন “জ্বি স্যার, ওকে স্যার, এইতো স্যার রাস্তায়, আসছি” বলতে বলতে রেডী হচ্ছে।

ঠিক দুপুর বারোটায় আমাকে হতবাক করে দিয়ে আমার বাসায় মেহমান আসলেন। আজ মনে হচ্ছে মুরুব্বিদের সব কথা ফেলে দেওয়ার মতো না। মেহমান হিসেবে তৃষার আগমন হয়েছে। তৃষার একহাতে একটা স্যূটকেস। দেখে মনে হচ্ছে বাড়ি ছেড়ে একেবারে চলে এসেছে। প্রচন্ড বিরক্ত হয়ে আমি চেনেও না চেনার ভান করে বললাম,

–কাকে চাচ্ছেন?” তৃষা মোটেও অবাক হলনা। উল্টো একরাশ দুঃখ নিয়ে বলল,
–চাইলেই কি সবাইকে পাওয়া যায়! আমি কি বলবো ভেবে পেলাম না। কোন দুঃখে বাড়ি ছেড়েছে কে জানে। জিজ্ঞেস করলাম,
–মানে ঠিক বোঝলাম না।
–বোঝতে তো আমিও পারছিনা। চিনেও না চেনার ভান করছো কেন?
আমার ভ্রু কুচকে গেল। এতো দেখি মারাত্মক মহিলা। আমি আর দেরি না করে চিনে ফেললাম। ভুবন ভুলানো হাসি দিয়ে বললাম,

–আরে তৃষা আপু না! অনেকদিন পর দেখা তো, চেনাই যাচ্ছেনা!
–চেনা যাবেনা কেন? আমার কপাল তো আগের মতোই আছে।
–মানে?
–দরজায় দাড় করিয়ে আমার কপালের দিকেই তাকিয়ে আছো দেখি। কেন বলতো?”

কপালে ওটা সত্যি সত্যি দাগ কি-না সেটাই দেখতে চাচ্ছিলাম। কিন্ত পারলাম না। হাসি হাসি মুখ করে দরজা থেকে সরে দাড়ালাম। রান্নাঘরে ঢুকে আনারসগুলোর দিকে তাকিয়ে আছি। মেহমান আসলে বরাবরই আমার ভিন্ন কিছুর আয়োজন করতে ইচ্ছে করে। আজও তার ব্যাতিক্রম হচ্ছেনা। ইচ্ছে করছে এই গরমের মধ্যে তৃষার জন্য এক গ্লাস স্পেশাল “পাইনএপল শেক” বানিয়ে নিয়ে যাই। তবে সেটা একটু বেশিই ভিন্ন হয়ে যাবে বিধায় আইডিয়াটা বাতিল করে দিলাম।আপাতত এক গ্লাস ম্যাংগো শেক নিয়ে ড্রয়িং রুমে ঢুকলাম। গ্লাস হাতে নিয়ে তৃষা তার বক্তব্য শুরু করলো।

কেন বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে সেটার কারন ব্যাখ্যা করছে। তৃষার ভাষ্যমতে, বাসা থেকে তাকে বিয়ের জন্য চাপ দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু তৃষা বিয়ে করবেনা। তৃষা বিয়ে করতে চাচ্ছেনা সেটা গুরুত্বপূর্ন না। গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে ওর বিয়ে না হওয়াতে ওর ছোট ভাইটি বিয়ে করতে পারছেনা। ঘরে বড়বোন থাকায় কেউ ভাইয়ের জন্য বিয়ের প্রস্তাবও নিয়ে আসেনা। হঠাৎ করেই তৃষার মনে হয়েছে এ বাড়িতে কেউ তার কদর করেনা। কারোও কোন টান নেই, মায়া-মহাব্বত নেই। তাই সে কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসেছে। কিছুদিন বাসার সবাইকে শিক্ষা দিতে চায়। সবাই ওর মেয়ে বন্ধুদের বাড়িতে খুজতে গেলেও, কেউ ছেলে বন্ধুর বাড়িতে খোজ করতে আসবেনা, এই বুদ্ধি নিয়ে সে এখানে এসে উঠেছে। যদিও এই মেয়ের সব কথা আমার হজম হচ্ছেনা। বক্তব্য শেষ করে তৃষা আমাকে বলল,

–তিন-চারদিন এখানে থাকলে তোমাদের কি খুব বেশি অসুবিধা হবে?” আমি ফ্যাকাসে হাসি হেসে বললাম,
–নাহ! অসুবিধা কেন হবে। তোমার যতদিন খুশি থাকো।
–আবিদও অবশ্য বলেছে কোন অসুবিধা নেই। তবুও তোমার পারমিশন নেয়াই বেশি জরুরি।
–ওর সাথে কখন দেখা হলো?
–দেখা হয়নি। কাল রাতেই মেসেজ করে বলে দিয়েছিলাম যে আজ আমি আসবো। কেন তোমাকে কিছু বলেনি?

আমি ছোট্ট করে নিঃশ্বাস ফেললাম। চাঁদের মতো দেখতে ছেলেটা আজকাল আমাকে বেশ ভালই বোকা বানাচ্ছে। তবে যাইহোক, আজ আমি আবিদকে ধরবো। তৃষা কেন এখনও বিয়ে করছেনা এই কাহিনী আমাকে জানতেই হবে। সাথে ব্যাগ গুছিয়ে রাখতে হবে। অনেকদিন ধরে “কঠিন মন খারাপ” না হওয়ায় আপার বাসায় যাওয়া হয়না!

রাতে খুব আড্ডা দেওয়া হলো, আবিদ গান গাইলো –“পুরনো সেই দিনের কথা”। গানটা শুনে তৃষা ফ্ল্যাশব্যাকে চলে গিয়েছিল। সেখান থেকে আসতে আসতে রাত এগারোটা বেজে গেল। রাতের খাবার খেয়ে আবিদ আর তৃষা যার যার রুমে চলে গেল। আপার “কাজের মেয়ে” তৃষা আমাকে কোন কাজেই সাহায্যই করলোনা। রান্নাঘরে সবকিছু গুছাতে গুছাতে সাড়ে এগারোটা বেজে গেছে। রাত এগারোটা পঁয়তাল্লিশ। আবিদ এখন মোবাইলের ভেতর ডুবে আছে। সারাদিনে এই একবারই সে মোবাইল নিয়ে বসে। আমি মোবাইলটা নিজের হাতে নিয়ে বললাম,

–একটা মেয়ে পাগলামি করে বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছে। তুমিও ওর পাগলামিতে সমানে তাল দিয়ে যাচ্ছো। কেন সেটা জানতে পারি?
–বন্ধু হিসেবে এটুকু তো করতেই পারি তাইনা?
–আর ওর বাড়ির লোক চিন্তা করবেনা?  আবিদ নির্বিকার কন্ঠে বলল,
–না।
–সর্বনাশ! তাহলে তো তৃষা ঠিকই বলেছে। ওই বাড়িতে কেউই তার কদর করেনা।
–আরে নাহ! আমি আংকেল কে ফোন করে জানিয়ে দিয়েছি তৃষা এখানে আছে। যাতে উনারা চিন্তা না করেন।
–ও আচ্ছা।
–তুমি কিছু বলবে?

আমি মাথা ঝাকিয়ে হ্যা বললাম। তৃষার ব্যাপারে জানতে চাইলে আবিদ বলল,

–দেখো তুমি খুবই ইমোশনাল একটা মেয়ে। সব শুনার পর তোমার খুব খারাপ লাগতে পারে। তারপরও যদি শুনতে চাও তবে শুনতে পারো।”  আমি হাই তুলে বললাম,

–ভূমিকা শেষ হলে মূল রচনায় আসো প্লিজ।
–ঠিক আছে তবে শুনো।

তৃষার সাথে ক্লাস থ্রি থেকেই আমার বন্ধুত্ব। বন্ধুত্ব এতটাই গাঢ় হয়ে গিয়েছিল যে আমরা স্কুল শেষ করে একই কলেজেও ভর্তি হই। ভর্তি পরীক্ষাগুলো খুবই বাজে হওয়ায় আমি কোন পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাইনি। বাধ্য হয়ে ন্যাশনাল ভার্সিটিতে ভর্তি হলাম। ক্লাসের প্রথম দিন ক্যাম্পাসে গিয়ে দেখি তৃষা বসে আছে। একটা বটগাছের দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। অথচ সে সিলেটের শাবিতে ইংরেজিতে চান্স পেয়েছিল। বেস্ট ফ্রেন্ডের জন্য এত বড় ত্যাগ আমি আগে দেখিনি। একটু খারাপও লাগছিলো যে আমার জন্যে সে এত বড় সেক্রিফাইজ করেলো। পাশে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন এমন করলি?” তৃষা মুচকি হেসে সামনের বটগাছের দিকে তাকিয়ে বলল, ভালবাসলে কত কিছুই করে মানুষ। এ আর এমন কি!” আমি তোতলাতে তোতলাতে বললাম,

–কা কা ক্কাকে ভালবাসিস?

তৃষা হাত তুলে সামনের বট গাছটা দেখালো। গাছের মগডালে একটা ছেলে বসে আছে। চোখে চশমা। পড়নে অনেক পুরোনো একটা ফুলহাতা শার্ট। ছেলেটাকে আমি চিনতাম। আমাদের কলেজ থেকেই টেনেটুনে পাশ করে বেরিয়েছে। কোন এক অদ্ভুত কারনে সে বেশিরভাগ সময় গাছে বসে থাকে।

গল্পের নায়ক আবিদ না হওয়ায় আমি ভীষনরকম হতাশ হলাম। তারমানে আমার আর আপার বাসায় যাওয়া হবেনা। আমি মোটামুটি শিওর ছিলাম যে এটা তৃষার একতরফা ভালবাসার গল্প হবে। আমি গল্প শোনার সব আগ্রহ হারিয়ে ফেললেও আবিদের গল্প বলার আগ্রহ বেড়ে গেছে দেখে বললাম, তারপর কি হলো? আবিদ বলতে লাগলো,

–ছেলেটা গাছে গাছে বসে থাকলেও কেন জানি সব মেয়েরা ওর জন্য পাগল ছিল। কিন্তু ছেলেটা কোন মেয়েকে পাত্তাই দিতোনা। মধ্যবিত্ত একটা ছেলের এমন এটিটিউড দেখে আমার অবাক লাগতো। ভেবেছিলাম তৃষাকেও হয়তো ফিরিয়ে দেবে। কিন্তু ছেলেটা তৃষাকে ফিরিয়ে দেয়নি। সত্যিকারের ভালবাসা হিসেবে তৃষাকে স্বীকৃতি দিয়ে দিল। খুব ভালবাসতো তৃষাকে। ছেলেটার কাছে তৃষা দামী কোন গিফট চাইতোনা। শুধু প্রতিদিন এক ঠোঙা বাদামের জন্য তৃষ্ণার্ত কাকের মত বসে থাকতো। ছেলেটা বাদাম নিয়ে এলে দুজন অনেকটা সময় নিয়ে সেই বাদাম খেত। যেন এই বাদামের ওপরই তাদের সম্পর্ক ঠিকে আছে। বাদাম শেষ তো সম্পর্কও শেষ। এমনি করেই হেসে খেলে কেটে গেল তিনটি বছর। হঠাৎ একদিন বিকেলবেলা ঠোঙার শেষ বাদাম মুখে দিয়ে ছেলেটা সেই ভয়ংকর কথা বলল। গল্পের টুইস্টে এসে থেমে যাওয়া আবিদের অন্যতম বাজে অভ্যাস। বিরক্তস্বরে বললাম,

–থামলে কেন? কি বলেছিল?
–বলেছিল, দেখো তৃষা, আমিও আমার পরিবারের বড় ছেলে।
–আমিও মানে? একটা পরিবারে কয়টা বড় ছেলে থাকে?
–তুমি ব্যাপারটা বোঝনি।

আসলে “বড় ছেলে” নাটক দেখার পরই সে সিদ্ধান্ত নেয় ব্রেক-আপের। এই নাটক নাকি ওর চোখ খুলে দিয়েছিল। তৃষা ওকে বোঝাতে গেলে ছেলেটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, আমার এই ঠুনকো জীবনে তুমি কাচের দেয়াল ছাড়া আর কিছুই না। এক আধটু কারনে সেটা ভাঙার আগে আমিই এই সম্পর্ক ভেঙে দিচ্ছি। ভাল থেকো।”- এই কথা বলে সে সামনের প্রকান্ড তেতুলগাছ বেয়ে উপরে উঠে বসে থাকলো। তৃষা ভেবেছিল হয়তো পারিবারিক কোন চাপে আছে । আজ নাহয় কাল ফিরেই আসবে। কিন্তু ছেলেটি আর কখনোই ফিরে আসেনি। প্রচন্ড অভিমানী তৃষা ঠিক করলো প্রেম তো দূরের কথা, এই জীবনে কোনদিন সে বিয়েই করবেনা। কিন্তু ছেলেটা কেন এমন করলো আমি আজও বুঝতে পারলাম না।” আমি লম্বা হাই তুলে বললাম,

–আমি ঠিকই বুঝতে পেরেছি।
–কি বুঝেছো?
–গাছে গাছে বসে থাকার ফলে ছেলেটার ঘাড়ে “মামদো ভূত” চেপে বসেছিল। সেই ভূতটাই এইসব করিয়েছে, আর কিছুনা।” আবিদ আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হেসে ফেলল।

এগারো দিন পরঃ- সেদিনের সেই কাচের প্লেটটা আজকে আমার হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল। আমি আবিদের দিকে তাকিয়ে ভ্রু কুচকে বললাম, কাচের জিনিস পড়ে ভেঙে গেলে কি হয়?” আবিদ আত্মবিশ্বাসের সাথে বলল, বাসায় কোন মেহমান থাকলে বিদেয় হয়। ওর কথা শুনে এত ভাল লাগলো যে খুশিতে আমি আরেকটা প্লেট ভেঙে ফেললাম। আবিদ হতভম্ব হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। ওকে কি বলা যায় ভাবতে ভাবতে শেষে হেসে বললাম, ইচ্ছে করে কাচ ভাঙলে মেহমান তাড়াতাড়ি বিদেয় হয় আর কি…..!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত