গোলাপীবউ

গোলাপীবউ

গোলাপী লিপস্টিক, গোলাপী কাজল গোলাপী মেকাপ, গোলাপী শাড়ি, গোলাপী চুড়ি, গোলাপী নেলপলিশ, গোলাপী আলতা, মোটকথা এক ড্রাম সমান গোলাপী রঙ নিয়ে বউ আমার সামনে দাঁড়িয়ে বলল:- আমায় কেমন লাগছে! তার এই ভয়ংকর সাজগোজের নমুনা দেখেই, ভয়ে আমি বিছানা থেকে, “মা…গো” বলে লাফিয়ে উঠলাম। এই অবস্থায় সত্যি বলতে গেলে আমার বলা উচিত:- ওরে বইন, তোরে রুপকথার ডাইনির চাইতেও তিনশো বাইশ গুণ বেশি ভয়ংকর লাগছে!

কিন্তু সেটা বলা যাবে না। মা বলেছে বউয়ের মনে আঘাত লাগে এমন কিছু না বলতে। কিন্তু মা কি জানে? তার আদরের বউ মা অতিরিক্ত মাত্রায় গোলাপী রঙ প্রিয়। তার জন্য আমার বিছানা, বালিশ, দেয়ালের রঙ, মেঝে, ফ্যান, টিভি, বেসিন, সাবান, সাবানের কেইস, ব্রাশ, টুথপেষ্ট, বাথটব, এমনকি বদনাটা পর্যন্ত গোলাপী রঙের! সে চায় পুরো দুনিয়াটা গোলাপী হয়ে যাক! তার এই গোলাপীরঙের অত্যাচারে আমার তো উপরে চলে যাবার জোগাড় হয়েছে!

সেদিন ঠান্ডা লেগে বউয়ের কাশি হয়েছে। তাকে সাথে নিয়ে ফার্মেসীতে গেলাম ঔষধ কিনতে। সে বিক্রেতাকে বলল:- ভাই, গোলাপীরঙের একটা কাশির সিরাপ দিন! কথাশুনে বিক্রেতা চোখ বড় বড় করে বউয়ের দিকে তাকালেন। তারপর ভ্রুকুঁচকে বললেন:- ম্যাডাম, আপনার কাশি ভালো হলেই হলো! ঔষধ গোলাপী হলেই কি, আর কালো হলেই কি!

ঔষধ বিক্রেতার যৌক্তিক কথায় সে সন্তুষ্ট হলো না। আমাকে নিয়ে অন্যান্য ফার্মাসিতে সারাটাদিন ঘুরলো গোলাপীরঙ্গের কাশির সিরাপের খোঁজে। তবুও পেলাম না। ঘুরোঘুরির সময় আমার বলতে ইচ্ছে করছিল:- ওরে বইন, তোর পেটের ভেতরে কি কেউ গিয়ে দেখবে? যে ঔষধ গোলাপী রঙের নাকি হলুদ রঙের?

কিন্তু বলতে পারলাম না। মায়ের কড়া আদেশ কোনো কথায় ই বউকে কস্ট দেয়া যাবে না। যাইহোক, শেষমেষ গোলাপী রঙের ঔষধ না পেয়েও সে হার মানলো না! দোকান থেকে খাবার উপযোগী গোলাপী রঙের গুড়ো কিনলো এবং একটা কাশির সিরাপ কিনলো। বাসায় ফেরার পর কাশির সিরাপের ভেতর রঙ দিয়ে ঘন্টা খানেকের মতো ঝাকিয়ে ঔষধের রং গোলাপী করলো। তারপর.. সে খুশি মনে ঔষধ খেলো।

আমার জন্মদিনে ঘরদোর সাজানোর দায়িত্ব নিল আমার বউ। রাতে অফিস থেকে বাড়ি ফিরে দেখি আমার রুমের সব জায়গায় প্রায় একশোটার মতো গোলাপী বেলুন ঝোলানো। একটা কাগজে গোলাপী কালিতে বড় বড় করে লেখা “হ্যাপি বার্থ ডে টু অন্তু”। খেয়াল করলাম কেইক ও আনা হয়েছে গোলাপী রঙ্গের। এমনকি মোমবাতি, জন্মদিনের টুপি,কেক কাটার চাকুটা পর্যন্ত গোলাপী রঙের। সব দেখে মনে হচ্ছিলো আমি কোনো গোলাপী রঙের সাগরের ভেতর ডুবে আছি। বার্থ ডে সেলিব্রেশন শেষে সে আমায় গোলাপী র‍্যাপিং পেপারে মোড়ানো একটা গিফ্ট বক্স দিয়ে বলল:- এটার ভেতরে আমার পছন্দের রঙের কিছু জিনিস আছে, সকালে তুমি সেগুলো পড়বে। তারপর আমরা একসাথে ঘুরতে বেরোবো।

বউয়ের কথা শুনে বুকের ভেতরটা ধুক করে উঠলো, শরিরে পশমগুলো শিহরণ দিয়ে উঠলো। ভয়ে ভয়ে গিফ্ট বক্সটা খুললাম। খুলে দেখি গোলাপী রঙের একটা শার্ট, গোলাপী রঙের প্যান্ট, গোলাপী রঙের ঘড়ি, গোলাপী রঙের জুতা, গোলাপী রঙের মোজা, এসব দেখেই ভয়ে আমার চোখে জল এসে গ্যালো। তারমানে এসব পড়ে সকালে বউয়ের সাথে আমার বের হতে হবে? হে সৃষ্টিকর্তা আজকে যেন আর সকাল না হয়। এই মিনতি করতে করতে আমি ঘুমোতে গেলাম!

আমার মিনতি কবুল হলো না, যথারীতি সকাল হলো। বউও সকাল সকাল ঘুম ভাঙ্গিয়ে আমায় ঐসব কাপড়-চোপড় পড়ে রেডি হতে বলল। বউয়ের দেয়া গোলাপী রঙা কাপড়-চোপড় পড়ে যেই আয়নার সামনে দাড়িয়েছি অমনি নিজেকে নিজেই দেখে…” মা..গো.. বলে দেয়ালফাঁটা চিৎকার দিলাম। কি ভয়ংকর ই না দেখাচ্ছে আমায়! মনে হচ্ছে, যেন জোকারের সাজ সেজেছি। বাইরে দর্শকেরা আমার সার্কাস দেখার জন্য অতি আগ্রহে অপেক্ষা করছে। একটু পর বউও সাজগোজ করে আসলো। বরাবরের মতো রুপকথার ডাইনিকেও হার মানানো সেই ভয়ংকর গোলাপীরঙা সাজ! আমি শুধু ভাবছি বাইরে যখন বেরুবো সবাই আমাদের দেখে কি ভাববে?

রাস্তায় দাড়িয়ে আছি রিক্সার অপেক্ষায়। রিক্সা পাচ্ছি না। রাস্তা দিয়ে যারাই যাচ্ছে সবাই আমাদের দিকে চোখ বড় করে তাকাচ্ছে আর মুচকি মুচকি হাসছে। লজ্জায় আমার ইচ্ছে করছে রাস্তার মাটি খুড়ে ভেতরে গিয়ে বসে থাকি। কিন্তু… লোকজনের এই হাসাহাসিতে আমার বউয়ের কোন অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে না। সে দিব্যি খুশি মনে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষণ পর রিক্সা পাওয়া গেল। রিক্সাওলাকে সে বিউটিপার্লার যেতে বলল। রিক্সা বিউটি পার্লারের দিকে যাচ্ছে। পাশে বসে থেকে আমি মিন মিন করে বললাম।

:- ইয়ে..মানে আমরা বিউটি পার্লার যাচ্ছি কেন?
:- কাজ আছে গেলেই বুঝবে! আচ্ছা বলোতো.. গোলাপী রঙের চুলে আমায় কেমন লাগবে!

কথাটা শুনে মনে মনে বললাম:- ওরে বইন.. তোর ঐ একটা জিনিসি গোলাপী হতে বাকি ছিল। আজ বুঝি ঐটাও গেলো! বউ আবারো বললো:- কি হলো.. কিছু বলছো না কেন? আমি বললাম:- ভালো লাগবে! বেশ ভালো লাগবে! তারপর বউ অতি উৎসাহের সাথে বলল:- তবে..একটা কাজ করো! তুমিও তোমার চুল গোলাপী করে ফেল। গোলাপী রঙের চুলে তোমায় বেশ লাগবে

কথাটা শুনে ভয়ে আমার গলা শুকিয়ে গেল। ভয়ে ভয়ে বললাম:- আরেহ্ না.. না। তুমিই করো; আমার করতে হবে না! পার্লারে যাওয়ার পর সে পার্লারের লোককে বলল:- আমি আমার চুল গোলাপী করতে চাচ্ছিলাম!
কথাশুনে পার্লারের লোক ভ্রুকুঁচকে বউয়ের দিকে তাকিয়ে বলল: চুলকে সাদা, লাল, কালো করতে শুনেছি। কিন্তু গোলাপী করার কথা আজ প্রথম শুনলাম!

:- পারবেন কি না সেটা বলুন! আমার হাজবেন্ড ও চুল গোলাপী করবে। প্রয়োজনে আমরা আপনাকে টাকা বাড়িয়ে দেবো।

:- না ম্যাডাম..আমার এখানে আপাতত চুল গোলাপী করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে গোলাপীরঙের আলগা চুল েয়া যাবে। চাইলে সেটা আপনি নিতে পারেন।

পার্লারের লোকের কথা শুনে বউ অতি খুশি হলো। সে একজোড়া গোলাপী আলগা চুল কিনলো। একটা তার নিজের মাথায় পরলো আর অন্যটি জোরপূর্বক আমায় পড়িয়ে দিয়ে বলল:- এবার একদম পারফেক্ট! চলো আমরা এবার ঘুরতে বেরুরো!

পার্লার থেকে বাইরে বেরিয়ে বললাম:- আজকে আর ঘুরোঘুরির দরকার নেই! ইয়ে..মানে আমার পেটটা খুব মোচড় দিচ্ছে, খুব সম্ভবত পাতলা পায়খানা হয়েছে। রাস্তায় থাকলে কাপড় চোপড়ের সমস্যা হতে পারে। চল.. দ্রুত বাড়ি চল আমার অযুহাতে কাজ হলো। গোলাপী চুল নিয়ে আমাদের আর ঘুরোঘুরি করতে হলো না। বউকে নিয়ে বাসায় ফিরলাম। আমি যে বিড়ালটা পুষি তার নাম টুসু। রঙ ধবধবে সাদা। টুসুকে আমি খুব পছন্দ করি। সেও আমায় খুব পছন্দ করে। টুসু বলে ডাক দিলেই সে যেখানেই থাকুক একদৌড়ে আমার কাছে চলে আসে। আজ সকালে ঘুম থেকে উঠে যখন টুসু বলে বলে ডাক দিলাম। অমনি কোথা থেকে গোলাপীরঙের এক বেড়াল আমার উপর ঝাপিয়ে পড়লো। আমি তো ভয়ে “আম্মা..গো” বলে চিৎকার দিলাম। আমার চিৎকার শুনে বউ দৌড়ে এসে বলল,

:- কি হয়েছে?
:- এ বিড়ালটা কোথা থেকে এলো? আমার টুসু কোথায়?

বউ হাসতে হাসতে বলল:- এটাই তো তোমার টুসু! আমি সকালে গোলাপীরঙের স্প্রে দিয়ে এটাকে গোলাপী করে দিয়েছি। দেখেছো একে এখন কত্ত কিউট লাগছে।

রাগে ক্ষোভে আমার মাথায় আগুন ধরার অবস্থা! ইচ্ছে করছে এক্ষুণি এক ড্রাম গোলাপী রঙ এনে বউয়ের সারা শরীর গোলাপী করে দেই। কিন্তু ঢেলে লাভ নেই, কারণ এতে সে রাগবে না উল্টো খুশিই হবে হয়তো!রেগেমেগে কাঁপতে কাঁপতে বললাম:- অদ্রিতা! তুমি পেয়েছোটা কি? খালি গোলাপী..গোলাপী আর গোলাপী। তোমার এই গোলাপীর ঠেলায় তো আমার জীবনটা নরক হয়ে গেছে! বউ কাঁদতে কাঁদতে বলল:- কি বললে? আমি তোমার জীবনটা নরক বানিয়ে দিয়েছি?

:- হ্যাঁ.. হ্যাঁ যা বলেছি ঠিকি বলছি। তুমি কি জানো? যখন তুমি গোলাপীরঙা সাজে সাজো তখন তোমায় পেত্নি, ডাইনি, রাক্ষসীর চাইতেও ভয়ংকর লাগে?

:- কিহ্.. আমি পেত্নি, ডাইনি, রাক্ষসী? আমি আর থাকবোই না এই বাড়িতে। আমি আজি গাড়ির নিচে চাপা পড়ে আত্মহত্যা করবো।

:- আরেহ্ যাও.. যাও! করো গিয়ে আত্মহত্যা, কে না করছে তোমায়?

আমার কথা শুনে বউ এক দৌড়ে ঘরের বাইরে চলে গেল। আমিও ওকে থামালাম না। রেগে ঘরে বসে রইলাম। একটু পর যখন রাগ কমলো ভাবলাম..হায়! হায়! সত্যিই যদি বউ আত্মহত্যা করে ফেলে? তবে কি হবে? পাগলের মতো দৌড়ে রাস্তায় গেলাম। গিয়ে দেখি বউ রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে। আমি বললাম:- কি হলো? তুমি না আত্মহত্যা করবে, দাঁড়িয়ে আছো কেন? বউ কেঁদে কেঁদে বললো:- কি করে করবো? সেই কখন থেকে দাঁড়িয়ে আছি। একটাও গোলাপী রঙের গাড়ি আসছে না!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত