অদ্ভুত প্রেম

অদ্ভুত প্রেম

“কিরে সুমন ফেসবুকে তো কিসব পোস্ট করেছিস দেখলাম ট্রেন নাকি তোর ভালোবাসা, ট্রেনের সাথেই শেষে রিলেশনে গেলি নাকি ?

“আরে ওই সব নাটক রে অভিষেক, গার্লেফ্রন্ড না জুটলে যা হয়, ট্রেন আবার ভালোবাসা, ন্যাকামি আনলিমিটেড””। ইত্যাদি না নানা বিরক্তিকর কথাবার্তা বলে অভিষেক সহ আরো অন্যান্য ছেলে গুলো সুমন কে উত্যক্ত করেই চলেছিল। সুমন বরাবরই ভিষন রকম মেধাবী ছাত্র, এবং সাথে ভিষন রকম রেল প্রেমী, ফ্রি টাইমে সে অন্যান্য ছেলেদের মতন, গেম, ফেসবুক নিয়ে নাড়াচাড়া কমই করে, বরং তার বদলে বেশিরভাগ সময়ই পড়ে থাকে সে ইউটিউবে ইন্ডিয়ান রেলের বিভিন্ন ট্রেনের ভিডিও নিয়ে, বা কখোনো চোখ বোলায় ট্রেনের অনলাইন টিকিট বুকিং অ্যাপ এ, শিয়ালদহ এর কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস থেকে হাওড়ার জ্ঞানেশ্বরী সুপার ডিলাক্স এক্সপ্রেস বা কলকাতার তেভাগা এক্সপ্রেস সবকিছুরই টিকিট ভাড়া, ডেস্টিনেশন , টাইম টেবিল সবই সুমনের নখদর্পণে। প্লেনের যাত্রার থেকে ট্রেনের যাত্রা তার কাছে অনেক বেশি আনন্দের, সেই কোন ছোটো বেলায় একবার বাবা মায়ের সাথে সে গেছিল নিউ জলপাইগুড়ি তে উত্তরবঙ্গ এক্সপ্রেসে করে, সেই যাত্রার প্রতিটি মুহূর্ত এখোনো তার চোখে ভাসে। এরপর তার আর কোথাও দূরে যাওয়ার সুযোগ আসেনি, তার প্রধান কারণ তাদের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব একটা ভালো নয়,

তার বাবা অমল বাবু একটি মুদি দোকান চালান আর মা একটি সামান্য প্রাইভেট স্কুলে পড়ান, তাতে তাদের সংসার চলেগেলেও দুরে ট্রেনে ভ্রমণ করার মতন অর্থ সামর্থ্য তাদের ছিল না। সুমন কে বিশেষত এক্সপ্রেস ট্রেন গুলোই বেশি আকর্ষণ করে, তার বহুদিনের ইচ্ছে ট্রেনের ফাস্ট এসি তে করে কোথাও যাওয়ার, কিন্তু যেখানে স্লিপারের সামর্থ্যই তার পরিবারের নেই সেখানে এসি কম্পার্টমেন্ট তার কাছে একটি অবাস্তব স্বপ্ন ব্যতীত আর কিছুই নয়। সুমনের জীবনের একটিমাত্র লক্ষ্য যে কোনো মূল্যেই তাকে রেলে চাকরি পেতেই হবে, এবং নিজের ওপর তার যথেষ্ট ভরসা আছে। সব কিছু ভালোই এগোচ্ছিল দেখতে দেখতে মাস, বছর গড়িয়ে সুমন স্কুল ছেড়ে পা রাখলো তার কলেজ জীবনে, কিন্তু ওইযে কথায় আছে ঢেকি স্বর্গে গিয়েও ধান ভানে, তার স্কুলের সহপাঠী অভিষেক, সহ তাদের আরো বন্ধুরা তখনো তার পেছন ছাড়েনি, সেই স্কুল লাইফ থেকে এখন কলেজ লাইফ তাকে প্রতিটি মুহূর্তে তারা অপদস্থ করার সুযোগ হাতছাড়া করেনা, সেদিনই তো ভ্যালেন্টাইন্স ডের দিন কলেজ ক্যাম্পাসে সবাই সবার প্রেমিক প্রেমিকা কে নিয়ে আড্ডা দিচ্ছিল, সে সেখানে একা যেতেই রনিত তাকে কটাক্ষের সুরে বলে উঠেছিল “কিরে তোর গার্লেফ্রন্ড কোথায় ?

“আরে ওর গার্লেফ্রন্ড তো ভাগীরথী এক্সপ্রেস, সে এখানে কিকরে আসবে বল রনিত, চল আমারা বরং চাদা তুলে ওর ভাগীরথী গার্লেফ্রন্ডের জন্য কলেজ ক্যাম্পাস পর্যন্ত রেল লাইন করেদি যাতে ও ওর প্রেমিকা কে এনে আমাদের মতন প্রেম করতে পারে, ওর ও তো কষ্ট হয় নাকি রে হা হা হা “” বলে সবাই সুমন কে হাসির মাধ্যম করে অভিষেক রনিত সব আরো অন্যান্যরা একত্রে ব্যঙ্গের হাসিতে মেতেছিল । সেদিন সুমন একটুও মন খারাপ করেনি, কারন এইসব তার অনেক আগে থেকেই সহ্য করার অভ্যাস ছিলো, সে সর্বদা ডুবে থাকতো তার পড়াশোনা আর তার ট্রেনের জগৎ এ। প্রেমের গান না বরং ট্রেনের হর্ন, ট্রেনের আওয়াজ তার মনে উন্মাদনা আনতো, এইভাবেই এইভাবেই চলছিল বেশ, হঠাৎ করে হলো একটু ছন্দ পতন, কলেজের ফাস্ট ইয়ারের সুনন্দা বলে একটি মেয়ের সৌন্দর্য তাকে আকর্ষিত করে, একদিন তাকে সে সবার সামনে বলে ফেলেছিল তার মনের কথা, কিন্তু আগেথেকে অভিষেক দের সাথে ষড়যন্ত্রকারী সুনন্দা সেদিন সবার সামনে সুমন কে অপমান করে বলেছিল “”তোর সাথে আমার সম্পর্ক কিভাবে হতে পারে তুই তো একটা সাইকো, নাহলে আবার কেউ ট্রেনের প্রেমে পড়ে? তুই বরং এক কাজ কর শিয়ালদহ স্টেশনে চলে যা ওইখানে একটা ট্রেন কে প্রোপোজ কর, আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোকে বিয়ে দেব””।

এহেন অপমানের পরে সুমনের ট্রেনের প্রতি ভালোবাসা না কমে বরং অনেকগুন বেশি বেড়ে গেছিল, এবং সে প্রতিজ্ঞা করেছিলে এই ট্রেনের মাধ্যমেই সে দেবে এই সমস্ত অপমানের জবাব। এই ভাবে চলে গেছে অনেকগুলি বছর, অনেক বাঁধা কাটিয়ে সুমন চৌধুরি আজ একজন লোকো পাইলট। আজ সন্ধ্যা থেকে তার তাড়াহুড়ো একটু বেশিই দেখে তার মা কমলা দেবী বেশ রেগে উঠে ধমক দিলেন ছেলেকে “”এই এতো তাড়াহুড়োর কি আছে রে?”” “”না মা আজ 8টা 35এর কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসে আমার ডিউটি তো তাড়াতাড়ি করবো না”” বলে সুমন কমলা দেবী কে প্রণাম করে বেরিয়ে পড়ে শিয়ালদহ স্টেশনের উদ্দেশ্যে। 9/A প্ল্যাটফর্মে ঢোকার সময় বসার সিট গুলোর দিকে তাকিয়ে হঠাৎ সে এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলো, হ্যাঁ সে ঠিক চিনেছে, এটা অভিষেক। আজ এতো বছর পর আবার দেখা। “”কিরে কেমন আছিস?””

কথাটা শুনে বেশ অবাক হয়ে মাথা তুলে তাকায় অভিষেক, ‘এই চলছে, আর তোর খবর কি?’ উত্তর দেয় অভিষেক, “”আমার খবর ভাই বিন্দাস” হেসে উত্তর দেয় সুমন। “তা কোথায় চললি? ঘুরতে? ” জিজ্ঞাসা করে অভিষেক। না রে ঘুরতে না ঘোরাতে, এই যে দাঁড়িয়ে আছে আমার গার্লেফ্রন্ড কাঞ্চনকন্যা, এনাকে নিয়ে নিউ আলিপুরদুয়ার ঘোরাতে নিয়ে যেতে হবে এখন”” উত্তর টা শুনে বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে সুমনের দিকে অভিষেক, তাকে আর ব্যাখ্যা করে বোঝাতে হয় না সুমনের পজিশন। “আচ্ছা তুই কি করছিস ? বেশ আগ্রহী হয়ে অভিষেক কে প্রশ্ন করে সুমন, “”আমি? বেকার, গ্র্যাজুয়েশন টাও কমপ্লিট করলাম না, আজ বেকার হয়ে বসে আছি””। “আর সুমনা?” আবারও প্রশ্ন করে সুমন।

“সে এখন অন্য কারো সাথে সুখে আছে, বাদ দে যাইহোক তোর গার্লেফ্রন্ড কিন্তু তোকে ছেড়ে যায়নি””। না যায়নি তো এইযে দাঁড়িয়ে আছে আমার জন্য , হো হো করে হেসে উঠলো সুমন, “”আসি রে , ভালো থাকিস”” বলে সে এগিয়ে চললো ট্রেনের ইঞ্জিনের দিকে, ইঞ্জিনের কেবিনে ওঠার আগে একবার সে পিছন ফিরলো, সমস্ত যাত্রীরা হয় তো সবাই ট্রেনে উঠে গেছে, শিয়ালদহ স্টেশনের হাজারো মানুষের কোলাহলের মধ্যেও ভেষে আছে সুমধুর কন্ঠে ‘অনুগ্রহ করে শুনবেন 13149 আপ শিয়ালদহ নিউ আলিপুরদুয়ার কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেস রাত আটটা বেজে তিরিশ মিনিটে 9/A নম্বর প্ল্যাটফর্ম থেকে ছাড়বে’। “”কি ডার্লিং রেডি তো? এসেগেছি চলো এবার”

ট্রেনের ইঞ্জিনের উদ্দেশ্যে কথাটা বলে নিজেই নিজের পাগলামি তে হেসে উঠলো সে, ঘড়ির কাটায় আটটা তিরিশ, জোরে ট্রেনের হর্নে কেপে উপলো শিয়ালদহ স্টেশন চত্বর, আজ এই ট্রেনই সুমনের সব অপমানের জবাব দিয়ে দিয়েছে। স্টেশনের একেবারের শেষ প্রান্তে বসে থাকা অভিষেক দেখতে পেল কাঞ্চনকন্যা এক্সপ্রেসের শেষ কম্পার্টমেন্টের লাল আলোটা ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হতে হতে অবশেষে দূরে রাত্রির গভীর অন্ধকারের আড়ালে মিলিয়ে গেল।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত