পরিনতি

পরিনতি

তুমি কি চাও আমি চলে যাই?

স্ত্রীর কথায় রফিক সাহেব একটু চুপ করেই রইলেন।আসলে কি বলবে হয়তো সেটাই ভাবছেন। নয়তো অন্য কিছু।রফিক সাহেব একটু চুপ থেকে বললেন,
-এই কাজটা করা কি ঠিক হবে?
রফিক সাহেবের কথায় রফিক সাহেবের স্ত্রী রাহেলা বেগম একটু রাগ দেখিয়েই বললেন,

-তোমার কি মনে হয় আমি ভুল কিছু বলেছি?
স্ত্রীর কথায় রফিক সাহেব কিছু বলেন না।বউকে একটু বেশিই ভালবাসেন তিনি।তাই বউয়ের সব আবদার সহজেই মেনে নেন।কিন্তু আজকের কথাটা শুনে রফিক সাহেব একটু অবাক হলেও তিনি ভাল করেই জানেন তার স্ত্রী এসব খুব সহজেই বলতে পারে,করতে পারে।রফিক সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে স্ত্রীকে বলেন,

-তুমি খাওয়াবে নাকি আমি?
-তোমার কিছু করতে হবে না,সব আমিই করবো।কিন্তু দেখো, কেও যেন জানতে না পারে।
রফিক সাহেব মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়।কিন্তু ভেতরটা কি বলে সেটা তিনিও বুঝতে পারেন না।

রফিক সাহেব বিয়ে করেছেন উনিশ বছর হবে।এই উনিশ বছরেও স্ত্রীর প্রতি ভালবাসা একটুও কমেনি।অন্য দিক খেয়াল না থাকলেও স্ত্রীর প্রতি তার যথেষ্ট নজর থাকে।কোনটাতে খুশি হবেন আর কোনটাতে হবে মন খারাপ।
রফিক সাহেবের প্রতি রাহেলা বেগমের ভালবাসাটাও বেশ প্রখর।বিয়ের উনিশ বছর পরেও যখন তাদের কোন বাচ্চা হচ্ছিলো না তখনও তাদের ভালবাসাটা ঠিক থাকলেও রাহেলা বেগম কেমন যেন একপেশে হয়ে যাচ্ছিলেন।
রফিক সাহেবের বাবা মারা গেছেন চার বছর হবে।ওনার মা ও বেশ অসুস্থ।ওনাদের পাশের রুমেই থাকেন।একটু বেশিই অসুস্থ বলে সারারাত ঘুমাতেও পারেন না।ছটফট করেই রাত কেটে যায়।

এদিকে শ্বাশুড়ি মায়ের রাত জাগার কারনে রাহেলা বেগমের ঘুমে বেশ সমস্যা হয়।মনে মনে শ্বাশুড়ির প্রতি রাগ দেখালেও উপরে বেশ ভালই গুছিয়ে নিতে পারেন।আর এর জন্যে রাহেলা বেগমকে সবাই পছন্দও করে।

আজ রফিক সাহেব বাসায় আসতেই রাহেলা বেগম বলেন,
-আচ্ছা রাতে আমার ঘুম না হওয়ার কারণ টা কি জানো?
-না বললে জানবো কিভাবে?
-তোমার মা।
রফিক সাহেব একটু চমকে গিয়ে বলেন,
-উনি কি করলো?
-সারা রাত কেও না ঘুমিয়ে শব্দ করলে কার ঘুম আসে বলো তো।নিজেও ঘুমায় না,অন্যকেও ঘুমাতে দেয় না।
-অসুস্থ বলে এমন হচ্ছে।একটু মানিয়ে নাও।
-পারবো না। তার চেয়ে বরং ঘুমের ওষুধ খায়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেবো।

রাহেলা বেগমের কথায় রফিক সাহেব এবার বেশ ভালই অবাক হন।যেখানে ডাক্তার নিজে ঘুমের ওষুধ দিতে নিষেধ করেছেন সেখানে উনি কিভাবে দেবেন।এতে করে মায়ের সমস্যা আরও বেড়ে যাবে।

কিন্তু রফিক সাহেব স্ত্রীর ইমোশনাল ব্লাকমেলের শিকার হয়ে আর বাধা দিতে পারেন নি।ওনার কাছে স্ত্রীই সব।

স্ত্রীর কথায় রফিক সাহেব এখন নিজের মা কেও বেশ খারাপ ভাষায় গালি দেন।যেটা শুনে রফিক সাহেবের মা হাসিনা বেগম নীরবে চোখের জল ফেলে।যে ছেলেকে এত কষ্ট করে বড় করেছেন,মানুষ করেছেন,সে কি আদও মানুষ হয়েছে,এসব ভাবতেই হাসিনা বেগমের চোখে জ্বল চলে আসে।কোনকিছু বলতেও পারেন না।কিন্তু মনে মনে আল্লাহর কাছে কি বলেন সেটা উনি ছাড়া কেও বলতে পারবেন না।

হাসিনা বেগম আর কথা বলতে পারেন না।খাওয়াতে হয় পাইপের মাধ্যমে।এত অসুস্থ হওয়ার পরও রাহেলা বেগমের এরকম নীরব নির্যাতন বন্ধ হয়নি।মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়া হাসিনা বেগমকে এখনও ঘুমের ওষুধ খায়িয়ে দেন।যাতে করে আপদটা একটু তাড়াতাড়িই বিদেই হয়।এসব দেখে রফিক সাহেব কিছু বলেন না।বউয়ের প্রতি অন্ধ ভালবাসায় উলটো নিজের মা কেই গালি দেন।

হাসিনা বেগম মারা গেছেন মাস দুয়েক হবে।অবশ্য এটাই চেয়েছিলেন রাহেলা বেগম।রফিক সাহেবও যে স্ত্রীর পক্ষেই ছিলেন।

হাসিনা বেগম মারা যাওয়ার পর রাহেলা বেগম বেশ পালটে যেতে শুরু করে।রফিক সাহেবের সাথে এমনিতেই ঝগড়া করে দু দিন পর পর বাবার বাড়ি চলে যান।আর যাওয়ার আগে ব্যাগ বোঝাই করে যেগুলা নিয়ে যান, তিনি ফিরে আসলেও সেগুলা আর ফিরে আসে না।

রাহেলা বেগম এবার রাগ করে চলে গেছেন মাস খানেক হবে।রফিক সাহেব অনেকবার নিয়ে আসতে গেলেও উনি আসেননি।তবে ডিভোর্স পেপারটা ঠিকই পাঠিয়ে দিয়েছেন।

রফিক সাহেব ডিভোর্স পেপার হাতে পেয়ে কি করবে বুঝতে পারে না।চোখটা এমনিতেই ভিজে উঠে।যার জন্যে সবকিছু করলো সে যদি আজ এমন করে তাহলে কার বা ভাল লাগবে।স্ত্রীর জন্যে নিজের মা কেও খারাপ কথা বলতে ছাড়েনি।আর আজ সেই স্ত্রীই ডিভোর্স পেপার পাঠিয়েছে।

রফিক সাহেবের ডিভোর্স হওয়ার পর বেশ ভেঙে পড়েছিলেন।যাকে নিজের মায়ের থেকেও বেশি ভালবাসতেন সেও আজ অনেক দূরে।অনেক দূরে।

কিছুদিনের মাঝেই রফিক সাহেব বাথরুমে পিছলে পড়ে গিয়ে স্ট্রোক করেন।যার দরুন মাত্র কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে তার ডান সাইড পুরো প্যারালাইজড হয়ে যায়।মুখ বেকে যায়।কথা বলতে পারেন না।ইচ্ছে করলেও আর উঠে দাঁড়াতে পারেন না পায়ে শক্তি পান না বলে।

দু দিন আগেও যার সব ছিল সে আজ পুরো একা।মা,বাবার পর স্ত্রীকেও হারিয়েছেন।ছেলে মেয়ে না থাকায় পুরো একা হয়ে গেছেন।

সারাদিন বিছানায় শুয়েই রফিক সাহেবের দিন কাটে।বাম হাত দিয়েই রফিক সাহেবকে এখন সবকিছু করতে হয়।খাওয়া থেকে শুরু করে বাথরুম পর্যন্ত সবকিছুতেই এখন বাম হাতই সম্বল।

রফিক সাহেবের কাছে এখন আর কেও আসেনা।সপ্তাহ খানেক আগে রাহেলা বেগমের ও বিয়ে হয়ে গেছে।সেটা নাকি প্রেমের বিয়ে।

এসব শুনে রফিক সাহেব কিছু বলতে পারে না।কিভাবে বলবে,যে মুখে নিজের অসুস্থ মা কে গালি দিত সে মুখ তো এখন বেকে গেছে।কথা বলতে পারে না।ঘুমের ওষুধ খায়িয়ে দেওয়া হাতটাও আজ নাড়াতে পারে না।হয়তো এটা ছিল ছেলের প্রতি হাসিনা বেগমের ক্ষোভ।যখন কথা বলতে পারতেন না তখন হয়তো আল্লাহর কাছে মনে মনে এটাই চেয়েছিলেন হাসিনা বেগম।

রফিক সাহেব এখন সারাদিনই শুয়ে শুয়ে কান্না করে আর মায়ের প্রতি অবিচার বুঝতে পেরে চিৎকার করে বলতে চায়,আমার মা নেই,আমার বাবা নেই।রফিক সাহেব তার ভুল বুঝতে পেরেছে তবে সেটা বেশ দেরিতে।রফিক সাহেবকে দেখে আমরা আপনারা অনেক কিছু শিখতে পারি।তার ভুলগুলো যদি আমাদের মাঝে থাকে সেটাও শুধরে নিতে পারি।কিন্তু মা বাবার সাথে খারাপ আচরন ওনারা সহ্য করলেও আল্লাহ সহ্য করেন না।কোন ভাবেই না,কোন মতেই না।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত