এটাই বোধহয় ভালোবাসা

এটাই বোধহয় ভালোবাসা

” স্যার এই ফুলডা আপনার লাইগা একটা আফা দিয়া গেছে।” হাতে জবা, নীলকণ্ঠ, গোলাপ, নয়নতারা আর বেগুনী ঘাস ফুল দিয়ে একটা ফুলের গোছা হাতে দারোয়ান দাঁড়িয়ে। মুহুর্তে হতবাক হয়ে গেলো নিয়ন।

আজ তার জন্মদিন এটা অফিসের কারো জানার কথা না। নিজের ব্যক্তিগত জীবন সে একান্ত ই নিজের করে রাখতে চায়। এমনকি জন্মদিন ও।

” যে দিয়েছে সে কি নাম বলেছে?”

” না স্যার।” তার চুল কি অনেক লম্বা ছিলো?”

” না স্যার চুল ত অনেক ফ্যাশন কইরা কাডা ছোডো ছোডো। কিন্তু স্যার দেখতে হুরপরীর লাহান।” মোতালেব ওই আপা কি শাড়ি পরে এসেছিলো লাল রঙের?”

” না স্যার সালোয়ার কামিজ পরা। তয় স্যার লাল রঙের সালোয়ার কামিজ।” মুখে কি কোনো তিল ছিলো?”

জি স্যার এইবার মিলছে মুখের ডাইন সাইডে বড় একখান তিল আছে।” আচ্ছা তুমি যাও।”

নিয়ন চুপ করে কিছুক্ষণ বসে রইলো। তার আজ জন্মদিন আর এই ফুলের তোড়া পাওয়া সব মিলিয়ে একজন কে ই ইংগিত দেয় কিন্তু এটা সম্ভব না। কারণ নিয়ন জানে সে মৃত। এই মেয়ের সাথে ও তো তার মিলছে না শুধু তিল টা ছাড়া। শানুর ছিলো লম্বা কোমর পর্যন্ত ছড়ানো চুল। প্রতি জন্মদিনে লাল শাড়ি পরে নিজের হাতে বানানো বাগানের ফুল দিয়ে তোড়া নিয়ে নিয়ন কে শুভেচ্ছা জানাতে আসতো শানু।সেই ছোট্ট মেস বাড়িতে।

মেসের আর সবাই বলতো, মিয়া মেয়েছেলে নিয়া আসবেন না তো মেসে। এত্ত গুলা ছেলে র মাঝে আপনার রুমে মেয়ে আসলে লোকে খারাপ কথা কইবে।

নিয়ন হেসে বলতো, কি করবো বলেন তো এই পাগলি মেয়েটা ত কথা শুনে না। আমার রুমে এসে সব গুছিয়ে পরিষ্কার করে আমার জন্য রান্না না করলে নাকি ওর দিন অপূর্ন থেকে যায়। আমি কত বুঝিয়েছি লোকে কি বলবে? কিন্তু তার নাকি কিছুই যায় আসে না। কি পাগল ই না ছিলো শানু। কোমলমতি কিন্তু বড্ড সাহসী। মেসের সেই ছোট্ট রুমে যেদিন আলতো করে কপোলে চুমু খেয়েছিলো নিয়ন কেঁদে ফেলেছিলো শানু। চোখ ফুলিয়ে ভাঙা ভাঙা কন্ঠে হেঁচকি দিতে দিতে বলেছিলো,

” সারা জীবন কিন্তু আমাকে এভাবে ভালোবাসতে হবে আদর করতে হবে নাহলে কিন্তু অভিশাপ দিলাম ওই ঠোঁট তুমি আর কারো কপোলে ছোঁয়াতে পারবে না।”

হাসি পায় নিয়নের। শানুর অভিশাপ কাজে লেগেছে। শানু চলে যাওয়ার পর আর কারো কপাল সে খুঁজতে যায় নি আদর করার জন্য।

মনে মনে শুধু প্রচন্ড তেষ্টা ছিলো আরেক বার যদি কোনোদিন শানুর কপালে ঠোঁট ছোঁয়ানো যেত! কিন্তু এত অসম্ভব। শানু তো নেই। হাতে ফুলের গোছাটা নিয়ে বাসার দিকে এগোয় নিয়ন। কে ফুলটা দিলো? ঠিক শানুর মতন?

নিয়ন এখনো সেই মেস বাড়িতে ই থাকে। সেই রুমটাতেই। চারপাশে কত্ত অট্টালিকা তার মাঝে নিয়নের মেস। সবাই যখন অট্টালিকা বানাতে ব্যস্ত নিয়ন তখন এই মেস বাড়ি টাই কিনে ফেলে শুধুমাত্র বাড়ি টাকে ঠিক আগের মতন অক্ষুণ্ণ রাখতে।

এত বড় চাকরি নিয়নের। তাকে নিয়ে মানুষের কত অভিযোগ। কত কিপটে সে! কত থার্ডক্লাস। একা একা থাকে বিয়ে শাদি ও করে না । এত বড় চাকরি করে ও এরকম একটা বাড়িতে একটা ছোট্ট রুমে থাকে। কিন্তু সত্যি টা কেও জানে না।

এই মেস টা এই রুম টা যে শানুর অজস্র স্মৃতিমাখা। সে স্মৃতি সে কোনো দিন ও মুছতে চায় না। মানু্ষের শত কটাক্ষ ও তার কাছে নিদারুণ নগণ্য। মেসে ফিরে নিয়ন দেখতে পায় রুম খোলা। অবাক হয় সে রুম ত খোলা থাকার কথা নয়। সে নিজে সকালে তালা লাগিয়ে গিয়েছিলো।

আর কারো কাছে চাবি ও নেই। এই তালার দুটো চাবি একটা তার কাছে। আর একটা ছিলো শানুর কাছে। হাস্যকর হলে ও সত্যি গত দশ টা বছর সে তালাটা বদলায় নি। তার অবচেতন মন বলতো যদি কোনোদিন শানু আসে। কিন্তু শানু তো আসতে পারবে না তা সে জানে তাও মিথ্যে স্বান্তনা। কিন্তু দরজা খুললো কে?

আস্তে করে রুমের ভেতরে ঢুকে নিয়ন দেখে তার রুম টা ঝকঝকে তকতকে। পরিষ্কার বিছানার চাদর বিছানো। কাপড় সব ভাজ করে রাখা।

টেবিলের উপর ঢেকে রাখা চার পদের তরকারি ভাত। এসব কে করলো?

খাবারের ঢাকনা খুলে দেখে পুডিং বানিয়ে রাখা তাতে ক্রিম দিয়ে লেখা ” শুভ জন্মদিন আমার তুমি”

এই কথাটা এক মাত্র শানু ই তো বলতো। তার প্রতিটি চিঠির প্রথমে লেখা থাকতো ” আমার তুমি” আর শেষে ” তোমার আমি”।

দম বন্ধ লাগছে নিয়নের। এসব কি করে সম্ভব শানু তো মারা গেছে। তা ও অনেক দিন হলো। গুণে গুণে দশ বছর।

পেছন থেকে দরজা বন্ধের আওয়াজ পেয়ে তাকিয়ে দেখে নিয়ন দরজা বন্ধ করে সামনে দাঁড়িয়ে আছে লাল সালোয়ার কামিজ পরা ছোট চুলের একজন রমনী যার ডান গালে বড় তিলটি তার পরিচয় বহন করছে।

শানু দাঁড়িয়ে আছে নিয়নের সামনে। প্রচন্ড আতংকে জ্ঞান হারায় নিয়ন। মিনিট পনেরো চোখমুখে পানির ঝাপটা দেয়ার পর চোখ খুলে আবারো শানুকেই দেখে নিয়ন। তাড়াতাড়ি করে শানু বলে উঠে, ওগো আমি ভূত নই। আমি সত্যিই তোমার শানু। আমাকে ছুঁয়ে দেখো।”দশ বছর পর শানুর ছোঁয়া নিয়নের ভেতর টাকে কাঁপিয়ে দিলো।” কিন্তু এ কিভাবে সম্ভব? ” শানু কিছুক্ষণ চুপ করে তারপর ধরা গলায় বলে, তুমি আমাকে যা খুশি ভাবতে পারো কিন্তু তোমাকে সত্য টা আমি সব বলবো। তোমাকে হজম করে নিতে হবে। কি সত্যি আমি শুনতে চাই।

শুনো। আমি তোমার সাথে দেখা করে বাসায় যাওয়ার পর বাবা আমার বিয়ের জন্য উঠে পড়ে লাগে। আমি বার বার ভেটো দিতে থাকি। বাবা ও এক সময় চুপ হয়ে যায়। বাবার কাছে তখন আমার বাহিরে স্কলারশিপ নিয়ে পড়তে যাওয়ার কথা বলি বাবা রাজি ও হোন। পাসপোর্ট ও করে ফেলি। কিন্তু বাবার কথা বাহিরে যেতে হলে নিজের বরের সাথে যেতে হবে। আমি তখন তোমার কথা বাবাকে বলি। বাবাকে বলি তুমি ত দেশেই সেটেল তোমার বাহিরে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। আর আমি পড়া শেষ করে এসেই তোমাকে বিয়ে করবো। বাবা সব শুনে কিছু না বলে চুপচাপ থাকলেন। তিনি কিছুতেই মেয়ের প্রেমের বিয়ে দিয়ে সমাজের কটাক্ষ সহ্য করতে পারবেন না। তার উপর যে ছেলে এতিমখানায় বড় হয়েছে তার সাথে ত কিছুতেই না।

তাই এরই মাঝে তিনি ভেতরে ভেতরে আমার জন্য ছেলে দেখতে লাগলেন। একটা ছেলে বাবার মনে ও ধরে গেলো। একদিন ছেলে পক্ষ বাসায় এসে হাজির। বাবা মা দুজন ই আমার সামনে এসে বললো আমি যদি বিয়ে না করি তাহলে আমার সামনে ই তারা আত্মহত্যা করবে। আমি এত কাঁদলাম কিন্তু কোনো লাভ ই হলো না। জানো আমি কবুল বলি নি তাও হইহই রব উঠলো, আলহামদুলিল্লাহ মেয়ে কবুল বলেছে।

বাবা আমার হাতের উপর হাত ঘুরিয়ে আমাকে সাইন করতে বাধ্য করলো। আমি জানতে পারলাম সেদিন ই রাত বারোটায় আমার লন্ডন যাওয়ার ফ্লাইট বর সহ।

আমি চলে গেলাম দূরদেশে। যাওয়ার আগে শুনে গেলাম বাবা আমার মৃত্যুর সংবাদ জানিয়ে তোমাকে চিঠি দিবে। আমি ভাবলাম আসলেই তো এ তো আমার মৃত্যুই। আমার বিয়ের খবর এর চেয়ে আমার মৃত্যুর খবর শোনাই তোমার জন্য ভালো। অন্তত আমাকে ঘৃণা করে তোমাকে বেঁচে থাকতে হবে না।”

” এত দিন পর তাহলে কেনো এলে? মৃত থেকে কেনো জীবিত হলে?”

” মৃত মানুষ হিসেবে দশ টা বছর কাটাতে কাটাতে আমি ক্লান্ত হয়ে গেছি। লন্ডনে যাওয়ার পর ই আমার যার সাথে বিয়ে হয়েছে সে টের পায় আমার মনে আরেকজনের বসবাস। সে যতই আমার কাছে আসার চেষ্টা করেছে আমি তার কাছ থেকে আরো দূরে সরে গিয়েছি।

স্বামীর অধিকার নিয়ে অনেকবার ই সে আমার শরীর চেয়েছিলো। তাকে আঘাত করে ক্ষত বিক্ষত করেছি কত বার। শেষে সে আমার কাছে ডিভোর্স চায়। কিন্তু সেখানে ডিভোর্স চাইতে গেলে অনেক ঝামেলা আর অনেক টাকা পয়সার ব্যাপার তাই আমরা আলাদা থাকতে শুরু করি। এরই মাঝে আমি আবার পড়াশুনা শুরু করি। পার্ট টাইম জব করি। দেশে ফেরার কোনো ইচ্ছে আর আমার ছিলো না। সেটেল ও হয়ে গেলাম মোটামুটি। বাবা মার প্রতি অভিমান। তোমাকে চোখ দেখাতে না পারার লজ্জা সব মিলিয়ে জীবন টার কাছে আমার আর কোনো চাওয়া ছিলো না। ভেবেছিলাম তুমি বুঝি আমাকে ভুলে নতুন করে জীবন টা শুরু করেছো। দশ টা বছর কিভাবে যে কেটে গেলো আমার জীবন থেকে তা শুধু আমি জানি। এক মৃত মানুষের বেঁচে থাকাটা কতটা যন্ত্রণাদায়ক তা শুধু আমি ই জানি।

প্রতি রাতে ঘুমানোর আগে তোমাকে একটা করে চিঠি লিখতাম। আর চিঠিগুলো জমিয়ে রাখতাম। খুব ইচ্ছে করতো তোমাকে পাঠাই। কিন্তু মৃত মানুষ ত কোনোদিন কোনো চিঠি পাঠাতে পারে না। তাই আমি ও পারি নি।”

” তো ফিরলে কেনো?”

” গত মাসে কার এক্সিডেন্ট এ বাবা মা দুজনই মারা যান। হাসপাতালে যখন বাবা কে নেয়া হয় মৃত্যুর আগে তার শেষ ইচ্ছে ছিলো তার মাটি দেয়ার সময় যেনো তার মেয়ে থাকে আর তার মেয়ে যেন তাকে ক্ষমা করে দেয়।

এক মৃত মানুষ এলো আরো দুজন মৃত মানু্ষের কবর দেয়ার সময় থাকতে। হিমঘরে বাবা মাকে দেখে চিৎকার করে কাঁদার সময় আমি আবিষ্কার করলাম আমি এখনো বেঁচে আছি। আমার চোখে এখনো জল আছে।

তারপর তোমার খোঁজে আসলাম। সেই মেস বাড়িতে। তুমি এখনো এখানে আছো কি নেই এত চিন্তা মাথায় ঘুরঘুর করছিলো! চাবি টা আমার কাছে ই ছিলো জানো। দেখলাম সেই চাবিটা দিতে ই তোমার তালা খুট করে খুলে গেলো। আমি ঢুকলাম সেই চিরচেনা ঘরে। তার মানে তুমি এখনো এত গুলো বছর এখানেই আছো। আমি তোমার ঘরে প্রথম ঢুকি দিন পনেরো আগে। তোমার রোজকার ডায়েরী পড়ি। প্রতিটা দিন তুমি তোমার শানুকে ভালোবাসা জানিয়ে এত্ত গুলা কথা লিখো। সে মৃত জেনে ও। তোমার প্রতিটি ডায়েরীর প্রতিটি পাতা গত পনেরো দিনে আমি তোমার না থাকার সময়ে পড়ে শেষ করেছি। সিদ্ধান্ত নিয়েছি জীবিত হয়ে তোমার সামনে উপস্থিত হব। তা তুমি যেভাবেই নাও না কেনো। তোমার জন্মদিন সামনে এসে পড়ায় এদিন টাই ঠিক করলাম আমার জীবিত হওয়ার জন্য। নিয়ন কাঁদছে। শানু কাঁদছে। বহু বছরের কষ্ট বিলীন করার কান্না।

নিয়ন অনেকক্ষণ বাদে আস্তে আস্তে বললো, তোমাকে একটা কথা বলবো রাখবে? আমাকে আবার মৃত হয়ে যেতে বলবে না তো। নিয়ন শানুর মুখে হাতচাপা দিয়ে বললো,  চুপ করো! তোমার কপোলে একটু আমার ঠোঁট টি ছোঁয়াতে দিবে?

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত