পুরোনো চিঠি

পুরোনো চিঠি

ছেলেটাকে স্কুলে পৌছে দিয়ে রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলো স্বর্না। হঠাৎ রাস্তার পাশে একটা ডাস্টবিনের চিপায় একটা চিঠির খাম দেখলো।

খামটা বেশ পুরোনো দেখেই বুঝা যাচ্ছিলো। কিন্তু, খামের উপরে লেখা নাম দুটোই স্বর্নার বেশ পরিচিত।

খামের উপরে লেখা ছিল রাসেল লাভ উইথ স্বর্না।

চিঠিটা হাতে নিয়ে বাসায় ফিরে এলো সে।

বাসায় এসে চিঠিটা খুলে পড়তে লাগলো, কিন্তু যত-ই পড়তে লাগলো তত-ই তার চোখ থেকে জল গড়িয়ে পড়তে লাগলো।

গল্পটা শুরু হয়ে ছিল আরো ৫ বছর আগে, যখন সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তো। এই সেই রাসেল এক সময় যে তার সব থেকে কাছের বন্ধু ছিলো।

ক্রমশ-ই অতীত গুলো স্বর্নার সামনে ভেসে উঠতে লাগলো।
..
মাথায় মার্কার পড়তেই ঘুম ভেঙ্গে গেল, আর ঘুম ভাঙ্গতেই নিজেকে এক ভিন্ন গ্রহে আবিষ্কার করলো রাসেল।

পরে বুঝতে পারলো এটা ভিন্ন গ্রহ নয় এটা তার ক্লাস রুম।

ম্যাডামের বোরিং লেকচার শুনতে শুনতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছে টের-ই পায়নি।

অতঃপর প্রতিদিনের মত আজকেও ক্লাস থেকে বের হয়ে যেতে হলো তাকে।
..
তবে আজকে বের করাতে কিন্তু বেশ ভালোই হয়েছে। নীরা তার জন্য অনেক সময় ধরে লেকের ধারে বসে আছে।

নীরার সাথে ১২ টা বাজে দেখা করার কথা, এখন ১২:৩০ বাজে।

নীরার সাথে ২ মাস হলো রিলেশনের আর এ ২ মাসে যতবার-ই দেখা হয়েছে, ঠিক ততবার-ই কোন না কোন কারণে দেরি হয়েছেই,

আর প্রতিবার-ই এটার জন্য নীরার ঝাড়ি শুনতে হয়।
..
ঘড়ির সময় দেখতে দেখতে ক্যাম্পাসের শেষের রাস্তাটা ধরে হেটে গিয়ে রিক্সার জন্য দাড়ালো রাসেল….,

হঠাৎ পাশ থেকে একটা মেয়ে এসে সরাসরি বলে উঠলোঃ
— ভাইয়া, ৫০ টাকা দিনতো।
— মানে?
— আরে, ভাইয়া দিন নাহ, একটু বিপদে পড়েছি, আমি ভুলে টাকা বাসায় ফেলে চলে এসেছি, এখন রিক্সা ভাড়া দিতে পারছি নাহ।

আপনি আমায় ৫০ টাকা ধার দিনতো। আমি পরে আপনার টাকাটা দিয়ে দিবো।
..
আর কোন কথা না বলে পকেটে হাত ডুকাতেই ৫০ টাকা বেরিয়ে এলো। যদিও তখন এটাই রাসেলের শেষ সম্বল ছিলো।

তবুও কি আর করার, একটা বিপদে পড়া মানুষকে সাহায্য করাটাও জরুরি।

অতঃপর ৫০ টাকা দিতেই মেয়েটি রাসেলকে দাড়াতে বলে রিক্সাওয়ালা মামাকে টাকাটা দিতে চলে গেলো।

এর মাঝে রাসেল পকেট থেকে মোবাইলটা হাতে নিতেই দেখে ২৪ মিসড কল। তখনি বুঝে ছিলে আজকে কপালে শনি আছে।

কল দিতে গেলো, কিন্তু দেখলো মোবাইলে টাকা নেই। কি আর করার পকেটেও তখন কোন টাকা ছিলো নাহ।
..
লেকের ধারে যেতে হেটে যেতে প্রায় ৩০ মিনিট লাগে, রিক্সায় হলে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া যেত।

কিন্তু পকেটে তো টাকা নেই, তাই হেটেই লেকের ধারে পোঁছাল, আর গিয়ে দেখলো নীরা সেখানে নেই।

তাই হতাশ হয়ে হেটে হেটে বাসায় ফিরে এলো রাসেল।

আর এসেই মোবাইলে টাকা রিচার্জ করে নীরাকে কল দিলো।

অতঃপর নীরা সুন্দর ভাবে ফোনটা রিসিভ করে রাসেলকে এক বালতি কথা শুনিয়ে দিলো…..,

আর সরাসরি বলে দিলো আর যেনো কখনো তাকে ডিস্টার্ব না করে।

আর কথা গুলো এমন ভাবেই বলেছে যে আর কোন কথা বলার সাহস পায়নি রাসেল। আর নীরা আর রাসেলের গল্পটার সেখানেই সমাপ্তি হয়।
..
রাসেলে মন খারাপ ছিলো বলে বেশ কিছুদিন ক্লাসে যায়নি। সপ্তাহ খানেক পর মোটামুটি আবার সব ঠিক হয়ে গেলো।

পরের দিন ক্লাসে যখন ডুকতে যাবে ঠিক তখনি রাসেল একটা অপরিচিত কণ্ঠ শুনে থমকে গেলো। পেছন থেকে কে যেনো বলে উঠলোঃ
..
— হ্যালো মিস্টার আপনার টাকাটাতো আর নিলেন নাহ, এই নিন আপনার ৫০ টাকা,

সত্যি সেদিন আপনি সাহায্য না করলে অনেক সমস্যায় পড়ে যেতাম অনেক অনেক ধন্যবাদ।
..
(পেছন ফিরে তাকাতেই দেখলো এটা তো সেই মেয়েটিই)
..
— আপনাকে স্বাগতম, টাকাটা ফেরত দিয়ে লজ্জা দিবেন নাহ। আপনি দিতে চেয়েছেন এটাই যথেষ্ট। ভালো থাকবেন আসি।
— শুনুন, তাড়া আছে নাকি বেশী?
— নাহ, কেনো?
— নাহ, ঠিক ভাবে কথা না বলেই চলে যাচ্ছেন যে তাই বল্লাম, আরকি।
— ওহ, না এমনিই।
— ওইদিন চলে গেলেন যে দাড়াতে বলার পরেও?
— একটু তাড়া ছিলো, তাই।
— ওহ, তো আপনার সাথে তো পরিচয় হয়নি, আমি স্বর্না অনার্স ১ম বর্ষ (রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ)।
— ওহ, আমি রাসেল, আমি ও এক-ই ক্লাসেই পড়ি।
— ওহ, তাই তাহলেতো তুমি করে বলাই যায়।
—হুম, কিন্তু ক্লাস শুরু হয়েছে ২ মাস আগ থেকে কিন্তু তোমায় কখনো দেখিনিতো।
— আমি, তোমার সাথে যেদিন প্রথম দেখা হয়েছে, সেদিন ই প্রথম ক্যাম্পাসে এলাম, তাই দেখোনি হয়তো। কিন্তু তুমি এই কয়দিন ক্লাসে এলেনা যে?
— রাসেল তখন স্বর্নাকে সব খুলে বললো।
..
আর এভাবেই শুরু হয়ে ছিলো রাসেল এবং স্বর্নার বন্ধুত্ব, আর দিন যত-ই বাড়তে লাগলো তাদের বন্ধুত্ব ও গভীর হতে লাগলো।
..
দেখতে দেখতে প্রায় ২ বছর কেটে গেল।

আর এর মধ্যে রাসেল লক্ষ করলো, স্বর্নাকে কেন যেনো তার খুব ভালো লাগতে শুরু করলো,

স্বর্নাকে একটা দিন না দেখলে যেনো তার দিনটা খারাপ কাটে।

আর প্রতিটা রাততো কাটেই স্বর্নার কথা ভেবে, তাহলে কি রাসেল স্বর্নার প্রেমে পড়েছে গেছে? হ্যা, ঠিক তাই।
..
অনেক ভাবার পর রাসেল সিদ্ধান্ত নিলো স্বর্নাকে তার মনের কথা গুলো বলা দরকার। কিন্তু কিভাবে বলবে বুঝতে পারছে নাহ।

বার বার বলতে গিয়ে ব্যর্থ হলো।

অতঃপর সারারাত ধরে ভাবছে, কাল যেভাবেই হোক বলতে হবে।

যেই কথা সেই কাজ, সকাল হতেই স্বর্নাকে কল দিয়ে ক্লাস শেষে কফিশপে দেখা করতে বললো।

ভেবে ছিলো সে একা আসবে আর তখনি সব মনের কথা খুলে বলবে। কিন্তু স্বর্নার সাথে তার ২টা বন্ধবি এসে সব নষ্ট করে দিলো।
..
— কিরে, এতো জরুরী তলপ কেন হঠাৎ?
..
(উত্তরে কি বলবে কিছু খুঁজে না পেয়ে,)
— তোর নোট খাতাটা আমায় দেতো, আমি কিছু টপিক্স মিস করেছি যে, ওগুলো নোট করে নিতে হবে।
— ওহ, এই কথা। এইনে ধর।
..
শেষ পর্যন্ত নোট খাতাটা নিয়ে হতাশ মনে বাসায় ফিরে এলো রাসেল। হঠাৎ, মাথায় একটা বুদ্ধি এলো,
শেষ পর্যন্ত একটা চিঠিতে তার সব মনের কথা লিখলো, আর চিঠিটা স্বর্নার নোট খাতার ভেতরে রেখে দিলো।

ভেবেছে বাড়িতে গিয়ে খাতাটা খুললেই স্বর্না দেখতে পাবে।
..
পরের দিন বাসায় ফেরার সময় স্বর্নার খাতাটা ফেরত দিয়ে বাসায় ফিরলো। সারারাত ঘুমাতে পারেনি, না জানি স্বর্না কি বলবে কাল।
..
পরের দিন কাসে যেতেই স্বর্না বলে উঠলোঃ
— তোর জন্য একটা খুশির সংবাদ আছে।
..
(রাসেল মনে মনে বুঝে নিলো নিশ্চিত স্বর্না আমাকে ভালোবাসে,তবুও জিজ্ঞাস করলোঃ)
— কি?
— দোস্ত আমারতো বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে, ছেলে বিমান বাহিনীতে জব করে, কিছু দিন আগেই ঠিক হয়েছে কিন্তু তোকে বলিনি।

ভেবেছি তোকে সারপ্রাইজ দিবো, তাই রাতে গায়ে হলুদ আর তোকে এখন বললাম। যা তাড়াতাড়ি বাসা থেকে রেডি হয়ে আমায় বাসায় আয়।
..
তখন আর রাসেলের মুখে কোন কথা ছিলো নাহ, নিজের মত বক বক করে, চলে গেল স্বর্না।
..
তার মানে স্বর্না রাসেলের প্রস্তাবে রাজি না, তাই ওই ব্যাপারে একটা কথাও বলেনি।কথা গুলো ভাবছে আর নিরবে চোখ থেকে জল ঝরছে রাসেলের।
..
..
সেদিন-ই স্বর্নার সাথে রাসেলের শেষ দেখা হয়েছিলো। আর কখনো যোগাযোগ হয়নি।

স্বর্না অবশ্যই যোগাযোগ করতে চেয়েছিলো, কিন্তু,রাসেলের নাম্বারে আর কখনো কল ঢুকেনি। আর রাসেলকে ও কোথাও খুঁজে পায়নি।

হয়তো রাসেল সেদিন ইট, পাথরের শহরে কোন ব্যস্ততার ভীড়ে হারিয়ে গেছে।
..
চিঠিটা পড়ছে আর কাঁদছে স্বর্না।

হয়তো সেদিন যাওয়ার পথে তার ব্যাগটা না হারিয়ে ফেললে, খাতাটা হারাতো না, আর চিঠিটাও এভাবে ডাস্টবিনে পড়ে থাকতো না।

আর হয়তো এভাবে রয়ে যেতো না, কিছু না বলা কথা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত