ময়নামতি

ময়নামতি

পরিবারের চাপে হিমু নামের একটা মেয়েকে বিয়ে করেছি।একদম ফর্সা না হলেও চেহারাটা তার অনেক মায়াবী।যেন মেঘের দেশের এক মায়াবতী কন্যা! বাসর ঘরে ঢুকতেই কেমন করে তাকালো।কি আজব মেয়েরে বাবা!বরকে সালাম করা তো দূরের কথা এতটুকু সম্মান আর ভালোবাসার চোখে তাকালই না!বরং আমি খাটে গিয়ে বসা মাত্র তার কথা শুনে চমকে গেলাম!এতো সুন্দর,মায়াবতী মেয়েটা কিভাবে এতো পাষাণীর মতো কথা বলতে পারে!

-এই মেয়েটা কে?
-ও নয়নতারা আমি ওকে আদর করে নয়ন বলে ডাকি।
-ও এখানে আজ এই রুমে কেন?
-ও এখানেই থাকে!
-এখানে থাকে মানে!কি হয় আপনার!এখানে থাকবে কেনো ও?
-ও আমার মেয়ে।এখানে থাকার অধিকার ওর আছে!
-আপনার মেয়ে আছে?
-তা তো দেখতেই পাচ্ছেন!
-কেনো নষ্ট করলেন আমার জীবনটা?(পাঞ্জাবীর কলার ধরে)
-কেন?ইচ্ছের বিরুদ্ধে বিয়ে করেছি নাকি?
-না।কিন্তু আপনার সাথে বিয়ে হওয়ার আগে বাবা শুধু বলেছিল আপনার মতো ছেলেই হয় না!কিন্তু এমন ছেলে বুঝতেই পারিনি তখন।
-তা আমি কোন দিক দিয়ে আপনার লাইফ নষ্ট করলাম?
-আমি জানতাম না আপনি আগে বিয়ে করেছিলেন।কেনো ঠকালেন আমায়?
-আমি কাউকে ঠকাইনি।আমি আগে বিয়ে করিনি।

-আপনার সন্তান আছে এখানে আর জলজ্যান্ত প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও বলছেন আগে বিয়ে করেননি!এই মেয়েটা কি আকাশ থেকে পড়ছে?আমি আপনার ঘর করবোনা,আমি কাল সকালেই চলে যাবো বাপের বাড়ি।
-চলে যাওয়া আপনার ইচ্ছা তবে একটা সত্যি কথা বলতে আমি আগে কোনো বিয়ে করিনি।

-বললেই হলো!স্ত্রী ছাড়া সন্তান আসে কোথা থেকে!তাহলে নিশ্চয় এটা অবৈধ সন্তান!আগে নিশ্চয় আপনি কোনো মেয়ের জীবন নষ্ট করেছেন!এই মেয়েকে আমি এ রুমে রাখবো না।

ও নয়নকে ঘুমের মাঝে টেনে নিয়ে যাচ্ছিল এমন সময় ঠাস করে গালের উপর একটা চড় লাগালাম।সাথে সাথে নয়নকে ও ছেড়ে দিলো।গালটা রক্তবর্ণ ধারণ করেছে।চার আঙ্গুলের ছাপ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে!মেয়েটা বসে বসে ঠোট উল্টিয়ে কাঁদছে আর গাল ফুলে গেছে।একদম বাচ্চা মেয়ে মনে হচ্ছে!
-শোনো!

-আপনার সাথে আমার কথা নাই।আপনি মারছেন আমায়।আজ অব্দি শুনেছেন কাউকে বাসর ঘরে বউকে চড় মারতে?আরে পাগলেও তো বউ চিনে!

কথাটা শুনে হাসি পেলেও হাসি চেপে বললাম

-সরি।আর তুমি একবারও কি ঠাণ্ডা মাথায় জানতে চাইছিলে যে ও কোথা থেকে এলো?কিভাবে এলো?সেই তখন থেকে শুধু রিয়েক্ট করে যাচ্ছ।এই বাচ্চা মেয়েটাকে টেনে বের করে দেয়ার আগে এগুলা জানার প্রয়োজন মনে হয়নি?

-আচ্ছা বলেন কে ও?কিভাবে এলো!

-তিন বছর আগের কথা।তখন আমি অনার্স ফাইনাল বর্ষে।ময়নামতির লোকাল হওয়ার প্রায়সময় কুমিল্লা শহরে যাওয়াআসা।তখন আবার পার্টটাইম একটা কিন্ডারগার্টেনের ইংলিশ টিচার ছিলাম।একদিন সব শিক্ষক আর ছাত্র-ছাত্রী কোটবাড়ি বনভোজনে গিয়েছিলাম…

-থেমে গেলে কেন?
-বলছি আগে আমার বুকে মাথা রেখে শুয়ে বাকিটা শুনবে?
আর কোনোকথা না বলে হিমু আমার বুকের উপর মাথা রাখল।
আমি আবার বলতে লাগলাম
সেদিন বৌদ্ধ বিহারে মোটামুটি ফর্সা দেখতে একটা দশ-বারো বছর বয়সী একটা ছেলে এসে বলল স্যার ফুল এগুন নিবেন নি?

লালমাই-বিজরার দিকে অনেকটা নোয়াখালীর ভাষা ইউজ হয় তাই ভাবলাম ছেলেটা ওদিকের হতে পারে।ভাষা থেকে এতোখানি অন্তত বুঝা যায়।তাছাড়া লাকসাম,মনোহরগঞ্জ,বিজয়পুর ছাড়াও কুমিল্লার আরও কয়েকটা অঞ্চলে নোয়াখালীর ভাষার ব্যবহার ব্যাপক।

যদিও ফুল দেয়ার মতো এমন কেউ আমার ছিল না তবুও বললাম কত এগুলো?
-স্যার আন্নে আশি টেয়া দেন।
পকেট থেকে একশ টাকার নোট দিতেই ছেলেটা খুচরো বিশ টাকা দিতে লাগলো।
-এটা তুমি রেখে দাও।

-আন্নেরে অনেক ধইন্যবাদ স্যার।আড় ছোড বইনডার লাই আইজ্জা দুধ কিনি লই যাইয়ুম।
-তোর ছোট বোন আছে বুঝি?
-হ’ স্যার।
-তো তোর মা-বাবা কি করে?
-জানিনা স্যার।আড় বুঝ অনের হর আড় মা-বাফরে দেইনো!
-মা-বাপকে দেখিস নাই মানে?

-দেইনো মানে আই জানিনা আড় মা-বাফ কেগা!আইতো লালমাই পাহাড়ের ঢালে থাইন্না এক চাচার লগে হাত্রে হাত্রে বদিল্লা দিতাম আর হেবেডার কাছে থাইকতাম।আবার কোনোদিন ভিক্কাও কইচ্ছি!গেছে শীতে হেবেডা মরি যায় আর আই হেঘরো থাই একলা একলা।

-কিন্তু বোন কোথা থেকে এলো?

-হিজ্ঞারে আই হাইছিলাম পাহাড়ের ধারে এককান গাছের তলে আরো কদিন আগে।কেগা মনেঅয় হালাই থুই গেছে।আই চিন্তা কইরলাম ইজ্ঞা কোনায় যাইবো!কেন্নে বাইছবো!আড়েওতো ছোডকালে কেগা ডাস্টবিনের ধারে রাই গেছিলো যে চাচার লগে আছিলাম হেমিয়া কইছে আড়ে ডাস্টবিনের ধারে হাইছে!জানিনা আড় মতো এদেশো আরো কত হোলাইন আছে!

-তোর নাম কি?
-চাচায় আড়ে মতি কই বোলাইতো।
-আমি যদি তোকে কিরণ বলে ডাকি?
-আন্নে যেডা ইচ্ছা বোলাইতে হারেন।
-আচ্ছা তুই লালমাই থেকে কোটবাড়ি আসিস কিভাবে?
-ট্রাক-পিকাপের হিছেদি ঝুলি।
-আচ্ছা চল তোর বোনকে দেখতে যাবো।
-হাছা কইছেন নি স্যার?
-হুম সত্যি।

স্কুলের হেড স্যারকে বলে দিলাম আপনারা চলে যান আমার একটা কাজ আছে।তারপর আমি ওই ছেলেটার সাথে গেলাম।কোনোরকম ছনের ছাউনি দিয়ে গড়া একটা ঘর।পুরাতন হয়ে গেছে।

-স্যার এডা আড় গর!
-ও আচ্ছা।তোর বোন কোথায়?
-ওই হিয়ানো!(মেঝেতে একটা শীতলপাটিতে শোয়ানো)
দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটার বয়স একবছর ছুঁই ছুঁই!আমি গিয়ে ওকে কোলে তুলে নিলাম।আর ঘুম ভেঙ্গেগেলো মেয়েটার।

জানিনা মেয়েটাকে কে ওভাবে কেনো ফেলে রেখে গিয়েছিল!পাষাণ হৃদয়ের কোনো মানুষ না হলে কেউ এটা করতেই পারে না।কত কিউট আর মায়াবী ওই চাঁদ মুখটা।

-ওকে এখানে রেখে গেছিলি কেনো?
-ইজ্ঞার ধারে ওই হেবাইড় ওজ্ঞা চাচি আছিল।মনেঅয় ইজ্ঞা ঘুমাইযানের হর হেতাই থুই গেছে অইবো।
-তা ওকে ওদের বাড়িতে রাখলেই তো পারিস।
-চাচি চাইলেও নিতো হারে না হেতাগো অভাবের সংসার নিজেরাই দুইবেলা টানাটানি করি চলে।
-আচ্ছা।নাম কি ওর?
-আই ময়না কই বোলাই।
-আমি নয়নতারা বলে ডাকলে তোর অসুবিধা হবে কিরণ?
-না স্যার আঙ্গরে যে নামে বোলায় হেডাই আঙ্গ নাম!

কোলে থাকা মেয়েটার মায়ায় পড়ে যাচ্ছিলাম,কেমন করে তাকিয়ে আছে অপলক!তাই কিরণের কোলে দিয়ে একটা হাজার টাকার নোট বের করে দিয়ে বললাম এটা রাখ।নয়নতারার জন্য দুধ কিনে দিস।

-ধইন্যবাদ স্যার!
-আর আমি এখানে মাঝেমধ্যে আসবো কিন্তু।
-আইচ্ছা ঠিকাছে।

তারপর চলে আসতে রওনা দিলাম আর পিছন থেকে কে যেনো শার্ট টেনে ধরল।পিছনে তাকাতে দেখি নয়নতারা তার ছোট হাত দিয়ে শার্টের নিচেরভাগ শক্ত করে ধরে আছে!আর কেমন করে তাকিয়ে আছে।কথা বলতে পারলে মনে হয় বলেই ফেলতো আমাকে ছেড়ে যেয়ো না!এতো ছোট মেয়ে কি করে এতো ভালোবাসা বুঝতে পারে!আমি ওর হাত ছাড়িয়ে দিয়ে চলে আসি আর রাস্তায় উঠতেই ওই ফুটফুটে মেয়েটাকে ফেলে আসাতে মন মানছিল না।বুকের মধ্যে চিনচিন ব্যথা করছিল।নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি ঝরছিল। কিন্তু ওই পাষাণ মা-বাবাগুলা কি করে করতে পারলো এটা!

তাই কিছু না ভেবে আবার ছুটে গেলাম।আর দেখলাম কিরণ ঠিক ওভাবেই দাঁড়িয়ে আছে আর চোখ থেকে অশ্রু ঝর্ণা বইছে!

-একটা কথা বলতে এসেছি কিরণ।
-কিতা স্যার?
-আমি নয়নতারাকে আমার বাড়ি নিয়ে যাবো?
-আন্নে সত্যি নিবেন স্যার?
-হুম।তোর কিছু না থাকা সত্ত্বেও যদি তুই ভালোবেসে ওকে কাছে টেনে নিতে পারিস কোনো কিছু না ভেবেই!তাহলে আমি কেনো পারবো না!পৃথিবীর সবাই পাষাণ মানব হলে সৃষ্টি চলবে কি করে!আজ থেকে ও আমার মেয়ে।
-স্যার আন্নে মানুষ না আল্লাহ্‌র দরবারেরতুন আইন্না এক ফেরেশতা!

আমি ভাবছি মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছি ছেলেটা কত খুশি আর তার নিজের জন্য বুঝি একটুও আপসোস হচ্ছে না!ছেলেটার মনটাও তো ছোট হয়ে যাবে।তাই সেদিন নয়নের সাথে কিরণকেও নিয়ে এসেছিলাম।কিরণকে একটা কিন্ডারগার্ডেনে (প্লে-অষ্টম) আবাসিক ডিপার্টমেন্টের আওতায় ভর্তি করিয়ে দেই ও এখন সেখানে আছে।প্রতি দুই সপ্তাহ অন্তর ও এখানে এসে আমার সাথে দেখা করে যায়।আজকে ও আছে কিরণ পাশের রুমে।আর তখন থেকেই নয়ন আমার মেয়ে।এবার তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যেতে পারো।আমার সাথে সংসার না করলেও আমার আফসোস নাই।আমার আগে কোন স্ত্রী ছিল না।আর সৃষ্টিকর্তা হয়তো আমার কাছেই নয়নকে পাঠিয়েছে।অপেক্ষা ছিল শুধু ওইদিনটার।

-আমি তোমার নয়নের মা হতে চাই।তুমি কি এই সুযোগটা দিবে আমায়?(আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে)
-সত্যি?
-হুম।বাবা বলেছিলো হাসিব ছেলেটার মতো ছেলে লাখে একটা হয়।এখন আমি বলবো তোমার মতো স্বামী কোটি মেয়ের মধ্যে একজনের ভাগ্য জোটে আর আমি সেই একজন ভাগ্যবতী!
তারপর ও নয়নের কপালে ছোট্ট করে একটা ভালোবাসার পরশ এঁকে দিয়ে বলল কিরণ কি করতেছে?
-এতোক্ষণে হয়তো ঘুমিয়ে যাওয়ার কথা।
-চলো ওকে একনজর দেখে আসি।
-হুম চলো।
পাঁচদিন পর।ঠিক এদিনেই আমি নয়ন-কিরণকে পেয়েছিলাম।তাই প্রতিবছর এদিনেই দুজনের জন্মদিন পালন করি।
এবারের কেক তোমাদের মায়ের সাথে কাটবে।
-ওকে পাপা।
তারপর কেক কাটা হয়ে গেলে।
-পাপা তুমি মাম্মামকে আমার জন্য ফিরিয়ে এনেছ?তুমি না বলতে মাম্মাম আমার ছোট বেলায় অভিমান করে চলে গেছে?অভিমান অনেক পঁচা জিনিশ।
-হুম নয়ন অভিমান অনেক পঁচা।তাই তো তোমার মাম্মাম সব অভিমান ভুলে চলে এসেছে।
-হুম এইতো তোমাদের মা চলে এসেছে।এই তোমার পাপাকে ছুঁয়ে বলছি আর কখনো তোমাদের ছেড়ে যাবো না।
-সত্যিতো?
-হুম সত্যি।

তারপর কিরণ আমাকে আর নয়ন ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বললো আই লাভ ইউ পাপা।আই লাভ ইউ মাম্মাম।
এখন কিরণ আর নোয়াখালীর আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে না।শুদ্ধ আর মার্জিত ভাষায় কথা বলে।
সবশেষে দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভেতর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এলো আজকের দিনে ময়না-মতিদের কেউ কাছে টেনে নেয়া তো দূরের কথা ওদের জন্য কারোর গাড়ীর উইন্ডোগ্লাস পর্যন্ত খোলা হয়না।ওইটা তোমাদের বুলেট প্রুফ কার হতে পারে কিন্তু অভিশাপ প্রুফ নয়!অভিশাপ মুখে দিতে হয় না,মন থেকেই লেগে যায়! মানবতা আজ হাজার প্রশ্নের মুখোমুখি থাকলেও জবাব নিরউত্তর!

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

আরও গল্প

সর্বাধিক পঠিত