অপূর্ণ ইচ্ছা

অপূর্ণ ইচ্ছা

–মৃদু ?
–হু।
–ঘুমিয়ে পড়েছো ?
–হু।
–গল্প শেষ ?
–হু।

–কি হু হু করছো কখন থেকে,ঘুমিয়ে পড়েছো তুমি,কথাটি বলেই শয়ন মৃদু কে ওর বুক থেকে বালিশে দিতে লাগলো তখনি মৃদু আবারো শয়নকে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে ওর বুকে ভালভাবে মাথা রাখলো।শয়ন আর পারলো না মৃদু কে বুক থেকে সরাতে।মৃদুর খোলা চুল গুলো বাতাসে এলোমেলো হয়ে উড়ে শয়নের মুখে এসে পড়ছিলো,কেমন জানি একটা নেশা নেশা ঘ্রাণ মৃদুর চুলে যা শয়নকে ঘোড় লাগাতে বাধ্য করছে।ছাঁদে ওরা শুয়ে আছে খোলা আকাশের নিচে।চাঁদের আলো মৃদুর মুখে পড়ছে।অসম্ভব রকমের মায়াবী লাগছে মৃদুর মুখ খানি।চাঁদের আলোয় মৃদুর নিষ্পাপ মুখ খানি উজ্জল হয়ে উঠেছে।মৃদু কেঁদেছে,চোখের কোনে এখনো বিন্দু বিন্দু জল জমে আছে।শয়ন মৃদুর চোখের জল মুছে দিয়ে কপালে আলতো করে একটা চুমু দিয়ে মৃদুকে জড়িয়ে ধরে ঘুমিয়ে পড়লো।

আজ প্রায় অর্ধেক রাত ধরে মৃদু শয়ন কে গল্প শুনিয়েছে,ওদের রাজকুমারির।শুধু আজই না রোজ রাতেই মৃদুর এই পাগলামি গুলো শয়ন কে মেনে নিতে হয়। মৃদু সবসময় শয়ন এর সাথে পাগলামি করে তবে সেটা সুখের নয় অত্যন্ত কষ্টের,যন্ত্রনার।মৃদু প্রায় পুরোটাই পাগল হয়ে গেছে।এমনটা সে ছিলো না। অনেক দুষ্টু,হাঁসি,খুশি চঞ্চল একটা মেয়ে ছিলো।কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে আজ সে পাগলের তালিকাভুক্ত।ভাগ্য তার কাছে থেকে কেড়ে নিয়েছে সুখকড় মুহুর্তগুলো।তার জিবনটা অভিশপ্ত করে তুলেছে।সে অনেক কিছু হাড়িয়েছে সেদিন।সেদিনের একটু অসাবধনতা তার জিবনটাকে নরক করে তুলেছে,কেড়ে নিয়েছে অনেক কিছু।

ভালবেসে বিয়ে করেছিলো শয়ন আর মৃদু। দুজনের প্রতি দুজনের ভালবাসার কোনো কমতি ছিলো না।দুজনের ভালবাসাময় সুখের জিবন কাটাতে লাগলো।একবছর পর মৃদু গর্ভবতী হলো।দুজন ভালবাসার মানুষের কোল আলো করে আসছে একটা সন্তান। দুজনেই খুব খুশি।কিন্তু ভাগ্য হয়তো মৃদু আর শয়নের বিপরীতে ছিলো।তাইতো সেদিন তারা তাদের ভালবাসার অস্তিত্ব আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ উপহার টাকে পৃথিবীতে নিয়ে আসতে পারলো না। অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে গেলো। আচমকা একটা ঘটনা সবকিছু কেড়ে নিলো।৮ মাস গর্ভাবস্থায় ব্যাথরুম সাবানের পানিতে পিচ্ছল

হয়ে থাকায় মৃদু পা পিছলে পড়ে যায়।তারপর ওর প্রচুর ব্লিডিং শুরু হয়।হাসপাতালে গিয়ে অপারেশন করে মৃদুর গর্ভ থেকে মৃত সন্তান বের করা হয়।এ পর্যায়ে মৃদুকে বেঁচে গেলেও সে সন্তান ধারনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলে।
অনেকটা সময় সেন্সলেস অবস্থায় থাকার পর মৃদু জ্ঞান ফিরে সুস্থ স্বাভাবিক হয়ে যখন জানতে পারে ওর সন্তানটি নেই আর সে কখনো মা হতে পারবে না তখন সে খুব শকড হয়।যার প্রভাবে আজ সে পাগল,তবে সে শুধু মা ডাকের পাগল।একটা সন্তান পেলেই মা ডাক শুনলেই তার পাগলামো শেষ হয়ে যাবে।মৃদুর এমন অক্ষমতা,পাগলামিএইসবকিছুর জন্য শয়নের পরিবার শয়নকে বার বার বোঝায়।

–দেখ বাবা, তোর একটা জিবন আছে।এভাবে আর কতোদিন?

–আর কি কত দিন মা,জিবন আছে মানে কি, এটা কি আমার জিবন নয়?

–হ্যাঁ বাবা এটাও তোর জিবন,কিন্তু সুখের নয়।মৃদু তোকে সুখ দিতে পারেনি,সন্তান দিতে পারেনি,বাবা ডাকটা তোকে সে কখনোই শোনাতে পারবে না।ওতো একটা পাগল আর সন্তান দিতে অক্ষম মৃদু।

–মৃদু পাগল নয় মা।ওর সাথে যা কিছু হয়েছে তাতে মানুষ স্বাভাবিক ভাবে থাকতে পারবে না।আর কে বলেছে মা তোমায় মৃদু আমায় সুখি করতে পারেনি,যথেষ্ঠ সুখি আমি।মৃদুকপ নিয়েই আমি সুখু।সন্তান চাই না আমার।আমি শুধু মৃদুকে চাই।

–কিন্তু আমরা নাতী চাই।মৃদুকে ছেড়ে দে তুই।আমরা তোকে আবার বিয়ে করাবো,বিয়ে করে নতুন করে জিবন শুরু কর তুই।

–মা তুমি এ কথা কিভাবে বলতে পারো।এতোটা স্বার্থপর মানুষ কি করে হয়।আজ তুমি মৃদু কে ছেড়ে আমায় অন্য কাউকে বিয়ে করার কথা বলছো।একবারও কি ভেবেছো মৃদুর জায়গা টা যদি আমাদের ইরার হতো,ও যদি সন্তান জন্মদিতে অক্ষম হতো ওর বর যদি ওকে ছেড়ে দিতো তাহলে কেমন হতো মা,আমাদের ওপর কতটা অশান্তি নেমে আসতো তা তুমি ভেবে দেখেছো।তেমনটাই ওর পরিবারের সাথে হতো।আর সবচাইতে বড় কথা হলো আমি মৃদুর পৃথিবী, বেঁচে থাকার আশা।আমাকে আকঁড়ে ধরেই ও বেঁচে আছে।তা না হলে এতোদিনে ও এই পৃথিবীতে থাকতো না

আর মৃদু কে ছাড়া আমিও থাকতে পারতাম না।কথা গুলো বলেই শয়ন বাড়ি থেকে চলে গেলো।বাড়ির পাশের দোকানে টঙে বসে ভাবছে,আমাদের এই সমাজ এমন কেন,এতো স্বার্থপর কেন।একটি মেয়ে যদি সন্তান ধারনের অক্ষম হয় তাহলে তাকে সবাই কু-দৃষ্টি নিক্ষেপ করে,অবহেলা করে।কথা শোনায়, বর তাকে ডিভোর্স দেয়,অন্য কাউকে বিয়ে করে।কিন্তু কেন,মেয়েটার কি দোষ এতে।এটা তার ভাগ্য,ভাগ্যের ওপরতো কারো হাত নেই।আর

সমস্যা কি শুধু মেয়েদের থাকেই ছেলেদেরও থাকে।অনেক ছেলেই তো আছে যারা সন্তান জন্ম দিতে অক্ষম কই তখন তো তাদের স্ত্রী তাদের ছেড়ে যায় না।মা ডাক থেকে বঞ্চিত হয়েই পড়ে থাকে স্বামীর ঘরে।সন্তানের কথা মুখে পর্যন্ত নিয়ে আসে না তার স্বামী কষ্ট পাবে,লজ্জা পাবে বলে,,আর মেয়েদের সাথে কেন এতো অবিচার করা হয়।সন্তান আল্লাহ প্রদত্ত শ্রেষ্ঠ উপহার।কেউ যদি সেই উপহার থেকে বঞ্চিত হয় তবে এটা শুধুই তার ভাগ্যের কারনে এতে তার কোন হাত নেই মানুষ কেন এটা বোঝে না।এইসব ভাবতেই চা ওয়লা শয়নের সামনে চায়ের কাপ দিয়ে বললো,,

— কি খবর শয়ন ভাই,চা টা নিবে তো নাকি?

— হুম দিন।চায়ের কাপ টা হাতে নিয়ে চুমুক দিলো সে,কিন্তু আজ সে চায়ের কোনো স্বাদই পাচ্ছে না,রহিম চাচা এতো ভালো চা করে কিন্তু আজ কেন জানি পানসে লাগছে তার চা।মন ভালো না থাকলে কিছুই ভালো লাগে না।

–শয়ন ভাই কি হয়েছে গো তোমার, তখন থেকে খেয়াল করে দেখছি তুমি এসে সেই কখন থেকে আনমনে কি যেনো ভেবে চলেছো,কথাও বলছো না কি হয়েছে বলোতো দেখি।

–কই না কিছু না কথাটি বলতেই বাড়ি থেকে চেঁচামেচির আওয়াজ শুনতে পেলো।মৃদু বোধ হয় জেগে গেছে এইসব ভেবেই শয়ন চা পুরোটা শেষ না করেই বাড়ির দিকে গেলো।গিয়ে দেখে মৃদু ফ্লোরে পড়ে আছে।টেবিলের কাছেই।মাথাটা অনেকখানি কেটে রক্ত বের হচ্ছে।শয়ন কে দেখেই ছোটদের মতো ছুটে এসে ওর বুকে মুখ লুকিয়ে কাঁদতে লাগলো,আর ইশারায় ইরার দিকে আঙুল দিয়ে বোঝাতে লাগলো ইরা ওকে ফেলে দিয়েছে।শয়নের রাগ মাথায় উঠে গেলো।

— ইরা কি মৃদুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছিস কেন?

— তো কি করবো,তোর বউ তো একটা পাগল সকাল বেলা উঠেই চিৎকার চেঁচামেচি, জিনিষ ভাঙ্গা শুরু করেছে।

আমি আটকাতে আসতেই ঐ ফুলদানী নিয়ে তেঁড়ে আসছে আমার দিকে তাই আমি ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছি।

— তুই ফেলবি কেন ওকে তোরা কি মানুষ,জানিস না মেয়ে টা অসুস্থ?

–জানি কিন্তু ওকে না আটকালে আমাদেরই মারতো।

— ও কখনো তোদের কাছে মারতে গেছে,নাকি তোরাই এসে ওকে ক্ষেপিয়ে দেস,আর ও চেঁচামেচি করছে করুক না

তোকে আসতে কে বলেছে,জানিস তো ঘুম থেকে উঠে আমায় না দেখতে পেলে মৃদু এমন করে।তারপরো তোরা এমন করিস।তোরা ওকে ভাল থাকতে দিবি না আমাকেও না।বলে মৃদুকে বুকের ভিতর জরিয়ে রাখলো,মৃদুও চুপটি করে লক্ষি মেয়ের মতো থাকলো।

–তোর বউ আমাদের ভালো থাকতে দেবে না,এই মেয়েকে আমি এই বাড়ি রাখবো না,ওকে পাগলাগারদে দিয়ে আসবি তুই তারপর তোকে আমরা বিয়ে করাবো।আমরা নাতী চাই,দাদী ডাক চাই,,শয়নের মা বললো।

–এটা কখনো সম্ভব না মা,আমি মৃদুকে ছাড়বো না কখনো।

— তাহলে তুইও শুনে রাখ, আজ থেকে আর কোনো জায়গা নেই এই মেয়ে র এই বাড়িতে বলেই শয়নের মা শয়নের রুম থেকে মৃদুর সব কাপড় সামনে এনে ফেলে দিলো।

— ঠিক আছে না থাকুক কোন জায়গা,আমিও থাকছি না এই বাড়িতে,তোমাদের যখন এতোই সমস্যা মৃদুকে নিয়ে তাহলে আমি মৃদুকে নিয়ে এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছি।বলেই মৃদুকে নিয়ে আর একমুহুর্ত দেরী করলো না শয়ন।বাড়ি থেকে বেরিয়ে ছুটে চললো অজানার উদ্দেশ্য ভালবাসায় পরিপুর্ন দুটি মন।রিক্সায় পাশাপাশি বসে আছে শয়ন আর মৃদু।মৃদু শয়নের কাধে মাথা রেখে আছে।শয়ন মৃদুর কপালে একটা চুমু দিয়ে মনে মনে বলতে লাগলো নাইবা থাকলো ভাগ্যে আল্লাহর উপহার,নাইবা হলাম বাবা।নাইবা পুর্ন হলো বাবা ডাকের অপুর্ণ ইচ্ছা

তারপরো ভাল আছি আমার পাগলি বউ কে নিয়ে, ভালবাসি আমার পাগলি বউকে বলেই একহাতে মৃদু কে শক্ত করে জড়িয়ে নিলো শয়ন।

ভালো থাকুক প্রত্যেকটা ভালবাসার মানুষ,মুছে যাক তাদের হৃদয়ের যত কষ্ট যন্ত্রণা।

গল্পের বিষয়:
ভালবাসা
DMCA.com Protection Status
loading...

Share This Post

সর্বাধিক পঠিত